মুসলমান সমাজে গান

গোলাম মুরশিদ
Published : 5 April 2021, 05:42 AM
Updated : 5 April 2021, 05:42 AM

একশো বছর আগেও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে গান শোনা ছিলো হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। এমন কি, এখনও অনেকে গান শোনা ঠিক পছন্দ করেন না। বিশেষ করে বাজনা জিনিশটাকে তাঁরা আদৌ অনুমোদন করেন না। অথচ ১৯৩০/১৯৪০ দশকের সময়েও বাজনা বাজিয়ে মসজিদের ধারে-কাছে গেলেও হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে দাঙা শুরু হয়ে যেতো। কিন্তু অবাক হবার বিষয় হলো, সমগ্র ভারতবর্ষে উচ্চাঙ্গ সংগীতের জগতে আধিপত্য করতেন মুসলমানরাই। সেতার ও সরোদ বাজানোতেও বাঙালি মুসলমানরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গদেশের মুসলমানরা অবশ্য কণ্ঠসংগীতে তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেননি। এক কথায় বললে, তাঁদের মধ্যে গানের চর্চাও তেমন ছিলো না।
নজরুল ইসলামকে রক্ষণশীল মুসলমানরা দীর্ঘ দিন নিজেদের কবি হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং ১৯২২ সালে তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে মুসলমান সমাজের নেতারা তাঁকে বরং নানা ভাষায় গালাগালি করতেন। কেউ তাঁকে বলতেন কাফের (নাস্তিক), কেউ বলতেন শয়তান বা ইবলিস, কেউ বলতেন ফেরাউন। এ ছাড়া, তাঁরা তাঁকে নানা ভাষায় গালাগালি করতেন। তারপর তিনি যখন গান লেখা আরম্ভ করলেন, তখন তাঁকে আরও গালাগালি করতে আরম্ভ করলেন।
বিশ শতকের শুরু থেকে কলকাতায় গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি করার একাধিক কম্পেনি স্থাপিত হয়েছিলো। গওহার জান ছাড়া, মুসলমান গায়করা কেউ তখন রেকর্ড করতে সাহস পাননি। অথবা তাঁদের হয়তো গানের মানও তেমন উঁচু ছিলো না। কিন্তু গওহর জান ছিলেন বাইজি। গান গাওয়া ছিলো তাঁর পেশা। তিনি বিভিন্ন ভাষায় বহু গান করেছিলেন। বাংলাতেও কয়েকটা গান গেয়েছিলেন। সেই সময়ে কলকাতায় আসেন মোহাম্মদ কাশেম মল্লিক নামে একজন গরিব মুসলমান। বর্ধমানের লোক। তিনি ভাগ্যের খোঁজে কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন উত্তর ভারতের কানপুরে। সেখানে গিয়েও টাকাপয়সা তিনি আয় করতে পারেননি। কিন্তু এক ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলেন। তাঁর গলাও ছিলো মিষ্টি। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি এক দোকানে ছোট্টো একটা কাজ জুটিয়েছিলেন। অচিরেই দোকানের মালিক তাঁর গানের ভক্ত হয়ে গেলেন। কাছাকাছি অন্য যারা কাজ করতো, তারাও তাঁর গান শুনে তারিফ করতে আরম্ভ করলো। একদিন তিনি দোকানের বাইরে বসে গান করছিলেন। অমনি রাস্তায় ভিড় জমে গেলো। সেই ভিড়ের মধ্য দিয়ে গাড়িতে যাচ্ছিলেন এক সায়েব। তাঁরও সেই কাশেমের গান ভালো লাগলো।


