ফ্রোজেন উইন্টারেস্টিং টেক্সাস

দিলরুবা আহমেদদিলরুবা আহমেদ
Published : 2 March 2021, 05:58 AM
Updated : 2 March 2021, 05:58 AM


রোববার, ১৪-ই ফেব্রুয়ারী ২০২১, ভেলেন্টাইন ডে-টি পার করে গভীর মাঝরাত সবে নেমেছে ডালাসে, টেক্সাসে, আমেরিকায়। রাতের প্রায় ২টো, আমি লিখছিলাম। ধারাবাহিক ভাবে আমার একটি ভ্রমণ কাহিনী বেরুচ্ছে তাই এতো রাত জেগে লেখার চেষ্টা। হঠাৎ গেলো বিদ্যুৎ চলে, বিনা মেঘে বজ্রপাত। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় এক্কেবারে অন্ধকার, বলা উচিত ঘরের ভেতর কুচকুচে অন্ধকার। আমি নিচের তলায়, শুনতে পেলাম আমার বর দোতলা থেকে আমার নাম ধরে ডাকছে। নিচের তলায় এতক্ষন জড়িয়ে থাকা ইলেক্ট্রিক্যাল কম্বলটাকে আরো জড়িয়ে নিয়ে তার উপর ল্যাপটপটি রেখে তার উপর কাগজ কলম রেখে ভাবলাম এসে যাবে বিদ্যুৎ। প্রত্যাশায় থাকলাম কম্বল ঠান্ডা হবার আগেই বিদ্যুৎ এসে যাবে। এই আমেরিকাতে কারেন্ট যাওয়ার ঘটনা বিরল। হঠাৎ গেলেও ৩/৪ মিনিটের মধ্যেই চলে আসে। আমার বর নিচে নেমে এসেছে, ও দেখতে চাইছে সার্কিট ব্রেকার পরে গেছে কিনা। আমিও উঠে পড়লাম, আর হয়েছে লেখালেখি। সার্কিট ব্রেকার দেখতে হলে সামনের মেইন দরজা খুলে লনে নেমে ডানদিকের ছোট ছোট পাতাবাহারের পাশ কাটিয়ে ছোট্ট বাগান পেরিয়ে বাড়ির পিছে যাওয়ার দরজা পর্যন্ত যেতে হবে, ওখানে পাওয়ার হাউস। এতো রাতে ওখানে যাওয়া, অন্ধকার তো আছেই, সাথে বরফ জমে কার্পেট হয়ে রয়েছে। ওই তুষার চাদর বা তুজ হয়ে জমে থাকা বরফ কতটুকু কি রকম ভয়ঙ্কর না সহনীয়, বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ওকে যেতে দিতে রাজি নই জানবাজি রেখে বরফ ডিঙাতে। পিছলা খেলে চিৎপাত হয়ে বরফে পা ভাঙ্গবে। যেহেতু আমরা ডালাসবাসী তাই খুবই সামান্য জানি বরফের ছলাকলা কাহিনী কীর্তন। ইতিমধ্যেই আমাদের এখানে টেক্সাসের ডালাস ফোর্থ ওয়ার্থ (DFW) এলাকায় দুই/তিন দিন আগেই রাস্তায় জমে থাকা বরফের কারণে ১১ই ফেব্রুয়ারিতে যে ভয়াবহ এক্সিডেন্টটা ঘটেছে তা পুরা শহরকে থমকে দিয়েছে। ১৩৩টি গাড়ি একে অপরকে ধাক্কা দিয়েছে, তারপর দুমড়ে মুচড়ে একাকার। ২৬টি ফায়ার বিগ্রেটের গাড়ি, ৮০টি পুলিশ কার, ১৩ টি অ্যাম্বুলেন্স ব্যস্ত ছিল উদ্ধার কাজে। না বলে উপায় নেই যে এই দেশের স্পিডি রাস্তাগুলোতে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তা হয়ই অত্যন্ত মারাত্মক। এখন তাই তুষার বা বরফের উপর চলাচল নিয়ে ওকে দিয়ে কোনো গবেষণা বা ঝামেলা নয়, চাই না বাড়তি বিপদ। কিন্তু ইলেকসিটিও তো ফেরত চাই।
পুরা বাড়িতে হিটার চলে দিনরাত, প্রচুর প্রেশার, চুলা থেকে ইন্টারনেট হয়ে গেরাজ ডোর খোলা সব কিছুতেই বিদ্যুৎ অপরিহার্য। তাই সার্কিট ব্রেকার পরেও যেতে পারে। গেলো কয়দিন ধরেই তুষার ঝরছে। আমাদের এই ডালাসে তুষার ঝরে পুরা বছরে একবার, খুব বেশি হলে দুবার, তাও মাত্র দুই তিন দিনের জন্য। এবার দুই কি তিন দিন হয় শুরু করেছে ঝরা। ক্রমে তাপমাত্রা কমছে। আরো এবং আরো কমবে সহসা। উঠে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে হা হয়ে গেলাম। কি ধবধবে সাদা চারদিক, কি আলো, কে বলবে এখন রাত, রাতের ২টো। কারেন্ট না থাকায় তুষারের দ্যুতি জগৎকে আলোকিত করে তুলতে ব্যস্ত