জেমস রেনেল ও তাঁহার রোজনামচা : ১৭৬৪-১৭৬৭

সলিমুল্লাহ খান
Published : 20 Dec 2007, 05:22 PM
Updated : 20 Dec 2007, 05:22 PM

কিস্তি

(তেসরা কিস্তি)

৩য় কিস্তির ভূমিকা

………
জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০)
……….

জেমস রেনেল: আরোর আরো

মেজর জেমস রেনেল খ্রিস্টিয় ১৭৭৬ সালে সরকারি চাকুরি হইতে অবসর গ্রহণ করিলেন। ইহার শুদ্ধ কিছুদিন আগে 'বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার' নামক পল্টনে মেজর পদে তাঁহার উন্নতি হইয়াছিল। তখন কলিকাতায় পূর্ব ভারত কোম্পানি নিয়োজিত গভর্নর জেনারেল পদে ওয়ারেন হেস্টিংস আসীন। জেমস রেনেলের নামে মাসিক ৫০/= টাকা পেনসন মঞ্জুর করিয়াছিলেন তিনি। এই কথা আমরা পহিলা কিস্তিতেই উল্লেখ করিয়াছি। ইহার পর দেশের ছেলে দেশেই ফিরিয়া গেলেন। দেশে ফিরিবার পর জেমস রেনেল লন্ডনেই বসবাস শুরু করেন। তাঁহার বাকি জীবন খুব একটা হ্রস্ব ছিল এমন কথা বলিব না। এই নাতিহ্রস্ব জীবন তিনি নানানদেশের ভূগোলবিদ্যা আর সাহিত্য চর্চা করিয়া কাটাইয়াছিলেন।

তাঁহার বড় কীর্তি বাঙ্গালাদেশের ভূচিত্রাবলী যাহাতে হিন্দুস্তানের ঐদিককার রণাঙ্গন আর বাণিজ্যাঙ্গনের মানচিত্র সন্নিবেশিত হইয়াছে বা Bengal Altas, containing Maps of the Theatre of War and Commerce on that side of Hindoostan প্রকাশিত হয় ১৭৭৯ সালে। ১৭৮১ সালে ইহার একটি দোসরা সংস্করণও ছাপা হয়। একই বৎসরে তিনি বিলাতের—রাজসভা বা Royal Society নামেই সমধিক পরিচিত—বিজ্ঞানসাধকমণ্ডলীর সদস্য বা ফেলো নির্বাচিত হইলেন।

ইহার পর তিনি ভারতবর্ষের একপ্রস্ত মোটামুটি নির্ভরযোগ্য মানচিত্র তৈয়ারে মনোনিবেশ করিলেন। সঙ্গে একটি প্রবন্ধ বা মেমোয়ারও জুড়িয়া দিলেন। (রেনেল ১৭৮৩) তাহাতে যোগ করিলেন কোন কল্পনা ও কোন কোন গ্রন্থকারের সহায়তা লইলেন তাহার বিবরণও। এশিয়াখণ্ডের পূর্বাঞ্চল জুড়িয়া বিশাল একখণ্ড ভূগোল বই লিখিবার মওকাও তিনি করিলেন আর গ্রিক ইতিহাসবেত্তার নামে 'এরোদোতসের ভূগোল' নাম দিয়া তদ্বিরচিত ২ খণ্ড বহিও বাহির হইল।

আফ্রিকা মহাদেশের ভূগোল লইয়াও তিনি মাতিয়াছিলেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ লন্ডনস্থ আফ্রিকা সমিতির ডাকে তিনি ঐ মহাদেশের উত্তর অর্ধাংশের মানচিত্রও প্রকাশ করিলেন। সঙ্গে একপ্রস্ত প্রবন্ধও। ১৭৯১ সালে বিলাতের রাজসভা তাঁহাকে কোপলে পদক (Copley Medal) প্রদান করিয়া সম্মান জানাইলেন।

