নববর্ষ, শৈশবস্মৃতি ও বর্তমান

শাহাব আহমেদ
Published : 14 April 2022, 05:39 AM
Updated : 14 April 2022, 05:39 AM


দৌড়াচ্ছি না, তড়িঘড়ি হাঁটছি। মাথায় গিজ গিজ করছে কত কিছু। জাপানিজ ম্যাগনোলিয়া গাছটা এই ক'দিন আগেও যে ফুলের হাট বসিয়েছিল, তা এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোছগাছ করে নিয়েছে। তন্বীর মত সোজা দাঁড়িয়ে আছে এ দেশীয় ম্যাগনোলিয়া গাছটা। রোদ চিক চিক করছে পাতায়। পাতাগুলো ঘন সবুজ।
"দেখো, পাতাগুলো কী সুন্দর, ১৪ বছরের কিশোরি গালের মত।"
"এখনও বুঝি চৌদ্দ বছরের কিশোরি মাথায় ঘুর ঘুর করে।"
বলি, "করে, খুব করে"
"নু—ই—রাজভ্রাতনিক*, বৌকে এমন কথা বলতে লজ্জা হয় না?"
"চৌদ্দ যে সুন্দর! সুন্দরের ভবিষ্যত সামনে। তুমি আমি ১৪ অতিক্রম করে এসেছি বলেই কি সুন্দরের দিকে চোখ বুজে থাকবো?"
"রেজোনিওরস্তভা, মেটাফিজিকাল ইনটক্সিকেশন"- সে বলে ওঠে।
"তুমি কী সব জটিল শব্দ বলছো! এদের পাশে নিজেকে আমার অজস্র পেঁপের ভারে ভারাক্রান্ত শীর্ণ পেঁপেগাছের মত মনে হয়।
"খাপছাড়া, অর্থহীন, পণ্ডিতি কথা", পাভলভ বলতেন, "শব্দের অপুখল, বুঝলে না? শব্দের টিউমার।"
ধরতে পারি না।
"আপেল গাছের থেকে আপেল দূরে পড়ে না" প্রবাদটি জানো?
"হ্যাঁ, সন্তান পিতা মাতার পথেই যায়। হাজির ছেলে হাজি, পাজির ছেলে পাজি। ভূমিদস্যুর ছেলে সাংসদ আর রাজাকারের ছেলে রাজাকার।"
সে হেসে ফেলে হা হা করে।
"অনেকটা তাই। কিন্তু কেউ যদি বলে, প্রকৃতির অন্য যে কোন বস্তুর মতই আপেলও মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মেনে আপেল গাছের নীচে পড়ে।- এই এই উত্তরটা তোমার কেমন মনে হবে?"
"হাস্যকর।"
"ওটাই হল রেজোনিওরস্তভা। লক্ষ্যভেদী কোনো উত্তর নয়, বিজ্ঞের মত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক কথা বলা, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল একটার সাথে অন্যটার কোনো সংযোগই নেই। যেমন ধরো, ডাক্তার রোগীকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি আজ কেমন বোধ করছেন?
রোগী উত্তর দিচ্ছে, নির্ভর করে আপনি "বোধ করা" বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন। আমাদের "বোধ" শুধুমাত্র পৃথিবীর কেন্দ্রে উদ্ভুত ম্যাগনেটিক বিশৃংখলার ওপরেই নয়, নির্ভর করে সদা ছুটন্ত সৌরমণ্ডলের সক্রিয়তার ওপরেও, যা আবার মহাবিশ্বের মেনে চলা সর্বজনীন আইন-কানুনের অধীনস্ত এবং আমাদের গ্যালাক্সিতে কী পরিমাণ কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে তার দ্বারা প্রভাবিত। শুধু তা-ই নয়, আমাদের অন্ত্রে বসবাসরত অর্বুদ অসংখ্য জীবানুর মানসিক ভারসাম্যের সাথেও এর সরাসরি সংযোগ রয়েছে।**

