বাঙালির মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের সাতকাহন

নিরুপমা রহমান
Published : 4 Dec 2021, 04:32 PM
Updated : 4 Dec 2021, 04:32 PM


চিত্রকর্ম: কাজী রকিব
যদি বলি প্রত্যেক বাঙালির কাছেই জন্মসুত্রে একটি 'চরকা' আছে, তবে নিঃসন্দেহে সকলে বেশ নড়ে চড়ে বসবেন। আরে অবাক হচ্ছেন কেন?! সেই তো আজন্ম প্রতিটি বাঙালিই জানে 'নিজের চরকাতেই তেল' দিতে হয় বা দেয়াটাই সমীচীন। কিন্তু যেহেতু আমরা একবার 'চরকায় তেল' দেবার ব্যাপারটা জেনে যাই, শিখে যাই, তখন কী আর শুধু নিজেরটাতে তেল দিয়ে পোষায় বলুন!! আর আমাদের 'নিজের চরকা' আর নিজের কবে ছিলো? আশৈশব তাতে চারপাশের সকলে মিলে তেল দিয়ে গেছে। এই যখন ঘটনা, তখন আমিই বা সুযোগ পেলে অন্যেরটাতে তেল কেন দেবোনা বলুন? অন্যের চরকায় তেল দেওয়া প্রতিটি বাঙালিই তার জন্মগত অধিকার বলে ধরে নেয়। কারণ আমরা সবাই যে 'গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল'!!! আর কে মানলো আর কে না মানলো তা ভাবলে আবার চলে নাকি। রবিঠাকুর তো কী সুনিপুনভাবেই না সুরে সুরে বলেছেন 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে'। তো সবাই যেখানে রাজা, সেখানে 'গাঁয়ে মানার' প্রশ্নই বা আসছে কেন?

'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে'র বাঙালি আমরা। তাই আমাদের ঠিক-ভুল বিচারের পরাকাষ্ঠা আমরা আমাদের নিজের সুবিধেমতো তৈরি করে নেই। বলাই বাহুল্য যে আমাদের প্রত্যেকের কাছেই নিজের বিচার, নিজের বিশ্বাসই সবচাইতে ভালো আর সবসময় নির্ভুল। আবার অন্যের ব্যাপারে সেই পরাকাষ্ঠাই কিন্তু বড় কঠিন, বড় জটিল। নিজের স্বার্থ হাসিল হলেই কেবলমাত্র অন্যের বিচার সোনামুখ করে নিতে আমরা রাজি হই কিন্তু এর অন্যথা হলে তা একেবারেই নৈবচ। আমরা বাস্তবিক অর্থেই যেন একেকজন 'নিধিরাম সর্দার' – ঢাল কিংবা তলোয়ার না থাকুক কিন্তু 'চাপা'র জোর আছে, আর আছে আজন্মলালিত গভীর আন্তরিক বিশ্বাস 'জোর যার মুল্লুক তার'। তাই আমাদের আচারে, ব্যবহারে কিংবা বিশ্বাসে শুধু চাপিয়ে দেবার প্রয়াস। এতে শক্তিরূপের প্রকটময়তায় মুক্তিরূপের দেখা মেলেনা। তাই দেশ, কাল, পাত্র নির্বিশেষে আমাদের ভাষায় এর স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে নিরন্তর। আমরা সকলেই কীভাবে যেন শুধুমাত্র নিজেরটাকেই ভালো জানি, ভালো বলি, ভালোবাসি। আর যা কিছু নিজের মত, পথ আর বিশ্বাসের সাথে মেলেনা বা মেলাতে পারিনা তাকে দুর্মর দুর্বার বলে প্রতিরোধ করতে শিখি আজন্ম কেননা ওই যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমরা আশৈশব শিখে বড় হই 'জোর যার মুল্লুক তার'। এ শব্দবন্ধ কিন্তু অতিকায় পরাক্রমশালী, সাথে সাথে ভয়াবহ গভীর এক আত্মবিশ্বাস তথা আত্মপ্রণোদনার জন্ম দেয় যা আমাদের উৎসাহ দেয় চাপিয়ে দিতে, প্রশ্রয় দেয় শক্তিমত্তার কাছে বুদ্ধিমত্তাকে বিসর্জন দিতে। সে কারণেই বোধ করি আমরা ব্যতিক্রমকে উপেক্ষা করি, বলহীনকে দুমড়ে পিষ্ট করতে পিছপা হইনা, স্বীয় বিশ্বাস যদি গরিষ্ঠজনের সাথে মেলে তবে তাকেই একমাত্র পথ দাবী করে অন্য পথ উপড়ে ফেলি।