যেন। বাসার সেন্ট্রাল হিটার অফ হয়ে গেছে তবে ঘর এখনও গরম আছে। ভাবলাম একবার, ফায়ার প্লেস জ্বালাতে হবে কি! না নিশ্চয়ই, অবশ্যই কারেন্ট চলে আসবে সহসা। ও দরজা খুলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেই বললো, দেখছি আমাদেরটাই গেলো না সবার। আমি বললাম চারদিকে তো কোন আলো নেই, সবার-ই হবে। সে ইলেক্ট্রিক্যাল কোম্পানির ইনফমেশন লাইন এ কল দিল। লম্বা কিউ, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তার মানে তো অনেকেরই গেছে তাই এত্ত লম্বা লাইন।

আমাদের এই চত্বরে কোনো বাঙালি নেই যাকে এতো রাতে ফোন করা যায়। বললাম বিদেশী নেইবারদের ফোন করো। আমাদের বাসা থেকে বের হলে ডানদিকের জন ইন্ডিয়ান, বাম দিকের জন সাদা আমেরিকান। এতো রাতে কল দিতে ইতস্তত করছে দেখে বললাম, মেসেজ পাঠাও। পাঠালো। আমাদের অবাক করে সাথে সাথেই উত্তর এলো বাম দিকের স্যামুয়েল আলেক্স থেকে, তারও কারেন্ট চলে গেছে। ডান দিকের জন মনে হয় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, কোনো সাড়া শব্দ নেই তার থেকে। যাই হোক ,তাহলে এটা সবার সমস্যা, আমাদের করণীয় কিছু নেই। ঠান্ডা ঠান্ডা কি ঠান্ডা বলতে বলতে বাসায় ঢুকে পড়লাম। সেলফোনে দেখলাম তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট । বাপরে বাপ অনেক ঠান্ডা, সোজা উপরের তলাতে গিয়ে খাটে উঠে কমফোর্টারের নিচে। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম শীত মানছে না। ঘর আর গরম থাকছে না, ঠান্ডা হামা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। আমার বর বললো, এবার মারেমা বলো, বাপ রে বাপে আর কাজ হবে না।
আরেকটা কম্বল নিলাম। হাউস কোট পরে নিলাম। তখনও জানি না ৩০ মিনিটের মধ্যেই আরেকটা কোট আর সোয়েটার চাপাতে হবে গায়ে। মেয়ের রুমে গিয়ে দেখলাম সে ঘুমাচ্ছে। ওর রুমটা আমাদের রুমের চেয়ে অনেক গরম দেখে খুশি হলাম। তার পাশের গেস্ট রুমে এসে শুবো কিনা ভাবলাম কিন্তু অন্ধকারে এতো কিছু মানে রুম বদলের প্রাসঙ্গিক এতো সব কিছু কে করে! সেই চিন্তা তাই বাতিল। মনে হলো আলো আঁধারিতে নিজের শোবার ঘরেই গুটলি মেরে পরে থাকাটাই অনেক আনন্দের হবে। আবার লেপের নিচে চলে গেলাম। মোম যেটা পাওয়া গেলো তা আলো কম সুগন্ধ বেশি ছড়াতে ব্যস্ত। আমার বর কোত্থেকে বিশাল এক ফ্ল্যাশ লাইট বের করে আনলো। এতে ফোনেও চার্জ করা যাবে। আমার ফোন দেখলাম চার্জ প্রায় শেষ। ওই যে বলে না যেখানে অন্ধকার সেখানে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায়। তাই হলো। এবং এর কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি ঘুমিয়েও গেলাম। ইমতিয়াজ আছে, ঝড় তুফান তুষার সব সামলে নেবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

এলার্ম বাজতেই লাফ মেরে উঠে গেলাম সকাল আটটায়।
অফিস করি বাসা থেকে সেই মার্চ থেকে। ওটা করোনার কারণে। সাপে বর হয়েছে, না হলে এই বরফ ভেঙে অফিস দৌড়াতে হতো। আমার বর বললো, শুয়ে থাকো, অফিস সার্ভারে লগ ইন করতে পারবে না। কারেন্ট নেই। হায় হায় করে উঠলাম। ডিরেক্টরকে ফোন করলাম, বললাম। সে বললো তারও বাসায় কারেন্ট নেই।আরো অনেক সহকর্মী ফোন করেছে তাকে যাদের বাসায় কারেন্ট নেই। মানে কি, শহরময় এই অবস্থা।
