ভাষা আর ভাবনার আয়নায় বাঙালিয়ানা

নিরুপমা রহমান
Published : 25 Sept 2021, 02:01 PM
Updated : 25 Sept 2021, 02:01 PM


তখন কিশোরবেলা – স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি। ছোট বোন তখনও কৈশোরে পা দেয়নি। আমেরিকান মিশনারী স্কুলে পড়া আমরা সবে সবে তখন বেশ নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে চাইছি, আত্মসচেতন হয়ে উঠছি। বোন সেসময় হঠাৎ একদিন বাবাকে অনুযোগ জানালো যে আমরা বড় হচ্ছি কিন্তু মা আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ 'প্রাইভেসি' দিচ্ছেন না। 'এটা একেবারেই ঠিক হচ্ছেনা' বোনের এ কথায় সায় জানিয়ে বাবা তাঁর সহমর্মিতা প্রকাশ করে বললেন 'এ তো একেবারেই মেনে নেয়া যায়না। তুমি এক কাজ কর বরং 'প্রাইভেসি' শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ বের করে নিয়ে এসো।' বাবা সাতদিন সময় দিলেন আর আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে যেই মাত্র 'প্রাইভেসি' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ তাঁকে জানাবে বোন, তিনি মায়ের সাথে কথা বলবেন আর আমাদের দু'বোনের যথোপযুক্ত 'প্রাইভেসি' নিশ্চিত করবেন। বোন মহা উৎসাহে কাজে নেমে পড়লো। এক-দু'দিন পর খানিকটা ভর্ৎসনা করে আমাকেও ডেকে নিলো 'তুমিও খোঁজ কর প্রাইভেসির বাংলা শব্দ! 'প্রাইভেসি' পেলে কি শুধু আমার লাভ হবে, তোমার হবে না? নাকি তোমার দরকার নেই প্রাইভেসি?' এদিকে বাবার বেঁধে দেয়া সাতদিন ফুরিয়ে আসছে, দু'বোন মিলে বাড়ির আর স্কুলের যাবতীয় অভিধান ঘেঁটে চলেছি। স্কুলে বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকা কেউ আমাদের এই অনুসন্ধান অভিযান থেকে বাদ গেলেন না। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত শব্দকল্পদ্রুমের দেখা আর মিলছেনা। বাবা যথাসময়ে জিজ্ঞেস করায় আমরা দু'এক খানা শব্দ যেমন গোপনীয়তা, একান্ততা বললাম বটে কিন্তু নিজেরাই জানতাম ওগুলি আসলে ঠিক সত্যিকার অর্থে 'প্রাইভেসি'র প্রতিশব্দ নয়। ক্ষান্ত দিলাম, হার মানলাম এই বলে যে 'আমরা খুঁজে পাইনি'। বাবা একদম অবাক না হয়ে বরং ভারী সহানুভুতি মেশানো কন্ঠে বললেন 'তোমাদের আর কী দোষ মা! 'প্রাইভেসি' শব্দের যে আসলে কোন বাংলা প্রতিশব্দই হয়না। এখন বলো দেখি মায়েরা, যে শব্দের বাংলা নেই, সে জিনিসের দাবী তোমাদের হয়ে আমি কীভাবে তোমাদের বাঙালি মায়ের কাছে তুলে ধরব? তাঁকে কী বোঝাবো বলো দেখি?' স্তব্ধ আমরা দু'বোন, ছাত্রজীবনে তুখোড় বিতার্কিক বাবার জোরালো যুক্তির কাছে হার মানতেই হলো। আর কৈশোরের সেই বোধিপ্রাপ্তি থেকে এটুকু লাভ হয়েছে যে আজ পর্যন্ত সারাজীবনে কখনও আর বাঙালি কারও কাছে 'প্রাইভেসি' বা 'স্পেস' আশা করে আশাহত হতে হয়নি। অন্যের 'হাঁড়ির খবর' না নিলে যে বাঙালির 'পেটের ভাত হজম' হয়না কিংবা 'হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে' যেই আমাদের প্রতিশোধ স্পৃহার উপশম হয়, তাদের কাছে 'প্রাইভেসি' বা 'স্পেস' একেবারেই অজানা অপরিচিত ভাবনা, সে তো বলাই বাহুল্য।

