ফারুক মঈনউদ্দীনের ভ্রমণকাহিনী: প্রাচীন তাসখন্দের সন্ধানে

ফারুক মঈনউদ্দীনফারুক মঈনউদ্দীন
Published : 4 June 2019, 04:51 AM
Updated : 4 June 2019, 04:51 AM


ছবি: ব্রডওয়ের ভবনের গায়ে আধুনিক ঘরানার ম্যুরাল

তাসখন্দে প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন দেখতে চাইলে কিছুটা হতাশ হতে হয়। অন্তত বুখারা বা সমরকন্দের সাথে তুলনা করে কেউ কেউ উজবেকিস্তানের রাজধানী শহরটিকে হতছেদ্দা করলেও করতে পারে। যেসব শতাব্দীপ্রাচীন ভবনের জন্য তাসখন্দের সহোদরা দুই নগরীর বিশেষ আকর্ষণ, তাসখন্দ সেসব হারিয়েছে ১৯৬৬ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে। তারও আগে ১৯৪১ সালে জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, তখন যুদ্ধ থেকে দূরে থেকেও উজবেকিস্তানকে যুদ্ধ সরঞ্জাম শিল্পের বহু কারখানাকে স্থান দিতে হয়েছিল। এসব শিল্পের সাথে এখানে আসে হাজার হাজার রাশিয়ান কর্মী। আরও একটি কারণে জনমিতির এই প্রবণতা বেগবান হয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে রাশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষের অনুগত্যের বিষয়ে সন্দেহের কারণে সোভিয়েত সরকার কোরীয়, তাতার, চেচেনদের মতো ক্ষুদ্রতর জাতির মানুষকে বলপূর্বক উজবেকিস্তানে স্থানান্তরিত করে। ফলে বিশাল এই অভিবাসী জনসংখ্যার কারণে তাসখন্দ রূপান্তরিত হয় এক বহুজাতিক নগরে। ভূমিকম্পে গৃহহীন উজবেক এবং অভিবাসী রুশদের জন্য দ্রুত অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক এবং সোভিয়েত ঘরানার আজদাহা সাইজের বহু আধুনিক ভবন তৈরি হলেও তাসখন্দ ফিরে পায়নি ইতিহাসমণ্ডিত একটি প্রাচীন নগরীর সম্মান।
তাসখন্দের প্রাচীনতম স্থাপনা খাস্ত ইমাম স্কোয়ারে ইতিহাসের কিছুটা দেখা মেলে। তবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর স্বাধীন রাষ্ট্র উজবেকিস্তান তাসখন্দকে একটি আধুনিক নগরীতে পরিনত করার সকল প্রয়াস বাস্তবায়িত করে। সেসবের নজির দেখতে দেখতে অনতিপ্রাচীন আলিশের নাভাই থিয়েটারের পাশের পাতাঝরা ছায়াময় প্রায় নির্জন বুখারা স্ট্রিট ছাড়িয়ে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক স্ট্রিটে পড়লে দৃশ্যপট বদলে যায়। এখানে দেখা মেলে অভিজাত দোকানপাট, বার রেস্তোঁরা, প্যাস্ট্রি শপ, নামী দামী ব্র্যান্ড স্টোর এসবের। কোনো কোনো ভবনের গায়ে আধুনিক ঘরানার ম্যুরাল থেকে উঁকি দিচ্ছে অ্যাবস্ট্রাক্ট নারীমূর্তি। হেঁটে গেলে এসব খুঁটিনাটি দৃশ্য চোখে পড়ে। পশ্চিমী ট্যুরিস্টদের দেখি পিঠে ঝোলাব্যাগ নিয়ে এটা ওটা দেখতে দেখতে রোদবৃষ্টির তোয়াক্কা না করে রাস্তা ধরে হেঁটে যায়। আমরা নিজদেশে প্রতি পদে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক যন্ত্রণা ভোগ করি বলেই বোধ হয় দেশভ্রমণে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য বিলাসী হয়ে পড়ি। অথচ রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে এটা-ওটা দেখে নেওয়া যায়, কুকুর নিয়ে রাস্তায় নামা বাচ্চাদের সাথে একটু খুনসুটি করা যায়, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের সাথে 'হাই' বিনিময় করা যায়, এমনকি নারী পথচারীদের প্রতি স্মিত হেসে আরেকটু আগ বাড়িয়ে 'গুড আফটারনুন'ও বলা যায়। এসবই সম্ভব বিদেশের মাটিতে। আমাদের দেশে এসবের কোনো কিছু করার জো নেই। রাস্তায় পথচলতি কারো দিকে হেসে তাকিয়ে সম্ভাষণ জানালে প্রতিপক্ষ এমন অবাক সন্দেহের চোখে তাকাবে যে অজান্তেই নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকবে। কোনো বাচ্চার সাথে মজা করতে গেলে ছেলেধরা মনে করে হেনস্তাও শিকার হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।


