এজাজ আহমদ এখন আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতির অংশ

গোলাম ফারুক খানগোলাম ফারুক খান
Published : 6 April 2022, 08:50 AM
Updated : 6 April 2022, 08:50 AM


গত ৯ মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে চোখে পড়ল প্রিয় বন্ধু অধ্যাপক আজফার হোসেনের পোস্ট। চোখ ঘষতে ঘষতে জানতে পারলাম, এই সময়ের এক তুখোড় জনবুদ্ধিজীবী এজাজ আহমদ আর নেই। গত দু বছরে পৃথিবী থেকে সওয়ারি বয়ে নিতে মৃত্যুর কালো উটের আনাগোনা এত বেশি দেখেছি যে, মানুষের প্রয়াণ-সংবাদ এখন প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এ কথা জানতাম, এজাজ আহমদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তবু তাঁর চলে যাওয়ার খবরটা শুনে বিমূঢ়, হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সারাদিন কাটল গভীর বিষণ্ণতায়।

এজাজ আহমদ আমাদের দেশে এত পরিচিত ছিলেন না। তাঁর চেয়ে অনেক বেশি পরিচিতি ও খ্যাতি নোম চমস্কি, এডওয়ার্ড সাইদ, গায়ত্রী স্পিভাক এবং অরুন্ধতী রায়ের। কারো সঙ্গে কারো তুলনা করব না, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে চিন্তার ভুবনে এজাজ আহমদ যে অবদান রেখে গেছেন তার ঔজ্জ্বল্য এবং স্থায়ী মূল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক অর্থনীতির অঙ্গনে বিস্তৃত। মতাদর্শগতভাবে মার্কসবাদী ছিলেন তিনি। নানা বিষয়ে যা বলেছেন, যা লিখেছেন তার সঙ্গে সবাই যে একমত হবেন তা নয়। অন্তত কিছু দ্বিমতের জায়গা তো থাকবেই। সেটা স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর। কিন্তু যাঁরা তাঁর সম্পর্কে জানেন তাঁরা হয়তো স্বীকার করবেন, তাঁর প্রতিটি লেখাই ছিল দারুণ স্বচ্ছ, সাহসী, তথ্য ও যুক্তিতে শানিত এবং চিন্তা-উদ্রেককারী। সব মিলিয়ে বলতেই হবে, তিনি সাম্প্রতিক পৃথিবীর একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিক ছিলেন।

এজাজ আহমদের জন্ম ১৯৪১ সালে, অবিভক্ত ভারতের মুজফফরনগরে। দেশবিভাগের পর তাঁর পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। তরুণ মার্কসবাদী এজাজ আহমদের পক্ষে পাকিস্তানে থাকাও সম্ভব হয়নি। শাসকদের হাতে নানারকম হয়রানির শিকার হয়ে আবার দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। ফিরোজ আহমেদ, একবাল আহমদ এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে মিলে নিউ ইয়র্কে 'পাকিস্তান ফোরাম' নামে একটি সাহসী জার্নাল প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালে এ জার্নালে তাঁরা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্যাতন ও গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন। উচ্চশিক্ষা শেষে এজাজ আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। জেনারেল জিয়াউল হকের উত্থানের পর সত্তর দশকের শেষদিক থেকে ধীরে ধীরে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে অবশিষ্ট যোগাযোগ ছিন্ন করেন এবং ১৯৮০ সালে ভারতে চলে আসেন। দিল্লিতে নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে প্রফেসারিয়াল ফেলো এবং জওয়াহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিটিকাল স্টাডিজ-এ ভিজিটিং প্রফেসার হিসাবে কাজ করেন। চেন্নাই থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত 'ফ্রন্টলাইন' পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জন্য স্থায়ীভাবে ভারতে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। অসুস্থ এজাজ আহমদের উন্নত চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় তিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান এবং ২০১৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আরভিং-এ তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে যোগ দেন।


ব্যক্তিগতভাবে আমি এজাজ আহমদের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও আলোকসঞ্চারী চিন্তার কাছে গভীরভাবে ঋণী। সত্তর দশকের শেষদিক থেকে তত্ত্ব ও চিন্তার অনেক নতুন স্রোত পৃথিবীতে এসেছে। মৌলিক ইংরেজি রচনা ও ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে তার কিছু কিছু আমরা জানতে পেরেছি। মাঝেমাঝে মুগ্ধ হয়েছি, মাঝেমাঝে বিভ্রান্ত ও বিচলিত হয়েছি, আবার মাঝেমাঝে নতুন ধারার কিছু তাত্ত্বিকের সঙ্গে মনে মনে তর্কে লিপ্ত হয়েছি। বিশেষ করে আমাদের অঞ্চলে এসব তত্ত্বকে যেভাবে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে নানা স্বার্থগোষ্ঠীর কূটচালের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে তা আলোর চেয়ে ধোঁয়াই সৃষ্টি করছে বেশি। সজাগ চেতনা ও প্রখর বিবেকের নিরিখে হালের এসব তত্ত্বের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এজাজ আহমদ।

