সমকালীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেমিনার

প্রমা সঞ্চিতা অত্রি
Published : 24 Oct 2010, 01:15 PM
Updated : 24 Oct 2010, 01:15 PM


ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সেমিনার: সৃজনে ও মননেঃ সমকালীন বাংলা সাহিত্য

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির 'ইংরেজী ও মানববিদ্যা' বিভাগ ২৯ ও ৩০ জুলাই ২০১০, এই দু'দিন বাংলা সাহিত্য নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করে। "সৃজনে ও মননে: সমকালীন বাংলা সাহিত্য" শীর্ষক এই সেমিনারে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের অংশগ্রহণের কারণেই সম্ভবতঃ আয়োজকগোষ্ঠী একে সমকালীন বাংলা সাহিত্য বিষয়ে 'আন্তর্জাতিক' সেমিনার বলেছেন। এই সেমিনারে বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষার বিভিন্ন সাহিত্যিক তাঁদের নিজ নিজ কবিতা, গল্প পড়ে শুনিয়েছেন। আলোচকগণ এই সময়ের বাংলা কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এতে সমকালীন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কতটা স্পষ্ট হওয়া গেছে সেটা পরিষ্কারভাবে বলা না গেলেও বাংলাদেশ ও ভারতের এই সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সমকালীন বাংলা সাহিত্যকে কীভাবে অনুধাবন করছেন এবং সাহিত্য উৎপাদন করছেন সেটা উঠে এসেছে। প্রমা সঞ্চিতা অত্রি সেমিনার চলাকালীন দু'দিন সেখানে উপস্থিত থেকেছেন।-বি.স.

প্রথম দিন

২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ইনডোর গেম্স রুমে এক ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুই দিন ব্যাপী এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও

মানববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম এবং বিশেষ বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আইনুন নিশাত। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রাইম ব্যাংক লিঃ-এর সভাপতি আজম জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। সবশেষে বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মোট তিনটি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সেমিনারের প্রথম দিনের কার্যক্রম।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দিতে আসেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতেও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বলে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "আজকাল পাবলিক ভার্সিটির মতো আমাদের প্রাইভেট ভার্সিটির ছেলেমেয়েরাও যে বাংলা সাহিত্যের দিকে ঝুঁকছে এটি সত্যিই আশার কথা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে আজকের এই সেমিনারের মধ্য দিয়ে তা আরও বিকশিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। এর আগেও আমরা আরও তিনটি সফল সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছি।

এটি হচ্ছে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত চতুর্থ সম্মেলন। কয়েক বছর যাবৎ ইংরেজী ও মানববিদ্যা বিভাগ প্রতি বছর জুলাই থেকে একটা করে সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে। প্রথম আয়োজনটি ছিল শেক্সপিয়ারিয়ান সাহিত্য নিয়ে আর ২য় বারের অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল 'ক্যারিবীয় সাহিত্য'। তৃতীয় সাহিত্য সম্মেলনটি হয়েছিল শিশু সাহিত্যের উপর। কিন্তু এবারই প্রথমবারের মত একটি পূর্ণাঙ্গ ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ। এরপর আমাদের লক্ষ্য থাকবে, প্রতি দুই বছর অন্তর যেন এরকম একটা সম্মেলনের আয়োজন করতে পারি।"

এরপর মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। সাহিত্যে সমকালীনতার মানদণ্ড নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। তিনি বলেন, "সমকালীনতা আসলে এমন এক আপেক্ষিক বিষয় যা নির্ণয় করা খুব কঠিন। সমকালীন বাংলা সাহিত্য যে আসলে কোন সময়কার সাহিত্য তা বলা খুব মুশকিল! কেউ হয়ত বলবে, আজকে এই মুহূর্তে যে সাহিত্য রচিত হচ্ছে তাই সমকালীন সাহিত্য আবার কেউ হয়ত বলবে '৪৭ সাল অর্থাৎ দেশবিভাগ পরবর্তী যে সাহিত্য তাই-ই সমকালীন সাহিত্য আবার কেউ হয়ত '৭১ পরবর্তী সাহিত্যকে সমকালীন সাহিত্য বলে অভিহিত করবেন। এরকম বিভিন্ন মত আসাটা স্বাভাবিক। তবে দশক-ওয়ারী ভাবে সাহিত্যের বিভাজনটা চলে আসছে অনেক দিন ধরেই। যেমন ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই কিংবা শূন্য দশক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নানা আঙ্গিক থেকেই সমকালীনতা ধরা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে 'সৃজনে ও মননে: সমকালীন বাংলা সাহিত্য' এখানে আমরা সমকালীন বাংলা সাহিত্য বলতে কোন সময় থেকে কোন সময় অব্দি সাহিত্যগুলোকে ধরব? ব্যাপারটা আমার কাছে একটু গোলমেলে ঠেকছে! অবশ্য আজকাল আবার অনেক রকম তত্ত্ব-টত্ত্ব আছে, সাহিত্যে সমকালীনতার কী কী সব সংজ্ঞা-টংজ্ঞাও আছে বলে শুনেছি! এটা সেরকমই একটা কিছু হবে হয়ত, আমি ঠিক জানি না।

আবার বাংলাসাহিত্য নিয়েও অনেক রকম হ্যাপা আছে। বাংলা সাহিত্য বলতে আমরা কি বাংলাদেশের সাহিত্যকে বোঝাব নাকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকে বোঝাব নাকি পূর্ব-পশ্চিম দুই বাংলার সাহিত্যকেই বোঝাব? আবার বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে বাংলাভাষায় রচিত বহু গান কবিতা রয়েছে, বাংলা সাহিত্য বলতে বলতে কি আমরা সেগুলোকেও বোঝাব নাকি বোঝাব না? ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়। যাক সেসব কথা, একটা বিষয়ে সকলেই নিশ্চয় একমত হবেন যে '৪৭ সালের পর থেকে আমাদের বাংলা সাহিত্যে কিন্তু বিভাজন এসে গেল। ভাষা এক থাকলেও সাহিত্যের হেঁসেল হয়ে গেল আলাদা! আমরা যতই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে মরি, দু' দেশের মাঝে যে সীমানারেখা তার দাগ অত সহজে ওঠে না। তাই আমরা না চাইলেও পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাজনটা রয়েই যাচ্ছে। কিন্তু তা বলে কি বাংলা সাহিত্যকে আমরা দু'টো ভাগে ভাগ করে ফেলব? প্রশ্নই ওঠে না। আমরা কি বলব রবীন্দ্রনাথ আমাদের কবি নন কিংবা ওরা কি বলবে মাইকেল তাদের কবি নন? কখনোই নয়। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে 'আলাদা ও এক'। অর্থাৎ আমাদের প্রস্তুতকৃত খাদ্য এক, কিন্তু হেঁসেলটা ভিন্ন।"