ছবি: ব্রডওয়ের পুরানো স্যুভেনির, অ্যান্টিকস

মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক স্ট্রিটের এক জায়গায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করা। এখানেও নাইট ক্লাব, পাব, শপিং মল, বুটিক শপ, বড়লোকদের জন্য গলাকাটা ফ্যাশন স্টোর, রেস্তোঁরা, ক্যাফে এসবের ছড়াছড়ি। গাড়িহীন প্রশস্ত সড়কটিতে জনসমাগম দেখে কোনো মেলার মতো মনে হয়। সন্ধ্যার পরের প্রস্তুতি হিসেবে মাথার ওপর জালের মতো বিছানো হয়েছে মিটমিটে তারাবাতির সজ্জা, সেখান থেকে ঝালরের মতো ঝুলছে তারাবাতির মালা। সেই মালা দিয়ে তৈরি বড়সড় একটা ঝাড়বাতিও তৈরি করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে বসেছে এক অন্যরকমের মেলা। তবে কোনো দোকান বা স্টলের অস্থায়ী কাঠামো নেই, নেই কোনো টেবিল বা কাউন্টার, স্রেফ রাস্তার ওপর বিছিয়ে রাখা হয়েছে হরেক রকমের পসরা। মেলা না বলে এটিকে স্ট্রিট মার্কেট বলাই শ্রেয়। মোস্তফা কামাল স্ট্রিটের এই অংশটা সোজা বেরিয়ে গেছে সেইলগখ স্ট্রিটকে ক্রস করে। রাস্তাটির পাশে বড় গাছে ঢাকা বিস্তৃত পার্ক। মেলাটির নাম সেইলগখ স্ট্রিট ব্রডওয়ে আর্ট বাজার। ব্রডওয়ে নামের মাহাত্ম্যটা বুঝতে পারি না। নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে নাটক পাড়া ব্রডওয়ে আছে বটে, যার নাম এসেছে ওলন্দাজ 'ব্রিড ওয়েখ' থেকে, যার অর্থও প্রশস্ত রাস্তা। প্রথমবার যখন নিউ ইয়র্ক যাই, আমার ধারণা ছিল ব্রডওয়ে হচ্ছে আমাদের মহিলা সমিতি মঞ্চের মত কোনো নাট্যশালার নাম। বিভিন্ন স্ট্রিট ও অ্যাভিনিউ পার হয়ে একটা বড় রাস্তায় পৌঁছে এক পথচারী বয়স্কা মহিলাকে জিজ্ঞেস করি ব্রডওয়েটা কোথায়? ওসব দেশে বয়স্ক মানুষের কথা বলার মতো লোকের অভাব, তাই মহিলা আমার দিকে একটু ¯েœহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, বাছা, এই রাস্তাটার পুরোটাই ব্রডওয়ে। পরে বুঝতে পারি ব্রডওয়েও অন্যান্য এভিনিউর মতো একটা চওড়া রাজপথ।
তাসখন্দের এই সড়কটিকে স্থানীয়রা হয়তো আদর করেই এ নামে ডাকে। তবে আর্ট বাজার বলাটা ভুল নয়। সাজিয়ে রাখা পশরার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পেইন্টিং। এছাড়াও আছে বেশ কিছু পথশিল্পী, ওদের সামনে বসলে স্বল্পতম সময়ে এঁকে দেবে একটা পোর্ট্রটে। রাস্তায় সাজিয়ে রাখা পেইন্টিংগুলো অবশ্য তেমন আহামরি কিছু নয়, সাধারণ কিংবা শিক্ষানবিস শিল্পীদের আঁকা শস্তা ল্যান্ডস্কেপ, স্টিল লাইফ, কিছু সাদাকালো পুরনো পোর্ট্রটে। অনেক ঘেঁটেও কেনার মতো কিছু পাওয়া যায় না। এসবের পাশাপাশি আছে পুরনো বইয়ের স্তুপ। তবে বেশিরভাগই কীটদষ্ট, সেসবের প্রায় সবগুলোই রাশিয়ান কিংবা উজবেক ভাষায়। ইংরেজিতে দুচারখানা পাওয়া গেলেও কেনার মতো নয়। এক জায়গায় বইয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে রংচটা নড়বড়ে ফ্রেমে স্ট্যালিনের বাঁধানো পুরনো সাদাকালো ছবি, ঝাপসা হয়ে আসা পত্রহীন গাছের পোকায় খাওয়া ফটোগ্রাফ। বই আর ছবি ছাড়া বিভিন্ন তরফে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে নানান ধরনের পুরানো স্যুভেনির, অ্যান্টিকস। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ফুলদানী, মোমদানী, লম্বা নলওয়ালা গড়গড়া, কোরোসিন স্টোভ, সামোভার, পেতলের ঘণ্টা, মূর্তি, বর্শা হতে ঘোড়সওয়ার, টেবিল ঘড়ি, চেইন লাগানো পকেট ঘড়ি, নানান ধরনের ঝরনা কলম, কাফলিংক, টাই ক্লিপ, পেতলের ছাইদানী Ñ কী নেই সেখানে?


ছবি: ব্রডওয়ে আর্ট বাজার

এক জায়গায় কালো আর খয়েরি কেসে রাশিয়ান জেনিথ ক্যামেরা রাখা আছে বেশ কয়েকটা। এই জেনিথ ক্যামেরা দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ছাত্রাবস্থায় যখন আমাদের ক্যামেরার দৌড় ইয়াশিকা মিনিস্টার থ্রি থেকে ইয়াশিকা ইলেকট্রো থার্টি ফাইভ পর্যন্ত, তখন ঢাকায় দুচার জনের কাছে দেখেছিলাম এই জেনিথ ক্যামেরা। দেখতে ঢাউস এবং কাঠখোট্টা চেহারার ক্যামেরাটির আকৃতি মোটেই পছন্দ হতো না। সোভিয়েত সাহিত্যের অপূর্ব স্বাদে ডুবে থাকলেও রাশিয়ান যন্ত্রপাতির এই ঢাউস ভাবটা পছন্দ হয়নি কখনো। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে যায়। রাশিয়ায় তৈরি ট্রাক্টরের এক বড় ক্রেতা ছিল জাপান। কিছুদিন পর দেখা গেল জাপান রাশিয়ান ট্রাক্টর কিনছে, আবার নিজেদের তৈরি ট্রাক্টর রফতানীও করছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত ও রহস্যজনকই বটে। তবে বহু কসরতের পর সেই রহস্য ভেদ করে জানা যায়, জাপান রাশিয়া থেকে ট্রাক্টর কিনে তার প্রতিটা থেকে দুটো ট্রাক্টর তৈরি করতে পারে। কাঁচামাল সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কমদামে বিদেশে রফতানিও করতে পারছে। অর্থনীতির ছাত্রদের জন্য হালকা চালে এটিই বৈদেশিক বাণিজ্যের তুলনামূলক সুবিধাতত্ত্বের একটা উদাহরণ হতে পারে। তবে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয় বলে আর না এগোনোই ভালো।
এই আর্ট বাজারে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ছবিও তুলি। এক জায়গায় এক দিদিমা একটা চৌকিপিড়ির মতো উঁচু আসনে বসে নিজের জিনিসপত্রের ওপর নজর রাখছেন। ছবি তুলতে গেলেই কড়া ধমক দিয়ে নিষেধ করেন যাতে কোনো ছবি না তুলি। তারপর গজগজ করে কীসব বলতে বলতে সামনের সাজানো পসরা বিনা কারণে এদিক ওদিক সরিয়ে নতুন করে সাজান। নিশ্চয়ই বলছেন, কিছু কেনার মুরোদ নেই, আবার ছবি তুলতে এসেছে হতভাগা বিদেশী ট্যুরিস্ট। সেখান থেকে সরে এসে এপাশের পথশিল্পীদের ডিসপ্লে করা নিখুঁত স্কেচ দেখতে থাকলে একজন ছবি এঁকে দেওয়ার আহ্বান জানায়, হ্যালো মিস্তার, পোত্রেত? আগ্রহী শিল্পীকে 'নো থ্যাংকস' বলে নিবৃত্ত করি। প্রায় জীবন্ত সেসব আঁকা পোর্ট্রটে দেখে কিছুটা লোভও হয়, কিন্ত আমাদের হাতে অত সময় নেই।


