‘সে-সত্য জানার আগে মিলনের মুহূর্ত ফুরাল’! (দ্বিতীয় পর্ব)

আবেদীন কাদেরআবেদীন কাদের
Published : 12 July 2021, 09:40 AM
Updated : 12 July 2021, 09:40 AM


আলোকচিত্রে বাকি থেকে কথাসাহিত্যিক কাজী হাবীব ও কবি জাহিদ হায়দার

দেখতে দেখতে সপ্তাহটা কেটে গেল, আমার ছুটি শেষ। এমন দ্রুত সময় বহুদিন কাটেনি। কেমন এক ঘোর আর আনন্দের মধ্যে কেটে গেল সময়টা। ফিরে যাবার কথা ভাবতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বশীরকে বললাম, 'দোস্ত, যেতে মন চায় না, আবার সেই মফঃস্বলে বসে বসে অলস দিন কাটানো, এদিকে বন্ধুরা কত আনন্দে উত্তেজনায় দিন কাটাচ্ছে। ফিরে আসবো কিনা ভাবছি!' বশীর বলল, 'চলে আয়।' কিন্তু আমি ভাবলাম চলবে কী করে, থাকবো কোথায়, খাব কী! যেহেতু চাকুরী করা একেবারে ধাতে নেই, তাই শুধু টুইশানি করে দিন চালানো কঠিন, তাছাড়া দুটো ভাই কলেজে। এক রকম বিষণ্ণ এক মন নিয়েই চরমুগরিয়া ফিরলাম। কাজী হাবীবের সঙ্গে চিঠিতে আমার এই দুশ্চিন্তার কথা বিনিময় করি। রাতে কলেজের অধ্যাপকদের বাড়ির আঙিনার অন্ধকারে জোনাকির ছেড়া ছেড়া আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনি, মনটা কাতর হয়ে ওঠে ঢাকার জন্য। অন্যদিকে মায়ের কাছাকাছি আছি এখানে, চাইলে ঘণ্টা তিন চারেকের মধ্যে গিয়ে থেকে আসতে পারি এক দুইদিন, সামান্য হলেও মার হাতে মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে পারি ছোট ভাই দুটির জন্য পাঠাতে। কেন জানি না এই প্রথম জীবনে আমি বড় দোলাচলের মধ্যে পড়লাম! আমার ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমি একটা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি। বিষয়টা চিঠিতে বশীর ছাড়া আর মাত্র এক দুজন বন্ধুর সঙ্গে বলে হালকা হতে পেরেছি। একদিন ভাবলাম ওসমান যেহেতু আমার ছেলেবেলার বন্ধু এবং ভীষণ হৃদয়বান মানুষ, ওঁকে লিখি, কী করা যায় বিষয়টি জানতে চেয়ে। লেখার কয়েকদিনের মধ্যেই ওসমানের কাছ থেকে উত্তর এলো। জানালেন, বছর খানেক বা আট নয় মাস থাকার কোন অসুবিধা নেই, টিচার্স ট্রেনিং কলেজে তাঁর রুমেই হই হই করে কাটানো যাবে, তাছাড়া টুইশানির চেষ্টা করা যাবে। ঢাকায় চাকুরীর চেষ্টাও করা যেতে পারে। আমি তাকে বলিনি, চাকুরী আমি করতে চাইনা, টুইশানি আর লেখার চেষ্টা করবো, এটাই সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু টুইশানি করে নিজে চলা যাবে, কিন্তু ছোট ভাইকে বা বাড়িতে তেমন কিছু দেয়া যাবে না। একটু দুশ্চিন্তা হল, কিন্তু দিন কয় ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, চলেই যাই, পরে না হয় দুচার মাস পর ফিরে আসা যাবে আবার চরমুগরিয়ায়। প্রিন্সিপাল সাত্তার সাহেবকে জানালাম, আমার ঢাকা যেতে হবে মাস দুই তিনেকের জন্য। তিনি একটু দুশ্চিন্তায় পড়লেন, কিন্তু যেহেতু জানতেন ওখানে কোন ইংরেজির শিক্ষকরা হয়তো বেশিদিন থাকবে না, তাই তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন, 'আমাদের কলেজের ইন্সপেকশন আছে শিগগীর, এর ওপর নির্ভর করছে বোর্ডের আপ্প্রুভাল, আপনি যদি পারেন ইন্সপেকশনের সময়টা এখানে থাকেন, খুব ভাল হয়।' আমি সহজেই রাজী হয়ে জানালাম, 'ইন্সপেকশনের সময় জানাবেন, আমি এসে কয়েকদিন থেকে যাব।' সাত্তার সাহেব রাজী হলেন, তবে কলেজ কমিটিকে তেমন কিছু জানাবেন না বললেন। আমি পরের মাসের মাহিনা পেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। পথে মেজো চাচীর সঙ্গে দেখা করলাম মাদারীপুরে। ঘণ্টা কয়েক আগে গিয়ে দুপুরে চাচীর কাছে বসে খেলাম, বাড়ি নিয়ে অনেক কথাবার্তা বললাম, আর জানালাম যে ঢাকায় কিছু একটা করতে পারলে এখানে আর আসবো না। চাচীর মন খারাপ হল। তেমন দেখা হয় না, কিন্তু আধা ঘণ্টার দূরত্বে ছিলাম সেটা হয়তো তাঁর ভাল লাগতো। মেজো কাকার সঙ্গে আবার বাবার সম্পর্ক ঠিক ভাইয়ের মত নয়, তার অধিক। তাঁরা দুই ভাই একেবারে পিঠাপিঠি আপন চাচাতো ভাই, কিন্তু একান্নবর্তী পরিবার বলে আপন ভাইয়ের মত বেড়ে উঠেছেন শিশুকাল থেকে। বাড়িতে প্রথম দুজন স্কুলে গিয়েছেন, শিক্ষিত হয়েছেন, কাকা এসডিও অফিসে কেরানীর চাকুরী নিয়েছেন ব্রিটিশ ভারতে, বাবা স্কুল শিক্ষকতা নিয়ে দাদার জমিজমা দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু এই দুই ভাইয়ের মধ্যে অসাধারণ একটা বন্ধন গড়ে উঠেছিল সারা জীবনের জন্য! সেটা বাড়িতে যেমন সবাই জানতো, আমার দুই দাদা দাদী, এমনকি মাও জানতেন। কাকার বেতনে তাঁর সংসার ভালোই চলতো, কিন্তু বাবা আর বড় কাকা ধান ওঠার পর প্রতি বছর কয়েক মন বাড়ির ক্ষেতের চাল, মুসরির ডাল বা সরিষার তেল কাকার জন্য পাঠাতেন। এছাড়া বাবা মাদারীপুর গেলে এক গাদা নারিকেল বা অন্যান্য ফল দাদী কাকার জন্য দিয়ে দিতেন। আমাদের হাতেও দিতেন। কাকার ডাক নাম ছিল রূপাই। কেন জানি না, বাড়িতে আমার বাবা যার ডাক নাম জনু, আর মেজো কাকা রূপাই ছিলেন সবার চোখের মনি, বিশেষ করে দাদা দাদীদের কাছে। তাই আমি নিজেও ছেলেবেলায় কাকার খুব স্নেহ পেয়েছি। খুব কোমল স্বভাবের এবং দেখতে ফর্সা সুদর্শন ছিলেন মেজো কাকা। বাড়িতে আমাদের ছোটদের প্রতি ছিল তাঁর অপার স্নেহ। মাস কয়েক পর পরই বাড়িতে এসে দুতিন দিন থেকে যেতেন। ধবধবে শাদা পায়জামা ও ফুল হাতা জামা পরতেন, পায়ে দামী চামড়ার জুতো। সব সময় কাঁচি মার্কা সিগারেট খেতেন। দুধে আলতা গায়ের রঙ ছিল কাকার। খেতে পছন্দ করতেন। মাদারীপুরের বাসায় তাই সব সময় খুব খাবার রান্না হত, বাড়িতে এলেই দাদীরা খুব পিঠা বানাতেন আর ভাল খাবার রান্না করতেন কাকার জন্য! চাচীর পাশে বসে খেতে খেতে সেদিন খুব মন খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমার লঞ্চঘাটে যাওয়ার আগে কাকা অফিস থেকে ফিরে এলেন, চাচী আমার যাওয়ার কথা বলতে কাকা খুশী হলেন, বললেন, 'সরকারী চাকুরীর জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও। এখানে থাকা ঠিক হবে না।'

মেজো কাকা ও চাচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বাড়ির পাশেই লঞ্চঘাটে গিয়ে সন্ধ্যার আগে লঞ্চে উঠলাম। রাত দশটার দিকে আমাদের বাড়ির ঘাটে লঞ্চ থামলো, আমি নেমে বাড়িতে গেলাম। মা শুয়ে পড়ছিলেন, আমি গেলে হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে ভাত গরম করে খেতে দিলেন। আমি বললাম ঢাকা যাব, তাই দুয়েকদিন থেকে যাই! খেয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এক অজানা আশঙ্কা এবং অনিশ্চয়তায় নিজেকে সপ দিচ্ছি এমন একটা দুশ্চিন্তা মনের মধ্যে কাজ করছিল। এর আগে কোনদিন আমার এমন দুশ্চিন্তা হয়নি। কেন জানি না দ্বিধাদীর্ণতা আমার ভেতরটাকে কিছুটা রক্তাক্ত করছিল। এই প্রথম মনে হল আমি বোধ হয়, জীবনের কোন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি!
