জেমস রেনেল ও তাঁহার রোজনামচা ১৭৬৪-৬৭

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 22 Nov 2007, 05:50 PM
Updated : 22 Nov 2007, 05:50 PM


জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০)

খ্রিষ্টিয় ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বঙ্গদেশে ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ ফল আজকের বাংলাদেশশুদ্ধ অখিল ভারতবর্ষের পরম দারিদ্র ও দুর্গতি। এই কথা মোটেও অতিশয় নয়। অখিল ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের অভিশাপ প্রায় দুই শত বৎসর বহন করিয়াও আমরা আজও
বুঝিতে পারিতেছি না এই উপনিবেশবাদ বা পরশাসন কী পরিমাণে আমাদের দেশের ক্ষতিসাধন করিয়াছিল।

আমাদিগের ইদানিন্তন শাসক ধনবান শ্রেণী ইহার কারণ জানিবার প্রয়াসও করে না। তাঁহারা পশ্চিমা সাম্রাজ্য শাসকদের সহিত গাঁটছড়া বাধিয়া এই দেশ চালাইতেছেন। ইংরেজ শাসনের পাপ এখন মার্কিন সাম্রাজ্যের তাপে চাপা পড়িতেছে।

দুইশত বর্ষব্যাপী ইংরেজি শাসনপাপের মধ্যে যে দুই চারিটি প্রায়শ্চিত্ত হইয়াছে মেজর জেমস রেনেলের রোজনামচা তাহাদের মধ্যে পড়ে বলিয়া বর্তমান লেখকের ধারণা। কথায় বলে শয়তানকেও তাঁহার প্রাপ্য দিতে হইবে। রেনেলের জরিপকর্ম বাবদ এই প্রাপ্য ইংরেজ ডাকাতদেরও দিতে হইবে।

জেমস রেনেল যে সময় বঙ্গদেশের নদনদী জরিপ কার্যে মন দেন তখন বাংলাদেশে ইংরেজি ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে কিন্তু ইংরেজ-দায়িত্ব প্রবর্তিত হয় নাই। দেশের অবস্থা তখন সম্পূর্ণ অরাজক। পূর্ব ভারত কোম্পানি খাজনা আদায় করিতেছে কিন্তু কোন শাসন ব্যবস্থাই প্রবর্তন করে নাই। কিছুদিন পর চালু হইবে দ্বৈত শাসন-ব্যবস্থা। এতদিন পর্যন্ত যাহা চলিতেছিল তাহা নামে নবাবের শাসন আর কাজে ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা।

১৭৬৪ সনের ৬ মে তারিখে কলিকাতাস্থ দূর্গের অধিনায়ক বা গবর্নর হেনরি ভ্যানশিটার্ট কাপ্তেন জেমস রেনেলকে নদীয়া জেলার উত্তর সীমানাবর্তী জলঙ্গি নদীর মাথা হইতে পূর্বদিকে ঢাকা পর্যন্ত গঙ্গা ও পদ্মার দক্ষিণ তীর তথা অববাহিকাবর্তী নদীনালা জরিপের লক্ষ্যে জরিপকার বা আমিন নিযুক্ত করেন।

এই জরিপের অংশস্বরূপ গবর্নর মহোদয়ের নিযুক্ত গোয়েন্দা কর্মচারি জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালের ৭ই মে তারিখ হইতে তাঁহার রোজনামচা বা দিনলিপি লিখিতে শুরু করেন। সেই দিনলিপি ১৯১০ সাল পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য ছাপা হয় নাই।

১৯১০ সালে কলিকাতাস্থ এশিয়াটিক সমিতি তৎকালীন 'ভারতবর্ষের ভূতাত্ত্বিক জরীপ' নামক সংস্থার সদস্য টি. এইচ. ডি. লা টুশ (T. H. D. La Touche) নামা এক ভদ্রলোকের সম্পাদনা বা মধ্যবর্তিতায় এই দিনলিপি প্রকাশ করে। আমরা সেখান হইতে এই তর্জমা প্রকাশ করিতেছি।