ছবি: ব্রডওয়ে আর্ট বাজারের শিল্পকর্ম

ব্রডওয়ে আর সেইলগখ স্ট্রিটের কোণায় সাজিয়ে রাখা আছে একটা আস্ত ইয়ুর্ট। এটা হচ্ছে স্তেপ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তাবু, গোলাকার এই তাবু তৈরি হয় মেষের চামড়া, ফেল্ট Ñ এসব দিয়ে, যাতে ঠা-া ঢুকতে না পারে। এগুলোর কোনোটির ছাদ সামিয়ানার মতো মাঝ বরাবর খুঁটির ঠেকনা দিয়ে ওপর দিকে ওঠানো, শীর্ষে থাকে ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য ভেণ্টিলেশন ব্যবস্থা। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের যাযাবর মানুষেরা এরকম অস্থায়ী তাবুতেই থাকে। মঙ্গোলিয়াতে ঠিক এরকম তাবুতেই থাকে থাকে যাযাবর মানুষ। সে দেশে এটির নাম 'গের'। এই ইয়ুর্টটি নিজেই এক দর্শনীয় স্যুভেনির, তবে এর গায়ে বড় ব্যানারে লেখা দেখে বোঝা যায় এখানে এটি স্যুভেনিরের দোকান। ভেতরে ঢোকার চেষ্টায় দরজা ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করে বুঝতে পারি কোনো কারণে বন্ধ আছে দোকান। মঙ্গোলিয়ায় একাধিক গেরের ভেতর ঢোকার সুযোগ হয়েছে আমার, তাই সফরসঙ্গীদের দেখাতে চেয়েছিলাম ইয়ুর্টের ভেতরটা কেমন। কিন্তু ওদের ভাগ্য খারাপ, কী করা?
যাবতীয় দর্শনীয় জিনিস দেখার পর ব্রডওয়ে লাউঞ্জ বারের বারান্দায় বসে পয়সাওয়ালা ট্যুরিস্টদের মতো আয়েশী ভঙ্গিতে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দর্শনার্থীদের আনাগোনা দেখি। তরুণ-তরুণী, বাচ্চাকাচ্চা সহ গোটা পরিবার এবং আমাদের মতো ট্যুরিস্টদের ঘোরাফেরায় জায়গাটা সরগরম। এখানে কেবল পসরা সাজিয়ে বসা নয়, পেইন্টিং শিল্পীদের মতো অন্য বিদ্যায় পারদর্শী লোকজনও এখানে দেখায় নানান কসরৎ, পথগায়কেরা শোনাতে পারে লোকগীতি। তাসখন্দের এই ঘরোয়া, নিরাভরন ও আন্তরিক আদি বিনোদনের জায়গাটাকে খুব ভালো লেগে যায়। কিন্তু ভালো লাগলেই যে কোথাও বসে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অগত্যা আমাদের উঠতে হয়।


ছবি: ব্রডওয়ে আর্ট বাজারে পুরনো বইয়ের স্তুপ

সেইলগখ স্ট্রিটের ছায়াচ্ছন্ন পথ ধরে হাঁটতে হাতের ডান পাশে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া একটা বাঁধানো পুকুরকে পাশ কাটিয়ে ছিমছাম একটা রাস্তায় উঠে এলে বুঝতে পারি এটা সেই বুয়ুক তুরন স্ট্রিট, এই রাস্তার পাশেই দেখে এসেছিলাম আলিশের নাভাই থিয়েটার। রাস্তাটা পার হয়ে কয়েক পা এগোলেই গ্রিলের ঘেরার ভেতর প্রাচীন স্থাপত্য ঘরানার একটা বাড়ি দেখে দাঁড়াতে হয়। বাড়ি না বলে ছোটখাটো প্রাসাদ বলাই উচিত। দেয়ালভর্তি অজস্র খাঁজ আর নাতিদীর্ঘ স্তম্ভের বহুরৈখিক দেহরেখা, বাঁকানো খিলানযুক্ত জানালার বিচিত্র আকৃতি, ওপরে ব্যতিক্রমী মিনার ও গম্বুজ, পোর্চের ছাদের দুকোণে দুটো কুকুর, আর দরজার দুপাশে বসে থাকা দুটো হরিণের মূর্তি Ñ সব মিলিয়ে এটি ঠিক কোন ঘরানার কাজ বোঝা যায় না। গাইড আবদুল্লা জানায় এটি হচ্ছে প্রিন্স রোমানভের প্রাসাদ। রাজপুত্র নিকোলাই কনস্টান্টিনোভিচ রোমানভ (১৮৫০ Ñ ১৯১৭) ছিলেন জার প্রথম নিকোলাসের দৌহিত্র এবং দ্বিতীয় নিকোলাসের খুড়তুতো ভাই। ছোটবেলা থেকে অতি আদরে বেড়ে উঠে বখে যাওয়া মেয়েবাজ রোমানভের সাথে ফ্যানি লিয়ার নামের এক কুখ্যাত মার্কিন নারীর আশনাই ছিল। তার জের ধরে রোমানভ ওঁর মায়ের গহনা থেকে তিনটে দামী হীরা চুরি করে ধরা পড়ার পর পরিবারের মান রাখতে তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ সাব্যস্ত করে রাশিয়া থেকে বহু দূরে নির্বাসন দেওয়া হয়। তাসখন্দের বিভিন্ন এলাকায় কঠোর নজরদারীতে থাকাকালীন সময়ে তিনি এখানে সাবান কারখানা, ফটো স্টুডিও, বিলিয়ার্ড সরঞ্জাম তৈরি, চাউল, তুলা Ñ এসব ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। তাঁর আয়ের একটা বড় অংশ ব্যয় হতো বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহে। এই প্রাসাদটি তিনি নির্মাণ করান যাতে সংগৃহীত শিল্পকর্মের বিশাল সম্ভার সাজিয়ে রাখা যায়। রোমানভের মৃত্যু হয় ১৯১৭ সালে, তবে সে মৃত্যু রহস্যাবৃত। তিনি নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন বলা হলেও বলশেভিকদের হতে খুন হওয়ার গুজবও বেশ জোরালো। রোমানভের অনেক কির্তীর মধ্যে তিনি রেখে গিয়েছেন স্ত্রী দুই পুত্র এবং গোটা ছয়েক বিবাহ বহির্ভুত সন্তান।
তাঁর মৃত্যুর পর প্রাসাদটি উজবেকিস্তানের শিল্প জাদুঘর, পুরাকীর্তি ও জহরতের জাদুঘর, সোভিয়েত আমলে পাইওনিয়ার নামে পরিচিত তরুণ স্কাউটদের আবাস হয়ে শেষাবধি উজবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিসেপশন হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটার ভেতরের চত্বরের বিশাল চিনার গাছগুলোর বয়স কমপক্ষে একশ ত্রিশ বছর। সেগুলোর নিচে ঝরা পাতার রাশি দেখে জনহীন বাড়িটাতে প্রাণের স্পন্দন আছে বলে মনে হয় না।