আমার বর বললো, ইন্টারনেটে তো তাই দেখছি। ফোনের ডাটা খরচ করে সে আপডেট নিচ্ছে, রাখছে। বললো অবস্থা সুবিধার না। কিন্তু সকালে চা বা কফি লাগবে। বরকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু খেয়েছো? আমার বর হাসি দিয়ে বললো, সোমবার সকালে নাস্তা খেতে নেই। বুঝলাম,আঙুর ফল টক।
আমার মেয়েকে বললাম, চলো কফি কিনে আনি এবং নাস্তা যে কোনো ফাস্টফুডের দোকান থেকে কিনবো চলো। আমার বর বললো, তোমার গাড়িতে গ্যাস নেই, তলানিতে পরে আছে দেখলাম, তোমাদের ওই গাড়ি নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে না। মনে পড়লো গতকালকেই লাল লাইট জলে উঠেছিল। সে সব সময় বলে অর্ধেক হলেই গ্যাস নিয়ে নিবে। আজ হাতেনাতে বিপদ তার কথা না শোনার। আমার গাড়িটি গেরাজের বাহিরে ছিল। তার গাড়িটি গ্যারাজের ভেতরে, ওটিতে পেট্রল ভরা আছে কিন্তু ইলেক্ট্রিটিসি ছাড়া গেরাজ ডোর খুলবে না। টেনেটুনে হাতপা দিয়ে চেষ্টা করে হয়তোবা খোলা যাবে কিন্তু ঠিক জানি না সেটা কতদূর কি হবে। আগে কক্ষনো করিনি। হঠাৎই মনে হলো বাংলাদেশে যে গেরাজ খোলার জন্য একজন দারোয়ান থাকতো সেটাই অনেক ভালো ছিল। অথচ প্রথম যখন এলাম এই দেশে অটোমেটেড গেরাজ ডোর ওপেনার দেখে কি আনন্দ! বাংলাদেশের দারোয়ানদের মনে হয়েছিল ছদ্দবেশী বেকার। এখন ভাবছি ওনারা সবাই কই! ওনারাই অতীব প্রয়োজনীয়।
ইমতিয়াজ জেকেট গ্লাফস কানটুপি আরো অনেক কিছু পরে পেকেট হয়ে বের হলো গ্যাস নেবে, কফি কিনবে, ষ্টার বাক্স না ডানকিন ডোনাট তা নিয়ে আমরা মা মেয়ে মতামত দিলাম, নাস্তা আর লাঞ্চ এর জন্যও কিছু কিনবে, চুলা জ্বলবে কিভাবে কারেন্ট ছাড়া, রাধাবাড়া বন্ধ। নিঃসন্দেহে কেরোসিনের চুলার বা গ্যাসের কথা আমার মনে এলো। সেই যেন ছিল অনেক ভালো। তখনও জানি না আরো কত অভিজ্ঞতা আছে সামনে।তখনো ভাবছি এসে যাবে বুঝি কিছুক্ষন পর ইলেকট্রিসিটি।
একটি সোয়েটার এবং দুটো হাউজ কোট সেই যে পরেছি আর খুলিনি। ওভাবেই গিয়ে কমফোর্টারের নিচে শুয়ে থাকলাম। ইমতিয়াজ যেতে যেতে বললো কলে এখনো গরম পানি আসছে। মুখ হাত ধুয়ে নাও। গোসলও। জানালো, ফোনের ইন্টারনেটের কারণে এসে গেছে কানে যে ওই ক্ষণ পর্যন্ত ১.১ মিলিয়ন গ্রাহক বিদ্যুৎ হারিয়েছে ডালাস ফোর্থ ওয়ার্থ ( DFW )এলাকায়। এতো মানুষ বিদ্যুৎহারা! হায় খোদা! এ কি হলো! আবার একই সাথে মনে হলো এতজনকে দেখে নিজেকে আর অসহায় মনে হচ্ছে না। ইমতিয়াজ তাই শুনে বললো,আমার তো মনে হলো বিশাল এক অসহায় গ্রুপের একজন আমি। তার আগে আমি বিপর্যস্থ হলেও মনে হচ্ছিলো সাহায্যের প্রয়োজন হলে আছে অনেকে, এখন তো সবাই অন্ধকারে। সবাই অসহায়। আমি বললাম, সবাই আমার মতন অবস্থাতে, এটা এক ধরণের সাহস দিচ্ছে দ্রুত উত্তরণের।
ও হেসে বললো, পজিটিভ অলওয়েজ, এটা খুব ভালো গুন।
ইমতিয়াজ ফিরলো বেশ কিছুক্ষন পরে সাথে নিয়ে গ্যাস স্টেশনের কফি। বললো, সব দোকান পাট বন্ধ। সে এদিক ওদিক একটু দূরে বেশ দূরে গিয়ে দেখেছে কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা,নাই কিছু ,সব বন্ধ, অবিশ্বাস্য, কিন্তু তাই সত্যি। ফাস্ট ফুড থেকে শুরু করে পাশের ওয়ালম্যাট সুপার শপ সব বন্ধ। কারো পাওয়ার/ইলেট্রিসিটি নেই। সে তৈরী কোনো খাবার না পেয়ে শেষে গ্যাস স্টেশনের থেকে শুকনা কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। আমাদের এখানে গ্যাস স্টেশনগুলোতে চিকেন রোল পাওয়া যায়, খুব মজার, আজ তাও ছিল না। ও বলল একটি মাত্র কর্মচারী ছিল স্টোরে, কর্মচারীটি জানিয়েছে আর কেও আসেনি এই দুর্যোগে, তাই সে কিছুই বানায় নি। আমার ফ্রিজ ভরা রান্না করা খাবার আছে কিন্তু গরম করবো কিভাবে। শনি রবিবার রাঁধি তাই রান্না করা খাদ্য আছে, কিন্তু গরম করার ব্যবস্থা নেই।