আসলে প্রতিটি ভাষার শব্দভান্ডার, বাগধারা, প্রবাদ-প্রবচন এসবই একটি জাতির মনস্তত্ত্বের অংশ। একটি ভাষার শব্দভান্ডার, প্রজন্মান্তরে চলে আসা তার প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারার মাধ্যমে সেই ভাষাভাষী জাতির জীবনবোধ, জীবনাচরণ, গৃহীত সামাজিক আচার-ব্যবহার, চর্চিত সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, রসবোধের পরিচয় মেলে। জাতিগত মনস্তত্ত্ব আর ভাষা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বলেই আমরা ঠিক যেমনটা ভাবি আমাদের ভাষা ঠিক তেমন শব্দেরই জোগান দেয়। যে শব্দের খোঁজ আমার ভাষায় নেই, সেই জীবনবোধ কিংবা মূল্যবোধ কিংবা রসবোধ আমার নিজস্ব সংস্কৃতির উপাদান বা উপাচারই হয়তো নয়। ভাষার সঙ্গে ভাবনার, মুখের বুলির সঙ্গে প্রাত্যহিক আচরণের এবং নিত্যকার দিনজাগতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজ নিজ ভাষার শব্দভান্ডারের নিবিড়তম যোগ রয়েছে। সে যোগ গভীর আত্মিক, সহজাত আর স্বতঃস্ফূর্ত।

আবার এও ঠিক যে ভাষা বহমান। কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেমন মানুষের জীবনবোধ, মূল্যবোধ, রসবোধ বা চর্চিত সংস্কৃতি ও আচারে পরিবর্তন আসে, ঠিক তেমনি সময় আর পরিস্থিতির পরিবর্তনে রূপ বদল করে ভাষা। এতে যোগ হয় নতুন শব্দ, পুরনো শব্দের নতুন অর্থ তৈরি হয়, তৈরি হয় নতুনতর প্রকাশভঙ্গি। এই যে ভাষার বাঁক পরিবর্তন, এতে কিন্তু জাতিগত মনস্তাত্বিক পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন প্রতিফলিত হয়, প্রতিবিম্বিত হয়। আবার স্থান, কাল, সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হয় যা শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থের বাইরে গিয়ে দৈনন্দিন প্রায়োগিকতায় প্রকাশমান হতে হতে জাতির মনস্তত্বে জায়গা করে নেয়। ভাষা যেমন চলমান ঠিক তেমনি জাতিগত মনস্তত্ত্বও এক বহমান প্রক্রিয়া – এরা একে অপরের পরিপূরক। নানান সূক্ষ্ম দ্যোতনা ভাষাকে জীবন্ত করে তোলে কারণ এই সব ব্যঞ্জনাতেই ভাষাভাষী জাতির প্রাণস্পন্দন লুকিয়ে থাকে।

যেমন ধরা যাক 'ছ্যাঁকা' শব্দটার আভিধানিক অর্থ 'শরীরে তপ্ত বস্তুর জ্বালকের স্পর্শ' বা 'তপ্ত লোহার শলাকার স্পর্শ'। কিন্তু কালক্রমে এর নিত্যকার প্রায়োগিক অর্থ সম্প্রসারিত হয়ে গেল 'প্রেমে পরাজয়' কিংবা 'অপরপক্ষ থেকে প্রেমে সাড়া না পাওয়া'। এবং এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো সাধারণত 'ছ্যাঁকা দেওয়া' শব্দযুগলের ভেতর দিয়ে যিনি প্রেমে সাড়া দিলেন না তার একধরণের দাম্ভিক আস্ফালন বা অহঙ্কার প্রকাশ পায়। আবার 'ছ্যাঁকা খাওয়া' শব্দবন্ধের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কে পরাজিতের প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। ক্রমশ সামাজিক কথোপকথনে এই তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা প্রকাশ থেকে 'ছ্যাঁকা খাওয়া' মানুষটির মনোকষ্টের বিষয়টিকেও ঠাট্টার বিষয় করে তাকে ব্যঙ্গ করে 'ছ্যাঁকামাইসিন' (এ বেদনা কাটিয়ে