হাসান আজিজুল হক, দেবেশ রায় ও অন্যান্য, সেমিনারের দুই পর্বের মাঝের নাস্তা বিরতি

এরপর তিনি একে একে বিভিন্ন যুগে বাংলা সাহিত্যের রূপান্তর তথা সংযোজন কিংবা বিয়োজন এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
সবশেষে তিনি তাঁর একটি ব্যক্তিগত মতামত পেশ করেন। তিনি বলেন, "তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ভাষার ব্যাপারটা এতটাই স্বতন্ত্র যে এ নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। ভাষাকে চাইলেই অনেক বিশাল করে নেয়া যায় আবার প্রয়োজন মতো ছোট করেও নেয়া যায়। তর্ক যদি করতেই হয় তবে করা উচিৎ একটি জাতির আদর্শ ও কর্ম নিয়ে। মনোযোগ যদি দিতে হয় তো ওখানেই দিন। কেননা, নিষ্কর্মা জাতি তো নিষ্কর্মা ভাষা আর সকর্মা জাতি তো সকর্মা ভাষা! ধন্যবাদ সবাইকে।"

এরপর ডঃ আইনুন নিশাত, আজম জাহাঙ্গীর চৌধুরী, মোহাম্মদ মাহমুদুল হক তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সবশেষে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটি।


সেমিনারে শ্রোতা ও অংশগ্রহণকারীগণের একাংশ

১ম অধিবেশন: অনুবাদ সাহিত্য

আধঘণ্টা চা বিরতির পর সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বসে বেলা ১২টায় ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনডোর গেম্স রুমে। বিষয় ছিল 'অনুবাদ সাহিত্য'। অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ফকরুল আলম, বক্তব্য পাঠ করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সাজ্জাদ শরিফ ও রফিক-উম-মুনির চৌধুরী। অনুবাদকদের নানা রকম দুর্দশার কথা রফিক-উম-মুনির চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "বাংলাদেশে অনুবাদকেরা ভালো অবস্থায় নেই। দেশে যেমন ভাল অনুবাদকের অভাব তেমনি ভাল অনুবাদকের প্রকৃত মূল্যও কেউ দিতে চায় না। তাদের অনুবাদ কর্মগুলোর সহজে স্বীকৃতি মেলে না। প্রকাশকেরা নানারকম টাল-বাহানা করেন। ফলে ভাল অনুবাদক যারা তারা কাজ করতে উৎসাহ পায় না। কিন্তু বাজারে অনুবাদের অনেক চাহিদা থাকায় আজকাল বেশ কিছু ভূঁইফোড় অনুবাদক তৈরি হচ্ছে। যাদের ভাষা ও কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার কখনো দেখা যায়, কোন বড় লেখকের বই হুবহু অনুবাদ করে নিজের নামে ছেপে দেন কিছু তথাকথিত অনুবাদক। এ বিষয়গুলো আমাদের দেশে ভাল অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।"

এরপর তিনি অনুবাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা করেন। অনুবাদ নিয়ে তার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথাও ব্যক্ত করেন। সবশেষে তিনি বলেন, "সর্বোপরি আমি বলতে চাই প্রতিটি অনুবাদক একজন বিশ্বাসঘাতক! অনুবাদকের কাজই হচ্ছে একজন সাহিত্যিকের গচ্ছিত ধনকে নিজের মত ব্যবহার করে উপস্থাপন করা। কিন্তু তারপরও অনুবাদের এত চাহিদা। মানুষ চায় বিদেশি মানুষের মনের কথা জানতে তাঁদের সাহিত্য পড়তে যার জন্য মানুষ মুখাপেক্ষী হয় অনুবাদকের। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনুবাদক নরমান টমাস ডিজিওভান্নি সম্পর্কে এক লেখায় লেখক বন্ধু রাজু আলাউদ্দিন যে কথা বলেছিলেন সেটা এই প্রসঙ্গে খুবই যথার্থ। তাঁর ভাষায় বলা যায়, "অনুবাদক হচ্ছেন একজন বিশ্বাসঘাতক পরম বন্ধু!"

………
সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন দেবেশ রায়
………

এরপর অনুবাদ সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আহ্বান করা হয় সাজ্জাদ শরিফকে। তিনি আলোচনা করেন কবিতা অনুবাদ প্রসঙ্গে। তার বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল:

'প্রথমেই বলে রাখা ভাল আমি কবিতা লিখি, আমি কোন পেশাদার অনুবাদক নই। কিন্তু গত তিরিশ বছর ধরে আমার লেখা যত কবিতা আছে, তার চেয়ে আমার অনুবাদ কবিতার সংখ্যাই বেশি হয়ে গেছে।… আমি আজ পর্যন্ত যত কবিতা অনুবাদ করেছি, তার মাঝে অনুরুদ্ধ হয়ে খুব কম কবিতাই লিখেছি। অধিকাংশ কবিতাই লিখেছি অনুপ্রাণিত হয়ে। অনুবাদকদের নিয়ে তো অনেক রকম কথাই প্রচলিত আছে। যার কিছু কিছু রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী বলে গেছেন। আরও কিছু আছে যেমন, কবিতা অনুবাদ করার সময় যা হারিয়ে যায় তাই-ই কবিতা! আবার উল্টা কথাও আছে। সেটা হচ্ছে অনুবাদ করার পর যা টিকে থাকে সেটা হল কবিতা। সে যাই হোক আমাদের বাংলা সাহিত্যের একজন সু অনুবাদক ও কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন যে, যেহেতু অনুবাদের ক্ষেত্রে কনটেক্সট বা আধেয়টা আগেই দেয়া থাকে তাই অনুবাদকের জন্য এটা একটা শৈল্পিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কবিতার 'আধেয়'টা কী? ডিমের খোসাটাকে না ভেঙে কুসুমটাকে কী করে বের করে আনা যায়? কাউকে যদি কোনো গল্প সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় যে, গল্পটি কেমন কিংবা গল্পের 'আধেয়'টা কী? তখন হয়ত সে উত্তরে গল্পের একটা ছোট সামারি দিবে। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে সেটা কী করে সম্ভব। কাউকে যদি বলা হয়, জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কবিতার কনটেক্সটটা কী, তখন কি সে বলবে যে, ভদ্রলোক হাজার বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, অতঃপর নাটোরে এক মহিলার সাথে দেখা হয়েছে কিংবা এরকম? কখনোই তা নয়। সুতরাং কবিতার 'আধেয়' বলে তো আসলে কিছু নেই। কিংবা থাকলেও সেটা অনেকটাই অনুভূতির ব্যাপার কিংবা বলা যায় বিমূর্ত একটা কনসেপ্ট। সুতরাং আমার মতে কবিতার অনুবাদ এক কথায় অসম্ভব।'

এরপর মঞ্চে আহ্বান করা হয় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনুবাদ সাহিত্যের বিভিন্ন দিক তথা অনুবাদের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা করেন। তার বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল:

