সংগীতে নির্মমভাবে আধুনিক রবীন্দ্রনাথ

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 8 May 2021, 12:51 PM
Updated : 8 May 2021, 12:51 PM


রবীন্দ্রনাথ যখন গান বুনতে শুরু করেন তখন নাগরিক সমাজে বাংলাগানের পরিবেশ ছিল 'পরের ধনে পোদ্দারি' চর্চার মানসিকতা। পরের ধনে পোদ্দারি বলার অর্থ হল বাংলাগানে তখন শাসকের ন্যায় রাজত্ব করছিল হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সংগীত। আর সেই রাজত্বের ঔপনিবেশিকতায় সৃষ্ট দাসে পরিণত হয়েছিল বাঙালি কালোয়াতি ওস্তাদ বর্গ। সে সময় হিন্দি-উর্দু-পার্সি ইত্-যাদি ভিনভাষার ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী না শিখলে বাঙালি গায়কের জাত-কূল-মান-সম্মান থাকতো না শিক্ষিত বাঙালি সমাজেই। রাজতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্র উবে গেলেও উচ্চবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির বৈঠকখানায় দরবারী আমেজ আর খুশবু প্রবেশ করেছিল আধুনিকতার ধাঁচে। এই উচ্চবিত্ত মহলেই চলত পরের ধনে পোদ্দারি কৃষ্টি। হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের দাসত্ব বৃত্তি করাই সেকালে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ প্রায় নির্ধারিতই হয়ে গেছিল। তৎকালীন বাঙালি গায়ক ও ওস্তাদ সমাজেরই ইতিহাসে এর নজীর ভুরিভুরি পাওয়া যায়। বাঙালির সংগীত সমাজেই বাংলাভাষায় রচিত খেয়াল গানকে মেনে নেওয়ার উদাহরণ সে সময়ে খুঁজতে গেলে ইতিহাসের পাতা হাতড়াতে থাকলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে এসেই পৃষ্ঠা ঠেকে যায়। আর ওতেই প্রমাণ মেলে, হিন্দুস্তানি সংগীতের ওপর সেসময়ের বাঙালি সংগীত সমাজের যত অধিকার আর অগ্রাধিকার জন্মেছিল, অথচ আপন সত্তার বাংলাগান থেকেই যেন তখনকার শিক্ষিত বাঙালি ঠিক ততটাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যারফলে হাজার বছরের জীর্ণ প্রাচীন হিন্দুস্তানি বন্দেশের চর্চা রাগে, ঠাটে, তানে, বাটে বহাল থাকলেও বাঙালির প্রাচীন খুঁজতে গেলে চর্যাপদের সুর বিহীন বাণী কঙ্কাল বৈ আর কিছু মেলে না। আমাদের সৌভাগ্য যে, এই 'আপনি কেটেছে আপনার মূল' স্বভাবের বাঙালি সমাজে একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন বলে বাংলাগানে মুক্তি এসেছিল, তেমনি দাসত্ব চেতনার কলুষমুক্ত হয়েছিল বাঙালির মনন।
আর্য ভারতীয় সংগীতের আদি ইতিহাসে তাকালে দেখা যায়, ধর্মের মতন সংগীতেও নারী-পুরুষ এমনকি সন্তান সন্ততির ব্যাপার স্যাপার ছিল। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান ছাড়া যেমন সংসারধর্ম বাঞ্চাল হএয় যায়, তেমনি তাদের সংগীতও সেই সংসার চেতনার বাইরে থাকতে পারত না। রাগ যদি রাজা হয় তো রাগিণী তবে রানী, আবার রাগ-রাগিণীর মিশ্রণে যে নতুন সুর উদ্ভাবিত হয়েছে, সেগুলো পুত্র নয়ত পুত্রী। তাদের ধর্মেও দেখা যায়, দেব দেবীর সন্তান সমেত সংসারচিত্র। হিন্দুস্তানি সংগীত সমাজও আর্য সংগীত চেতনার বাইরে ছিল না। বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় পৌঁছে সেই প্রাচীন সংগীত বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেন বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে। তাঁকেও নানা ঝক্কি পোহাতে হয়েছে আধুনিক হিন্দুস্তানি সংগীত পদ্ধতি প্রচার প্রসারে। কিন্তু বাংলাদেশের সংগীত সাধকগণ তোতাবুলির মতন হিন্দুস্তানি সংগীত আওড়াতেন বলে গুরুবাক্যই তাদের কাছে আসমানি আয়াত সম ছিল। তাই বাংলার অঞ্চল সমূহে ভাতখণ্ডের আধুনিক চিন্তা