এই সায়েব ছিলেন জার্মান গ্রামোফোন কম্পেনির কর্মকর্তা। তিনি কাশেমকে জিজ্ঞেস করলেন, রেকর্ডে গান গাইতে কাশেম রাজি কিনা। কাশেম সঙ্গে সঙ্গে রাজি। এটা ১৯০৯ সালের কথা। পর দিন কম্পেনিতে গেলেন কাশেম। সেখানে সমস্যা দেখা দিলো তাঁর নাম নিয়ে। মুসলমানী নামে গান গাইলে হিন্দুরা রেকর্ড কিনবে না। কারণ এসব গানের বিষয়বস্তু হলো হিন্দু দেবদেবীদের ভজনা করা। কাজেই কাশেমকে প্রথমেই একটা নতুন নাম দেওয়া হলো—কে. মল্লিক। কে মল্লিক প্রথমে বারোটি শ্যামাসংগীত রেকর্ড করেন। তারপর তিনি নানা ধরনের গান গেয়ে চললেন। তিনি কখনও শ্যামাসংগীত, কখনও কীর্তন, কখনও অন্যান্য গান করতে থাকলেন। তাঁর নামও হলো খুব। পরে কে. মল্লিক রেকর্ডে নজরুল ইসলামের গানও গাইতেন। রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদের দু-একটা গানও গেয়েছিলেন।
ওদিকে, নজরুল ইসলাম কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। যদিও অনেক মুসলমানের চোখে লিখে তিনি কুখ্যাত হয়েছিলেন। তারপর তিনি দু-একটা করে গানও লিখতে আরম্ভ করলেন। ১৯২৬ সালের শেষে তিনি বেশি করে গান লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন গজল গান লেখার পর। তাঁর ছিলো দারুণ অভাবের সংসার। তিনি লক্ষ করলেন যে, গান লিখে সহজেই টাকা পাওয়া যায়। তা ছাড়া, কবিতার চেয়ে গান লেখা যায় সহজে। অতএব তিনি আস্তে আস্তে কলকাতা বেতার আর রেকর্ড কম্পেনির সঙ্গে ভিড়ে যান। রেকর্ডের গান লিখে তিনি কতোটা লাভবান হয়েছিলেন, তার একটা অভ্রান্ত প্রমাণ এই যে, তিনি ১৯২৯ সালে রেকর্ডের কম্পেনির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দু বছরের মধ্যে— ১৯৩১ সালে— একটা দামী গাড়ি কিনে ফেলেন। গাড়ি কেনেন সেই নজরুল, যে-নজরুল ১৯২৭ সালে পাঁচ টাকা / দশ টাকার জন্যে অনুনয় করে অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন প্রকাশক এবং সম্পাদকদের কাছে।
নজরুল ইসলাম গান লিখতেন গ্রামোফোন কম্পেনির চাহিদা অনুয়ায়ী। যে-গায়কগায়িকাকে দিয়ে যে-গানের রেকর্ড করতে চাইতো, কম্পেনি নজরুলকে সে গান লেখার অনুরোধ জানাতো। নজরুল সে গান লিখে, তাতে সুর দিয়ে এবং শিল্পীকে সে গানটা শিখিয়ে দিতেন। তারপর সে গান রেকর্ড হতো। প্রতিটা গানের জন্যে নজরুল নগদ বিশ টাকা পেতেন। তা ছাড়া, সেই রেকর্ড বিক্রি হলে শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে রয়্যাল্টি পেতেন। মনে হয়, তা থেকে তিনি অনেক টাকা আয় করতেন। নয়তো গাড়ি কিনতে পারতেন না।


সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিলো তাঁর ধর্মীয় গান আর গজল গানের। গজল হতো সাধারণত প্রেমের গান। আর ধর্মীয় গান হতো হিন্দুধর্মের দেবদেবীদের বন্দনার গান। নজরুল মুসলমান হলেও হিন্দুধর্মের গান লিখতে পারতেন অনায়াসে। কারণ তিনি হিন্দুধর্মের নাড়ীনক্ষত্র খুব ভালো করে জানতেন, এসব তিনি শিখেছিলেন তাঁর কৈশোরে, বিশেষ করে লেটোর দলে কাজ করার সময়ে। তা ছাড়া, তাঁর মনটা ছিলো ভক্তিরসে ভরা। সে জন্যে তিনি যে-হিন্দু ধর্মীয় গান লিখেছিলেন, সেসব গানে খুব ভক্তি আর দরদ থাকতো। রেকর্ড বিক্রি হতো প্রচুর। কিন্তু তিনি ইসলামী কোনো গান লিখতেন না। রেকর্ড কম্পেনিও ইসলামী গানের রেকর্ড প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলো না। কারণ কে কিনবে সে গান?