এক ভাবি বললেন, পার্টির সময় আমার যে কুপি জ্বালাই শেফ ডিশ এর নিচে সেগুলো দিয়ে গরম করে নিন, ভালো বুদ্ধি কিন্তু এতো করতে ইচ্ছে হলো না, সময় সাপেক্ষ সে সব করা। আশা করলাম সহসা বিদ্যুৎ চলে আসবে।

তিনটা বাজতেই বিদ্যুৎ ফিরল। কিন্তু আমার বর বললো এটা বেশিক্ষন থাকবে না। ওরা একেক এলাকাকে কিছুক্ষন করে বিদ্যুৎ দিচ্ছে। টেক্সাস নিজের বিদ্যুৎ নিজে উৎপাদন করে, আমেরিকার নেশানাল গ্রিডের সাথে এর কোনো চুক্তি নেই। যে টারবাইনগুলো বিদ্যুৎ তৈরী করতে ঘুরে সব ফ্রিজ হয়ে গেছে এই আবহাওয়ায়। তাই এতো টানাটানি।
দৌড়ে প্রথমে ফোনে চার্জ দিলাম ।
ফোন করছে অনেকে ধরা হয়নি, দুই একজনকে ফোন দিলাম, পরিচিত জনদের মধ্যে দেখলাম কয়েকজনের বাসায় বিদ্যুৎ আছে, বলছে তাদের বাসায় চলে যেতে। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম বাসায় থাকবো। ইমতিয়াজ হোটেলের খবর নিয়ে রাখলো। বলা যায় ততক্ষনে মোটামুটি সব ভালো হোটেল অগুন্তিক আগুন্তুকে ভরপুর হয়ে উঠেছে,ভরে গেছে। বাসাবাড়ী ছেড়ে অনেকেই ছুটেছে হোটেলবাসী হতে। বললাম এমন উইন্টারেস্টিং সিচুয়েশন জিন্দেগীতে দেখিনি, দেখি না কি হয়। একই সাথে এটি ইন্টেরেস্টিং এবং প্রশ্ন বিদ্ধ সমস্যা ও পরিস্থিতিতে ভরপুর। ইমতিয়াজ মেয়েকে বললো, তোমার মা ঘরে দাড়ায়ে দাড়ায়ে বরফ এর মূর্তি হয়ে যেতে চাইছে। এটুকু বলেই থামে নি, আরো বলেছে, এক মহিলা অসীম সাহস নিয়ে বাঘের সামনে গিয়ে দাড়ায়ে গিয়েছে, হয় সে বোকা না হয় নির্বোধ এবং কি করছে তা সে জানে না, কিন্তু তার বর বলছে সবাইকে আমার বৌয়ের কি সাহস বাঘের সামনে গিয়ে দাড়ায়ে আছে। সে একটি হোটেলে দুইদিন পরের থেকে কয়দিনের জন্য রুম বুক করে ফেললো। মেয়েকে বললো, আগামী দুইদিন এভাবে গেলে নিশ্চিত তোমার মা বাঘের মুখের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। ওকে ব্যাগে ভরে বাঘের সামনে থেকে সরাতে হবে। আমি তখনো যথেষ্ট সাহসী , বললাম ভয়ের কিছু নেই, আল্লাহ ভরসা।
উপরে নিচে যত ছোট বড়ো টুকরাটাকরা হিটার রয়েছে সেগুলোও কানেকশন দিয়ে দিলাম। ইলেকট্রিসিটি আসা মাত্রই সেট্রাল হিটিং সিস্টেম তো সাথে সাথেই ওন হয়েছে। ঘর গরম হোক আগে। এতো জামা কাপড়ের ভার নিতে পারছে না শরীর।
ভয়ে ভয়ে আছি কারেন্ট না চলে যায়, ঘন্টায় ঘন্টায় ঘড়ি দেখছি।
কারেন্ট যাচ্ছে না দেখে আমরা খুশি।
পাঁচটা বাজে, ছয়টা বাজে। রাত হয় হয় টিভি চলছে। খাবার সব গরম করে রেখেছি। ফ্লাক্স বের করে গরম পানি করে ভরে রেখেছি। আর যাই হোক চা বাদ দেওয়া যাবে না। ভাগ্গিশ হোটেলের একটা রুমে গিয়ে উঠিনি। বরঞ্চ হেটে চলে নিজের ঘরে বসে অবাক করা প্রকৃতির খেয়ালের সাথে দুলছি, নিজেকে একোমোডেট করছি নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে। এডভেঞ্চারাস পরিবেশ ওপরিস্থিতি। ধাম করে গেলো চলে কারেন্ট ৭টা বাজতেই। টিভিও ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেলো। ফায়ার পেলেসের জন্য লক কাঠ কয়লা কিছুই আর কোথাও পাওয়া যায় নি। মানুষজন এতো চালাক আমরা যাবার আগেই সব কিনে নিয়েছে।

