বাঙালির মাতৃভক্তি বনাম নারীভাবনা

নিরুপমা রহমান
Published : 7 May 2022, 06:37 PM
Updated : 7 May 2022, 06:37 PM


চিত্রকর্ম: যামিনী রায়

বাঙালি বড় মাতৃভক্ত জাতি। 'মা'কে নিয়ে আমাদের আবেগের জোয়ারে ভাঁটা পড়বার কোন সুযোগই নেই। মাতৃভক্তি বা মাতৃবন্দনার যে গল্পগুলি শুনে আমরা বড় হই, সেগুলিও কিন্তু যেমন তেমন নয়। শৈশবের পাঠ্যপুস্তকের পাতায় বাঙালি মায়ের সন্তান বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে পারসি মায়ের সন্তান বায়েজীদ বোস্তামীর মাতৃভক্তির গল্পের উদাহরণ দিয়ে আমাদের মনে যে উঁচুমানের মাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা বা মানদণ্ড তৈরি করে দেওয়া হয়, তাতেই আমরা বাঙালিরা শিখে যাই একজন বিদ্যাসাগর কিংবা বোস্তামী হতে গেলে মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া গতি নাই।

বিদ্যাসাগর আর বোস্তামী যেরকম যেমন তেমন মানুষ নন, তাঁদের মাতৃভক্তির গল্পও কী আর যে সে রকমের নাকি! অসুস্থ মাকে দেখতে যাবার জন্য ছুটি চেয়ে, ছুটি না পেয়ে চাকুরীই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। শুধু কী তাই? ঝড় বৃষ্টির রাতে খেয়ানৌকা না পেয়ে, সাঁতরে পার হয়েছিলেন দামোদর নদ, শুধুমাত্র অসুস্থ মাকে দেখতে যাবেন বলে। এ তো তাও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেছিলেন তাঁর যুবাবয়সে। কিন্তু বায়েজীদ বোস্তামী তাঁর শিশুকালেই মাতৃভক্তির যে দুর্দান্ত অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, সে তো প্রতিটি বাঙালি শিশুকেই একান্ত মাতৃভক্ত হয়ে উঠবার প্রেরণা যোগায়, তাগিদ জাগায়। অসুস্থ মা মাঝরাতে তৃষ্ণাকাতর হয়ে পানি খেতে চাইলে বালক বায়েজীদ পানি নিয়ে আসেন মায়ের জন্য। কিন্তু এসে দেখলেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। ডেকে তুললে পাছে মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত হয়, তাই বায়েজীদ মাকে ডাকলেননা। আবার ঘুম থেকে উঠে পানি না পেলে মায়ের কষ্ট হবে ভেবে ছেলে মায়ের শিয়রে সারারাত পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে মায়ের ঘুম ভাঙবার প্রতীক্ষায় রইলেন!

অভূতপূর্ব মন কাড়া এইসব মাতৃভক্তির নিদর্শন শুনে আর জেনে বড় হওয়া আমরা বাঙালিরা কিন্তু শুধু মানুষ জন্মদাত্রী 'মা'তেই থেমে থাকিনা। আমাদের হাজার বছরের সনাতন সংস্কৃতিতে মা দুর্গা আছেন, মা কালী আছেন। দেবী বন্দনাতে মাতৃভক্তির সমাপতন আর প্রতিফলন ঘটে বাঙালির। আমাদের 'মা' দশভুজা ভেবে আমরা নমিত হই, আপ্লুত হই, গর্বিত হই। আবার 'মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত' – অমন স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস নিয়ে আমাদের গরিমারও কমতি নেই। তবে এটুকুতেই কিন্তু থেমে থাকে না আমাদের মাতৃভক্তি! আমরা বাঙালিরা 'দেশ'কেও মা 'ভেবে' আর 'বলে' বড় আহ্লাদিত হই। নিজেদের অমন মাতৃভক্তি আর মাতৃবন্দনার ঐতিহ্যে, ইতিহাসে, অভ্যাসে আর তার চিরাচরিত প্রকাশে আ্মরা যারপরনাই পুলকিত হই, আবেগমথিত হই। ভারী আত্মতৃপ্তি আর শ্লাঘায় আপ্লুত হই হরহামেশা এই ভেবে যে আমাদের মতো করে মাকে আর কেউ ভালবাসতেই পারেনা।