বাতাস ও সমুদ্রস্রোতের গতিবিধি লইয়া গবেষণায়ও তিনি এক পর্যায়ে আগ্রহ দেখাইলেন। ১৮১০ সালের পর তিনি তাঁহার সকল গবেষণা এক জায়গায় আনিয়া কিছু সার্বিক সিদ্ধান্ত বা 'জেনারেল থিয়োরি' প্রকাশ করিবারও কোশেশ করিলেন।

রেনেল সাহেব যে সময় জরিপকার্য সমাধা করিতেছিলেন সেই সময় মাপজোকের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তত উন্নত বা নিখুঁত হয় নাই। তিনি একপ্রস্ত কম্পাস ও এক বাঁও শিকল ভরসা করিয়া জরিপাদি চালাইতেছিলেন। সবে—শুদ্ধ ১৭৬১ সালে—সময় পরিমাপক যন্ত্র বা ক্রোনোমিটারের দৌলতে অক্ষাংশ মাপিবার কৌশল বাহির হইয়াছে। রেনেল তাঁহার কাজ শুরু করিয়াছেন ততদিনে মাত্র ১ বৎসর হইয়াছে। তাহা সত্ত্বেও রেনেলের জরিপ কী করিয়া এত নিখুঁত হইল তাহা একশ/দেড়শ বছর পরের পণ্ডিতসাধারণের বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কর্নেল ল্যামটন প্রমুখের হাতে জরিপের আরো নিখুঁত পদ্ধতি বাহির হইয়া গেলেও ভারতবর্ষের ব্রিটিশ জরিপ বিভাগ রেনেলের কর্জ চিরকাল স্বীকার করিয়াছেন।

১৭৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেনেল মুক্তিযোদ্ধা ফকির বাহিনীর হাতে মার খাইয়া ঘা শুকাইবার নিমিত্ত ঢাকায় চলিয়া আসেন। তাঁহার জীবনীকার বলিয়াছেন ইংরেজ অফিসারদের মধ্যে ঐ বছর মে মাসে যে বিদ্রোহ দেখা দিল তাহাতে তিনি শরিক হইবার সুযোগ পান নাই। সুস্থ থাকিলে তিনি অসন্তুষ্ট অফিসারদের সঙ্গে যে যোগ দিতেন তাহা তৎলিখিত এক পত্র মারফত জানা যায়।

তথাপি সেই যুগের ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ওরফে কলিকাতার কৌন্সিল রেনেলের এতখানি তারিফ করিলেন কেন? রেনেলের রোজনামচা সাক্ষী তিনি রোজকার কাজ কতটা মনোযোগ সহকারে সারিতেন। আবহাওয়ার প্রতি প্রহরের পরিবর্তন তিনি লিখিয়া রাখিয়াছেন—তাঁহার জরিপ যুগের (১৭৬৪-১৭৬৭) আগা হইতে গোড়া পর্যন্ত কখনও ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায় না।

রোজনামচার সম্পাদক লা টুশ সাহেব ১৯১০ সালে লিখিত ভূমিকায় বলিয়াছেন: 'ভারত ইতিহাসের ঐ তুলনারহিত জমানায় যখন এয়ুরোপীয় লোকজন বল্গাহীন বিলাসিতায় সময় কাটাইতেন, তখন যে কর্ম হাতে লইয়াছেন সেই কাজে একাগ্রে চিত্তনিবেশ করিবার প্রতিভা তাঁহার ছিল বলিয়াই তিনি পরম নিষ্ঠা ও সততার সহিত নিজ কর্তব্যে অটল থাকিতেন। সন্দেহ নাই এই কারণেই কলিকাতার কৌন্সিল এহেন প্রশংসাবাক্যে তাঁহাকে অভিনন্দিত করিয়াছিলেন। ঐ যুগে তাঁহাদের কর্মচারী মহলে এহেন সদগুণের দেখা পাওয়া সহজ ছিল না।'