'গাঁয়ে মানেনা , আপনি মোড়ল' এমন লোকের অভাব নেই বাঙালির সমাজে – সে দেশে হোক, প্রবাসে হোক, অভিবাসে হোক; হোক তরুণ কিংবা বৃদ্ধ, সব প্রজন্মেই নারী পুরুষ নির্বিশেষ তার দেখা মিলবে সহজে। এরা নিজের আচারকেই 'সদাচার', নিজের বিশ্বাসকেই 'একমাত্র পথ', নিজের দৃষ্টিভঙ্গীকেই 'অনুশাসন' দাবী করে 'পরাকাষ্ঠা'র মানদণ্ড তৈরি করেন। আর অন্যদিকে বাকি সকলের চরকায় তেল দেবার জন্য 'তেল' এর অভাব বাঙালির কোনকালেই হয়নি। আর যে জাতি মনে প্রাণে জানে আর মানে যে 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম', সে নিজের 'পিঠ' বাঁচাতে আর 'মান' বাঁচাতে শক্তিরূপের প্রদর্শনে অন্যায় দেখেও 'মুখে তো কুলুপ' আটবেই। নিজেদের 'আমরা সবাই রাজা' ভাবলেও দিন শেষে সেই 'নিধিরাম সর্দার'ই বটে – যাদের আর যাই থাক 'চিত্তের স্বাধীনতা' নাই, আর তাই জানা নেই মুক্তিরূপ।
'শক্তের ভক্ত, নরমের যম' এই বাঙালির একদিকে আবেগ যেমন বাঁধাহীন, অন্যদিকে যুক্তিবিচার বড় নড়বড়ে – বেশ সুবিধেবাদী গোছের আর কী। যাতে 'গাছেরটাও খাবো, তলারটাও কুড়াবো'র ভাবনাতে কেউ কোনক্রমেই জল ঢালতে না পারে। নিজেদের সুযোগ সুবিধেমতো তাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ভাবতে আর ভাবাতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পারলে আমরা নিজেরাই যে শুধু তাতে পুলকিত হই তা নয়, চারপাশের সকলকে সেটা গর্ব করে বলে বেশ বাহবাও কুড়িয়ে নিতে ছাড়িনা। বানরের রুটিভাগের গল্পটা মনে পড়ে? ঐ যে দুই ইঁদুর বন্ধু গৃহস্থের রান্নাঘর থেকে একটা রুটি পেয়ে দুজন সমান ভাগ করবে বলে মনস্থ করলেও সেই মতো ভাগ করবার পর দুজনেই ভাবলো তার ভাগেই ছোটটা পড়েছে, অন্য জনের ভাগটাই বড়। কিছুতেই একমত হতে না পেরে তারা গেল বানরের কাছে। এদিকে বানর রুটির সমান ভাগ করার নামে যখন প্রায় পুরো রুটিই খেয়ে সাবাড় করবার পথে, তখন ইঁদুর দুটোর টনক নড়ায় তারা বানরের কাছে রুটির শেষ ছোট অংশটূকূ ফেরত চাইলো। বানর তখন বরং উল্টো 'ভাগ করবার' মতো কঠিন কাজ করবার পারিশ্রমিক হিসাবে শুধু যে বাকিটুকু রুটি খেয়ে নিলো তাই নয় উপরন্তু দু'কথা শুনিয়ে দিলো এই বলে যে তার পারিশ্রমিক আরও বেশিই, শুধুমাত্র জানাশোনা বলেই 'এত কমে মেনে নিলাম'। আমাদের মধ্যে এই বানরের মতো মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আর এমনতর লোক ঠকানো খোঁড়া যুক্তি দিয়েও গায়ের জোরে জিতে যাবার অমন প্রয়াসকেও হরহামেশাই আমরা মেনে নেই, আর মানিয়েও নিয়েছি বারবার কালে কালে। 'শালিস মানি কিন্তু তালগাছ আমার' এই মানসিকতা আমাদের মজ্জায় মিশে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

