কান্তজীর মন্দির, রাম সাগরের জল!

মোস্তফা মহসীন
Published : 18 Sept 2021, 10:16 AM
Updated : 18 Sept 2021, 10:16 AM


নয় ঘন্টার দীর্ঘপথ। বেয়াড়া ধুলো কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে এসে যখন হানা দিচ্ছে জানালা দিয়ে তখন বিমানের মতোই যেন শহর,জনপদ অতিক্রম করে ছুটছে তো ছুটছেই হানিফ পরিবহনের দূরপাল্লার বাস। জানালার পাশে সিট। কানে এয়ারফোন। ভ্যাপসা গরমে শরীর কাহিল হলেও ঘামে ভিজেনা।তবে মাঝে মাঝে ধুলোবালির তরঙ্গ থেকে ওঠে আসা ঝাপটাটা প্রশান্তির খোরাক রচনা করে বৈ কি।

দেখলাম, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আসার পর একটি পথ ভাগ হয়ে ডানদিকে চলে যায়। সম্ভবত ওই পথটাই রংপুরের দিকে গেছে। ঢলে পড়ো সূর্যটার দিকে তাকাতে তাকাতে অনেক দোকান-পাট আর মানুষের হল্লা,মনে করিয়ে দিচ্ছে এখানে ব্যবসাটা সত্যি রমরমা। মরিচ-ভুট্টার জন্য বিশেষায়িত গাইবান্ধার রসমঞ্জরির স্বাদটাও পুনরায় চেখে দেখার লোভ হয়! কিন্তু জানিনা, আজকাল ইন্দ্রিয় সংযত রাখার কৌশল পদ্ধতির সাথে কিভাবে যে স্বতঃস্ফূর্ত সংযোগ ঘটেছে! গন্তব্য তাই উত্তরবঙ্গের সুনসান নীরবতার শহর দিনাজপুর।

ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে দিনাজপুর পৌঁছাতে পৌছাতে দুটো বাংলা ছবিতে আঁখিপাত যেমন হলো তেমনি কয়েকটি হারানো দিনের জনপ্রিয় বাংলা গানের শ্রবণও সমাপ্ত হয়ে গেল । জানি,দিনাজপুর বিখ্যাত তার সুগন্ধি আতপ চালের জন্য। আছে কাটারী ভোগ চাল। দিনাজপুরের চায়না ৩ লিচু সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত তার স্বাদের জন্য। চিড়া এবং খইয়েরও খুব সুনাম ওই অঞ্চলের। আছে মসুর ডালের সুস্বাদু পাঁপড়। পিঠা পুলির মধ্যে আছে নুনিয়া পিঠা, গুড়্গুড়ি পিঠা অনেকে একে কুকুর ঢেলাও বলে থাকে। আর আছে শিদল। কচু, পুটি মাছ আর নানা শাক পাতা মিশিয়ে গাঁজন পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই শিদল।
চারদিকে সবুজের আবহ। গলিতে গলিতে ধূপ-ধোনার গন্ধ। কোথাও কামিনী, কোথাও বা বেলি আবার কোথাও সন্ধ্যা মালতী । মিষ্টি সুগন্ধে ভরপুর চারিধার। প্রতিটি বাড়ির গেট থেকে ফুলের টবে ছাওয়া। এমনকি বাড়িতে ঢোকার সদর দরজাটিও মনে হচ্ছে সবুজের দখলে! পলকা বাতাসে শরীর যেমন জুড়োচ্ছে, বৃষ্টিও নামি নামি করছে। এরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি মুহূর্তে, শহরের কালীতলায় বহুকাল বাদে অ্যাডভোকেট দিলারার সাথে দেখা। রিমেম্বার মেশিন ঘেটে ল কলেজ জীবনের নানা রঙের স্মৃতি হাতড়ায় দিলারা। ড্রয়িংরুমের বুকশেলফ, দেওয়াল, আলো, শৌখিন উপকরণ সবকিছু নিরীক্ষণে ফুঁটে ওঠেছে গৃহকর্তার রুচি ও সৃজনশীলতা। ইতোমধ্যে বৈঠকখানায় প্রবেশ করেছেন দিনাজপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য,দিলারার বাবা আমার অতীব শ্রদ্ধাভাজন অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম সাহেব। নানা বিষয়ে খোশগল্প জমে ওঠে। চা পর্ব শেষে মামলার নথিপত্র গুছাতে গুছাতে, আমাদের সাথে প্রাণ-রসে মেতে ওঠেন তাঁর আইনজীবী সহকারী রাধা গোবিন্দ রায়ও।