লা টুশ সাহেব জানাইতেছেন ১৭৬৪ সাল হইতে ১৯৬৭ সালের মধ্যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপূত্র নদীর জরিপ চলার সময় পরাধীন বঙ্গদেশের শাসন অধিনায়ক বা গবর্নরদের গোয়েন্দা হিসাবে জেমস রেনেল এই বিবরণী লিখিয়াছিলেন। লা টুশ সম্পাদিত রেনেলের রোজনামচায় তিনটি বড় টুকরা আছে। প্রথম টুকরা ১৭৬৪ সালের মে হইতে ১৭৬৫ সনের মে পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় টুকরার বিস্তার ১৭৬৫ সালের মে হইতে ১৭৬৬ সালের জানুয়ারি। আর তৃতীয় টুকরার প্রসার হইতেছে ১৭৬৬ সনের জানুয়ারি হইতে ১৭৬৭ সনে মার্চ অবধি।

এক্ষণে জেমসের পরিচয় খানিক দেওয়া যাইতে পারে। এই তথ্য আমরা পাইয়াছি খানিক লা টুশের লেখা পরিচয়পত্র হইতে আর খানিকটা 'উয়িকিপিড়িয়া' নামক একটি দাতব্য বিশ্বকোষ হইতে। আমাদের জ্ঞাতসারে জেমস রেনেল জন্মিয়াছিলেন ১৭৪২ সালের ৩ ডিসেম্বর আর প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন ১৮৩০ সালের ২৯ মার্চ। মানে তিনি প্রায় ৮৮ বছর আয়ু পাইয়াছিলেন। বিবরণ মোতাবেক মাত্র ১৪ বছর বয়সে মানে ১৭৫৬ সালে – তিনি নৌবাহিনীর চাকরি লইয়াছিলেন। ১৭৭৭ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৩০ সালে পরলোক গমনের পর হইতে লন্ডন শহরের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে নামক ধর্মস্থানে তিনি শুয়ে আছেন।

১৭৬৪ সালে যখন তাহাকে জরিপকাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন তাঁহার বয়স বড়জোর ২২ বছর। ১৭৬৭ সালে তাঁহাকে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহা আমিন বা সার্ভেয়ার জেনারেল নিয়োগ করা হয়। ১৭৬৪ সাল হইতে ১৭৭৭ – সর্বমোট এই তের বছর – তিনি বঙ্গদেশের ব্রিটিশ জরীপকাজে নিযুক্ত ছিলেন।

রেনেলের বঙ্গীয় জরিপ ও মানচিত্র সম্পর্কে বিশেষ তারিফ শোনা যায়। মহা আমিনের প্রধান কার্যালয় বসিত পূর্ব বাংলার ঢাকা শহরে। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রাম তখনও চলিতেছিল। ইংরেজরা এই সংগ্রামকে ফকির বিদ্রোহ বলিয়া ডাকিতেন। ১৭৭৬ সালে ভূটানের সীমান্ত বরাবর একস্থানে একবার মুক্তিযোদ্ধা ফকির বাহিনীর আক্রমণে পড়িয়া রেনেল সাহেবও গুরুতর আহত হইয়াছিলেন।

এই আঘাত হইতে তিনি কখনও পুরাপুর সারিয়া উঠেন নাই। বলা যায় এই আঘাতের কারণেই অল্পবয়সে অবসর গ্রহণে বাধ্য হইয়াছিলেন তিনি । বলা হইয়াছিল ইহার পর হইতে তিনি আর বঙ্গদেশের "আবহাওয়ার প্রভাব" সহ্য করিতে পারিতেন না। ১৭৭৬ সালের ৫ এপ্রিল তাঁহার মেজর পদে উন্নতি হয়। খ্যাতনামা গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁহাকে বার্ষিক ৬০০ পাউন্ডের ভাতা মন্জুরি প্রদান করিয়াছিলেন।

জীবনের বাকি ৫৩ বছর তিনি লন্ডন শহরেই কাটাইয়াছিলেন। তখন ভারতে ব্রিটিশ শাসনে সহায়তা করিবার নিমিত্ত প্রতিষ্ঠিত "ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস" নামক দপ্তরে কাজ করিতেন জেমস রেনেল। সেই যুগে তাঁহাকে এয়ুরোপের না হইলেও বিলাতের সেরা ভূগোল-বিশারদ বলিয়া গণনা করা হইত।