দেশ কাল পাত্রের পটভূমি পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু 'যার লাঠি তার মাটি' এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে 'ধরা কে সরা জ্ঞান করা' বলশালী বাঙালি দুর্বলকে খোঁড়া যুক্তির বিচার শুনিয়ে দ্বিধাহীনভাবে বলে 'যে সয়, সে রয়'; ক্ষমতাহীনের প্রতিবাদকে যুক্তির বিচারে 'বিষ নাই কুলোপনা চক্কর' শব্দবন্ধের তকমা দিয়ে দেয় অকপটে। সাধারণ ছাপোষা গৃহস্থ বাঙালির 'পানিতে কুমির ডাঙায় বাঘ'। যতই ভাবুক সব ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলবে, কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে তাকে সংসাররূপী 'পানি'তে নেমে একদিকে 'কুমির'রূপী মানুষকে যেমন সামাল দিতে হয়, আবার খেয়াল করতে হয় সমাজের জঙ্গলের প্রতাপশালী 'বাঘ'রূপী মানুষেরাও যেন রুষ্ট না হয়। কাউকেই অখুশি করবার সাহস তার কই আর দরকারটাই বা তার কীসে? আর তাই পরিবার আর আত্মরক্ষার তাগিদে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে সে বর্তে যায়। কিন্তু প্রয়োজনে সেই 'ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানা' সাধারণ গোবেচারা বাঙালিই আবার সংখ্যার আধিক্যের জোরে কিংবা শক্তির প্রাবল্যে নিজের 'খোঁড়া যুক্তি' কে বৈধতা দিতে ঠিক কীভাবে, কেমন করে 'শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে' হয়, তা খুব ভালো করেই জানে। তাই কালে কালে বারম্বার সবলতর প্রতিপক্ষের কাছে 'সাত চড়ে রা না করা' বাঙালিই কীনা তার চাইতে অপেক্ষাকৃত 'নরমের যম' হয়ে তাকে হাতেও মারে, ভাতেও মারে।

আসল মোদ্দা কথা হলো বাঙালির মানসে, চিন্তায়, আচারে আর আচরণে শক্তিরূপের জয়জয়কার – সে শারীরিক কিংবা সামাজিক প্রতিপত্তির কিংবা আর্থিক কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের শক্তি যাই হোক না কেন। দিনশেষে সকলে শাসক তথা আমরা সবাই রাজা' কিংবা 'মোড়ল' হতে চাই আর চাই নিজের মতকেই একমাত্র পথ বানাতে। 'যস্মিন দেশে যদাচার' কে যদি আচরণ আর ব্যবহারের সূচক পরাকাষ্ঠা বলে মানি, তবে আমরা সব বাঙালিই হয়তো কম বেশি 'লঙ্কায় গিয়েই রাবণ' হয়ে উঠি।