ওঠবার ঔষধ অর্থে ব্যবহৃত শব্দ) খাবার উপদেশ দিতেও এ যুগের বাঙালি পিছপা হননা একেবারেই। আবার ধরুন, নিজে ঘুড়ি না ওড়ালেও ছোট থেকেই জানি ঘুড়ির সূতা মজবুত ও ধারালো করবার জন্য 'মাঞ্জা' দেওয়া হয়। কিন্তু আজকাল শুধু কিশোর বা তরুণেরাই নয় অনেক মধ্যবয়সীদেরও দেখি কেউ খুব সাজলে বা প্রসাধন করলে তার বর্ণনায় 'মাঞ্জা মারা' শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে। আবার ইদানীং প্রায়শই কথ্য বাংলাতে শুধু নয়, গদ্যলিখনেও নতুন এক বিশেষণের ব্যাপক ব্যবহার চোখে পড়ে। 'দারুণ' রসিক বন্ধু যেমন এখন 'জোশ বন্ধু'; 'দুর্দান্ত লেখক' এখন 'জোশ লেখক'; 'দুরন্ত ক্রীড়াবিদ' এখন 'জোশ খেলোয়াড়'; 'নির্ভীক সাংবাদিক'ও এখন 'জোশ সাংবাদিক'। হালের প্রচলিত ধারায় জনপ্রিয় গায়ক থেকে নায়ক সব 'জোশ' তেমনি আধুনিক সমকালীন মা-বাবার গুণকীর্তনেও ছোট্ট 'জোশ' শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারই যথেষ্ট বলে বোধ হচ্ছে।


আসনে বা পিঁড়িতে বসে 'পাত পেড়ে' খাওয়া বাঙালি এখন টেবিল চেয়ারে বসে খায় আর তাতে কেই বা মনে রেখেছে টেবিল বা চেয়ার আদতে বাংলা শব্দই নয়। আমরা উচ্চারণে শব্দ দু'টোর এমন বাঙালিকরণ করেছি যে এদের আভিধানিক বাংলা শব্দগুলি বললে অর্ধেকের বেশি বাঙালি 'হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন'। এমন নানান উদাহরণ আমাদের বারংবার মনে করিয়ে দেয় যে একই ভাষাভাষী জাতির মাঝেও ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণে কিংবা নিত্যকার অভ্যাসে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান, উপাচার, অনুঘটক আর অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ একই ভাষার প্রকাশভঙ্গীতেও ভিন্নমাত্রিকতা আসে খুব সহজাত ভাবেই। এই প্রকাশভঙ্গীর ভিন্নতা আবার অনেক সময় আর্থসামাজিক কিংবা পেশাগত কিংবা ভৌগলিক অবস্থানের সূচকও হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন শহুরে শিক্ষিত সম্পন্ন বাঙালি বেশ দু'তিন প্রজন্ম ধরেই আর 'দাঁতন' করেন না, 'ব্রাশ' করেন। ডিম ভাজা না খেয়ে 'মামলেট' খান । আর আরও যারা 'শিক্ষিত, শহুরে, দুনিয়াঘোরা' তারা শুধু 'অমলেট' খেয়েই তৃপ্ত থাকেন না, যারা 'মামলেট' খান তাদের দিকে অবজ্ঞ্রার হাসি ছুঁড়ে দেন। এই হাসি ছোঁড়ার সাথে সাথে মনে মনে 'খ্যাৎ' বলে খানিক উপহাস করতেও ছাড়েন না। 'খ্যাৎ' শব্দ ব্যবহারে গ্রাম্যতাকেই কটাক্ষ করা হয়। আমি ভেবে খুব অবাক হই যেখানে অধিকাংশ শিক্ষিত শহুরে বাঙালির পূর্বপুরুষ গ্রামীণ কৃষিজীবী ছিলেন, সেখানে 'গ্রাম্যতা' অভিধাটিই কীভাবে অবমাননা বা অপমানসূচক হয়ে উঠলো কালে কালে। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী নগরায়ণ বা বিশ্বায়নের এই যুগেও গ্রাম ও তার কৃষিজীবী সমাজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছেন, তবুও গ্রাম্য আচার বা জীবনাচরণকে আমরা ব্যঙ্গ করি, উপহাস করি নির্দ্বিধায়। চাষের জমি তথা ক্ষেত শব্দ থেকে উদ্ভুত এই 'খ্যাৎ' শব্দের ব্যবহারে আমরা খুব সহজেই অবজ্ঞা জানাই সেই ব্যক্তিকে যে কিনা আমাদের 'তথাকথিত' দৃষ্টিতে যথোপযুক্ত নাগরিক ও কেতাদুরস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