"অনুবাদ সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটি বলতে হয় তা হল অনুবাদ কোন নিষ্পাপ কর্ম নয়। এর পেছনে রয়েছে অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় ইস্যু, শোষণ ও ক্ষমতা লাভের অভিপ্রায়, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। যেমন, ইংরেজিতে অনূদিত না হলে কোনো সাহিত্যকর্ম, তা সে যত উচ্চমার্গেরই হোক না কেন, নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত পায় না। এ কারণে কোনো বাংলা সাহিত্যের ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া মানে আমাদের কাছে এক বিশাল ব্যাপার। কিন্তু হিন্দি, উর্দু কিংবা ওড়িয়া ভাষায় হওয়াটা তেমন বড় কিছু নয়।

তেজস্বিনী নিরঞ্জনা অনুবাদকে একটা ঔপনিবেশিক হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেছেন। কলোনিয়াল পিরিয়ডে অনুবাদকে ঔপনিবেশিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে। সেসময় দেখা গিয়েছে শাসক প্রভুদের ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো উপনিবেশিত দেশগুলোর উপর একরকম আরোপিত হয়ে গিয়েছিল। আরও উদাহরণ রয়েছে। যেমন, রবিনসন ক্রুশোর মূল বইতে ক্রুশো ফ্রাইডেকে যা বলে অনুবাদ করার সময় কিন্তু তা হুবহু লেখা হয় নি। অনুবাদক অনেক কথা বাদ দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ ক্রুশো ও ফ্রাইডের কথোপকথনে এমন কিছু বিষয় ছিল যাতে রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে তাই সে কথাগুলো বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখানে অনুবাদক একজন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। আমার মনে হয় এ বিষয়গুলোর প্রতি অনুবাদকের দৃষ্টি দেয়া উচিৎ।

অনুবাদ সাহিত্যের আরেকটি স্পর্শকাতর দিক হল সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। রবীন্দ্র অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচি অনুবাদ করার সময় রবীন্দ্রনাথের বনমালী চরিত্রটিকে মেয়ে হিসেবে উপস্থাপন করেন। কারণ হিসেবে তিনি যুক্তি দেখান ভারতবর্ষে মেয়েদের নামের শেষে 'ঈ' যুক্ত থাকে। তাই বনমালীকে তিনি মেয়ে ভেবেছেন! এইভাবে তিনি 'কাঁটামারা বুট'-এর অনুবাদ করেছেন 'throne crushing boot'! কাজেই সাংস্কৃতিক ফাঁক থাকলে অনুবাদ তার মূল্য হারায়। যে কারণে শামসুর রাহমান রবার্ট ফ্রস্টের যে কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন সেগুলো সকলের ঠিক হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠতে পারেনি।"

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সম্মেলনের প্রথম দিনের প্রথম অধিবেশন।

২য় অধিবেশন: নাটক

মধ্যাহ্নভোজন শেষে দুপুর ২:৩০-এ ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জিডি এল এন সেন্টার রুমে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। অধিবেশনের বিষয় ছিল নাটক। আমন্ত্রিত নাট্য গবেষকবৃন্দ ছিলেন: সাইমন জাকারিয়া, আরিফ হায়দার ও অধ্যাপক আফসার আহমেদ। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন রামেন্দু মজুমদার। সাইমন জাকারিয়া, আরিফ হায়দার ও আফসার আহমেদ প্রত্যেকেই একে একে নাটক নিয়ে তাঁদের চিন্তা ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন।

প্রথমেই বক্তব্য উপস্থাপন করেন সাইমন জাকারিয়া। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা নাম না জানা হরেক রকম নাচ, নাটক ও উৎসবের খোঁজ করেছেন তিনি। সেরকমই কিছু অনুষ্ঠানের সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন তিনি। স্ক্রিনের মাধ্যমে তাঁর সংগৃহীত অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্রও দেখান। এগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল নেত্রকোণা অঞ্চল থেকে ধারণকৃত ১৮জন বিষাদসিন্ধু বয়াতির গান, মানিকগঞ্জের গাজীর যাত্রা, নড়াইলের শ্রাবণ সংক্রান্তি, অষ্টক গানের আসর, টাঙ্গাইলের হরগৌরি নৃত্য, পরীর নাচ (পার্বতীর রূপ ধরে নৃত্য), লাঠিনৃত্য, বহুরূপী নৃত্য ইত্যাদি। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পরীর নাচ। এই নাচের প্রধান অংশ হচ্ছে একজন পুরুষ শাড়ি পড়ে ঘোমটা টেনে ও মুখে রঙিন কাগজের মুখোশ লাগিয়ে পার্বতী অর্থাৎ দুর্গা প্রতিমা সাজে এবং ধূপ-ধূনা হাতে নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে সে অজ্ঞান হয়ে গেলে সবাই ধরে নেয় তার উপর দেবী ভর করেছে। তখন সবাই মিলে তাঁর আরাধনা করে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই উৎসবগুলোর অধিকাংশ হিন্দু ধর্মের আচরিত বিষয় হলেও এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীর বেশিরভাগই গ্রাম বাংলার সাধারণ মুসলিম জনগণ।

এরপর বক্তব্য উপস্থাপন করেন আরিফ হায়দার। বাংলা নাটকের ইতিহাস বর্ণনা করেন তিনি। বাংলা নাটকের উত্থান, বিকাশ এবং বর্তমানে এর কী অবস্থা তা নিয়ে আলোচনা করেন। সমকালীন বাংলা নাটকের (মঞ্চ ও টিভি) দুর্দশা, প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেন।
সবশেষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্বের অধ্যাপক আফসার আহমেদ। তিনি নাটকের বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে বক্তব্যের বিষয় হিসেবে মারমা নাটককে বেছে নেন। তিনি মারমা নাটকের বিভিন্ন শাখা যেমন জ্যা, কড়ি, গেংখুলি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন এবং সেই সাথে তাঁর সংগৃহীত মারমা পালার ভিডিও প্রদর্শন করেন। মারমা নাটকের পাশাপাশি তিনি অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর নাট্যচর্চার উপরেও আলোকপাত করেন। সবশেষে একটি ছোট প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ অধিবেশন।


সেমিনারে গাজীর যাত্রা প্রদর্শনী

তৃতীয় অধিবেশন: কবিতা ও পাঠ

প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনটি ছিল, 'কবিতা ও পাঠ'। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ তলার সেমিনার রুমে কিছুটা ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে শুরু হয় এ অধিবেশনটি। এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত কবিরা পাঠ করে শোনান তাঁদের কবিতা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনের দায়িত্বে ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁর অনুপস্থিতিতে কবি মাকিদ হায়দারের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় শুরু হয় কবিতা পাঠের আসর।

