লোরকার খোঁজে দুই রজনী

ইকতিয়ার চৌধুরী
Published : 20 March 2021, 06:40 AM
Updated : 20 March 2021, 06:40 AM


স্পেন ছাড়ার দিন প্রায় এসে গেল। আশ্চার্য, সাড়ে চার বছরের মত দীর্ঘ সময়েও বিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ স্পেনিশ কবি ও নাট্যজন ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকার খোঁজ করতে না পারার যোগ্য কোন সদুত্তর নেই। সাড়ে চার বছর অনেকটা সময়। দু'হাজার দশ থেকে চোদ্দ। তারও আগে গত শতাব্দীর আটানব্বই সালে ঘুরে গেছি স্পেন। সে যাত্রায় আমার কয়েকটি দিন রাখা ছিল গ্রানাডার জন্য। লোরকার বার্থপ্লেস দক্ষিণ স্পেনের ফুয়েন্তে ভ্যাকুরোস গ্রানাডা হতে মাত্র সতের কিলোমিটার। এত কাছে তবুও লোরকা অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি। প্রতি বছর অতলান্তিক মহাসাগর আর ভূমধ্যসাগর বেষ্টিত স্পেনের পাগলপারা আকর্ষণে ছূটে আসে ষাট মিলিয়নেরও বেশী পর্যটক। এর বাইরে দিনে এসে দিনে চলে যায় এমন পর্যটকের সংখ্যাও প্রচুর। সংখ্যাটি চল্লিশ মিলিয়ন। তাদের অধিকাংশের এক নম্বর গন্তব্য গ্রানাডার আলহামরা। হ্যাঁ, প্রায় আট শ' বছর ধরে (৭১১-১৪৯২) স্পেনের মুসলিম শাসকদের প্রধান আবাস আলহামরা তাদের প্রথম পছন্দ। আটানব্বইয়ে প্যারিস থেকে মাদ্রিদে বেড়াতে আসা আমারও অগ্রাধিকার ছিল তাই। লোরকার জন্মভুমি অনুসন্ধান ওই অগ্রাধিকারে পেছনে পড়ে যায়। কিন্তু এবার তো তার পুনরাবৃত্তি হওয়া সমীচীন হবে না।
আগষ্টের এক ঝকঝকে দিনে তাই বেরিয়ে পড়া গেল। মাদ্রিদ থেকে। লোরকার জন্মভিটা দক্ষিণ স্পেনের ফুয়েন্তে ভ্যাকুরোস যেতে ছুটতে হবে প্রায় তিন শ' পঞ্চাশ কিলোমিটার। সাথে বউ লীনা। আটানব্বইয়ের সফরে আমাদের দু'পুত্র সংগী ছিল। এবার তাদের কেউই নেই। বড়ছেলে অনত লন্ডনে আর ছোটজন অলভ্য বার্মিংহামে। আমাদের পর্তূগীজ ড্রাইভার জর্জ ভাল গাড়ী চালক। আসলে পূর্তগীজ কিংবা স্প্যানিশ রীতিঅনুযায়ী ওর নামের উচ্চারণ খর্খে। ইংরেজি ভাষায় যদিও এর উচ্চারণ জর্জ। জর্জ বলে চার ঘন্টায় সে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যাবে। বলি,'নিয়ে যাবে ভাল কথা। তবে দ্রুত যেতে আমাকে বউসমেত আবার খাদে নামিয়ে দিওনা।' শুনে জর্জ মৃদু হাসে। ওর বাড়ী পর্তুগালের গ্রামে। স্পেন সীমান্ত হতে মাত্র বিশ পঁচিশ কিলোমিটার ভেতরে। গ্রামটি আমাদের চৌকশ শহরকেও ছাড়িয়ে যাবার মত। তা আমি জেনেছিলাম যখন জর্জ একদিন আমার স্পেনের উত্তর পশ্চিমের 'আ করুণা' সফরকালে একটানে ওর গ্রামের বাড়ী নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামটি ছবির মত। ইটের রাস্তার সাথে কোথায়ও কোথায়ও পাথরের বাঁধানো রাস্তা। রাস্তা ঘেসে মাঝে মাঝে ক্যাফে বার। জর্জের বয়স চল্লিশ হবে। পনের ষোলর একটি মেয়ে আছে তার। থাকে মায়ের সাথে। মেয়ের মাকে জর্জ বলে গার্ল ফ্রেন্ড। কেন বউ নয় জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়, আমাদের বিয়ে হয়নি।' জর্জদের রোমান ক্যাথলিক সমাজে এভাবে বাচ্চা নেয়া দোষের নয়। তবে ওই বন্ধুত্বও এখন আর নেই। তারা পৃথক হয়ে যাওয়ায় বেচারি জর্জ বর্তমানে নিঃসঙ্গ। তবে সে দায়িত্বশীল পিতা। মেয়ের লেখাপড়া হতে শুরু করে সব খরচ নিয়মিত যোগায়।
ইউরোপের গ্রাম আমার ভাল লাগে। এই ভাল লাগার শুরু এক দশক আগে আমি যখন ইংল্যান্ডে থাকতাম। ইংরেজরা তাদের অষ্টাদশ শতকের অনেক গ্রামকে কোথায়ও কোথায়ও অবিকল আগের মত রেখে দিয়েছে। লোরকার জন্মস্থান ভ্রমনে এবার তাই আমরা থাকব গ্রামে। আলফাকারের ভিজনার এক প্রকার গ্রামই। দশ মাইলের মত দূরে- ফুয়েন্তে ভ্যাকুরোস থেকে। সেখানে আমাদের হোটেল 'রুতা দ্য লোরকা'। এক সপ্তাহ আগে আমার ব্যক্তিগত সহকারী মিজ খুলিয়েতা বুকড্‌ করে রেখেছে । ওর নামটি নিয়েও রয়েছে স্পানিশ আর ইংরেজির ঠোকাঠুকি। খুলিয়েতা আসলে ইংরেজদের জুলিয়েটা।


অখন্ড মনোযোগে মার্সিডিজ চালাচ্ছে জর্জ। অন্ততঃ একটার মধ্যে তাকে আমাদের হাজির করতে হবে হোটেল রুতা দ্য লোরকায় । গাড়ী চলছে। পেরিয়ে যাচ্ছে প্রান্তর। চারলেনের মসৃন রাস্তা। স্টিয়ারিংয়ে শক্ত করে হাত রেখে জর্জের নজর সেদিকে। স্পেনের প্রকৃতি আমার ধূসর আর ফ্যাকাসে লাগে। রুক্ষ। গাছপালার সবুজ প্রাণবন্ত নয়। বিদেশ ভূমিতে জর্জকে নিয়ে ঘুরতে আমাদের বড় সুবিধা সে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলোতে স্বচ্ছন্দ। স্প্যানিশ, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ সে ভালই জানে। স্পেনে আসবার আগে সে থাকত ফ্রান্সে। লরী ড্রাইভারের চাকরী। মালামাল নিয়ে নিত্য যাতায়াত ছিল এক দেশ থেকে আরেক দেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আটাশটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিকদের চলাফেরা ও পণ্য পরিবহনে কোন সীমান্ত বাঁধা নেই। মুক্ত বানিজ্যের মহাদেশে দেশ দেশান্তরে জর্জ তার দশ হুইলের বিশাল লরী নিয়ে একাই ছুটত। বাংলাদেশের ট্রাক-ড্রাইভারদের মত তার কোন হেলপার থাকত না।
আমি জর্জকে আমাদের অবস্থান কিংবা কতকক্ষণে গন্তব্যে পৌছুব সে সম্পর্কে কিছুই বলিনা। কারণ এ ব্যাপারে সর্বদাই তার পারফেক্ট জবাব দেবার প্রবণতা বিরক্তিকর। আমি যদি এখন তাকে জিজ্ঞেস করি আর কতক্ষণ লাগবে সে মাইলেজ ও স্পীড দেখে একটি বিদঘুটে সময় বলবে। যেমন উনপঞ্চাশ মিনিট কিংবা এক ঘন্টা তের মিনিট। খানিকবাদেই আবার কারেকশন করে যোগ করবে,' সামনের রাস্তা জিগজাগ। স্পীড উঠবেনা। সময় লাগবে এক ঘন্টা সাইত্রিশ মিনিট।' আমি ভাবি একেবারে সঠিক সময় তো চাইনি। ধারণা চেয়েছি মাত্র। কিন্তু কে শোনে আমার কথা।