অন্যের প্রতি অবজ্ঞা বা উপহাস ছুঁড়ে দেবার জন্য আমাদের ভাষায় শব্দের কমতি নেই। যেমন ধরুন আমরা বাঙালিরা বড্ড মাতৃভক্ত জাত। মাকে বন্দনা করে আমাদের কত না কবিতা, কত গান। কিন্তু সেই আমাদের ভাষাতেই কিনা অনায়াসে অন্য নারীদের অবজ্ঞা আর উপহাস করবার জন্য 'মেয়েলোক' বা 'মেয়েছেলে' শব্দগুলো আছে। ডাইনী, পেত্নী ইত্যকার শব্দগুলোও নারীর প্রতি চরম অবমাননার প্রকাশ ঘটায়। দিনে দিনে কালে কালে বাঙালি বদলেছে অনেক, কিন্তু সমাজে প্রচলিত গালিগালাজের বেশিরভাগই এখনও নারীকে উদ্দেশ্য করেই। এমনকি বহুল প্রচলিত গালি 'শালা' শব্দের অর্থ কিন্তু স্ত্রীর ভাই। শব্দের এমন প্রায়োগিক ব্যবহারও কিন্তু জাতিগত মনস্তত্ত্বে পুরুষাধিপত্য থেকে নারীকে অপমান করবার প্রবণতার প্রকাশিত রূপ। যে বাঙালি দেশের মাঝে মায়ের রূপ দেখে, মা আর দেশ মা দু'জনের জন্যই 'জান লড়িয়ে' দিতে জানে, অবাক লাগে ভাবতে সেই বাঙালির মনের অন্তঃপুর হয়তো একটি গরুর চেয়েও নিজের স্ত্রীকে তুচ্ছ বলে মানে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা প্রবাদ 'অভাগার মরে গরু, ভাগ্যবানের মরে জরু' তো বাঙালির সেই বৈপরীত্যময় চরিত্রের শুলুকসন্ধান যোগায়।
আবার প্রশংসার চেয়ে নিন্দে করতেই হয়তো আমরা বেশি আত্মতৃপ্তি আনন্দ পাই। 'পরশ্রীকাতরতা' বা 'ছিদ্রান্বেষী' শব্দের প্রতিশব্দ অন্য ভাষাতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এতেই বাঙালির জাতিগত মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। আর তাই তো আমরা যখন খারাপ কিছু খুঁজে না পাই, তখন হতাশ মন তির্যক মন্তব্য করেই বসে 'বেশি ভালো, ভালো না'। প্রজন্মান্তরে ভাষার ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রেই বিনয় হারিয়ে ঔদ্ধত্য এসেছে, দেখবার দৃষ্টি বদল (পড়ুন 'অনেকক্ষেত্রেই ঘোলা') হয়েছে, কিন্তু বাঙালির 'ছিদ্রান্বেষী' স্বভাব বেড়েছে বৈ কমেনি। শহুরে বাঙালি তাই অনায়াসে আজ ব্যক্তিবিশেষের গ্রাম্যতাকে 'ধিক্কার' জানায়, 'উপহাস' করে 'খ্যাৎ' বলে। 'চাষা' শব্দটা নেহায়েত গালি যদিও অধিকাংশ শহুরে শিক্ষিত বাঙালির বাপ দাদা ঐ 'চাষা'ই ছিলেন। কালান্তরে মূল্যবোধ জীবনবোধে নানান পরিবর্তন এসেছে ঠিক। বাঙালি আধুনিক নগরকেন্দ্রিক জীবন ছাপিয়ে আজ বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে কিন্তু বাঙালি অস্থিমজ্জায় মিশে থাকা 'পরশ্রীকাতরতা' সেই এক জায়গাতেই আছে। তাই আজও বাঙালি 'নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ' করতে 'এক পায়ে খাঁড়া'। আর 'পরশ্রীকাতরতা'র সাথে সাথে আমরা কিন্তু বেশ খানিকটা স্বার্থপরও বটে! নইলে যেই আমরা কিনা আমাদের যূথবদ্ধ সাংস্কৃতিক আচার-বিশ্বাস কিংবা যৌথ সমাজের মুল্যবোধ-জীবনাচরণ নিয়ে অহংবোধ করি, চূড়ান্ত বিপরীতময়তায় সেই আমরাই কিনা অনায়াসে বলি 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম'।

