একুশের মন্তাজ

আবদুস সেলিমআবদুস সেলিম
Published : 20 Feb 2021, 08:29 PM
Updated : 20 Feb 2021, 08:29 PM


১. বসন্তের সুর
Where are the songs of Spring? Ay, where are they—John Keats

এখন বসন্ত। বসন্তের গানে আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন। এখন শরৎ নয়—তাই বলতে পারি না—কোথায় সেই বসন্তের গান, কোথায়?
কিন্তু বসন্তের গান কি মিষ্টি? কেন নয়? কোকিল ডাকা, বুগেনভেলিয়া-কৃষ্ণচূড়া-পলাশ ফোটা, আমের বোলের গন্ধ-ভরা উদাস দখিন-হাওয়া ছড়ান, উচ্ছল স্বচ্ছ স্নিগ্ধ কোমল নারী-শরীরের পরশ বুলানো বসন্ত এখন। সে তো মিষ্টি সুবাসিত না হয়ে যায় না। শীতের মৃত্যুময়তা এখন নেই। সে জড়তা মৃত—প্রাণের জন্ম এখন। আমাদের বলার কোন অবকাশ নেই বসন্ত বড়ই নিষ্ঠুর মৌসুম।
কারণ ফাল্গুন-বাংলাভাষা-বাংলাদেশ-এবং বাঙালি—কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে—হাজার-হাজার বছর আগে থেকে কি আশ্চর্যভাবে একই সাথে সংযুক্ত, এক সুতই গাঁথা। ঊনিশ শ' বায়ান্নতে এসে এরা সবাই মিলল এবং মিলে এক অনন্য ইতিহাসের দলিল হয়ে গেল। কি অদ্ভুত কাকতালীয়। এ যেন উপন্যাস বা নাটক কিংবা ছোট গল্প অথবা কবিতাই একটা। সাহিত্যের সেই বিশেষ দর্শনের পাতাকে পূর্ণত্বে ভরে দিল যেখানে লেখা: ট্রাজেডিই সবচেয়ে উঁচু মানের সাহিত্য—চিরায়ত শিল্পকর্ম। কাল: বসন্ত; স্থান: বাংলাদেশ; লবকুশ: বাঙালি; বিষয়: সংগ্রাম-যুদ্ধ; কারণ: বাংলাভাষা-বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ। এর চাইতে সম্পন্ন ও সুন্দর রূপক কি এর আগে কেউ লিখেছে!

এখন বসন্ত—শরৎ নয়। বসন্তের গান আছে। যে গান সুন্দর, সুমধুর। সে গান সুললিত। কিন্তু বাংলাদেশের বসন্তের গানের অন্য সূর। এখানকার কোকিল ডাক দিয়ে বলে মিষ্টি সুরে ডাকতে হ'লে চাই মুক্ত আকাশ। আর তার জন্যে সংগ্রাম করো যুদ্ধ করো। বাগানবিলাস বুগেনভেলিয়া-কৃষ্ণচূড়া-পলাশ জ্বালিয়ে দেয় এদেশের রক্তের অন্তর্গত অস্থিরতা। তারা রক্তের ভেতর ডাক দেয়। আমের বোল তার গন্ধ ছড়িয়ে ফিসফিস করে কানে-কানে বলে: তুমি বাঙালি। উদাস দখিন হাওয়া দুরন্ত ইচ্ছার আগল খুলে দেয়। আর সুন্দর স্নিগ্ধ নারী-শরীর ছড়ায় সেই সৃষ্টির শিহরণ যা বসন্তের নিজস্ব, বসন্তের একান্ত। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের বসন্তের গান বড় বিষণ্ন-করুণ: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। কারণ অনেক মৃত্যু অনেক দুঃখ তখন স্মৃতির সমুদ্র সৈকতে আছড়ে পড়ে—ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু আশ্চর্য মিষ্টি সে গান: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি ? কি স্মৃতিবিধুর! এই গান তো শুনতে হয় মৌনতায়, গাইতে হয় কোরাসে আর তারপর সারাটা বছর তার শব্দ আর সুর হৃদয়ে ধরে রাখতে হয়।
প্রসঙ্গ: একুশে ফেব্রুয়ারী বা আটই ফাল্গুন। কি আশ্চর্য—বাংলা দেশের সব আন্দোলনই ঠিক ফাল্গুনে এসে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছোয়। এর আগের যে ঘটনা তা শুধু প্রস্তাবনা। এবং ফাল্গুন হ'লো চূড়ান্ত। ভবিতব্যই দেখি সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক, সবচাইতে বড় শিল্পী।