ইমতিয়াজ বললো চলো সবাই উপরে চলে যাই, সোজা তোমরা গিয়ে উপরে শুয়ে পড়ো। শুম একটা গল্পের বই নিয়ে এসে শুলো আমার কাছে। মোমের আলোতে সে বই পড়ছে। আমি ওকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকলাম। ইমতিয়াজ ঘরে ঘরে হাটা চলা করছে আর প্ল্যান করছে কি কি করা দরকার। বললো, পোপেন কিনতে হবে, ক্যাম্পিং চুলা কিনতে হবে, তারপর নিজে নিজেই আবার বললো, আবার যখন এরকম হবে তখন আর এগুলো কোথায় রেখেছি তাই খুঁজে পাওয়া যাবে না। গেলো বিশ বছরে এরকম কেও দেখেনি,আগামী বিশ বছর পর যখন আবার হবে তখন কে কোথায় থাকবো কে জানে। ফোনে টেম্পারেচার দেখছে। হঠাৎ খবর এলো ফোনে আমাদের এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিতে এসেছে তার নেপালি প্রতিবেশী, কারণ ওদের ছাদ বরফের ভার সইতে না পেরে ধসে পড়েছে। আরেকজন জানালো, তারা হোটেলে আছে কিন্তু সেখানেও ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। বাসা থেকে কাজ করতে না পেরে অনেকেই আজ আমাদের অফিসে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু অফিসেও কারেন্ট নেই। একজন জানালো, পাওয়ার ফ্রাকচুয়ানে তার পিসি-র হার্ড ড্রাইভ মারা গেছে। উনি যখন ফোন করে বলছিলেন আমি শুনলাম ওনার পিসি হার্ট এটাকে মারা গেছেন। আমি ইন্নালিল্লাহ পড়াতে উনি অবাক হয়ে বললেন আপনি পিসির জন্য কেন ইন্নালিল্লাহ পড়ছেন। আমি আরো বেকুবের মতো বললাম হিন্দু হলে কি বলতে হয়, রেস্ট ইন পিস কি! আমি ধরে নিলাম এই ভাবী আগে হয়তোবা হিন্দু ছিলেন এখন বিয়ে করে মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু অভ্যাস বসত পিসি-ই ডাকেন বাবার বোনকে। মহিলা এবার বলছেন, হোয়াটস রং ভাবি? কম্পিউটারের জন্য কেউ এসব বলে! ততক্ষনে আমার মাথায় ঢুকেছে। আমার মনে হচ্ছিলো নিখাঁদ অন্ধকারে আমার ব্রেইনে আলো যাচ্ছে কম। তবে ওই ভাবীর দুঃখের কাহিনী শেষ হয়নি। তিনঘন্টা বসে থেকে হার্ড ড্রাইভের ইমেজ ঠিক ফিরে পাবার মুহূর্তে তার নিজের অফিসের কারেন্ট চলে গেছে, বাসায় ফিরে গিয়ে রিবুট করতে গিয়ে দেখলো বাসায় ফিরে আসা কারেন্টও চলে গেছে। অযথাই সারাটা দিন বরফের মাঝে দোড়ঝাপ করে বেড়ালেন উনি।

আরেকজন ফোন করে জানালেন,"ফেমা " নামের সংস্থাটি ফোন করলে হোটেলের থাকার খরচ দেবে। সবাই যেন ওদের ফোন নম্বর ফেইসবুকে শেয়ার করে অন্যদের জানায়। আমার মনে হয় না যারা এফোর্ট করতে পারে তাদের দেবে, সবাইকে দেবে না। রিচার্ডসন মসজিদে এবং আরো কিছু মসজিদে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে । অনেকে যারা পরোপকারী এবং বাসায় বিদ্যুৎ আছে তারা রেঁধে ওখানে খাদ্য পাঠাচ্ছেন সবার জন্য, সকলে সকলের জন্য। ডালাসে বসবাসকারী বিভিন্ন দেশের মানুষ যারা মসজিদে আশ্রিত তাদের সবার জন্য দেশ কাল জাতি ভেদে নির্বিশেষে এই উদ্যোগ। একজন বললো, কোন এক ফার্নিচারের দোকান খুলে দেওয়া হয়েছে রাতে থাকবার জন্য, এটি টিভিতে দেখিয়েছে, নতুন নতুন খাট পালংয়ে গিয়ে মানুষ বাসা থেকে আনা চাদর বিছিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করছে, মেট্রেস তো এই দেশে দোকানের সব খাটের উপরই পাতা থাকে, বড় কথা হিটার চলছে দোকানে, আলো আছে।
