খেয়াল শিক্ষা হোক প্রাণের বাংলা ভাষায়

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 1 June 2021, 06:20 PM
Updated : 1 June 2021, 06:20 PM


(প্রথম পর্ব )
যে কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য আলোচ্যবস্তুকে একটি বৃক্ষ রূপে কল্পনা করে নিলে বিশ্লেষণে সুবিধে হয়। তাতে বৃক্ষের মগডাল থেকে শুরু করে শেকড় পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখা যায়। আলোচনার বিষয় ঠিক তখনই গতি পায় যখন বিষয়টির অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতি উঠে এসে তার ভবিষ্যৎ নিরূপণ করতে থাকে। পৃথিবীর সব কিছু যেমন নিমিষেই সৃষ্টি হয়নি, তেমনি পৃথিবীর কোন বিষয়বস্তুই একক ভাবে সৃষ্ট নয়। প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্বের সাথে প্রত্যেকে সম্পৃক্ত, আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে; যাকে বলে বাস্তুতন্ত্র। প্রত্যেক বিষয়বস্তু সৃষ্টির অন্তরালে কোন না কোন বীজ নিহিত থাকে। আবার, কার্ল মার্ক্সেরও একটি সূত্রের কথা বলা যেতে পারে; বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তর। মার্ক্সবাদের এই সূত্র অনুযায়ী, কোনো কিছুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে সেই বিষয়টির অতীত ঘটনাপ্রবাহ এবং বর্তমান অবস্থানকে পর্যবেক্ষণ করা জরুরী। আবার কোনোকিছুর গঠনমূলক আলোচনা করতে হলে বিষয়টিকে ঘিরে থাকা আশপাশের বিষয়সমূহকেও পর্যবেক্ষণ করতে হয় প্রাসঙ্গিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার স্বার্থে। বর্তমান শিরোনামের মূলবক্তব্যকে যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে জরুরী হয়ে যায় বাংলার অতীত ইতিহাসের সাথে বোঝাপড়া করা। আরেকদিকে বঙ্গীয় সমাজচিন্তার ঘাট পরিবর্তনের কালগুলোকে সনাক্ত করে করে বর্তমানের সাথেও বোঝাপড়া করা।

বর্তমান শিরোনাম অনুযায়ী আলোচনার মোদ্দা বিষয় হল বাংলা খেয়াল গান। যার মূলে নিহিত রয়েছে উত্তর ভারতীয় খেয়াল গানের বীজ। সেই বীজেরও সৃষ্টি এক নিমিষে ঘটেনি, এই গানের ইতিহাসেও রয়েছে পরিমাণগত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে গুণগত পরিবর্তনের প্রবাহ। বাংলা খেয়াল গানের আলোচনায় অবধারিত হয়ে যায় হিন্দুস্তানি খেয়াল গানের বীজ ব্যুৎপত্তি কালের দুয়ার খুলে দেখা। বাংলা খেয়াল গানকে বৃক্ষরূপে প্রকাশ করলে এর অবস্থান দাঁড়ায় বাংলাগানের বনানীতে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাগানের অতীতের ঢাকনাও খুলে দেখা বাঞ্ছনীয়। এরই প্রাসঙ্গিকতায় এবং নিটোল আলোচনার স্বার্থে বাংলার অতীত ইতিহাস তুলে আনা জরুরী।

বর্তমানের জানালায় ভবিষ্যতকে সরাসরি দেখা যায় না। কিন্তু অতীত আর বর্তমানের মিশেলে ভবিষ্যতকে ঠিকই কোন না কোনোভাবে অনুমান করা যেতে পারে। অতীত পরিভ্রমণ করে বর্তমানের ওপর দৃষ্টি ফেললে বর্তমান আরও বেশী ¯পষ্ট হয়ে ওঠে। তেমনই ¯পষ্ট বীক্ষণ না হলে বোঝা যাবে না বর্তমান বাংলাদেশে প্রাথমিক সংগীত শিক্ষায় বাংলা খেয়াল গানের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায়। অথবা বাংলা গানের বনানীতে এটি নিতান্তই অথর্ব প্রচেষ্টা কি না। এভাবেই আলোচনার গতিতে স্পষ্ট হবে, সংগীত সাধক আজাদ রহমান এঁর বাংলা খেয়াল গান বাংলাদেশের প্রাথমিক সংগীত শিক্ষায় কতটা ভ'মিকা রাখতে পারছে।

