আভলাবারি রোডের ছাপাখানা: এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস

সঞ্জয় দে
Published : 2 Feb 2020, 02:45 PM
Updated : 2 Feb 2020, 02:45 PM


১৯০৬ সাল।
এপ্রিলের প্রথমার্ধ। মেঘলা দিনের পড়ন্ত বিকেল। শীতের হিমেল হাওয়া এখনো বিদেয় নেয়নি তিফ্লিস উপত্যকা হতে। মাঝে মাঝেই সেই হাওয়া কাঁপিয়ে দেয় শহরের প্রধান সড়কে মৃত কংকালের মত দাঁড়িয়ে থাকা বার্চ গাছের পত্রবিহীন শাখাগুলোকে। অনেকে সেই তুহিন হাওয়ার কবল থেকে বাঁচার জন্যে গলার মাফলারকে কিছুটা উপরে পেঁচিয়ে ঢেকে রেখেছেন মুখায়ব। 'স্বাধীনতা' সড়কের এক পাশে দুজন বৃদ্ধা ঘরে বানানো জ্যাম নিয়ে বসেছেন। আপাদমস্তক মোটা কম্বলে ঢেকে তারা এমনভাবে উবু হয়ে বসেছেন, মনে হয় জ্যামভর্তি বয়ামের ডালির পাশে কে যেন বড়সড় পুটুলি রেখে গেছে। এই সড়কের একেবারে শেষ প্রান্তে 'হাজার সাধুর সেতু'। লোকে বলে, প্রায় হাজার বছর আগে কোনো এক নিপীড়ক তুর্কি সম্রাট এ-তল্লাটে ধারালো তলোয়ার হাতে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন– হয় স্বধর্ম ছাড়, নয়তো জীবন দাও। সাধুরা জীবন দানের পন্থাকেই শ্রেয়তর বলে মনে করেছিলেন। পরিণামে সেদিন এই সেতুর উপর লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে শিরশ্ছেদ করা হয় হাজারো সাধুর। তাতে করে কোয়ালা নদীর জল রূপান্তরিত হয় রক্ত গঙ্গায়। সেই থেকে লোকে এই সেতুকে ডাকে হাজার সাধুর সেতু বলে। প্রস্তর নির্মিত এই সেতুর মাঝখানে এসে দাঁড়ালে ডান ধারে চোখে পড়ে তিফ্লিস দুর্গ, আর বাঁ-ধারে খাড়া পাথুরে পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়ানো সিওনি ক্যাথেড্রাল। যেন মনে হয় ক্যাথেড্রাল আর দুর্গ– দুজনে দুজনকে চোখে-চোখে রেখেছে, মাঝে বয়ে চলা নদীটিকে সঙ্গী করে। সেতুর দু'পাশে পাথরের নকশা করা কোমরসমান রেলিং। সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়ালে নীচে বয়ে চলা নদীর সবুজাভ জলের ঘূর্ণাবর্ত অকারণেই হাতছানি দিয়ে ডাকে। আর সবায়ের মত কমরেড কোবা-ও সেতুর এই জায়গাটিতে এসে মাঝেমাঝেই থমকে যান। একবারের জন্যে হলেও ঝুঁকে দেখে দেন- নদীর দুরন্ত জলের ক্রিয়াকলাপ। তবে আজ সে-সবের অবকাশ নেই। আগামী সপ্তাহেই পার্টির সম্মেলনে যোগ দেবার জন্যে তাকে যেতে হবে মেলা দূরের দেশ সুইডেনের স্টকহোমে। সেখানে যাবার আগে এখানকার পার্টির বাকি কমরেডেদের সাথে কিছু শলাপরামর্শ প্রয়োজন। কী সেই শলাপরামর্শ– সে প্রসঙ্গে যাবার আগে কেন তিনি এই শহরে ঘাঁটি গেড়ে আছেন, সে সম্পর্কে কিছু না বললে ঘটনা এগিয়ে নেয়া কঠিন।

কমরেড কোবা'র বাড়ি তিফ্লিস থেকে মাইল চল্লিশেক দূরের গোরি শহরে। তবে বাল্যকালের সেই গাঁ তিনি ছেড়েছেন বছর পনের আগেই। মাঝে কিছুদিন এই তিফ্লিসের একটি ধর্মীয় স্কুলে মায়ের চাপাচাপিতে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে টেকা হয়নি বেশিদিন। অল্প কিছুদিনের মাঝেই রাজনীতিতে জড়িয়ে সেই স্কুল থেকে বিদেয় নিয়ে নেন। তারপর ভবঘুরের মত ঘুরেছেন নানা শহরে। থেকেছেন তেল শ্রমিকদের শহর– বাকু'তে। সেখানে শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ করেছেন। এভাবেই একসময় তিনি পড়ে যান জারের গুপ্ত পুলিশের নজরে। আজারবাইজান, জর্জিয়া– উভয়েই তখন জারের করতলে। কোবা'কে পাঠানো হল দূর সাইবেরিয়ায়। নির্বাসনে। তিনি অল্পকিছুদিনের মাঝেই সেখান থেকে পালালেন। ফিরে এলেন মাতৃভূমি জর্জিয়ার তিফ্লিস নগরে। কিন্তু সাইবেরিয়া থেকে পলাতক আসামি হিসেবে তিফ্লিসের মুক্ত হাওয়ায় তিনি ঘুরে বেড়ান-ই বা কী করে? লোকে সন্দেহ করে– তিনি হয়তো তলে তলে গুপ্ত পুলিশের তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করেন। তার বিনিময়েই হয়তো পেয়েছেন– এ-শহরে থাকবার স্বাধীনতা। তবে এ সকল-ই লোকের অনুমান। পেছনের সত্যতা আজ অবধি জানা যায়নি।

তিফ্লিস তখন বেশ জমজমাট শহর। এখান থেকে রেলে চেপে পশ্চিমের শহর বাটুমি'তে যেয়ে কৃষ্ণ সাগরের জাহাজ ধরা যায়। আবার ওদিকে দখিন পানে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলা যায় কাস্পিয়ান সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ঝলমলে শহর বাকু'কে। যোগাযোগের এমন কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণে শ্রমিক আর সুশীল সমাজ– উভয়েরই প্রভুত উন্মেষ ঘটে এ সময়ে। তাঁদের হাত ধরেই মার্ক্সপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্রেট আন্দোলনের ঢেউ তিফ্লিসের তীরে এসে আছড়ে পড়ে। আর যারা এই ঢেউ-এর অগ্রভাগে নাও ভাসিয়েছিলেন, তাদের মাঝে উদারপন্থী ও সশস্ত্র অভ্যুথানের মাধ্যমে বিল্পবপন্থী– উভয়েই ছিলেন। প্রথম উপদলটি ১৯০৩ সালের মহা সম্মেলনের পর পরিচিত হয় মেনশেভিক হিসেবে; আর দ্বিতীয় দলটি পরিচিতি পায় বলশেভিক হিসেবে। তিফ্লিস শহরে কিন্তু মেনশেভিকপন্থীদের-ই সংখ্যাধিক্য ছিল। এ ছাড়াও কিছু মানুষ ছিলেন, যারা দোদুল্যমান। পার্টির কোন উপদলের সাথে মিশে যাবেন, সেই নিয়ে তাঁদের মাঝে ছিল দ্বিধা আর সংশয়। একই ব্যাপার কমরেড কোবা'র মাঝেও ছিল। তিনি-ও প্রথমে মেনশেভিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু গত ডিসেম্বরে ফিনল্যান্ডে যাবার পর থেকে তাঁর চিন্তা-চেতনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন তিনি অনেকটাই যেন বলশেভিক। বিশেষ করে তামেরফ্রস শহরের গোপন নিবাসে সাক্ষাতকালে কমরেড উলিয়ানভ যে উগ্রপন্থার মন্ত্রণা দিয়েছেন, সেটি তাকে আচ্ছন্ন করেছে অনেকটাই।

