উত্তরাধুনিকের চোখে রবীন্দ্রনাথ

aziz_hashan
Published : 22 July 2010, 11:34 AM
Updated : 22 July 2010, 11:34 AM


সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন অঞ্জন সেন

সততা, জ্ঞান ও আনন্দময়তা–এই তিনের সমাবেশ ঘটান রবীন্দ্রনাথ। আর এ আনন্দময়তার বিকাশ ঘটান তিনি সৃষ্টিশীলতায়। সেকারণে রবীন্দ্রনাথ মূলত সৃষ্টিশীল–নিয়ত গ্রহণ, বর্জন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয় তার সৃষ্টিশীল সত্ত্বা। তাই নির্দিষ্ট কোনো ছকে বেধে তাকে বিচার করা যায় না বা সে বিচারের চেষ্টা বোকামি বলেই আমার মনে হয়। এ কথাগুলো বলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক অমিতাভ চক্রবর্তী। কিন্তু আলোচনার বিষয়টি যে, উত্তরাধুনিকের চোখে রবীন্দ্রনাথ। তাই উত্তরাধুনিকের চোখেই রবীন্দ্রনাথের আংশিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন পশ্চিমা চিন্তাকে বাদ দিয়ে বাংলায় সৃষ্ট উত্তরাধুনিকতার নিষ্ঠাবান প্রচারক কবি অঞ্জন সেন। উত্তরাধুনিকতা বলতে অঞ্জন সেন বলেন, উত্তীর্ণ আধুনিকতা বা আধুনিকতার উত্তরণ। উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে তিনি বলেন, এ ধরনের সৃষ্টিকে ঔপনিবেশিক চিন্তার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে এ সাহিত্যকে আধুনিকতার ধারা থেকে বেরিয়ে আমাদের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য, লোকসাহিত্য ও ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে। আধুনিক সাহিত্য নাগরিক জীবন জিজ্ঞাসার প্রতিভু হয়ে ওঠে এবং তা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও লোকচিন্তা থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে যায়। দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের বিষাক্ত ছোবল নিয়ে রচিত হয় এ সাহিত্য। কিন্তু দৈনন্দিন জীবন জিজ্ঞাসার ওপরে গিয়ে মহত্তর এক জীবনানুভূতি সৃষ্টিই উত্তরাধুনিক সাহিত্যের উদ্দেশ্য। রবীন্দ্র বলয় ভেঙে ত্রিশের দশকের কবিরা যে আধুনিকতার চর্চা করেন তার ধারাবাহিকতায় জন্ম নেওয়া অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে এসে সাহিত্য চর্চার তাগিদে বাংলায় ১৯৮৫-৮৬ সালে উত্তরাধুনিকতার চর্চা শুরু হয়।

অঞ্জন সেন বলেন, রবীন্দ্রনাথ উত্তরাধুনিক সাহিত্যের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তার প্রতিটি গল্পে আমাদের এখনকার চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, অনুকরণ দ্বারা কোনো মহান সৃষ্টি হয় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে আমাদের শিল্প সাহিত্যকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ছোটো হয়ে আসে। বাঙালির তথাকথিত রেনেসাঁস ছিলো মূলত উচ্চবিত্ত কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদেরই একজন হরচন্দ্র ১৮৫২ সালে ব্রিটন সোসাইটিতে বলেন, এ যাবৎকালের সব বাংলা সাহিত্য নিকৃষ্ট, কুৎসিত। ১৮৫০ সালে কলকাতাতে ব্রিটিশ আর্ট স্কুলগুলো ব্রিটিশ একাডেমির আদলে আর্ট শেখানো শুরু করে। তার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজস্ব শিল্পরীতি বন্ধ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বিলেতি সে শিল্পরীতিকে গ্রহণ করেননি। তিনি সে শিল্পরীতির সমালোচনা করেন।

