একালের সংগীত চেতনায় নজরুলসংগীত চর্চার লক্ষ্য কোথায়

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 28 August 2021, 06:01 AM
Updated : 28 August 2021, 06:01 AM


আমাদের বাংলাদেশের নতুন নতুন গান মানেই দাদরা, কাহারবা বড়জোর তেওড়া- এই কয়টা তালের মুখস্থ আবৃত্তির ভিতর কথা ও সুরের ঘুরপাক। কথা, সুর সহজ হতে হতে আম-পাবলিকের কাতারে ঠেকে গেছে। তালকেও তাই সহজ সাবলীল হওয়ার সমঝোতা করে চলতে হয়।
বর্তমানকালে কথা ও সুরের সামঞ্জস্য রক্ষার শর্তে সাধারণ মানুষের বোধগম্যতাও প্রযোজ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন গান মানেই সাধারণ শ্রোতার নিমিত্তে প্রস্তুতকৃত। কিন্তু যদি বলি আমি কেন সাধারণ শ্রোতা হতে যাব? আমি কেন আমার সময়ের নতুন তাল, নতুন সুরের গান শুনতে পাবো না? সংগীতের কি আবিষ্কার শেষ হয়ে গেছে? আর কেনই বা আমাকে উচ্চ মার্গের শ্রোতা হিসবে প্রতিষ্ঠা করতে রাগাশ্রয়ী কিছু গান আর পঞ্চগীতিকবির গানে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে? অত্যাধুনিক যুগের মানুষ হয়েও আমি কেন পুরানো সেই কলেরগানের যুগের গানকেই আজও কচলাবো উচ্চমার্গের গান বিচার্যের জন্য? আমাদের সমকালকে এভাবেও জবাবদিহিমূলক প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু প্রশ্নগুলো ছুঁড়বো কোথায়? নিজেদেরই গায়ে তো উড়ে এসে এসব প্রশ্ন বিদ্ধ করবে আমাদের।

আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের যুগের কোন নতুন তাল নেই, নেই বাংলা গানের ভাণ্ডারে কোন নতুন রাগ বা সুর কাঠামো। এক লোকগীতির আশ্রয় আর পুরানো সেই ঔপনিবেশিক কালের রাগাশ্রয়ী স্বভাব ছাড়া আমাদের সময়ে আধুনিক গান বলতে পপ গানের রাজত্বই ঘিরে আছে। এর বাইরে কোক স্টুডিওর প্রভাবে কিছু অবাঙালিপনাও এখনকার বাংলাগানের শোকেজে জৌলুষ দেখাচ্ছে। এই শোকেজের ভিতরে সজ্জিত শোপিসগুলো একটুখানি আরবিয়, আধটুখানি ইউরোপিয়, সিকিখানি টার্কিশ এবং আধখেঁচরা বাংলাগানের বডি; সেই বডি কেটে ছেঁটে ওসব শোপিস ঢুকিয়ে সেলাই করে দেওয়া হয়। এভাবেই সেকাল-একাল সব কাল থেকে নির্বাচিত বাংলাগানের পোস্টমর্টেম করা হয় আমাদের জোকস্টুডিওতে। এতকিছু কাহিনী করেও না হচ্ছে নবসৃষ্টির সুধা বর্ষণ, না মিলছে সংগীত-আনন্দ। কোন কোন গান শুনে তৃপ্তির চেয়ে লাফঝাপেই মত্ত থাকে আমপাবলিক?