উলিয়ানভ তাকে কী বললেন? ১৯০৫ সালে জার'কে হটাবার একটা মওকা তৈরি হয়ে যায় হটাৎ-ই । সুবিশাল রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী পেত্রগ্রাদে আচমকা এক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ওদিকে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরের নৌ শ্রমিকেরাও বিদ্রোহ করে বসে। বন্দরে তখন মোতায়েন ছিল বিশাল এক যুদ্ধজাহাজ। উলিয়ানভের পরিকল্পনা ছিল– বলশেভিকদের মাধ্যমে নৌ-শ্রমিকদের প্ররোচিত করে যুদ্ধজাহাজের দখল নেয়া। কিন্তু একটু দেরি হয়ে যায়। ফুটন্ত পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে যুদ্ধজাহাজকে সরিয়ে নেয়া হয় রোমানিয়ায়। এই পরিকল্পনাটি ভেস্তে গেলেও উলিয়ানভ টের পেয়ে যান– জারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে গেলে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ কিংবা সহায়তা প্রয়োজন হবেই। শুধু তা-ই নয়, এভাবে বিল্পবের চাকা সচল রাখতে প্রয়োজন বিপুল অর্থের-ও। সদ্য ত্রিশ পেরনো কমরেড কোবা উলিয়ানভের মুখে এই রক্ত উষ্ম করা বিপ্লবী বুলি শুনে উদ্দীপ্ত হন। তাঁর হটাৎ মনে হয়– ঠিক যেন এমনই চনমনে সংগ্রামের সন্ধানে এতটা কাল পথ হেঁটেছেন। উলিয়ানভ'কে তিনি কথা দেন– জর্জিয়ায় ফিরে টাকা জোগাড়ের একটা উপায় তিনি বার করবেনই। সেটা সোজা পথে হোক, আর বাঁকা পথে হোক। কথা হয়, উলিয়ানভের পত্রিকা 'ইস্ক্রা' নিয়েও।

ইস্ক্রা ছিল উলিয়ানভের বলশেভিক মতাদর্শ প্রচারের প্রধানতম স্তম্ভ। তিনি যখন জার্মানির স্টুটগার্টে, তখন সেখান থেকেই এটি প্রকাশিত হত। মূলত রুশ হরফে। তারপর সেগুলো পাঠানো হত রাশিয়ায়। তবে সরাসরি নয়। প্রথমে সেগুলো পাঠানো হত প্রাগে। প্রাগ থেকে রাশিয়ায় বিভিন্ন জায়গায়। পুলিশের চোখে ধুলো দেবার জন্যে এই ব্যবস্থা। তবে সেই সুদূর দক্ষিণের রাজ্য জর্জিয়ায় ইস্ক্রা'কে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই উলিয়ানভ আর কমরেড কোবা'র মাঝে আলোচনা হয়, কী করে ইস্ক্রা'কে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া যায়। বিশেষ করে জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান ও আজেরি – এই তিনটি ভাষায় ইস্ক্রা'র ভাষান্তর করে মুদ্রণের ব্যবস্থা করলে বেশ হয়। কারণ, তাতে করে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়া হবে। ঠিক হয়– পার্টির কেও একজন লন্ডন কিংবা প্রাগ থেকে ইস্ক্রা'র সংখ্যা নিয়ে তিফ্লিসে যাবেন। সেখানে বাকি কাজটুকু অর্থাৎ ভাষান্তর করে মুদ্রণের ব্যাপারটুকুর দেখভাল করবেন কমরেড কোবা।

কোবা অ্যাজ যেখানে চলেছেন সেটি হল ইস্ক্রা মুদ্রণের সেই ছাপাখানা। এটি অবশ্য শুধু ছাপাখানা-ই নয়, এখানে চলে পার্টির গোপন বৈঠক-ও। ছাপাখানাটি কোয়ালা নদীর পূর্ব প্রান্তে, আর্মেনীয় পাড়ায়। শহরের ও দিকটা একটু নিরিবিলি। এ পাড়ায় সংক্রামক ব্যাধির হাসপাতাল থাকায় লোকে খুব একটা এদিকটা মাড়ায় না। পাড়ার চারধারে লাইম গাছের ঘন বীথি। এখানে-সেখানে অল্প দুয়েক ঘর আর্মেনীয় বসতবাড়ি। আর এই বাড়িগুলোর মাঝ দিয়ে সর্পিল বঙ্কিমতায় এগিয়ে গেছে আভলাবারি রোড, যার শেষ মাথায় রয়েছে রহস্যময় দু কামরার কাঠের বাড়ি। বাড়িটির মূল কাঠামো ভূমি থেকে কিছুটা উঁচুতে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় সামনের বারান্দায়। পাড়ার লোকেরা দেখে– প্রায়ই সেই বারান্দার রেলিঙে বসে অলস ভঙ্গিমায় কুড়ি পেরনো এক যুবতী উলের কাটায় সোয়েটার বুনে। এই মেয়েটি, ওর বাপ আর আমাদের কমরেড কোবা– এঁরা ভিন্ন আর কাউকে সাধারণত দিনের আলোয় সেই বাড়ি অভিমুখে দেখা যায় না। পার্টির বাকি যারা আসেন, তাঁরা আসেন রাতের আঁধারকে চাদর হিসেবে ব্যবহার করে। পাড়া প্রতিবেশীদের কানাঘুষো বন্ধ করে দেবার জন্যে বাড়ির মালিক রস্তমসভিলি রটিয়ে দিয়েছেন– অনাথ যুবক কোবা'কে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন নিজ কন্যার সাথে বিয়ে দেবেন বলে। অবশ্য এই রটনার পুরোটাই নিছক রটনা নয়। সেই উল বোনা মেয়েটি, মানে রস্তমসভিলি'র কন্যার সাথে কোবা'র মন দেয়া-নেয়া চলছে কিছুদিন ধরেই। ঠিক হয়েছে, কোবা স্টকহোম থেকে ফিরলেই বিয়ের ব্যাপারটা সেরে ফেলা হবে। তিফ্লিসে বিয়ে হলে অযথা ঝুঁকি নেয়া হয়। তাই ঠিক হয়েছে, বিয়েটা হবে পশ্চিম জর্জিয়ার খাখায়া শহরে। ওখানে রস্তমসভিলি'র কিছু জ্ঞাতি আত্মীয়স্বজন আছে। ওরাই বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা দেখভাল করবে।


রস্তমসভিলি কোবা'কে পূর্ব থেকে চিনতেন না। তিনি কাজ করতেন রেলের যান্ত্রিক শেডে। পেশায় মেকানিক। সেই সূত্রেই রেলশ্রমিকদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে তার পরিচয়; আত্মায় ধারণ। এমনকি এই আন্দোলনে মজে গিয়ে শহরের বাকি সমমনা নেতাদের সাথে বসে ঠিক করলেন– নিজ খরচে তিনি একটি গৃহ নির্মাণ করবেন, যেটি মূলত ব্যবহৃত হবে আন্দোলনের গুপ্ত কার্যালয় হিসেবে। আর সেভাবেই বছর তিনেক আগে এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। অনেকটা ওই একই সময়ে কোবা সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে তিফ্লিসে এসে উপস্থিত হন। পূর্ব পরিচিত কমরেডরা তাকে এই ডেরায় নিয়ে এসে রস্তমসভিলি'কে অনুরোধ করে– কোবাকে আশ্রয় দেবার। রস্তমসভিলি সানন্দে রাজি হন। সেই থেকে কোবা এখানেই আছেন। দু ঘরের মাঝে বাঁ দিকের ঘরে এক চিলতে খাটে কোবা শোন। আর ডান দিকের ঘরটাতে থাকে বাপ-মেয়ে।

কৌতূহলী পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই যদি হয় গৃহের কাঠামো, তাহলে সেই ইস্ক্রা কিংবা মার্ক্সবাদী আন্দোলনের ইশতেহারগুলো ছাপা হত কোথায়? সেগুলো কি তবে এই দু ঘরের কোনো একটিতে ছাপা হত? উত্তর হল, তেমনটি হলে জারের গুপ্ত পুলিশকে মেহনত করে এই ছাপাখানা খুঁজে বার করতে হত না, পাড়া-প্রতিবেশীরাই হয়তো থানার বড়বাবুর কাছে কানকথা পেড়ে আসতো। ছাপাখানার জন্যে রস্তমসভিলি আরেক পথ বাতলেছিলেন। রেলের যন্ত্র কারখানায় কাজ করতেন বলেই হয়তো এমন একখানা মোক্ষম আইডিয়া তার মাথায় এসেছিল। সেই আইডিয়ার কথাটি বলি।