জর্জকে নিয়ে আমাদের পরিবারে একটি গল্প আছে। গল্পটির শুরু এবছরই বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ে। জর্জ একজন ফুটবল প্রেমিক মানুষ। ভরা যৌবনে পর্তুগালে তাদের গ্রামের টিমের সে নির্ভরযোগ্য সেন্টারহাফ ছিল। জর্জ দাবী করে সে ভাল খেলোয়ার ছিল। এমন কি 'ক্ষ্যাপে' যেত। অর্থাৎ হায়ারে খেলত। যেদিন গল্পটির জন্ম সেদিন বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানি বনাম পর্তুগালের খেলা। লীনা-অলভ্যসহ গাড়ীতে ছিলাম। চলতে চলতে জর্জকে জিজ্ঞেস করলাম,' আজকের খেলার ফলাফল কি হবে মনে করছ?' জর্জ একটু চুপ থেকে জবাব দিল,' জার্মানি ইজ এ স্ট্রং টিম।' পরক্ষণেই মনে হল নিজের দেশ পর্তুগালের ওপর কেন সে আস্থা রাখবেনা। আবার এও বলতে পারছেনা জার্মানিকে তারা হারাবে। শেষে একটু বাতেনিভাবে মন্তব্য করল,' বাট এভরিথিং ইজ পসিবল।' মাথা একটু ঘুরিয়ে জোর দিয়ে আবার বলল,' বাট এভরিথিং ইজ পসিবল।' সেই সন্ধ্যার খেলায় পর্তুগাল চার গোলে হারল। তখন থেকে মজাটি চালু হল আমাদের পরিবারে। যেমন অলভ্য স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে এলো। ওর মা জানতে চাইল,' বাবা, এ প্লাস কি থাকবে?' উত্তর এলো,' থাকবে কিনা বলা যাচ্ছেনা।' মৃদু হাসির পর যোগ হল,' বাট এভরিথিং ইজ পসিবল।' ওর মা আর আমি হেসে ফেললাম। এ হল নির্দোষ মজা। আসলে জর্জকে আমরা খুবই পছন্দ করি। সে সৎ ও যার পর নাই দায়িত্বশীল।
জর্জ একটার মধ্যে আমাদের হোটেলে নিয়ে এলো। রুতা দ্য লোরকা দু'তারকা হোটেল। ফুয়েন্তে ভ্যাকুরোস থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে। স্পেনে এ ধরণের আবাসনকে বলা হয় 'হোটেল রুরাল।' অর্থাৎ গ্রামীন হোটেল। বুঝতে অসুবিধা হয়না ব্যবসায়িক প্রয়োজনে লোরকার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। হোটেলটির নামের অর্থ 'লোরকা যাবার পথে' অথবা 'লোরকা যাবার পথ' হবে হয়তো। ১৮৯৮ সালের ৫ জুন এই অঞ্চলে জন্ম নেয়া এবং ১৯৩৬ সালে নিহত 'শহীদ' নাট্যজন লোরকা জন্মের একশ' বছরেরও অধিক সময় পর বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানের মত। তার বাবাও ছিলেন এই এলাকার একজন প্রভাবশালী ভূস্বামী। সুতরাং লোরকার নাম পুঁজি করে ব্যবসা চলবে তা বিচিত্র কিছু নয়।


আমরা চেকড ইন করে রুমে এলাম। ঘরটি তখনও গোছানো হয়নি। সবেই হয়তো কেউ রুম ছেড়েছে। কক্ষটি ছোট। স্নানঘর ততোধিক- একটি টিউবের মত। সাদা বেলগার্ল রুমের ভেতর কোন রকমে আমাদের কেবিন ব্যাগ দুটো ঢুকিয়ে অগোছাল বিছানার ওপর ভাঁজকরা বেডসিট ছুঁড়ে বলল,' গুছিয়ে নাও।' বড়ই তাচ্ছিল্য তার আচরণে। সারা দুনিয়ায় কালো মানুষের বড়ই মুসিবত। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরাও একই দলে। তবে এত তাচ্ছিল্যর মুখোমুখি এর আগে কোন হোটেলে হইনি। আমি নিজের পরিচয় দিতে গিয়েও বিরত থাকলাম। মনে হলো এর আসলে প্রয়োজন নেই। তাতে বরং ঝামেলা বাড়তে পারে। কারণ তখন আমার বিশিষ্ট একজনের একটি অভিজ্ঞতার বয়ান মনে পড়ল। তিনি দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব ছিলেন। সরকারি কাজে বিদেশ সফরে গেছেন। সিংগাপুর চাঙ্গি বিমানবন্দরে সংযোগ ফ্লাইট ধরতে বিপত্তি বাধল। সময় ছিলনা। তিনি প্রায় দৌড়ুচ্ছিলেন। ইমিগ্রেশনের একজনের সন্দেহ হলো। কারণ তার গাঢ় বর্ণের দেহাবয়ব আর উদ্ভ্রান্তের মত ছোটা তাকে হয়তো 'ফুগেটিভ'এর মত দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে যখন জানল তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব তখন তার মানসিক ভারসাম্য নিয়ে অফিসারটির খটমট লাগায় সেদিন অহেতুক পেরেসানের পর তিনি সংযোগ ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলেন।
'একজন রাষ্ট্রদূত হয়ে লোরকার খোঁজে সামান্য দুই তারকা গ্রামীন হোটেলে বউসহ হাজির হয়েছি' জানলে বেলগার্লটিও বিশ্বাস নাও করতে পারে। কারো নিজকে বড় করে প্রকাশের প্রবণতা মানুষ সাধারণতঃ পছন্দ কিংবা বিশ্বাস করতে চায়না। দেড়যুগ আগে প্যারিসে কর্মরত ছিলাম। একদিন দেখি আমাদের তামিল ড্রাইভার দূতাবাসের গাড়ীতে হেলান দিয়ে বই পড়ছে। নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিণের 'লজ্জা' উপন্যাসের ফরাসী অনুবাদ। বইটি হাতে নিয়ে কথায় কথায় যখন বললাম তসলিমার তিন সাবেক স্বামীই আমার বন্ধু/ঘনিষ্ঠজন তখন সে আমাকে একটু নতুন করে দেখল যেন। তার দৃষ্টিতে মাপ। মনে হল যেন মেপে দেখছে আমি তসলিমার মত বিখ্যাত নারীর স্বামীদের বন্ধু হবার মত ওজনদার কিনা। তামিল ড্রাইভারটির চোখে আমি সেদিন স্পষ্ট অবিশ্বাস দেখেছিলাম। একটি শিক্ষা ওইদিন হয়েছিল আমার – বিখ্যাত মানুষদের সাথে নিজেকে আগবাড়িয়ে জড়ানোর চেষ্টা না করা কিংবা নিজেকে বিশেষ কিছু না ভাবা।
আমি তাই বেলগার্লকে কিছু না বলে ওয়ালেট থেকে পাঁচ ইউরোর একটি কয়েন নিলাম। মেয়েটি তা তাকিয়ে দেখল। ঘর গোছানো রুম সার্ভিসের কাজ জানলেও আমি তর্জনিতে তাকে স্নানঘর, মেঝে ও বেড দেখালাম। কাজ হল। নিচে হোটেল বারে এক মগ বিয়ার শেষ করে ফিরে দেখি পরিস্কার চাদর, বালিশ, কুশনে সুন্দর করে বিছানা সাজানো। বেডসাইড টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া কয়েনটি নেই।