১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে নজরুলের অত্যন্ত আদরের পুত্র বুলবুল হঠাৎ করে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মারা যায়। সেই মর্মবিদারী শোকের ঘটনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো কিনা, জানি না। কিন্তু ঐ বছরই নজরুল দুটি ইসলামী গান রচনা করেন বোধহয় নিজের মনে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যে। গান দুটি হলো: 'বক্ষে আমার কাবার ছবি, চক্ষে মোহাম্মদ রসুল' আর 'যাবি কে মদিনায় আয় ত্বরা করি'। গান লিখলেও, সঙ্গে সঙ্গে সে-গানের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়নি। 'বক্ষে আমার কাবার ছবি, চক্ষে মোহাম্মদ রসুল' গানটি প্রকাশিত হয় প্রায় দু বছর পরে, ১৯৩২ সালের জুন মাসে, মোহাম্মদ কাশেমের কণ্ঠে। আর এর কয়েক মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হয় 'যাবি কে মদিনায়, আয় ত্বরা করি।' এটিও গেয়েছিলেন মোহাম্মদ কাশেম। এই মোহাম্মদ কাশেম এবং কে. মল্লিক একই ব্যক্তি। লক্ষ করার বিষয় হলো: মুসলমান শ্রোতাদের মনে বিশ্বাস জোগানোর জন্যে এ রেকর্ডে কে. মল্লিক নাম না-দিয়ে তাঁর মূল নামই ব্যবহার করা হয়েছে।
এ সময়ে মফস্বল থেকে এসে মঞ্চে দেখা দিলেন আর-একজন তরুণ, যিনি পরে গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এঁর নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ। নজরুলের প্রায় সমান-বয়সী। আব্বাসউদ্দীন ছেলেবেলা থেকে কোচবিহারের বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত পল্লীগান-সহ নানা ধরনের গান, যাত্রা গান, পালাগান ইত্যাদি শুনতে যেতেন। গানের প্রতি ছিলো তাঁর আন্তরিক আকর্ষণ। নিজের গলাও ছিলো মিষ্টি ও উদাত্ত। একবার নজরুল গিয়েছিলেন কোচবিহারে একটা সভায় যোগ দেবেন বলে। সেখানে আব্বাসউদ্দীন এসেছিলেন গান শুনতে। সেই সঙ্গে সুযোগ পেলে, গান গাইতে। তিনি সেখানে গাইলেন নজরুলের একটা জনপ্রিয় গান—ঘোররে ঘোররে ঘোর, আমার চরকা ঘোর। গানটি রচিত হয়েছিলো গান্ধীজীর চরকা কাটার আন্দোলন নিয়ে। গানটা গেয়ে অনেক হাততালি পেলেন আব্বাস। নজরুলও খুশি হলেন। আব্বাসকে তিনি বললেন, কলকাতায় আসতে। বললেন কলকাতায় গেলে গান গাওয়ার অনেক সুযোগ পাবেন। তারপর কলকাতায় গেলেন আব্বাস। সেখানে নজরুলের অনুরোধে এইচএমভির ট্রেনার ওস্তাদ জমীরউদ্দীন খান আব্বাসকে গান শেখাতে রাজি হলেন। আব্বাস সেই প্রথম যথার্থভাবে গানের তালিম নিতে আরম্ভ করেন। এর কিছু কালের মধ্যে গ্রামোফোন কম্পেনি তাঁর দুটি গান রেকর্ড করতে রাজি হলো। এটা ১৯৩০ সালের কথা। গান দুটি ছিলো: 'কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো' আর 'স্মরণ পারের ওগো প্রিয়'। এভাবে শুরু হয় আব্বাসউদ্দীনের সংগীত-জীবন।