দু কক্ষের এই বাড়িটির বাইরে উঠোনের এক কোণে কুয়ো ঘর। কাঠের বালতি উপরে ঝুলে থাকা শিক থেকে মোটা রশি বেয়ে নেমে যায় জলের স্তরে। রস্তমসভিলি এই কুয়োর প্রায় বিশ মিটার নীচে এক সুরঙ্গ খুঁড়লেন। ব্যবস্থাটা এমন যে, বালতির ভেতর বসে কুয়োর শেষপ্রান্তে পৌঁছে সেখান থেকে সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিতে হবে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় একটি চৌকা ঘর। ঠিক যেন গুপ্তধনের গুপ্তঘর। তবে গুপ্তধনের বদলে সেখানে আছে ছাপাখানার একটি মেশিন। রস্তমসভিলির অতি বিশ্বস্ত কিছু রাজনৈতিক অনুচর সেই বাকু থেকে একটি জার্মান প্রেসমেশিন এ-গুপ্তকুঠুরিতে এনেছেন। অতটা ভারি মেশিনকে তো আর সেই কুয়োর সঙ্কীর্ণ পথ বেয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই ওটিকে নানা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে তারপর এই ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে এনে জোড়া দেয়া হয়েছে। ছাপাখানা পুরোদমে দাঁড়িয়ে গেলে মূলত কমরেড কোবা-ই এর পরিচালনা দায়িত্ব নেন। শুরুতে ছাপা হতো কিছু রাজনৈতিক স্লোগানের হ্যান্ডবিল। তারপর বছরখানেক বাদে কোবা নিজেই এক মার্ক্সবাদী মন্ত্রে উজ্জীবিত সংবাদপত্র ছাপানো শুরু করেন। নাম – 'মেহনতি জনতার কণ্ঠস্বর'। জর্জিয়ান ভাষায় এই সংবাদপত্রটি ছাপানো হত। কমরেড উলিয়ানভের সাথে সেই ডিসেম্বরের বৈঠকের পর ছাপানখানার কর্মোদ্দীপনা গেছে বেড়ে। তবে এমন একখানা ছাপাখানা তো আর হাওয়ায় ভর করে চালানো যায় না, এর জন্যে মালকড়ি প্রয়োজন। যদিও এক ধরণের পাতলা মামুলি কাগজে পত্রিকা ছাপানো হয়, কিন্তু সেই কাগজ আর কালি কিনতে-ও তো বেশ কিছু টাকা লাগে। ওদিকে আবার কোবা ফিনল্যান্ডে যাবার পর শহরে বড় আকারের ধরপাকড় হয়। তাঁর বেশকিছু চ্যালাচামুণ্ডা ধরা পড়ে। এঁদের পরিবারের কিছু ভরণপোষণের দায়িত্ব-ও কোবা'র কাঁধে এসে পড়েছে। সব মিলিয়ে টাকার বড্ড প্রয়োজন। আজকের বৈঠকটি মূলত এই নিয়ে একটি পথ বাতলানোর নিমিত্তে।

মাফলারে মুখের বেশ খানিকটা ঢেকে রাখলেও দূর থেকে কোবা'কে দেখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো সেই উল বোনা মেয়েটির ঠোঁটের কোণে। কোবা বাড়ির কাছে আসার পর সে উলের কাঁটাদুটো কাঠের রেলিঙয়ের উপর রেখে সংকেত দেয়, আশেপাশে কোন ঘুঘু নেই। তার এ উল বোনার ব্যাপারটি কিন্তু একটি ছলনা। মূলত সে চোখ রাখে, পুলিশের কোনো চর বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছে কিনা– সেটির উপর। যদি করে, তবে ও এক ঝটকায় ঘরে ঢুঁকে ডানধারের জানালার ফ্রেমের নিচে লুকনো একটি বেল টিপে দেয়। সেই বেল তরঙ্গবাহি তারের মাঝ দিয়ে সংকেত পৌঁছায় বাড়ির নিচকার গুপ্ত ছাপাখানায়। সেখানকার লোকেরা তখন প্রেস মেশিন বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে বসে থাকে।

এ বাড়ির উঠোনের একধারে মস্ত সিডার গাছ। কুয়োঘরের চাতালটি ঢেকে গেছে এই গাছের কঙ্কালসার ডালপালায়। আর গাছটির গোঁড়ায় জমিয়ে রাখা হয়েছে উনুনে দেবার কিছু লাকড়ি। খুব কাছেই ধার উঠে যাওয়া কুঠার। কোবা কুঠারটির দিকে এগিয়ে যান। যেন তিনি এগুচ্ছেন আরও কিছু লাকড়ির কাঠ কুঠারাঘাতে ফালা করবেন বলে। চকিতে চারপাশটা আরও একবার ভাল করে দেখে নিয়ে কোবা হটাত বিদ্যুৎবেগে ঢুঁকে যান কুয়োঘরে। যদি কেও তাঁকে ঢোকার মুহূর্তে খেয়াল করে-ও থাকে, তাহলে বড়জোর ভাববে– তিনি বুঝি-বা বাইরে থেকে ফিরে মুখে-চোখে জল দেবার জন্যে সেই কুয়োঘরে ঢুকলেন। অবশ্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই বোঝা যেত– কোথাও একটা গোলমাল আছে। কারণ, সেই কুয়োঘর থেকে কোবা বের হয়ে এসেছিলেন বেশ কয়েক ঘণ্টা পর। মাঝ রাতের দিকে।

পাতালের সেই দশ বাই দশ ফুট ঘরের মাঝে গুমোট আঁধার। মাটির দেয়াল ধ্বসে পড়া থেকে ঠেকাবার জন্যে দেয়ালে গেঁথে দেয়া হয়েছে কিছু ইট। ঘরের দু ধারে দেয়ালের হুকে ঝুলছে দুটো লন্ঠন। সেগুলোর আলোয় স্বল্পালোকিত এই ঘর। এককোণে বান্ডিল করে রাখা কিছু পুস্তিকা। পুস্তিকার উপর ডাই করে রাখা কিছু সিলমোহর, যেগুলো মূলত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জাল সিল। পুস্তিকার বান্ডিলের পাশে মাটির জারে রক্ষিত এসিড,যেটি প্রেসের যন্ত্রের কালি প্রক্রিয়াকরণের কাজে লাগে। আরেক ধারে টিমটিমে পিদিম ধারণকারী আবলুস কাঠের একটি ছোট্ট টেবিল। বসার জন্যে টেবিলের ধারে দুটো টুল।

কমরেড কোবা হামাগুড়ি দিয়ে এই পাতাল ঘরে ঢুঁকে দেখেন– আগে থেকেই উপস্থিত কমরেড মিখাইল জাভাকিশভিলি। ইনি একজন উদীয়মান তরুণ সাহিত্যিক। সাহিত্যিক পরিচয়ের আড়ালে তিনি মেনশেভিক ঘরানার রাজনীতি করে বেড়ান। সেদিক দিয়ে কোবা'র সাথে তার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে। ঘরের একেবারে মাঝবরাবর রাখা প্রেসের যন্ত্রে কিছু ইশতেহার ছাপার কাজ করে যাচ্ছে কমরেড কাকুতসা ও কমরেড স্মিরন। এঁরা দুজনেই অবশ্য বলশেভিক ঘরানার। এঁদের মাঝে একজন আর্মেনীয়। ইস্ক্রা'র আর্মেনীয় ভাষায় অনুবাদ ও মুদ্রণে সে অক্লান্তভাবে সাহায্য করে। ওদিকে জাভাকিশভিলি মেনশেভিক ঘরানার হলেও কোবা'র সাথে তার কিঞ্চিৎ সখ্যতা আছে। মেনশেভিকদের মধ্যে একমাত্র তিনি-ই বলশেভিকদের এই গোপন ডেরার খবর জানেন। মূলত ইনিই এ শহরের মেনশেভিক ও বলশেভিক গ্রুপের মাঝে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি এ শহরে বেশ কিছু পুলিশ ফাঁড়ির অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। দু গ্রুপের ছেলেরা মিলেই সেই কাজটি করেছে। আর সেটি সম্ভব হয়েছিল কোবা আর জাভাকিশভিলি'র পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে।