বিকেলটা আমরা শুয়ে বসে এক প্রকার আলস্যে কাটিয়ে দেই। ভিজনার ছোট্ট জায়গা। লোক সংখ্যা এক হাজারের মত। দেখার মত তেমন কিছু নেই। আবার আছেও। সেটি জানা গেল আমরা যখন সান্ধ্য চক্করে বেরুলাম। পদব্রজে। ভিজনারের অধিবাসীরা বৈকালিক আড্ডা জমাতে ওস্তাদ। যদিও সংখ্যায় তারা কম কিন্তু দিনের শেষে আসন্ন রাতের স্বল্পালোকিত ক্যাফেগুলোতে তারা বেশ জমিয়েছিল। এই অঞ্চলটিকে আমার কৃষিপ্রধান এলাকা বলেই মনে হচ্ছে। আসরের মানুষগুলোর কেউ কেউ তাই হতে পারে এ্যাসপ্যারাগাস অর্থাৎ সব্জী চাষী কিংবা তাদের রয়েছে জলপাইয়ের বাগান। ছোট্ট ভিজনারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব নাগরিকদের প্রশান্তি অবলোকনও আমাদের মনকে আনন্দময় করে দিল। এটি একটি সাধারণ পৌরসভা যেখানে বড় কোন স্থাপনা আমাদের গোচরে আসেনা এবং হাঁটতে হাঁটতে লীনা ও আমার এই প্রতীতি জন্মে যে দু'তারকা রুতা দ্য লোরকা এখানকার সবচে' বড় হোটেল। বেরুনোর মুখে সেখানে আমরা ডিনারের প্রস্তুতিতে ওয়েটারদের সারা ফ্লোর জুড়ে টেবিল সাজাতে দেখেছি। প্রতিটি টেবিলে প্লেট উল্টো করে রাখা। তার দু'পাশে ছুরি, কাটা চামচ। সামনে মাঝ বরাবর ঝকঝকে গ্লাস। পাশে রেড/হোয়াইট ওয়াইনের বোতল চকচক করছে।
রাতের ডিনারে তার একটার সদ্ব্যবহার করা গেল।
সকালে কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্টের পর আমরা বেরিয়ে যাই। গন্তব্য ফুয়েন্তে ভ্যাকুরোস- লোরকার জন্মস্থান। দশ মাইল পথ তেমন কিছু নয়। প্রায় গাড়ীবিহীন রাস্তায় কোথায়ও কোথায়ও এ্যাসপ্যারাগাস ক্ষেতের মাঝ দিয়ে জর্জ সহজেই আমাদের ফুয়েন্তে নিয়ে আসে। স্পেনের আন্দালুসিয়া রিজিয়নের অর্থনীতি প্রধানতঃ কৃষি প্রধান। যদিও সাম্প্রতিককালে পর্যটন ও সার্ভিস সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। গ্রানাডা- আন্দালুসিয়ার আটটি প্রভিন্সের অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ আর দুটি প্রভিন্স হচ্ছে মালাগা ও সেভিল। সেভিল আন্দালুসিয়ার রাজধানী আর সেখানে ভুমধ্যসাগরের তটরেখা ঘেষা মালাগা হচ্ছে পর্যটনের রাণি।
দেশটির অন্য এলাকার তুলনায় কৃষি নির্ভর গ্রানাডার প্রধান ফসল গম, সূর্যমুখী, ভুট্টা, বার্লি । আবাদি ফসল ছাড়া সেখানে আরও পাওয়া যায় জলপাই ও আপেল। এমনই একটি পরিবেশে কেটেছে লোরকার শৈশব। তবে বেশি সময়ের জন্য নয়। কারণ লোরকার যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন তার পরিবার ভ্যাকুরোস থেকে অনতিদূরের আসকুয়েরোসা শহরে বসবাস শুরু করে। তা ছিল নামেই শহর। কারণ ওই সময় তা ছোট্ট জনপদের বেশি বৈ কিছু নয়। ১৯০৯ সালে গ্রানাডায় স্থায়ী হবার আগ পর্যন্ত সেখানেই কেটেছিল লোরকার জীবন। লোরকা বড় হয়েছেন ওই গ্রামীন পরিবেশে এবং ওই প্রভাব তার ভেতর আজীবন ছিল। তবে তাকে যা সবচে' বেশি প্রভাবিত করেছিল তা এসেছিল মায়ের কাছ হতে। ভিসেন্টা লোরকা ছিলেন তার জননী। পেশায় শিক্ষিকা ও পিয়ানো শিল্পী। শৈশবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় ভিসেন্টার প্রভাব তার মধ্যে এতটাই ভর করেছিল যে ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকা নিজের বেলায় তার মায়ের পারিবারিক নাম 'লোরকা' ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যদিও স্পেনীয় সমাজের প্রচলিত রীতিনুযায়ী ফেডেরিকোদের পারিবারিক নাম 'গার্সিয়া'র প্রাধান্য যুক্তিযুক্ত ছিল।