প্রারম্ভে মনে রাখতে হবে, খেয়াল গান বাঙালির নিজস্ব কোনো কৃষ্টি সম্পদ নয়। বাংলা গানের বনানীতে হিন্দুস্তনি খেয়াল গান আরোপিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলার উর্বর মাটির মতই ফলনশীল বাংলার সংগীত ক্ষেত্র। ভাষার মতো সংগীতও পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের গতি ছাড়া সংগীতের বৈচিত্র্য ঘটেনা। একদা খেয়াল গানের প্রচল কেবল উত্তর ভারতীয় সংগীত পদ্ধতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলো। ত্রয়োদশ শতাব্দীর যে সময়ে খেয়াল গান দিল্লী রাজসভার তুর্কি বংশোদ্ভ'ত এক ক্ষুরধার সংগীতজ্ঞের হাতে তৈরি হচ্ছিল, তখন ভারতে চলছিল তুর্কি (খিলজি) শাসনামল। এরই ঠিক একশো বছর আগে নিজের পথ হারিয়ে ফেলেছিল সহস্র-বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে খ্যাতমান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা জনপদগুলো। ব্রাহ্মণ্যবাদের উপনিবেশ, নব ধর্মের আগমন, রাজনৈতিক-সামাজিক কলহ, জ্ঞানপীঠ ধ্বংস- সব মিলে চেতনায় অপুষ্টির মড়কে স্বীয় অস্তিত্ব-জ্ঞানবোধও হারিয়ে ফেলেছিল তৎকালীন প্রাকৃত বঙ্গজ-জীবন। বঙ্গীয় সংস্কৃতি যখন এমনই ভয়াবহ অসহায় সময় পার করে সবে ক্রান্তিকালের ক্লান্তি ভাঙছিল সেরকম মুহূর্তেই খেয়াল গান সৃষ্টি হয়েছিল দিল্লীতে। সে গান সাধারণ বাঙালির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে কয়েক শতাব্দীকাল লেগে গেছে।

মূলত রাজসভার উস্তাদ-শিষ্য পরম্পরায় বেড়ে ওঠা খেয়াল গানের প্রধান শ্রোতা ছিল রাজন্য পরিবার-বর্গ এবং তৎসংশ্লিষ্ট সমাজের উচ্চ শ্রেণিকুল। আজও এ গান কোন সাধারণ মানুষের গৃহে ওস্তাদ বিনা পা রাখে না। কেননা এই গান ওস্তাদি গান। পথে ঘাটের কোলাহলে হেসে খেলে বেড়ানোর স্বভাব এই গানে নেই। এর চরিত্র হল, সুরের অসীম ধ্যানে তালের পরিমণ্ডলে আত্মমগ্নতায় ডুবে থাকা। রাজন্যরা নিয়মিত এই গানের আসরে মজতেন। দূর থেকে এই দৃশ্যকে প্রাসাদী মনোরঞ্জন মনে হলেও এই মনোরঞ্জন শিথিল আমোদপ্রমোদ ছিলো না। খেয়াল গানের আসর মূলত জ্ঞানসাধনার আসর। রাগরাগিণীর সৃষ্টিই হয়েছে জ্ঞান সাধনার নিমিত্তে। সেই রাগরাগিণীর সুর চরিত্র প্রকাশ করার বিভিন্ন গীতরীতির মধ্যে খেয়াল গান একটি অন্যতম নান্দনিক ধারা। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উদ্ভ'ত খেয়াল গান সাধারণ বাঙালির শ্রোতার আসরে উনবিংশ শতাব্দীতেও পৌছতে পারেনি সার্বিকভাবে। যদিও এ কথাও সত্য, সম্যক চেতনার মহাজাগরণ ব্যতীত কোন উচ্চ মার্গীয় শিল্পের বার্তা সাধারণদের কাছে পৌঁছতে পারে না। দীর্ঘকালের শোষণের ফলে অশিক্ষা আর অনটনই ছিল বাংলার সাধারণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। যার ফলে, বাংলার জমিদার আর উচ্চবিত্ত সমাজে প্রাচীন সামগীত, প্রবন্ধগান, ধ্রুপদের পাশাপাশি এই খেয়াল গানের কদর তৈরি হলেও সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই ছিল কয়েক শতাব্দী যাবত। আধুনিক যুগের ঊষাকালে এই গান ধীরে ধীরে সাধারণ জনসমাগমে চলতে শুরু করে ভারতীয় সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডের অভিনব সংগীত শিক্ষানীতির বদৌলতে।