কোবা ঘরের কোণে রাখা একটি টুল নিয়ে জাভাকিশভিলি'র পাশে গিয়ে বসেন। জাভাকিশভিলি'র চোখে থাকা গোলাকার রিমের চশমার কাচে প্রতিফলিত হয় লন্ঠনের আলো। গোঁফের সূচালো অগ্রভাগে হাত বুলিয়ে তিনি কোবা' র মখায়বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, হয়তো পাঠ করার চেষ্টা করেন এই সুচতুর কমরেডের মূল অভিপ্রায়। যদিও তিনি এ অবধি কোবা'র সাথে নানা ব্যাপারে সহযোগিতা করে এসেছেন, কিন্তু সেই সাথে খুব বুঝতে পারছেন, বলশেভিক এই নেতাটি ক্রমশই যেন হিংস্র হয়ে উঠছেন। তাঁর কানে কথা এসেছে– পুলিশের কাছে কথা পাচার করেছে, শুধুমাত্র এমন সন্দেহে কোবা দলের একটি ছেলেকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইনি যে সামনের দিনগুলোতে এমন আরও কাণ্ড করবেন, সেটি তিনি আঁচ করতে পারেন। আর বলপ্রয়োগের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে বলশেভিকরা একসময় মেনশেভিকদের উপরও চড়াও হতে পারে, সেই ভয়ও তার আছে। কিন্তু মনের সেইসব শঙ্কা আড়াল করে তিনি 'কেমন আছেন কমরেড'- বলে কোবা'র প্রতিউত্তরের অপেক্ষা করেন।


'আপনার সাথে আজকের এই বৈঠকটি একটি বিশেষ কারণে।'– কোবা শুরু করেন। প্রেসের ঘূর্ণন যন্ত্রকে থামিয়ে স্মিরন আর কাকুতসা এদিকে কান খাড়া করে থাকে। 'আমাদের প্রচুর টাকা প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত, টাকা প্রয়োজন আপনাদেরও। পার্টির নানা কাজ সামাল দেবার জন্যে টাকার অভাবে আমরা যেন কয়লাশূন্য রেল ইঞ্জিনের মত হয়ে উঠছি।' এটুকু বলে কোবা একটু থামেন। জাভাকিশভিলি'র মনে পড়ে, কোবা কিছুদিন আগে কয়েকজন মেনশেভিক বিপ্লবীদের সাথে নিয়ে তিফ্লিস শহরের কয়েক বণিকের গদিঘর লুট করেছিলেন। এবারেও কি তেমন কিছু করার ফন্দি আঁটছেন? এ ব্যাপারে তিনি তার লাইনের হাইকমান্ডকে ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন। মেহনতি জনতার জন্যে লড়ছেন তাঁরা। কিন্তু তাই বলে নৈরাজ্যবাদী রাজনীতিকে বরদাশত করা যায় না। আর তাছাড়া ধনী বণিকদের মাঝেও অনেকে আছে, যারা তাঁদের এই রাজশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন করেন। কিন্তু কোবা'র লুটেরা ক্রিয়াকর্মের কারণে তাঁদের মাঝেও তৈরি হতে পারে বাড়তি আতংক। তাই মনে মনে তিনি তৈরি হয়েই থাকেন, এবারে এমন কোনো প্রস্তাব কোবা দিলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাবেন।

জাভাকিশভিলি যখন এসব ভাবছেন, কোবা তখন পরনের কোটের পকেট থেকে বার করেছেন তার প্রিয় এজ ওয়ার্থ সিগারেটের প্যাকেট। যদিও পরক্ষণেই তার মনে পড়ে– ভূগর্ভস্থ এই ছাপাখানায় সিগারেট ধরাবার ব্যাপারে বাড়ির মালিক তাঁকে বার বার সতর্ক করেছে। আগুন ধরবার ভয়ে নয়। সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী যদি সুড়ঙ্গের পথে প্রবাহিত হয়ে কোনোভাবে কুয়োর উপরিতলে পৌঁছে, সেই ভয়ে। আর এই ভয়টি অমূলক নয়। বছরখানেক আগে পুলিশ সন্দেহের বশে এই বাড়িতে হানা দিয়েছিল। কুয়োঘরে-ও তারা উঁকিঝুঁকি মেরেছে। কিন্তু কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যায় কোবা'র দল। তারপর থেকে সবাইকে আরও বেশিমাত্রায় সতর্ক হয়ে চলতে হচ্ছে।

'ইরভানি রোডের স্টেট ব্যাংক-এ কাজ করে, আপনার দলের এমন কেও আছে?- সিগারেটের প্যাকেটটি কোটের পকেটে পুণরায় চালান করে দেবার মুহূর্তে কোবা জাভাকিশভিলি'র দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। এমন প্রশ্নে মোটামুটি আঁতকে ওঠেন জাভাকিশভিলি। 'আপনি কি স্টেট ব্যাংক লুটের চিন্তা করছেন?'– জাভাকিশভিলি'র এমন আঁতকে ওঠার পেছনে কারণ আছে। ওই ব্যাংকের পেছনেই সৈনিকদের একটি ছোটখাট ব্যারাক আছে। লুটের ঘটনার খবর পেলে তারা এসে বাঁধা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে দু পক্ষেই ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে। জাভাকিশভিলি'র উদ্বিগ্নতাকে উপেক্ষা করে কোবা'র নির্লিপ্ত জবাব, 'আমার কাছে আমাদের লাইনের হাই কমান্ড থেকে বার্তা এসেছে। এছাড়া খুব বেশি উপায় খোলা নেই। বেশ বড় ধরণের দাও মারা যেতে পারে এই ব্যাংক থেকে। অন্তত কয়েক লক্ষ রুবল তো বটেই।'

'কিন্তু কমরেড…।'– জাভাকিশভিলি কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন। তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে কোবা বলতে থাকেন, 'ব্যাংকের ভেতরে আমাদের কোনো চর নেই। কিন্তু এ কাজে এগুলে আমাদের প্রচুর তথ্য প্রয়োজন। শুধু তথ্য-ই নয়। আমার হাতে যে ছেলেরা আছে, ওদেরকে দিয়ে এতো বড় অপারেশনে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনাদের দলের ছেলেদের সাহায্যও প্রয়োজন। লুটের টাকা না হয় আমাদের দু দলের মাঝে সমভাবে ভাগ হবে।' কোবা'র মূল অভিপ্রায়টি এবারে জাভাকিশভিলি'র কাছে পরিষ্কার হয়।

ঘরের অপর কোণে রাখা সামোভারে চায়ের জল ফুটছে। স্মিরন এবারে গিয়ে সেই চা দুটো ছোট কাচের কাপে ঢেলে এগিয়ে দেয় দু কমরেডের দিকে। চিনি বিহীন চা। তবে এই শীতল গুমোট ঘরের পরিবেশের জন্যে একেবারে মানানসই একটি পানীয়। জাভাকিশভিলি চায়ের কাপে মৃদু চুমুক দেন। তারপর পাশের টেবিলে রাখা নিজের হ্যাটের প্রান্তভাগটি মুচড়িয়ে কোবা'কে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আপনি তো এ সপ্তাহে স্টকহোমে যাচ্ছেন। ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুন। তারপর না হয় এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে। এর মাঝে আমি পার্টির বাকি সবায়ের সাথে কথা বলে তাদের মতামত জানার চেষ্টা করবো। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, শুনলাম কৃষকের ভূমি বণ্টনের ব্যাপারে আপনি নাকি একটি বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে সম্মেলনে যাচ্ছেন?' এই শেষোক্ত প্রশ্নটি তিনি করলেন দুটি কারণে। প্রথমত সেই ব্যাংক ডাকাতির মত অস্বস্তিকর বিষয় থেকে আলোচনাটিকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করা। দ্বিতীয়ত – স্টকহোম সম্মেলনে কোবা বাদে তিফ্লিস শহর থেকে যারা যাচ্ছেন, তারা সবাই মেনশেভিক। শোনা যাচ্ছে, কৃষকদের ভূমি বণ্টন ও বিন্যাস নিয়ে তুমুল একটা আলোচনা হবে সম্মেলনে। সেখানে মেনশেভিক পক্ষ থেকে বলা হবে, পৌরসভার হাতে স্থানীয় ভূমির মূল নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে। ওদিকে, বলশেভিক পক্ষ চাইছে, পৌরসভা নয়, বরং ভূমির নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। জাভাকিশভিলি ভেবেছিলেন, কোবা হয়তো সেই প্রস্তাবকেই সম্মেলনে সমর্থন করবেন। তাই এ ক্ষণে তিনি কোবার এ সংক্রান্ত মতামতও জেনে নিতে চাইছেন। ব্যাংক সম্পর্কে জাভাকিশভি'র অনাগ্রহের ইঙ্গিতটা কোবা ধরতে পারলেন। তিনি চতুর লোক। বুঝে গেলেন, অপর পক্ষের অনাগ্রহ অগ্রাহ্য করে তিনি যদি আগেই বেশি তথ্য ফাঁস করেন, তবে আখেরে বিপদের সম্ভাবনা-ই বেশি। তিনি তাই ও-আলোচনায় না গিয়ে বরং জাভাকিশভিলি'র প্রশ্নের সূত্র ধরেই বলেন- 'ঠিকই শুনেছেন। তবে এ-ব্যাপারে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত আমার দলের অবস্থান থেকে কিছুটা ভিন্ন। আমি চাই, ভূমি বণ্টন হক কৃষকদের সমবায় ফার্মের মাধ্যমে। স্থানীয় পর্যায়ে। তারাই সিদ্ধান্ত নিক, কী করে নিজেদের জমি নিজেদের মাঝে বন্টিত হবে। এতে করে কৃষক আর সরকারের মাঝে দূরত্ব কমবে বই বাড়বে না।'