দোহাই

১. Major James Rennell, 'Bengal Altas, Containing Maps of the Theatre of War and Commerce on that Side of Hindoostan, 1st ed., London 1779, 2nd ed., London 1781, reprinted by order of the Surveyor General of India.
২. Major James Rennell, Memoir of a Map of Hindoostan or the Mogul Empire, &c., London, 1783.
৩. Sir C. Markhan, Memoir of the Indian Surveys, 2nd ed. London, 1878.
৪. T. H. D. La Touche, 'Introduction', in The Journals of Major James Rennell, Calcutta, 1910.

~~~

আমিন জেমস রেনেল

বিরচিত

শুকনা মৌসুমে গঙ্গানদী হইতে কলিকাতা যাইবার নিকটতম পথ খুঁজিয়া পাইবার লক্ষ্যে জলঙ্গি নদীর মাথা হইতে ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থল পর্যন্ত গঙ্গার; লক্ষীপুর হইতে ঢাকা পর্যন্ত মেঘনা ও অন্যান্য নদীর; এবং দক্ষিণ তীরবর্তী নদীনালার জরিপকার্যের বিবরণী সংযুক্ত

রোজনামচা

সন ১৭৬৪-১৭৬৭

তজর্মা : সলিমুল্লাহ খান

(গত সংখ্যার পর)

বৈকালে পূর্বতীরে ভিড়িলাম, কারণ এইখান হইতে মোহনার মাথা পর্যন্ত ফিরতি জরিপ করিতে হইবে, কারণ যদি খালটিতে নৌ চলাচলের উপযোগী অবস্থা আছে বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায় তবে যে সমস্ত নৌকা নদীর ভাঁটিতে নামে তাহারা তো সহজেই এই পথ বাহিয়া আসিতে পারে।

বেলা ৪ ঘটিকার সময় উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিক হইতে একটি ভারি দমকা হাওয়া বহিয়া গেল। সুদীর্ঘ মোহনাঞ্চল নৌকা-সাম্পান যাতায়াতের উপযোগী নহে বিধায় আমরা কুষ্টিয়া খালের ভেতরে আশ্রয় লইয়া সময় কাটাইতে বাধ্য হইলাম। সারা রাত ধরিয়া বিস্তর বাতাস আর বৃষ্টি।

৪ ও ৫ তারিখ আবহাওয়া ভাল গেল, বাতাস কখনো ভারি কখনো হালকা। এই দুই দিবস সুদীর্ঘ দক্ষিণ মোহনার পূর্বতীর জরিপ করিয়া কাটাইলাম আর বৈকালে কুষ্টিয়া খালে গমন করিলাম।

৬, ৭ ও ৮ তারিখ গভর্নরের কাছে পাঠাইব বলিয়া আদি জরিপ চিত্রাবলী ছোট আকারে আঁকিয়া, রোজনামচার নকল করিয়া কাটাইলাম। এই সময়টা জুড়িয়া প্রচুর বৃষ্টি হইল। বজরার ফুটাফাটা বন্ধ করিবার এবং রাডার সারাইবার নিমিত্ত কয়েকজন কাঠমিস্ত্রী নিযুক্ত করিলাম।