রেনেলের লেখার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করার যোগ্য বিবেচিত হইয়াছে ১৭৭৯ সালে প্রকাশিত Bengal Atlas বা বঙ্গদেশের মানচিত্র । ১৭৮৩ সনে তিনি 'ভারতবর্ষের খসড়া মানচিত্র' প্রকাশ করেন। ১৮০০ সালে প্রকাশিত হয় Geographical System of Herodotus বা 'এরোদোতসের ভূগোলজগত'। তাঁহার আরেকটি উল্লেখ্য বই Comparative Geography of Western Asia বা 'এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের তুলনাভিত্তিক ভূগোল' ।

শেষ বয়সে জেমস রেনেল সমুদ্রস্রোত বিষয়ে গবেষণা করিয়া আপন খ্যাতির বৃদ্ধি সাধন করেন। তাঁহাকে ওসানোগ্রাফি বা মহাসমুদ্রবিদ্যার পিতা বলিয়াও ডাকিবার রীতি ইংরেজরা চালু করিয়াছিলেন। তাঁহার এন্তেকালান্তে মোতাবেক ১৮৩২ সালে তদীয় কন্যার সম্পাদনায় Curreats of the Aetlantic Ocean বা 'অতলান্তিক মহাসমুদ্রের স্রোতধারা' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৭৮১ সালে তিনি ইংলন্ডের রাজকীয় সমিতির সদস্য মনোনীত হইয়াছিলেন।