সেদিন রাতে স্টকহোম সম্মেলনের আরও কিছু আলোচ্য বিষয় নিয়ে দু জনের মাঝে আলোচনা চলল। বাকি দুজন নীরবে এসব আলোচনা শুনে গেল। কিন্তু খুব একটা অংশ নিল না। রাত গভীর হবার পর জাভাকিশভিলি সেই কুয়ো ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে তখন কৃষ্ণ পক্ষের ঘুটঘুটে আঁধার। আভলাবারি রোডটুকু হেঁটে পেরিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে তিনি দেখেন, পেছনে লন্ঠন ঝুলানো এক ঘোড়ার গাড়ি ওই সময়ে সেই পথ ধরেই চলেছে। তিনি হাত নেড়ে কোচওয়ানকে থামান।

এর পরদিন কমরেড কোবা স্টকহোমের উদ্দেশ্যে পেত্রগাদের পথে যাত্রা করেন। তার ভাগ্য কিছুটা সুপ্রসন্নই বলতে হবে। কারণ, তার ঠিক পরের সপ্তাহেই, পনের তারিখে, পুলিশ আবারও এই আভলাবারি রোডের বাড়িতে হানা দেয়। এবারেও তারা কুয়ো ঘরে উঁকি মারে। তবে এবারে এক কাণ্ড হয়। যে কনস্টেবল কুয়ো ঘরে ঢুকেছিল, সে কুয়োর দিকে তাকিয়ে দেখে- একেবারে কালিমাখা অন্ধকার। বুদ্ধি করে নিজের পকেটের থাকা একটি কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে সেটিতে সে আগুন ধরায়। তারপর সেটিকে ফেলে দেয় কুয়োর জলে। অবাক হয়ে সে দেখতে পায়, সেই কাগজটি ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অথচ, এই বদ্ধ কুয়ায় তো জলের ধারা থাকার কথা নয়। ব্যাস, ওমনি সে চিৎকার করে বড় কর্তাকে ডাকে। আরও লোক নামানো হয় নিচে। তারা এসিটিলিনের আলোয় আবিষ্কার করে– গত তিন বছর ধরে হন্যে হয়ে যে ছাপাখানা তারা খুঁজে চলেছে, সেটির হদিস। ছাপাখানাটি তো বটেই, উপরকার সেই কাঠের বাড়িটিকেও আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভাগ্য ভাল, দিনের বেলায় পুলিশের অভিযান চলায় কোবা'র বিশ্বস্ত সহযোগীরা সেই মুহূর্তে এ বাড়িতে ছিলেন না।

তবে সবকিছু পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলেও কী করে যেন টিকে গিয়েছিল লোহার তৈরি সেই জার্মান প্রেস মেশিনটি। মহাকালের সাক্ষী বানাবার জন্যেই হয়তো আগুনের শিখা ইচ্ছে করেই এর শরীর স্পর্শ করেনি। আর তাতে করে শত বছর পর কোন এক পরিব্রাজকের সৌভাগ্য হয় ভূতলের সেই একই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে একই অবস্থানে এটিকে দেখার।


২০১৯ সাল।
কোপালা রেস্তোরাঁর চার তলার টেরাসে এক মোক্ষম জায়গা বেছে নিয়ে বসে আছি। এখান থেকে ফ্রিডম স্কয়ার আর পিস ব্রিজকে সিনেমার পর্দার মত করে দেখা নেয়া যায়। উচ্চতা অনুযায়ী এটি চতুর্থ তলে হলেও মূল ভূমি থেকে কম করে হলেও প্রায় দশম তলের উচ্চতায় আছি। কারণ, গোটা রেস্তোরাঁটাই যে এক পাহাড়ের গায়ে। বেশ বনেদি এই রেস্তোরাঁটি মূল সড়ক থেকে খুব সহজে চোখে পড়ে না। পুরনো শহরের নানা পাড়ার গলি ঘুপচি পেরিয়ে তবেই এখানে আসতে হয়। এতোটা ভেতরে এমন এক স্থানে হোটেল বানাবার কারণই হল ওই উচ্চতা। উচ্চতার কারণেই লোকে এখানে খেতে আসে। খেতে খেতে শহরের রূপ গেলে। আমিও সেটি গেলবার এক পর্যায়ে উঁকি মেরে নিচের পিচঢালা পথ দেখি। সেখানে তখন চলেছে প্রায় দশটি গাড়ির আনন্দ শোভাযাত্রা। উচ্চস্বরে বাজছে গান। গাড়িগুলোর জানালা ফুঁড়ে বার হয়ে ছাই বর্ণা স্যুট পরা কয়েক ছোকরা হই হই রব তোলে। গাড়িগুলোর পুষ্পসজ্জা দেখেই বোঝা যায়, বিয়ে বাড়ির গাড়ি এগুলো। মাত্রই হয়তো চার্চ থেকে বেরিয়ে এল। ও হ্যাঁ, অ্যাজ রবিবার। বিয়ের জন্যে শুভদিন। সকালে প্রায় শ খানেক সিঁড়ি ডিঙিয়ে গিয়েছিলাম সিওনি চার্চে সকালের আরতি দেখতে। চার্চের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। লোকে ঠাসা। অনেকের হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। আমার গায়ে উলের ভারি পোশাক থাকায় ভয় হয়, পেছনের লোকের মোমবাতি আবার আমাকে জ্বালিয়ে না দেয়। সেই ভয়ের কাছে পরাভূত হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই চার্চ থেকে বেরিয়ে আসি। ওদিকে হাতের ঘড়ি নির্দেশ করছিল, ইলায়ার সাথে দেখা করবার কথা ঘণ্টা খানেকের মাঝেই। তাই পাহাড়ের নিচে নেমে ট্যাক্সি চেপে সোজা এই রেস্তোরাঁয় এসেছি। এখানেই ভদ্রলোকের আসবার কথা।

আমার উল্টোদিকের দেয়ালে জাতিসংঘের এককালের মহাসচিব কফি আনান মশাইয়ের একটি বিরাট ছবি। ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, ছবিখানা তোলা হয়েছে এ রেস্তোরাঁর-ই এক কোণে। অপর দেয়ালে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ছবি, সেই সাথে আরও আছে হলিউডের কিছু চিত্রতারকার ছবি। বলাই বাহুল্য, তারা সকলেই এ রেস্তোরাঁয় পদধূলি দিয়েছেন। কফি আনান আর জিমি কার্টার'রা খুব সম্ভবত আসেন আবখাজিয়া নিয়ে সংকটের সময়ে। আবখাজিয়ার সাথে জর্জিয়ার কাজিয়া সেই ৯৩ সাল থেকে। বেশ একটা যুদ্ধের পর সেখানে বসবাসকারী জর্জিয়ানরা উদ্বাস্তু হিসেবে পালিয়ে আসে মূল ভূখণ্ডে, রয়ে যায় কেবল আবখাজ রা। কিন্তু জর্জিয়া সে ভূখণ্ডের উপর দাবি এখনো ছাড়েনি। '৯৩ সালের যুদ্ধের পর দু পক্ষের মাঝে স্থিতাবস্থা রাখার প্রয়োজনে জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষক দল দীর্ঘকাল এই দেশে ছিল। রেস্তোরাঁয় থাকা ছবিতে যেসব হোমরা-চোমরাদের দেখছি, তারা বোধকরি এসেছিলেন সেই আবখাজিয়া সংক্রান্ত সালিশ বৈঠকে অংশ নিতে। তার মানে, এ রেস্তোরাঁর সুনাম আছে মেলা নিশ্চয়ই। তবে সেই সুনামের ইনাম খেয়ে এখন খাবারের দাম নিয়ে গলা কেটে দেয় কিনা, কে জানে! অবশ্য এখানে না এসেও উপায় ছিল না। সেই ইলায়া লোকটি নাকি এখানকার হোটেলেই ভিনদেশী পর্যটক ধরবার জন্যে ছিপ ফেলে বসে থাকে। শহরের যে ক'জন স্বল্প সংখ্যক ইংরেজি জানা চৌকশ গাইড আছে, সে তাদের মধ্যে একজন। অন্তত তেমনটাই শুনলাম গতকাল একজনের কাছে।