অমন করে ভাবতে পেরে আমরা স্বস্তি পাই নিঃসন্দেহে। আমরা ভাবি বিদ্যাসাগর কিংবা বোস্তামী না-ই হতে পারি অথবা কবি কাজী কাদের নেওয়াজের মতো করে লিখতে না-ই পারি "মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই", কিন্তু 'মা'কে ভালোবাসায় আমাদের প্রত্যেকের জুড়ি মেলা ভার। আর ঠিক এখানেই আমি প্রায়শই বেশ আতান্তরে পড়ে যাই, সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি। ভাবতেই পারেন এ আবার কেমন কথা!! জন্মদাত্রী মাকে কে না ভালোবাসে! এর অন্যথা হওয়াটাই তো বরং ব্যতিক্রম বলে পরিগণিত হবার কথা। সে কথাও একেবারে সঠিক।

কিন্তু আমার প্রশ্নটা অন্যজায়গায়। মাকে ভালোবাসবার সময়, তাঁর 'পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত' ভাববার সময় আমরা কি সত্যিই গভীর ভাবে ভেবে দেখি আমার জন্মদাত্রী মা 'মা' হয়ে উঠবার আগে আসলে একজন নারী? আমার জন্য তিনি 'মা' হলেও সমগ্র বিশ্বসংসারের কাছে তিনি আর সব নারীদের মতোই একজন 'নারী'মাত্র। আর তাই 'নারী'র অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে আমার 'মা' তাঁর যথোচিত অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। সমাজ 'নারী'কে সম্মান দিতে না শিখলে, আমার 'মা' তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হন, তাঁর সম্মানও ক্ষুণ্ণ হয়। আমাদের পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা, আমাদের আইন 'নারী'কে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে, আমার 'মা' অনিরাপদ থাকেন, তাঁর নিরাপত্তা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তাই এ কথা ভুলে গেলে কী করে চলবে যে 'মা'কে নিয়ে আমাদের আবেগ আর আহ্লাদ শুধুমাত্র দেখানেপনার আদিখ্যেতা বা আদেখলামোর আতিশয্য হয়েই থেকে যাবে, যতদিন না পর্যন্ত আমাদের জাতিগত মননে, মানসে; আমাদের চিন্তায় আর চেতনায় 'মাতৃভক্তি' আর নারীর প্রতি সম্মান – এই দুই ভাবনার সমাপতন ঘটবে।
মাতৃভক্ত বাঙালি একদিকে যেমন 'মা'কে নিয়ে আবেগের বন্যায় ভাসে, ঠিক অন্যদিকে তার নিত্যদিনের ভাষার প্রয়োগে, তার দৈনন্দিন চিন্তার প্রকাশভঙ্গীতে, তার রোজকার ব্যবহারে 'নারী'কে অসম্মান করে, অবমাননা করে নির্দ্বিধায়। আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে আমাদের ভাবনার, মুখের কথার সঙ্গে সহজাত আচরণের এবং সামাজিক মুল্যবোধের গভীর অনুষঙ্গ রয়েছে। সন্তান ভালো কিছু করলে 'বাপ কা বেটা' (অথবা বাপ কা বেটি) বলে আমরা সরল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি, চেতনে কিংবা অবচেতনে সন্তানের সমস্ত কৃতিত্বের দাবিটুকু বা অর্জনের প্রশংসাটুকু বাবার কাছেই পৌঁছে দিতে বিন্দুমাত্র ভাবিনা। কিন্তু খারাপ কাজের প্রসঙ্গে 'চোরের মায়ের বড় গলা' শব্দবন্ধ কিছু না ভেবেই হয়তো প্রয়োগ করি, যেন 'চোর' ছেলের বাবা নেই, এর দায় শুধুমাত্র মায়ের!

যেই বাঙালি কী না অমন মাতৃভক্ত, মাতৃবন্দনা না কী যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে, সেই বাঙালির প্রচলিত ভাষাতে 'চোরের মায়ের বড় গলা' কিংবা 'মাছের মায়ের পুত্রশোক' এই ধরণের প্রবাদ যুগ যুগ ধরে কেন চলে আসবে, সেই প্রশ্ন ওঠা মোটেও অবান্তর নয়। আসলে সমাজ, সংস্কৃতি আর ভাষার সম্পর্ক বড় গভীর বলেই জাতিগত মনস্তত্বের প্রতিফলন ঘটে ভাষার মাধ্যমে। আর বাঙালির দৈনন্দিন মুখের ভাষা, তার নানান শব্দের প্রাত্যহিক প্রয়োগই মনে করিয়ে দেয় যে মাতৃভক্তি আর মাতৃবন্দনার নানান উপচারের আবরণেও বাঙালি সমাজের গভীরে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতাকে আড়াল করা সম্ভব নয়। আমাদের ভাষা পুরুষতন্ত্রের সেই আধিপত্যকে, সেই উদ্ধত বিশ্বাস প্রকাশের সুদৃঢ় বাহন হিসাবে কাজ করেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