৯ তারিখে মাথা হইতে নিচের দিকে সোয়া এক মাইল পর্যন্ত খালের তত্ত্ব লইলাম, ঐ পর্যন্ত গিয়া দেখিলাম পানির গভীরতা একেবারেই নাই। আরো কড়াকড়ি পরিক্ষা করিয়া দেখিলাম কুপাদি (Cupadin) গ্রামের উল্টাদিকে পানি মাত্র ৪ কি ৫ হাত আর বিশ্বাসযোগ্য একজনের জবানিতে জানিতে পারিলাম এই বৃষ্টির মৌসুম শুরু হইবার পর পানি ৪ হাত পর্যন্ত বাড়িয়াছে। এই পরিস্থিতির কথা ছাড়িয়া বলিতে, কয়েকজন নৌকার মাঝি আমাকে বলিয়াছেন শুকনা মৌসুমে তাহারা এই জায়গাটা ডিঙ্গিযোগে পার হইয়াছেন আর এইখানে অনেক সময় ৯০ মণ বোঝাই নৌকা পার হইতে পারে মতন পানি থাকে না। ৩০০ মণের নৌকা যাইতে ২ হইতে ২ ৩/৪ হাত মতো পানির দরকার পড়ে।

১০ তারিখ সকালে গভর্নর সমীপে মানচিত্র আর রোজনামচাযোগে হরকরা (Hircar) পাঠাইলাম। রোজনামচায় কুষ্টিয়া খালের যাবতীয় পরিস্থিতি গভর্নর সাহেবকে অবহিত করিয়াছি। আজ সারাদিন ভাল আবহাওয়া। অপরাহ্নে কুষ্টিয়া খালের পূর্বদিক ধরিয়া জরিপ শুরু করিলাম। নদীর গতিমুখ এখন ৮ হইতে ৯ মাইল পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব ও পূর্বমুখি।

১১ তারিখ সকালবেলা পূর্বদিক হইতে আনকোরা দমকা বাতাস, সঙ্গে কড়া বৃষ্টির ঝাট। দিনের মধ্যভাগে আবহাওয়া পরিষ্কার, সন্ধ্যাবেলা শান্ত আর বৃষ্টি বৃষ্টি। আগের মতোই জরিপে ব্যস্ত ছিলাম। ভরা বর্ষায় নদীর প্লাবন হইতে কুল ঠেকাইবার নিমিত্ত বিরাট একটা বাঁধ দেওয়া হইয়াছে। এই বাঁধটি ৫ মাইলের চেয়েও লম্বা; ইহা উচ্চতায় ১২ ফুট আর প্রস্থে ১৪ গজ। এখানে কোন কোন জায়গায় নদী মাত্র ১/৪ মাইল চওড়া।

১২ তারিখ পূর্বাহ্নে ঘন ঘন বাতাস ও বৃষ্টির দমকা ঝড়; দিনের বাদবাকি পরিষ্কার।

আজ পাবনা খালের মাথায় আসিলাম। ইহা বাহির হইয়াছে বড় নদীর [পদ্মা] উত্তর দিক হইতে আর ইহার অবস্থান কুষ্টিয়ার উত্তর-পূর্বে ও পূর্বে ৮ মাইল দূরে। এই খালটি আবার গঙ্গায় মিশিয়াছে রতনগঞ্জ (Rottingunge) গিয়া—ইহার কথা পরে হইবে।

খালের পূর্বে পাড়ে পাবনা গ্রাম, গ্রামটি বড় নদীর অতি ধারেকাছে। এই জায়গায় নৌকাসাম্পান মেরামত আর বানানো হয়।
এখান হইতে ৯ মাইল পর্যন্ত নদীর গতিমুখ দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে। পূর্ব দিকে একটি বাঁধ দেওয়া আছে, বাঁধের দৈর্ঘ্য কয়েক মাইল পর্যন্ত হইবে। বাঁধটা কয়েক জায়গায় ভাঙিয়া গিয়াছে। ইহা হইতে মনে হয় বাঁধ দেওয়ার পর হইতে নদীর বাড় পূর্বতীর ধরিয়া বেশ বাড়িয়াছে, কিন্তু বাঁধটা কতদিন আগে দেওয়া হইয়াছে তাহা জানিতে পারি নাই।

১২ তারিখ হইতে ১৭ তারিখ পর্যন্ত আগে যে মোহনার উল্লেখ করিয়াছি তাহার জরিপ করিয়া কাটাইলাম। দুই তীরের গ্রামাঞ্চলে উল্লেখ করিবার মতন তেমন কিছু নাই—কয়েকটি গ্রাম আছে আর আছে বিস্তর চাষের জমি—বিশেষ পশ্চিম তীরে অনেক জমি—সেই জমিতে ধান বোনে।