ভদ্রলোক আমি যে হোটেলে উঠেছি, সে হোটেলের ম্যানেজার। পার্সিয়ান। ইরানে শাহের আগমনের পর প্রাণভয়ে পালিয়ে আসেন পাশের দেশ জর্জিয়ায়। সেই থেকে এখানেই আছেন। এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। গলায় সব সময় ঝুলে থাকে একটি চশমার দুটো টুকরো। কোনো কাগজে চোখ বুলাতে হলে ঝট করে দু খণ্ডকে জোড়া লাগিয়ে চোখে লাগান। ইংরেজি বলেন কিছুটা ফার্সি টানে। প্রতিটি শব্দকে কিছুটা প্রলম্বিত করে। তো সেই তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম স্তালিনের ছাপাখানা সম্বন্ধে। ভদ্রলোক আমার প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এমন কোন ছাপাখানার কথা তিনি কস্মিনকালে শোনেননি, এ শহরে থিতু হবার পর থেকে। তবে আমাকে আশাহত হতে দেখে হাতে থাকা কলমখানি ঠোঁটে লাগিয়ে বললেন, 'আমার পরিচিত এক ছোকরা আছে। নাম ইলায়া। এখানকার কিছু বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় ও বিদেশীদের হয়ে গাইড আর দোভাষীর কাজ করে। তুমি বরং ওর সাহায্য চাইতে পার।' তারপর কী ভেবে আবার ফিরে এসে বললেন, 'আমি ওকে ফোন করে না হয় জানিয়ে দিচ্ছি। তুমি কোপালা রেস্তোরাঁয় কাল সকালের দিকে গেলে ওকে পেয়ে যাবে আশা করি।' সেজন্যেই অর্থাৎ ইলায়া'র নাগাল পাবার জন্যেই আমার এই রেস্তোরাঁয় আগমন।

এখানে ঢুকবার সময়ে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘাঙ্গিনী মেয়েটিকে বলে এসেছি, ইলায়া এলে আমার টেবিলে পাঠিয়ে দিতে। তবে ততক্ষণ তো আর শুকনো মুখে বসে থাকা যায় না। এঁরা খারাপ ভাবতে পারে। তাই আমি বেয়ারাকে ডেকে দু পদের জর্জিয়ান সালাদ অর্ডার করি। এই সালাদের সাথে আমি আগেই পরিচিত। কাজাখস্তানের এক জর্জিয়ান রেস্তোরাঁয় সর্ব প্রথম এই সালাদের সাথে আমার পরিচিতি ঘটে। আর তখন থেকেই জর্জিয়ান সালাদকে আমার বিশ্বের সেরা সালাদ বলে মনে হয়। অর্ডারের মিনিট দশেকের মাঝেই সালাদ চলে এলো। সে কী সুস্বাদু এক খাবার! আমরা বাঙালিরা যেমন শুধু শসা আর টমেটো এক করে সালাদ বানিয়ে ফেলি, জর্জিয়ানরা তেমন নয়। ওরা এর সাথে মেশায় নানা পদের মশলা, ডালিমের দানা আর ভিনেগার। সব মিলিয়ে যেন অমৃত!

আমার সালাদ ভক্ষণ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন দেখি– টেকো মাথার এক যুবক আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে সে নিজেকে ইলায়া বলে পরিচয় দেয়। আমি স্তালিনের ছাপাখানা খুঁজছি শুনে সে বেশ খানিকটা অবাক হয়। আর সেটি না লুকিয়ে অকপটে জানায়- সোভিয়েত সময়ের এসব স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে এখানকার কারুর আর তেমন কোনো আগ্রহ নেই। বহুকাল আগে সেই ছাপাখানার কথা ও শুনেছিল বটে, তবে সেটির অস্তিত্ব আজও আছে কি-না, সে-নিয়ে সন্দেহ আছে। আমি কিছুটা নাছোড়বান্দার মত বলি- যদি ওকে ঘণ্টাভিত্তিক সম্মানী দানে আমি সম্মত হই, তবে কি ও সেই ছাপাখানা খুঁজে বেড়াবার কাজে আমার সঙ্গী হবে? টাকার গন্ধ পেয়ে ইলায়া সানন্দে রাজি হয়। 'কেন যাব না? যদি খুঁজে পাই-ই, তাহলে এরপর বিদেশী কেও স্তালিন নিয়ে আগ্রহ দেখালে তাঁদেরও সেখানে নেবার প্রস্তাব দিতে পারবো। ভালই হবে আমার'- এই বলে ও আমাকে নিচে নামিয়ে আনে।

ইলায়ার একটি ছোটখাট গাড়ি আছে। বাংলাদেশে যেমন আমদানি হয়ে আসে জাপানের পুরনো সব গাড়ি, তেমনি জর্জিয়ায় আসে জার্মানি আর ইটালির সব পুরনো গাড়ি। ফলে সেগুলোর জীর্ণ যন্ত্রের পোড়া পেট্রোলে শহরে সব সময়ই একটা ঝাঁঝালো ভাব বিরাজ করে। ইলায়া'র গাড়িটিও তেমনই একটি সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। ব্যাংক ঋণে কেনা। এই গাড়ি-ই বলা চলে ওর ব্যাবসার অবলম্বন। অপর অবলম্বনের কথা তো আগেই বলেছি, যেটি হল- ইংরেজি ভাষা জানা থাকার ব্যাপার। কী করে এত ভাল ইংরেজি শিখল? তার উত্তরে ও বহুকাল পেছনে ফিরে গিয়ে বলে– কপাল গুণে কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়বার সময়ে আমেরিকার আরেকটি কলেজে এক বছর গিয়ে পড়বার সুযোগ পায়। সেই সাথে পেয়ে যায় একটি হোস্ট পরিবার। ইন্ডিয়ানাপলিস শহরে সেই একটি বছর থাকবার সময়ে ও খুব সহজেই রপ্ত করে নেয় এই ভাষাটি। তারপর জর্জিয়ায় ফিরে এসে দেখে- চাকরি নেই। অগত্যা ভাষাজ্ঞানকে সম্বল করেই নেমে পড়ে এই ধান্দায়।

আমরা আভলাবারি এলাকায় এসে পৌঁছাই। তবে এ এলাকাটি বোধকরি গত পাঁচ দশকে বদলে গেছে অনেকটাই। চারদিকে উঠে গেছে লালচে ইটের অট্টালিকা। এর মাঝে কোন ভবনটি যে সেই ছাপাখানা, সেটি খুঁজে পাওয়া এক দুঃসাধ্য কর্ম। আমাদের দেশে এমন অবস্থায় পড়লে গাড়ির চালক অনেক সময়ে পাড়ার চায়ের দোকানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জেনে নেয় ঠিকানার হদিস। কিন্তু এখানে তো আর তেমন চায়ের টং ঘর নেই, জিজ্ঞেস করিটা কাকে? এসময়ে দেখি, এক বৃদ্ধ হাতের লাঠিতে ভর করে এদিকেই হেঁটে আসছেন। ইলায়া গাড়ির গতি কিছুটা মন্থর করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের কথোপকথন চলে কিছুক্ষণ। শেষের দিকে ইলায়ার মুখে স্মিত হাসির রেখা দেখতে পাই। বুড়োকে 'মাদ্গাবা' অর্থাৎ ধন্যবাদ জানিয়ে ইলায়া আমার দিকে ফিরে বলে, 'এই হল প্রবীণ মানুষকে ঠিকানা জিজ্ঞেসের সুবিধে। মেলা খবর রাখে এরা। ঠিক বলে দিল, কোন গলিতে যেতে হবে আমাদের।'