যাহোক ঐ যে বলছিলাম না নিত্যকার অভ্যাস পরিবর্তন যেমন শব্দকোষে কিংবা ভাষার প্রায়োগিকতায় পরিবর্তন আনে, ঠিক তেমনি জীবনযাত্রায় নতুন উপাচারের সংযোজনে নতুন শব্দবন্ধের উৎপত্তি হয় কিংবা এর প্রয়োগ বা ব্যবহারেও অন্যতর ব্যাপ্তি আসে। যেমন ধরা যাক 'টিউবলাইট' শব্দটা এখন বাঙালির কাছে আর ইংরেজি শব্দ বলে বিবেচ্যই নয়। গ্রাম থেকে শহর, উচ্চশিক্ষিত থেকে স্বল্পশিক্ষিত, ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলে 'টিউবলাইট' চেনেন। কিন্তু খুব বেশি দিন নয় যখন 'টিউবলাইট' শব্দটির অন্যমাত্রিক একটি প্রয়োগও কথ্য বাংলাতে চলে এসেছে। 'টিউবলাইট' যেহেতু জ্বলতে খানিক সময় নেয়, তাই কোন কিছু বুঝতে সময় লাগে যে কোন ব্যক্তিতে অবজ্ঞা ছলে 'টিউবলাইট' হিসাবে বর্ণনা করা হয়। আর এই অন্যমাত্রিক প্রায়োগিক ব্যবহার এখন বেশ প্রচলিত। আবার খুব হালে 'কল দেওয়া', 'কল করা', 'কল আসা' শব্দবন্ধগুলো গ্রামীণ বা শহুরে; শিক্ষিত বা অশিক্ষিত; উচ্চপদস্থ চাকুরে বা শিক্ষক থেকে শুরু করে দিনমজুর বা সবজিবিক্রেতা সকলের কাছে একেবারে অনন্যমাত্রিকতা হাজির হয়েছে। আদতে ইংরেজি থেকে আসা 'call' শব্দের অর্থ প্রায়োগিক ভাবে সম্প্রসারিত হয়ে মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি আদত অর্থ জানা থাক বা না থাক 'মেসেজ' দেওয়া কিংবা পাওয়ার অর্থ এখন বাঙালির 'মোবাইল ফোনময়' দৈনন্দিন জীবনের নিত্যকার ব্যবহৃত শব্দবন্ধ। আর ইংরেজি থেকে পাওয়া 'missed call' এর পূর্ণ বাঙালিকরণ ঘটে তা হয়ে গেছে 'মিসকল'। শুধু যে অন্যভাষা থেকে আসা শব্দেরই রূপান্তর ঘটেছে তা তো নয়। ভাবুন না 'আজাইরা' শব্দটার কথা। বহুল প্রচলিত, বহুল ব্যবহৃত এ শব্দটা অভিধানে আছে 'আজাড়' হিসাবে যার আভিধানিক অর্থ শুন্য বা খালি অথবা অবসর বা ফুরসত। পূর্ববাংলার আঞ্চলিকতায় 'আজাড়' পরিবর্তিত হয়ে শুধু 'আজাইরা' ই হয়নি, এর অর্থ সম্প্রসারিত হয়ে হয়েছে কর্মহীন বা অপ্রয়োজনীয়। ভাষার বহমানতায় কালে কালে নতুন নতুন 'জোশ' বা 'জম্পেশ' শব্দ বা অভিব্যক্তির প্রকাশ যেমন ঘটেছে ঠিক তেমনি নানান 'আজাইরা' শব্দও ঢুকেছে।

দেশভাগ শুধুমাত্র ভৌগলিক আর রাজনৈতিক বিচারেই বাংলা ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করেনি, বাঙালির জীবনবোধ, জীবনাচরণ, মুল্যবোধ আর বৌদ্ধিক চেতনার জায়গাতেও আমূল পরিবর্তন এনেছে। বাংলা ভাষার বাঁক পরিবর্তনে বা বিবর্তনেও এর প্রভাব অনস্বীকার্য। কেবলমাত্র সিরিল র‍্যাডক্লিফের ভাবনাপ্রসূত এক সীমারেখাতেই তো আর দেশভাগ থেমে থাকেনি, এ ভূখণ্ডের আপামর মানুষের মনেও এ এক দ্বিধাদীর্ণ বিভাজন এঁকে দিয়েছিলো। যা দিনে দিনে, কালে কালে ধর্ম, সমাজনীতি আর রাজনীতির সমান্তরাল অথচ অহি-নকুল সম্পর্কের মাঝে ফেলেছে বাঙালির ভাষাকে। ভাষায় কালক্রমে লেগে গেল ধর্মের লেবাস। 'জলে' নেমে 'স্নান' করা বাঙালির পরিচয় আলাদা হল 'পানি'তে নেমে 'গোসল' করা বাঙালির থেকে। 