আমাদের সমাজমানসে আর মননে আরও নানান কিছুর মতো ভাষাও হয়ে দাঁড়ায় নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার, নারীকে প্রতিনিয়ত অবমাননা আর অপমান করবার, মৌখিক আর মানসিক নির্যাতন করবার এক শক্তিমান অস্ত্র। আর সেই অস্ত্রে শান দিতে মাতৃভক্ত বাঙালি যখন 'মা' শব্দের সঙ্গে 'গী' (যার আভিধানিক অর্থ বাণী, ভাষা, বাক্য, আরও গভীরভাবে বললে জ্ঞান) শব্দকে মিলিয়ে নিলো, তখন উদ্ভুত শব্দের অর্থ তাই 'মায়ের জ্ঞান' বা 'নারীর জ্ঞান' না হয়ে, হয়ে উঠলো নারীর জন্য চূড়ান্ত অবমাননাকর এক শব্দ। ঠিক এমন সব কারণেই বাঙালির মাতৃভক্তির বিষয়টাকে বড্ড বেশি বিভ্রান্তিকর আর লোকদেখানো বলে মনে হলে খুব কি ভুল হবে?

নিতান্ত মাতৃভক্ত বাঙালি পুরুষ যখন 'ডাইনি', 'বেশ্যা', 'ছিনাল', 'খানকি' ইত্যাকার নানান শব্দপ্রয়োগে চেনা কিংবা অচেনা কোন নারীকে অপমান করেন, হেয় প্রতিপন্ন করেন, তখন কি সেই পুরুষটি কিংবা পুরুষের দল একবারও ভেবে দেখেন এই নারীটিও কারও মা, কিংবা কোন মায়ের মেয়ে?! যুবক বীরপুঙ্গবের দল যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন মেয়েকে কিংবা নারীকে 'মাল' বলে সম্বোধন করে, তখন কি তাদের একবারের জন্যও মনে আসেনা এই নারীটি আজ কিংবা ভবিষ্যতে কারও মা হবে, আজ সে কোন এক মায়েরই মেয়ে! 'অলক্ষ্মী', 'অসতী', 'পোড়ামুখী' অভিধায় মৌখিক নির্যাতনের সাথে সাথে যেই পুরুষটি তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে পেশীশক্তির জোর প্রকাশ করেন, সেই (অ)মানুষটি কি একবারও ভেবে দেখেন তার স্ত্রীটি তারই সন্তানের মা?! ঘরে-বাইরে, চলার পথে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা হাটে-বাজারে নারীর প্রতি অসংবেদনশীল ব্যবহার ও অবমাননাকর শব্দের প্রয়োগ করবার সময় আমাদের মাতৃভক্তি বা মাতৃবন্দনার ঐতিহ্য কিংবা শিক্ষা কোথায় হারিয়ে যায়? আমরা কেন ভুলে যাই আমাদের প্রত্যেকের মা-ই কিন্তু একজন নারী, তাই যে কোন নারীকে অপমান করা হলে তাতে মায়ের সম্মানই ক্ষুণ্ণ হয়?!

আজকাল ঘরে-বাইরের এই আপাত দৃশ্যমান জগত ছাপিয়ে, অন্তর্জালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান রকম অশ্রাব্য ভাষায় আর অসংবেদনশীল শব্দে নারীকে অপমানে জর্জরিত করবার নিত্যনতুন উপলক্ষ তৈরি করা হয়। এতে আরও সুবিধে! চোখের আড়ালে থেকে শুধুমাত্র ভাষার অস্ত্র প্রয়োগে একজন নারীকে খুব সহজেই সমাজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, হেয় প্রতিপন্ন করা যায়। নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে, তার যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, সততা, মুল্যবোধ, পারিবারিক শিক্ষা এমনকি তার যৌনতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। তাকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করা যায়। তখনও একটিবারের জন্যও কি আমাদের মাতৃভক্ত বাঙালি মনে আর মানসে এই উপলব্ধি জাগেনা যে এই নারীটিও মায়েরই জাত?! আর সেই নারীটির মায়ের কথা না-ই বা বললাম। মেয়ের সঙ্গে সমাজ তার মা-কেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে, ধিক্কার দেবে 'অমন পোড়ামুখী, অলক্ষ্মী মেয়ে' জন্ম দিয়েছেন বলে, 'ঠিক মতো মেয়ে মানুষ' করতে পারেন নাই বলে।