প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী রবীন্দ্রযুগেও বেগ পেতে হয়েছিল। আজকের যুগেও সেই প্রাচীন রাগরাগিণীর সংসার চলছে, কিন্তু ভদ্রতা রক্ষার দায়ে হিজাবের মতন আধুনিকতার ঘোমটা পরানো হয়েছে কোথাও কোথাও। নইলে আজকের যুগেও অনেক ওস্তাদকে ঝক্কি পোহাতে হয় আধুনিক বাংলাভাষায় রচিত একটা খেয়াল গান লিখতে বা গাইতে! আজও বাঙালির সংগীত সমাজে গালগপ্প চলে, খেয়াল, গজল গান কি বাংলাভাষায় হিন্দি উর্দু ভাষার মতন আমেজ আনতে পারে (?) আর এসব আজও বাঙালিকে সংগ্রাম করেই বাংলা খেয়াল গান তৈরি করতে হয়- এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে বাংলা খেয়াল গানের সার্থক প্রণেতা সমাকালের সংগীত প্রজ্ঞা আজাদ রহমান জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়) এই দুইজনের নাম উল্লেখ করে এখানে আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখা শ্রেয় মূল বক্তব্যের পরিধি বিবেচনায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নির্মমভাবে একজন আধুনিক মানুষ। বাঙালি সংগীত সমাজে তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন, '…বাংলাদেশের সংগীতের প্রকৃতিগত বিশেষত্ব হচ্ছে গান, অর্থাৎ বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ। কিন্তু, এই রূপকে সর্বদা প্রাণবান করে রাখতে হলে হিন্দুস্তানি উৎসধারার সঙ্গে তার যোগ রাখা চাই। আমাদের দেশে কীর্তন ও বাউল গানের বিশেষ একটা স্বাতন্ত্র্য ছিল, তবুও সে স্বাতন্ত্র্য দেহের দিকে; প্রাণের দিকে ভিতরে-ভিতরে রাগ রাগিণীর সঙ্গে তার যোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি…'(সুর ও সংগতি/ সংগীত চিন্তা)। এই কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত পণ্ডিত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। বাঙালির কীর্তন গান সরাসরি মসনদী পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা এমন এক গান একদা যার শ্রোতা সম্ভার সৃষ্টি হয়েছিল রাজ দরবার থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। ধর্মীয় কলেবরে রচিত হওয়ায় এ গান আজ দায়কতার দায়ে কেবল ধর্ম সংগীতে পরিণত হয়েছে। আবার বাউল গান এমন এক গান যা মসনদ থেকে শত মাইল দূরের সৃষ্টি, যার শ্রোতা সম্ভার এককালে গুহ্যধারী থাকলেও পরবর্তী কালে বাঙালি সমাজের সর্বস্তরেই এই গান পৌঁছে যায় এবং বর্তমানে শ্রোতার পরিধি ব্যাপ্ত করে। অথচ বাউল গানও এক প্রকার ধর্মীয় সংগীত, বাউল ধর্মশিক্ষার বাহন হিসেবে এই গানের উন্মেষ ঘটেছে। কীর্তন ও বাউল গান দুটোই এক প্রকার ধর্মীয় সংগীত। কীর্তনে দেবতা নির্দিষ্ট আছে, আর বাউলগানেও ঈশ্বর নির্দিষ্ট না হলেও একেশ্বরবাদী চেতনা রয়েছে। দর্শনগত ধারায় মিল খুঁজতে গেলে দুই ধারার গানেই- একমে অদ্বিতিয়াম ব্যাপারটি আছে। কিন্তু দুটোর মধ্যে বড় পার্থক্য হল- প্রথমটি সাম্প্রদায়িক, দ্বিতীয়টি অসাম্প্রদায়িক। প্রসঙ্গেক্রমে উল্লেখ্য, গ্রামের পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাউল গানের সাথে শহুরে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে প্রথম পরিচিয় করিয়ে দেন যিনি তিনিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশেষ করে ফকীর লালন শাহ, গগন হরকরা প্রমুখের নাম ও তাঁদের ভাবস¤পদ সম্পর্কে তৎকালের বাঙালি বাবু সমাজ ইতঃপূর্বে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আরও উল্লেখ্য যে, যখন কীর্তন-বাউল সৃষ্টি হয়েছিল তখনকার যুগে বাংলাসংগীত সমাজে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয়সংগীতের