মার সঙ্গে দিন তিনেক থেকে ঢাকায় রওয়ানা দিলাম। ঢাকায় গিয়ে উঠলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হোস্টেলে, বেলা তিনটার দিক, সুবল আর ওসমান পাশাপাশি রুমে তিন তলায়। আমাকে দেখে সবাই হই হই করে উঠলো আনন্দে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজেই সুবল আর ওসমানের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। যদিও বাংলা এবং ইংরেজিতে দুজন একই বছরে আমার সঙ্গে এম এ করেছেন, কিন্তু আগে বন্ধুত্ব ছিল না। আমি চিঠি দুয়েছি দুজনকে, সেই থেকে তাঁরা ঘনিষ্ঠ। তাছাড়া ওঁদের দুজন এতো অসাধারণ মানুষ, সহজেই বন্ধু হয়ে গেছেন। আমি ওসমানের রুমে একটি খালি সিটে পাকাপাকি আশ্রয় নিলাম। সারাদিন বই পড়ি, বিকেলে শান্তিনগরে 'বিপক্ষে'র আড্ডায় যাই। সেখানে নতুন পরিচয় হয় মানিক ও বশীর এবং জুবেরী জাহিদদের পুরনো অনুজ প্রতিম বন্ধু পিউর সঙ্গে। পিউ এক আশ্চর্য চরিত্র। ক্যানাডার একটি কন্সালটিং ফার্মে কাজ করে। এই ফার্মটির নাম ছিল 'নর্থ ওয়েস্ট' কোম্পানি। এরা বাংলাদেশে নদী বিষয়ক বিদেশী সাহায্যের প্রকল্পগুলোতে কন্সালটিং -এর কাজ করতো। পিউর বাবা ছিলেন ওয়াপদার প্রধান প্রকৌশলী। সম্ভবত তাঁর মাধ্যমে চাকুরীটি পিউ পেয়েছিল। পিউ মেধাবী, ভীষণ বন্ধুবৎসল, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় তার মন ছিল না। রামপুরা রাস্তার ওপর পিউ এবং মানিকদের বাড়ি প্রায় মুখোমুখি। ওঁরা ছেলেবেলা থেকে হরিহর আত্মা। পিউ সন্ধ্যায় দপ্তরের গাড়িতে 'বিপক্ষে' অফিসে চলে আসে। এরপর সেখানে আড্ডা শেষ হলে টি এন্ড টির মোড়ে দুখুর দোকানে আবার প্রায় মধ্যরাত অবধি আড্ডা। এসময়ে বশীর ও জুবেরীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নাজমুল জার্মানি থেকে ফিরে আসে। অনার্স পরীক্ষা না দিয়ে নাজমুল জার্মানি চলে গিয়েছিল, সেখানে বছর পাঁচেক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখে দেশে ফিরেছে। কবিতা লেখে। স্বল্পভাষী, সুদর্শন। বন্ধু অন্তপ্রাণ মানুষ। গ্রীনরোড রাজা বাজারে বাসা নিয়েছে। সঙ্গে বড় ভাই ভাবী থাকে। কিছু একটা ব্যবসা করার চিন্তা করছে। সম্ভবত নওগাঁ বাড়ি, বেশ ধনী পরিবারের ছেলে। নাজমুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় সহজেই। নাজমুল আমাকে বলে শান্তিনগর যাওয়ার সময় ওঁর বাসা হয়ে যেতে। তাই বিকেলে নাজমুলের ওখানে আমি হেঁটে হেঁটে চলে যাই টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে, তারপর নাজমূলকে দিবানিদ্রা থেকে তুলে চা বিস্কুট খেয়ে দুজনে চলে যাই শান্তিনগর। সারাদিন হোস্টেলে বসে দরোজা বন্ধ করে 'বিপক্ষে'র জন্য প্রবন্ধটা লেখার চেষ্টা করি। বন্ধুদের কাছ থেকে এবং ভারতীয় তথ্যকেন্দ্রের লাইব্রেরি থেকে প্রয়োজনীয় বই এনে স্তূপাকার করে রেখেছি হোস্টেলের রুমে। পড়ছি, নোট নিচ্ছি আর একটু একটু করে লিখছি। এম এ পরীক্ষার পর সত্যিকার পরিশ্রম করে এই প্রথম একটা প্রবন্ধ দাঁড় করানোর চেষ্টা আমার। কিন্তু হোস্টেলে দুপুরে ক্লাস শেষ করে এলে সুবল আর ওসমান ও তাদের বেশ কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার আগে পরে অনেকটা হুল্লোড় হয়। ওসমান আমাদের দশ বছর আগের ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলের মতোই এখানেও খুব জনপ্রিয় এবং ডাইনিং রুমে খুব প্রভাবশালী। তাই আমার খাওয়া ছাত্রদের মেসের সঙ্গেই ব্যবস্থা হল, শুধু টাকাটা ছাত্রদের মতো দিতে হত, তাতে আমার হোটেলে আর খেতে হয় না, আমি বেশ নিশ্চিন্ত। সুবলের মাধ্যমে দুটো টুইশানি জোগাড় হয়ে গেল, যদিও পল্লবী এবং মিরপুরে। কিন্তু আমি সপ্তাহান্তে ছুটির সময় পড়াবো দীর্ঘ সময় ধরে, তাই কোন অসুবিধা হল না। আমার নিজের কলেজ থেকে পাওয়া মাহিনা এবং এই টুইশানির পয়সা মিলে আমি কয়েক মাসের জন্য নিশ্চিন্ত। তাছাড়া ছোট একটি ভাইকেও কিছু টাকা দিতে সক্ষম। যতোটা ভয় পেয়েছিলাম, ততো অসুবিধা হয়নি। এর মাঝে আমাদের এক বন্ধু, মূলত বশীরের বন্ধু ভিলেজ রিসারস এডুকেশন সেন্টার বলে একটি এনজিওতে কাজ করতেন, তিনি ফুসলিয়ে বশীরকে সেখানে যোগ দিতে রাজী করান। সেটির দপ্তর ছিল সাভারে। বেতন বেশ ভাল। সরকারী কাজের প্রায় দ্বিগুণ শুরুতেই। বশীর প্রায় এক বছর 'সার্বক্ষণিক লেখক জীবন' কাটিয়ে যেহেতু রেখা অপেক্ষা করছে, তাই চাকুরীটা নিতে রাজী হয়। শীত চলে এলো। প্রায় মাস তিনেক হয়ে গেছে আমি চরমুগরিয়া থেকে এসেছি। এর মাঝে আমি 'বিপক্ষে'র লেখাটা অর্ধেক শেষ করেছি। জাহিদ বলল অর্ধেক লেখাই দিতে, 'চলবে' বা 'অসমাপ্ত' লিখে প্রথম সংখ্যায় ধরিয়ে দেবে। আমি রাজী। জাহিদ আর জুবেরী খুব যত্ন করে প্রুফ দেখে দিয়েছে। এটি 'বিপক্ষে'র প্রথম সংখ্যার লিড প্রবন্ধ হিশেবে যাচ্ছে।

চাকুরী নেয়ার পর বশীর সাভার থেকে সোজা চলে আসে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হোস্টেলে, সেখান থেকে দুজনে শান্তিনগর, মাঝে মাঝে নাজমুলকে তুলে নেই। আড্ডা 'বিপক্ষে' অফিসে প্রথম সংখ্যা বেরোবার আগে থেকেই জমজমাট, তরুণ লেখকরা ভীষণ ক্ষুধার্ত তখন কোন একটা ভিন্নধর্মী পত্রিকার জন্য। সে কারণে গল্পকার সৈয়দ কামরুল হাসান, কবি আহমদ আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে, বুলবুল চৌধুরী আর কবি সমুদ্র গুপ্ত পুরাণ ঢাকা থেকে রামপুরা থেকে সেলিম রেজা আর শান্তিবাগ থেকে সারোয়ার কবীরসহ অগণিত তরুণ লেখকরা 'বিপক্ষে' অফিসে জমায়েত হত। ঘন ধোঁয়ার মধ্যে সবার রক্তচক্ষু, কণ্ঠ জড়ানো, কিন্তু এর মাঝেই এক মনে প্রুফ দেখে যাচ্ছে আবু সাঈদ জুবেরী ও জাহিদ হায়দার। ওঁদের দুজনের 'বিপক্ষে'র লেখার যত্ন ছিল অপরিসীম। আমি, নাজমুল, কবীর বা অন্যরা তক্কাতক্কি করতাম কিন্তু ঝিমুতাম ততোধিক। সঙ্গে সারাক্ষণ সন্ধ্যা থেকে দৌড়াত এবং পরে ঘুমাতো মানিকের একটি ছোট পোষা কুকুর! একদিন হায়দার আমাদেরকে দেখায় যে কুকুরটা দুই রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। কারণটা ঠিক বুঝতে পারি না। হায়দারের খুব শিল্পীর চোখ, ছোট ছোট বিষয়, কারো কারো সামান্য কথা বা তর্কের সময় শরীরের অঙ্গভঙ্গি খুব লক্ষ করতো, এবং পরে সেসব নিয়ে গুঢ় বিশ্লেষণ করতো। কুকুরটা যখন দৌড়াত, হায়দার বুঝতে পারে এটা বিকেলের দিকে বা সন্ধ্যার আগে আমরা যখন পুরিয়াগুলো সিগারেটের তামাকের সঙ্গে মিশিয়ে বিড়ি বানাতাম, ঠিক তার আগে দৌড়াচ্ছে। পরে সে আবিষ্কার করে যে কুকুরটা সন্ধ্যার পর ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেলে দেয়ালের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আসলে প্রতিদিন বিকেলে কুকুরটার শরীর নেশার জন্য উদগ্রীব হয়ে দৌড়ায়, আর ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেলে ওর তীব্র নেশাচ্ছন্ন শরীর ঘুমে নেতিয়ে পড়ে! এই নেশা এবং কুকুর বিষয়ক আবিষ্কার নিয়ে জুবেরী আর হায়দার বিস্ময়কর সব সৃষ্টিশীল উক্তি করতো, যা ছিল আমাদের ঘোলা মস্তিষ্ক এবং জড়ানো কণ্ঠে নিয়ে হাসি উদ্গীরনের কারণ!