শেষে দিনাজপুর প্রসঙ্গ আসতেই, সিনিয়র এই আইনজীবী তাঁর বিদ্যে বোঝাই চৌকস মাথা দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যান দিনাজপুরের সুদূর অতীতের গর্বিত ইতিহাসের চুম্বক অংশে। টগবগে ঘোড়ার মতো আমরাও ছুটতে থাকি ইতিহাসের মসৃণ পথ ধরে…

তিনি বলেন, পলাশী প্রান্তরে বাংলা-র স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর ৮ বছর পর দিনাজপুর জয় করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। তখন ওখানে ছিল ঘোড়াঘাট নগরী। ঘোড়াঘাট দূর্গ দখলে নেয়ার মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ওই সরকার এবং নগরটিরও পতন ঘটায়। তবে ভিনদেশী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রাজ্যারম্ভের সূচনায় ওই অঞ্চলের রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, উনার নাম'দিনারাজ' থেকে সৃষ্টি করে দিনাজপুর জেলা। বর্তমান দিনাজপুর জেলা পূর্বের সেই দিনাজপুর রাজ্যের সামান্য এক খন্ডাংশ মাত্র। আদি সেই দিনাজপুর এর বৃহৎ একটি অংশ, আমাদের থেকে বেহাত হয়ে চলে গিয়েছে বর্তমান ভারত এর পশ্চিম বঙ্গ ও বিহার রাজ্যে ।

কোম্পানী সরকার কর্তৃক উত্তরবঙ্গ শাসনের জন্য যে বৃহৎ স্থায়ী জেলার কথা আমলে নেয়া হয়; তার জেলা শহর স্থাপিত হয় পূণর্ভবা নদী তীরে দিনাজপুর নামক মৌজায়। কোম্পানী শাসন অবসানের পর ব্রিটিশরাজ আমলেও একই মৌজায় স্থায়ী জেলা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে দিনাজপুর শহর । দিনাজপুরে জেলা স্থাপিত হওয়ার প্রায় শতাধিক বছর পরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় দিনাজপুর পৌরসভা। বর্তমান দিনাজপুর জেলা অস্তিত্বে আসে প্রাচীন দিনাজপুর রাজ্যের কয়েক দফা বিভাজনের মাধ্যমে। এর মাঝে সর্বশেষ ১০০ বছরে দিনাজপুর বিভাজিত হয় ৩ বার। বিষ্ময়কর বটে!
১৯৪৭ সালে দেশভাগ এর সময়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিভাজিত হয় দিনাজপুর । তখন দিনাজপুরের কেন্দ্র তথা মূল অঞ্চলটি বাংলাদেশে পড়ে। ভারতের অংশটি পশ্চিম দিনাজপুর নামে পরিচিত হয়, যা পরে আবার ভেঙ্গে উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুর নামে পৃথক ২টি জেলা গঠিত হয়েছে । আর বাংলাদেশের অংশটি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা ।১৯৮৪ সালে ভেঙ্গে দিনাজপুর , ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় নামে ৩ টি জেলা গঠন করা হয় এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের কিয়দংশ রংপুর ও নীলফামারী জেলার অন্তর্গত হয় ।