এ অনুষ্ঠানে নির্বাচিত কবিবৃন্দ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ফিরদৌস আজিম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ। একে একে কবিতা পাঠ করে শোনান লাভলী বাসার, তুষার দাশ, শিহাব সরকার, আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ সাদিক, কবির হুমায়ূন, আসাদ মাহমুদ, শামীম রেজা, মাকিদ হায়দার, উম্মে মুসলিমা, রিয়াজুল হোসেন, পাপড়ি রহমান, কামাল চৌধুরী, ওবায়েদ আকাশ, জুয়েল মুস্তাফিজ, ফরিদ কবির, সাখাওয়াৎ টিপু, মনি হায়দার, জাফর আহমেদ রাশেদ, মারজুক রাসেল, আফরোজা সোমা ও আরও অনেকে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, চিরঞ্জীব বসু এবং ত্রিপুরা থেকে আগত কবি কুমার চক্রবর্তী।


সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন আরিফ হায়দার

দ্বিতীয় দিন

৩০ জুলাই, শুক্রবার ছিল সম্মেলনের ২য় দিন। দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনের নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১০টা। কিন্তু পোশাক শ্রমিক বনাম পুলিশ সংঘর্ষের কারণে রাস্তা বন্ধ থাকায় আমন্ত্রিত অতিথিদের আসতে কিছুটা দেরি হয়। ফলে বেলা ১১টা নাগাদ শুরু হয় প্রথম অধিবেশন। অধিবেশনের বিষয় ছিল: 'কথাসাহিত্য'। অনুষ্ঠানে সভাপতির ভূমিকা পালন করেন কথাসাহিত্যিক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রশান্ত মৃধা, ওয়াসি আহমেদ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় ও কিন্নর রায়।

প্রথম অধিবেশন: কথাসাহিত্য

শুরুতেই বক্তব্য দেন প্রশান্ত মৃধা। ৫০-এর দশক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলা ছোটগল্পে বাঁক পরিবর্তনের যে ধারা তা তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাঝে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের কিছু বিশেষ অংশ উদ্ধৃত করা হল:

"… পঞ্চাশ থেকে শুরু করে এই আশির দশকের লেখক প্রত্যেকেই আমরা সমকালীন। সমকালীনতাকে চিহ্নিত করার এছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কিন্তু এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় পঞ্চাশ থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যে বৈচিত্র্যময় পথযাত্রা তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাই আমি আমার আলোচনা স্বাধীন বাংলাদেশের ছোট গল্পে স্থির রাখতে চাই।…

আমার মনে হয় ছোটগল্প উপন্যাস কিংবা সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমগুলোর মত অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে পারেনি বলেই হয়ত আজ বড় বড় লেখকেরা এ মাধ্যম হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এ কথা তো সত্যি যে মানুষের জীবনে এমন সূক্ষ্ম কিছু অনুভূতি আছে তা একমাত্র ছোটগল্পেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, উপন্যাসে নয়।

বর্তমানে আমরা যারা ছোটগল্প লিখে থাকি তাদের ক্ষেত্রে একটা কথা খুব খাটে – তা হল, প্রত্যেকেই আমরা স্বতন্ত্র। জাকির তালুকদার কিংবা শাহনাজ মুন্নীর সাথে মেলে না অদিতি ফাল্গুনী কিংবা উম্মে মুসলিমার। আবার পাপড়ি রহমানের সাথে মিলে না নাসিমা বানুর লেখা। এটাই হল সবচেয়ে আনন্দের কথা।"

প্রশান্ত মৃধার পর বক্তব্য উপস্থাপন করেন ওয়াসী আহমেদ। তিনিও তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য বাংলা গল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল, "আমার ভাষা কিছুটা খটোমটো। তাই সেটার পাঠ আমার পক্ষেই একটু দুরূহ! কারও যদি তা বুঝতে অসুবিধা হয় তবে আমি নিরুপায়।" শুরুতেই নিজের জটিল ভাষাপ্রয়োগের ব্যাপারে এভাবেই অবহিত করে নেন তিনি।

এরপর তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। "আমার কাছে বাংলাদেশের গল্প মানে বাংলাদেশেরই গল্প। বর্তমানে বাংলা গল্পের যে পরিসর তাতে তাকে স্বতন্ত্র বলা যেতেই পারে। গল্প হচ্ছে সাহিত্যের একটি শিশু শাখা। এর পরিসর যেমন বিস্তর, তেমনি স্বভাবে তা অস্থির প্রকৃতির। হিসেব-নিকেশ মিলিয়ে এ কথা বলা যায় যে, বাংলা ছোটগল্পের বয়স প্রায় এক শতক অর্থাৎ একশ বৎসর অতিক্রম করেছে আমাদের বাংলা গল্প। এই অস্থির ও অপেক্ষাকৃত শিশু শাখার জন্য একশ বছর ধারণ করা কিন্তু কম কথা নয়। এই এতটুকু শরীরে একশ বছরের ওজন বোধকরি নিতান্তই কম নয়। আমার এ একশ বছরের মধ্যে যে জিনিসটি খুব প্রনিধানযোগ্য বলে মনে হয় তা হল, গল্পকে গল্পের মতো করে না বলে একে একটি আলাদা প্রতিবেদন বা অন্য একটি ডিসকোর্স হিসেবে উপস্থাপন করাটা। আজকের বড় বড় গল্পকারেরা তাই-ই করছেন।


সেমিনারে কথোপকথন

একশ বছর পর এখন যদি এ বাংলা ছোটগল্পের দিকে তাকাই তবে দু'টি বিষয় খুব লক্ষণীয় বলে মনে হয়। একটি হল রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রউত্তর অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিকদের সেনসিং। আর দ্বিতীয়টি হল আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়কে পটভূমি করে গল্পের মাধ্যমে লেখকদের আত্মপ্রকাশ। একে আমি আত্মপ্রকাশই বলব। এক্ষেত্রে আমি 'আত্মপ্রকাশ' শব্দটি ব্যবহার করেছি ইচ্ছাকৃতভাবেই। কারণ পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে যেখানে সাহিত্যকে তারা তাদের আত্মপ্রকাশের ভূমিকায় নিয়ে যেতে পেরেছে। বাংলাদেশ সে কাজটি করতে পেরেছে। এদেশে একজন লেখক তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে একটি বিশেষ ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল ১৯৪৭ সালে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শিক মতবাদের সৃষ্টি করে। এটিকে প্রায় একটি ফেরোসিক আদর্শবাদ বলা যায়। সেখানে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমাদের বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। এটি আমাদের এই দেশে, এই ভূ-খণ্ডের জন্য অনেক বড় একটি ব্যাপার। সেসময় দেশজুড়ে যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব বা সাংঘর্ষিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ছিল এদেশের লেখক সাহিত্যিকদের জন্য একটা বিরাট 'আইডেন্টিটি ক্রাইসিস'। সেটি ছিল আমাদের পরিচয়হীনতার ব্যাপার। সেই পরিস্থিতিতে সাহিত্য ও সংস্কৃতি উভয় অঙ্গনেই, আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন সে সময়ের যত কথাসাহিত্যিক লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। তাই আমাদের সাহিত্যকে তো এক অর্থে আত্মপরিচয় অন্বেষণ বা আত্মপ্রকাশই বলা চলে।… "