প্রথম সংখ্যা 'বিপক্ষে'র সব লেখা ছাপা হয়ে গেলে হায়দার একটি চমৎকার শাদা আর কালো রেখার সমন্বয়ে প্রচ্ছদ আঁকে। আর আমি এই সংখ্যার সকল কবি লেখকদের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী লিখি। পরিচয়ে কিছু ব্যতিক্রমী ভাষা ব্যবহার করেছিলাম, যার সঙ্গে লেখকের দৈহিক বর্ণনার সঙ্গে তাঁর লেখার চারিত্র মিলিয়ে একটি রূপ দিতে চেয়েছিলাম। পত্রিকার একেবারে শেষে লেখক পরিচিতি যায়। পত্রিকাটি বেরোবার পর অনেকেই বিভিন্ন লেখার সঙ্গে লেখক পরিচিতির স্টাইল বা ধরনটি নিয়ে প্রশংসা করেন। বাংলা একাডেমীর এক লেখক, যিনি আমাদের সব লেখা বা জীবন যাপনকেই একটু অতরিক্ত খোঁচা দিয়ে মন্তব্য করতেন, তিনি বেশ এটাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করেন। কিন্তু সেকালে খ্যাতিমান অভিনেতা ও আমাদের বন্ধু আফজাল হোসেন এই লেখক পরিচিতির ভাষা এবং ধরনটিকে খুব প্রশংসা করেন অনেকের কাছে। প্রথম সংখ্যা 'বিপক্ষে' খুব বিশাল মাপের কোন পত্রিকা হয়নি, কিন্তু কেন জানি না তরুণ ও প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল লেখকদের মাঝেই বেশ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের আশার চাইতেও বেশি কিছুটা হিল্লোল তুলেছিল পত্রিকাটি আমাদের সাহিত্যের আড্ডাগুলোতে!


প্রথম সংখ্যা বেরিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় সংখ্যার কাজ শুরু হয়। ফাইলের মধ্যে যে যে লেখা ছিল তার বাইরে সকল তরুণদের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি দেয়া হল। পত্রিকায় নাম যেত চার জনের। সম্পাদক জুবেরী, বশীর ও জাহিদ। প্রকাশক মানিক। কিন্তু পত্রিকার মিটিং বা লেখা নেয়া বা অন্যান্য সিদ্ধান্ত সব পত্রিকা অফিসে সবাই মিলেই করতো। নাজমুল, সেলিম রেজা, কবীর, সারোয়ার বা আমি বসে থাকতাম, সেখানেই সিদ্ধান্ত হত। কিন্তু আমি বা অন্য যারা সেখানে থাকতো তারা কেউ সিদ্ধান্তে নাক গলাতো না। ওঁরা সন্মান করে আমাদের সঙ্গী করেছে, এই যা, কিন্তু আমরা কেউ পত্রিকার ব্যাপারে কিছু বলতাম না। আড্ডাটাই ছিল আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি পত্রিকা বের করতে গেলে কে সম্পাদক হবে, কার নাম যাবে এসব নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে ভীষণ ঈর্ষা এবং বিরোধের সৃষ্টি হয়। হাসান হাফিজ, রাজা, জুবায়ের, আরও দুচারজন বন্ধু মিলে 'আলবাট্রস' পত্রিকা বের করার সময় যে ঘটনা দেখেছি, সেটা আমার মনে ছিল, তাই আমি পত্রিকার সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত, বা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকতাম। তাছাড়া জাহিদ বশীর জুবেরী এরা আমার এতো শ্রদ্ধার এবং প্রাণের বন্ধু যে সামান্য ছোট খাটো ব্যাপারে কেউ কিছু মনে করুক সেটা আমি চাইতাম না। তাছাড়া আমি খ্যাতি বা লেখক হিশেবে নামডাক, এসবের প্রতি কোনদিন আকর্ষণ বোধ করিনি। আমার স্বপ্ন ছিল বই পড়বো, পারলে লিখবো, আর বন্ধুদের লেখার প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল থাকবো। বরং বন্ধুদের ভাল লেখা যাতে পাঠকদের কাছে যায়, সবাই যাতে বুঝতে পারে আমার বন্ধুদের মধ্যে শক্তিশালী লেখকদের সেসব বিষয়ে লেখাই হবে ভাল কাজ, এবং সেটা আড়ালে থেকে। তাই পত্রিকার সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমি নিজেকে জড়াই নি। দ্বিতীয় সংখ্যার কাজ শুরু হওয়ার সময় আমাদের 'বিপক্ষে' অফিসে আড্ডার চরিত্র বদলাতে শুরু করলো। আমরা মূলত খুব দরিদ্র ছিলাম, কেউ কেউ মাত্র চাকুরী শুরু করেছে, আমি শুধু টুইশানি করি। একেবারে দিন আনা দিন খাওয়ার মতো। আমাদের চা বিড়ি সিগারেট ছাড়া একমাত্র নেশা ছিল কম পয়সায় গাঁজা খেয়ে নেশা করা। মধ্যরাতে 'বিপক্ষে' অফিস থেকে পুরো নেশাতুর অবস্থায় ডেরায় ফেরা। কিন্তু পিউ আমাদের আড্ডায় আসা শুরু করলো সন্ধ্যাগুলোতে, আর এসেই সবাইকে নিয়ে 'গ্রীন' বা সাকুরায় যেত ফুসলিয়ে। সেসব দিনে অর্থের অভাবে আমরা ভাল মদ খেতে পারতাম না, তাই বললেই আমরা আড্ডা ভেঙ্গে চলে যেতাম। আমি বশীর, নাজমুল, কাজী হাবীব বা আরও দুয়েকজন। জাহিদ আর জুবেরী কম যেত। আমরা প্রায় দশটা এগারোটা পর্যন্ত সেখানে বিয়ার বা হুইস্কি খেয়ে যার যার ডেরায় ফিরতাম প্রায় অর্ধচেতন অবস্থায়। মাতাল অবস্থায় পিউ আর বশীরের বাড়ি ফেরার সময় একটা প্রিয় গান ছিল 'বধূ মিছে রাগ করো না'! পানের সময় প্রায় প্রতিদিন এতো টাকার বিল কোথা থেকে পিউ দিত আমরা কোনদিন ভাবিনি। শুধু জানতাম পিউ ধনী বাবার ছেলে, বড় বেতনের চাকুরী করে, এটুকুই। তাছাড়া জানার বিষয়ে ইচ্ছে করেই হয়তো আমরা সবাই নীরব থাকতাম। এর মাঝে একদিন 'বিপক্ষে'র দলবল নিয়ে পিউর উদ্যোগে আমরা ওর অফিসের দুটি গাড়ি এবং একটি জীপ নিয়ে মধুপুরের জঙ্গলে পিকনিক করতে যাই। দুখুর দোকান থেকে ডেকচি ভর্তি বিরানি, সকালের নাস্তা এবং বিকেলের খাবার নিয়ে রওয়ানা দেই। দুখুর দোকান থেকে বেরিয়ে 'গ্রীন' থেকে প্রচুর বিয়ার এবং হুইস্কি নেয়া হয়, সঙ্গে শাহনেওয়াজ তার ক্যামেরা ভর্তি ফিল্ম নেয়। মধুপুরের জঙ্গলের মধ্যে প্রচুর ছবি তোলা, নাচ গান, রেকর্ডারে গান বাজানো ও হই হুল্লোড় করে সারাদিন কাটিয়ে আমরা সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরে আসি।