পশ্চিমা ভাবধারা থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের লোকজ্ঞান ও ইতিহাস ঐতিহ্যের সমন্বয়ে সাহিত্য রচনা করেন। ১৪-১৫ শতকে ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী সন্ত সাহিত্যের পাঠ তিনি করেন। সন্ত সাহিত্যিক কবীর,দাদূ ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে ভেদ করে যে অসাম্প্রদায়িক বার্তা মানুষের কাছে নিয়ে যান তার প্রভাব রবীন্দ্র মানসে সক্রিয় ছিলো। এ সন্ত দর্শনের সঙ্গে বাউল দর্শনেরও মিল রয়েছে। এসব পঠন-পাঠন ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লোকায়ত প্রাণকে ছুঁতে পেরেছিলেন। এ ধারাগুলোর সংমিশ্রণে রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা গদ্য পদ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তার ভানুসিংহ পদাবলী বৈষ্ণব পদাবলীর আঙ্গিকে লেখা। ১৯৩৮ সালে তিনি 'আধুনিক কাব্য পরিচয়' নামের কবিতা সংকলনে গগন হরকরা, লালন ফকির ও আলাওলের কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেন। আমার সেনার বাংলা গানটির সুর তিনি কুষ্টিয়া যশোর অঞ্চলের বাউলদের কাছ থেকে নিয়েছেন। মনোজাত শিল্পের ধারণা তার কাছ থেকেই পাওয়া যায়। কেবল পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করে আধুনিক কবিরা বলতে থাকেন রবীন্দ্র যুগ শেষ হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পশ্চিম এবং পুবের সংশ্লেষণ পশ্চিমাদের কাছেও নতুনত্বের স্বাদ দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্যতায় তারা রবীন্দ্র সৃষ্টির মাঝে নতুনের খোঁজ পান। তার সামাজিক ও দার্শনিক চিন্তার পাঠ থেকে আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নাৎসী বাহিনী ক্ষমতায় এলে তিনি তার সমালোচনা করেন। তাছাড়া জাপানের জঙ্গি শক্তির উত্থানেরও তিনি সমালোচনা করেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার এ অবস্থান নাৎসী বাহিনীর ভালো লাগেনি। তারা রবীন্দ্র রচনা পোড়াতে শুরু করে। বার্লিন মিউজিয়ামে দেওয়া তার তিনটি ছবি ফেলে দেয় তারা। সে ছবিগুলো আজও পাওয়া যায়নি। পোল্যান্ডে নাৎসীদের ক্যাম্পে আটক থাকা একদল মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থেকেও রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর' নাটকটি অভিনয় করেন। মৃত্যুমুখী সে মানুষগুলোর প্রেরণাস্থল হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরাধীন জাতির প্রতিনিধি হয়ে তিনি মানবতার জয়গান করেন।
ড. মাসুদুজ্জামান তার আলোচনায় বলেন, রবীন্দ্রনাথের সব লেখা জীবনধর্মী। তিনি পশ্চিমের যন্ত্র সভ্যতার সমালোচনা করেছেন। রক্তকরবী, তোতাকাহিনীসহ অনেক লেখায় তিনি সা¤্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন। আজকে যে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদের নাম আমরা পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের মুখে শুনছি তা তিনি বিশ শতকের শুরুতেই বলে গেছেন। আমাদের সব আধুনিক প্রেরণার উৎস এই মহীরুহ।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন বলেন, উত্তরাধুনিকের চোখে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় আধুনিকতাই মাত্র আসছে। আর উত্তরাধুনিক বাঙালি কবে হবে সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। আধুনিকতা ইংরেজী সাহিত্যে উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুতে এসে মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় ঈশ্বর মৃত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ যেখানে কলকাতার রাস্তায় সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রামের বিষাক্ত স্পর্শ অনুভব করেননি, জীবনানন্দ সেখানে ট্রামের মধ্যে সাপের বিষাক্ত স্পর্শ ধারণ করেছেন, আর বিষ্ণু দে সে রাস্তায় পেয়েছেন মানুষরূপী সারি সারি পিপড়ে সার। উত্তরাধুনিকরা মানুষকে বাদ দিয়ে সাহিত্য রচনা শুরু করে। পশ্চিম বাংলায় উত্তরাধুনিক কবিরা বের করেন 'কবিতা পাক্ষিক'। তাতে থাকে পোস্ট-মর্ডান বিড়ালের সন্ধান। পোস্ট মডার্নবাদীদের মতে, কবিতার কোনো বিষয়বস্তু থাকবে না, তা হবে শিকড়বিহীন ঘাসের মতো। কবি হবেন দায়হীন, বিদিশা মশগুল। পোস্ট মডার্নের চোখে রবীন্দ্রনাথ পরিতাজ্য। তবে অঞ্জন সেন যে উত্তরাধুনিকের প্রচার করেন তাতে রবীন্দ্রনাথ বেশি মাত্রায় গ্রহণীয়। পোস্ট মডার্নরা ভাঙা কাচের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দেখেন। আমি তাদের দলে নই।

