ভাটিয়ালি- ভাওয়াইয়ার ঘোমটা মোচন

গোলাম মুরশিদ
Published : 30 June 2021, 03:17 PM
Updated : 30 June 2021, 03:17 PM

আগেই লক্ষ করেছি, ভাটিয়ালি রাগিণীর কথা চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মালাধর বসু এবং আলাওলে পাওয়া যায়। তা ছাড়া, এখনো এই রাগিণী উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতে প্রচলিত আছে এবং তা খানিকটা বাউল সুরের মতো। ওদিকে, পূর্ববঙ্গের একটি বিশেষ অঞ্চলের পল্লীগীতি অর্থেও ভাটিয়ালি কথাটা প্রচলিত আছে। এই দুই ভাটিয়ালির মধ্যে কোনো যোগাযোগ রয়েছে কিনা, তা প্রমাণের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু পল্লীগীতি অর্থে ভাটিয়ালি শব্দটা আধুনিক বাংলা ভাষায় কিছু কাল আগেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো বলে মনে হয় না। নজরুল ইসলাম কৃষকের মুখে ভাটিয়ালি গান শোনার কথা লিখেছেন ১৯২৮ সালে। জসীমউদ্দীন লিখেছেন ১৯৩৩ সালে, তবে গান অর্থে নয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাংলা অভিধানে (১৯৩৭) অথবা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষেও (১৯৩৪) ভাটিয়ালি শব্দ অথবা গানের উল্লেখ নেই।
পল্লীগীতি অর্থে ভাটিয়ালি শব্দটা যে যথেষ্ট আগে প্রচলিত ছিলো না, তার আরও একটা পরোক্ষ প্রমাণ বিশাল রবীন্দ্রসাহিত্য। নানা ধরনের গান দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যে রাগ সংগীতের প্রভাবই ছিলো সবচেয়ে বেশি। তার কারণ, তাঁদের বাড়িতে গানের আসর বসতো প্রায়ই। গানের আসর অর্থাৎ উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর। তা ছাড়া, তাঁদের বাড়িতে ছিলেন বেতন-ভুক একাধিক ওস্তাদ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে, ছেলেবেলায় তাঁর এই আসরে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না, তাঁর মতো অন্য ছোটোদেরও। তা সত্ত্বেও দূর থেকে শুনে শুনেই তাঁর মনের মধ্যে সুরগুলো গেঁথে গিয়েছিলো। গানের আসর ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে বসতো ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা অনুষ্ঠান। সেখানে গাওয়া হতো ব্রহ্মসংগীত। তাঁর এক বড়ো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সংগীতে খুব পারদর্শী ছিলেন। অনেক সময়ই, তিনি পিয়ানো অথবা কোনো না কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। বলতে গেলে, নিজের চারদিকে গান নিয়েই জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তারপর যখন যৌবনে পা রাখলেন তিনি, তখন থেকে নানা ধরনের গান শুনেছেন। যে-সব সুরের মধ্যে যেগুলো তাঁর ভালো লেগেছিলো, সেসব তিনি আত্মসাৎ অর্থাৎ নিজের করে নিয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন সতেরো-আঠারো বছর বয়সে। সেখান থেকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমা সংগীত, বিশেষ করে সে দেশের কথাপ্রধান গান, যাকে সে দেশে বলে 'ফোক সং'।

তারও দশ-বারো বছর পরে, জমিদার সেজে তিনি গিয়েছিলেন মধ্যবঙ্গে। সেখানে প্রথমেই তাঁর মনে ধরলো বাউল গান, বাউল-মেশানো কীর্তন গান, এমন কি, বাউল-মেশানো সারি গান। সেসব গানের সুরকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। তারপর এক সময়ে নিজের গানে তিনি সেসব সুর মিশিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন, বাউল সুর আর বাউল গানের মর্মকথাকে তিনি নিপুণভাবে নিজের করে নিয়েছিলেন। তারপর সেই বাউল উপাদান দিয়ে তিনি এতো গান রচনা করেছিলেন যে, শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর নাম দিয়েছেন, 'বঙ্গের সবচেয়ে সেরা বাউল।'

কিন্তু ভাটিয়ালি গানের কী হলো? কবি যেখানে ছিলেন, বোটে বোটে তিনি যে-এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেই পদ্মা-গোড়াই বিধৌত অঞ্চলে ভাটিয়ালি গান কি গাওয়া হতো না? পল্লী-বধূর বিরহের কথা ভাটিয়ালি সুরে ভেসে এসে তাঁর হৃদয়কে কি স্পর্শ করেনি? কী আশ্চর্য! তাঁর গানে ভাটিয়ালি সুরের প্রভাব তো দূরের কথা, তাঁর সমগ্র রচনায় ভাটিয়ালি কথাটা কোথাও লিখেছিলেন বলেও চোখে পড়েনি। এ থেকে মনের ভেতরে একটি প্রশ্নই জেগে ওঠে—ভাটিয়ালি সুর তখন এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো কিনা। খুব সম্ভব ছিলো না। ভাটিয়ালি গান এ অঞ্চলে এসেছে, অনুমান করি, ১৯২৫-৫০ সালের দিকে। নজরুল ইসলাম কৃষকের মুখে ভাটিয়ালি গান শোনার কথা লিখেছেন ১৯২৮ সালে। জসীমউদ্দীনও ভাটিয়ালির কথা লিখেছেন ১৯৩৩ সালে, তবে গান অর্থে নয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাংলা অভিধানে (১৯৩৭) অথবা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষেও (১৯৩৪) ভাটিয়ালি গানের উল্লেখ নেই।