ওয়াসি আহমেদের পর পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, "জনাব জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মাননীয় শ্রী দেবেশ রায়, সহ আলোচক বন্ধু ওয়াসী আহমেদ ও প্রশান্ত মৃধা এবং আপনারা যারা এখানে উপস্থিত রয়েছেন এই মেঘলা দুপুরে গল্প বিষয়ক আলোচনা শুনতে, তাদের প্রত্যেককে আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। আমি যেটুকু লিখে নিয়ে এসেছি সেটুকুই বলব। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগ ও মানববিদ্যা বিভাগ আয়োজিত 'সৃজনে ও মননে: সমকলীন বাংলা সাহিত্য' – এই শ্লোগানে যে দু'দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনার চলছে তাতে উপস্থিত থাকতে পেরে, বাংলাদেশের পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়ার পর তাদের সান্নিধ্যে ও আত্মিক উষ্ণতায় আমার অসম্ভব ভাল লাগছে। শিরোনাম যখন নির্দিষ্ট তখন তাকে ধরে এগিয়ে নিতে হবে বাক্-প্রতিমায়, কথার চরণে। তাই বক্তব্যের মাঝে কিছুটা বাধ্যবাধকতা এসে যায়। কারণ যে কোন শিরোনামই তো বাধ্যবাধকতার অবসন্ন বিভাজন। ইদানিং, ঠিক ইদানিং বললে হয়ত কথার মাঝে একটা ফাঁক থেকে যায়, গত দশ-বার বৎসর যাবৎ প্রায় ক্রমশ একটু একটু করে মনে হচ্ছে, বড় বড় সাম্রাজ্য, তত্ত্ব-দর্শন একেবারেই অমর, অনড়, অজেয় কিছু নয়। তবে নশ্বরতাও প্রকট ও স্পষ্ট নয়। কিছু চিহ্ন, কিছু মুহূর্ত ও কিছু স্মৃতি থেকে যায়। অশোক, আকবর, আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন-এর সময়কার যে বড় বড় ঘটনা তার ক'টিকেই বা আমরা মনে রেখেছি? নেহাতই ইতিহাসের সন-তারিখের হিসাবে তারা হয়ত বা স্তব্ধ হয়ে আছে। তবে তার মানে এই নয় যে সমাজ ভাবনা, সমাজ বাস্তবতা, সমাজ চেতনা কিংবা সমাজ সচেতনতার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই প্রয়োজনীয়তা কি শুধুই প্রয়োজনীয়তা নাকি কিছু চিন্তাচেতনার আভাস, কিছু ছায়াপাত কিংবা গোলকধাঁধা? নাকি বঙ্কিমচন্দ্রের কবিতা 'এ জীবনে আমি কি দেখিলাম'-এর মত কোন জিজ্ঞাসা?

দু'শ বছরের টানা ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের বহু কিছু ধ্বংস করে দিতে পেরেছে। সাহেবদের শিখিয়ে দেয়া অঙ্কে আমরা যেন যোগ-বিয়োগ করে সাজিয়ে নিতে চেয়েছি জীবন বাস্তবতাকে। কিন্তু ভারতকে বুঝতে গেলে সাহেবদের তত্ত্বকথার ঠুঁলিতে চোখ ঢেকে নিলে হবে না। তাকাতে হবে ভারতবাসীর দিকে।"

এরপর তিনি একে একে শাসন, সাম্রাজ্যবাদ, পরবর্তীতে দেশভাগ, নকশাল আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনাবলীর দ্বারা যুগে যুগে বাঙ্গালা সাহিত্য কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে তা উল্লেখ করেন।

সবশেষে বক্তব্য দিতে আসেন পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক শ্রী দেবেশ রায়। তিনি বলেন, 'সমকালীন সাহিত্য: সৃজনে ও মননে' কথাগুলো তো বেশ ফাঁকা ফাঁকা কথা। সুতরাং যার যেরকম ইচ্ছে সে বলে নিতে পারে। আমি সমকালীনতাকে অত্যন্ত বাস্তব অর্থে শিল্প-সাহিত্যের সমকালীনতা ধরে নিচ্ছি। মানে আমার কাছে সমকালীনতা এরকম নয় যে কোনো একটা ট্রেন আমকে ধরতে হবে, সমকালীনতার ট্রেন। এবং সে ট্রেনটা ঠিক সময়ে ঠিক স্টেশনে আসে। এবং আমি ঠিক সময়ে ঠিক স্টেশন থেকে ঠিক ট্রেনটার ঠিক কামরায় যদি উঠি তাইলে সমকালীনতা হবে। তো সেই সমকালীনতা, আমি যে ট্রেন-এর টিকিট কেটে উঠেছি, আমার একটা গন্তব্যও আছে। সেই গন্তব্যে পৌঁছে দেখলাম যে সেই জায়গাটাতে আমি আসতে চাইনি। ফলে আমাকে আবার আর একটা ট্রেন ধরে আরেকটা গন্তব্যে পৌঁছাতে হল। এটাই আমার কাছে শিল্প সাহিত্যে সমকালীনতা। কখনোই এটা এরকম নয় যে সমকালীনতা, সাম্প্রতিকতা, আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা ইত্যাদি ইত্যাদি এগুলো সব একটা জিনিস — একেবারেই নয়।