শিল্প কখনই আমপাবলিকের কাতারের বিষয় নয়, জনতাকে শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করাই শিল্পের উদ্দেশ্য- সেটাই হয়ত গানের পোস্টমর্টেম কর্তারা ভুলে গেছেন। গ্রামোফোন, বেতার এসবও সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল প্রথমদিকে। সমাজের উঁচু সিঁড়ির লোকজনের বাড়িতে এসব দেখা যেত। শুধুমাত্র সিনেমার গান যখন প্রচল হতে শুরু করে তখন সিনেমাহলের মাইকে ভেসে আসা গান সাধারণের কানে বাজতে লাগলো। সেসব দিনের গাড়িয়াল, রিক্সাচালকের গলাতেও তাই সুন্দর সুন্দর গান সাধা হত। তখনকার দিনে সংগীত শিল্পে কোন পোস্টমর্টেম কর্তা ছিলেন না বিধায় উনবিংশ শতাব্দীর সাধারণ মানুষও সিনেমার বদৌলতে সংগীতের সুধা তৃপ্তি ভরে আস্বাদন করেছেন। সেটা তাদের সৌভাগ্য বলা যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এখন পুরাতন কালের মতন পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে রটে যাওয়া খবরের জের ধরে জানতেও পারিনা কোন সিনেমা হলে কোন মুভি চলছে। আমাদের সমাজে এখন পাড়া-প্রতিবেশি নেই বললেই চলে। টেলিভিশন কৃষ্টি প্রজন্ম পেরিয়ে এখন যা রয়েছে তা হল, ফেসবুক আর ইউটিউব। তাই আমাদের সময়ে পাড়ায় পাড়ায় রটে যাওয়া, কানাকানির কোনো কৃষ্টি নেই। আমরা এখন ইউটিউব, ফেসবুকে বিভিন্ন রটনা দেখি।

এমন যুগের আবহাওয়ায় নজরুলসংগীত চর্চার লক্ষ্য কোথায়? কাজী নজরুল ইসলাম- যিনি কিনা বিদ্রোহী কবিতার জনক, রণসংগীতের স্রষ্টা। আমরা তো যুদ্ধ, প্রতিবাদ -এসবে ভয় পাই এখন; নৈতিকতার চর্চাকারীদের সেকেলে ভাবি; আদর্শ নীতিবাক্য পড়ার সময় নেই তারচে টাকা উপার্জনের দিকেই আমাদের মনোযোগ বেশি। পাশের বাড়িতে হট্টগোলে লাশ পড়ে গেলেও আমরা টু শব্দ না করা পাবলিক। আমরা প্রতিবাদ করি ফেসবুকে, আমরা বীরত্ব কবচাই ইউটিউবে। অসহায়ের বিপদ দেখলে চুপ করে থাকাই আমাদের বর্তমান স্বভাব। কারো বাড়ির গেট ভেঙ্গে লোকজন ঢুকে পড়লেও আমরা সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রীর সুরক্ষার কথা না ভেবে তার গায়ের পোশাকে অশালীনতা খুঁজি, চরিত্র নিয়ে উস্কানি দিই। আমাদের নিজেদের বর্তমান চরিত্রের মহিমা বোঝাতে সাম্প্রতিক অনেক ঘটনাই উদাহরণ হিসেবে আনা যায়। কিন্তু সেসবে গেলে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হবে।

মোদ্দা কথা আমাদের জাতীয় কবিকে আমরা নিজেরাই বিদ্রোহী কবি বলে অভিহিত করি। আবার স্বাধীনতা দিবস এলে আমরাই গলা ঝেড়ে গাইতে থাকি 'কারার ঐ লৌহ কবাট ভেঙ্গে ফেল…', নারীর অধিকার বিষয়ক কোন মঞ্চে সুযোগ পেলেই 'জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা…' গেয়ে আসি। তো আমাদের এইসব কাজে গান এগিয়ে দিতেই কি একজন নজরুলের আবির্ভাব ঘটেছিল? আমাদের বিভিন্ন দিবসের প্রয়োজনে পদে পদে উদ্ধার করতেই কি নজরুলগীতির সম্ভারটি ইতিহাসে গচ্ছিত রাখা হয়েছে? কিম্বা নজরুলগীতি শেখার উদ্দেশ্য কি শুধু এক গাঁদা গানের খাতা উপচানো নানান পদের গান শেখা?

সারি সারি প্রজন্ম ধরে ধরে নজরুলগীতি শেখা আর শেখানোই যদি আমাদের কর্তব্য হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হয় নজরুলগীতি বড় দামী প্রোডাক্ট সংগীত বাজারে। আপনি যত বেশি বেশি নজরুলের গান জানবেন, তত বেশি বেশি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করবেন- এই তবে নজরুলগীতি শেখার মহিমা। একদা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতায় লিখেছিলেন, 'আমি বিদ্রোহী ভৃগু/ ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন', সেই ভগবানেরই (পুঁজির) পায়ে গড়প্রণাম দিয়ে নজরুলগীতিকে বড় দামী প্রোডাক্ট বানানো হয়েছে একালের সংগীত বাজারে। প্রকৃত নজরুলসংগীত চর্চা নিশ্চয়ই কেবলমাত্র জনপ্রিয় নজরুলসংগীত শিল্পী হওয়া নয়!