'পোস্টকলোনিয়ালিজম' নামক প্রভাবশালী তত্ত্বের পথিকৃৎ হিসাবে খ্যাত এডওয়ার্ড সাইদের সাড়াজাগানো বই Orientalism (1978) যখন প্রথম পড়ি তখন নিঃসন্দেহে আলোকিত হয়েছিলাম। নতুন এক ভাবনাকাঠামোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আবার মনে প্রশ্নও জেগেছিল নানারকম। তারপর এ তত্ত্বের বিচিত্র এমনকি বিকৃত ব্যবহার দেখেছি। ১৯৯৪ সালে হাতে পেলাম এজাজ আহমদের বহুল-আলোচিত বই In Theory: Classes, Nations, Literatures. এখানেই পড়লাম সাইদের 'Orientalism' সম্পর্কে এজাজের দুর্ধর্ষ আলোচনা 'Orientalism and After: Ambivalence and Metropolitan Location in the Work of Edward Said.' সাইদ তাঁর বইয়ে খুব জোরালো যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রতীচ্যের জ্ঞান তার সাম্রাজ্যবিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। প্রতীচ্যের জ্ঞানস্পৃহা ও ভিন্ন জাতি-অধিজাতিকে শাসন-পীড়নের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্রও তিনি উদঘাটন করেছেন। সাইদ আরো দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতীচ্য নিজের স্বার্থে প্রাচ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, নিজের প্রাধান্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রাচ্যকে তার 'অপর' হিসাবে তুলে ধরেছে। প্রতীচ্যের দৃষ্টিতে প্রাচ্য অপরিণত, দুর্বল, হীনতর। পাশ্চাত্য জ্ঞান ও ক্ষমতার এই গাঁটছড়াকে বোঝাতে গিয়ে তিনি মিশেল ফুকোর ডিসকোর্সের ধারণাটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ প্রাচ্যবাদ একটি ডিসকোর্স। সাইদের মতে প্রতীচ্যের আধিপত্যবিস্তারের সহায়ক এই 'প্রাচ্যবাদী ডিসকোর্স' প্রাচীন গ্রিসের নাট্যকার ইস্কিলুস ও এউরিপিদেস থেকে শুরু করে মধ্যযুগের রোমান কবি দান্তে আলিগিয়েরি এবং উনিশ শতকে কার্ল মার্কস হয়ে আধুনিক কালের প্রাচ্যবিদ বার্নার্ড লুইস পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন মহাজনদের সাহিত্যকর্মেও তিনি প্রাচ্যবাদের বীজ খুঁজে পেয়েছেন। সেসব রচনায়ও এশিয়ার কোনো স্বাধীন সত্তা এবং কণ্ঠস্বর নেই; ইওরোপ এশিয়াকে জয় করছে, নির্মাণ করছে, তার হয়ে কথা বলছে।

বিভিন্ন জ্ঞানক্ষেত্রকে যুক্ত করে, অসংখ্য টেক্সটের সমুদ্রমন্থন করে সাইদ যে একটি সর্বস্পর্শী, ত্রিকালবিস্তৃত আখ্যান গড়ে তুলেছিলেন, এজাজ আহমদ তার অভিনবত্ব স্বীকার করেছেন। তিনি উল্লেখ করতে ভুলেননি যে, এ কাজ করতে গিয়ে সাইদকে নগ্ন জায়নবাদী আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। পাশাপাশি এজাজ সাইদের কাজের বিভিন্ন পদ্ধতিগত ও মতাদর্শিক ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সাইদ যেভাবে প্রাচ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন তার মধ্যে কিছু অসংগতি রয়েছে বলে এজাজের ধারণা। বিশেষ করে যে পদ্ধতিতে সাইদ ইওরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট ও উপনিবেশবাদের কালপর্বকে ছাড়িয়ে প্রাচ্যবাদের সীমা সুদূর অতীতের ইওরোপে টেনে নিয়ে গেছেন তার মধ্যে এজাজ একটি অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মতে এভাবে ইওরোপকে দেখলে সেখানে একটি স্থির, অপরিবর্তনীয়, কালাতিক্রমী সারসত্তা আরোপ করা হয় যা সর্বযুগেই অভিন্ন ও সমরূপ। কিন্তু ইতিহাসের বিকাশধারার সঙ্গে এই অবলোকন মেলে না। এখানে প্রতীচ্যের কথিত প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাইদের নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য গুলিয়ে যায়। কারণ, সাইদের ভাষ্যমতে প্রতীচ্যও তো প্রাচ্যকে এক নিকৃষ্ট, একক, নিশ্চল, অপরিবর্তনীয় সারসত্তার আধার হিসাবেই দেখে। এভাবে এই দুই বীক্ষণ এক বিন্দুতে মিলে যায়। এই বিবেচনায় এজাজ সিরীয় চিন্তাবিদ সাদেক আল-আজমের অনুসরণে এডওয়ার্ড সাইদকে 'উলটো-ধারার প্রাচ্যবাদে'র প্রবক্তা হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। সাইদের বিচারপদ্ধতি প্রাচ্যকে প্রতীচ্যের নিষ্ক্রিয় ক্রীড়নক হিসাবে চিত্রিত করেছে বলেও এজাজ দেখিয়েছেন। যেন প্রাচ্যের কোনো কর্তাসত্তা নেই, কখনো ছিল না। যেন প্রাচ্যের মানুষ চিন্তা করেনি, নিজেরা নিজেদের কথা বলেনি, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি।