গ্রামোফোন কম্পেনির অফিসে যাওয়ার সূত্রে নজরুলের সঙ্গে আব্বাসের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। আব্বাস তাঁকে অনুরোধ করেন ইসলামী গান লিখতে। নজরুলের ধারণা ছিলো, গ্রামোফোন কম্পেনির কর্মকর্তা ইসলামী গান প্রকাশ করতে রাজি হবেন না। কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের বারবার অনুরোধের জন্যে কম্পেনির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইসলামী গানের রেকর্ড প্রকাশ করতে রাজি হন। তখন নজরুল আব্বাসউদ্দীনের জন্যে একটি গান রচনা করেন: 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ'। ১৯৩২ সালে রোজার মাস শুরু হয়েছিলো ৯ই/১০ই জানুয়ারি। আর ঈদ ছিলো ৮ই ফেব্রুয়ারি। এ গানটির বাণী থেকে মনে হয় গানটি নজরুল রচনা করেছিলেন রমজান মাসের কোনো একটা সময়ে। আর রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিলো ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু এ রেকর্ডের উল্টো পিঠে যে-গানটি ছিলো—সেটি কবি রচনা করেছিলেন কয়েক মাস আগে। গানটি হলো: 'ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।' আবদুল কাদির-সম্পাদিত' জয়তী পত্রিকায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৩১ সালের শেষ দিকে, কার্তিক মাসে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, এ গান দুটিকে নজরুলের প্রথম ইসলামী গান বলে যে-দাবি কেউ কেউ করেছেন, সেটা আদৌ সঠিক নয়। আগেই বলেছি, তাঁর প্রথম ইসলামী গান দুটি খুব সম্ভব 'বক্ষে আমার কাবার ছবি' আর 'তোরা যাবি কে মদিনায় আয় ত্বরা করি।' দুটি গানই প্রকাশিত হয়েছিলো চন্দ্রবিন্দু কাব্যে, ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তবে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে গাওয়া 'রমজানের ওই রোজার শেষে' এবং তার উল্টো পিঠের গানটি—এই গান দুটি নজরুলের সর্বপ্রথম ইসলামী গানের প্রথম রেকর্ড।
কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, 'ও মন, রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ' গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি রেকর্ডটির হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছিলো। আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন যে, সেনোলা রেকর্ড কম্পেনির এক কর্মকর্তা তাঁর দোকানে বিক্রি করার জন্যে এই রেকর্ডের প্রায় দু হাজার কপি আনিয়েছিলেন। এবং সেটি নাকি বেশ বিক্রিও হচ্ছিলো। এই উক্তিকে অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয়। তখনকার বঙ্গদেশের বাংলাভাষী মুসলমানদের ঘরে দু হাজার গ্রামোফোন থাকাটা অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিক দুটি কারণে। প্রথমত, মুসলমানদের মধ্যে গান শোনা নিষিদ্ধ ছিলো। আর দ্বিতীয়ত গ্রামোফোন কেনার মতো দু হাজার বাঙালি মুসলমান পরিবার গ্রামে-গঞ্জে ছিলো কিনা, সন্দেহ হয়। শহরে বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা খুব কমই ছিলো। যারা ছিলো, তারা ছিলো উর্দুভাষী। তাদের পক্ষে বাংলা গান শোনার কথা নয়। তা ছাড়া, তখন সবচেয়ে কম দামী গ্রামোফোনের দাম ছিলো ১২০ টাকা। পোর্টেবল গ্রামোফোনের দাম ছিলো এক শো টাকার কিছু কম। ১২০ টাকায় তখন বিশ মণ চাল কেনা যেতো। গ্রামের মুসলমানদের আয় এতো কম ছিলো যে, তারা ছেলেদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে পারতো না। আর মেয়েদের তো লেখাপড়া করা বারণই ছিলো। তাই অনেকে টাকার বিনিময়ে 'বায়স্কোপ' দেখানোর মতো বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে 'কলের গান' শোনাতো। কিন্তু যারা গান শোনাকেই পাপের কাজ বলে বিবেচনা করতেন, তাঁরা এ রকম গান শুনতেন না।