২.
আধুনিক কালের ভারতীয় সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে (জন্ম: আগস্ট ১০, ১৮৬০; বোম্বে। মৃত্যু: সেপ্টেম্বর ১৯, ১৯৩৬) ভারতীয় সংগীত ইতিহাসের একজন রেনেসাঁ পুরুষ। তাঁকে হিন্দুস্তানী সংগীত পদ্ধতির প্রাণপুরুষও মানা হয়। গুরু পরম্পরায় টিকে থাকা খেয়াল গানকে সর্বস্তরের সংগীত শিক্ষায় তিনিই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন, সার্বজনীন সংগীত শিক্ষা পাঠ্যক্রম তৈরি করে। তাই খেয়াল গান প্রসারণ প্রসঙ্গে শুরুতেই তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। কেননা তাঁর প্রসঙ্গ এলেই উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়।

তিনি কলেজ জীবনেই শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং ১৮৯০ সালে এল. এল. বি. সমাপন করে সফল আইন ব্যবসায়ী হয়েও যৌবনে মুশাফিরি শুরু করেন শুধুই সংগীত শেখার নিমিত্তে। ১৮৯৫ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রাচীন সংগীত গ্রন্থ পাঠ শুরু করেন। সেসব বই পড়তে তিনি বিভিন্ন ভাষাও (হিন্দি, সংস্কৃত, তেলেগু, গুজরাটি, মারাঠি, ইংরেজি ইত্যাদি) রপ্ত করেন। এরপর ১৮৯৬ সাল থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত কেবল দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন। তারপর উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে ঘুরে সংগীত শেখেন। ১৯০৭ সালে তিনি কলকাতায় পৌঁছান। পাথুরেঘাটার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ, পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব রাজা শৌরীন্দ্র্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে সেবারই প্রথম তিনি বাংলার বিভিন্ন লোকজ সুর এবং বিষ্ণুপুর ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে পরিচিত হন। যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে উত্তর ও পূর্ব ভারতের এই অভিযান শেষে তিনি ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে 'স্বরমালিকা' নামে প্রথম বই প্রকাশ করেন। পরে সংগীত বিষয়ে আরও অনেক গ্রন্থ একাধিক ভাষায় রচনা করেছেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সারা ভারতের সংগীত সমাজে আধুনিক ধারার সভা-সেমিনার ইত্যাদি চালু করেন। সর্বপ্রথম বিভিন্ন গীতধারার সঙ্গীতজ্ঞ এবং সংগীতশিল্পী, বাদ্যযন্ত্রশিল্পী সমাজকে একীভূত করেন। তাঁরই দেখানো নব জাগরণের পথে ভারতে উচ্চাঙ্গ সংগীত সহ বিভিন্ন সংগীত ধারায় উচ্চতর পড়াশুনার জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। তিনি নিজেও একাধিক সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্মাতা এবং রূপকার। এরই ধারাবাহিকতায় শতাব্দী ব্যাপী মহলবন্দী খেয়াল গান বাইরে এসে সুদুর প্রসারী পথ চলতে শুরু করে। ইতঃপূর্বে সংগীত সাধনা কেবল গুরুপরম্পরায় আবদ্ধ ছিল, সার্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার ইতিহাসে তিনিই অগ্রদূত।