মইনুদ্দীন খালেদ বলেন, পোস্ট মডার্ন ধারণাটি প্রথম এসেছে আর্কিটেকচার থেকে। দাদাবাদীরা সবকিছু নাকচ করে পোস্ট মডার্ন ধারণার প্রবর্তন করেন। পোস্ট মডার্নের লক্ষ্য হয়ে ওঠে পাশ্চাত্য চিন্তার বাইরে গিয়ে বিশ্বসাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাস বিনির্মাণ। ইতিহাসের মহাসড়কে না হেঁটে আলপথে শেকড়ের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে অন্ধকার দেখা যায়, দেখা যায় পরস্পরবিরোধী রঙের খেলা, নিজের ছবির মধ্যে কালি লেপ্টে দেন তিনি। এসবের মধ্যে তার পোস্ট মডার্ন চিন্তারই প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তার অনেক লেখায় সামাজ্রবাদ বিরোধিতা রয়েছে। 'আফ্রিকা' কবিতায় তিনি বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা এশিয়া ও আফ্রিকা ধর্ষিত হয়েছে।

অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে কোনো স্থির সিধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। জৈনদের অনেকান্তবাদে যেমন সূর্য নেই এবং আছে, আছে এবং নেই রয়েছে, তেমনি রবীন্দ্রনাথও নিয়ত দোলাচালের মধ্যে থেকে পরিবর্তিত হয়েছেন, নিজেকে করেছেন সমৃদ্ধ।

পোস্ট মডার্ন কিছু জরুরি প্রশ্ন থেকে এসেছে। পশ্চিমাদের ইঙ্গিত করে সার্ত্রে বলেন, 'আমরা এতদিন মানবতার নামে বর্বরতা করে এসেছি।' সুনির্দিষ্ট সমাধান দিতে ব্যর্থ হলেও ইউরোপের ইতিহাসে পোস্ট মডার্নের চেয়ে সৎ ইতিহাস কম আছে।

তবে পোস্ট মডার্ন বা উত্তরাধুনিক যাই হোক না কেন এ ধরনের কোনো তকমা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে গেলে একটুকরো রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যাবে। উত্তরাধুনিকরা আধুনিকদের যে অবক্ষয়ের কথা বলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে অবক্ষয় ধারণাটি তেমন ছিলো না। তার চোখে মনুষ্যত্বের বিরোধী সবই ছিলো অবক্ষয়। যাবতীয় তত্ত্বের জটিলতা থেকে দূরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করতে হবে।

শান্তিনিকেতনের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি কিন্তু তা তো একটি গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এখন আর কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথকে দেখার মতো দৃষ্টিভঙ্গি তার নেই।

বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত এ আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, রবীন্দ্রনাথকে কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্বের আলোকে নয় তাকে বিচার করতে হলে শাশ্বত মূল্যবোধ নিয়ে এগোতে হবে। অনুষ্ঠানের সভাপতি রফিকউল্লাহ খান বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে মৌলিক, নিঃসঙ্গ ও সৃষ্টিশীল কবি রবীন্দ্রনাথ। তাই যে চোখ দিয়েই আমরা তার দিকে তাকাই না কেনো তিনি সেখানে সম্পূর্ণ।