দোহাই

১. James Rennell, The Journals of Major James Rennell, First Surveyor-General of India, Written for the information of the Governors of Bengal during his surveys of the Ganges and Brahmaputra rivers 1764 to 1767, edited by T. H. D. La Touche, Geological Survey of India (Calcutta; Asiatic Soceity, 1910).

~~~

আমিন জেমস রেনেল

বিরচিত

শুকনা মৌসুমে গঙ্গানদী হইতে কলিকাতা যাইবার নিকটতম পথ খুঁজিয়া পাইবার লক্ষ্যে জলঙ্গি নদীর মাথা হইতে ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থল পর্যন্ত গঙ্গার; লক্ষীপুর হইতে ঢাকা পর্যন্ত মেঘনা ও অন্যান্য নদীর; এবং দক্ষিণ তীরবর্তী নদীনালার জরিপকার্যের বিবরণী সংযুক্ত

রোজনামচা

সন ১৭৬৪-১৭৬৭

তজর্মা : সলিমুল্লাহ খান

শুকনা মৌসুমে গঙ্গানদী হইতে কলিকাতা যাইবার ঘনিষ্টতম পথ আবিষ্কারের লক্ষ্যে পরিচালিত পহিলা অভিযাত্রার রোজনামচা।
উয়িলিয়াম দূর্গের শাসক মহাত্মা হেনরি ভানশিটার্ট মহোদয় প্রদত্ত আদেশের নকল।

~

উয়িলাম দূর্গ, ৬ মে ১৭৬৪

মহাশয়,
আপনাকে নিয়োগ দেওয়া হইতেছে সর্বপ্রথমে মহানদীর (গঙ্গার) যে অংশ জলঙ্গির পূর্বদিকে অবস্থিত তাহার জরিপকার্য সমাধা করিবার উদ্দেশ্যে; আর এই জরিপকার্যের বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ করিতে আপনাকে মহানদী হইতে খাড়ির খাল বা রাঙ্গাফুল পর্যন্ত হ্রস্বতম ও সর্বাধিক নিরাপদ পথটি খুঁজিয়া পাইতেই হইবে।

এই উদ্দেশ্যে আপনি মহানদীর দক্ষিণ ধার ধরিয়া চলিবেন আর দক্ষিণমুখি বাহির হইয়াছে এমন নদী বা নালার (Nulla) প্রত্যেকটি পরখ করিবেন, দেখিবেন এইসব নদী নালা দিয়া তিনশত মণ পর্যন্ত ভারবাহী নৌকা আসাযাওয়া করিতে পারে কিনা আর স্থানীয় লোকজন মারফত খবর লইবেন এইসব নদীনালা দিয়া সম্বৎসর যাতায়াত করা যায় কিনা; আর নদীতীরের চেহারা আর খাড়াই দেখিয়া এই বিষয়ের অবস্থা সম্বন্ধে আপনি নিজেই গ্রহণযোগ্য মতামত দিতে পারিবেন।

আপনি একটি রোজনামচা লিখিবেন যাহাতে আপনার কাজের বিবরণ খুঁটিনাটিশুদ্ধ লিপিবদ্ধ করিবেন, তাহাতে আপনি যে যে দেশগ্রামের পথঘাট পার হইতেছেন তাহা দেখিতে-টেখিতে কেমন আর তাহাতে কী কী ফসল ফলে তাহার কথাও লিখিবেন; তাহাতে কিন্তু দেশগ্রামের নামধামশুদ্ধ আর আর যাহা যাহা উল্লেখ করিবার যোগ্য তাহারও উল্লেখ করিবেন। নদী ও নালার যে খসড়া [চিত্র] আপনি প্রস্তুত করিবেন তাহার সঙ্গে এই রোজনামচার এক প্রস্থ নকলও আমাকে দিবেন।

নিবেদন ইতি
আপনারই একান্ত বাধ্য সেবক
বিনীত
হেনরি ভ্যানশিটার্ট।

~

সোমবার ৭ই মে। একটি ছোট বজরা, সঙ্গে লোকজন ও অন্যান্য জিনিশ বহন করিবার মতন ৫টি ছোট উয়িলক সমভিব্যহারে জলঙ্গির পথ ধরিয়া অগ্রসর হইব বলিয়া কলিকাতা হইতে যাত্রা করিলাম।

লোকজনের হিসাব নিচে লিখিতেছি:

সহকারী আমিন ১ জন
অন্যান্য এয়ুরোপীয় সাহেব ১ জন
লস্কর ১১ জন
মোটিয়া ১১ জন
অনুবাদক ১ জন
আমাকে শুদ্ধ ধরিয়া মোট ৩৯ জন