আসলে, ভাটিয়ালি গানের মূল নিবাস ময়মনসিংহ এবং তার আশে-পাশের এলাকা (দক্ষিণ সিলেট, কুমিল্লা ও ঢাকা অঞ্চল)। ফরিদপুর অথবা বরিশালকে ভাটিয়ালি গানের অববাহিকা বলে ধরা হয় না। ভাটিয়ালি গানের কথা এবং সুর ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন জসীমউদ্দীন। তিনি তখন ময়মনসিংহ অঞ্চলের নানা ধরনের পল্লীগীতি সংগ্রহ করছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের জন্যে। তিনি যেসব গান সংগ্রহ করেছিলেন, তার মধ্যে ভাটিয়ালি গানও ছিলো।
গানগুলোর 'কথা' তিনি নিশ্চয় লিখে এনেছিলেন। কিন্তু তখন গ্রাম থেকে গানের সুর রেকর্ড করে শহরে নিয়ে যাওয়ার কোনো যন্ত্র বঙ্গদেশে ছিলো না। তা হলে জসীমউদ্দীন ভাটিয়ালির সুর কলকাতায় নিয়ে গেলেন কী করে? ধারণা করি, ভাটিয়ালি সুর তিনি তাঁর গলায় করেই নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কবি ছিলেন, গদ্য লেখক ছিলেন, কাহিনীকার ছিলেন, কিন্তু তিনি গায়ক ছিলেন বলে কেউ দাবি করেননি। আব্বাসউদ্দীনের কোনো কোনো গানের ডিস্কের ওপর যদিও সুরকার হিসেবে জসীউদ্দীনের নাম লেখা আছে। আমার মনে হয়, জসীমউদ্দীনের গলায় সাতটি স্বর শুদ্ধভাবে খেলতো না। কারণ তিনি গানের তালিম পেয়েছিলেন বলে জানা যায় না। তাঁর সংগৃহীত গানগুলোর সুর অর্থাৎ সুরের কাঠামো তিনি আব্বাসউদ্দীনের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তারপর দক্ষ গায়ক আব্বাসউদ্দীন সুরগুলোকে মসৃণ করে নিয়েছিলেন।
বোঝা যায়, জসীমউদ্দীনের সুরগুলোর মধ্য থেকে আব্বাসউদ্দীন আট-দশটা প্রামাণ্য কাঠামো খাড়া করেছিলেন। শচীনদেব বর্মণও জসীমউদ্দীনের দু-একটা গান গেয়েছিলেন। সে গানের সুর আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া গানগুলোর সুর থেকে খানিকটা ভিন্ন—কুমিল্লা-ত্রিপুরা অঞ্চলে প্রচলিত সুর, সেই অঞ্চলের বাউল সুরের মিশ্রণ ছিলো তাতে। নজরুল ইসলামের 'পদ্মার ঢেউ রে' গানটাও গেয়েছিলেন শচীনদেব। কিন্তু এ গানের সুর মূলধারা ভাটিয়ালির সঙ্গে ঠিক মেলে না। আবদুল করিমের বাউল-মেশানে ভাটিয়ালি গানও দু-একটা আব্বাসউদ্দীন গেয়েছিলেন।