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা কবি, সংগীতকার, নাট্যকার, গল্পকার, সাহিত্যিক, লেটোর দলের পালাকর্তা। আরও অনেক কিছুই তাঁর কর্মজীবন ঘিরে শিল্পের বহুধারায় প্রবাহিত করেছে। গ্রামোফোন, বেতার, সিনেমাতেও তিনি ছিলেন তাঁর সমকালের বুকে নূতনের স্রষ্টা। তাঁর গান চর্চা করলে নিশ্চয়ই কেবল গায়ক হব না, তাঁর গানই আমাদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভাসিয়ে নেওয়ার কথা। তিনি নতুন রাগ (সুর) ও তাল, ছন্দ সৃষ্টি করেছেন। গানের পোস্টমর্টেম না করেও তিনি দেশি বিদেশি সুরের মিশ্রণে প্রকৃত বাংলা গান রচনা করেছেন। তাঁর গানে বৈষ্ণব, শাক্ত, সূফী, ইসলাম ইত্যাদি দর্শনের প্রভাব একদিকে, অন্যদিকে কর্ণাটকি, হিন্দুস্তানি, কোরাস ও মার্চ, বিলেতি, ক্যারাবিয়ান, পারস্য-আরব্য প্রভৃতি সংগীত প্রভাব থাকলেও তাঁর কোন গানই বাংলাগানের ভাবরসের বাহিরে যায়নি। তাঁর কাছ থেকে এগুলোই শেখার প্রধান উপজীব্য হওয়া উচিত ছিল আমাদের জন্য। কিন্তু আমরা অধিকাংশই সে শিক্ষার পথে না গিয়ে কেবল শতবর্ষ যাবত তোতাবুলির মতন তাঁর গান আওড়াচ্ছি। সেকারণেও হয়ত আমাদের সমকালের কোন নতুন তাল নেই, নতুন সুর নেই।

পৃথিবী এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। অথচ নজরুল ছিলেন আমাদের চাইতেও পিছিয়ে থাকা সময়ের বুকে। তবুও তাঁর গান আজও আমাদের কাছে আধুনিক, তাঁর কম্পোজিশন আজকের যুগের গানের চেয়ে বহু মাত্রায় শক্তিশালী। সেকালে তাঁর হাতে কম্পিউটার, ইউটিউব কিছুই ছিল না, কিন্তু তবুও তিনি নতুন নতুন সুর-তালের অন্বেষণে কালের প্রতিবন্ধকতা টপকে যাওয়া সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। যেমন তিনি আরবিয় তাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে কত নিগুঢ় নিষ্ঠার পরিচয় রেখেছেন, ''আরবী ছন্দ যেমন দুরূহ তেমনই তড়িৎচঞ্চল। প্রত্যেকটি ছন্দের গতি বিভিন্ন রকমের কেমন যেন চমকে ওঠা ওঠা ভাব। অনেক জায়গায় ধবনি একরকম শোনালেও সত্যি একরকমের নয়। তা একটু বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলে বা পড়লেই বোঝা শক্ত নয়। অনেক জায়গায় তাল এক কিন্তু মাত্রা আর অনুমাত্রার বিচিত্র সমাবেশের জন্য আর এক আশ্চর্য রকমের ধবনি চপলতা ফুটে উঠেছে''। সংস্কৃত ও স্বরবৃত্তের ছন্দ তিনি তাঁর গানে সার্থক প্রয়োগ করেছেন, সেই সাথে নতুনত্বও এনেছেন এসব ছন্দ গানে ব্যবহারের ক্ষেত্রে। পুরাতন কালের গহ্বর থেকে তুলে এনে প্রিয়াছন্দ, মণিমালা ছন্দ, স্বাগতা ছন্দ, মন্দাকিনী ছন্দ ইত্যাদি সংস্কৃত ছন্দের সার্থক ব্যবহার করেছেন তিনিই প্রথম। শুধু তাই নয় নুতন তালেরও প্রবর্তন করেছেন, নবনন্দন এবং ছন্দবৃষ্টিপ্রপাত।