দিনাজপুর জেলার বর্তমান আয়তন ৩৪৩৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে পূর্বে এই অঞ্চল আয়তনে ছিল সুবিশাল । পাল রাজবংশের চরম উন্নতির সময়ে দিনাজপুর রাজ্য বর্তমান রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ এর অধিকাংশ অঞ্চল এবং ভারত এর পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের একটি বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিলো। ভারত এর বিহার রাজ্যের সামান্য একটি অংশও এই সুবিশাল দিনাজপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিলাম উত্তরবঙ্গের একটি জেলার ইতিহাস কথন। যখন শেষ হলো তখন এক গম্ভীর থমথমে গুরুগাম্ভীর্য। দিলারা লাস্যময়ী। প্রশংসার নিরিখে বললে গানের গলাও জবাবহীন, সংগীতের তালিম নিয়েছিল নিমতলায় অবস্থিত দিনাজপুর সংগীত কলেজে। সে সুরেলা গলায় গান ধরে-মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে/ নি্ঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসংগীতে/রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম…

গান শুনতে শুনতেই তৃপ্তির জোয়ারে রাত হচ্ছে বাড়-বাড়ন্ত। বাইরে কুকুরগুলো সমস্বরে ডাকছিলো, উচ্চস্বরে তিনবার ডাকার পর কে যেন তাদের থামিয়ে দিল।

কর্তা আহার পর্ব সারতে মেহগনি রাঙা ডাইনিং টেবিলে ডেকে নিয়ে গেলেন। খাবার ঘরটি বেশ প্রশস্থই বলা যায়,একপাশে সেগুন কাঠের দেরাজ।টেবিলে লাল বর্ডারের সাদা চিনেমাটির প্লেট,লতাপাতায় ডিজাইন করা আগেকার দিনের গ্লাস। সঙ্গে হ্যাঙ্গিং ল্যাম্প শেডে ইস্তেটিক টাচ;সাবেক বনেদিয়ানার চিত্রকে সম্মুখে মেলে ধরলো। প্রথম দফায় কাটারি চালের ভাতের সুঘ্রান আর গরুর ভুনা মাংসের ম্যাজিকে নয়ন পরিতৃপ্ত হলে, আরোও ভালোলাগা বাড়িয়ে দেয় একটি হাফ প্লেটে সাঁজিয়ে রাখা পেঁয়াজের সালাদ। বাহ্ বলে পাঁচকের প্রশংসা করতে না করতেই যেন ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে টেবিলে এসে হাজির হল এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহি আলুর ডাল-ডিম; তৎসঙ্গে পোলাউ চাল,বুট এবং সুগন্ধি মসলার সমন্বয়ে তৈরি বুট-বিরিয়ানিও ! স্বাদ নিয়ে মনে হল এ যেন বহুদিন পর কাঙ্ক্ষিত অধরাকে ধরতে পারা! মেহমানদারির বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার ভেতর তলিয়ে ভাবছিলাম, বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কী হতে পারে? ঘনবসতির সাথে এখানে প্রতি ১০ কিলোমিটার পরপর কথ্য ভাষা, সংস্কৃতি,খাদ্যাভাসের রীতিমতো পরিবর্তন হয়ে যাওয়া!

কালীতলায় রিকসা খুঁজে হয়রান হতে হতে টংঘরে এসে চা খেলাম। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উত্তরবঙ্গের জনা কয়েক সহজ-সরল মানুষের দিকে তাকাই! প্লাস্টিকের চেয়ারটি এগিয়ে দিতে দিতে একজন মায়াময় ইশারায় বসতে বললেন,যেন ঢাকা থেকে কোনো বড় বাবু আজ তার শহরে গিয়েছে বেড়াতে!