তোমার কথা মাঝে মাঝে ও রকম মনে হয়। খুব বেশি কথা বলো। অত বলার দরকার কী?
এবার আমি হাসি হা হা হা করে। সব স্ত্রীরাই স্বামীদের বেফাস কথা বলে বিপদে পড়ার থেকে আগলে রাখতে চায়।
স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগিদের মধ্যে "রেজোনিওরস্তভা" দেখা যায়, জানি। এখনও কেউ আমার মধ্যে ওই রোগটি আবিস্কার করেনি কিন্তু শব্দ-বমনের সমস্যাটা আছে। বৌ ঠিকই ধরেছে। তবে সুস্থ মানুষের মধ্যেও এমন কথা বলার টেনডেন্সি দেখা যায়, বিশেষ করে যারা রাজনীতি করে। কয়েকটি কোড ওয়ার্ড: স্বাধীনতা, রাজাকার, উন্নতি, বঙ্গবন্ধু যে বাক্যে থাকবে, তা যত অযৌক্তিক, যত আন্তঃসম্পর্কহীন বিচ্ছিন্নই হোক না কেন, তা আমাদের মূলধারার বেদবাক্য, তার 'কন্টেন্ট' নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। অর্ধশতাব্দির নষ্ট ডিম ফুটে বের হওয়া বর্বরেরা যদি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের হাত-পা ভেঙে দেয় বা তার ম্যুরালের নাক, কান, মুখ উপড়ে ফেলেও, তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। ওরা আরব দেশ থেকে হিজাব এনে দিয়েছে, আমরা দেশপ্রেম ও স্বদেশিকতার তবজি গুনতে গুনতে নির্দ্ধিধায় মেয়েদের মুখ ঢেকে দিয়েছি। ওরা দিনরাত নারী বিদ্বেষী ওয়াজ নসিহত করছে এবং একই সাথে "মৌখিক" বিবাহের কথা বলে ব্যাভিচার করছে, আমরা ওতে অন্যায় কিছু দেখি না। ওরা মাদ্রসায় মাদ্রাসায় কচি কচি শিশুদের জন্য সদোমের ফাঁদ পেতেছে, আমরা তা মেনে নিয়েছি, এরপরে ওরা যখন বাংলাদেশে আরবী "তাহারুশ" পরিবেশন করবে, আমরা তা-ও মেনে নেবো। কারণ ওরা ট্যাকটিকাল মিত্র। ট্যাকটিকাল মিত্র হলে খুনী বিশ্ব-বেহায়াও ফাঁসির মঞ্চের বদলে সংসদ-মঞ্চে স্থান পায়। আমাদের পিতা, পিতামহদের ধর্ম-ধর্ষণকারীরাও পাবে এবং এদের কথা কিন্তু "রেজোনিওরস্তভা" বলে ভুল করা যাবে না। তারা স্পষ্ট জানে, তারা কী বলছে এবং তারা কী চায়। তারা তাবৎ দেশপ্রেমিকের মৌন সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায়।

অথচ আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে। সদ্য পাকিস্তানের জোয়াল ছেড়া সময়। বর্ষশেষ। 
চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষ এসেছে অপরিসীম আনন্দ নিয়ে। ২-৩ দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে কাচ নাচানী উৎসব! পাশের বাড়ির বৃন্দাবন সেজেছে মহাদেব। তার বড় জটাচুল, শীর্ষে খোপা, সারা গা নীল, পা অনম্বর, হাতে ত্রিশুল। কয়েকজন পুরুষ শাড়ি পরে সেজেছে দেবী। মাথায় তাদের শণপাট দিয়ে তৈরী লম্বা চুল। অন্যজন সেজেছে রাক্ষস। সবারই মুখ-চোখ রং দিয়ে আঁকা। প্রাণহরা ঢোল ও খোল-করতালের মৃদঙ্গ তরঙ্গে দুলে দুলে এরা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যায়। যেন উৎসব আকাশে বাতাসে। উৎসব গাছে গাছে, মাঠে ও রৌদ্রের আঙ্গিনায়। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে এসে মহাদেব মাঝখানে হাঁটু ভেঙে বসে, তার একপাশে দাঁড়ায় রাক্ষস, অন্যপাশে দেব-দেবীরা। একজন ঘটি উঁচু করে উঠানে জল ঢালে, তারপরে মহাদেবকে ঘিরে শুরু করে নাচ। ঢোল বাজে, করতাল বাজে, তালে তালে বেতাল সংসার। গৃহস্থেরা ধামায় ঢেলে দেয় যে যা পারেঃ চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ আর মরিচ। কেউ দেয় টাকা। সবার বাড়িতেই একই সমাদর, আমি মুসলামান, তুই হিন্দু এই বিভাজন নেই। কাচ নাচানী শেষ করে আসে চৈত্র-সংক্রান্তির মড়া-ভাসানি। আনন্দের অথৈ গঙা। 
সকাল বেলা একজন লাশের মত শুয়ে থাকে খালের আনত ঘাটে। মাথা জল ছুঁই ছুঁই, পা ওপরের দিকে। আপাদ-মস্তক সাদা ধুতি-কাপড় দিয়ে ঢাকা। সারা গ্রাম জড়ো হয়েছে তাকে ঘিরে। নারীরা বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে গান গাইছে,

"পায়রা বুনিলাম খেতে, ছাতু খাওয়ার সুখে
আভাইগ্যা পায়রার ছাতু ঠেইখ্যা রইল বুকে
ধচ-মচাইয়া ধরলো বুড়ি ঘরের কোণার খাম
আভাইগ্যা পায়রার ছাতু ধীরে ধীরে নাম।"