পিউর নারীদেহের সৌন্দর্য বিষয়ে চোখ ছিল দারুণ, রমণী মনোরঞ্জনে ছিল বেশ মেধাবী। কয়েকটি বান্ধবীকে এক সঙ্গে হ্যান্ডল করতে তার কখনও বিপদ হতে দেখিনি। একটি চিত্রকর তরুণীকে ভীষণ ভালবাসে, তার শিল্পকলার প্রদর্শনীর আয়োজন করে অনেক টাকা খরচ করে। বশীর আমাকে সেই শিল্পী মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় একদিন। আবার তেজগাঁয়ের কাছে এক কাজিনের সঙ্গেও দারুণ প্রেমের সম্পর্ক। এই কাজিনটি তখন নবম দশম শ্রেণীতে পড়ে, দারুণ তীক্ষ্ণ, ক্ষীণাঙ্গিনী এবং সত্যিকার রূপসী! একদিন হঠাৎ পিউ শাহনেয়াজ এবং আরও দুয়েক বন্ধুকে নিয়ে এই কাজিনকে পালিয়ে বিয়ে করে বাড়ি থেকে চলে যায়, কাজিনদের বাড়িতে নতুন বউয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। কিছুদিন পর পিউর মা বাবা মেনে নেন, পিউ একমাত্র ছেলে আর ওর ছয় সাতটি বোন আছে ওর ছোট এবং বড়। পিউর বাড়িতে কয়েকদিন পর ধুমধাম করে বিয়ের রিসেপসন হয়। বিরাট খাওয়া দাওয়া, বন্ধুদের হুল্লোড় সবই হয়েছিল।
এভাবে ভালোই আনন্দে কাটছিল, পিউর সারাক্ষণ উত্তেজনা দরকার, এতে আমাদের সাহিত্যের আড্ডা বা লেখায় ভাটা পড়ে, হইচই আর পানাহারেই সময় চলে যায় বেশি। একদিন সিদ্ধান্ত হল 'বিপক্ষে' থেকে সবাই ময়মনসিং এবং চট্টগ্রাম যাওয়া হবে, কারণ কবি শোয়েব সিদ্দিকী আর কথাশিল্পী আতা সরকার আমাদের ময়মনসিংহ গিয়ে ওখানকার তরুণ লেখকদের সঙ্গে আলাপ করার অনুরোধ করেন। আমরা ট্রেনে দল বেঁধে ময়মনসিংহ যাই, সেখানে চাঁদনী রাতে ব্রহ্মপুত্র নদীর বালুর চরে বস্তিতে ভিন্ন এক জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি আমরা। এটা খুব আনন্দের ভ্রমণ ছিল। চট্টগ্রাম থেকে খালিদ আহসান, কবি শিশির দত্ত, শ্যামলী এরা আসতেন আড্ডায়। সেখানে যাওয়ারও পরিকল্পনা হয়, কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। এসব ভ্রমণ আর সাহিত্য আড্ডা ছিল আমাদের 'বিপক্ষে' জীবনের উজ্জ্বল দিক। 'বিপক্ষে'র এই সাহিত্য অন্তপ্রাণ কয়েক তরুণের তুমুল আড্ডা ও সাহিত্য-লিপ্ততার সঙ্গে আনন্দ যেমন ছিল তেমনি পিউর অতিরিক্ত উত্তেজনা এবং পানাহার এবং তা আমাদের মাঝে সংক্রামণের ফলে বিপদও হয়েছে দুয়েকবার। একদিন সন্ধ্যায় শুক্রবার, সবাই আমরা আড্ডায় হাজির, ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, আমাদের চোখ কিছুটা রক্তিম, এসময় পিউ এসে হাজির এবং বলল, সেদিন তার জন্মদিন। আমরা আনন্দে নেচে উঠলাম। কিছু একটা করতে হবে, এটাই সবার সিদ্ধান্ত। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় এই ড্রাই ডে- তে! সেকালে গ্রীন রোডে, যেখানে এখন পান্থপথ মিশেছে, সেখানে একটি রেস্তোরাঁ ছিল 'শ্যালে' নামে। মালিক আমাদের ফরিদপুরের,চেনা মানুষ, শাহ আলম নাম। সেখানে ভালো চাইনিজ খাবার পাওয়া যেত, সঙ্গে বিয়ার বা হার্ড ড্রিঙ্কস। সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। দল বেঁধে আমরা সাত আটজন সেখানে গিয়ে খাবারের ও পানীয়র অর্ডার দিলাম যার যা খুশী। খাবার এলো, কিন্তু গাঁজার নেশায় আগেই আমাদের একটু বেহাল অবস্থা, তাই নতুন পানীয় পেটে পড়ায় কে যে কী বলছে আর চীৎকার করছে তার কোন সীমা পরিসীমা নেই! কাজী আর আরও দুয়েকজন বেশ উত্তেজিত হয়ে কমলকুমারের গদ্যরীতি নিয়ে উচ্চস্বরে তক্কাতক্কি করছিল। 'শ্যালে'র মালিক রেস্তোরাঁয় ছিলেন না, কর্মচারীরা ভয় পেয়েছিল মনে হয়। সবার লম্বা চুল, উদ্ভট ভাষায় বিতর্ক। তাই তারা তেজগাঁ থানায় ফোন করে। আমাদের পান এবং আহার তখন মধ্যপথে। এমন সময় এক দল পুলিশ এসে আমাদের ঘিরে ধরে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় থানায়, কারণ আমাদের কারো কাছে পান করার লাইসেন্স ছিল না। আমাদের পুলিশের গাড়িতে তুললে পিউ আমার পাশে, আমি পিউকে বললাম, 'আমাদের যখন পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তখন আমরা সরকারের কাস্টডিতে, তাই আমাদের সকল ঋণ সরকারের বহন করার কথা, 'শ্যালে'র বিল পুলিশের দেয়ার কথা আইনানুযায়ী।' পিউ আমাকে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, 'আবেদীন ভাই, এখন বলছেন, আমি যে এতগুলো টাকা খাওয়া আর ড্রিঙ্কসের বিল দিয়ে দিয়েছি পকেট থেকে!'