তাল সৃষ্টির পেছনে যে তাগিদটি ছিল তা হল, ভাষার ছন্দ। রাগ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়, সুরের সাঁচে বাণী গাঁথুনির ক্ষেত্রে সুরের চলন ও ছন্দের প্রয়োজনে তিনি প্রচলিত নানা রকম রাগের মিশ্রণে নতুন রাগের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। বেণুকা, উদাসী ভৈরব, অরুণ ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, আশাভৈরবী, রক্তহংস সারং, সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, শঙ্করী, যোগিনী, শিব সরস্বতী, নির্ঝরিণী, রূপমঞ্জরী, অরুণ রঞ্জনী, দেবযানী, দোলন চাঁপা, মীণাক্ষী তাঁর সৃষ্ট রাগসমূহ আজও বাংলাগানের জগতে বিস্ময় হয়ে আছে। কিন্তু আমরা এই বিস্ময়গুলোর প্রতি শতবর্ষ ধরে বিস্মিত ভঙ্গিমায় তাকিয়ে না থেকে যদি এইসব সুর ও তাল, ছন্দ রোজকার রেওয়াজে যুক্ত করতে পারতাম তবেই হয়ত আমাদের যুগের সংগীতেও আমরা পেতাম নতুন তাল ও সুর এবং ছন্দ।

নজরুল সংগীত চর্চার অর্থ এই নয়, আমরা কেবল তাঁর রেখে যাওয়া গানগুলোকেই আওড়াব বংশ পরম্পরায়। কেননা কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা আমাদের জাতীয় গর্ব হিসেবে জাতীয় কবি উপাধিতে ভূষিত করেছি। এ ভূষণ পরিয়ে তাঁকে নিয়ে কেবল মুখস্থ জাতীয় গর্ব আওড়ালে চলবে না। কেন তিনি আমাদের জাতীয় কবি সেই উপলব্ধির জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁকে বরণ করতে হবে, তাঁর সংগীতকে চর্চা করতে হবে, তাঁর রচনাকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশ্রিত করতে হবে। নইলে জাতীয় জীবনের সাথেই যাঁকে নিয়ে চর্চার কোন যোগ নেই তাঁকে নিয়ে আগামী প্রজন্মের মনে নানারকম প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে। যেমন সমকালেরই প্রশ্ন জেগেছে, একালের সংগীত চেতনায় নজরুল সংগীত চর্চার লক্ষ্য কোথায়? নিশ্চয়ই শুধু নজরুল সংগীত চর্চার লক্ষ্য কেবল নজরুল সংগীতের শিক্ষক ও শিল্পী এবং শিক্ষার্থী হওয়া নয়! সৃষ্টিশীল সংগীতকার হওয়া, বাংলাগানে নতুন সুর-তাল-ছন্দ আবিষ্কার বা প্রবর্তন, বাংলাগানের বাণীছন্দ ও ভাবনার উন্নীতকরণ, বাংলাগানের ধারায় নতুন ধারার অবতরণ এসব কাজে যদি নজরুল সংগীত চর্চার প্রতিনিয়ত যোগ না থাকে তবে এই সংগীত মিউজিয়ামের প্রদর্শনীবস্তু হওয়ার অপেক্ষা মাত্র।

আমরা যারা শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক হয়েছি, নজরুল সংগীত শেখার বিষয়ে একটি প্রচল ধারা হল বিভিন্ন পর্বের গানের মতন আমাদের সিলেবাসে নজরুল সৃষ্ট তাল ও রাগ পর্যায়ের কিছু গান আয়ত্ত করার পাঠ থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে তালমাত্রা শেখার ক্ষেত্রে আমরা তালি খালি দিয়ে দাদরা, কাহারবা, তেওড়া, ঝাঁপ, ত্রিতাল, চৌতাল ইত্যাদি তালের বাণী ও বোল শিখি। তারপর, তবলের সাহায্যে এসব তালের বাণী ও বোল সমেত সম ফাঁক অনুযায়ী কিছু সরগম শিখে তালগুলোর চলনের সাথে, লয়ের সাথে অভ্যস্ত হই। রাগ শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা এইসব তালের সঙ্গদে রাগের স্বর অনুযায়ী সরগম দিয়ে আরোহণ অবরোহণ আয়ত্তে আনি। তারপর কিছু ছোট ছোট স্বরমালার সাথে রাগের সুরের ধাঁচে অভ্যস্থ হতে থাকি। এরপর লক্ষণগীতির মাধ্যমে কথা ও সুরে তানে সেসব রাগের পরিচিতি শিখি যা আজীবনের জন্য আমাদের মগজে গেঁথে যায়। এরপর রাগ প্রকরণের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাকালে খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরী ইত্যাদি হিন্দুস্তানি মার্গ সংগীতের পাঠ্যক্রম চলতে থাকে।