তাই মোটেও অবাক লাগে না যখন দেখি বাঙালির মধ্যে মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার এই দুইয়ের অনুপস্থিতিতে সেই চল্লিশের দশকে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর 'মুল্যবোধ ও যুক্তিবিচার' প্রবন্ধে বড় আক্ষেপ করেছেন। ' সত্যের জন্য যাদের উন্মুখতা নেই, তাদের সত্য জানানোর চেষ্টা বিড়ম্বনা মাত্র। তর্ক করে লাভ নেই, তাতে খাম্কা মন বিগড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সত্যকে পাওয়ার আগ্রহ তলিয়ে গিয়ে জয়ের ইচ্ছাই বড় হয়ে ওঠে। এরূপ ক্ষেত্রে বুদ্ধির জগৎ ছেড়ে প্রাণের জগতে নেমে আসা স্বাস্থ্যকর।' আজ এতো বছর পরও সেই আক্ষেপ দূর করবার জায়গায় বাঙালি পৌঁছেছে বলে বোধ হয়না, বরং মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের অবনমনই হয়তো ঘটেছে। বাঙালির 'বোধ' নেই তা বড় শত্রুও বলতে পারবেনা, নিজের 'মূল্য'ও বুঝতেও সে কম যায়না। আত্মসম্মানবোধ সাথে আত্মাভিমান প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই আছে নিঃসন্দেহে। তাই আমাদের 'আঁতে ঘা লাগে' বড্ড সহজেই। আমাদের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয় নিমেষে – সে বড়ই ঠুনকো। কিন্তু আমাদের মনন আর মানসে 'মূল্যবোধ' তেমন করে জায়গা করে নিয়েছে কী? নিজের 'আঁতে ঘা' লাগবার সময় একবারও কী অন্যেরও যে 'আঁত' আছে আর তাতেও যে 'ঘা' লাগতে পারে তা ভাবতে শিখেছি কী? 'গাছেরটাও খাবো আর তলারটাও কুড়াবো' শুধুমাত্র আমি এই ভাবতে গিয়ে সবাই মিলে যে ফল পাকবার আগেই সব ফাঁকা করে ফেলছি তা বুঝতে পারছি কী? সকলে মিলে 'শাক দিয়ে মাছ' ঢাকতে ঢাকতে শুধু যে শাকরূপী অন্যায়টুকু, ছলনাটুকুর পাহাড়ের নীচে আসল 'মাছ'টুকু হারিয়ে যাচ্ছে, তা মনের মাঝে একবারও উঁকি দিচ্ছে কী?

প্রকৃতপক্ষে মূল্যবোধ ব্যাপারটা উপলব্ধি করা বেশ কঠিন। সেই ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) 'সভ্যতার সঙ্কট' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "… 'সিভিলিজেশন', যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়। এই সভ্যতার যে-রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার। অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন। … যে আচার পারম্পর্যক্রমে চলে এসেছে তাকেই বলে সদাচার। অর্থাৎ, এই আচারের ভিত্তি প্রথার উপরেই প্রতিষ্ঠিত—তার মধ্যে যত নিষ্ঠুরতা, যত অবিচারই থাক। এই কারণে প্রচলিত সংস্কার আমাদের আচারব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে চিত্তের স্বাধীনতা নির্বিচারে অপহরণ করেছিল।" এই সদাচার যদি হয় আমাদের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি কিংবা আমাদের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি তথা মানদণ্ড, তাহলে বলা যায় এ সকল আচরণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ভালো-মন্দ, ঠিক-ভুল সম্পর্কে সমাজের মানুষের যেই ধারণা তাকেই মূলত মূল্যবোধ বলা যেতে পারে। মূল্যবোধকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে কাজী মোতাহার হোসেনের কথা ধার করে মূল্যবোধের লক্ষণগুলো যদি বলি, তবে তা হলো যা কীনা 'নিকটবর্তী স্থূল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ' জানতে শেখায় এবং 'তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে' শেখায়। তাঁর কথায় যুক্তিবিচার হলো 'জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা'। এখন কথা হলো 'বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে' তবেই না স্থুল সুখ আর সূক্ষ্ম প্রাপ্তির পার্থক্য জানা যায়, সুন্দরকে চেনা যায়, সুকুমারবিদ্যাকে বোঝা যায়। এর ভেতর দিয়ে গেলেই না অনুধাবন করা সম্ভব যে এতে আত্মার মুক্তি ঘটে, চিত্তের স্বাধীনতা লাভ হয়। কিন্তু তার জন্য প্রতীক্ষা বা ক্ষতি স্বীকার করতে আমরা রাজি ছিলাম কী কোন কালে?