সাহিত্যের ইতিহাস থেকে অজস্র উদাহরণ দেয়া যায় যেখানে সমকালীনকে ধরবার জন্যই, সমকালীনের কথা বলবার জন্যই এবং সমকালীনের অবস্থান মাপার জন্যই লেখক পৌরাণিক কাহিনী লিখেছেন। যেমন, সকলেই জানেন আরব দুনিয়ায় সর্বত্র অত্যন্ত কঠিন সেন্সর মেনে চলা হয়। কোন অবস্থাতেই তা অতিক্রম করা যায় না। শুনতে অবাক লাগে যে, নাগিব মাহফুজ যেবার নোবেল পেলেন তখন ইজিপ্টের কোনো বুকশপে তাঁর কোন বই পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ তাঁর দেশে তখন তিনি নিষিদ্ধ ছিলেন। একমাত্র জায়গা যেখানে লেখা প্রকাশ করা যায় ও পড়া যায়, অর্থাৎ কোনো সেন্সর নেই, সেটা হচ্ছে বেইরুটে। কিন্তু বেইরুটে গিয়ে তো আর সবসময় বই ছাপা যায় না। কে নিষিদ্ধ কে অনিষিদ্ধ – এই সিদ্ধান্তটা হয় লোকাল দারোগা লেভেলে অর্থাৎ স্থানীয় থানায়! ওরা তো তেমন পড়তে বা বুঝতে পারে না। এ জন্য আরব লেখকরা একটা অদ্ভুত উপায় আবিষ্কার করলেন। সেটা হচ্ছে ধরুন, 'সিন্দবাদ নাবিকের উপাখ্যান' নামে একটি বই লিখলেন কোন লেখক। পরে বিধিমত তা গিয়ে পৌঁছল স্থানীয় সেন্সর বোর্ডের দারোগাদের হাতে। তারা তেমন পড়ালেখা জানেন না তো তারা মনে করলেন সিন্দবাদের জাহাজযাত্রার কাহিনী, এতে কোন দোষ নেই। তারা সেটা পাশ করে দিলেন। পরে দেখা গেল লেখক বইয়ের ভিতরে সিন্দবাদের নাম দিয়ে এমন একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যে বোমা ফাটাচ্ছে, দুর্বৃত্তের কাজ করছে, এক দেশের লোককে নিয়ে আরেক দেশে ফেলছে। তখন আবার সে বেই দারোগাদের কাছে ফেরত আসলো যে তুমি এ কোন বই পাশ করেছো? তখন লেখকেরা পেপারে বড় বিবৃতি দিল যে এ কী কাণ্ড, আরব দেশে তথা সমগ্র আরব দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গর্ব হচ্ছে আরব্য উপন্যাসের গল্প, সরাইখানার গল্প, যেসব নিয়ে সাহেবরা এত বড় বড় কথা বলেছে সেই গল্প লিখেছি, সেটা তুমি আটকে দিলে! এরকম কাগজে হেডিং বেরুলো, 'সিন্দবাদ প্রহিবিটেড ইন ইজিপ্ট'। একটা আন্তর্জাতিক সংকট! তখন তাড়াতাড়ি সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বললেন, পাশ করে দাও পাশ করে দাও। এবং এইভাবে আরবে, গোটা আরব ভূখণ্ড জুড়ে একটা প্রবল আন্দোলন হলো যেখানে লুপ্ত পুরাকালীন পুনরুদ্ধার ঘটলো ঐতিহাসিক সমকালীনের সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্বে। সে একটা ফূর্তির গল্প।


বক্তব্য রাখছেন আফসার আহমেদ

এরপর দেবেশ রায় তাঁর বক্তব্যে নানা দেশে, নানা কালে রচিত সাহিত্যের বিকাশ, উৎকর্ষ ও বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। দেবেশ রায়ের তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত উপস্থাপনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশন 'সমকালীন কথাসাহিত্য'।

দ্বিতীয় অধিবেশন: সমকালীন বাংলা কবিতা

এরপর চা-নাশতা ও মধ্যাহ্ন ভোজন বিরতির পর শুরু হয় আরেকটি নতুন অধিবেশন। দুপুর ২টায় ব্রাক ইউনিভার্সিটির ১৮তলায় জিডি এল এম সেন্টারে বসে ২য় অধিবেশন 'সমকালীন বাংলা কবিতা'। এ অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন এবং এতে আমন্ত্রিত বক্তারা ছিলেন শামীম রেজা, চিরঞ্জীব বসু ও মৃদুল দাশগুপ্ত।

প্রথমে বক্তব্য পাঠ করেন শামীম রেজা। তিনি তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমকালীন বাংলা কবিতা বিশেষতঃ 'বাংলাদেশের কবিতা' নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল:

"শুরুতেই আমি একটা কথা বলে নিতে চাই। তা হল কবিতা আজকাল আর ততটা জনপ্রিয় মাধ্যম নয়। তাই কবিদেরও আজ আর আগের সে জনপ্রিয়তা নেই। আর দেশভাগের পর আমাদের ভাষা আর পশ্চিমবঙ্গের লেখক কবিদের ভাষা নিয়ে এখন নানারকম কথা বলা হয়। কেউ বলেন তাদের সাহিত্যের ভাষা উঁচু দরের, আমাদেরটা ততটা নয় আবার অনেকে উল্টোটাও বলে থাকেন। কিন্তু আমি বলব যে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের ভাষা অনেক বৈচিত্র্যময়। আমাদের প্রতিটি জেলার ভাষায় অনেক পার্থক্য আছে যা পশ্চিমবঙ্গে নেই। ওদের ভাষায় একটা মান ভাব আছে। ফলে আমার মনে হয় বাংলাদেশের ভাষা আর পশ্চিমবঙ্গের ভাষার অবস্থা ভবিষ্যতে অনেকটা ব্রিটিশ আর আমেরিকান ইংরেজীর মত হয়ে যাবে।"

শামীম রেজার বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল সমকালীন বাংলা কবিতা বিশেষতঃ বাংলাদেশের কবিতা। তিনি মূলতঃ আশির দশক থেকে শুরু করে শূন্য দশক-এর কবিতার মধ্যেই তাঁর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন।

এরপর অধিবেশনের সঞ্চালক খোন্দকার আশরাফ হোসেন শামীম রেজার বক্তব্য সম্পর্কে বলেন,

"শামীম রেজা সমকালীন বাংলা কবিতার একটি চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন কিছু উদ্ধৃতির মাধ্যমে। উদ্ধৃতিগুলো আমার কাছে কিছুটা খাপছাড়া মনে হলেও আমি তাকে কোলাজধর্মী একটি রচনা বলে মেনে নিতে রাজি আছি! কোলাজের যে চরিত্র নানা বর্ণের, নানা আকারের, নানা ধরনের বিভিন্ন জিনিসের টুকরা-টাকরা একসঙ্গে জড়ো করে তার ভেতর থেকে একটি অনুভূতিকে বের করে আনা বা একটি দৃশ্যকে ফুটিয়ে তোলা, তো আমার মনে হয় সে কাজটা তিনি ভালমতই করেছেন।

আমার যেটা মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালটাকে যদি আমি সমকালীন বলি তবে সমকালের ব্যাপ্তিটা প্রায় ৪০ বছরের মতন। চল্লিশ বছরে আমাদের কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা পরিবর্তিত হয়েছে। বেশ লক্ষণীয় ভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যাকল্যাশের মধ্য দিয়ে। প্রবল, প্রখর স্বদেশ ভাবনা খুব স্বাভাবিক ভাবে উঠে এসেছিল সত্তরের কবিতায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে সত্তরের কবিতায় হারিয়ে গিয়েছিল মনন এবং মন এবং মানুষের অন্তর্জগতের যে ভাব সেটি প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছিল আশির দশকের কবিতা। কবিতায় মানুষের মনোজগতের কথা আশির কবিরা আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। আবার সেটা করতে একইভাবে বহির্জগতের প্রতি যে অনুরাগ, সেটি আবার তাঁরা হারিয়ে ফেলেন, আশির দশকের কবিতায় ভাষায় একটা পরোক্ষ ভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল অর্থাৎ উপমা উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। অনুভবের মৃদুলতা। ছন্দের প্রতি কিছুটা নিষ্ঠা তাঁরা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সত্তরের দশকে কবিতার ভাষা ছিল কিছুটা এলিয়ে পড়া, আশিতে তা কিছুটা সুসংঘবদ্ধ হয়েছিল বলে আমার ধারণা। যেহেতু, আশির দশকের কবি বলেই অনেকে আমাকে মনে করেন; আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় একটি বাঁক বদল হয়েছিল আশির দশকে। আপনারা কোনোভাবেই মনে করবেন না যে আমি বলতে চাইছি সেই বাঁকবদলের কারিগর আমিই (হাসতে হাসতে)!