সমাজের একাংশ সংগীত শোনার রীতিমতো বিরোধিতা করতেন। নজরুল যখন গ্রামোফোন কম্পেনির জন্যে সবেমাত্র গান লিখতে আরম্ভ করেছেন, তখন ১৯২৮ সালে শরিয়তে ইসলাম পত্রিকায় মওলানা আফসার উদ্দীন এক প্রবন্ধে দাবি করেন যে, কোরআন এবং হাদিস সংগীত চর্চাকে সমর্থন করে না। ফারায়েজি আন্দোলনের নেতা শরিয়তউল্লাহও সংগীত চর্চাকে বেদাত বলে ঘোষণা করেছিলেন। (স্বরোচিষ সরকার, কথাসাহিত্য ও নাটকে মুসলিম সংস্কার চেতনা; ১৯৯৭, পৃ ১৫২) অনেকেই এ মতের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সমাজের আর-এক অংশ গান শোনাকে হারাম বলে স্বীকার করেননি। মওলানা আকরম খান সংগীতের জোরালো সমর্থক ছিলেন। তিনি 'সমস্যা ও সমাধান' প্রবন্ধে বলেন যে, মুসলমানদের সংগীত চর্চা কোনোমতেই অবৈধ নয়। তিনি দাবি করেন যে, তিরিশ পারা কোরআনের এমন কোনো আয়াত নেই, যেখানে সংগীতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অথবা কোনো সহি হাদিসেও সংগীতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। (ঐ, পৃ ১৫৩)
সে যাই হোক, নজরুলের লেখা ইসলামী গানের রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পর সমাজের এই অংশের মধ্যে ইসলামী গানের একটা চাহিদা তৈরি হয়। যাঁরা গান শোনাকে নিষিদ্ধ বলে মনে করতেন, তাঁরাও আল্লাহ-খোদার নাম শুনে সে গান শুনতে আপত্তি করলেন না। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে নতুন এই যে চাহিদা তৈরি হলো, সে চাহিদা মেটানো কেবল মাত্র মোহাম্মদ কাশেম এবং আব্বাসউদ্দীনের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আব্বাসউদ্দীন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন: 'প্রায় প্রতি মাসেই আমার রেকর্ড বাজারে বের করা আরম্ভ হল। কিন্তু প্রতি মাসে গান বের হলে একজন আর্টিস্টের গান একঘেয়ে হয়ে যায়। অথচ ইসলামী গান গ্রামোফোন কোম্পানীর ঘরে এনেছে অর্থের প্লাবন। (!) তাই মুসলমান গায়কের অভাব বলে ধীরেন দাস সাজলেন গণি মিঞা, চিত্ত রায় সাজলেন দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ী, হরিমতী এঁরা কেউ সাজলেন সকিনা বেগম, আমিনা বেগম, গিরীণ চক্রবর্তী সাজলেন সোনা মিঞা।' মোট কথা, ইসলামী গান অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলো। ১৯৩০-এর দশকের রেকর্ড বুলেটিনে বেশ কয়েকটি মুসলমানী নামই চোখে পড়ে। কবি গোলাম মোস্তফা বিএ বিটি পেশাদার গায়ক ছিলেন না, ১৯৩৪ সালে তাঁরও দুটি রেকর্ডেরও বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রকাশিত হয়েছিলো আবদুল লতিফ, মিস ফিরোজা এবং সুলতানের নামেও ইসলামী গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিলো, ১৯৩৪ সালে।