মাতৃভক্ত এই আমরা যখন সাংসারিক জীবনের অসফলতায় প্রবাদ টেনে বলি 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে', তখন খুব সুবিধাজনক ভাবে ভুলে যাই পরের ছত্রটি 'গুণবান পতী যদি থাকে তার সনে'। আর এই গুণবান পতি হয়ে ওঠবার দায়িত্ব এড়াতে কালান্তরে, স্থানান্তরে এই ছত্রখানিই বদলে দিতে তথাকথিত মাতৃভক্ত পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ পেছপা হয়না। পরিবর্তিত সেই সংস্করণে নারীর ওপর আরও দায়িত্ব বাড়ে, বাড়ে তার ওপর দোষ চাপাবার অমোঘ সুযোগ 'সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে, রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে'। এই সমাজের পুরুষ শিশু থেকে জ্যেষ্ঠ যে কোন নারীর সম্ভ্রম কিংবা 'সতীত্ব' হরণ করবার ইচ্ছে পোষণ কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে, এতে বিন্দুমাত্র দোষ নেই। 'পুরুষ মানুষ এমন একটু আধটু করতেই পারে' কিন্তু নারীর সম্ভ্রম, সম্মান, 'সতীত্ব' নামক বস্তুর রক্ষণের দায়িত্ব শুধুই নারীর। মাতৃভক্ত সমাজ সন্তানহীন নারীকে 'বাজা' বলে অপমান করতে পারে, গাল দিতে পারে কিন্তু সন্তানসম্ভবা মাকে নিরাপত্তা, স্বস্তি দিতে পারে কি? স্তন্যদানকারী মাকে চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে অপমান করতে ছাড়ে কি? স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে নারীর ঋতুস্রাবের প্রসঙ্গে অশ্লীলতা, যৌনতার গন্ধ খুঁজে বেড়ায় না কি?

আর তাই বাঙালি 'লজ্জা নারীর ভূষণ' বাক্যবন্ধের আশ্রয় নিয়ে 'মায়ের জাত' নারীকে বঞ্চনা আর শোষণের পথ তৈরি করেছে যুগ যুগ ধরে। মাতৃরূপে পূজিত গঙ্গার উদাহরণ টেনে 'সতী নারী গঙ্গা জল, অসৎ নারী বদ্ধ জল' বলে নারীকে বেঁধে রাখবার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো, আজ হয়তো এই সব প্রবাদ তেমন ব্যবহার হয়না কিন্তু এই মানসিকতা থেকে কি আমরা বের হতে পেরেছি আদৌ?! আজকের যুগে তাই নারীর পোশাক, তার চালচলন-গতিবিধি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে অসম্মান করবার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়। শক্তির প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গাকে বাঙালি তার মননে, মানসে, উপাসনা, প্রার্থনায় ঠাঁই দিতে সানন্দে রাজি । কিন্তু বাস্তবিক জীবনে শক্তিরূপিনী নারীকে মেনে নেওয়া, তার সাথে মানিয়ে নেওয়া, সহকর্মী- সহধর্মী- সহযোগী হিসাবে 'নৈব নৈব চ'! তাই নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে আমাদের ভারী কুণ্ঠাবোধ হয়। 'মেয়েমানুষ বেশি বুঝলে' তাকে রূঢ় লাগে, ক্রুর লাগে, 'কুটনি' লাগে। 'মেয়েমানুষ বেশি বললে' তাকে 'মুখরা' লাগে, 'ঝগড়াটে' লাগে। 'মেয়েমানুষ বেশি পারলে' তাকে 'পুরুষালি' লাগে, 'বেটা বেটা' লাগে। মায়ের মমতায় সিক্ত আমরা নারীকে চাই অবলা, অসহায় দেখতে। তার রাগ থাকতে নেই, পছন্দ-অপছন্দের কথা বলতে পারতে নেই, 'বুক ফাটবে কিন্তু মুখ ফুটতে' নেই কারণ 'পুরুষ রাগলে হয় বাদশা, নারী রাগলে হয় বেশ্যা'।