বাংলাগানের পোস্টমর্টেম নিয়ে বহুরকম কাজ হলেও শতবর্ষেও নজরুল সৃষ্ট তাল ও রাগ শেখা ও সেগুলোকে বাংলাগানের প্রকৃত স¤পদ করে তোলার বিষয়ে কোন কাজ হয়নি। আমরা বিদেশি বাদক এনে বাংলাগানের ভায়োলিন বাজানোর জন্য অর্থ বিনিময় করতে পারি কর্পোরেট হাউজগুলোর সাহায্যে। কিন্তু বিদেশি বাদক এনে নজরুল সৃষ্ট তাল ও রাগে কোন নতুন গানে বাজিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। তাতে নজরুল স্বয়ং কিছু না বলতে পারলেও নজরুলভক্তদের মাঝে হুলস্থূল লেগে যেতে পারে হয়ত। সম্রাট আকবর যে আসনে বসতেন, যে পোশাকটি গায়ে দিয়ে দরবার করতেন সেটি মিউজিয়ামের প্রদর্শনী হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের কোন কৃষক সেই আসনে বসার অধিকার রাখে না, সেই পোশাক গায়ে দিয়ে মাঠে চড়ে বেড়ানোরও সাহস দেখাবে না। কারণ সম্রাটের ব্যবহার্য সামগ্রী প্রদর্শনীর বস্তু মাত্র। সেগুলোর সাথে জনতার কোন যোগ থাকে না, শাসন ক্ষমতার যোগ থাকে। এই জাতীয় ক্ষমতার শক্তি আর শিল্প শক্তির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে। ক্ষমতার শক্তি একটি নির্দিষ্ট কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু শিল্পের শক্তি মহাকালের, অনন্তকালের বুকে শাসন করার ক্ষমতা রাখে। সম্রাট আকবরের সিংহাসন, রাজপোশাক, তলোয়ার ইত্যাদি সবই এখন যাদুঘরের সামগ্রী হলেও তাঁরই নবরত্ন সভাসদের এক রতœ মিয়াঁ তানসেনের ধ্রুপদ কিন্তু আজও জীবিত এবং হিন্দুস্থানি সংগীত রাজ্যের সর্বচ্চ ক্ষমতাবান গীতরীতি। সেই রীতির শাসন হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল সংগীত রাজ্য থেকে উপড়ে ফেলা আর সম্ভব নয়। হয়ত এর প্রচল কমে যাবে কিন্তু টিকে থাকবে রাগ শিক্ষার আদর্শ পাঠ হয়ে।

আমাদের সংগীত চেতনায় জাতীয় কবির মর্যাদা কোথায়? প্রতিনিয়ত কি আমরা তাঁর প্রচলকৃত তাল, রাগ, ছন্দ চর্চা করছ? না। কারণ আজতক তাঁর প্রচলকৃত তাল-ছন্দ ও রাগ শিক্ষার কোন আদর্শ পদ্ধতি তৈরিই করা হয়নি। রাগ ও তাল শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যম মাত্রা ও স্বর শিক্ষা। উভয় শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিত্তি মজবুত করে সরগম। আমরা কি সেই পদ্ধতিতে নজরুল সৃষ্ট তাল-ছন্দ এবং রাগ সমূহ শিখি? না। আমরা শিখি সেসব তাল ও রাগে রচিত নজরুলগীতি। যারফলে, একজন লোকগানের শিল্পী কখনই উপলব্ধি করতে পারেন না নজরুল সৃষ্ট তালে ও সুরে একটি আঞ্চলিক গীতি রচনার মাহাত্ম। কিংবা নজরুল দ্বারা প্রচলকৃত যে কোন একটি ছন্দে পপ গান বাঁধার কথা কখনই একজন পপ গানের ক¤েপাজার তার ভাবনায় আনার প্রয়োজন মনে করেন না। কারণ নজরুল সৃষ্ট তাল-ছন্দ-রাগ মিউজিয়ামের বস্তু হয়ে গেছে, আমাদের সংগীত চেতনায় এর প্রচলের প্রয়োজনীয়তা নেই। এগুলো কেবল যারা ভুরি ভুরি নজরুলগীতি শিখবে তাদেরই শেখার বস্তু। আমাদের সংগীত চর্চার দৈনন্দিনতার সাথে আমরা নজরুল সৃষ্ট ও প্রচলকৃত তাল-ছন্দ-রাগের কোন যোগ রাখিনি। কেবল নজরুলেরই নয়, প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় আমরা রবীন্দ্রপ্রবর্তিত তালের যোগ রাখিনি। এমনও কি উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রয়োজনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁও যে সকল তাল সৃষ্টি করেছিলেন আমরা সেগুলোকেও যাদুঘরের বস্তু বানিয়ে রেখেছি। তাতে ওঁনাদের কারোরই ক্ষতি হয়নি। তাঁরা প্রত্যেকেই যার যার ক্ষমতায় শাসন করেই চলেছেন। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে আমাদের। তাই আমাদের একালে কোন নতুন তান, সুর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অবশ্য অতিসম্প্রতি জনপ্রিয় জীবনমুখী গানের শিল্পী কবির সুমন সংগীত পরিচালক ও সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে রাগ আজাদ নামের একটি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। এরকম আরও হয়ত কিছু টুকরো টুকরো কাজ হয়ে আসছে।