ছবি: ব্রডওয়ে আর্ট বাজারে পথশিল্পীদের করা নিখুঁত স্কেচ

রোমানভের বাড়ি থেকে বের হয়ে বিশাল চওড়া রাস্তা সরাফ রশিদভ অ্যাভিনিউ, তার উল্টো পাশে একটা উঁচু আরেকটা খাটো ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং দেখিয়ে আবদুল্লা বলে, ফাইনান্স মিনিস্ট্রি বিল্ডিং। ও জানায়, বেঁটে ভবনটা এটুকু তোলার পর বরাদ্দের টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে আর উঁচু করা হয়নি। ওর কথার সত্যতা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। পেশাদার গাইডেরা অনেক সময় ট্যুরিস্টদের মজা দেওয়ার জন্য এজাতীয় কিছু আজগুবি তথ্য দেয়, এটা সেরকম কিছু হতে পারে।
অ্যাভিনিউর তলা দিয়ে আন্ডারপাস ধরে ওপারে গেলেই মুসতাকিলিক মায়দোনি, অর্থাৎ ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কোয়ার। এখানে রয়েছে উবেকিস্তানের মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ মন্ত্রীদের দফতর এবং উজবেক পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ, অলি মজলিস। জারের আমলে এটার নাম ছিল ক্যাথেড্রাল স্কোয়ার। অক্টোবর বিপ্লবের পর এই স্কোয়ারের নাম হয় রেড স্কোয়ার, তারপর লেনিন স্কোয়ার। উজবেকিস্তানের স্বাধীনতার (১৯৯১) পর এই বিশাল চত্বরের নামকরণ করা হয় ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কোয়ার। মূল স্কোয়ারটি রাস্তা থেকে ভেতরে, একটা হালফ্যাশনের গেটের ওপর তিনটা উড়ন্ত পরস্পরসংলগ্ন সারস পাখির ভাস্কর্য, এই গেটের নাম ইজগুলিক আর্চ। ভেতরের মূল স্কোয়ারে শিশু কোলে চিরন্তন মায়ের ভাস্কর্য নিয়ে স্বাধীনতা স্তম্ভ, স্তম্ভের মাথায় বিশাল ভূ-গোলক। আমরা সময় বাঁচাবার জন্য ভেতরে না ঢুকে ইজগুলিক আর্চের সামনে দিয়ে দুপাশে বিশাল চিনার গাছের সুড়ঙ্গের মাঝপথ দিয়ে হেঁটে যাই। সূর্য তখন বড় বড় গাছের পেছন দিয়ে নেমে পড়ার আগে নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে দেখছিল পেছন দিকে। দূরের অল্পবয়সী গাছগুলোর পাতা আশ্চর্য পাটকিলে রঙে নেয়ে উঠেছে যেন। পাশের লম্বা কৃত্রিম লেকের শান্ত জলের আয়না সেই পাতার বিম্বিত বর্ণে রঙিন।