তো এরপর বাংলা কবিতা যে বাঁক নিল তা হল একেবারে ৯০ ডিগ্রি! বাঁক নিতে গিয়ে ভাষা হল আরও তির্যক, ভাষা বেঁকে-চুড়ে গেল। উপমা লোপ পেল। নব্বই দশকের কবিতায় কোন উপমা খুঁজে পাবেন না। 'চুল তার কবে কার' এ উপমা তো পাওয়া যাবেই না। এটা না হয় লুপ্তপ্রায় উপমা, কিন্তু 'চোখ তার পাখির নীড়ের মতো' এই 'মতো' শব্দটিও খুঁজে পাওয়া যায় না নব্বইয়ের কবিতায় এবং এ সময়ের কবিতায় 'রাজনীতি' একেবারে অপসৃত। এর সাথে সাথে স্বদেশ ভাবনা, দেশপ্রেম ইত্যাদিও পরিত্যাজ্য হয়ে গেল এবং এ মাহেন্দ্রক্ষণে হঠাৎ করে সীমান্তের ওপার থেকে প্রচুর পরিমাণে ফেনসিডিল-এর সাথে সাথে আরও একটি জিনিস এ দেশে আসে তা হল 'পোস্ট মডার্নিজম'! আমি একটি কথা প্রায়ই বলি যে আমাদের দেশে চীনা খাবার, কুংফু কারাতে ছাড়া আর সবই প্রায় পশ্চিম থেকে এসেছে। আমাদের কাছে ইমিডিয়েট পশ্চিম কিন্তু পশ্চিম বাংলা! তারাও আবার তাদের পশ্চিম মানে আরও পশ্চিম থেকে পোস্ট মডার্নিজম নামক এই জিনিস আমদানি করে আনেন। তারা তাদের দেশে তা চালু করেন আর তাদের দেখাদেখি আমাদের নব্বই দশকের কবিরাও সে চর্চা শুরু করেন। এতে ভাষা আরও একটু বেঁকে গেল, আরও তির্যক হল।… যাহোক, আমি এ পর্যায়ে পশ্চিম বঙ্গের কবি আমাদের অতিথি কবি চিরঞ্জীব বসুকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য আহ্বান করছি।"

এরপর আসেন কবি চিরঞ্জীব বসু। তিনি পশ্চিমবাংলার কবিতায় কবিতার ভাষা এবং আঙ্গিক যুগের সাথে সাথে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের প্রথম কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল:

"খোন্দকার আশরাফ হোসেন যা বললেন সেটা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যে, আমি পোস্ট মডার্নিজম ব্যাপারটা জানি না। কিন্তু সমালোচকেরা নাকি আমার লেখার মধ্যে পোস্ট মডার্নিজমের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন। আমি অবাক হয়েছি যে আমি জানি এতটা! সমালোচকেরা অবশ্য আরও অনেক কিছুই খুঁজে পেয়েছে আমার লেখায়। তো সে যাই হোক সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। আমি একটা লিখিত কাগজ নিয়ে এসেছি। আমাকে সেরকমই বলা হয়েছিল। আমি মূলত আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় সাত-এর দশক থেকে নয়ের দশকের যে প্রবণতা, সে প্রবণতা নিয়ে দু'একটা কথা বলব। আমি যেহেতু পদ্য লেখার চেষ্টা করি ফলে এতে হয়ত আমার প্রসঙ্গ বার বার এসেছে; এটা কিন্তু কোনো অহংকার থেকে নয়। এখানে রবীন্দ্রনাথের কথাও বারবার এসেছে, তাঁর কথাটা এসেছে মূলত তাঁর কবিতার কারণে। তাঁর গান নয়, গল্প নয়, উপন্যাস কিংবা অন্য কোনো বিভাগ নয়, শুধুমাত্র তাঁর কবিতার কথাই এসেছে।

তো একটা খুব মজার কথা হচ্ছে যে, আমি খুব ছোটবেলা জন্মেছিলাম! এবার জন্মানোর পর প্রচুর মানুষজন আমাকে ঘিরে ফেলে। আমার দাদা, আমার পিসী এরা। বিষয়টা হল গিয়ে আমার ঠাকুরদার দু'টো বিয়ে ছিল। আর তাদের তিন জনের মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের সন্তানের সংখ্যা ছিল সামান্য বেশি খুব সম্ভবত, সতেরো-আঠারো জন, আসলে আমার ঠাকুরদা বোধ হয় 'ফাদার অফ দ্যা নেশন' হতে চেয়েছিলেন। এটা অবশ্য আমাদের দেশের অনেক ঠাকুরদাই চান। তা না হলে আমাদের দেশের একশ দশ কোটি জনসংখ্যা কী করে হয়! যাহোক আমি আমাদের এই অগুনতি কাকু-পিসীদের গুণতে গুণতে ১,২,৩ কিংবা ১,২,৩ শিখি। সে যাই হোক, আমার কাকু, পিসীদের বেশ অদ্ভুত একটা গুণ ছিল, তা হল তাদের বই পড়ার বেশ অভ্যেস ছিল। সব রকমের বই-ই, একমাত্র পাঠ্যপুস্তক ছাড়া। ফলে স্কুলের গণ্ডি তাদের অনেকেই আর ক্রস করতে পারে নি। কিন্তু তাতে কী, আমার ঠাকুমারা যা ভাবতেন তা হল, 'পোলাপানগুলোর যা মাথা ছেল তা ব্যারিষ্টারের চেয়ে কম নয়!'