'নিমন্ত্রণে' গিয়ে 'মাংস' ভাত খাওয়া বাঙালির ঠিকানা বদলে গেল 'দাওয়াতে' গিয়ে 'গোশত' ভাত খাওয়া বাঙালির ঠিকানা থেকে। কাঁটাতারের একপারের হেঁসেলের 'লবণ' কিংবা 'মরিচ' অপরপারের হেঁসেলে গিয়ে হয়ে গেল 'নুন' আর 'লঙ্কা'। অতিআদরের সম্পর্কের ডাকগুলিতেও কালক্রমে লেপটে গেল সাম্প্রদায়িক পরিচয় – দিদি না আপা, মাসী না খালা, পিসী না ফুপু, কিংবা কাকা না চাচা ডাকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধর্মীয় পরিচয়। কালে কালে 'দাদাদের দেশ' কথার মধ্যে এক তির্যক ব্যঙ্গাত্মক সাম্প্রদায়িকতাও আমরা মেনে নিয়েছি, মানিয়ে নিয়েছি। আবার অন্য দিকে, ভৌগলিক সীমানায় বিভক্ত বাঙালি 'ঘটি' 'বাঙাল' থেকে 'বাটি' (বাঙালের 'বা' আর ঘটির 'টি'র মিলনে উদ্ভুত) শব্দে নিজেই নিজের গোত্রভাগ করেছে, তা জিইয়ে রেখেছে প্রজন্মান্তরে। ভাষা যদি হয় নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর রুচি, ঐতিহ্য আর জীবনবোধের প্রকাশমাধ্যম তাহলে এ অস্বীকার করবার উপায় কি যে আমাদের ভাষার প্রায়োগিক ব্যবহারে আমাদের মনের দ্বিধাদীর্ণ, দীন মনোভাবও প্রকাশ পায় অনেক সময়।

ভাষা বড় শক্তিশালী মাধ্যম। আমাদের মনের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, মুল্যবোধ, রসবোধ সব প্রকাশ পায় ভাষায় । কিন্তু ভাষা কি শুধু বোধগম্য একরাশ ধ্বনি বা শব্দভান্ডার? মুখের বচন যদি জোগান দেয় বাচনিক ভাষার, তাহলে না বলা অব্যক্ত কথাও যখন আমাদের নানান অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায়, সেও তো ভাষার আরেক রূপ। ভাষা তাই বাচনিক বা অবাচনিক দুই-ই হতে পারে। বাচনিক ভাষার সাথে যেমন জাতিসত্তার মনোস্তত্ত্ব আর মুল্যবোধ একাকার হয়ে আছে, অবাচনিক ভাষাতেও ঠিক তেমনি জাতিগত অনুভুতি আর অভিব্যক্তির সমাপতন ঘটে। আমরা তেমন করে হয়তো কখনো ভাবিইনা যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, আমাদের চিরায়ত বাঙালিয়ানায় অবাচনিক ভাষা কী দারুণ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাঙালির তো চিরকালই 'বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা'। আর আমরাতো প্রায়ই বলি 'সব কথা কি মুখে বলতে হয়, বুঝেও নিতে হয়' আর তাই বোধ করি আমাদের গানেও আছে 'কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয়, সে তো মুখে বলা যায়না'। এ সবই ইঙ্গিত দেয় আমাদের অবাচনিক ভাষার গুরুত্বের দিকে, বুঝিয়ে দেয় অবাচনিক বাংলা ভাষায় সড়গড় হয়ে ওঠাও বাঙালির কাছে খুব জরুরী। খুব সাম্প্রতিক কয়েক দশক ধরে হয়তো আমরা নাগরিক বাঙালিরা ইংরেজি thank you শব্দবন্ধকে একান্ত আপনার করে নিয়েছি প্রাত্যহিক জীবনে। কিন্তু এর বাংলা প্রতিশব্দ 'ধন্যবাদ' এর ব্যবহার আজও বড্ড পোশাকি বা আনুষ্ঠানিক। প্রিয়তম এক গোছা ফুল কিনে দিলে আমাদের উজ্জ্বল চোখের হাসি আর ভালোবাসার হাত বাড়ানোতে অনুক্ত অব্যক্ত কথার মাঝে যে অবাচনিক ভাষার তরঙ্গ প্রিয়জনের অন্তরে পৌঁছে যাবে, 'ধন্যবাদ' শব্দের ভার হয়তো সেই সপ্রাণ অভিব্যক্তিটুকু বইতেই পারবেনা। বাঙালি মা যখন সন্তানের চুলে তেল দিয়ে বিলি কেটে দেন, তখন 'ধন্যবাদ' শুনলে হয়তো তিনি খানিক থমকেই যাবেন। বরং আরামে বুজে আসা সন্তানের দু'চোখে যে অবাচনিক ভাষা লুকিয়ে থাকে বাঙালি মা ঠিক তা বুঝে নিতে জানেন।