ভ্রমণের মধ্য দিয়ে পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ন ভাতখণ্ডে আবিষ্কার করেছিলেন, বহুজাতিক মৃত্তিকার ভারতবর্ষে যাবতীয় সংগীতরীতি দুইটি প্রধান ধারায় বিভক্ত। একটি হলো কর্ণাটকী বা দক্ষিণ ভারতীয় সংগীত পদ্ধতি এবং অন্যটি উত্তর ভারতীয় সংগীত পদ্ধতি। অর্থাৎ তদানীšন দক্ষিণ ভারত বাদে ভারতবর্ষে যতদূর ভূখণ্ড বাকী থাকে, তার প্রায় সর্বত্রই উত্তরভারতীয় সংগীত পদ্ধতির অনুগামী। কেবল এটাই নয়। তিনি আরও বহু বিষয়ে তৎকালের সংগীত সমাজের টনক নড়িয়েছিলেন। তিনি প্রথমেই সকলের দৃষ্টি কাড়েন উত্তর ভারতীয় সংগীতের রাগরাগিণী বিভাজনের ত্র"টি সমূহ উল্লেখ করে। দক্ষিণ ভারত বাদে বাকী ভারতবর্ষে রাগ-রাগিনীর ধারণা ছিলো এমন -রাগ হল পুরুষ (দেব/ রাজা), রাগিনী হল নারী (দেবী/রানী) এবং মিশ্ররাগকে পুত্রা (সন্তান) মানা হতো। মিশ্ররাগ মানে একটি রাগের সুরের সাথে আরেকটি ভিন্ন রাগের সুর অথবা স্বরের মিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্ট নতুন রাগ।

প্রসঙ্গত, দেব-দেবীর ভাবনা ভারতীয় প্রাচীন শিল্পশাস্ত্রের মূলে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেবদেবীর মাধ্যমে (নারী-পুরুষ মিলনের মধ্য দিয়ে) ঈশ্বর বা অসীমকে ধারণ করার চেতনাও অবিমিশ্র। কোনার্ক মন্দির, শিবলিঙ্গ মন্দিরের মতন বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরের গায়ে লেপ্টে থাকা টেরাকোটার ফলকগুলো সাক্ষ্য রাখে আজও। যেখানে মানবদেহের পঞ্চইন্দ্রের সমন্বয়ে যৌনচর্চাকে অসীম ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতত্ত্বের রূপক হিসেবে দেখানো হয়েছে। মানবদেহের পঞ্চইন্দ্র আর ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (মহাশূন্য) বহ্মাণ্ডের এই পঞ্চতত্ত্বের সমন্বয়ে সেই অসীম পানে ধাবমানতার তাগিদে এক প্রাকৃত ধর্মদর্শন -বৈরাগ্য সাধনা বা আধ্যাত্মিকতার জন্ম হয়েছে। এ কথা ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসে বহুল শাখায় আলোচিত হওয়ার ফলে কোনো গ্রন্থ নির্দেশনা এখানে জরুরী নয়, আপাতত। আধ্যাত্মিকতাবোধ মানবইন্দ্র সমন্বয় (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) সাধনায় সৃষ্ট। সুরবোধের জন্মও সেই ইন্দ্র থেকে বিকশিত। পঞ্চইন্দ্রের সাথে পঞ্চতত্ত্বের ব্রহ্মাণ্ড মিলে যে আধ্যাত্মিকতার জন্ম, সেই আলোকে '…রাগ- রাগিণী বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে নিত্য আছে। সেইজন্য আমাদের কালোয়াতি গানটা ঠিক যেন মানুষের গান নয়, তাহা যেন সমস্ত জগতের। ভৈঁরো যেন ভোরবেলার আকাশেরই প্রথম জাগরণ; পরজ যেন অবসন্ন রাত্রিশেষের নিদ্রাবিহ্বলতা…ভারতবর্ষের সংগীত মানুষের মনে বিশেষভাবে এই বিশ্বরসটিকেই রসাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছে।' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সংগীতের মুক্তি)। টেরাকোটাগুলোয় বিভিন্ন সুর-বাদ্য যন্ত্রেরও উপস্থিতি প্রমাণ বহন করে যে, প্রাচীন বঙ্গীয় সংগীতশিল্পও আধ্যাÍিকতা থেকে মুক্ত ছিল না। প্রায়োগিক উদাহরণ খুঁজলে প্রাচীনকালের চর্যাপদকে স¤পূর্ণ আধ্যাত্মিকতায় পরিপুষ্ট পাওয়া যায়। কিম্বা তারও পরবর্তী পদাবলীর প্রাচীন গ্রন্থ গীতগোবিন্দের কথাও বলা যায়। যেখানে রাধাকৃষ্ণ (নারী-পুরুষ) প্রেমলীলার উপাখ্যান সম্বলিত সংগীতের মধ্য দিয়ে দেখানো হয় ঈশ্বরের (অসীম) সাথে মানবের আধ্যাত্মিক মিলনরূপ। তাই প্রাচীন ভারতে রাগরাগিণী চিন্তায় দেবদেবীর প্রভাব থাকা খুব স্বাভাবিক ছিল। তো প্রাচীন কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় আধুনিক যুগেও হিন্দুস্তানি সংগীতের রাগরাগিণীকেও তেমনই নরনারী বা দেবী ভাবাটা অসামঞ্জস্যকর ছিল না।