যাহোক, সার্ত্রের 'দ্য ওয়ার'-এর ঠাকুরদার মত আমার ঠাকুরদার বেশ ক'টা আলমারী ছিল। সার্ত্রের গল্পের ঠাকুরদার মতই সেই আলমারীগুলো বইয়ে ঠাসা ছিল। যদিও আলমারি ঠাসা বই থাকলেই সে আলমারির মালিককে যে বইপ্রেমিক বলা যাবে, তা নয় কিন্তু। এক হারেম ভর্তি রমণী থাকলেই কি সে হারেমের মালিককে প্রেমিক বলা যায় নাকি? যাহোক, সে আলমারির সামনে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। মানুষ যেমন শহীদ মিনারের সামনে থাকে। সে আলমারিতে নানারকম বই-ই ছিল জেমস জয়েস থেকে শুরু করে রান্নার বই কিংবা 'ঘরে বসে রেডিও বানান' ইত্যাদি নানা রকম বই। কিন্তু সেই অর্থে কবিতার বই খুব একটা খুঁজে পাই নি। 'সঞ্চয়িতা', 'সঞ্চিতা' আর 'সুকান্ত সমগ্র' – গড়পরতা বাঙালী পরিবারে যে সব থাকে সেসবই ছিল। তো সেই ছিল আমার কবিতায় হাতেখড়ি যাকে বলে।… "

চিরঞ্জীব বসুর পর খোন্দকার আশরাফ হোসেন পরবর্তী বক্তা মৃদুল দাশগুপ্তকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য আহ্বান করেন। তার আগে তিনি বলেন, "ধন্যবাদ চিরঞ্জীব বসুকে তাঁর প্রবন্ধটি পাঠ করার জন্য। 'পশ্চিম বঙ্গের সমকালীন কবিতা' সম্পর্কে তাঁর আলোচনা করার কথা ছিল। তিনি একদম শুরু থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত এসেছেন। তাঁর বক্তব্য আমরা উপভোগ করেছি। চিরঞ্জীব বসু তাঁর প্রবন্ধের মাঝখানে একটা কাজ করেছিলেন। তিনি আশির দশকের কবিতার আলোচনা না করে সরাসরি নব্বইয়ে চলে এসেছিলেন এবং বলেছেন তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে নাকি বলেন, 'আশিতে আশি অনাচার'। চিরঞ্জীব বসুকে আমি বলছি, আমরা বাংলাদেশে নব্বইকে কী বলি। 'নব্বই কবিতার মার্কায় কাটা গেল সর্বই!' রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাকে এভাবে বলা হয়। যাহোক, আসলে পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশ দু'জায়গাতেই আশি এবং নব্বই খুবই গুরুত্বপূর্ণ দশক। সময়ের স্বল্পতা আছে বলে আমি আর কথার জাল বিস্তার করব না। আমি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অতিথি কবি, আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব প্রিয় কবি, 'জলপাই রঙের এস্রাজ', 'এভাবে কাঁদে না', 'গোপনে হিংসার কথা বলি' এসব অসাধারণ কাব্যের যিনি কবি, কবি মৃদুল দাশগুপ্তকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য অনুরোধ করছি।"

কবি মৃদুল দাশগুপ্ত বাংলা কবিতা বিশেষতঃ বাংলাদেশের কবি ও কবিতার উপর বিশদ আলোচনা করেন। তাঁর বক্তব্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হল:
"নমস্কার, আমি এখানে কিছু বলবার আমন্ত্রণ পেয়ে ভেবেছিলাম মনে যা আসবে মুখে তাই বলে দেবো। কিন্তু আমার সহকর্মীরা বললেন, তুমি তো এলোমেলোভাবে বলবে, ওটা কোরো না বরং তুমি লেখো, আমারা কম্পোজ-টম্পোজ করে ছাপিয়ে দেব। তা তাঁরা সেভাবে আমাকে একটা কপি সাজিয়ে দিয়েছে, আমি সেটাই পাঠ করে শোনাব। আজ এই শ্রাবণ দিনে তাঁর প্রয়াণ মাসে তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষে কবিতা নিয়ে যে কোনো আলোচনার সূচনায় সর্বাগ্রে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাঁকে। শিক্ষিত বাঙালীর হৃদয়ে তো বটেই সমাজ সাধারণেরও, রবীন্দ্রনাথ-ই সহায়। কিন্তু আজকের বাংলা কবিতায় তাঁর ছায়াপাতের হদিস আমরা কিছুতেই আর পাব না। অণুবীক্ষণের অধীক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বীক্ষণযন্ত্রে কোনো গবেষকই আর এই শূন্য দশকের এ বছরে বোধ করি সে চেষ্টা আর করবেন না। আমি গবেষক বা তাত্ত্বিক নই। নেহাতই মফস্বলের এক কবিতাপ্রয়াসী। তবে একশ শতাংশ কবিতা পাঠক তো বটেই। এহেন মানুষটিকে আপনারা ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রীরা ডেকে এনেছেন বাংলাভাষী রাষ্ট্রের রাজধানীতে এ আলোচনাসভায়; এতে আমি আপ্লুত, আহ্লাদিত এবং কিছুটা থতমত! আপনাদের ধন্যবাদ, তবে কী, আমাকে ছাত্রদলে বসার সুযোগ দিলে আরও খুশী হতাম।

… আমি যত বার বাংলাদেশে এসেছি ততবারই এখানকার নতুন নতুন কবিদের কবিতা পড়েছি, তাঁদের বই কিনে নিয়ে গিয়েছি। আমি বাংলাদেশের তরুণ কবি, কবি তাপস গায়েন, মাসুদ খান, কামরুজ্জামান কামু, ব্রাত্য রাইসু এদের প্রত্যেকের লেখাই আমি পড়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছি… আমি বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় জন্মেছি। অন্যান্য সব বরিশ্যাল্লার মত আমারও এ নিয়ে গর্বের শেষ নেই! আপনারা হয়ত জানেন বরিশ্যাল্লারা যে দেশেই যাক তারা বরিশ্যাল্লাই। তাদের দেশ হচ্ছে-বরিশাল। তাই আমি বাংলাদেশেই আসি বা ভারতেই যাই কিংবা অন্য যেখানেই যাই আমার দেশ-বরিশাল! আমি যখন ঢাকায় আসি তখন মনে হয় যেন বরিশাল থেকেই এসেছি। যতবার আমি বাংলাদেশে কিংবা ঢাকায় আসি ততবারই শুনতে পাই একটি অদৃশ্য কণ্ঠ যেন আমায় বলেছে, 'ও মনু! কই যাও?'…"

……….
সেমিনারের ফাঁকে নাস্তা আর আলাপ
……….

তৃতীয় অধিবেশন: গল্প থেকে পাঠ

মৃদুল দাশগুপ্তের আবেগঘন বক্তব্যর মধ্য দিয়েই শেষ হয় এ অধিবেশনটি। শুরু হয় এ সেমিনারের সর্বশেষ অধিবেশন গল্প থেকে পাঠ। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ তলা সেমিনার রুমে অনুষ্ঠিত হয় এ অধিবেশনটি। এ অধিবেশনের সঞ্চালক ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ কথাসাহিত্যিক। এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত গল্পকার ছিলেন পারভেজ হোসেন, শহিদুল আলম, শাহনাজ মুন্নী, প্রশান্ত মৃধা, মনি হায়দার, নাসিমা আনিস, হাবিব আনিসুর রহমান, অদিতি ফাল্গুনীসহ আরও অনেকে। এ অধিবেশনে গল্পকারেরা তাঁদের গল্পের অংশবিশেষ পাঠ করে শোনান। বিকাল পাঁচ থেকে প্রায় রাত ৯ টা অবধি চলে এ গল্পপাঠের আসর।

এর মাধ্যমেই ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত দু'দিন ব্যাপী এ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।