থানা থেকে রাত এগারোটার দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ওয়াশ করে প্রমাণ করার জন্য যে আমরা বেআইনিভাবে পান করেছি। গলায় নল ঢুকিয়ে পাকস্থলী ওয়াশ করার অভিজ্ঞতা যার নেই, তার পক্ষে বোঝা মুশকিল কী সাংঘাতিক কষ্টের বিষয় সেটা। কিন্তু কার মাথা থেকে বুদ্ধি এসেছিল হাসপাতালে কে জানে, যে ওয়াশ করছিল তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয়ার কথা, আমি জানি না। দেখা গেল সবাই কষ্টের অভিনয় করছি আমরা আর পুলিশকে হাসপাতালের ওয়াসম্যান জানাচ্ছেন সবাইকে ওয়াস করা হয়েছে, মদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে পাকস্থলীতে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে হাসতে হাসতে পুলিশের গাড়িতে আবার তেজগাঁ থানায় যাত্রা। থানার হাজতে কিছু অপরাধী আগেই ছিল, এই সাত আট তরুণ বিপুল মশার অত্যাচারের মধ্যে থানার দালালদের সাহায্যে সেখানে কিছু গাঁজার ব্যবস্থা করা গেল। মধ্যরাতে ইত্তেফাকে ফোন করে কথাশিল্পী রাহাত খানকে না পেয়ে তাঁর বাসায় ফোন করা হল, একইভাবে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এবং রফিক আজাদকে ফোন করে আমাদের এই 'বীরত্বের' সংবাদ জানানো হল। এবং এটাও জানানো হল যে সকালে আমাদের আদালতে চালান করা হবে। সেসব দিনে রফিক ভাই, বা বেলাল ভাই সাহিত্যিকদের যে কোন বিপদে সচিব কবি ওবায়দুল্লাহ খানের সাহায্য নিতেন। আমাদের ব্যাপারেও তাই হয়েছিল। পরদিন সকালে সরকারী পয়সায় থানায় নাস্তা খেয়ে আমরা সবাই আদালতে। কোমরে দড়ি ছিল না, কিন্তু আসামী হিশেবে কিছু নিয়ম মানতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি রাহাত ভাই, হাবীবুল্লাহ সিরাজী ভাই ও আরও বেশ কয়েকজন লেখক সাহিত্যিক। আদালতের নিয়মানুযায়ী আমাদের কিছু কাগজপত্র স্বাক্ষর করে সেই যাত্রায় বিচারকের আদালত থেকে আমরা ছাড়া পেয়েছিলাম। মহা উত্তেজনায় দুপুরের কিছু পরে আমরা যার যার ডেরায় ফিরতে পেরেছিলাম। নিজেদেরকে এই প্রথম বেশ 'সেলিব্রেটি' মনে হয়েছিল সেদিন! বন্ধুদের বাবা মায়েরা জেনে গিয়েছিলেন বিষয়টা, কিন্তু আমার আর কাজীর ঢাকায় কেউ না থাকায় আমাদের একটু নিস্তার ছিল।

এভাবে সেই শীতে, মানে জানুয়ারির শেষ দিকে 'গ্রীন' হোটেলে এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় সিরকা দিয়ে ভেজানো ছোলা, গরুর মাংস ভুনা সহযোগে পরোটা আর অসংখ্য বিয়ার পানের সময় পিউ বলল, 'এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে চলেন বশীর ভাইয়ের একটা বই বের করি।' আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজী। বশীর একটু সংকোচ করছিল কে প্রকাশক হবে সেই চিন্তায়। পিউ সটান বলে দিল, 'যত টাকা লাগে আমি দেব, কোন চিন্তা নাই, কালই সকালে প্রেসে খোঁজ নেন।' আমার দিকে তাকিয়ে পিউ বলল, 'আবেদীন ভাই খোঁজ নেন। আমি সকালে আপনাকে তুলে আজিমপুর যাব প্রেসে।' যথারীতি পিউ পরদিন সকালে আমাকে তোলার আগে কাজী হাবীবকে মগবাজার তার ডেরা থেকে তুলে টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এসে আমাকে তোলে। যে গাড়িটি পিউ অফিস থেকে ব্যবহার করতো সেটি একটি সুন্দর ফোরড গাড়ি, 'ফেলকন'। শাদা রঙয়ের বড় গাড়ি, সিটগুলো শাদা কাপড়ে মোড়ানো। বসে বেশ আরাম। এছাড়া মাঝে মাঝে একটি 'উইলিস' জীপও পিউ ব্যবহার করতো। আমরা তিনজনে প্রথমে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে নাস্তা করি, কারণ কাজী আর আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। পরে আজিমপুর শেখসাহেব বাজার রাস্তার ওপর যতোগুলো প্রেস আছে, প্রায় সবগুলোতেই আমরা হানা দেই, কিন্তু এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কেউ ছাপার কাজ নিতে রাজী হয় না, কারণ তাদের হাতে তখন অনেক কাজ। আমরা সেদিনের মতো বিফল হয়ে ফিরে আসি। পিউ পরের দিন মতিঝিল বা হাটখোলার দিকে দুয়েকটি প্রেস দেখতে যাবে বলে জানালো। আমি আর কাজী এদিক সেদিক ঘুরে এক রেস্তোরাঁয় বসে বশীরের দেয়া তালিকা অনুযায়ী গল্পের তালিকা করলাম। সবগুলোর কপি আছে দুতিনটা ছাড়া, সেগুলো বিভিন্ন পত্রিকা অফিস থেকে জোগাড় করতে হবে। পরের দিন আমি আর হাবীবের সাথে হায়দারকে তুলে সবাই মিলে পিউকে নিয়ে মতিঝিল দুয়েকটা জায়গায় হানা দিয়ে 'পাইওনিয়ার' প্রেসে কথা বললাম, তারা রাজী হল, কিন্তু কম্পোজ করার বা ছাপার দাম প্রায় আজিমপুরের দ্বিগুণেরও বেশি। পিউ তাতেই রাজী, কারণ হাতে সময় নেই। আসলে কী ঘোরে যেন আমরা দৌড়াচ্ছিলাম, কী আমাদের নেশা ঠিক জানি না, তবে একটা বই বের করতে হবে আর তা যখন এক বন্ধু টাকা দিচ্ছে তাই সুযোগটি ছাড়া ঠিক নয়! এই ভাবনাটি ছিল, তাছাড়া বশীর এতো ভাল লেখে, কিন্তু বই নেই, তাই সে অভাবটাও পূরণ করতে হবে। তাই দুদিনের মধ্যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে জাহিদ আর জুবেরীকে দেখানো হল, বশীর বন্ধুদের পরামর্শ, মানে কোন কোন গল্প দেয়া হবে বইতে সেটা খুব মূল্য দিত। তাছাড়া জুবেরী আর জাহিদ ছিল সত্যিকার অর্থে বশীর বা আমাদের আরও দুয়েক বন্ধুর লেখার সঙ্গে একেবারে শুরু থেকে জড়িত, মানে ওঁদের নিজেদের লেখা বিষয়ে প্রায় প্রতিটি অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত। আর লেখার মান বিষয়ে বন্ধুত্বকে ছাড়িয়ে একেবারে নির্মোহ মতামত দিতে সক্ষম। সাহিত্য বিষয়ে আমার ভাল লাগা বন্ধুত্বের মমতায় জড়ানো থাকতো, আমি আবেগের ঘরে বন্দী থাকতাম, বন্ধুদের লেখা নিয়ে নির্মোহ হতে পারতাম না। কিন্তু জাহিদ আর জুবেরী এসব ব্যাপারে একেবারে নির্মোহ এবং বিস্ময়কর রকম নির্মম! তাই ওঁদের দুজনের মতামত নিয়ে ফাইনাল পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা হল। প্রেসে দিয়ে আমরা কম্পোজ নেই আর সেখানে বসেই কাজী আর আমি প্রুফ দেখি। বশীর প্রতিদিন সাভারে অফিস করে, বিকেলের দিকে কখনও 'পাইওনিয়ার' প্রেস থেকে আমাদের তুলে মতিঝিলের কোন টঙের দোকানে চা সিঙ্গারা খেয়ে শান্তিনগর যায়। এভাবে দিন দশেকের মধ্যে অনেকখানি কম্পোজ হয়ে গেল। যেটুকু কম্পোজ হয় তা আমরা প্রুফ দেখি, কিন্তু ফাইনাল প্রুফ দেখে জুবেরী আর জাহিদ। ওঁদের চোখ ভীষণ তীক্ষ্ণ। কথাসাহিত্যের ভাষা বিষয়ে জ্ঞানও খুব পরিচ্ছন্ন!