আরো কত ধরনের ছড়া ও কৃত্রিম ক্রন্দন! 
তারপরে এক সময়ে সেই মড়াকে কয়েকজনে আস্তে আস্তে ধাক্কা মেরে জলে ভাসিয়ে দেয়। এবং সবাই নেমে যায় জলে। অসংখ্য মানুষের জলকেলির ভীড়ে হারিয়ে যায় মড়া, তাকে আর চেনা যায় না তারপরে দীর্ঘ সময় ধরে চলে স্নান। খাল-ভরা মানুষ আর মানুষ, যেন সারা গ্রাম নেমে এসেছে। সকালে যাকে মড়া হিসাবে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল বিকালে তার কপালে আঁকা হয় তিলক।
পিঠে আংটার মাধ্যমে ঝুলিয়ে দেয়া হয় বল্লা গাছে। চড়ক গাছকে আমরা বলি বল্লা গাছ।
আগের রাতে হরগৌরী পুজা সম্পন্ন করে সিদ্ধান্ত হয়েছে কাকে বাল্লাগাছে চড়ানো হবে। ধীরেন পাল সবার পছন্দের ও সদা প্রস্তুত। গাছের মাথার মাঝখানে একটি খাঁজ কাটা ঘুর্ণনশীল বাক্স বসানো হয়েছে। তার ওপরে বাধা হয়েছে লম্বা বাঁশ। বাঁশের একমাথায় চরক ঘুরানোর মোটা কাছি, অন্য মাথায় ঝুলে আছে ধীরেন পাল। দশহাতি ধুতি দুই বগল ও দুই নিতম্বের প্যাঁচ ঘুরে পিঠের মাঝখানে যে গ্রন্থির সৃষ্টি করেছে, তার সাথেই বাঁধা হয়েছে তাকে।
বল্লাগাছ রেডি।


"দেবা দেব মহাদেব" -অনুকূল গোঁসাই'র দল সমস্বরে গেয়ে ওঠে।
সহদেবের দল দুয়ো দেয়, "শিব হে! শিব হে!"
এবং তারা কাছি ধরে দৌড়ে দৌড়ে চড়ক ঘোরাতে থাকে। উড়ন্ত এরোপ্লেনের মত চক্রকারে ওড়ে ধীরেন পাল। তার কপালে তিলক, মুখে বোটাসুদ্ধু বড় গাঁদা ফুল।দাঁত ও ঠোঁট দিয়ে চেপে রাখা। হাতে একটি বেতের ছড়ি বা "ছড়" যা সে অনবরত ঘোরাচ্ছে ডান হাত দিয়ে। কখনও কখনও ছড় ঘোরানো বন্ধ রেখে সামনে প্রসারিত দুই হাতদিয়ে তার দুই প্রান্তে ধরে দুই পা বিস্তৃত করে মাটির সমান্তরালে সোজা হয়ে আছে টান টান। ঘুর্ণির গতি যত বাড়ে, তার দেহ উড়ে যায় তত ওপরে।
চরক ঘুরছে, পাখির মত পরাণ উড়ছে, আর ধ্বনিত হচ্ছে উঁচু স্বরগ্রাম:
দেবা দেব মহাদেব
শিব হে! শিব হে!
সারা গ্রাম রুদ্ধশ্বাসে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

বাবার হালখাতা শেষ, গরম গরম জিলাপি খাবার সময়। জম-জমাট গলিয়া বসেছে। আমাদের এলাকায় মেলাকে বলা হয় গলিয়া। গলিয়া'র আকর্ষণের শেষ নেই। মুরলি ভাজা, নিমকি, লাঠি বিস্কুট কিনে খাই। ভেতরে গুয়ামুড়ি দিয়ে মিষ্টি লাল, সাদা, সবুজ, গোলাপি রংয়ের গোল গুটিগুটি টিকটিকির ডিম অপ্রতিরোধ্যভাবে টানে। তুলার মত হাওয়াই মিঠাই গলে যায় মুখে দিতে না দিতে।
বাবা আমাকে সুন্দর একটা মাটির গাভী কিনে দেন। তার ওলান-ভরা দুধ, একটি বাছুর দুধপান করছে। আমি তাকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই মাঠে। সেখানে ঘাসের মধ্যে ছোট ছোট ফুল। আমার গরু ঘাস খায়, আর আমি মাঠে শুয়ে শুয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখি।

এই আমার দেশ। ইরান যদি মুসলিম দেশ হয়েও অগ্নিউপাসকদের কাল থেকে চলে আসা 'নওরোজ'কে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, আমাদের নববর্ষকেও রাখতে হবে। সৌদি আরবের পেট্রোডলারের কাঁধে চেপে ধর্মের মুখোশ
পরে আসা সর্ববিধ্বংসী অধর্মের কাছে আমরা বিলীন হয়ে যেতে পারি না। আমাদের পূর্বপুরুষদের পালন করা ধর্ম ছিল অনেক বেশি সহনশীল ও মানবিক, আমরা তার বিনিময়ে ওহাবিজমের বিষ চাই না। এই ভূমিতে সবধর্ম, সব লোকাচার ও সাংস্কৃতিক রীতিগুলো পাশাপাশি থেকে একে অন্যকে সমৃদ্ধ করুক। সবার আগে আমরা বাঙালি,
বাঙালি বেদুইন নয়।
——
পাদটিকাঃ
*নু ই রাজভ্রাতনিক- লুব্ধক তুমি, লম্পট
** মনোবিজ্ঞান বিষয়ক সাইট Medpsy.world থেকে উদ্ধৃত।
***তাহারুশ- প্রকাশ্যে নারীর শ্লীলতাহানী ও গণ যৌননির্যাতনের মিশর/আরবীয় প্রথা।

এপ্রিল ১, ২০২১