বেলা ৩ ঘটিকার সময় আমরা নতুন দূর্গ হইতে নৌকা ছাড়িলাম, তবে আজ রাত্রে জোয়ার অনুকূল না থাকায় আমাদের উজানে যাওয়া ব্যাহত হইয়াছে। তাই আমরা কলিকাতা পর্যন্ত আসিলাম। আজ সারাদিন আবহাওয়া চমৎকার।

৮ তারিখ রাত্রি ১ ঘটিকা। আওয়াজ পাইলাম বজরা ডুবিতেছে । আমার ঘুম ভাঙিল, দেখিলাম সত্য সত্যই ইহা ডুবিবার উপক্রম হইয়াছে, দুই তৃতীয়াংশ পানিতে ভরিয়া গিয়াছে। এই দুর্ঘটনার ফলে আমার নিত্য ব্যবহার্য জিনিশপত্রের বেশির ভাগই নষ্ট হইয়া গেল, আমার কাপড়চোপড়ের সিংহভাগেরও একই দশা ঘটিল। আজ কলিকাতায় কাটাইয়া ছিদ্রটা সারাইলাম। সাঁঝের বেলা নদীপথে উজানে যাত্রা করিলাম, আর রাত্রের মতো শ্রীরামপুরে আসিয়া নৌকা ভিড়াইলাম, আজ বিকালে উত্তর পশ্চিম দিক হইতে চোখা চোখা দমকা হাওয়া বহিতেছিল।

৯ তারিখ পরিষ্কার আবহাওয়া। সকাল আটটায় গিরিটির শোভা দেখিব বলিয়া বাহির হইলাম। চন্দননগরে বৃষ্টি হইল, আর দূর্গের ধ্বংসাবশেষ ও শহর দেখিব বলিয়া বাহির হইলাম। বৈকাল ৪ ঘটিকার সময় চিনসুরা অতিক্রম করিয়া রাত্রি নাগাদ বাঁশবাড়িয়া খালে প্রবেশ করিলাম। এই খালের পানি এক্ষণে ভরা জোয়ারে ৫ হাত গভীর হয়। কাপ্তেন পলিয়রের মানচিত্রে এই নদীর বিবরণ বেশ ফলাও করিয়া দেওয়া হইয়াছে বলিয়াই মনে হয়। রাত্রি পরিষ্কার। দক্ষিণ পশ্চিম দিক হইতে নবীন হাওয়া বাহিতেছে।

১০ তারিখ, আবহাওয়া রকমারি। বেতোয়ালেরা নালা অতিক্রম করিলাম। প্রস্থে বাঁশবাড়িয়া যতখানি চওড়া ইহাও মনে হইতেছে ততখানিই চওড়া। বিকাল ৪ ঘটিকায় যথন আমরা বেতোয়ালেরার মুখে অবস্থান করিতেছি, তখন দক্ষিণ দিক হইতে চোখা একটা দমকা হাওয়া দিল। বজরায় আর একটা ফুটা বাহির হইল। অদ্য দিবাগত রজনী বিরমপুরে কাটাইলাম।

১১ তারিখ আবহাওয়া দিনের বেশির ভাগ জুড়িয়াই ভালো, শুদ্ধ একবারই দক্ষিণ দিক হইতে সামান্য ঝড়ো হাওয়া দিয়াছিল। আজ (মধ্যাহ্নের) পূর্ব নাগাদ আম্বোয়া অতিক্রম করিলাম। জায়গাটা নদীর দক্ষিণ দিকে কুচোয়া হইতে খুলনা যাওয়ার রাস্তার মাঝামাঝি অবস্থিত। বাংলার পুরানা মানচিত্রাদির কোন কোনটিতে এই জায়গাটার উল্লেখ দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান করিতেছি একদা ইহা বধির্ষ্ণু গ্রাম ছিল, না থাকিয়া পারে না। যাহাই হউক, বর্তমানে এই জায়গায় শুদ্ধ কয়েকটি পর্ণকুঠির বৈ কোন ঘরবাড়ি নই। আজ রাতে বেলডাঙ্গায় ঘুমাইলাম।

১২ তারিখ সারাদিন ভালো আবহাওয়া, সন্ধ্যা গাঢ়, ভয়াল। সকাল ৮টায় জলঙ্গি নদীতে ঢুকিলাম। কাসিমবাজার নদী যেখানে জলঙ্গির সহিত মিলিয়াছে সেখানে নদী মনে হইতেছে খুব সরু হইয়া গিয়াছে: আমার ধারণা বর্তমান মৌসুমে ইহা কিছুতেই চওড়ায় ৫০ গজের অধিক হইবে না। লোকের মুখে জানিতে পারিলাম এখন এই পথ দিয়া মাঝারি আকারের নৌকা চলাচল করিতে পারে।

সন্ধ্যায় হাউতনগরে একটা জায়গায় মাপজোক করিলাম আর দেখিলাম এখন (জলঙ্গী) নদীর চওড়াই ১৫০ গজ আর বর্ষায় ২৭০ গজ হয়। সেখানে নদী সবচেয়ে বেশি গভীর সেখানে গভীরতা ১৩ ফুট হয়। তীর দেখিয়া মনে হয় বৃষ্টি হইলে পানি আরও ১৩ ফুট উপরে উঠিবে।