যুগ বদলেছে, যুগের সাথে এই সব প্রবাদের ব্যবহার আর প্রয়োগ হয়তো কমেছে কিন্তু আমাদের মননে বা মানসে পরিবর্তন এসেছে কি? মমতাময়ী মায়ের গল্পে স্বাভাবিকভাবেই আমরা আপ্লুত হই, আবেগে তাড়িত হই। অথচ জন্ম দেবার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে, সমস্ত ঝড়ঝাপটা, বাধাবিপত্তি, প্রতিকুলতা কাটিয়ে সন্তান বড় করে তোলার, তাকে মানুষ করে তোলার এই পুরো সময়জুড়ে শারীরিক আর মানসিক কী অসীম শক্তি একজন মা যে ব্যয় করেন, তা কী গভীরভাবে আমরা একবারও ভেবে দেখি? আর আজকের দিনের মায়েদের যে সংসার- সন্তান – কর্মক্ষেত্র সামলে নিরন্তর নিজেকে জীবনযুদ্ধে সচল রাখতে একইসঙ্গে মমতাময়ী আর শক্তিময়ী দুই-ই হয়ে ওঠা ছাড়া গতি থাকেনা, তাও হয়তো আমরা ভুলে যাই। তাই অবলা, কোমল, অসহায় নারীকে সমাজ করুণা দেখিয়ে নারীর প্রতি কর্তব্য করবার তুষ্টি আর তৃপ্তি পেতে আমাদের তাও যেটুকু ভালো লাগে; শক্তিমান, সবল, ঋজু, দৃঢ়চেতা নারী সমাজের কাছে হুমকিস্বরূপ। আর তাই মাতৃভক্ত বাঙালির 'আদর্শ মা'র সংজ্ঞাতে শক্তিমান, সবল, ঋজু, দৃঢ়চেতা নারীর জায়গা নেই। এরা 'অযোগ্য', 'অক্ষম', 'মমতাহীন', 'বেয়াড়া' মা।

তথাকথিত মাতৃভক্ত এই বাঙালি যেমন 'ভালো মেয়ে' 'মন্দ মেয়ে' র সংজ্ঞা তৈরি করে, ঠিক এই একই ছাঁচে ঢেলে তৈরি করে 'ভালো মা' আর 'মন্দ মা'র পরিচয়ের তকমা। যেই সমাজে শিশুকাল থেকে একজন ছেলেকে শেখানো হয়, জানানো হয় যে সে একটি মেয়ের চেয়ে শক্তিতে, বুদ্ধিতে শ্রেয়তর, তখন সেই সমাজে শুধুমাত্র মা হবার কারণে একজন নারীকে তাঁর সন্তানদের তাঁকে শ্রেষ্ঠ ভাবার বর্ণনা শুনলে সত্যিই বেশ ধন্দে পড়তে হয়! আর মুখের অশ্রাব্য ভাষায়, চোখের দৃষ্টির লোলুপতায়, অসংবেদনশীল ব্যবহারে নিজের মা ছাড়া বাকী সব নারীদের অপমান, অবমাননা এমনকি নির্যাতন করতেও যখন বাধা থাকেনা কিংবা সংকোচ হয়না, তখন সেই মাতৃভক্তির স্বরূপ ও প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক হয় কি? মাতৃভক্ত বাঙালি কিন্তু হরহামেশাই তার বোনকে তাঁর প্রাপ্য সম্পত্তির ভাগ দিতে নারাজ; স্ত্রীকে তার প্রাপ্য সম্মান বা প্রশংসা দিতে কুন্ঠিত, তাঁর পাশে সহমর্মী হয়ে, সহযোদ্ধা হয়ে দাঁড়াতে সঙ্কুচিত; নারী সহকর্মীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে অনিচ্ছুক, তাঁর সাফল্যে প্রশ্ন তুলতে, সন্দিহান হতে উন্মুখ। এবং এই তার বোনটি, তার স্ত্রী, তার নারী সহকর্মীটি প্রত্যেকেই হয়তো কোন সন্তানের মা। অন্যের মাকে ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে, অপমান করে, সন্দেহ করে শুধুমাত্র নিজের মাকে কীভাবে সত্যিকার অর্থে, আন্তরিক ভাবে ভালোবাসা সম্ভব, তা সত্যিই সহজে বোধগম্য হয়না, হতে চায়না! বাঙালি চরিত্রের ইত্যাকার অদ্ভুত সব বৈপরীত্য আগেও ছিলো, এখনও আছে আর হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে তার মাতৃভক্তির আন্তরিকতা নিয়ে, মনোগত ঐকান্তিকতা নিয়ে।

যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নারীকে অবদমন করবার জন্য, তার মনোবল দুর্বল করে দেবার জন্য অসংবেদনশীল তিরস্কৃত ভাষার ব্যবহার হয়েছে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত। একটি ভাষার মাধ্যমে ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মনোভাবের, তাদের মনোজগতের প্রতিফলন ঘটে। সুতরাং বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক কথা, গালি, তিরস্কারমূলক শব্দ যখন মূলত নারীকে অপমান, অবমাননা অথবা হয়রানি করার জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন বাঙালি মনে – মননে – মানসে নারীর অবস্থান স্পষ্টরূপে প্রকাশমান হয়। আমাদের দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহার, এর উপযোগিতা আমাদের সমাজের মানসের চিন্তা-চেতনা এবং ভাবনাকে ধারণ করে, তাই নারীর প্রতি ব্যবহৃত অশ্রাব্য, অশ্লীল, অভব্য, অসংবেদনশীল শব্দ বা বাক্য কিংবা প্রবাদ-প্রবচন অথবা অন্য যে কোন প্রকাশভঙ্গীকে নিছক শব্দসম্ভার বা প্রচলিত লোকজ বাগধারা বলে উড়িয়ে দেবার অবকাশ নেই। আমাদের মানসিকতার প্রতিফলন যেমন এসবে দেখা যায়, ঠিক তেমনি এসব শুনে, জেনে, ব্যবহারে আমাদের মানস ও মনোজগৎ তৈরিও হয়।

বৈশ্বিকতা আর বাজার অর্থনীতির হাওয়া পালে লেগে মাতৃভক্ত বাঙালির মাতৃবন্দনায় সাম্প্রতিক সংযোজন মা দিবসের উদযাপন। যুগের বদলে বাঙালির মাতৃভক্তি প্রদর্শনে তথা মাতৃবন্দনাতেও এসেছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন। মাকে ভালোবাসবার ব্যাপারটি এখন কেবল অনুভবের নয়, তা এখন প্রদর্শনের, আনুষ্ঠানিকতার নিদর্শনেও। সে মন্দ কী! একটি বিশেষ দিন যদি মাকে ঘিরে, তাঁকে উপলক্ষ্য করে, তাঁর জয়গান করে কাটানো যায়, সে তো ভালোই। কিন্তু এবারের মা দিবসে, শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার ঘেরাটোপে আটকে না থেকে, ভালোবাসার প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতায় না নেমে, শুধুমাত্র 'মমতাময়ী মা'র গল্পের আবেগের জোয়ারে ভেসে না গিয়ে আমাদের মনে-মননে-মানসে 'চিরকেলে' নারীভাবনার সুলুক সন্ধানে নামি। এই আত্মানুসন্ধান, এই আত্মবীক্ষণ বড় জরুরী। আমাদের ভাবনাতে যা কিছু কদর্য, তাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন করে ভাবতে শিখি, চিন্তা করতে শুরু করি। নিজের মাকে সম্মান করবার সাথে সাথে মায়ের জাত সকল নারীকে সম্মান করতে শিখি। তার জন্য আর কিছু না হোক , মুখের ভাষা, চোখের দৃষ্টি, মনের দৃষ্টিভঙ্গি, নিত্যকার জীবনাচরণ আর আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আনবার চেষ্টা করি। আমাদের কাজে, আমাদের ভাষায়, আমাদের মূল্যবোধে, আমাদের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন না আনলে বাঙালির মাতৃভক্তি আর নারীভাবনা বরাবর বিপরীত মেরুতেই রয়ে যাবে। আর তাতে যাই হোক মাতৃবন্দনায় সত্যিকার অর্থে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবেনা। বাঙালির মাতৃভক্তি সত্যিকার অর্থেই দেখানেপনার আদিখ্যেতা কিংবা আদেখলামোর আতিশয্য থেকে বেড়িয়ে আসুক। প্রতিটি নারী তাঁর প্রাপ্য সম্মান, তাঁর যোগ্যতার সমাদর বুঝে পাক। নারীবান্ধব সমাজ সৃজনেই না মাতৃভক্ত বাঙালির মাতৃবন্দনা সার্থক হবে, পূর্ণতা পাবে। সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় প্রাণিত হোক আজকের মা দিবস উদযাপনের প্রতিজ্ঞা।