কোন রাজত্ব বা স্থান ছিল না। এসব গীতরীতি বাংলার আপন রাগ-রাগিণী সুর বৈচিত্রে রচিত হয়েছিল। এখানে অনেকে বলতে পারেন, কীর্তন গানে যে সকল রাগের প্রচলন আছে তা হিন্দুস্তানি সংগীতেও আছে। কিন্তু প্রমাণ স্বরূপ বলা যাবে, কীর্তনে এমন কিছু তাল ও রাগের ব্যবহার রয়েছে যা হিন্দুস্তানি সংগীতেও নাই। আর কিছু প্রাচীন রাগ তো চর্যাপদেও ছিল, সেগুলোর মধ্যে অনেক রাগ স¤পর্কেও হিন্দুস্তানি শাস্ত্রসংগীত নীরব। বলা যায় হিন্দুস্তানি সংগীতে সেগুলোর অস্তিত্বই নেই। পরাশক্তি বিদেশি শাসনে অধীনস্থ উপনিবেশিক মনোভাবই আমাদের হারিয়ে দিয়েছে অতীত সংগীত ও ইতিহাস স¤পদ। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে ফিরে যাওয়া যাক। বাংলাদেশের গান স¤পর্কে তাঁর বক্তব্যে আধুনিক মননের পাশাপাশি হিন্দুস্তানি সংগীত থেকে বাংলাগানকে স্বতন্ত্র করে রাখার বিচক্ষণতাও প্রকাশ পায়। এই প্রকাশভঙ্গিটি তাঁর পূর্বে আর কারো বক্তব্যে এত স্পষ্ট করে পাওয়া যায় না।

যা হোক, বলছিলাম বাঙালির পরের ধনে পোদ্দারি স্বভাবে বা ঔপনিবেশিক মনভাবে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক চিন্তার কুঠারাঘাতের কথা। বাঙালি সমাজের গায়ক ও ওস্তাদ সমাজে তিনিই প্রথম বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, বাংলাগানে কিছু পাওয়ার জন্য কিম্বা কিছু নতুন যোগ করবার জন্য হিন্দুস্তানি কালোয়াতি আমরা শিখবো কিন্তু '…ওস্তাদী করবার জন্যে নয়। বাংলা গানে হিন্দুস্তানি বিধি বিশুদ্ধ ভাবে মিলছে না দেখে পণ্ডিতেরা যখন বলেন সংগীতের অপকর্ষ ঘটছে, তখন তাঁরা পণ্ডিতি স্পর্ধা করেন- সেই ¯পর্ধা সব চেয়ে দারুণ'(ঐ)। কারণ,বাংলাভাষা সাহিত্যেও যখন সংস্কৃতের আধিপত্য বেড়ে গেছিল তখন ভাষা পণ্ডিতদের দাপটে তখন কিন্তু ভাষাশক্তির নিয়মেই বাংলাভাষা সংস্কৃতের সাথে বন্ধন বিচ্ছিন্ন করেছিল এবং নতুন নতুন সৃষ্টির পথে হেঁটেছিল বলে একদা সেই বাংলাভাষাই পরিণত ছিলো গণমানুষের রাষ্ট্রভাষার দাবী আদায়ের চিৎকার। রবীন্দ্রনাথও নির্মমভাবে আধুনিক ছিলেন বলেই তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টির রাডারে ধরা পড়েছিল, বাংলাদেশের সংগীত সমাজে সেইসব হিন্দুস্তানি পণ্ডিতি স্পর্ধাও একদিন সংস্কৃত পণ্ডিতদের মতোই থেমে যাবে এবং বাংলা গান সৃষ্টির নানা ধারায় প্রবাহের ফলগু হয়ে উঠবে। আজকের যুগে আমারা কতরকমের বাংলা গান পাই অন্য কোন সংগীতের শাসনবেড়ি ছাড়াই। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সেকালের কীর্তন-ধ্রুপদ-ধামার ইত্যাদি মুখস্থ স্টাইল ছেড়ে দেশপ্রেম, ঋতু-প্রকৃতি, চা, বন্ধুত্ব, বিশ্বভ্রাতিত্ব, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি নতুন নতুন বিষয়ে গান লিখেছেন। তাঁর আধুনিক মননের ছোঁয়ায় বাংলাগানকে পরের ধনের দালালি থেকে মুক্তি এনে দিয়েছেন। তাই তিনি অকপটেই বলতে পেরেছিলেন, '…সংগীতে আমি নির্মমভাবে আধুনিক, অর্থাৎ জাত বাঁচিয়ে আচার মেনে চলি নে। কিন্তু একেবারেই ঠাট বজিয়ে না রাখি যদি তবে সেটা পাগলামি হয়ে দাঁড়ায়'(ঐ)। সার্ধশত বছরের পুরনো একজন আধুনিক মননের রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালে সার্থকভাবে নিজস্ব ঠাট বজিয়ে রেখেছিলেন বলেই আজও আমরা তাঁর আধুনিকতা নিয়ে ভাবনায় পড়ে যাই। আজও তাঁর গান আমাদের কাছে নতুন কিছু শেখায়। তাঁর গানে গানে ভাবনা কেঁপে ওঠে, প্রকৃত মানুষ হওয়ার তালিম পাই। এই মহাগুণীর ১৬০তম জন্মজয়ন্তীতে জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।