এ প্রসঙ্গে ছোটবেলার গল্প মনে পড়ে গেল। তখন বয়স কতই বা হবে – বছর দশেক বড়জোর। মিশনারী স্কুলপড়ুয়া আমি দিনমান শিক্ষকদের, সহপাঠীদের (শিক্ষকদের মাঝে বাঙালি, আমেরিকান সব ছিলেন, আর স্কুলের কেতা বেশ আমেরিকান) নানান কারণে thank you বলতে শিখেছি। যাহোক পিতামহী ভাত বেড়ে খেতে দিয়েছেন। স্বাভাবতই তাঁকে অভ্যাসসুলভ thank you বলেছি। বেশ কড়া ভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি 'এটা কী হল?' শিশু আমি ভাবলাম হয়তো ইংরেজিতে বলাটা ঠিক হয়নি, তাই দ্রুত ঠিক করে নিয়ে বাংলায় বললাম 'ধন্যবাদ'। পিতামহীর কণ্ঠে এবার বিরক্তির সাথে হতাশাও যোগ হল। তাঁর কথা 'আমি আমার নাতনীকে খেতে দিয়েছি, সে আনন্দ নিয়ে, তৃপ্তি করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে খাবে। ওতেই তো আমার শান্তি। আমি কি ধন্যবাদ আর thank you শোনার জন্য আদর করে খেতে দিয়েছি?' বুঝুন এবার! শৈশবের সেই ঘটনার ভেতর দিয়ে আমার বাঙালি মন শিখে নিয়েছিলো বাচনিক 'ধন্যবাদ' আমাদের কাছে ততটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা আমাদের আন্তরিক অবাচনিক অভিব্যক্তি।

আর ঠিক একারণেই ইংরেজি 'সরি' শব্দটার পোশাকি শব্দ 'দুঃখিত' তেমন 'হালে পানি পায়না'। নাগরিক বাঙালি থেকে এখন গ্রামীণ বাঙালি সকলের কাছে 'সরি' শব্দটাই বেশি গ্রহণযোগ্য। আর ঐ যে বলছিলাম না আমাদের ভাবনাগুলি থেকেই আমাদের শব্দগুলি আসে। বাঙালি কবে আর সহজে বা স্বতঃস্ফূর্ততায় নিজের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে বা করতে পেরেছে। এতে বাঙালির ভারী আপত্তি আর গভীর কুণ্ঠা। দুঃখ প্রকাশের মাঝে বাঙালি পরাজয় দেখে, অপমান খোঁজে আর তাই ইংরেজিতে sorry শব্দটার পোশাকি বাংলা প্রতিশব্দ যাই থাক এর আসলে কোন সঠিক অভিধা নেই। বড় টনটনে আত্মসম্মান বোধ আমাদের, নিজের কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আর যাই হোক 'নিজের নাক কাটা' বাঙালির সয়নি কোনদিন, আজও সয়না।

আমরা যেমনটা ভাবি, তেমনটাই বিশ্বাস করি আর মুখের বুলিতেও তারই প্রকাশ হয়। যেমন ধরুন নিয়ম শব্দটার সাথে আমরা শৃঙ্খলা শব্দটা জুড়ে দেয়ার মাঝে আমি বাঙালি মনস্তত্ত্বের এক অদ্ভুত দিক খুঁজে পাই। কেন যেন বোধ হয় শৃঙ্খলা শব্দটার মাঝে থাকা 'শৃঙ্খল' বা 'নিগড়' কে বাঙালি মানতেই পারেনা। তাই নিয়ম ভাঙাতেই বাঙালি শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার আনন্দ খুঁজে পায়। এমনকি নিজের অমঙ্গল হলেও আমরা নিয়মকে মঙ্গলবিধান না ভেবে কঠিন নিগড় ভাবি, ভাবি দুঃসহ শৃঙ্খল। তাই তো বাঙালিরা প্রতিনিয়ত 'শৃঙ্খল'সম নিয়মকে দলে, পিষে, ভেঙে হয়ে যাই 'আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে'।