বাড়িটির সামনে বয়স্কা এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। গায়ে ফ্লানেলের মোটা চাদর। মাথায় লেনিন টুপি। নাম তামারা ইরাশভিলি। ইলায়া তাকে প্রেসের কথা জিজ্ঞেস করায় তামারা সানন্দে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। তবে আমাদেরকে নিয়ে বাড়ির ভেতরভাগে যাবার আগে বাড়ির সীমানা দেয়ালে লাগানো একটি ফলকের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেখানে জর্জিয়ান ভাষায় কিছু একটা লেখা। শুধু সনের ব্যাপারটি রোমান হরফে লেখা থাকায় পাঠোদ্ধার করতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। ১৯০৩-১৯০৬। এই সময়কাল দেখে অনুমান করি, হয়তো সেই গুপ্ত প্রেস হিসেবে এই বাড়িটির ব্যবহারকালের সময়টি ওই ফলকে তুলে ধরা হয়েছে।

সেই যে ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে বাড়িটিকে পুড়িয়ে দেয়া হয়, তারপর বেশ কিছুকাল অবধি এ বাড়িটি নিয়ে লোকের তেমন একটা উৎসাহ ছিল না। বলা চলে, লোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল বাড়িটির কথা। এরপর '১৭ সালে বিপ্লব হল। বিপ্লবের বাদেও প্রায় বছর দশক লেগে গেল সারা রুশ সাম্রাজ্যে বলশেভিকদের ক্ষমতা সুসংহত করতে। মেলা পরে, সেই '৩৭ সালের দিকে, পুরো বাড়িটিকে পুনরায় সংস্কার করা হয়। জর্জিয়ায় তখন স্তালিনের সাগরেদ বেরিয়া ক্ষমতায়। লোকে বলে, বেরিয়া স্তালিনের চিন্তারেখা পড়তে পারতেন। এই বেরিয়া-ই সেই ১৯০৬ সালের দিকে তিফ্লিস শহরে স্তালিনের সহযোদ্ধা যারা ছিলেন, তাঁদের সব্বাইকে জেলে অথবা জল্লাদের কাছে পাঠায়। যাতে এরা ভবিষ্যতে কোনোভাবেই স্তালিনের প্রতিপক্ষ হিসেবে না দাঁড়াতে পারে। বেরিয়া-ই স্তালিনের মনোভঞ্জনের জন্যে ঢেলে সাজায় এই ছাপাখানা ভবনটিকে, একে গড়ে তোলে একপ্রকার তীর্থস্থান হিসেবে। এই মোসাহেবি বিফলে যায়নি। পরের বছরই স্তালিন বেরিয়া'কে তার গুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডি-র প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে মস্কোয় নিয়ে যান।

এই বাড়িটির ঢুকবার মুখে স্থাপন করা হয়েছিল একটি একতলা দালান– জাদুঘর ও তথ্যাগার হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। ছাপাখানা দেখতে হলে তাই সেই বাড়িটিতেই আগে ঢুকতে হয়। দেখতে হয়, এই ছাপাখানা পত্তনের আদি ইতিহাস।

ভদ্রমহিলার পিছু পিছু সেই ভবনে ঢুঁকে বুঝি– এটি এখন অন্তিমকাল অতিক্রম করছে। ছাদ থেকে নেমে এসেছে ফাটলের ধারা। চারদিকে ঝুল, মাকড়শার জাল। তামারা বাদে দেখভাল করবার আর কেও নেই। তিনিও আছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। পার্টিকে ভালোবাসতেন বলে জীবন সায়াহ্নে এসেও এই স্মৃতিচিহ্নকে আঁকড়ে ধরে আছেন। বেশ উচ্ছ্বসিত তিনি আজ। মেলা দিন পর নাকি ভিনদেশী কারও পদধূলি পড়লো। কালেভদ্রে যারা আসেন, তাঁদের মাঝে থাকে ভারতীয় আর চীনেদের প্রাধিক্য। অথচ সোভিয়েত সময় তিব্লিসি শহরে যে রাষ্ট্র নায়কেরা আসতেন, তাঁদের প্রায় সবাই এ জাদুঘরটি পরিদর্শন করে ধন্য হতেন। ইন্দিরা গান্ধীও এসেছিলেন একবার। সেই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা এসব গল্প বলেন একটি দীর্ঘশ্বাসকে সাথী করে।

ঢোকার মুখেই দেয়ালে লেনিন-স্তালিনের প্রকাণ্ড পোট্রেট। নিচে ঝুলছে কাস্তে-হাতুড়ির প্রতিকৃতি সম্বলিত সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা। পাশের টেবিলে পুরনো কিছু প্রাভদা পত্রিকার স্তূপ। আর এর ডান দিকে দেয়ালে ঝুলছে সোভিয়েত দেশের মানচিত্র। মানচিত্রটি যান্ত্রিক। কোথায় যেন একটি সুইচ টেপেন ভদ্রমহিলা। তাতে করে ভৌতিক শব্দের সাথে মানচিত্রের এখানে-ওখানে জ্বলে ওঠে লাল বাতি। ভদ্রমহিলা কিন্তু অনবরত কথা বলেই যাচ্ছেন। জর্জিয়ান ভাষায়। আর ইলায়া থেমে থেমে সেসব আমাকে অনুবাদ করে শুনাচ্ছে। সেই থেকে জানলাম, এই বাতিগুলো দেখাচ্ছে কী করে ধীরে ধীরে বলশেভিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ে গোটা রুশ সাম্রাজ্যে।

এরপর আমরা ঢুকি চতুষ্কোণ একটি ঘরে। সেখানকার দেয়ালে বহুকাল আগে টানানো হয়েছিল এই ছাপাখানার সাথে সংশ্লিষ্ট নানা জনের ছবি আর পরিচিত। কালের পরিক্রমায় সেসব ছবির পরে জমেছে পুরু ধুলোর আবরণ। ছবির ফ্রেমগুলো যেন দেয়ালে ফুটে ওঠা পুরু ফাটলের রেখা ঢাকতে ব্যাস্ত। আর সব ছবির মাঝে আছে হাতে আকা একটি ম্যাপ। যে ম্যাপ অবলবন করে মাটির তলে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। আছে মাটিতে অনাদরে পড়ে থাকা লেনিন স্তালিনের একটি বৈঠকরত তেলচিত্র। এই ছবিটিতে মূর্ত করা মুহূর্তটির সাথে আমি পরিচিত। শিল্পীর কল্পনাপ্রসূত মুহূর্ত নয় এটি। ১৯২২ সালে মস্কোয় লেনিনের নিবাস 'গোর্কি'র উদ্যানে স্তালিন ও তিনি একটি বেঞ্চে উপবিষ্ট। এর মাত্র কয়েক মাস পরেই প্রয়াণ ঘটে লেনিনের। তাই বলা চলে, এটিই দুজনের শেষ প্রাণবন্ত মুহূর্ত, যেটি ধরা পড়েছিল ক্যামেরার রিলে। এমন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের বেশ কিছু আলোকচিত্র আগে দেখার সুযোগ হলেও, সেটিকে অবলম্বন করে আঁকা তেলচিত্র এই প্রথম দর্শনের সুযোগ ঘটলো।


ঘরটির এমন শ্রীহীন দশা কেন? বিমর্ষ চিত্তে সেই মহিলা বললেন- সত্তরের দশকে এ জাদুঘর চত্বরে ঢোকার জন্যে মানুষ দু তিন ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রতিদিন তখন শত শত মানুষের ঢল নামত এখানে। কিন্তু ৯২-৯৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পর আচমকাই বদলে যায় সবকিছু। তিব্লিসিতে তখন ছড়িয়ে পড়েছে গৃহযুদ্ধের আগুন, বিপ্লবী দলের কিছু সশস্ত্র যোদ্ধা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে এই বাড়িটি। এখানে এনে জমা করে রাখে গোলাবারুদ। ওই সময়ে তাঁদের বুটের আঘাতে ঐতিহাসিক এই স্থাপনার নানা নিদর্শন হয় পদদলিত। আর তারপর জর্জিয়ায় গণতন্ত্র পুনস্থাপিত হলে এই বাড়িটিকে ন্যাস্ত করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সংস্কৃতি দপ্তরে না দিয়ে বাণিজ্য দপ্তরের অধীনে কেন ন্যাস্ত করা হল, কে জানে। তবে কথা হল, তারা দায়িত্ব বুঝে নিয়ে এর সংস্কার তো দূরের কথা, বরং বহুবার উদ্যোগ নিয়েছে বাড়িটিকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলার। শহরে রয়ে যাওয়া অল্প কিছু সংখ্যক বলশেভিক নানা প্রতিবাদ আর সমাবেশ করে ঠেকিয়ে রেখেছেন তেমন পরিকল্পনা। এমনকি নিজেরাই পালা করে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এর দেখভাল করে টিকিয়ে রেখেছেন এর অস্তিত্বকেও। কারণ, সরকারের হাতে থাকলে তারা হয়তো এটিকে ভেঙে না ফেললেও অর্থাভাবের অজুহাত দেখিয়ে তালাবদ্ধ অবস্থায় ফেলে রাখতো।