এই সময়টা আবহাওয়া খুবই ঝড়ঝাপটাময় ছিল, রোজই দক্ষিণপূর্ব কোণা হইতে ঝড়ো হাওয়া বহিতেছিল আর বৃষ্টিও বেশ হইল।

দক্ষিণ-পূর্ব মুখি দক্ষিণ মোহনার শেষ মাথায় আসিয়া নদী হঠাৎ উত্তর উত্তর-পূর্বমুখি মোড় লইয়াছে আর লইয়া পাঁচ মাইল পর্যন্ত এই পথে চলিতেছে। এই মোহনার পূর্ব তীর ধরিয়াও আর একটি বাঁধ দেওয়া আছে।

১৭ তারিখ আজুদিয়া (Oddygya) আসিলাম। ইহা এই মোহনার পূর্বতীরের গ্রাম বটে। এই পর্যন্ত আসিয়া নদীর খাড়ি দুই খাতে ভাগ হইয়াছে। সর্ব উত্তরের খাতটি শুদ্ধ রবিমৌসুমে নৌ চলাচলের যোগ্য থাকে। যে দ্বীপটি এই দুই খাতের বিচ্ছেদ কায়েম করিয়াছে তাহা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩ ১/২ মাইল হইবে। আর ইহা দেখিতে অবিরাম। আর ইহা ভালোমতো আবাদমহলও বটে।

১৮ তারিখ আনকোরা হাওয়ার ঝাপটা সারাদিন আর নিরন্তর বৃষ্টি। ইহাতে আমরা বাধ্য হইয়া শুইয়া থাকিলাম।

১৯ তারিখ পরিষ্কার আবহাওয়া। নদীর দক্ষিণ খাত জরিপ করিয়া কাটাইলাম।

২০ তারিখ সারাদিন দক্ষিণামতো দিক হইতে আনকোরা হাওয়ার দাপাদাপি কিন্তু আবহাওয়া শুকনা। সকাল নাগাদ দক্ষিণ খাতের জরিপ সমাধান করিলাম আর হাবাসপুরের (Habbaspour) কাছাকাছি বড় নদীতে আসিলাম। এই স্থান হইতে নদী দক্ষিণমুখি পথ লইয়াছে।

২১ তারিখ সকাল পরিষ্কার কিন্তু বিকাল ঝঞ্ঝা ও বৃষ্টিময়। হাবাসপুর হইতে মোহনার শেষ মাথায় একটা বড় খালের মুখানি (inlet) চোখে পড়িল আর বিকাল ইহার মাথা পরখ করিলাম। ইহা সাধারণ হিসাবে চওড়ায় ২৫০ গজ আর গভীরতায় কোনখানেই ১৬ হাতের কম হইবে না। এই খালের ভাঁটি বরাবর ১ মাইলের মধ্যে মৌদাপুর (Maudapur) নামে এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে; গ্রামটি নদীর পশ্চিমতীরে। এই খালের ধারা দক্ষিণ-পূর্বমুখি আর লোকে বলিল ইহাতে সম্বৎসর নৌসাম্পান চলে, সুন্দরবন (Sunderbound) যাওয়ার পথ ইহার উপর দিয়াই।

২২ তারিখ বড় নদীতে আসিলাম কারণ পূর্বদিকে আরো কয়েক মাইল জরিপ করিতে হইবে আর খালের মুখ বরাবর মোহনার মোড় ঘুরিবার মুখে যে বড় দ্বীপটি আছে তাহা আঁকিতে হইবে: ইহা না করিলে নদীর মানচিত্র বড়ই বেখাপ্পা দেখাইবে, খালের মুখানি হইতে পূর্বদিকে ইহার স্রোতধারা কোন পথে আগাইয়াছে তাহার সঠিক ধারণা পাওয়া যাইবে না।