এদিকে দেশ থেকে ভয় পেয়ে দলে দলে আত্মীয় বন্ধুরা ফোন করতে শুরু করেছেন। ফোন চার্জ দেওয়া সম্ভব নয় বলে, কথা এক লাইনের বেশি বলা যাবে না বলে, রেখে রেখে দিলাম। আমার বর এই মাঝ রাতে গেরাজে গেলো তার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফোনে চার্জ ফিরিয়ে আনতে। ফোন এখন খুব জরুরি, একে অচল হতে দেওয়া যাবে না কোনো ভাবেই। গেরাজের দরজা বন্ধ এই অবস্থায় স্টার্ট দিয়ে চার্জ দেওয়া রিস্কি, কার্বন মনো অক্সাইড বের হওয়ার ভয় থাকে, মানুষকে খুব দ্রুত বেহুশ ও মেরে ফেলতে পারে। আমি তাই ডেকে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে নিলাম।
কিন্তু একটু পরে যখন আরো ঠান্ডা হয়ে এলো ঘর তখন যখন আমরা আরো ২টো কম্বল নিলাম ইমতিয়াজ বললো, আমাদের অন্য গাড়িটা যেটি ড্রাইভ ওয়েতে খোলা আকাশের নিচে ওতে গিয়ে বসবে নাকি হিটার অন করে। বললাম, মোটেও না। এতো বরফ ডিঙিয়ে ওটাতে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে বললো, আমি গিয়ে গরম করছি গাড়ি তারপরে তোমরা মা-মেয়ে কমফোর্টার নিয়ে চলে এসো। আকাশ দেখে দেখে ঘুমানোর তো তোমার অনেক শখ। আমি রাজি হলাম না। গাড়ি গরম করতে করতে সেই-ই ঠান্ডায় জমে যাবে। তুষার পড়তে শুরু করলে গাড়িতে বসে তা দেখা যেত, সেটা বেশ দারুন হতো কিন্তু এও ভাবলাম চারদিকে বরফ জমে আমরা ওই রাস্তায় গাড়ির ভেতরে আটকে গেলে তখন কি হবে! ওকে তাই বললাম লেপের নিচে ঢুকে থাকো। সে ঠান্ডা সইতে পারে না, কিছুক্ষন পরে উঠে গেলো গাড়িতে হিটার ওন করে বসে থাকতে। আমিও না ঘুমিয়ে দুই মিনিট পর পর ওকে ফোন করে দেখতে লাগলাম, ওর হাল কি, বেঁচে আছে তো! আমার টেনশন তো সে বুঝলোই না উল্টা বিরক্ত হলো এতো ফোন কেন করছি!ফোনের চার্জ নষ্ট হচ্ছে বলে রাগ করছে।আমার যে জান উড়ে যাচ্ছে টেনশনে সেটা বুঝলো না। কি কপাল!

তবে ভালো যে এই, ও যেতে না যেতেই কারেন্ট চলে এলো। রাতের ২টা তখন। ইমতিয়াজও বাসায় ঢুকলো। ৭ ঘন্টা ছিল না, থাকবে মনে হয় পরের ৭ ঘন্টা। আবার তাড়াতাড়ি ঘর গরম করার চেষ্টা। নিচে গিয়ে গভীর রাতে রোজার মতন করে এটা ওটা খেলাম, কিন্তু হায় খাবার গরম করতে গিয়ে দেখলাম মাইক্রোওয়েভ নষ্ট হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটর এতো রংবাজ মনোভাব নিতে পারে নাই। গাল ফুলিয়ে ফেলেছে। ইমতিয়াজ বললো চলো গেরাজে আরেকটি মাইক্রোওভেন রাখা আছে, নিয়ে আসি ওটা ভিতরে, কিন্তু সেই ঠান্ডা, আমি গেলাম না গেরাজে, কিন্তু সে মেয়েকে নিয়ে ভেতরে নিয়ে আসলো, বললো কোন সময়ে আবার কারেন্ট চলে যাবে কেও জানে, করে ফেলি কাজটা, এটা লাগিয়ে দেই। ভোর হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় রাত শেষ হচ্ছে। আরেকটা নতুন সকাল। আমরা ঘুমাতে গেলাম। মনে প্রাণে চাইছি দিনগুলো শেষ হোক দ্রুত।