অধিক রাতে হোটেলে ফিরে,একটু বেলা করে ঘুম ভেঙ্গেছে মালদাহপট্টির ইউনিক রেসিডেন্সিয়াল হোটেলে। শরীরে চনমনে আমেজ। প্রাকৃতিকভাবে বাতাসের দুর্গন্ধ দূর করে এয়ার ফ্রেশনার যেমন চমৎকার আমেজ ছড়িয়েছে তেমনি সীমিত আওয়াজে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শোনার ব্যবস্থাটাও মন্দ না।মনে হল বাহ্,অফিস ট্যুরে এসেও সময়টা কাটছে চোখের আরাম আর মনের আনন্দে!একটু পরেই আমাকে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যেতে হবে, দিনাজপুর জেলা জজ আদালতে। জানিয়ে রাখি, এই নিয়ে কোম্পানির কাজেই অন্তত বেশ কয়েকবার এই জেলা শহরটিতে আমার সফল পদার্পন ঘটেছে। যতোবার শহরটিতে আসি প্রতিবারই নতুন কিছু আবিস্কার! আচ্ছন্ন করে মোহের ব্যারিকেড ভেঙ্গে মুগ্ধতার মন ভোলানো বিভ্রমও!


মুন্সীপাড়া, নিমতলা, গনেশতলা, ক্ষেত্রীপাড়া, কাঁয়াপট্টি, বাসুনিয়াপট্টি কিছুটা ব্যবসায়িক আবার কিছুটা আবাসিক । পশ্চিম দিকে আরোও একটু হেলান দিলেই নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ষষ্ঠীতলা, বালুয়াডাঙ্গা, ঘাসিপাড়া, চাউলিয়াপট্টি এবং পূর্বদিকে রিকশায় বা ইজি বাইকে চড়তে চড়তে এগিয়ে গেলে দেখবেন বালুবাড়ী মহল্লার ঘনবসতি। ষষ্ঠীতলা, ঘাসিপাড়া, কালীতলা, বড়বন্দর, বালুবাড়ী। বড় মাঠের পশ্চিমে মিশন রোড ।রাস্তাগুলো জীর্ণ কোথাওবা ভাঙ্গাচোরা তবে দৃশ্যকল্পের মাদকতায় একেবারে নির্ভেজাল।

দিনাজপুর শহরের মালদাহপট্টি এলাকা…শত বছরের পুরনো দালানের পাশে বহুতল অট্টালিকা থাকলেও এখানেই যে কয়েকটি। স্ট্রীট ফুড-রেস্তরাঁয় লোকজনের ভিড়। দেশের অন্য জেলা সদরের মতো এ শহরে আলিশান দালানের সাড়ম্বর প্রকাশ নেই; এর পরিবর্তে আছে পুরনো আমলের ঘরবাড়িকে অবিকৃত রেখে বাংলার ঐতিহ্যটা ধরে রাখার প্রচেষ্ঠা।

বিয়ে, গায়ে হলুদ, বাদ্য-বাজনা, উলুধ্বনি, রান্না ও অতিথি আপ্যায়নসহ হিন্দু শাস্ত্রমতে সব আয়োজনই ছিল। তবে বর-বধূ ছিল বৃক্ষ। মহাধুমধামে বৃক্ষের এমন বিয়ে ঘটেছে বড়কালী মন্দিরের সামনে। জমজমাট এই বিয়ের আয়োজনে মন্দির প্রাঙ্গণ ভক্ত-পূণ্যার্থীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।

শাড়ী পড়ে টোপর মাথায় দিয়ে বউ বটেশ্বরী ও ধুতি-পাঞ্জাবী পড়ে টোপর মাথায় দিয়ে বর পাকুড়। বিয়ে সন্ধ্যায়, তার আগেই হিন্দু শাস্ত্রমতে বাদ্য-বাজনা, সনাতন আচার পালন, বরযাত্রীর আগমণ ও অতিথি আপ্যায়ন সবকিছুই পালন করা হয়েছে নিয়ম মেনে। বিষয়টি ছিল গল্পের মত। জেলা জজ আদালতে লোকমুখে শুনে অদ্ভুত এ কান্ডটি সরেজমিনে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারিনি! দ্রুতবেগে ছুটলাম জেলা শহরের ৫ কিলোমিটার পূর্বে দিঘন বড়কালী মন্দিরে । এই বিয়ের আয়োজন করেছে দিঘন ও গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দারা। তারা নিজেরাই চাঁদা তুলে এই বিয়ের খরচ যুগিয়েছে। সন্ধ্যায় বিয়ে হলেও এই বিয়ে ঘিরে এলাকায় ছিল ব্যাপক চাঞ্চল্য। আর তাই দুপুরের আগেই মন্দির প্রাঙ্গণ ভরে উঠে মানুষের পদাচারনায়। সেখানে অনেকেই জানালেন, বট ও পাকুরের বিয়ে মানেই মঙ্গল আগমন। আর তাই অতি আগ্রহে এবং মঙ্গল কামনায় এই বিয়েতে এসেছেন।