এসব গানের সুরই গ্র্যামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো। আব্বাসউদ্দীন এবং শচীনদেব বর্মণ ভাটিয়ালি সুরের যে-ভিত রচনা করেছিলেন, সেই ভিতের ওপর নতুন কথা বসিয়ে পরবর্তী কালে নতুন নতুন গান তৈরি করেছেন গীতিকার আর সুরকারগণ। এবং সেই ভাটিয়ালি গান বঙ্গদেশের পূর্ব অঞ্চলে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর পর আবদুল আলিম, নির্মলেন্দু চৌধুরী, নীনা হামিদ. আবদুল লতিফ প্রমুখ গায়কের মাধ্যমে ভাটিয়ালি গানের কথা ও সুরে বৈচিত্র্য আসে। কিন্তু ভাটিয়ালি গানের প্রচলন এবং জনপ্রিয়তা লাভের পেছনে যে-দুজনের অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁরা হলেন এই গানের সংগ্রাহক ও আংশিক রচয়িতা জসীমউদ্দীন এবং এ গানের প্রামাণ্য সুরদাতা ও গায়ক আব্বাসউদ্দীন।
এঁদের যুগল সম্মিলন যেসব গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তার মধ্যে নীচের তালিকার গানগুলোর কথা মনে পড়া স্বাভাবিক।
নদীর কূল নাই কিনার নাই
আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না
তোরা কে যাবি লো জল আনতে
আমি ভাবি যারে পাই না গো তারে
আমায় এত রাতে ক্যানে ডাক দিলি
রঙিলা, রঙিলা রঙিলা রে আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলা রে
আমায় ভাসাইলি রে আমার ডুবাইলি রে
আমার হাড় কালা করলাম রে
রঙিলা নায়ের মাঝি
নিশীথে যাইও ফুল বনে, ও ভোমরা
ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙল বাইতে
প্রাণ সখী রে ঐ শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে
ও আমার গহীন গাঙের নাইয়া
উপরের গানগুলোর সবই জসীমউদ্দীন রচনা অথবা সংস্কার করেছিলেন কিনা, তা হলপ করে বলা যায় না। কিন্তু তিনি এবং আব্বাসউদ্দীন মিলে যে-অসাধারণ সুরসুধা সৃষ্টি করেছিলেন, সে কথা স্মরণ করে আব্বাসউদ্দীনকে লক্ষ্য করে জসীমউদ্দীন লিখেছেন;
তোমার কণ্ঠে ভরে দিয়ে আমি / পদ্মা নদীর সুর
ভাটিয়াল সুরে ভেসে যাব কোনো / ভাটির সুদূর পুর।
ভাওয়াইয়া গানের ইতিহাসও অনেকটা ভাটিয়ালির মতো। ভাওয়াইয়া গান তার জন্মস্থান থেকে কলকাতায় গিয়ে তারপর রেকর্ডের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকের গানগুলো সংগ্রহ করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। গেয়েওছিলেন তিনি। তাই তাঁর গাওয়া গানগুলো হলো খাঁটি সুরের গান। তাঁর আত্মীয় আবদুল করিম তাঁকে এ গান সংগ্রহ করতে সহায়তা করেন। ভাওয়াইয়া গানের রকম ফের আছে। যেমন, দীঘলনাসা ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল ভাওয়াইয়া ও চটকা। এই সুর কোচবিহারের পুবে আসামের দিকে এবং দক্ষিণে রংপুরের দিকেও শোনা যায়। ভূপেন হাজারিকার গাওয়া 'মাহুত বন্ধু' গানটি যেমন। ভাওয়াইয়ার 'মাহুত বন্ধু' হলো হাতির চালক। 'গাড়িয়াল ভাই' হলো যে গরুর গাড়ি চালক। আর মোষের গাড়ির চালক হলো 'মৈষাল'। এই তিন রকমের চালককে উদ্দেশ্য করে তিন রকমের ভাওয়াইয়া। কিন্তু এই তিনের বিষয়বস্তু কমবেশি একই রকমের। এখানে একটা কথা না-বললে ভাওয়াইয়া গানের প্রতি অবিচার করা হবে। ভাটিয়ালি এবং ভাওয়াইয়া গান প্রধানত প্রণয় ও বিরহের। কোথাও কোথাও আধ্যাত্মিকতার ছাপও লেগেছে। কিন্তু কিছু ভাওয়াইয়া গানে চমৎকার হাস্যরসের অবতারণা করা হয়েছে।

১৯৩০ সালে দুটি গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আব্বাসউদ্দীন গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তারপরই তিনি তাঁর সংগৃহীত ভাওয়াইয়া গানগুলো রেকর্ডে গাওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে নজরুল ইসলাম এবং রেকর্ড কম্পেনির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। সময়টা অনুমান করা যায়। তিনি 'নদীর নাম সই কচুয়া, মাছ ধরে মাছুয়া' গানটি কলকাতায় গাইলে পর নজরুল ইসলাম তা শুনে এতোই মুগ্ধ হন যে, সেই গানের সুরে 'নদীর নাম সই অঞ্জনা' গানটি রচনা করেন। অতঃপর নজরুল ইসলামের গানটি রেকর্ড হয়। এই গানটি রেকর্ড হয় ১৯৩২ সাালে। আমরা আগেই এ গানটির কথা উল্লেখ করেছি। সুতরাং আব্বাসউদ্দীন সম্ভবত ১৯৩২ সালের আগে ভাওয়াইয়া গান কলকাতায় আনেননি।
ভাওয়াইয়া সুরে গান লেখা তো দূরের কথা, ভাওয়াইয়া কথাটাও রবীন্দ্রনাথ কোথাও লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। সে দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ভাওয়াইয়া এবং ভাটিয়ালি গান নাগরিকতার স্পর্শ লাভে সর্ববঙ্গীয় গানে পরিণত হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে। তার আগে পর্যন্ত এ গান ছিলো বিশেষ অঞ্চলের গ্রাম্য গান।
(চলবে)