Orientalism প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রতীচ্যের বিদ্যায়তনে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এই জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবের পটভূমিও এজাজ তাঁর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। বলব না যে, এজাজের সব কথা তর্কাতীত। বস্তুত ইতিমধ্যে অনেক ঝাঁজালো বিতর্কও হয়ে গেছে তাঁর এই প্রবন্ধ নিয়ে। কিন্তু আমি নিজের বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব পেয়েছি তাঁর লেখায়।

এডওয়ার্ড সাইদ সম্পর্কিত আলোচনা ছাড়াও আরো অনেক জরুরি বিষয়ে তাঁর নির্মোহ বিশ্লেষণ এখানে স্থান পেয়েছে। এই সময়ের বিভিন্ন মনন-প্রবণতার উৎস ও স্বরূপ, সাহিত্যতত্ত্ব ও 'তৃতীয় বিশ্বে'র সাহিত্য,সালমান রুশদির Shame ও পোস্টমডার্ন অভিবাসিতা, ভারতীয় সাহিত্য, ভারত সম্বন্ধে মার্কস — এগুলি এ বইয়ের অন্যান্য প্রসঙ্গ। আরেক বিখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমিসনের সঙ্গে নিজের কিছু ভিন্নমতও এজাজ খুব জোরালোভাবে ব্যক্ত করেছেন। জেমিসনের একটি বহুল-আলোচিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট অনিবার্যভাবে ন্যাশনাল অ্যালেগরি বা জাতীয় রূপক। এজাজের মতে এই সিদ্ধান্ত ত্রুটিপূর্ণ। তৃতীয় বিশ্ব বলতে জেমিসন এখানে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও তখনকার সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বাইরে সেইসব দেশকে বুঝিয়েছেন যারা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণের শিকার। কেবল সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়নের আয়নায় এইসব দেশের বাস্তবতাকে দেখতে চেয়েছেন বলে জেমিসন তাদের সব আখ্যানকেই জাতীয়তাবাদী চেতনার অভিপ্রকাশ বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু আসলে এই দেশগুলির আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা অনেক জটিল। জাতীয় মুক্তি ছাড়াও শ্রেণি, লিঙ্গ, বর্ণ, অঞ্চল ইত্যাদি পরিচয়কে কেন্দ্র করে বহুবিধ দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে সে বাস্তবতা নির্মিত। ফলে মানুষের চেতনাও বিচিত্র ও বহুবর্ণ। এই বহুস্তরীয় চেতনার প্রকাশে সাহিত্য-সংস্কৃতিও বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাই তাকে শুধু জাতীয় রূপক হিসাবে আখ্যায়িত করলে তার বহুমাত্রিকতাকে উপেক্ষা করা হয়।


এজাজ আহমদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই Lineages of the Present: Political Essays অনেক জরুরি বিষয়ে আমাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। এ বইয়ে তিনি পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জীবন ও কাজ, উর্দু সাহিত্যে জাতি ও সম্প্রদায়, ফ্যাশিবাদ ও জাতীয় সংস্কৃতি, আন্তোনিও গ্রামশি, জাক দেরিদার মার্কস-ভাবনা, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিশ্লেষণী আলো ফেলেছেন। উল্লেখ করা দরকার, এজাজ আহমদ উর্দু ভাষার একজন কবি এবং ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত তিনি মূলত উর্দুতেই লেখালেখি করতেন। ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই Ghazals of Ghalib (1971) মির্জা গালিবের বেশ কিছু গজলের অনুবাদ ও হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপন। তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে On Communalism and Globalization: Offensives of the Far Right (2002), Iraq, Afghanistan and the Imperialism of Our Time (2004), In Our Time: Empire, Politics, Culture (2007) এবং Nothing Human is Alien to Me (2020).