অতঃপর পরের দিন প্রশান্তির বৃষ্টিটা নামল। মাতাল বেগে ভিজিয়ে দিতে লাগলো শহীদুল সাহেব এবং আমাকে। সইবে না জেনে চালকের আসন থেকে নেমে কোনোমতে বাইকটিকে ব্যালেন্স করে একটি দোকানে ভেতরে সেঁধিয়ে পড়লেন শহীদুল সাহেব । ইতিউতি তাকাতেই দেখলেন, তার আগেই নিরাপদ সুরক্ষা বলয়ে ঢুঁকে পড়েছি আমি। শহীদুল সাহেব ডেপুটি ম্যানেজার এবং আমার অফিস কলিগ। বাইকে চড়ে আমরা রওয়ানা দিয়েছি,কান্তজীর মন্দির পরিদর্শনে।

কান্তজীর মন্দির শ্রীকৃষ্ণের জন্য নিবেদিত। কালিয়াকান্ত জীউ অর্থাৎ শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপনের জন্যই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে কান্তজীউ, কান্তজী বা কান্তজীর। মন্দিরটির সুবাদে এলাকাটি কান্তনগর নামে পরিচিতি পায়। সেজন্য পরবর্তী সময়ে এর আরেক নাম হয়ে যায় কান্তনগরের মন্দির।

অভাবনীয় নির্মাণশৈলী চোখকে তৃপ্ত করে। জানলাম, নির্মাণকালে মন্দিরটির চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। তিনতলায় নির্মিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন। তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো সারাদেহে বসানো পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। প্রায় ১৫০০০ এর মতো টেরাকোটার ফলকসমৃদ্ধ এই মন্দির ছিল অবিভক্ত বাংলার সবথেকে সুন্দর মন্দির। শুধু তাই নয় অবিভক্ত ভারতের এগারতম আশ্চর্য ছিল এটি।

তবে পোড়ামাটির ফলকগুলোর বিশেষত্ব আসলে অন্যখানে। এগুলো সাধারণ কোনো টেরাকোটার কাজ নয়। এর গায়ে লাগানো প্রত্যেকটা ফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তবে কিছু ফলকে মুঘল আমলের চিত্রবর্ণনাও দেখা যায়। তবে এসব ফলকের উপস্থাপন ছিল অনন্য যা অন্যান্য টেরাকোটার নিদর্শনে দেখা যায় না। এর স্তম্ভের কার্নিশে সমসায়িক জীবন ও অভিজাত শ্রেণির শিকারের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে মুঘল জীবন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। মুঘল বাদশাদের শিকার ও কারুকার্য খচিত রথের দৃশ্যায়ন দেখা যায় এ ধাপে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী বিবরণ। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বর্ণিত আছে এই অংশে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সীতার বনবাস, বাকাসুর হত্যা ইত্যাদি গুরুত্তপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী স্থান পেয়েছে এই ধাপে। তবে এই ধাপের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লৌকিক উপস্থাপন। শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী সমূহকে এখানে জনসাধারণের জীবনের মতো চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক গল্পকথা। পৌরাণিক কাহিনীর লৌকিক উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন এই ফলকগুলো। শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরের নির্জন এই কান্তনগরে হাঁটতে গিয়ে একটি ধ্বংস প্রাপ্ত শিবমন্দির ও সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিশাল দীঘির সন্ধানও পেয়ে গেলাম।