২. আপনাপন মাতৃভাষা
আমরা এসেছি আর এক চূড়ান্তের দ্বারপ্রান্তে এই একুশের হাত ধরে—এই উত্তর-উপনিবেশবাদের যুগে যে দ্বার উন্মুক্ত, অবারিত। যে দ্বারের ঐ পারে দৃষ্টিগোচর হয়েছে সুন্দর-সুপ্রশস্ত পরিচ্ছন্ন বিটুমেন-করা এক রাস্তা যা প্রসারিত অনন্ত অনাবিল এক বিবাদহীন সুখরাজ্যের দিকে। সেখানে জাতিতে জাতিতে, ভাষাতে ভাষাতে, নান্দনিক বোধে, মানুষে মানুষে নেই কোন প্রতিযোগিতা, হিংসা, আধিপত্য। কারণ আমরা তো সেই মৈত্রী বন্ধনের অনুশীলন করেছি আমাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে, বুঝেছি মাতৃভাষা কত পবিত্র, কত বড় ভালবাসার ধন।
একুশের সংগ্রাম ছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার সঠিক স্থান নির্বাচনে, তাকে তার সঠিক স্থানে প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় শপথে। সেখানে, সে সময়ে আমরা কোন আপোষ করিনি ঠিক, কিন্তু অন্য ভাষাকে কোনক্রমেই ঘৃণা করিনি, অপাংক্তেও গণ্য করিনি। মাতৃভাষাকে ভালবাসার অধিকার সার্বজনীন, মানুষের মৌলিক অধিকার। আমি কখনওই মানতে রাজি নই বাংলাভাষাকে ভালবাসা অর্থ অন্য ভাষাকে অবহেলা করা, অন্য ভাষা ও শিল্পসাহিত্যের মৌলিকতা, বৈশিষ্টকে অস্বীকার করা। এ তো প্রমাণিত সত্য ভাষাতে ভাষাতে, শিল্পে শিল্পে, সাহিত্যে সাহিত্যে আদান প্রদানেই মানুর সভ্যতার বিকাশ ও উচ্চমানে আরোহণ কারণ পুরো মানব জাতিই তো এক অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব, এক বিশাল মহাদেশ—যেমনটা অনুধাবন করেছেন রবীন্দ্রানাথ কিংবা নজরুল, কিংবা জীবনানন্দ কিম্বা জন ডান, কিংবা বোদলেয়ার, কিংবা সেরভেন্তেস, কিংবা বোরহেস কিংম্বা এই বিশ্বের অপরাপর ভাষাবিদ, সাহিত্যিকরা।

৩. একুশ এক উৎসব
১৯৫২ থেকে ২০২১—এই দীর্ঘ ঊনসত্তুর বছরের ব্যাবধানে একুশকে উৎসবের লগ্নমুহূর্ত রূপে বিশেষিত করায় যে-বিরোধকল্পের জন্ম হতে পারে, তার ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে দেয়া সম্ভব। ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এতটা সময় পাড়ি দিয়ে এসে একুশ যে একটি উৎসব-আধার তাতে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার কোন সন্দেহ একেবারেই নেই।
এই আধারের উৎপাদক কয়েকটি বিজয়। বিজয় অধিকার প্রতিষ্ঠার, বিজয় স্বাধীনতার, বিজয় জাতীয় চেতনার। অর্থাৎ উৎসব—উৎসব বিজয়ের, উৎসব আত্মত্যাগের।
শোষকরা উপনিবেশবাদের নেশায় বুঁদ হয়ে যে দিন রক্তের-উৎসবে মেতেছিল তারা বিন্দুমাত্র বোঝেনি আসল বিজয় কার জন্যে অপেক্ষা করছে—সেই বিজয়ের মাধ্যমেই তাদের পতনের উৎসব।
একুশ থাকুক আমাদের হৃদয়ের পবিত্রতম কোটরে স্মৃতির সঞ্জীবনী সুধায় সদা সিক্ত হয়ে!
এখন বসন্ত। বসন্তের গানে আকাশ-বাতাস হয়ে উঠুক উচ্ছ্বসিত, আর একুশ হোক সারা বিশ্বের মাতৃভাষার ব্রাত্যমন্ত্র।