১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত 'Colonial and Post-Colonial Encounters' শীর্ষক এক সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে এজাজ ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা একাডেমিতে তাঁর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ ও উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। সে বক্তৃতার বিষয় ছিল 'The Future of English Studies in South Asia' মনে পড়ে, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কবি কাশীনাথ রায়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়ে কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। আরেকটি মূল্যবান বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের অফিসে। সেই ছোট অফিস উপচে-পড়া মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁর কথা শুনেছিলেন। অনুষ্ঠানে লেখক শিবিরের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আজফার হোসেনের তেজোদৃপ্ত স্বাগত ভাষণটিও এখনো আমার কানে বাজে।

অসুস্থ থাকায় গত কয়েক বছর ধরে এজাজ আহমদের লেখালেখি অনিয়মিত ছিল। এর আগে তিনি 'ফ্রন্টলাইন,' 'সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট,' 'মার্কসিস্ট' 'সোশ্যালিস্ট রেজিস্টার' ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ২০০০ সালে, বিশ শতক শেষ হওয়ার আগে আগে, প্রায়-অতিক্রান্ত শতাব্দীর মূল্যায়ন করে তিনি 'A Reflection on Our Times' শিরোনামে এক অসাধারণ প্রবন্ধ-সিরিজ রচনা করেছিলেন। এই সিরিজের প্রতিটি প্রবন্ধই অনেক নতুন তথ্য এবং বিরল মনস্বিতায় ঋদ্ধ। বিশ শতকের বিশ্ব-রাজনীতি ও সংস্কৃতির একটি চকিত কিন্তু মূল্যবান মানচিত্র তিনি এখানে এঁকেছিলেন। জানি না এই লেখাগুলি কোনো বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিংবা হচ্ছে কি না। বিশেষভাবে উল্লেখ না করে পারছি না 'Resources of Hope' শিরোনামে শেষ প্রবন্ধটির কথা। এখানে তিনি ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক গতিধারা পর্যালোচনা করেছেন এবং দুনিয়াজুড়ে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় সত্ত্বেও মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে মননচর্চায়, মার্কসবাদের দুর্মর প্রভাবের কথা বলেছেন। তাঁর লেখা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না:
Cultural theory is today the most influencial discipline, but virtually all the commanding figures whom the discipline invokes were Marxists or at least very deeply involved in Marxism: Lukacs, Gramsci, Voloshinov, Benjamin, Goldmann, Althusser, Raymond Williams, E. P. Thompson, Stuart Hall and several others. Poststructuralism which is the other pole within cultural theory, is dominated by Derrida, a student of Althusser whose professed affiliation with Marxism is so pronounced that he claims that his Deconstruction itself is nothing but a further 'radicalisation' of Marxism, and Foucault, another student of Althusser who maintains a much more ambivalent relationship with Marxism but is on record saying, in a public interview, that entire passages in his work have been lifted out of Marx but his readers do not realise it because he does not put them in quotation marks…Much of the power of Marxism in academic life itself is owed to its magisterial explanatory power…The life of the mind in the 20th century, even the bourgeois mind, has a peculiar fascination with Marxism because its explanatory power overwhelms even those who live in constant dread of the politics which follows from these explanations.

ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতত্ত্বের যেকোনো সম্পাদিত সংকলন হাতে পেলেই আমি সূচিপত্রে এজাজ আহমদের নাম খুঁজতাম। নিয়মিত চোখ রাখতাম 'ফ্রন্টলাইনে'র পাতায়। তাঁর লেখা দেখলেই এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠত। এই মানুষটির চিরবিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার এই উৎসুক অন্বেষণও শেষ হয়ে গেল।

ইতিহাসের যে জাগ্রত স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বাঁকাচোরা পথ বেয়ে বিশ শতক এসে একুশ শতকে মিলেছে, তার তীক্ষ্ণ ব্যবচ্ছেদ শেষে 'Resources of Hope' প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন: Where, then are the resources of hope? First of all, in remembrance…it is in such periods that resistance reflects upon its own past, experiments with new forms, accumulates new experiences, works towards historically new forms for a fresh breakthrough…That, then, is the first resource of hope: memory itself. স্মৃতি থেকে — পরাজয় এবং বিজয়ের স্মৃতি থেকে, বিপর্যয় এবং বার বার ঘুরে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ আহরণ করবে আশা, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। স্মৃতি মানুষের পরম সম্পদ। আজ সংকটদীর্ণ, যুদ্ধোন্মত্ত পৃথিবীর এক রক্তগোধূলিতে দাঁড়িয়ে তাঁর এই প্রজ্ঞাদীপ্ত বাণী বিশেষভাবে মনে পড়ছে।

এজাজ আহমদ, আপনি এবং আপনার কাজও এখন আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতির অংশ। আমাদের স্মৃতিতেই আপনি বেঁচে থাকবেন এবং আশা ও সাহস যোগাবেন। আপনিও আজ আমাদের আশার নির্ভর।