আধুনিক মনমানসিকতা সম্পন্ন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে রাগরাগিণীকে দেবদেবীর কল্পজগত থেকে নামিয়ে উত্তর ভারতীয় সংগীতে ঘটালেন রেনেসাঁ। তিনিই সর্বপ্রথম প্রচলিত সকল প্রকার রাগরাগিণীকে বারোটি ঠাটের ছাঁচে ফেলে নারী-পুরুষ চিন্তাকে বর্জন করেন। যদিও ভাতখণ্ডে মহাশয় আধুনিক ঠাট রীতি ধারণার মূল প্রবর্তক নন। তিনি দক্ষিণ ভারতের সংগীতজ্ঞ ব্যঙ্কটমুখীর ৭২টি মেল/ ঠাটের গাণিতিক পদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দুস্তানি ঠাটেও এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এখানে ৭২টি ঠাটের গাণিতিক পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গেলে ধান ভানতে শিবের গীত হবে, তাই এই পর্বটির আলোচনা এখানে অবান্তর। তো, হিন্দুস্তানি সংগীতে রাগ-রাগিনীর ঠাট নির্ধারণে তিনি কোনো গাণিতিক পদ্ধতি আরোপ করেননি। শুধু স্বরের ব্যবহার অনুযায়ী প্রচলিত অধিকাংশ রাগরাগিণীকে তিনি বারোটি ঠাটের ছকে আবদ্ধ করেছেন। আজও হিন্দুস্তানী সংগীত সমাজ তাঁরই প্রবর্তিত পথ অনুসরণ করে সংগীত সাধনা করে আসছে। তবে, বারোটি ঠাট নিয়ে মতভেদ তাঁর আমলেই শুরু হয়েছিলো। বারোটি ঠাটের পরিবর্তে দশটি ঠাট মানা হয়েছে। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ আজও হিন্দুস্তানী সংগীত ধারায় অনুসরণ করা হয়, এমনকি বাংলাদেশেও।

কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ঘরনায় (গুরু পরম্পরা) প্রচলিত প্রায় ৩৬টি রাগ-রাগিনীর খেয়াল গান সংরক্ষণ করতে তিনি বিশেষ স্বরলিপি পদ্ধতি নির্মাণ করেন। যা হিন্দুস্তানি স্বরলিপি বা ভাতখণ্ডে স্বরলিপি পদ্ধতি নামে সুপরিচিত। ইতঃপূর্বে বিষ্ণু দিগম্বর পালু¯কর প্রবর্তিত দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি পদ্ধতির প্রচল থাকলেও নানান ঝুটঝামেলা সঙ্কুল ছিল সেটি। সেকারণে হিন্দুস্তানি স্বরলিপি বা ভাতখণ্ডে স্বরলিপি পদ্ধতিই সর্বজন গৃহীত হয়েছে। তিনি এই স্বরলিপি প্রবর্তন করেও হিন্দুস্তানি সংগীত ইতিহাসে আরও এক রেনেসাঁ ঘটান। ক্রিয়াত্বক সংগীতের পাশাপাশি তত্ত্বীয় বিষয় জানাও সংগীতসাধক ও শিল্পীর দায়িত্ব, তাঁর এই ব্যক্তিগত মর্ম উপলব্ধি করে তিনিই তা ছড়িয়ে দিয়েছেন সংগীত সমাজে। মূলত এই আত্মমর্ম থেকেই ত্বরান্বিত হয়ে তিনি শিক্ষা ভ্রমণ শুরু করেছিলেন প্রথম, বোম্বে থেকে দক্ষিণ ভারতে। এবং বিভিন্ন প্রদেশ থেকে খেয়াল গান সহ বিভিন্ন গীতপদ্ধতি সংগ্রহ করে সেসবের ওপর নিবিড় গবেষণাও করেছেন। তাঁর এই একান্ত গবেষণা ও পরিশ্রমের ফলেই বিংশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতীয় সংগীত পেয়েছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। উত্তর ভারতীয় ঠাট-রাগরাগিণীর পরিচয় ও স্বরসমুহ সহজে আস্থ করার জন্য তিনি লক্ষণগীত নামের গীতরীতিরও প্রবর্তন করেন।

উত্তর ভারতীয় সংগীত পদ্ধতিকেই হিন্দুস্তানি সংগীত পদ্ধতি বলা হয়। আলোচনার পরবর্তীতে আমরা "হিন্দুস্তানি সংগীত পদ্ধতি" প্রয়োগ করব শাব্দিক সুবিধার্থে। তাহলে এবার স্পষ্ট হল গুরু পর¤পরায় লালিত খেয়াল গান সহ শাস্ত্রীয়সংগীত সর্ব সাধারণের মাঝে পৌঁছাতে শুরু করে প্রথমত ভাতখণ্ডে প্রবর্তিত সভা সেমিনার, দ্বিতীয়ত পাঠ্যক্রম এবং তৃতীয়ত স্বরলিপির মাধ্যমে। সংগীত শিক্ষার জন্য উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রধান ধারা ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপখেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী গান শেখার প্রয়োজনীয়তা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। যেহেতু তখনও ভারত ভাগ হয়নি সেহেতু বাংলারও মোটামুটি অধিকাংশ অঞ্চলের সংগীত সমাজে তাঁর শিক্ষানীতির প্রভাব ছড়িয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। এখানে মনে রাখতে হবে ইতঃপূর্বের ইতিহাস যা আছে তা কেবল খেয়াল গানের পৃষ্ঠপোষকের ইতিহাস। তা শুধুই মহলবন্দী কাহিনী ছিল। খেয়াল গান ছিল গান্ধর্ব (দরবার) সংগীত, তাই সর্বসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। ওস্তাদ-শিষ্য পরম্পরায় টিকে থাকা সেই প্রাসাদ বা মহলবন্দী খেয়াল গান সৃষ্টি-ইতিহাসের জানালাটি আমরা পরে খুলবো। তার আগে বাংলার অতীত বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে বাংলাগান শিক্ষায় হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয়সংগীত প্রবেশের চিত্রটি দেখে নেওয়া যাক। যদিও বাংলার অতীত ইতিহাস সকলের জানা কথা। তবুও এই আলোচনায় সেই জানা কথাগুলোরই ভিতর নিংড়ে আমরা বাংলাগানের পথ পরিভ্রমণ করবো। প্রাচীন বঙ্গীয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি (অতীতের ভাল-মন্দ মিলে) বর্তমান বাংলাদেশকে যতটা স্পষ্ট করবে, ঠিক ততটাই ব্যক্ত করবে বাংলাদেশে বাংলা খেয়াল গান সাধনার মূল্যবোধকে।