ভ্যাকুরোসে লোরকার প্রথম শৈশবের বাড়ীটি এখন মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি আমরা খোলা পাই। আর পাই কয়েকজন দর্শনার্থীকে। প্রধান দরজায় ডিউটি করছে একজন প্রতিবন্ধী কিশোর। বয়স সতের আঠারো। মস্তিস্ক পুরো কার্যক্ষম না হলেও সে তার নির্ধারিত কাজটি ঠিক মতই করতে পারে। যেমন প্রয়োজনমত দরজা খোলা কিংবা বন্ধ করা। জিজ্ঞাসিত হলে দর্শনার্থীদের টিকেট কাউন্টার দেখিয়ে দেয়া ইত্যাদি। আমি তার দক্ষতায় চমৎকৃত হই। পাশ্চাত্যে প্রতিবন্ধী নরনারীদের অবহেলা না করে তাদের উপযোগী কাজে প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা সব সময়ই রয়েছে। লোরকার জন্মভূমি ভ্যাকুরোসও তার ব্যতিক্রম নয়। মিউজিয়ামটি ছোট। একে বরং 'লোরকা স্মৃতিঘর' বলা সংগত। তা ঘুরে দেখতে লীনা ও আমার আধ ঘন্টার মত লাগে। বেড়াতে বেরিয়ে আমরা সবখানেই কিছুটা অলস সময় দেই। এই দেয়াটার উদ্দেশ্য হলো ওই জায়গাটি এবং সেখানকার পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে ধাতস্থ করা। কোন স্থানে দু'তিন ঘন্টা চোখ মেলে নিশ্চল বসে থাকলেও তাতে কত কিছুই না ধরা দেয়। সেরকম একটি ইচ্ছে নিয়ে আমি চারপাশটা পরখ করি। মিউজিয়াম সংলগ্ন জায়গাটিকে কলোনিয়াল শাসক স্পেন দেশটির প্রেক্ষাপটে একেবারেই গ্রাম্য মনে হয়। অদূরে বার কাম ক্যাফের মত একটি কিছু আমাদের নজরে এলে আমরা সেদিকে এগিয়ে যাই। বেলা তখন বারোটারও কম। ক্যাফের সামনের খোলা জায়গায় দু'তিনটে টেবিল। টেবিল ঘিরে চেয়ার । কিন্তু চেয়ারে কোন খদ্দের নেই। আগস্টের আকাশ জুড়ে উজ্জ্বল আলো। দিন তাতে ফুটে আছে। ক্যাফের খোলা চত্বরে আমাদের ভালোই লাগতে থাকে। যা অনেকটা সময় আমাদের সেখানে আটকে রাখে। এরই মাঝে স্থানীয় দু'একজনের সাথে সামান্য কথাবার্তায় আমরা যেটি বুঝতে পারি লোরকার জীবনের শেষটা সম্পর্কে তারা একেবারেই ওয়াকিবহাল নয়। তারা শুধু জানাতে পারল আসকুয়েরোসায় ফেডেরিকো লোরকা পরিবারের যে আবাসটি ছিল সেটিও একটি মিউজিয়াম। আমরা সেখানে যাবার কোন আগ্রহ বোধ করিনা।