এই মন্দিরে ব্যবহৃত এত উৎকৃষ্ট টেরাকোটার ফলক আপনি দেশের আর কোথাও দেখতে পাবেন না। কান্তজীর মন্দিরের বিখ্যাত রাসমেলা দেখতেও চলে যেতে পারেন উত্তরবঙ্গের সবথেকে প্রাচীন জেলা দিনাজপুরে। কান্তনগরের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর কাছে নিঃসন্দেহে আকর্ষণের। আর হ্যাঁ কান্তজীর মন্দির ভ্রমণের বোনাস হিসেবে দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদও। একটু জানিয়ে রাখি কান্তজীর মন্দির নির্মাণের জন্য ভারত থেকে আগত মুসলমান স্থপতিরা নিজেদের জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এখানেও মধ্যযুগীয় নির্মাণশৈলীর দেখা পাওয়া যায়।

রূপকথার কোনো স্বপ্নপুরী নয়। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন পিকনিক বা বিনোদন স্পট। নাম স্বপ্নপুরী। দলবেধে পিকনিক অথবা ঘুরতে যাওয়ার জন্য উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশের মানুষের পছন্দের জায়গা। দিনাজপুর শহর থেকে ফুলবাড়ী হয়ে একটু ভেতরের দিকে গেলেই দেখা মিলে স্বপ্নপুরীর। ১৯৯০ সালে প্রায় ৪০০ বিঘা জমির ওপর এটি তৈরি করা হয়। উত্তারাঞ্চলসহ বহু দূর থেকে মানুষ এখানে আসে মূলত পিকনিক করতে। এখানে কৃত্রিম ছোট চিড়িয়াখানাসহ চিত্তবিনোদনের নানা সামগ্রী রয়েছে। চিড়িয়াখানাটিও কম সমৃদ্ধ নয়। উত্তর জনপদের মানুষকে দেশ-বিদেশের বহু পশু-পাখির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সামর্থ রাখে এটি।

জীবন্ত চিড়িয়াখানায় প্রবেশের সময় বাংলার ঐতিহ্য বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখাকৃতির এ প্রধান ফটকটি পর্যটকদের শিহরিত ও রোমাঞ্চিত করে।সুবিশাল স্বপ্নপুরীর স্থানে স্থানে রয়েছে চমৎকার চমৎকার বিশ্রাম ছাউনি। অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত স্বপ্নপুরীর বাগানে রয়েছে ঘনপাতা, লতাগুল্ম উথিত ঢেউ বেষ্টনীর মাঝে বাগান বিলাসের সমারোহ। নিপুণ হাতের যত্নের পরশে বাগ-বাগিচার সৌন্দর্যে স্বপ্নপুরী পেয়েছে জীবন্তরূপ।

ঢাকা থেকে 'সাগর' শব্দ শুনে কেউ হতচকিত হলেও এটি আসলে একটি দিঘী মাত্র। চোখে শীতলতা ছড়ালো কেবলই দিঘির বিশালতা। দিনাজপুর জেলার তাজপুর গ্রামে অবস্থিত মানবসৃষ্ট দিঘিটি। এটি স্বচ্ছ নীলাভ জলের দ্যোতনায় বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় দিঘি।প্রশস্ত পাকা রাস্তা ধরে পুরো রামসাগর পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় ফুরিয়ে গেল।দিঘির পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, আমলকী, হরীতকী, দেবদারু, জারুল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, কাঁঠালিচাঁপা, বটসহ প্রায় দেড় শতাধিক গাছ যেন পর্য়টকদের রাত প্রহরী হয়ে কাজ করছে! আর ইন্দ্রিয়ে সতেজ অনুভূতির ঘ্রাণ ছড়াতে রয়েছে হরেক রকমের ফুল গাছ।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, সারাটা রাস্তাজুড়ে টুকরো টুকরো রুপোলি আলো-ছায়ার খেলা। বাতাস ভরে ছিল অদ্ভুত এক মিষ্টি গন্ধ। অস্ফুট উচ্চারণে যেন নিজেকেই বলি, ' বুনো ভেষজ আতরের গন্ধ নয় তো?' ক্লান্তিতে ঘাসের মধ্যে কিছুক্ষণ বসার পর উঠে পড়লাম; পায়ের শব্দ আর চাপা স্বরের কথা শুনে। নির্জন জায়গা, আমার একটু ভয়ও করতে লাগল! পরে দেখলাম, ছায়ার আড়ালে চুপ করে নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সারছিলেন দুজন মধ্যবয়স্ত কৃষক।তারা আমাকে অভয় দিলেন। কোথা থেকে এসেছি? সেটা জানার জন্য অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়লেন।