আমার ঘুম ভাঙলো ১২টায়। হায় হায় অফিস! ইমতিয়াজ অফিস করছে,আমাকে জাগায়নি, বললো সেই যে এসেছিলো মাঝরাতে তারপর ২ ঘন্টার জন্য কারেন্ট একবার চলে গিয়ে বেলা ১০টা থেকে আছে। জানতে চাইলাম, মঙ্গলবারে কি লাঞ্চ থেকেই খেতে শুরু করতে হয়। সে বললো আমি সকাল থেকেই খাচ্ছি, বলে হাসলো। সোজা আমি অফিসের সার্ভারে গিয়ে ঢুকলাম, কাজে বসে গেলাম, কিন্তু ৩টা বাজতেই আবার কারেন্ট চলে গেলো, জি আবার। কি আজব! কি অসহ্য। ফিরে এলো রাতের ৯টা থেকে ১০টা, মাত্র এক ঘন্টার জন্য, যেন ডিনার করার সময় দিয়েছে। তার আগেই আমরা বের হয়েছিলাম মোম কিনতে, খাদ্য কিনতে, চারদিক দেখতে। কোথাও কিছু খোলা নেই। শুমশুমি থাই থেকে কোরিয়ান হয়ে ইন্ডিয়ান দেশি বিদেশী অনেক দোকানে ফোন করল খাবার অর্ডার করতে। নাই কিছু খোলা। সব দোকান বন্ধ, অন্ধকার। কিন্তু ধবধবে সাদা চারদিক। সুন্দরী ভারী সুন্দরী ভুবন। এ এক অন্যরকম সুন্দর। ইন্টারেষ্টিং। অনেক ক্ষন ঘুরে ফিরে আমরা বাসায় আসলাম রাতের ৯ টায়, আমরা আসতেই কারেন্ট এলো। আমাদের দেখেই যেন এলো হাই বলতে। ভাবখানা, তোমরা কেমন ছিলে আমাকে ছাড়া। বলিনি তাকে, আমি পথে পথে ঘুরে ভেবেছি সেই আদিম মানব আর মনবী কেমন ছিল চাঁদের আলোয়!! কতটা সুখকর ছিল তাদের সেই জীবন! তারপর বিদ্যুৎরানী চলেও গেলো কিছুক্ষন পরে বিদ্যুৎ বেগে ধেয়ে।। আমাদের ছেড়ে গেলো টুইংকেল টুইংকেল লিটল ষ্টার এর হাতে। টিভিটা আমরা আনপ্লাগ করে রেখেছিলাম বাঁচাতে ওটাকে যাতে মাইক্রোওয়েভের মতো অবস্থা ওর না হয়। টিভিও আর চালানো হলো না। তাপমাত্রা দেখলাম ১ ডিগ্রি। তিনটা কোট গায়ে আছে। ছবি তুললাম এদিক ওদিক বরফ ঢাকা চারদিকের।

এতো কিছুর মধ্যেও দেখলাম আনন্দ মানুষ করেই নেয়, বেঁচে থাকার জন্য এটি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এই বরফে শাড়ি পরে সুন্দর ভাবে সেজে ছবি তুলেছেন প্রচুর ভাবী, ওনাদের তুষার ছড়ানো ছিটানো ছবি নিঃসন্দেহে ক্ষনিকের জন্য হলেও যে দেখেছে ফেইসবুকে তাকে আনন্দ দিয়েছে প্রচুর। কারো কারো সুইমিং পুল বরফে শক্ত হয়ে গেছে, ইঁদুর কুকুর বিড়াল যা আছে সব দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাতে, উচ্ছাসের সাথে সেই ঘটনা তারা লিপিবদ্ধ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । আমাকেও তা উল্লাসিত করছে। যারা ফেইসবুক দেখছেন কারেন্ট বিরতিতে তারাও খুশি হয়েছেন। একজন জানতে চাইছে ফেইসবুকে, বিড়াল কুকুর ইঁদুর এদের মধ্যে কে বরফ ভেঙে পানিতে পরে গেলে আপনিও বরফ ঠান্ডাকে তোয়াক্কা না করে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? ওই ভাবীওসাথে সাথে উত্তরে লিখেছেন "আপনি"। কেও আপনাকে খুঁচিয়ে চলে যাবে সেই যুগ এখন হিমাগারে।

হিম হিম তুষারে খরগোশের পথ চলার ছাপ এতো পরিষ্কার যে ওই পথে ফলো করে খুঁজে পাওয়া যাবে যেন তাদের বাসস্থান, ঠিকানা।স্নো-বল আর স্নো-মেন তো দেখা গেলো যাদের স্কুল পড়ুয়া বয়সী ছেলে মেয়ে আছে তাদের সবার বাড়ির সামনেই একটা করে দাঁড়িয়ে গেছে। মায়েরা খুজেছে বাচ্চাদের মাফলার হাতমোজা ,ততক্ষনে ওগুলো চলে গেছে স্নো-মেনের গলায় ।পাখিদের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠলো চারদিক। যে পাখিটি এবার প্রথম তুষার ঝরতে দেখলো,আমি জানি সেও খুশি সাদা ছেড়ে সব আবার সবুজ হচ্ছে দেখে। জি, আমাকে সে এসে বলেছে, আপনাকেও পাখি কিন্তু বলেছিলো, বুঝেননি কি আপনি তা!! নিঃসন্দেহে মাতিয়ে রাখা জীবন উপভোগ্য। মেতে থাকার জন্যেও কি অনেক মানুষ ভালোবাসে বেঁচে থাকতে এই মর্তে!