১৩ তারিখ সারাদিন ভারি সুন্দর আবহাওয়া। দক্ষিনা হাওয়া। নদীর গভীরতা খুব কমিয়া গিয়াছে, আর এমন আকাবাঁকা হইয়াছে যে যদিও আমরা নদীপথে ২২ মাইল পার হইয়াছি তথাপি নাক বরাবর ১০ মাইলও আসিয়াছি কি না সন্দেহ। অদ্য রাত্রি তিগারি বা নেগারিনে কাটাইলাম। সূর্যাস্তের সময় (কম্পাসের) কাঁটার নড়াচড়া চওড়ায় বাড়িয়া পূর্বমুখি ৩˚-৩ʹ মতো হইয়াছে।

১৪ তারিখ পূর্বাহ্ন পরিষ্কার; বৈকালে পশ্চিম দিক হইতে বৃষ্টি, বজ্র ও বিদ্যুতসহ ভারি দমকা বাতাস হইল। আবহাওয়া খারাপ বলিয়া অদ্য দিবাভাগে আমরা শুদ্ধ ১৬ মাইল আগাইয়াছি। আজ রাতটা আমরা যেখানে কাটাইতেছি সেই নটিডাঙ্গায় নদী মাত্র ২ হাত গভীর।

১৫ তারিখ আবহাওয়া ভারি দমকা হাওয়াময়, আর বৃষ্টিও ভারি। ইহার কারণে, আর নদীর পানি অগভীর ও আকাবাকাঁ হইবার ফলেও, আমরা পথে পিছাইয়া থাকিতেছি। কোন কোন জায়গায় নদী এমনকি ৫ গজও চওড়া নয়। পাঁচদাদায় নদীর চওড়াইর আর গভীরতার মাপ লইলাম । আর একইভাবে নদীতীরের খাড়াইও মাপিলাম, চওড়াই এখন ২০০ গজ; গভীরতা কোথাও ৫ হাতের বেশি নয়। তীর বরাবর বৃষ্টির পর নদী আরো ২৬ ফুট উঠিবে। এই মাপ আর আগে (মানে ১২ তারিখে) হাউতনগরে যে মাপজোক লইয়াছিলাম তাহার জোরে মনে হইতেছে এই নদী বড় নদীর (গঙ্গা) কাছাকাছি স্থানে অনেক বেশি ফাপিয়া উঠে, দূরে গেলে কতখানি ফাপে না আর গোটা ৪১ মাইল দূরে গেলে এই পার্থক্য ১২ কি ১৩ ফুট পর্যন্ত হইয়া থাকে।

আজ সন্ধ্যা গাওঘাটিতে নোঙর করিলাম, সারাদিনে মাত্র ১০ মাইল পথ আগাইয়া আসিয়াছি। এই জায়গায় নদীবক্ষের মধ্যস্থলে ১৯ টি বড় বড় লবণভর্তি নৌকা ডুবিয়া গিয়াছে। আজ রাত্রে কিছু বৃষ্টি হইয়াছে।

১৬ তারিখ সকালবেলার আবহাওয়া সাফ আছে। বিকাল ও সন্ধ্যা ভেজা আর হাওয়া ঝোড়ো। আজ সকালবেলা বকসিপুরের খাড়ি পার হইতে আমাদের অনেক বেগ পাইতে হইয়াছে, উখানে এখন মাত্র ১ ১/২ হাত পানি। ইহাতে মনে হইতেছে এই জায়গায় শুকনা মৌসুমে নদী নিশ্চয়ই একেবারে শুকাইয়া যায়। কারণ আমরা শুনিয়াছি বৃষ্টি হইবার পর নদীর পানি ১ ১/২ হাত বাড়িয়াছে।

দুপুরে ভিখারিগঞ্জ (Vheckery-Gunge) পার হইলাম। এই জায়গায় ৯ কি ১০টা লবণের নৌকা ডুবিয়াছে। অদ্য দিনের বেলা মাত্র ১০ মাইল আগাইয়া রাত্রিতে জগিপুরে নৌকা ভিড়াইলাম। নদী এই জায়গায় ৪ হাত গভীর। আজ রাত্রে বেশ বৃষ্টি।

১৭ তারিখ আবহাওয়া পরিষ্কার। আজ দিনের বেলা ১১১/২ মাইল চলিলাম, কিন্তু নদী এমন আকাবাঁকা যে আমরা নাক বরাবর মাত্র ৬ মাইল গিয়াছি। এইস্থলে দেশগ্রাম খোলামেলা আর অতীব নয়নসুখকর। আজ রাতটা কাটাইলাম স্বস্তিয়াপুরের কাছে ছোট্ট একটি নালায়। চমৎকার রাত্রি।

১৮ তারিখ বেশির ভাগই চমৎকার আবহাওয়া, দখিনা হাওয়া। সকালবেলা আমার (বাজার) সরকারকে পাশের জলঙ্গি গ্রামে পাঠাইলাম, উদ্দেশ্য আমার আগমনের বিনিময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা। অদ্য দিবাভাগে মাত্র ১১ মাইল আগাইয়াছি, কারণ নদী এই স্থলে আগের তুলনায় প্রশস্থতর ও গভীরতর হইলেও কি হইবে, পানি অতি জোরে প্রবাহিত হইতেছে। আজ রাতটা কাটাইলাম জলঙ্গির ৬ মাইল ভাঁটিতে, ধুলমপুরের কাছে। আবহাওয়া পরিষ্কার।