২২, ২৩ ও ২৪ তারিখের কিছুক্ষণ খালের পূর্বদিকে বড় নদীর ৩ মাইল এবং একইভাবে পূর্বতীর ধরিয়া সেই স্থান হইতে পিছন ফিরিয়া সুজানগর (Sujanagare) পর্যন্ত জরিপ করিলাম। ২৩ তারিখ বৈকালে উত্তর-পশ্চিম দিক হইতে আরো এক দফা কড়া ঝড়বৃষ্টি আসিল আর ২৪ তারিখ সকালবেলা আনকোরা দমকা হাওয়া বহিল, দিনের বাদবাকি পরিষ্কার আবহাওয়া। আজ সকালে খালের ভিতর ঢুকিলাম আর ভাঁটি বরাবর আরো এক মাইল জরিপ চালাইলাম। এই জায়গায় খাল বড়ই আকাবাঁকা। আমি ধরিয়া লইতেছি এই সময়টায় পানি ৫ হাত পর্যন্ত বাড়িয়া গিয়াছে, এখন খালের গভীরতা ১৩ হাতের কম নহে।

জুনের ২৪ তারিখ হইতে জুলাইর ৩ তারিখ পর্যন্ত আবহাওয়া চোখে পড়িবার মত পরিষ্কার। এই সময়ে শুদ্ধ কয়েক পশলা হালকা বৃষ্টি হইয়াছে আর বাতাস দক্ষিণপূর্ব দিক হইতে বহিয়াছে মৃদুমন্দ হিল্লোলে। এই সময়ের মধ্যে আমরা ৩০ মাইলেরও বেশি খালের সন্ধান পাইলাম। ইহার স্রোত সাধারণভাবে বলিতে দক্ষিণ-পূর্বমুখি, যদিও গত ২ দিন আমরা দেখিলাম ইহার পথ খুবই আকাবাঁকা, শেষ ৯ মাইলের মধ্যে ইহা ৭ বার মোহনা (Reaches) পরিবর্তন করিয়াছে আর এইটুকু সময়ের ভিতর নাক-বরাবর শুদ্ধ ২ ১/২ মাইল আগাইয়াছে। যে গ্রামদেশের মধ্য দিয়া আমরা চলিয়াছি তাহার চেহারা বহরূপী, কোথাও মাইলের পর মাইল ঘন জঙ্গল আর কখনও বা উন্মুক্ত গ্রামাঞ্চল, যদিও চাষাবাদ সাধারণভাবে বলিতে বিরল। খালপাড়ের ৯ মাইল মতো নিচে সোনাপাড়া (Sunapara) এলাকায় কয়েক বাগান সুপারি (Betal বা Areca) গাছ আর আরো ৭ ১/২ মাইল পর শ্রীরামপুরে একবাড়ি ছোট্ট মন্দির (Pagoda)। পাঁচ মোহনার সঙ্গমস্থলে গঠিত উপদ্বীপে ইহার স্থান। এই খাল কুমির আর কচ্ছপে ভর্তি—আমরা দুই জাতিরই দেখা পাইয়াছি অপর্যাপ্ত সংখ্যায়। কুমিরজাতি সাংঘাতিক লাজুক। কানে সামান্যতম শোর বাজিলেও উঁহারা ডুব মারেন।

গ্রামবাসীরা খালটির নাম রাখিয়াছেন চন্ননা (Chunnunah) আর আমরা শুনিয়াছি আরও চার মাইল ভাঁটিতে ইহা গিয়া পড়িয়াছে কুমার নদে (Comare Creek)। প্রস্তে এই খালটি সবখানেই সমান মাপের, প্রায় ২০০ গজ হইবে; গভীরতায় যথেষ্ট অসমান, কোথাও ৫০ হাত আর কোথাও বা ৬ হাত হইবে।

২৬ ও ২৯ জুন পাটনামুখি দুই বহর লবণের নৌকার সহিত মোলাকাত হইল। একটি সুন্দরবন ও খুলনা (Culna) হইয়া কলিকাতা হইতে আসিতেছে, আরেকটি আসিতেছে বরসিয়া নদ (Burrashee Creek) ধরিয়া জয়নগর (Jaynagore) হইতে। একটি নৌকার বোঝাই ৩৫০০ মণ (প্রায় ১২০ টন) আর পানিতে ইহার দাবা ৪ ১/২ হাত।

২৮ তারিখ পদ্মদহে (Podumdey) দেখিলাম কম্পাসের কাঁটা পূর্বমুখি ০º-৫৪´ পর্যন্ত নড়িয়াছে।

২৯ তারিখ ২ হরকরাযোগে গভর্নর সাহেবের পাঠানো এক প্রস্ত পত্র পাইলাম।

(৩য় কিস্তি সমাপ্ত)

(চলবে)