একদিকে 'বিপক্ষে' দ্বিতীয় সংখ্যার কাজ, আড্ডা, অন্যদিকে বশীরের বই 'অন্য পটভূমি'র ছাপার কাজ, এসব নিয়ে আমরা ভীষণ উত্তেজনায় আছি। এসময়টায় প্রায় প্রতিদিন পিউ এসে সন্ধ্যায় আমাদের কোন শুঁড়িখানায় নিয়ে যায়। একদিন কী কারণে আমরা সন্ধ্যায় 'রোববার' অফিসে গেছি, কিন্তু সন্ধ্যায় পানের নেশায় পিউ রফিক ভাইকে অনুরোধ করলেন আমাদের সঙ্গে বেরোতে। সেখানে রফিক ভাইয়ের কিছু প্রুফের কাজ ছিল, সেসব দেখে আটটার দিকে আমরা গ্রীনে গিয়ে একটা গোল মেহগিনির টেবিলে বসলাম মূল ভবনে, একচালায় নয়। সেখানে বেশ খাবার, মানে গরুর ভুনা আর পরোটা সহযোগে হুইস্কি অনেকটা পান করে রাত এগারোটার দিকে সবাই প্রায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বেরোলাম। সেসব দিনে পিউ মাঝে মাঝে 'ফ্লাইং ডাচম্যান' সিগারেটের কালো কৌটা ভর্তি সিগারেট খেতেন, নয়তো 'ফ্লাইং ডাচম্যান' তামাকের কৌটা থেকে নিজেই সিগারেট বানাতেন। এমন একটি গাঢ় বাদামী ডাচম্যানের কৌটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা নেন। রাতে আর সিগারেট খাব না। আমি আমার কাঁধের কাপড়ের থলিতে সেটা পুরে ডেরার উদ্দেশ্যে প্রায় মধ্যরাতে রওয়ানা দিলাম গ্রীনের সামনে থেকে।

একুশে ফেব্রুয়ারির দিন চারেক আগে প্রচ্ছদ দিল হায়দার। হালকা হলুদের সঙ্গে মেজেন্টা রঙয়ের একটি ছবি ও লেটারিং। কিন্তু কী কারণে জানি না মেজেন্টা রঙটা কিছুতেই ফুটলো না। সারা রাত আমি হায়দার কাজী এবং বশীর মতিঝিল 'পাইওনিয়ার' প্রেসে প্লেটে ছাপার দিকে তাকিয়ে থাকলাম মনমরা হয়ে। যাহোক এক সময় হতাশ চিত্তে আমরা হাল ছেড়ে দিলাম, সময় নেই যা হয়েছে, তাই নিয়ে খুশি থাকা ভাল। ফেব্রুয়ারি কুড়িতে সব ছাপা শেষ হল, আমরা দৌড় দিলাম বাঁধাইয়ের জন্য নবাবপুরে। তাদেরকে অনুরোধ করলাম যেমন করে আমাদের অন্তত একশত কপি রাতের মধ্যে দিতে। এ সময়ে বাঁধাইয়ের মানুষরা খুব ব্যস্ত থাকেন, তবুও মধ্যরাত অবধি থেকে কিছু পেলাম না। আমরা তিনজন, আমি কাজী আর হায়দার টিএন্ড টি অফিসের কাছে, হায়দারের বাড়ির পাশে একটা রেস্তোরাঁয় চা সিঙ্গারা খেয়ে কয়েক ঘণ্টা নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। বশীর বাসায় চলে গেছে, সকালে সাভার যাবে। বাঁধাইয়ের লোকরা বলেছেন শেষ রাতের দিকে বই রেডি হবে। আমরা তিনজন উত্তেজনায় বাড়ি না ফিরে রমনা ভবনের কাছে সেই রাতে রেস্তোরাঁয় কাঁপের পর কাপ চা খেয়ে কাটিয়ে কাঁক ডাকা সকালে বাঁধাইয়ের লোকদের কাছ থেকে বই নিয়ে রিকশায় চরলাম আমি আর কাজী হাবীব। বাংলা একাডেমীতে যখন আমাদের রিকশা পৌঁছল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। রিকশায় আমাদের পায়ের কাছে দুটি বইয়ের বান্ডিল। কাজী আর আমি ক্লান্ত, উত্তেজিত এবং কিছুটা অবসাদগ্রস্ত। প্রায় ষাট সত্তরটা বই বিভিন্ন দোকানে দিয়ে আমরা ডেরার দিকে রওয়ানা দিলাম। সেই '৮১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রায় পুরো দিনটা আমি একেবারে অঘোর ঘুমে কাটিয়ে বিকেলের দিকে উঠে স্নান আহার করে বশীর ও কাজীকে নিয়ে আবার বাংলা একাডেমী গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিলাম। পিউ জুবেরী জাহিদ হায়দার সবাই মিলে ভীষণ উত্তেজনা আর আনন্দে কাটলো আমাদের সন্ধ্যাটা। মানিক, পিউসহ 'বিপক্ষে'র সকল বন্ধুদের প্রথম সন্তান লাভের মতো আনন্দের দিন ছিল সেটা। সে সময়ে ৭/৮ ফর্মার একটি বই বের করতে সাকুল্যে ৬/৭ হাজার টাকা হলেই হয়ে যেত, কিন্তু 'অন্য পটভূমি' বের করতে খরচ হয়েছিল কিঞ্চিদধিক সতেরো হাজার টাকা। কারণ 'পাইওনিয়ার' প্রেস অতিরিক্ত চার্জ করে, আর আমরা সময়াভাবে খুব তাড়াহুড়া করে বইটি বের করি। এরপর পিউর মাথায় ঢুকলো এক নতুন চিন্তা, যদি একটা প্রকাশনা করা যায়। একদিন 'পাইওনিয়ার' প্রেসে যেতে যেতে আমাকে বলল, 'আবেদীন ভাই, আপনি চালান, চলেন একটা প্রকাশনা করি। প্রথমে তিন চারটা বই বের করে মার্কেট করেন।' আমি মহা উত্তেজিত। বশীরকে বললাম। বশীর বলল, 'যদি পারিস, চালা।' আমার উচিৎ জুবেরী জাহিদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া, কারণ ওঁরা দুজন অনেক বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, পিউর আবেগাশ্রিত হৃদয়বৃত্তি সম্পর্কে অনেকদিন জানে। কিন্তু সেটা না করে আমি পিউর কথায় সাড়া দিয়ে প্রকাশনার কাজে রাজী হই। আমি মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেনের একটা করে উপন্যাস এবং একটা তরুণ কবিদের গল্পের সংকলন বের করার কথা ভেবে পিউকে বলি। পিউ রাজী। ততদিনে নাজমুল গ্রীনরোড সুপারমার্কেটের পাশে একটা ছোট প্রেস শুরু করেছে। ওখানেই সেলিনা হোসেনের 'যাপিত জীবন' উপন্যাসটি ছাপা শুরু হয়। আমাদের এই নতুন প্রকাশনার নাম রাখা হয় 'সপ্তপদী প্রকাশনী'! 'যাপিত জীবন' দুই ফর্মা ছাপার পর পিউ জানায় তার চাকুরীতে অসুবিধা হচ্ছে, প্রকাশনী বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর এই উপন্যাস নিয়ে একটু বিপাকে পড়ি আমরা। সেটা ভিন্ন ইতিহাস। ইতিমধ্যে 'বিপক্ষে'র আড্ডায় কিছুটা ভাটা দেখা দেয়। মানিকের প্রেসে তেমন আয় হত না, তাই একটু আর্থিক সংকট দেখা দেয়। তাছাড়া বন্ধুদের মধ্যে কিছুটা রেষারেষি, ঈর্ষা এসব বোঝা যাচ্ছিল। পিউ এবং মানিকের মধ্যে একটু সম্পর্কে চির ধরে। আমরা হতাশ হই। কিন্তু নিয়মিত 'বিপক্ষে' বের করার পরিকল্পনা অব্যাহত থাকে, আড্ডাও চলে। কিন্তু সন্ধ্যাগুলোতে পানের দিকে সবাই ঝুঁকে পড়ে বেশি।


আলোকচিত্রে প্রাবন্ধিক অনুবাদক আবেদীন কাদের
এরপরও প্রতিদিন আমরা 'বিপক্ষে'র আড্ডায় যাই, কিন্তু জাহিদ জুবেরী লেখা ও প্রুফ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আমরা পিউর সঙ্গে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় বেরিয়ে যাই। 'অন্য পটভূমি' দারুণ প্রশংসিত হয় পাঠক ও সমালোচকদের কাছ থেকে। একটি পুরস্কারও পায় কিছুদিন পর। আমি গ্রন্থ সমালোচনা লিখেছিলাম 'রোববার' পত্রিকায়। কিন্তু কী কারণে জানি না, আমাদের কয়েকজনের 'বিপক্ষে' অফিসের আড্ডায় সঙ্গে লিপ্ততা একটু কমে যায় সন্ধ্যায় পিউর সঙ্গে 'গ্রীনে' সন্ধ্যাগুলো কাটানোর জন্য। এমনি এক সন্ধ্যায় আমরা চার পাঁচজন বেশ নেশা আর আড্ডায় মশগুল 'গ্রীনে', হঠাৎ জাহিদ সেখানে উপস্থিত, বেশ বিষণ্ণ এবং চিন্তাগ্রস্ত। জাহিদের বাম হাতটা গ্রীনের যে ঘরটায় বসে পান করছিলাম, তার দরোজায় রেখে বশীরের দিকে তাকিয়ে বলল, 'বশীর, আমাদের একটু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে, এখনই!' আমি ছিলাম জাহিদের ঠিক বিপরীত দিকে,মুখোমুখি বসে, আমি জিজ্ঞেস করলে জাহিদ জানায় খালুজান এক দুর্ঘটনায় আহত, এই মাত্র সাবু তোদের খুঁজে না পেয়ে আমাকে খবর দিয়েছে।' আমরা দ্রুত পিউর গাড়িতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সিতে গিয়ে দেখি বশীরের আব্বাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথায় আঘাত লেগেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। তিনি বাসা থেকে আলুবাজারে তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে ভাড়া সংগ্রহ করতে যাচ্ছিলেন রিকশায়, একটি ট্রাক ধাক্কা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছাকাছি এক জায়গায়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তাকে নেয়া হয়েছে। আমি কাজী আর বশীর সেখানে রয়ে গেলাম, বাকীরা মধ্যরাতের একটু আগে বাড়ি ফিরে গেল। রাত বারোটার দিকে তাকে একটি ওয়ার্ডে নেয়া হল এবং জানতে পারলাম যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে তাঁকে নিওরোসার্জনের আন্ডারে রাখা হবে। আমরা সেখানে সারারাত কাটিয়ে দিলাম, মাঝে মাঝে বাইরে যাই চা খেতে। কিন্তু পরদিন জানতে পারলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভাল নিওরোসার্জন নেই, এবং এ বিষয়ে একমাত্র যিনি বিশেষজ্ঞ তিনি ডাঃ রশীদউদ্দিন, তিনি পিজিতে অধ্যাপক। পরদিন বিকেলে বশীরের আব্বাকে পিজিতে ট্রান্সফার করা হল, আমরা তাঁকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখি একটি কেবিন দেয়া হয়েছে তাঁর জন্য। এই কেবিনে সাবু মাঝে মাঝে আসে, খালাম্মা আসেন দেখতে, কিন্তু আমি আর কাজী থাকি পালা করে, সন্ধ্যার দিক থেকে আমি বশীর আর কাজী থাকি। বন্ধুরা আসেন, খোঁজ নেন, পিউ প্রায় প্রতিদিন আসে। কিন্তু ভাবনার ব্যাপার হল রোগীর জ্ঞান ফিরছে না, কয়েকদিন হয়ে গেল। ডাঃ রশীদ উদ্দিন দেখে যান, তাঁর ক্লিনিকাল এসিসট্যানট ডাঃ কনক বড়ুরা, এক তরুণ সুদর্শন ডাক্তার, যিনি সার্বক্ষণিকভাবে দেখতেন আর অধ্যাপক রশীদ উদ্দিনকে জানাতেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও যখন জ্ঞান ফিরলো না তখন বশীর এবং বাড়ির সবার উদ্বেগ বেশ বাড়তে লাগলো।
দোতলার যে কেবিনটায় বশীরের আব্বাকে রাখা হয়েছে, তার একটা ছোট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শাহবাগ মোড়ের গাড়ি চলাচল দেখা যায়, আমরা গভীর রাতে সেখানে বসে ক্ষীণ কণ্ঠে তিনজন মাঝে মাঝে কথা বলি, নয়তো নীচে নেমে কয়েকবার চা সিঙ্গারা খাই, এভাবেই আমাদের পালা করে রাত কাটে। প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেল, একদিন বশীর আমাকে বলে, 'দোস্ত তুই আজ হোস্টেলে গিয়ে সারারাত ঘুমিয়ে নে, আমি আর কাজী থাকি আজ। আমি সন্ধ্যায় চলে গেলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হোস্টেলে। খুব সকালে উঠে সাড়ে সাতটা বা আটটার দিকে দ্রুত রিকশা নিয়ে শাহবাগ যাই ওদেরকে বিশ্রাম দিতে, রিকশা থামার সাথে সাথে বশীরের বড় দুলাভাই এবং আরও কয়েকজন পারিবারিক সদস্যকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে আমি একটু বিস্মিত হই, কাছে যেতেই বড় দুলাভাই বললেন, 'কাল গভীর রাতে উনি ইন্তেকাল করেছেন।' শুনে আমি প্রায় বিমূঢ়! কী বলবো তাঁকে। লাশ পেতে আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে। সবাই অপেক্ষা করছেন। কাজী হাবীব খুব সকালে রওয়ানা দিয়েছে কুমিল্লায়, বশীরের বোনকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে। লাশ নিয়ে আমরা বশীরদের মগবাজার নয়াটোলার বাসায় যাই। সেখানে সবাই আসেন, জানাজা হয় এবং জোহরের পর দাফন হয়।
বাবার মৃত্যু বশীরকে খুব বিষণ্ণ করে দেয়। যে বশীর কখনও পরিবার বা পেশা এসব জাগতিক বিষয় নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেনি, তাঁকে পরিবার, মা ও ছোট ভাই সাবুকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হল। তাই তার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম আমি। বিষণ্ণ এবং নিজের দায়িত্ব নিয়ে কিছুটা উৎকণ্ঠায় কাটতে থাকলো তার দিন। আড্ডায় থাকে যথারীতি, কিন্তু বেশ কয়েকদিন মনটা বেশ বিষণ্ণ থাকে। 'বিপক্ষে'র পরবর্তী সংখ্যায় বশীর বাবার মৃত্যু নিয়ে একটু হৃদয়-ছোঁয়া কবিতা লেখে!
বশীরের আব্বার মৃত্যুর পর বশীর বেশ কিছুদিন বিষণ্ণ থাকে, আমরা সবাই মিলে ওঁকে সব সময় উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু মনে হয় বশীর রেখার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কয়েক সপ্তাহ পর বশীর একদিন আমাকে আর কাজীকে বলে রেখার সঙ্গে কথা বলতে। আমরা কথা বলি,সব তো আগেই ঠিক ছিল, কিন্তু রেখা ভেবেছে বাবার মৃত্যুর এতো কম সময়ের মধ্যে বিয়ে করা ঠিক হবে কিনা! কিন্তু বশীরের তখন মানসিকভাবে রেখাকে বেশি দরকার। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে সম্ভবত, তারিখটা মনে নেই, বশীর আমাকে বলল রেখাকে নিয়ে মগবাজার কাজী অফিসে যেতে। একদিন খুব সকালে পিউর অফিসের শাদা গাড়িটা নিয়ে আমি আর কাজী মোহাম্মদপুর রেখাদের বাসা থেকে রেখাকে তুলে সোজা মগবাজার কাজী অফিসে নিয়ে গেলাম। সেখানে বশীর ও আরও দুয়েকজন বন্ধু ছিল। বিয়েটা হয়ে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমরা সেই গাড়িতেই রেখা আর বশীরকে নিয়ে নয়াটোলা ওদের বাড়িতে খালাম্মাকে কদমবুচি করার জন্য নিয়ে যাই, তখন সকাল দশটার কাছাকাছি। খালাম্মা একটু বিস্মিত হলেও সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়। আমরা সামান্য কিছুক্ষণ পর বশীর আর রেখাকে নিয়ে মোহাম্মদপুর গিয়ে রেখার আব্বা আম্মাকে ছালাম করানোর ব্যবস্থা করি। মোটামুটি কাজী আর আমি বেশ কয়েক ঘণ্টা সেই বাড়িতে থেকে খাওয়া দাওয়া এবং আনন্দ ফুর্তি করে রেখা ও বশীরকে রেখে চলে আসি।

৩.
আমরা সবাই 'বিপক্ষে'র প্রায় এক বছর আড্ডার পর কাঁচের বিচূর্ণ টুকরোর মতো আলাদা হয়ে গেলাম মানসিকভাবে। আমরা আমাদের সাহিত্য-লিপ্ততার মাঝে এক ধরনের শ্লথতা দেখতে পেলাম। বশীর চাকুরীর পর রেখাকে কিছুটা সময় দিতে গিয়ে প্রতিদিনের আড্ডার সময়কে কিছুটা কমাতে বাধ্য হয়। রেখা সারাদিন একা থাকেন, তাই ওঁকে একটু আগে ঘরে ফিরতে হয়। 'অন্য পটভূমি' বের হওয়া ও 'বিপক্ষে'র দুটো সংখ্যা বের হওয়ার পর আমাদের উত্তেজনা কমে আসে। কিন্তু আমার নিজের মাঝে আমি কিছু ভিন্ন রকম দোলাচল বোধ করতে থাকি। এম এ পরীক্ষার আগে আমি ছিলাম এক ধরনের উনমূল মানুষ, এখনও অনেকটা তাই, কিন্তু জীবনের, বিশেষ করে পারিবারিক কিছু দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমি খুব উদ্বেগ বোধ করি ভেতরে ভেতরে। কিন্তু একই সঙ্গে এক ধরনের 'রূপান্তর'ও আমি আমার মনের মাঝে অনুভব করলাম। 'বিপক্ষে' নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি প্রথম আমার লেখার বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা শুরু করি। এর আগে কয়েক বছর যাবৎ আমি অনুবাদ করি, পত্রিকায় ফ্রিলেন্সিং করি, ছোটখাটো গ্রন্থ সমালোচনা বা প্রবন্ধ লিখি, আর সারাক্ষণ বই পড়ি, সুনির্দিষ্টভাবে লেখক হিশেবে আমার কী করা উচিৎ, কী লেখা উচিৎ, কীভাবে লেখা উচিৎ, কোন বিভঙ্গে লেখা উচিৎ তা নিয়ে খুব একটা ভাবি নি। কিন্তু গত বছর খানেক সময়ে 'বিপক্ষে'র বন্ধুদের মমতা-জড়ানো উষ্ণতা, আড্ডা, সাহিত্য-লিপ্ততা আমার মনের ওপর বেশ ঘনবদ্ধ একটা ছাপ ফেলে যায়। বিশেষ করে জুবেরী, জাহিদ এবং বশীর আমার ওপর ভিন্ন রকম এক ছাপ রাখে যা তারা কেউ জানে না, এমন কি আমি তাদেরকে কোনদিন বুঝতে দেইনি। ওঁদের তিনজনকেই আমার সত্যিকার অর্থে লেখক পেশা বেছে নেয়ার জন্য প্রস্তুত মনে হয়েছে। আমি মনের দিক থেকে ওদের থেকে আলাদা, সাহিত্য বিষয়ে ভাবনাও কিছুটা আলাদা, আর রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে একেবারে আলাদা। কিন্তু ওদের হৃদয়ের মানবিক দিকগুলো আমাকে ভীষণ টানে। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য ওদের তিন জনেরই মমতাবোধ আমাকে ওদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে ভীষণভাবে। গভীর রাতে একা একা যখন আড্ডা থেকে ফিরি তখন 'বিপক্ষে'র সাহিত্য-লিপ্ততার বাইরে আমার ব্যক্তিমানসে এই তিন বন্ধুর উজ্জ্বল দীপ্ত প্রভাব নিয়ে আমি ভাবি। কিন্তু আমার ভেতরের অন্তর্গত এক ধরনের নিভৃতচারীতার জন্য আমি এ বিষয়টা এই তিন বন্ধুর কাউকেই কোনদিন জানাই নি! সাহিত্য আড্ডার বাইরে এটাই ছিল আমার মনের ওপর 'বিপক্ষে'র স্থায়ী এক ছাপ, যা আজও আমাকে ভাবলে কাতর করে!