সবাই রাজার এ রাজত্বে খোসামোদকারীর সংখ্যা অপ্রতুল থাকলে চলে কীভাবে! উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্যায্য স্তুতি না গাইলে নিজের সুবিধেমতো নিয়মের তোয়াক্কা না করে চলাই তো দুষ্কর। আর তাই বাঙালির কাছে আর যা কিছুর অভাব থাক, অভাব নেই 'তেল' এর। 'তেল' এর ছড়াছড়ি এখন জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে। হেঁসেলের উপাচার ব্যতিরেকে আমরা বাঙালিরা এর ব্যবহারিক প্রয়োগ বাড়িয়ে এমন সম্প্রসারিত করেছি যে এর সাথে গভীর নেতিবাচক ব্যঞ্জনা জড়িয়ে গেছে বহুকাল ধরে। আগের কালে সংস্কৃত কবিরা পারষ্পরিক স্নেহ প্রদর্শনের উপমা হিসাবে 'তৈল দেওয়া'র কথা উল্লেখ করেছেন। আর এই 'ঘোর কলিকালে' আমরা বাঙালিরা সবাই যে যার মতো 'তেল মেরে' নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় মগ্ন আছি। ভুলেও যেন 'তেল মারা' বা 'তেল দেওয়া'র সাথে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনকে গুলিয়ে ফেলবেন না। প্রাপ্য সম্মানের হিসাবের টাকা, আনা, পাই গুণতে আমাদের বয়েই গেছে। এর চেয়ে বাপু অনেক সহজ 'তেল মারা' বা 'তেল দেওয়া'। কারণ আমরা 'তেল' দিতে আর পেতে – দুই-ই বড্ড ভালোবাসি ।

'মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে খেটে / গেছে তো দিন অনেক কেটে' এমনি ভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে ভাষার রূপান্তরের এ পথপরিক্রমায় যুক্ত হয়েছে ব্রাহ্মীলিপি থেকে বাংলালিপি কিংবা চর্যাপদ থেকে আধুনিক বাংলা। বাঙালির জীবনবোধ, জীবনাচরণ, গৃহীত সামাজিক আচার-ব্যবহার, চর্চিত সংস্কৃতি, মুল্যবোধ, বিশ্বাস, রসবোধের খোলনলচে বদলেছে ক্রমাগত। চিরকালীন বাঙালিয়ানার সাথে জুড়েছে নিত্যনতুন আধুনিকতা, নগরায়ণ আর বৈশ্বায়নের উপাচার আর অনুষঙ্গ। এ বহমানতা নিরন্তর চলমান এক প্রক্রিয়া। ব-দ্বীপের এই ভূখন্ডে নানান জাতি, পেশার মানুষ যুগে যুগে যেমন এসে বাসা বেঁধেছে, ঠিক তেমনি তাঁদের আনা জীবনবোধ, সংস্কৃতি, জীবনোপচার কালক্রমে বাঙালিয়ানার অংশ হয়ে উঠেছে, পরম মমতায় বাঙালি ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নতুন নতুন সব শব্দকে বাঙালিকরণ করেছে, শব্দের অর্থের সম্প্রসারণ করেছে নিজের আবেগ-অনুভূতি, ভালোলাগা-মন্দলাগা, রাগ-অনুরাগ-রসবোধ ফুটিয়ে তুলতে। বাচনিক আর অবাচনিক ভাষার দু'রকম প্রকাশভঙ্গিতেই এসেছে আমূল কিন্তু সঙ্গত-সহজাত-স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন আর পরিবর্ধন কালে কালে, যুগে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাই বাঙালী যখন আজ শুধু পরবাসে যায় না, অভিবাসে যায়; বৈশ্বিকতা যখন বাঙালিয়ানাকে ছুঁয়েছে নানান ভাবে তখন ভাষার সঙ্গে ভাবনার সমাপতনকে, মুখের বুলির সঙ্গে প্রাত্যহিক আচরণের এবং নিত্যকার দিনজাগতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজ নিজ ভাষার শব্দভান্ডারের সন্নিপাতের বিষয়টিকে বৌদ্ধিক আর জ্ঞানজাগতিক ভাবনা থেকে দেখা যেতেই পারে। কারণ বাংলা ভাষা আমার কাছে বাঙালিয়ানার আয়না, যাতে কিনা ভূত-ভবিষ্যতের প্রতিটি রেখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষার দর্পণে তাই বাঙালি চরিত্রের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে নিরন্তর কাল থেকে কালান্তরে।