ছবি: প্রিন্স রোমানভের প্রাসাদ

লেকের অংশটুকু পার হয়ে আবার ঢুকে পড়ি বিশাল বৃক্ষের ছায়া ঢাকা পার্কের গভীরে। এই অংশটুকু পার হয়ে এগিয়ে গেলেই আচমকা আড়াল থেকে যেন বেরিয়ে আসে এক বিশাল ভাস্কর্য। এক মাথা সমান উচ্চতার বেদির ওপর বসা এক বয়স্কা নারীমূর্তি, মাথায় ঘোমটা পরে হাঁটুর ওপর হাত রেখে বসে আছে নতমুখে। তার সামনে গোলাকার চৌবাচ্চার মতো নিচু বাঁধানো বৃত্তের কেন্দ্রে লাফিয়ে উঠছে আগুনের অনুচ্চ শিখা। তার বিষাদভারাক্রান্ত দৃষ্টি যেন আগুনের শিখার স্তিমিত দহনে জ্বলে যাচ্ছে অহর্নিশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিখোঁজ কিংবা নিহত পুত্রের প্রতীক্ষায় ক্লান্তিহীন বসে থাকা এই শোকাতুরা মা যেন জগতের সকল প্রতীক্ষারত মায়ের প্রতিরূপ। এই যুদ্ধের বিভীষিকা নানাভাবে স্পর্শ করেছিল উজবেকিস্তানের প্রতিটি পরিবারকে। যুদ্ধে নিহত ও নিখোঁজ প্রায় চার লক্ষ উজবেক সৈনিকের মা কিংবা স্ত্রী এভাবেই দিনের পর দিন প্রতীক্ষায় কাটিয়েছেন দুঃসহ প্রহর। এখানে উল্লেখ করা যায় ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ১৪ লক্ষ উজবেক সৈনিক রেড আর্মির সাথে যোগ দিয়েছিল জার্মানির বিপক্ষে। এদের মধ্যে সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২ লক্ষ ৬৩ হাজার নিহত আর ১ লক্ষ ৩২ হাজার নিখোঁজ হয়েছিল পূর্ব রণাঙ্গনে। উজবেকিস্তানের মানুষ যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য যোগান দিয়েছিল ৬৫ কোটি রুবল, ৫৪ কেজি সোনা ও রূপা, ২০ লক্ষ জোড়া জুতো এবং লক্ষ লক্ষ শীতবস্ত্র। হাজার হাজার এতিম শিশুকে দত্তক নিয়েছিল উজবেক পরিবারের লোকজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বহু দূরে থাকলেও বইপত্র আর সিনেমার কল্যাণে সেই বিভৎস সময়ের বিপন্ন মানবতার স্বরূপ কিছুমাত্রায় উপলব্ধি করতে পারি। ভাস্কর্যটির নির্মাণশৈলীর চেয়ে বেশি অকৃত্রিম যেন এই রমণীর বসার ভঙ্গী Ñ ক্লান্ত, অসহায় ও হতাশ। নাতিপ্রশস্ত এই কমপ্লেক্সের অন্যপাশে টানা করিডরে পেতলের পাতায় উৎকীর্ণ আছে যুদ্ধ থেকে না ফেরা সৈনিকদের নামের মিছিল। যুদ্ধে নিহত ও নিখোঁজ সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশে প্রতি বছরে ৯ মে তারিখে উজবেকিস্তানে পালিত হয় 'স্মৃতি ও সম্মাননা দিবস', সেদিন এই শোকাতুরা মায়ের পদতল ভরে ওঠে ফুলে, সেনাদল জানায় আনুষ্ঠানিক সামরিক অভিবাদন। বেদির ওপর বসা ময়ের দৃষ্টি সেদিকে পড়ে কি পড়ে না। আমরা বসে থাকতে থাকতে চারপাশের গাছের মাথায় বিদায়ী সূর্যের ম্লান আলো সৃষ্টি করে এক অপার্থিব আভা। খানেক পরেই এখানে নামবে অন্ধকার, কেবল প্রজ্জলিত শিখাটি ঠেকিয়ে রাখবে তার আগ্রাসন।


ছবি: ইজগুলিক আর্চের মাথায় সারস পাখির ভাস্কর্য

কিছুটা ভারি মন নিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরে আবার পৌঁছে যাই স্বাধীনতা স্কোয়ারে। ইজগুলিক আর্চের সামনে থেকে পাতাল পথে নেমে যে একটা মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে যাবো, আগে থেকে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তাসখন্দের প্রায় সবগুলো মেট্রো স্টেশনে ঢোকার পথ এমনই সাদামাটা, অথচ ভেতরে রয়েছে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের নিদর্শন, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই।
তাসখন্দের দ্রুত নগরায়ন ও বাড়তি জনসংখ্যার সাশ্রয়ী পরিবহন চাহিদা মেটানোর জন্য এখানে মেট্রো রেলের কাজ শুরু করা হয় ১৯৬৬ সালের ভূমিকম্পের দুবছর পর। রুশ বিপ্লবের ষাটতম বার্ষিকী উদযাপনের প্রাক্কালে তাসখন্দ মেট্রোর প্রথম ধাপ চালু করা হয় ১৯৭৭ সালে। এখন মোট ৩৭ কিলোমিটার লাইনে চালু রয়েছে ২৯ টি স্টেশন। উল্লেখ্য তাসখন্দ মেট্রো হচ্ছে মধ্য এশিয়ার দুটি মাত্র মেট্রোর একটি, আরেকটি রয়েছে কাজাখস্তানের আলমাতিতে।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বত্র যে ঢাকঢাক গুড়গুড় অবস্থা ছিল, মেট্রো স্টেশনগুলোও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এগুলো যে কেবল স্টেশন, তা নয়, সামরিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবেও মেট্রো স্টেশনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো। পরমাণু বোমা হামলার সময় এগুলো যাতে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে তার জন্য রাখা হয়েছিল পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এমনকি কিছু স্টেশনে ব্যাংকের ভল্টের দরজার মতো ভারি দরজার দেখা মেলে, যাতে পরমাণু হামলার সময় এই সব ভারি দরজা লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে আশ্রয় নেওয়া সাধারণ নাগরিক ও সেনা বাহিনীর সদস্যদের রক্ষা করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টুকরো হয়েছে ২৮ বছর, বিদায় হয়েছে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, অথচ মাত্র সেদিন, অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত এখানকার মেট্রো স্টেশনের ভেতরের বা বাইরের ছবি তোলা ছিল রীতিমত নিষিদ্ধ।
আবদুল্লা আমাদের নিয়ে পাতালে নেমে টিকিট কিনে নেয়। টিকিটের দাম এক হাজার ২০০ সোম, অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১২ টাকার মতো। এটা নাকি প্রাক্তন সোভিয়েত যুগের সবচেয়ে শস্তা সাবওয়ে ভাড়া। মেট্রোতে ঢোকার পথটা যত নিস্প্রভ মনে হয়েছিল, প্লাটফরমে নেমে নকশাদার স্তম্ভের সারি, ছাদ থেকে ঝুলে থাকা জেল্লাদার ঝাড়বাতির সমারোহ দেখে উপলব্ধি করি প্রচ্ছদ দিয়ে সবসময় বই চেনা যায় না। আমাদের মেট্রোযাত্রা ছিল অতি সংক্ষিপ্ত, মাত্র একটি স্টেশন, মুসতাকিলিক মায়দোনি থেকে পরের স্টেশন আমির তিমুর খিয়োবোনি, অর্থাৎ আমির তিমুর স্কোয়ার স্টেশন। সোভিয়েত আমলে এই স্টেশনের নাম ছিল অক্টোবর রেভল্যুশন স্কোয়ার।
স্টেশন থেকে বের হয়ে এগোতেই পথে পড়ে জয়েন্ট স্টক কমার্শিয়াল ব্যাংকের মির্জা উলুগবেগ শাখা। পেশায় ব্যাংকার বলেই বোধকরি আমার নজর কাড়ে ওটার পাশে ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা তাসখন্দের স্টেট ব্যাংকের ইতিহাস। জার শাসনামলে রাশিয়া তাসখন্দ দখল করে ১৮৬৫ সালে, তার পর বলশেভিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত তাসখন্দে বেশ কয়েকটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব ব্যাংকে রাশিয়ান পুঁজির সাথে ছিল বিদেশী পুঁজিও। তেমনি একটা ব্যাংক ছিল স্টেট ইম্পেরিয়াল ব্যাংক। এটির তাসখন্দ শাখাটি ছিল ব্যাংকের শাখার তুলনায় অনুপযোগী একটা ভাড়াটে বাড়িতে। প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংকের টাকা রাখার ভল্টে ঢোকার এক ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনা ধরা পড়ে ১৮৯২ সালে। এই ঘটনার পর কনন্টানটিনোভস্কায়া স্কোয়ারে (বর্তমানের আমি তিমুর স্কোয়ার) স্টেট ইম্পেরিয়াল ব্যাংকের একটা নতুন ভবন নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়। বোর্ডটিতে আরও দীর্ঘ বয়ান আছে কীভাবে এই ব্যাংক বেড়ে ওঠে, কীভাবে এটিতে আরও কয়েকটা চুরির ঘটনা ঘটে। সেসব এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
আমরা বরং আমির তিমুর স্কোয়ারের দিকে নজর ফেরাতে পারি। জার শাসিত রাশিয়ান আমলে বিশাল এই স্কোয়ার এখনকার মতো এমন সাজানো গোছানো ছিল না। খানাখন্দে ভরা গ্রীষ্মে ধুলা আর বর্ষার কাদায় সয়লাব এই মাঠটিকে চারফালি করে মাঝ বরাবর পরস্পরকে ছেদ করে বের হয়ে গিয়েছিল দুটো সড়ক, কাউফম্যান সড়ক আর মস্কো সড়ক। দ্বিতীয়টি ছিল সিল্ক রোডের অংশ, যেটি ধরে চীন অবধি যাওয়া যেত। ফলে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পাশে যে স্টেট ব্যাংকের শাখা চালু করা হবে সেটাই স্বাভাবিক। পরবর্তী সময়ে এখানে রাশিয়া শাসিত তুর্কিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কনস্টানটিন পেত্রোভিচ ভন কাউফম্যানকে সমাহিত করা হয়েছিল বলে এটির নাম হয় কাউফম্যান স্কোয়ার। তার পর থেকে নাম বদলের পালা শুরু হয়। বলশেভিক বিপ্লবের পর মস্কো স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় এঙ্গেলস স্ট্রিট, কাউফম্যান স্ট্রিটের নাম দেওয়া হয় কার্ল মার্কস স্ট্রিট।