সে সময় আরও একটি বিষয় আমি ভাবতাম, মানুষ বদলে যায়, তার চিন্তা-আদর্শ-কল্পনা-নৈতিক অবস্থান সবই হয়তো বদলে যায় সময়ের দীর্ঘ পরিসরে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চেতনায় নতুন রঙের যে ছায়া পড়ে, তার সংশ্লেষ মানুষ এড়াতে পারে না, কিন্তু অন্তরলীন সময়ের কিছু কিছু ছাপ সারাজীবন মানুষটি সঙ্গে বহন করে। আজ এতদিন পর সেই সময় নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি এই তিন বন্ধুর আমার মনের ওপর রেখে যাওয়া কিছু চিহ্ন এখনও খুঁজে পাই, যা কিছুটা সাহিত্যিক, কিছুটা নৈতিক! যেমন তখন লেখা নিয়ে, অর্থাৎ জীবনে লেখাকে কীভাবে নেব, কী হবে তার লক্ষ্য-অভিলক্ষ্য, কী বিষয়ে লিখবো ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাকে খুব ভাবাতে শুরু করে, সেই দিনগুলোতে! নিজের মনের ভেতর আমি কিছু দ্বন্দ্বদীর্ণ অনুভূতির অস্তিত্ব অনুভব করি। প্রথম দ্বন্দ্বটি ছিল আমার আবেগ বা চিন্তার নিষ্কাশন আমি কীভাবে করতে চাই, এবং যে-রীতিতে তা করতে চাই সে-বিষয়ে আমি বুঝতে পারি আমার 'বিপক্ষে'র তিন বন্ধুর একক এবং সমবেত প্রভাবের অস্তিত্ব। আরেকটি অন্তর্গত দ্বন্দ্ব আমার ছিল তাহলো আমার লেখা বা ভাবনার সঙ্গে জীবিকার। আমি স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলাম জীবিকার দিক থেকে। সেদিন যেমন ভেবেছি, আজও ভাবি লেখকের পেশা বা জীবিকা একেবারেই স্বাধীন হওয়া উচিৎ, যা আমার পক্ষে পাওয়া বা নির্বাচন করা কঠিন ছিল। কারণ ছিল একাধিক, বিশেষ করে আমার পারিবারিক দায়িত্বটি ছিল আমাকে সেই পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। যে কোন চিন্তাশীল বা সৃষ্টিশীল লেখককেই ভিন্নভাবে সময় সাজিয়ে নিতে হয় লেখা বা সৃষ্টির জন্য, কিন্তু সেই লেখা বা সৃষ্টি থেকে যদি জীবিকার সংস্থান না হয়, তাহলে সংকট বা আরেক ধরনের দ্বন্দ্ব প্রায় অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমার ক্ষেত্রেও তা কিছুটা অনুভব করি সে সময়ে। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম স্বাধীনভাবে লেখার মাধ্যমে, কিন্তু পারিবারিক দায়িত্ব আমাকে নিরন্তর দুর্বল করে দেয় মানসিকভাবে। আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল, হয় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজের লেখকসত্তাকে বিকশিত করার চেষ্টা করা, নয়তো অন্তত বছর দশেক অপছন্দের জীবিকা গ্রহণ করে পারিবারিক কিছু দায়িত্বের ঘানি টেনে নিয়ে যাওয়া ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার কথা ভেবে। আমি দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেই। এর জন্য আমার গ্লানিবোধ যেমন ছিল, তেমনি মনের তৃপ্তিও কিছুটা ছিল! এসময়ই আমার বার বার মায়ের মুখখানা মনে পড়তো! এছাড়া আরেকটি বেদনাদায়ক দ্বন্দ্ব আমি নিজের মাঝে সারাক্ষণ অনুভব করতাম সেটি আমার ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে সমাজসত্তার দ্বন্দ্ব। সেসব দিনে বশীর আর জুবেরীর মতোই আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম যিনি লিখবেন, আঁকবেন বা গাইবেন, অর্থাৎ কোন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন বা সৃষ্টি সমাজবিচ্ছিন্ন কোন কাজ নয়। হয়তো আমার এই বন্ধুদের মতোই আমার সকল লেখা বা চিন্তা সমাজকে বাদ দিয়ে অর্গলবদ্ধ, অব্যক্ত, কিছুটা অসম্ভবও! আমাদের জীবন আমাদের সমাজের মতোই বিজীর্ণ, খণ্ডিত, চিন্তারহিত রয়ে যাবে, যদি তা সমাজের অসহায় অনাহারী মানুষগুলোর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে যায়! তাই এমন জীবন বা জীবিকা বেছে নিতে সিদ্ধান্ত নেই যা পরিপার্শ্বের হাওয়া এবং আকাশের ছবি ধারণ করে কিছুটা! কিন্তু সেখানেই আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হই, যা আমাকে একেবারে কুঁকড়ে দেয় মানসিকভাবে। এর ফলে অন্তর্গত দ্বন্দ্বটা আমার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়! এই দ্বিধাদীর্ণ দ্বন্দ্বরক্তিম মন নিয়ে চলতে গিয়ে হতাশা গাঢ়তর হয়, ভাবি শুধু 'মৃত্যুই' নিয়তি! তিমিরাচ্ছন্ন এক মন কিছুতেই এমন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না জীবনের, যা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! স্বপ্নগুলো দূর থেকে দূরতর হয়! নিছক কঙ্কালের মতো অন্বিষ্টহীন জীবন যা কিছুতেই কিছুকেই দীপ্ত করে না, আমার মনে আর সাড়া দেয় না কোন কল্পনা যা দিয়ে সৃজন করা যায় কিছু! হতাশাজর্জর হৃদয় গভীর রাতে কান্নার তোড় সামলাতে নির্ঘুম কাটায়! কিন্তু মন থেকে সেই স্বল্প সময়ের 'বিপক্ষে'র উদ্দাম উত্তেজনায় কম্পমান বন্ধুদের আশ্চর্য অদ্ভুত নিবিড়তাও ভুলতে পারে না, কে জানে এটাই ছিল হয়তো 'বিপক্ষে'র এবং সেই বন্ধুত্রয়ের আমার চেতানায় দীর্ঘমেয়াদী ছাপ, যা আমাকে কিছুটা স্বপ্ন দেখতে, কিছুটা লিখতে বা লেখা বিষয়ে ভাবতে শিখিয়েছিল সেই নিকষ অন্ধকার সময়ে, তাঁদের কিছুটা মানবিক মমতা দিয়ে! 'বিপক্ষে' ছিল স্বল্পায়ু, কিন্তু এর রেখে যাওয়া ছাপ, আমার ব্যক্তিগত জীবন এবং চেতনার ওপর প্রলম্বিত এক উজ্জ্বল রেখার মতো! তাই ভাবি, 'বিপক্ষে'র বন্ধুদের কেন যে বাসি এতো ভাল, 'সে- সত্য জানার আগে মিলনের মুহূর্ত ফুরাল,/শুরু হল দীর্ঘায়িত রাতি।'