সেই কোন ছোটবেলাতেই কিছু বুঝবার আগেই আমাদের মাথায় ঢূকিয়ে দেওয়া হয় 'লেখা পড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই'। আমাদের কাছে শিক্ষা অর্জনের পেছনের মোদ্দা কথা কিন্তু শেখবার আনন্দ নয়, জানবার অভিলাষ নয়। বরং শিক্ষার অর্জন অর্থকড়ি রোজগারের অঙ্কে, গাড়িঘোড়া, বিলাসব্যসন প্রাপ্তির মাপকাঠিতেই মাপা হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ খুব যথার্থই লিখেছিলেন 'মেধাবীরা যদি শুধু বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করাকেই জীবনের ধ্রুবতারা মনে করে; গাড়ি পাবে, ফ্ল্যাট কিনবে অভিজাত এলাকায়-এসবই হয় তাদের লক্ষ্য, তাহলে তাদের থেকে জাতি কিছু পায় না।' আমাদের শিক্ষা আসলে আমাদের নিজেদের চিনতে শেখায় না, অন্যদের বুঝতে শেখায় না। শেখায় 'আখের গোছাতে', শেখায় 'ঝোপ বুঝে কোপ মারতে'। যদিও সেই গত শতাব্দীতে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর দূরদর্শী প্রজ্ঞায় আমাদের সাবধান করেছিলেন 'যে শিক্ষায় আমাদের দেশের লোককে ঘৃণা করতে শেখায় বা তাদেরকে শোষণ করবার প্রবৃত্তি যোগায় সে দুষ্টূ শিক্ষা থেকে আমাদের শত হস্ত দূরে থাকা দরকার' কিন্তু তাতে আর আমরা কান দিলাম কোথায়! আমরা কী কখনও ভেবে দেখেছি কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার যখন তাঁর কবিতায় 'লেখা পড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই' বলেন, তখন আসলে বোঝাতে চান একজন শিক্ষার্থীর গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার পিছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা ও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করা। গাড়ি ঘোড়া এখানে নতুন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, খোলামনে বিশ্বকে দেখবার, জানবার রূপক। কবিতাটা পুরোটা পড়লে এই ভাবনা স্পষ্ট হয় যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়া রূপকল্পের মধ্য দিয়ে কবি এখানে মনকে সতেজ, বেগবান করে তুলবার উপদেশ দেন , নতুনকে জানবার জন্য পথে নামতে অনুপ্রেরণা যোগান। এই শিক্ষা শুধুমাত্র সনদপত্র অর্জনের শিক্ষা নয়, এই লেখাপড়া 'কেউকেটা' হয়ে ওঠবার মন্ত্র নয়, এই শিক্ষার্জন শুধুমাত্র সমাজে 'রুই কাতলা' হয়ে উঠে অন্যকে অবজ্ঞা করবার পন্থা শেখায় না।

'জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই' – শুধু শুধু গলদঘর্ম হয়ে কী লাভ! এতো জেনে বুঝে কার কবে কী 'কেল্লা ফতে' হয়েছে! তাই আমরা শিখি না, মুখস্থ করি – তোতাপাখির মতো পড়া আউরে যাই, বুঝে কিংবা না বুঝে। তাই আমাদের পড়া আমাদের মাথায় থাকে পরীক্ষা পর্যন্ত, অন্তরমহলে তার প্রবেশই হয়না আর বসবাস তো দুরস্ত। আমাদের ভাবনার জগতে তাই আমাদের শিক্ষা কোন প্রণোদনা যোগায়না, তৈরি হয়না তাই আরও শেখবার খিদে। নিজেকেই চিনতে চাইনা আমরা, তাই অন্যকে, অন্য কিছুকে জানবার জন্য আমরা বুভুক্ষু হইনা। আমাদের পঠন পাঠনের সাফল্য জ্ঞানজাগতিক বা বৌদ্ধিকতার নিক্তিতে না মেপে, মাপা হয় ইহজাগতিক আর আর্থিক সাফল্য আর প্রতিপত্তির বিচারে। আর তাই বাঙালির জীবনাচরণে মননশীলতার অভাব অনস্বীকার্য । এই অভাবের আর একটি কারণ হয়তো আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর রীতিরেওয়াজ। সেখানে খুব সুনির্দিষ্ট আর সুনির্ণীতভাবে বিদ্রোহ এবং প্রশ্নশীলতার পরিবর্তে দাস্য এবং ভক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন না করতে জানলে যে উত্তর খুঁজবার ইচ্ছে জাগেনা, তা বাঙালি জানেনা, জানতে চায়ও না। বরং প্রশ্ন করলে প্রশ্নকারীর আনুগত্য নিয়ে আমরা সন্দিহান হই। আমরা 'চাটুকার' চাই। আমরা অনুসন্ধিৎসু, স্বাধীনচেতা ভাবুক চাইনা কারণ আমাদের চোখে সে বড্ড বেয়াড়া, বেপরোয়া, 'বেয়াদব'ও বটে।