ওদিকে, নজরুল হিন্দু ধর্মীয় গানের পাশাপাশি ইসলামী গানও লিখতে আরম্ভ করলেন। তাঁর ইসলামী গান ছিলো প্রধানত দু রকমের। প্রথমত, আল্লাহ-রসুল, রোজা-নামাজ, ইহকাল-পরকাল ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়ক গান। আর দ্বিতীয়ত, মুসলিম জাতীয়তাবাদী গান। যেসব গানে নজরুল মুসলমানদের অতীত গৌরবের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁদের জেগে ওঠার এবং উন্নতি পথে যাত্রা করার আহ্বান জানান।
আব্বাসউদ্দীন উভয় ধরনের ইসলামী গানই গেয়েছিলেন। নজরুলের ইসলামী গান আব্বাসউদ্দীনই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গেয়েছিলেন। তিনি নজরুলের লেখা সব ধরনের গান মিলে প্রায় এক শো গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্তত এগারোটি গান গেয়েছিলেন ১৯৩২ সালে। প্রথম দিকে অনেক মুসলমান শ্রোতাই এসব গান শুনতে চাইতেন না। কিন্তু তিনি যখন গান ধরতেন, তখন শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর সে গানটি শুনতেন। তিনি এ সম্পর্কে একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন যে, একবার তিনি কলকাতার এক মুসলিম ছাত্রাবাসে গিয়ে এ রকম অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। কারও কারও আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি যখন গান আরম্ভ করলেন 'তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে', অমনি কথা ও সুরের মোহজালে শ্রোতারা মনোযোগের সঙ্গে গান শুনতে আরম্ভ করলেন। মোট কথা, তিনি নজরুলের ইসলামী গান গেয়ে মুসলমানদের কাছে গান শোনাকেই গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। এক দিকে, নজরুল আল্লাহ-রসুলের প্রশংসাসূচক এবং রোজা, নামাজ, হজ, জাকাত ইত্যাদি বিষয়ে ধর্মীয় গান লিখে; অন্য দিকে, আব্বাসউদ্দীন সেসব গান মুসলমানদের মধ্যে পরিবেশন করে গান শোনাকেই মুলমানদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করেছিলেন।
কেবল ইসলামী গান নয়, পল্লীগীতির মাধ্যমেও নজরুল ও আব্বাস মুসলমানদের কাছে গান শোনাকে জনপ্রিয় করেছিলেন। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন যে, মুসলমানদের কাছে পল্লীগীতিও আকর্ষণীয়। কিন্তু এ গান গাইতে পারতেন, এ রকমের মুসলমানের সংখ্যা তখন খুবই কম ছিলো। গ্রামে যেসব গান প্রচলিত ছিলো, যেমন, কবিগান, পালাগান, যাত্রা গান—সেসবের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত। অথচ পূর্ববঙ্গের গ্রামবাসীদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। তাঁদের কাছে এ জন্যে ইসলামী ভাবাপন্ন পল্লীগীতির চাহিদা ছিলো। ফলে নজরুলের লেখা গান নিয়ে আব্বাসউদ্দীন যখন তাঁদের কাছে গেলেন, তখন সে গান দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ এসব গানের বিষয়বস্তু ছিলো পল্লীসমাজ, বিশেষ করে মুসলমান সমাজ।
একটা দৃষ্টান্ত দিলে হয়তো বিষয়টাকে সহজে বোঝাতে পারবো। আব্বাসউদ্দীন কোচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড়ো হন। সেই অঞ্চলের এক ধরনের পল্লীগীতির নাম ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া গান তখনও আজকের মতো সুপরিচিত ছিলো না। অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরা এ গান আদৌ শুনতে চাইবে কিনা, তা-ই বোঝা যাচ্ছিলো না। যেমন, আব্বাসউদ্দীন একটা ভাওয়াইয়া গান জানতেন, সেটা কোচবিহারের একটা নদীকে নিয়ে। গ্রামোফোন কম্পেনি সে গানটা রেকর্ড করবে কেন? কিন্তু গানটার কথা যেমনি হোক, সুরটা নজরুলের খুব ভালো লেগেছিলো। তিনি তাই সে গানটাকে অবলম্বন করে একটা গান রচনা করলেন। এটাও নদীর নাম দিয়েই শুরু, কিন্তু গানটা প্রেমের:
নদীর নাম সই অঞ্জনা, / নাচে তীরে খঞ্জনা / পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি /
আমি যাব না আর অঞ্জনাতে / জল নিতে সখী লো / ঐ আঁখি কিছু রাখিবে না বাকি /
সেদিন তুলতে গেলাম দুপুর বেলা / কলমী শাক ঢোলা ঢোলা (সই)
হল না আর সখি লো শাক তোলা
আমার মনে পড়িল সখি, / ঢল ঢল তার চটুল আঁখি, / ব্যথায় ভরে উঠল বুকের তলা/
ঘরে ফেরার পথে দেখি / নীল সুঁদি ও কি / ফুটে আছে ঝিলের গহীন জলে /
আমার অমনি পড়িল মনে / সেই ডাগর আঁখি লো /
ঝিলের জলে চোখের জলে / হল মাখামাখি।
কী অসাধারণ রূপান্তর! যেন মাটির ঢেলাকে পরশ পাথর দিয়ে সোনায় পরিণত করা। এ গান রেকর্ড হয়েছিলো ১৯৩২ সালে, মেগাফোন কম্পেনি থেকে। একই বছর এ রকম আর-একটি রূপান্তরিত গান প্রকাশিত হয় টুইন কম্পেনির নামে। তারপর নজরুলের রচিত এবং গ্রাম থেকে সংগৃহীত পল্লীগীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 'ওরে ও দরিয়ার মাঝি' রেকর্ড হয় ১৯৩৬ সালে।
মুসলমানদের মধ্যে গানের প্রচলনে আরও একজনের অসামান্য অবদান ছিলো। তিনি জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ফরিদপুরের একটি গ্রাম থেকে কলকাতায় যান লেখাপড়া শেষ না-করেই। তিনি গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দীনেশচন্দ্র তখন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের মৌখিক এবং যেনতেন করে লেখা গান গ্রামে গ্রামে সংগ্রহ করছিলেন। তাঁর হয়ে এ গান সংগ্রহ করছিলেন চন্দ্রকান্ত দে। জসীমউদ্দীনকেও দীনেশচন্দ্র এই কাজে নিযুক্ত করেন।
জসীমউদ্দীন বহু গান সংগ্রহ করেছিলেন। তা ছাড়া, পল্লীগীতির বৈশিষ্ট্য এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা লাভ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে তিনি ডজন দুয়েক গান রচনা করেন, যা আজও পূর্ববঙ্গীয় পল্লীগীতির আদর্শ হয়ে আছে। 'ও কি ও গাড়িয়াল ভাই কত রবো আমি পন্থের পানে চাইয়া' যেমন ভাওয়াইয়া গানের আদর্শ; 'ও ভাটিয়াল গাঙের নাইয়া মা-বাপেরে কইও আমায় নাইয়র নিতে আইয়া' তেমনি ভাটিয়ালি গানের আদর্শ। জসীমউদ্দীনের যে-গানগুলো আব্বাসউদ্দীন রেকর্ডে গেয়েছিলেন, তার প্রতিটি গানই জনপ্রিয় হয়েছিলো। এবং আজও অমর হয়ে আছে।
এক কথায় বলা যেতে পারে যে, আব্বাসসউদ্দীন নজরুলের লেখা ইসলামী গান, কোচবিহার অঞ্চলে প্রচলিত ভাওয়াইয়া গান এবং জসীমউদ্দীনের সংগৃহীত পূর্ববঙ্গীয় গানগুলো গেয়ে মুসলমানদের মধ্যে গানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং গানের প্রতি তাঁদের যে-বিদ্বেষ ছিলো তা দূর করেছিলেন। তারপর যখন দেশবিভাগ হলো, তখন যাঁরা সাধারণত গান-বাজনা করতেন, সেই হিন্দুরা বেশির ভাগ দেশত্যাগ করলেও, ধীরে ধীরে মুসলমানদের মধ্যে গোড়া থেকে গান-বাজনার চর্চা আরম্ভ হলো।