১৯ তারিখ সারাদিন আবহাওয়া পরিস্কার, দক্ষিণ দিক হইতে তাজা বাতাসের দোলা থাকিয়া থাকিয়া হাওয়া দিতেছে। জলঙ্গির মাথা হইতে ৩ মাইল ভাঁটিতে দেখিলাম পানির গভীরতা এতই কম যে বজরার পানিভাসা থাকিতে হইল বড়ই কষ্টেসৃষ্টে। এই অবস্থা প্রায় পোয়া মাইল পর্যন্ত চলিল।

মধ্যাহ্ন হইবার আগেই আমরা মহা গঙ্গানদীতে আসিলাম আর দুপুর একটা নাগাদ জলঙ্গি আসিয়া পৌঁছিলাম।

আমি যে বজরায় চড়িয়া আসিয়াছি তাহা ছিল কলিকাতায় যে সকল বজরা পাওয়া যাইতেছিল তাহাদের মধ্যে সবার চেয়ে ছোট। তাই কলিকাতা ছাড়িবার আগে গভর্নর সাহেব আমাকে জানাইয়াছিলেন জলঙ্গি বরাবর আসিয়া আমার ব্যবহারের জন্য যতগুলি 'উয়িলক' আমার দরকার হইবে ঠিক ততগুলি 'উয়িলক'সহ সুবিধাযুক্ত একটি বজরা আমার অপেক্ষায় থাকিবে, যেন যে মৌসুমে নদীর পানি বড়ই নিচে নামিয়া যায় সে মৌসুমেও জলঙ্গি নদী ধরিয়া যত রকমের অভিযান পরিচালনা সম্ভব তত অভিযান পরিচালনা করিবার কাজে এই সকল যান আমি ব্যবহার করিতে পারি।

কিন্তু জলঙ্গি পৌঁছিয়া দেখিলাম সেখানে কিছুই নাই, না বজরা না উয়িলক কিছুই নাই। সেখানকার লোকজন আমাকে বলিল যে কাপ্তেন উয়িডারবর্ণ (যিনি সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত অভিযানে গিয়াছেন) হাতের কাছে যাহা পাওয়া যায় তাহা লইব বলিয়া সমস্ত নৌকা ধরিয়া লইয়া গিয়াছেন আর সেই নৌবহরের মধ্যে একটি বজরাও রহিয়াছে; কিন্তু সেই বজরাটিই আমার জন্য ধরা ছিল কিনা এখনও পর্যন্ত সঠিক সংবাদ যোগাড় করিতে পানি নাই। যে বজরায় চড়িয়া আমি আসিয়াছি তাহা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে আমি যে কাজ করিতে আসিয়াছি সে কাজ সম্পন্ন করার উপযুক্ত মোটেও নহে; ইহাতে সন্দেহ নাই । বজরাটা ছোট আকারের ও ফুটায়ফাটায় ভরা এই দুই কারণেই।

দেখিলাম নষ্ট করিবার মতন কোন সময়ই আমার হাতে নাই। কারণ নদীর পানি দিনকে দিন বাড়িতেছে। তাই আমি আমার জরিপদলের ব্যবহারোপযোগী কিছু উৎকৃষ্ট উয়িলক সংগ্রহে ব্যস্ত হইয়া পড়ি, কিন্তু তেমন সফল হইতে পারি নাই। কারণ যে তিন দিন আমি ঐখানটায় ছিলাম সেই তিনদিনে আমি শুদ্ধ ২টি উয়িলক যোগাড় করিতে পারিলাম; এইগুলির একেকটি ২০০ মণ পর্যন্ত বোঝা লইতে পারে; তাহা ছাড়া আমি কলিকাতা হইতে আনা ৩টা উয়িলক সঙ্গে রাখিলাম আর ২টা কলিকাতায় ফেরত পাঠাইলাম।

২০ তারিখ সারাদিন আবহাওয়া ভাল ছিল; ২১ তারিখ পূর্বাহ্নও একই রকম কাটিল, তবে বিকালবেলা দক্ষিণপূর্ব দিক হইতে একটা তাজা ঝাপটা বহিয়া গেল, মাঝে মাঝে ভারি দমকা হাওয়া দিতেছিল। কিন্তু বৃষ্টি নামে নাই। আজ গভর্নর সাহেব বরাবর পত্র লিখিলাম, এই পর্যন্ত আমি যতদূর আসিয়াছি তাহার বিবরণী পাঠাইলাম, আর সঙ্গে জুড়িয়া দিলাম জলঙ্গী নদীর অংশবিশেষের নকল।