ব্যতিক্রমে বাঙালির বড় অনীহা। ঐ যে যেদিকে 'পাল্লা ভারী' সেদিকের 'গড্ডালিকা প্রবাহে' নিজেকে ভাসিয়ে দিলে বড় নিরাপদে থাকা যায়, তা আমরা খুব ভালোই জানি। বাঙালির জীবনাচরণে মৌলিকতা, স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রতা একেবারেই অপাঙ্ক্তেয়। আমাদের চেনা ছকের বাইরে কিছু দেখলে আমরা সহজেই 'নাক সিটকোই', 'ভ্রু কুঁচকোই', 'চোখ তুলি কপালে'। আমরা ভারী গোত্রবদ্ধ থাকতে ভালোবাসি, বড় নিরাপদ বোধ করি। একটু ভিন্নতর কিছু ভাববার সুযোগ আমাদের নেই (ইচ্ছেও যে খুব থাকে তা নয়)। যা কিছু আমার ভাবনা মতো চলছেনা, যা কিছু আমার চেনা পথে হাঁটছেনা, তা শুনলে কিংবা দেখলেও আমাদের 'মাথায় বাজ পড়ে'। ঐ যে বললাম না প্রতিবাদ আর প্রশ্নশীলতা বাঙালির ধাতে সয়না, তাই ঐ পথে হাঁটলে 'জাত গেল' রব উঠতে বাধ্য।

আপনি হয়তো বলবেন কই আমরা তো খুব বিতর্ক করি, নানান মতের ফুলঝুরির ডালা নিয়ে আমরা সব তর্কবাগীশ 'এক পায়ে খাঁড়া' থাকি সবসময়। কিন্তু সত্যি ভাবুন তো আমাদের তর্কে মৌলিকতা কতটুকু, স্বতন্ত্র ভাবনার দেখা কী আসলে মেলে? আর এই তর্কের খাতিরে তর্ক করবার সময় আমাদের পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটুকু কতটা দৃশ্যমান থাকে, অথবা আদৌ তার কোন প্রয়াস কী আমাদের থাকে? একটা জাতির প্রাণ-ঐশ্বর্যের মূলে তার চিন্তার ঐতিহ্য। এই চিন্তার দুর্বলতা তার নিঃস্বতার প্রমাণ। বাঙালির জ্ঞানচর্চার ইচ্ছের দৈন্য প্রতিফলিত হয় তার মুক্ত স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রেও, আর তাতেই প্রকাশমান হয় চিন্তার দৈন্য। আর তাই মুক্তবুদ্ধির চিন্তা আর চর্চাকে ঘিরে যে ভাবপ্রকাশের প্রয়োজন হয়, পারষ্পরিক মননশীলতা এবং চিন্তাশীলতাকে বুঝবার আর বোঝাবার জন্য যে বৌদ্ধিক আর জ্ঞানজাগতিক ভাষার প্রয়োজন হয়, আমাদের ভাষা তার যোগান দিতে পারেনা। যে চিন্তার ভাষা নেই, সেই চিন্তাও তাই সম্ভব নয়।