ছবি: খদ্দেরের অপেক্ষায়

অবশেষে উজবেকিস্তান যখন (১৯৯১) স্বাধীন হয়, তখন এটির নাম চূড়ান্তভাবে বদলে রাখা হয় আমির তিমুর স্কোয়ার। স্কোয়ারের ঠিক মাঝবিন্দুতে বসানো হয় তৈমুর লংয়ের অশ্বাসীন ব্রোঞ্জ মূর্তি। এই কেন্দ্র থেকে সবুজ ঘাসের লন পেরিয়ে বাঁধানো পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে বিভিন্ন দিকে। পরিকল্পিত প্যাটার্নে সাজানো বিভিন্ন বৃক্ষসারি, ফুলের বেড, ফোয়ারা ছড়িয়ে রয়েছে পুরো স্কোয়ার জুড়ে। গাছের মধ্যে এল্ম, পপলার আর চিনারই চোখে পড়ে বেশি। এসবের মধ্যে কিছুদূর পর পর বসানো আছে বসার জন্য বেঞ্চ। এখানে দাঁড়ালে চোখে পড়ে হোটেল উজবেকিস্তানের বিশাল বহুতল ভবন, চেহারায় সোভিয়েত স্থাপত্যের কাঠখোট্টা ভাব স্পষ্ট। তার অন্যপাশে ডম ফোরামের আধুনিক স্থাপত্যবৈশিষ্টম-িত ভবন। এটি উজবেকিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাষ্ট্রিয় অতিথি ভবন। রাষ্ট্রিয় মর্যাদার এই ভবনটি তৈরির সাথে নাকি প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী জড়িত ছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন স্থপতি, প্রজেক্ট ম্যানেজার এবং দক্ষ কারিগরদের এক বিশাল বাহিনী। দুর্জনেরা বলে, ২০১০ সালে এই স্কোয়ারের ছায়াময় শতবর্ষী চিনার গাছগুলো কেটে ফেলা হয় সাবেক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভের নির্দেশে, যাতে এই ভবনটি গাছের আড়ালে ঢাকা না পড়ে।
অতি সম্প্রতি এই ভবনটি ভিন্ন আরেক কারণে আলোচনায় উঠে এসেছে। ভবনটি উজবেকিস্তানের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ফোরামের সাথে জড়িত, আর এই ফোরাম হচ্ছে প্রেসিডেন্টের মেয়ে গুলনারা কারিমোভার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। গুলনারার বিরুদ্ধে অবৈধ প্রভাব খাটানোর বহু অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটা হচ্ছে টেলিকম কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য প্রায় ৮৬ কোটি ডলার উৎকোচ গ্রহণ, যা বর্তমান আইনে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ। এসব অভিযোগ এমনই অকাট্য ছিল যে প্রেসিডেন্ট কারিমভ বাধ্য হয়েছিলেন নিজের মেয়েকে গৃহবন্দী করে পরবর্তী সময়ে সেটিকে কারাদ-ে রূপান্তরিত করতে। আসলে ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত ব্যবসায়ী, কুটনীতিবিদ, ফ্যাশন ডিজাইনার ও পপশিল্পী গুলনারা ছিলেন তাসখন্দের ওপরের মহলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী। তাঁর ফ্যাশন শোতে উপস্থিত থাকতেন পশ্চিমী দুনিয়ার বাঘা বাঘা সেলিব্রিটিরা। তারপর আচমকা জনসমক্ষ থেকে উধাও হয়ে যান এই নারী। পরে জানা যায় তিনি তাঁর লন্ডনে পড়ুয়া মেয়ে ও দুই পরিচারিকা সহ গৃহবন্দী আছেন। পিতা ইসলাম কারিমভের জীবদ্দশাতেই তাঁরা যে বাড়িতে বন্দী, সে বাড়িতেই এক অস্থায়ী আদালত বসিয়ে কয়েক ঘন্টার বিচারসভার শেষে তাঁকে ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর পাঁচ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। আরও জানা যায়, গৃহবন্দীত্বের সময় গুলনারার পরিচারিকাদের একজন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা সইতে না পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন। প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৫ বছরের স্বৈরশাসন, নিষ্ঠুর দুঃশাসন, ২০০৫ সালে আন্দিজান নগরীতে নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ সহ অগনিত অভিযোগ থাকলেও তিনি যে তাঁর নিজ মেয়েকে শাস্তি দিতে পিছপা হননি, সেটা এক বিস্ময়। বিভিন্ন বাণিজ্যে রাষ্ট্রপতির কন্যার অবৈধ প্রভাব, একটি বিশেষ ভবনের নাম তাঁর সাথে জড়িত হওয়া, মালকিনের সাথে পরিচারিকার বন্দীত্ব, এসব কিছুর সাথে আমাদের দেশের কিছু ঘটনার আশ্চর্য মিল পাওয়া যায় এখানে।
এরকম কাহিনী জানার পর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগ মুহূর্তে ডম ফোরামের সুদৃশ্য ভবনটিকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। জানা যায়, গুলনারার সাংস্কৃতিক ফোরামের সাথে সম্পর্কের কারণে এই ভবনটি সত্যিই এখন কিছুটা কোণঠাসা, কালেভদ্রে ব্যবহার করা হয়। ওটার ছাদের মৃদু উত্তল গম্বুজের ওপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দুটো সারসের সিল্যুয়েট মূর্তিকেও যেন বিষণœ দেখায়। ঠিক সে সময় একদল মেয়ে কলকল করতে করতে সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের দলটিকে দেখে ওরা কৌতুহলভরে এগিয়ে এসে আলাপ করে। আলাপে জানা যায় সবাই ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ওরা। আমাদের দলটিকে দেখে ওরা কৌতুহলভরে এগিয়ে এসে আলাপ করে। কিছুক্ষণ ধরে বিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়ে এবং নানান প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমাদের দলের মহিলাদের সাথে ফটোসেশনের পর কলকল করতে করতে নির্জন স্কোয়ারের প্রশান্তিতে টোল ফেলে চলে যায়।