তৃতীয় এই রাতে কারেন্ট এলো ৩টার দিকে, তবে এবার থেকে গেলো, আর গেলো না।
কিন্তু ঠান্ডায় জমে গিয়ে বাস্ট করলো পানির পাইপ। তবে এটা হলো আমাদের গ্যারাজে, গেরাজের বাহিরে একটা পানির কল আছে সেটাই এই কান্ডটা ঘটালো। পাইপ থেকে পানি গলে নদী হয়ে যাবে বুঝি। কিন্তু সব পানি বয়ে চলে গেলো গেরাজের বাহিরে। খুব অল্পের উপর দিয়ে আমরা রক্ষা পেলাম। সিটির অফিসে ফোন করে লোক ডাকা মাত্রই এলো।এসেই পানির কানেকশন বন্ধ করে দিলো। আমি আর শুমি ভাগ্গিশ বালতি, পাতিল, যা পেলাম সব কিছুতে পানি ভরে রেখে দিলাম। ডালাসবাসী অনেক ভাবীর প্রশ্নই ছিল বালতি পেলাম কোথায়! একজন বললেন, এই আমেরিকায় থাকে নাকি কারো বাসায় বালতি! আমার কাছে তিনটা আছে! কবে যেন কিনে গেরাজেই রেখে দিয়েছিলাম, আজ কাজে এলো। সকাল হতেই প্লাম্বার এসে তা
ঠিকও করে দিলো। কিন্তু চারদিকে শুনলাম প্লাম্বার এর ক্রাইসিস। সবারই কিছু না কিছু বাস্ট হচ্ছে ।চারদিকে যেন বাস্ট এর ব্যস্ত বজ্রপাত। ফেইসবুকে প্লাম্বারদের হাতে পায়ে প্রচুর সোনা পরিয়ে ছবি দিয়ে তারা যে এই সপ্তাহের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী ব্যক্তি তাই ঘোষণা করে বলে দিয়ে মজা করেও গেলো অনেকে।
তারপরের ৩ দিনের পুরাটাই আমাদের বাসাতে বিদ্যুৎ পানি সব ঠিক থাকলো, সপ্তাহ শেষ হলো বিদ্যুৎকে সাথে জাপটে ধরে নিয়ে। কিন্তু আগে যাদের বাসায় বিদ্যুৎ ছিল বিদ্যুৎ হারিয়ে তাদের বাসাগুলো অন্ধকার হয়ে গেলো। একদিকে আসে তো আরেক দিকে যায়। তুষার ঝরা বন্ধ হয়েছে। বৃহস্পতি শুক্রুবারে বরফও গলতে শুরু করলো। এরমধ্যে টেক্সাসের সিনেটর ট্রেড ক্রুজ আমাদের আর তার কুকুরকে যার নাম "স্নোফ্লেক" তাকে ফেলে মেয়ের কথায় মেক্সিকোর কানকুনে ভেকেশনে চলে গেলো। যত্রতত্র যেখানেই তাকে দেখা যায় ছবি তুলে জনগণ সোশ্যাল মিডিয়াতে দিতে থাকলো, সে ফিরে এসে বাঁচলো। আমাদের পাশের বাসার আলেক্সও মেক্সিকোর টুলুমে চলে গেলো বৌ নিয়ে, তার বাসারও পাইপ বাস্ট হয়েছে, মহা দামি প্লাম্বারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার জন্য, অবশেষে উনি পেলেন তাদের, দুই সপ্তাহ পরে তার প্লাম্বার আসবে। তিনিও তখন ফিরবেন। তবে আলেক্স আমজনতা, সে যেতে পারে কিন্তু যার কাঁধে দায়িত্ব থাকে তাকে দাঁড়াতে হয় শক্ত হয়ে জনতার জন্য, এটাই সময়ের দাবি।
আচ্ছা আরেকটা খবর, ওই যে আমার ডানদিকের বাসার বাসিন্দা, উনি পুরা সপ্তাহটা দরজা জানালা বন্ধ করে চুপচাপ ভিতরে বসে থাকলেন, উকিও যেন দিলেন না। আজ সব ঠিক হয়ে এক সপ্তাহ পরে সূর্য যখন ঝিলমিল করছে তখন উনি বের হলেন পৃথিবী পরখ করে দেখতে। উনি অবাক হয়ে গম্ভীর ভাবে এদিক ওদিক দেখছেন। আমি ওনাকে দেখছি আরো অবাক হয়ে। গুহা মানব যেন বেরিয়েছে জগতের হালহকিকত দেখতে।
গেল রোববারে শুরু হয়েছিল তুষার বরফে হিম হয়ে যাওয়া আমাদের Winteresting জীবন। আজ এই বোরবার (২১/২/২১) সব স্বাভাবিক! জীবন চিত্র বড় বিচিত্র,বৈচিত্রময়। মনে হয় সবকিছুরই একটা নিজস্ব সংগীত ছন্দ মায়া মাত্রা ভাষা আছে। প্রাকৃতিক কষ্টেরও তাই। বিপর্যয় এসে কেবলই যেন মনে মনে বারে বারে বলে যায় শুদ্ধ হতে, মানবিক হতে সবাইকে।