লোরকা তার আটত্রিশ বছরের জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছেন গ্রানাডায়। তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস 'গুয়েত্রা দ্য স্যান ভিসেন্তে'তে। বিশেষ করে ১৯২৬ – ১৯৩০ সময়কালের গ্রীষ্মমৌসুমগুলো। অপরাহ্নে ভ্যাকুরোস থেকে আমরা সেখানে যাই। গুয়েত্রা দ্য স্যান ভিসেন্তেও বর্তমানে একটি মিউজিয়াম। দোতলা মিউজিয়ামটি ছোট। তার চারপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে অনেক গাছগাছালি থাকলেও একপ্রকার নিরিবিলিই বলা যায়। গাছগাছালি ভরা এই জায়গাটি আসলে 'ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকা পার্ক'। পার্কের মাঝেই মিউজিয়ামটি। আমরা যখন সেখানে পৌছি তখন তা পরিদর্শনে মধ্যাহ্নের বিরতি চলছিল। বিরতির পর নিরিবিলি স্যান ভিসেন্তে কিছুটা সরব হয়ে উঠল। টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম আমরা। বড় কিউ নয়। সংখ্যাটি পনের ষোল জনের হবে হয়তো। ভেতরে কয়েকটি পেইন্টিংস্‌, ফেডেরিকোর কিছু আলোকচিত্র- তার পান্ডুলিপি/গ্রন্থের ফটোকপি, বাদ্যযন্ত্র ও সংগীতের স্বরলিপি ইত্যাদিসহ বেশ কিছু স্যুভেনির সামগ্রী আমাদের গোচরে এলো। ভবনটিতে লোরকা পরিবারের ব্যবহৃত কাঠের আসবাবের কিছু নিদর্শনও রয়েছে। এই যেমন টেবিল, বসার বেঞ্চ, শোবার খাট ইত্যাদি। একটি সরু সিঁড়িতে যুক্ত দোতলা মিউজিয়ামটি দেখতে আমাদের সময় লাগেনা।
এখানে বসেই লোরকা নির্মান করেছেন বেশ কিছু 'সাহিত্য মিনার'। তার মধ্যে 'ব্লাড ওয়েডিং' গ্রন্থটির নাম করা যেতে পারে। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর একনায়কবাদী শাসনামলে লোরকা পরিবার চল্লিশের দশকের শুরুতে দেশত্যাগী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়। যদিও তাদের সামার হাউজ সান ভিসেন্তে ও তার চারপাশের বাগিচা এখন মিউজিয়ামের অংশ তবে এখন অবধি এর মালিকানা লোরকা পরিবারেরই রয়ে গেছে।
স্পেনের গত শতাব্দীর এই গুরুত্বপূর্ণ কবি ও নাট্যজনকে যখন হত্যা করা হয় দেশটিতে তখন গৃহবিবাদ চলছিল। একদিকে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী বামপন্থীরা অন্যদিকে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সমর্থক চরম ডানপন্থী ন্যাশনালিষ্টগন। গনতন্ত্রকামী বাম ও তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের বলা হত রিপাবলিকান। ফ্রাঙ্কোর সখ্যতা ছিল ইতালির ফ্যাসিস্ট একনায়কবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনি ও জার্মানির নাত্‌সি নেতা এডোলফ্‌ হিটলারের সঙ্গে। রিপাবলিকানদের সমর্থন দেয় তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষ। গৃহবিবাদ ১৯৩৬ সালে যখন রক্তক্ষয়ী তখন ন্যাশনালিষ্ট ফোর্সেস ফেডেরিকোকে হত্যা করে। ঠিক কবে এবং কোথায় তিনি নিহত হন তার হদিস আজও জানা সম্ভব হয়নি। অনুমান করা হয় তারিখটি আগষ্টের ১৮ কিংবা ১৯ আর জায়গাটি 'ফুয়েন্তে গ্রন্দে'। ফুয়েন্তে গ্রন্দে আলফাকার ও ভিজনারকে সংযোগকারী রাস্তার ওপর। হত্যা সম্পর্কে আরো অনুমান