এই একতলা ইমারত থেকে এবারে আমরা যাই সেই কাঠের বাড়িটিতে, যেটির বাঁ দিকের ঘরে স্তালিন ঘুমোতেন। হাতের চাবির গোছা থেকে একটি চাবি খুঁজে নিয়ে মহিলা সেই ঘরের দোর খোলেন। এক চিলতে একটি খাটের দেখা পাই ঘরে ঢুঁকেই। মাথার কাছের জানালার কার্নিশে স্তূপ করে রাখা বই। যদিও সেসব বই স্তালিনের জমানার বলে মনে হয় না। সেটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায় জানতে পারি, আমার ধারণা সঠিক। সমাজতন্ত্রের পতনের পর শহরের বামপন্থীরা এর-ওর কাছে সংরক্ষিত বাম মতাদর্শের নানা পুস্তক এনে গচ্ছিত রাখে এই বাড়িতে। সেগুলোকেই পরে এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে স্তালিনের পালঙ্কের শিয়রের দিকটায়।

এই যে কাঠের বাড়ি, এর নিচেই রয়েছে সেই ছাপাখানা। যদিও সেই ১৯০৬ সালের সময়ে ছাপাখানায় যেতে হতো কুয়ো ঘরের মাঝ দিয়ে। প্রথম যখন এই স্থাপনাটিকে জাদুঘর বানিয়ে খুলে দেয়া হয়, তখন কাঠের বাড়িটির পাশেই একটি স্টিলের ঘোরানো সিঁড়ি তৈরি করা হয়। সাধারণ দর্শনার্থীদের পক্ষে তো আর সেই কুয়োর বালতির মাঝে নিজেকে লুকিয়ে তারপর সুড়ঙ্গ পথ মাড়িয়ে গুপ্তঘরে ঢোকা সম্ভব নয়! তাই তাদেরকে খুব সহজেই পাতালের সেই ঘরে নেবার জন্যে এ ব্যবস্থা। এখন অবশ্য সেই সিঁড়িটি মরচে ধরে বিপজনকভাবে ঝুলে আছে। সেটি ধরেই সন্তর্পণে নিচের শীতল ঘরে নেমে দেখি- টিমটিমে বিজলী বাতির আলোর নিচে সমাহিত হয়ে শুয়ে আছে সেই ঐতিহাসিক জার্মান মেশিনটি। মাঝের সেই টালমাটাল সময়ে এই গুহা ঘরের ছাদ বেয়ে অঝোরে জল চুইয়ে পড়েছে। তাতে করে মেশিনের লোহা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে হারিয়ে পুরনো জৌলুশ। সমুদ্রে নিমজ্জিত জাহাজের মতই তার গায়ে জমেছে অমোচনীয় পলি। খুব কষ্ট করে শুধু যেটুকু এর গা থেকে পড়া যায়, সেটি হল- ১৮৯৩। এই মেশিনটি বাদে এ ঘরে এখন আর তেমন কিছু নেই। তামারা যদিও এই প্রেস মেশিনের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বকবক করেই চলেছে, কিন্তু আমার এই ভূতুড়ে এই পাতালপুরীতে খুব বেশিক্ষণ থাকার ব্যাপারে মন সায় দেয় না। আমি তাই ইলায়াকে ইশারা করে উপরের সূর্যালোকে উঠে আসি।

মনে হয়, ভ্রমণটি বুঝি শেষ হল। কিন্তু তামারা দেখি হনহন করে হেঁটে চলেছে সেই একতলা মূল ভবনের দিকে। কিছু একটা দেখবার এখনো হয়তো বাকি আছে। আমরা ওর পিছু পিছু এগিয়ে দেখি সম্মুখের টেবিলে রাখা বিশাল একটি খাতা খুলে তামারা ঝুঁকে কিছু একটা খুঁজছে। তারপর আমার দিকে ফিরে ও বলে, 'এই খাতায় তোমার মাতৃভাষায় কিছু একটা লিখে দেবে? এটা আমাদের দর্শনার্থীদের স্বাক্ষর বই।' লাল কাপড়ে বাঁধাই করা সুবিশাল সেই বইয়ের পাতা উল্টাতে দেখি, সেখানে সেই পঞ্চাশের দশকের কিছু মানুষের সইসাবুদও আছে। রোমাঞ্চিত মনে সেখানে বাংলায় কিছু কথা লেখার মাঝে হটাৎ আমি তামারা'র দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করি, 'সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সমাজতন্ত্রের বিদায় ঘণ্টা তো সেই কবেই বেজে গেছে। এখনো এই স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে আছো কেন? বিশেষ করে স্তালিনের এই স্মৃতিকে?'

তামারা কিছুক্ষণ স্থানুবৎ হয়ে শূন্য চোখে আমার দিকে তাকায়। ঘরের ওই আধো অন্ধকারময় স্থানটিতে তামারা'কে মনে হয় যেন এক বিশুষ্ক বৃক্ষশাখা। কিছুটা যেন কেঁপে ওঠে চোয়ালের বলিরেখাগুলো। তারপর ভারি নিঃশ্বাস নিয়ে কিছুটা থেকে থেমে ও বলে, ' আবখাজিয়ার মেয়ে আমি। সুখোমি নগরে ছিল আমাদের সুখের নিবাস। আমার স্বামী নিউক্লিয়ায় ইন্সিটিউট-এ ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু তারপর……। তারপর একদিন দুঃস্বপ্নের মত সবকিছু ভেঙে পড়ল। যুদ্ধ বাঁধল। জর্জিয়ান হবার অপরাধে আবখাজিয়া থেকে পালিয়ে এলাম এখানে। আর এখানে……। দেখতেই তো পারছ– ভিখিরির মত আছি। এই হল সমাজতন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে আগমনের পুরস্কার। আজ যদি স্তালিনের রেখে যাওয়া সেই সোভিয়েত রাশিয়া থাকতো, তাহলে কি আর এত গৃহযুদ্ধ, এতো হাহাকারের মুখোমুখি হতাম আমরা? হতাম না। কেন সেই অতীত স্বপ্নকে আজও আঁকড়ে আছি, সেটা বুঝলে এবার?'

শুধু তামারা নয়, তিব্লিসিতে আরও দু একজন আবখাজিয়ান শরণার্থীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তাঁদের কেও কেও এখানে এসেছে জন্মের পর পর। জর্জিয়া-ই তাঁদের নতুন দেশ, নতুন মাতৃভূমি। আবখাজিয়া নিয়ে তাই তাঁদের তেমন কোন হা-হুতাশ নেই। কিন্তু মাংসপেশীতে ঢুঁকে থাকা বহু পুরনো বুলেট যেমন প্রায়ই বেদনা উদ্গত করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়, তেমনই পুরনো প্রজন্মের শরণার্থীদের কাছে মাতৃভূমি আবখাজিয়ার স্মৃতি বেদনার ঊর্মি জাগ্রত করে। হাতের কড়ে তারা গুনতে বসে দু জমানার জীবনমান। সেই হিসেব আর সবাইয়ের থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। আর সেজন্যই তামারার হিসেবকে অসম্মান করা হয়তো আমার পক্ষে সমীচীন হবে না। স্তালিনের নীতিসৃষ্ট রাজনীতি-ই যে এ অঞ্চলে পরবর্তীতে ক্ষমতালোভী যুদ্ধোন্মাদ কিছু রাক্ষসের জন্ম দিয়েছে– সেটি তামারাকে বলতে গিয়েও তাই আমাকে থেমে যেতে হয়।