ইংরেজিতে তথা পাশ্চাত্য দর্শনে critical thinking শব্দযুগল যে মৌলিক চিন্তাসমৃদ্ধ জ্ঞানচর্চার দিকনির্দেশনা দেয়, বাঙালি তাকে চেনেনা, জানেনা। আর তাই critical thinking এর কোন উপযুক্ত প্রতিশব্দ বাংলাতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। criticism আর critiquing কী ভাবে যেন আমাদের বাঙালিদের কাছে সমার্থক। দুই ক্ষেত্রেই আমরা একই প্রতিশব্দ ব্যবহার করি – 'সমালোচনা' যা কী না সাধারণ বাঙালির কাছে সোজা বাংলায় 'খুঁত ধরা'। আর এ ব্যাপারে আমাদের দ্বিচারিতা প্রবাদপ্রতিম। আমরা সমালোচনা করতে (পড়ুন 'খুঁত ধরতে') খুব ভালোবাসি কিন্তু সমালোচিত হতে 'নৈব নৈব চ'। আর আমাদের শিক্ষায়, জীবনচর্চায় critical thinking এর কোন জায়গা নেই বলেই আমরা নিজের মতকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জয়ী হতে চাই। সহজে চাপিয়ে দিতে না পারলে অসম্মান করি, হিংস্র হই, মারমুখী হই। ঐ যে 'জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা' কে যে কাজী মোতাহার হোসেন যুক্তিবিচার বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন তাই তো আসলে সোজা ভাষাতে critical thinking। আর তার অস্তিত্ব চল্লিশের দশকেও বাঙালির ভাবনাতে ছিলোনা আর আজকের আধুনিক, বৈশ্বিক বাঙালিও তাকে ভাবতে বা অনুভব করতে শেখেনি।

আর তাই বোধকরি পরমত সহিষ্ণুতার ব্যাপারটা বাঙালির কাছে বড় অধরা হয়েই রয়ে গেল। অন্যের মতকে সম্মান দেওয়া মানে কিন্তু তাকে মেনে নেওয়া নয় – এই সহজ কথাটা আমরা মানতেই চাইনা। এক অদ্ভুত কারণে পরমত সহিষ্ণুতা শব্দবন্ধ কিংবা এই ধারণাটাই যেন আমাদের শ্লাঘাতে আঘাত হানে, আমাদের আত্মসম্মানে টান পড়ে। অন্যকে সম্মান দিয়ে যে নিজের সম্মান বাড়তে পারে এ ধারণার চর্চা আমাদের একেবারেই 'ধাতে সয়না'। বরং অপরের দোষ খুঁজে বেড়ানোতেই ষোল আনার ওপর আঠারো আনার বাঙালিয়ানা প্রকাশ পায়। 'ছিদ্রান্বেষী' শব্দটার ইংরেজি বের করুন তো দেখি! পরমত সহিষ্ণুতা না থাকুক এক ফোঁটাও , কিন্তু 'পরের মুখে ঝাল খেতে' বাঙালি বড় সড়গড়। আর তারপর যদি অকারণেই 'চিলে কান নিয়ে গেছে' বলে রব উঠে 'লঙ্কা কাণ্ড'ও বাঁধে, তাতেও বাঙালির আপত্তি নেই এক বিন্দুও। তাতে হাতে পায়ে ঘা লাগলেও 'আঁতে ঘা' লাগেনা আমাদের।

আমাদের কী সত্যিই কিছু এসে যায় না? আমরা বরাবরই 'পাছে লোকে কিছু বলে' নিয়ে বেশ চিন্তামগ্ন থাকি। সেই পরাকাষ্ঠার মানদণ্ডে নিজেদের করণীয় ঠিক করি। কালের পরিবর্তনে বাঙালি এখন সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক, উন্নতির নানান সূচকে অগ্রগতির স্বপ্ন আর সম্ভাবনা তার চোখেমুখে, তার কর্মযজ্ঞের বিশালতায়। এখন তাই ভাবতে হবে এই 'পাছে লোকে কিছু বলে'র 'লোকগুলি' আর কিন্তু শুধু পাড়ার লোক, গ্রামের দশজন, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-কুটুম নয়। 'কিছু বলা'র মতো লোকগুলিও এখন আমাদের মতোই বৈশ্বিক, তারা ছড়িয়ে আছে দুনিয়াময়। তাই 'দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি'র দিন এখন শেষ। নিজের ঘরে নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিলে, 'গায়ের জোরে' নিজের মাটিতে অন্য বাসিন্দার সম্মানহানির কারণ হলে কিন্তু বিশ্বজোড়া লোকে খুঁত ধরবেই শুধু না, আমাদের চরকাতেও তেল দিতে আসবে। তখন 'ভাবমূর্তি'র কী দুর্দশাই না হবে! সজোরে যে তখন 'আঁতে ঘা লাগবে, তার সামাল আমরা দিতে পারবো তো?