কোনো নগর ভ্রমণে গেলে সেখানকার মানুষজনের জীবনযাত্রা বোঝার জন্য স্থানীয় বাজার দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই তাসখন্দে আমাদের ভ্রমণসূচিতে চরসু বাজার দেখে অবাক হইনি। প্রাচ্যদেশীয় সমাজ জীবনে হাট বা বাজার ছিল একটা জনপদের মূল কেন্দ্র। এগুলো যে কেবল নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বেচাকেনার জায়গা তা নয়, এসব ছিল মানুষের সম্মিলন ও সামাজিক মেলামেশার জায়গাও। আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে নাভাই অ্যাভিনিউ ধরে কয়েক কিলোমিটার পথ গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় জমজমাট চরসু বাজারে। এক সকালে আমাদের তুলে নিয়ে সেই বাজারে ছেড়ে দিয়েও সঙ্গ ছাড়ে না আবদুল্লা। বাজারের চৌহদ্দিতে ঢুকতেই নজর কাড়ে ফিরোজা, নীল আর সাদা রঙের মিলিত নকশার বিশাল গম্বুজ। মূল বড় গম্বুজটি ছাড়াও আরো কয়েকটা অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ দেখা যায়। গম্বুজের নিচে বাজার বুখারাতেও একাধিক দেখে এসেছি, মেটে রঙের সে সব গম্বুজের কোনোটিই চরসুর বর্ণিল গম্বুজগুলোর ধারে কাছেও লাগেনা। রোদ, বৃষ্টি আর ধুলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বাণিজ্য পথের ওপর স্থাপিত এসব বাজারে বিকিকিনির পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হতো নানান সাংস্কৃতিক কর্মকা-।
মূল বাজারে ঢোকার আগে আবদুল্লা আমাদের নিয়ে ঢোকে নানান হস্তশিল্প পণ্যে ঠাসা বড় এক দোকানে। সেটি এমনই ঠাসা যে, নড়াচড়া করতেও ভয় লাগে, পাছে কোনো মৃৎপাত্র কি মহার্ঘ্য ফুলদানি গায়ের সাথে লেগে পড়ে ভেঙে যায়। সেদিন খাস্ত ইমাম স্কোয়ারের স্যুভেনির শপ থেকে কোনো কিছু কিনতে দেয়নি বলেই আবদুল্লা প্রথমেই আমাদের এখানে ঢুকিয়ে দেয়। দলে চারজন মহিলা থাকলে যা হয়, ওদের সামলাতে দোকানের দুতিন জন বিক্রয়কর্মীর দিশেহারা অবস্থা। দর কষাকষির জন্য আবদুল্লা তো মজুত আছেই, নিজে থেকেই এখানে নিয়ে এসেছে বলে দাম নিয়ে টানা হ্যাঁচড়ার দায়িত্বটা ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে দোকানের প্রায় তিনভাগের দুইভাগ জিনিসকে ছেনে ফেলতে থাকেন।
দোকানটির বাইরের চাতালের ওপারে অপেক্ষাকৃত ছোট কয়েকটা দোকান, কোনোটিতে কার্পেট, কোনোটিতে লেপ কম্বল, চাদর, বালিশ, কুশন ইত্যাদি, কোনোটিতে হস্তশিল্পজাত জিনিসপত্রের লোভনীয় সম্ভার। উজবেকিস্তানের ট্রাডিশনাল পোশাকের দোকানে ঝুলছে বাহারি কুর্তা, কোট, শাল। দোকানের বাইরে রাস্তার পাশে সাজিয়ে রাখা জাতীয় পোশাক পরানো ছোট ছোট মূর্তি, বড়বড় মাটির ফুলদানি। ঢাকা নিউ মার্কেটের মতো বাইরের খোলা চাতালেও পণ্য সাজিয়ে বসা কিছু ভাসমান দোকান। সেকারণেই বাজারের এই অংশটির চেহারা বেশ পরিচিত ঠেকে।
রাশিয়ানরা আসার আগে তাসখন্দ ছিল চারটি উপশহরের একটা নগর। এসব উপশহর শাসন করতেন চারজন হাকিম, যাদের বলা যায় মেয়র। এরা নির্দিষ্ট বিরতিতে কিংবা কখনো জরুরিভিত্তিতে সভায় বসতেন, যাকে বলা হতো 'চরহাকিম', অর্থাৎ চার মেয়র। চার উপশহরের বাসিন্দারা কখনো কখনো সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়তো। তখন বাইরে থেকে কাজাখ বা উজবেকদের সাহায্যের জন্য ডেকে আনা হতো। চার মেয়রের আধিপত্য শেষ হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, নতুন নেতৃত্বে হাকিমদের নিয়োগ দেওয়া হয় উপদেষ্টা হিসেবে।
ফার্সি 'চরসু'র বাংলা করলে দাঁড়াবে 'চার নহর', বা চার নহরের সংগমস্থল। অর্থাৎ এখানে বাণিজ্য এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য মিলিত হতো চারটি উপশহরের মানুষ। যে বিশাল বর্ণিল গম্বুজটি এখন দৃশ্যমান, সেটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ভূমিকম্পের পর। তবে গম্বুজঢাকা বাজারের পরম্পরাটা এখানে টিকিয়ে রাখা হয়, সোভিয়েত রাশিয়ার আজদাহা সাইজের কংক্রিটের ঢাউস কিছু বানানো হয়নি। সেকারণেই বোধকরি তাসখন্দের অল্প কয়েকটা আকর্ষণের মধ্যে চরসু বাজারও একটা দ্রষ্টব্য। রাশিয়ানরা তাসখন্দ দখল করার পর ব্যাপক নির্মাণকাজ শুরু হলে নগরীর পুরনো এবং নতুন অংশের মধ্যে পরিবর্তনটা জোরালো হয়। পুরনো অংশে থেকে যায় মুসলমানপ্রধান মধ্য এশীয় নাগরিকেরা, অন্যদিকে বেড়ে ওঠে জনসংখ্যার ইউরোপীয় ও রাশিয়ান অংশটি। হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে পুরনো অংশটিতে রয়ে গিয়েছিল মধ্য এশিয়ার বৈশিষ্ট্যম-িত স্থাপত্যগুলো। সেসবের বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ভূমিকম্পে। ফলে পুরনো অংশের অনেক কিছু নতুন করে তৈরি করলেও প্রাচ্যের আদলে রেখে দেওয়া হয়েছিল মূল বাজারটি, যেটি দেখতে এসে আমাদের একবেলা কাটে। এটির পাশেই একসময় স্থানীয় কারিগরেরা বিক্রি করতো কাঠের আসবাব, বাদ্যযন্ত্র ও নানান গৃহস্থালী সরঞ্জাম। সিল্করুটের পাশের এই গুরুত্বপূর্ণ বাজারটিতে বাণিজ্যের পাশাপাশি লোকজন কাছের-দূরের মানুষের সাথে বিনিময় করতো খবরাখবর, উপভোগ করতো গানবাজনা, বাজিকরদের কসরত, মোরগ লড়াই কিংবা চাইখানায় বসে মশগুল হতো আড্ডায়।