প্রচলিত আছে যে, ফ্রাঙ্কো সমর্থকরা লোরকার তথাকথিত সমকামী যৌন জীবন ও রিপাবলিকান প্রীতি অপছন্দ করায় এই হত্যাকান্ড ঘটে। লোরকার হাতেই গ্রামীন স্পেনে সাধারণ জনগোষ্ঠির মাঝে মুক্ত নাটক/পথ নাটকের ধারণা ও মঞ্চায়ন প্রসারিত হয়। স্পেনে সেটি ছিল মুক্ত নাটক/পথ নাটকের দ্বিতীয় সোনালি ঢেউ। তার রচনাবলীর মধ্যে ১৯২৮ সালে প্রকাশিত 'জিপসী ব্যালাডস্‌' তাকে আন্তর্জাতিক সুনাম ও পরিচিতি এনে দেয়। শত্রু ও মিত্র উভয় শিবিরের অনেকের বিশ্বাস জিপসী ব্যালাডস্‌এ তার অস্থির একান্ত জীবনের ছায়া রয়েছে।
পারিবারিক অসম্মতি কিংবা অসহযোগিতা সেইসাথে রাজনৈতিক আশীর্বাদ না থাকায় লোরকা হত্যা রহস্যের অনুসন্ধান বলতে গেলে গত শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময় বন্ধই ছিল। এমনকি ন্যাশনালিষ্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর আমলে ১৯৫৩ সাল অবধি স্পেনে লোরকার সাহিত্য কর্মের প্রকাশনা বন্ধ ছিল। পরবর্তিতে তার যে 'সাহিত্য সমগ্র' পাঠকের দরবারে মুদ্রিত অবস্থায় হাজির করা হয় তাও ছিল কাটছাট করা।
চলতি শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে কয়েকবার লোরকার দেহাবশেষের অনুসন্ধান চলে। প্রথম অনুসন্ধানটি ছিল আলফাকারের কাছাকাছি একটি সম্ভাব্য কবরস্থানে। দ্বিতীয়টি আলফাকারের বাইরে একটি তথাকথিত গণকবরে। লোরকার দেহের খোঁজে সেখানে খনন হয়েছিল। এক ব্যক্তি দাবী করেছিলেন ভিজনার ও আলফাকারকে যুক্তকারি পার্বত্য রাস্তার ধারে তিনি লোরকাসহ কয়েকজনকে সমাহিত করেছিলেন। এবাদে আরও দু'বার তার দেহাবশেষ উদ্ধারে উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু কোনটিই কোন ইতিবাচক ফল আনতে পারেনি।
স্যান ভিসেন্তে হতে বেরুনোর মুখে আমরা স্যুভেনির কার্ড কিনি। সামনের চত্বরে বসে ভাবনায় ফেডেরিকো লোরকার শৈশব, কৈশোর ধরার চেষ্টা করি। শুধু শৈশব কৈশোর কেন যৌবনের ফেডেরিকোও সেখানে দীপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর আমরা খানিকটা সময় কাটিয়ে দেই পার্ক ফেডেরিকোতে। আগস্টের আকাশ জুড়ে থাকা উজ্জ্বল আলো একটু একটু একটু করে ম্লান হতে থাকে। আমাদের ফেরাটা সন্ধ্যায়। রুতা দ্য লোরকায়। এখান হতে মাত্র সাত কিলোমিটার পথ। সেখানে লোরকা ভূমিতে আরও একটি রাত্রি উৎসব আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। গেল আটচল্লিশ ঘন্টার বেশী সময় আমরা ভিজনার, ভ্যাকুরোস থেকে শুরু করে আলফাকার হয়ে গ্রানাডার অনেকটা জায়গা চষে ফেলেছি। কোথায়ও তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন নেই। ফ্রাঙ্কোর বদ্ধ অনুসারীরা তা রাখেনি, রাখতে চায়নি। অথচ লোরকা আছেন সর্বত্র।
ব্লুবেলস্‌, ২৪ ইস্কাটন গার্ডেন রোড, রমনা
জানুয়ারি ১০, ২০২১