বাংলা গানের জগতে একটি বিপন্ন ও দেউলিয়া চেতনার সঞ্চার ঘটে আসছে বহুকাল ধরে। তা হল, রাগ ও তাল এগুলো যা সৃষ্টি হবার তা বহুকাল আগেই হয়ে গেছে। তাও যারা স্রষ্টা তাঁরা সবাই হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের নির্মাতা। বাংলার সংগীতকারগণ যা করেছেন তা কেবল তাদের গানেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের নির্মাতাদেরই সৃষ্ট রাগ-রাগিণী-তাল শিক্ষা করতে হবে। এসব মানসিকতা সামনে এলে তখন একালের একজন সংগীত গবেষক হিসেবে প্রশ্ন জাগে আমরা হিন্দুস্থানি সংগীতের কাছে কী এমন ঘুষ খেয়েছিলাম যে বাংলার সংগীত নির্মাতাদের রাগ-তাল চর্চা করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ রাগ জয়জয়ন্তির কাছে যেমন কোন ঘুষ খাননি বলেই জয়জয়ন্তির সব শর্ত মেনে নেননি তাঁর নিজের গানের ভাব ও রূপ রক্ষার্থে। নজরুল ইসলামও প্রচলিত তাল-রাগে তুষ্ট ছিলেন না বলেই হাতিয়েছেন আরবিয়, সংস্কৃত ইত্যাদি জায়গায়, প্রাচীন এবং তাঁর সমকাল ঘেঁটে মিশ্রণ ঘটিয়ে তুলে এনেছেন নতুন সৃষ্টির উল্লাস। প্রচলিত রাগসুর ভেঙ্গেচুড়েই নতুন কিছু সৃষ্টির সন্ধানে বিদ্রোহীই হয়ে উঠেছিলেন। তেমনই আমরাও কারও কাছে ঘুষ খাইনি বলেই আমাদের উচিত হবে নজরুলসংগীত সম্ভার থেকে নতুন রাগ ও তাল-ছন্দকে বের করে এনে সেগুলোর যথার্থ সরগম চর্চা করা। তবেই এই তাল ও সুর আমাদের রক্তের সাথে মিশে গিয়ে ধ্বনিত হবে নবছন্দ-সুরে। তখন আর আমাদের একাল-সেকাল ঘেঁটে জনপ্রিয় গান বের করে পোস্টমর্টেম করতে হবে না; গান বানাতে আমপাবলিকের কথা মাথায় রাখতে হবে না; সংগীতের নিয়মেই নতুন নতুন সুরে ছন্দে বাংলাগান সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠবে। আমাদের সংগীতও তোতাবুলি আওড়ানো থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে পাবে নতুন সৃষ্টি সুখের উল্লাস। একালের সংগীত চেতনায় নজরুলসংগীত চর্চার লক্ষ্য নব সৃষ্টির পথ অন্বেষণ করাই হয়ে উঠুক মুখ্য। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫তম মহাপ্রয়াণ দিবসে এই হোক আমাদের সংগীত সমাজের প্রত্যয়।