লাঙ্গল-গরুর জীবনযুদ্ধ। সারা বছর চাষাবাদ আর বছর শেষে মহাজনের ঋণের বোঝা তবু তাদের সুখী সুখী ভাব যেন এক পজেটিভ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি! টিপসই দেওয়া এই মানুষগুলো বোঝেন না এনজিওদের ছলা কৌশল,চিনেন না কৃষির নব্য গজিয়ে ওঠা কর্পোরেট দালালদেরও! তারা শুধু বুঝেন গতর খাটানো শ্রমে অর্জিত মাঠের পর মাঠে পড়ে থাকা পাকা ধান।হাতে থাকা কীটনাশক ঘাসের উপরে রেখে অতি আনন্দে যখন দুজনেই আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকলেন, উত্তর থেকে দক্ষিণে মাইলের পর মাইল এই শস্য সমুদ্রের বিস্তার…! এর ভেতরেও কত সব পোকা।অন্ধকারে দলে দলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে ধানের ছড়ার উপর। আবার কখনো বা দ্রুত ধাবমান ইঁদুরের খস খস শব্দ।

সৃজন-তরঙ্গের যৌথশ্রমে গড়া রপবতী শস্য ভান্ডার দেখে মনে পড়ে, সেই কবে একদিন এই আলপথ ভেসে গিয়েছিল তেভাগার রক্ত জোছনায়! কী ভীষণ উদ্দীপনা জাগিয়ে তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর-এ শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই অঞ্চলে। এখনকার বর্গা বা ভাগ-চাষীরা কী তা জানে? মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই ছিল দাবি। এই আন্দোলনের জনক নামে খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ দিনাজপুরের সূর্য়সন্তান।

সন্ধ্যা ঘনীভূত হলে ঝিঁঝিঁর ডাক, ময়ূরের নৃত্যে যেন মন ময়ূরের মতোই নেচে ওঠে। তেমনি দিনের বেলা গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি আর দেবদারু গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলোর কিরণমালা- যেকোনো জীবন রসিককে আনমনা করে তুলবে গ্যারান্টি দিচ্ছি।

উদ্বিগ্ন পথিকের মতো ফাঁকা চাউনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূর হলো যখন অপেক্ষা শেষে পাওয়া গেল অটো রিকসা।যেদিকে ছুটছি …উপত্যকা ও এর গাছপালাগুলোকে, একে ঘিরে-থাকা এলাকা থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হচ্ছিল। এখানে সবুজ ঝোপঝাড় এবং গাছগাছালির সমারোহ। এটার একটাই অর্থ হতে পারে : ঝানঝিরা-শিঙ্গানগরের মাঝে আত্রাই নদীর ফিরিঙ্গি ঘাট এখনো বহাল তবিয়তে। অটো রিকসা দ্রুত দৌঁড়াতে থাকে। নদীকে বাস্তবে চোখে না-দেখা পর্যন্ত এটা যে সত্যি বইছে; তা যেন আর বিশ্বাস হচ্ছিল না!