ছবি: জাফরান আর গুড়ো মশলার উজ্জল আভা

স্যুভেনিরের দোকানের বাইরে রাস্তার পাশে পশরা বিছিয়ে দুই অসম বয়সী মহিলা পাশাপাশি বসে, একজনের কাছে চকলেটের প্যাকেট, নেসকাফে কফির বয়াম, কয়েক ব্র্যান্ডের চায়ের বাক্স, আচার ইত্যাদি। বয়স্কজনের সামনে ছড়ানো রয়েছে চিরুনী, চুলের ব্রাশ, ক্লিপ, রিবন ইত্যাদি মেয়েদের জিনিস। এখান থেকে একপাতা ক্লিপ আর কি যেন কিনে মিনা আমাকে দাম দিয়ে দিতে বলে। দাম কত জিগ্যেস করলে মহিলা হাতের তিন আঙুল তুলে দেখায়। আমি খুব মনোযাগ না দিয়ে তিনখানা দশ হাজার সোমের নোট ধরিয়ে দিলে কম বয়সী মহিলা বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে কী যেন বলে ওঠে, আমি ঘাবড়ে গিয়ে পিছু হটতে শুরু করলে মহিলা আমাকে দুখানা নোট ফিরিয়ে দিয়ে আরও সাত হাজার সোম ফেরত দেয়। এবারে বুঝতে পারি, ওরা চেয়েছিল তিন হাজার, আমি উজবেক সোমের দুর্বলতা বিবেচনা করে দিয়েছিলাম ত্রিশ হাজার। এরা হয়তো বা মা মেয়ে কিংবা শ্বাশুড়ি বউ। ওদের সরলতা ও সততায় স্তম্ভিত হয়ে বারবার থ্যাংক ইউ বললে ওরাও কেবল থ্যাংকু থ্যাংকু করতে থাকে, আর অবোধগম্য ভাষায় আমার বোকামীর কথা বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে। প্রতিদান হিসেবে ওদের ছবি তুলতে চাইলে প্রথমে কিছুটা আপত্তি করেও শেষে দুজনেই দোকান ছেড়ে উঠে এসে সহজ ভঙ্গিতে পোজ দেয়। ভাষার কারণে ওদের সাথে দুদ- আলাপের সুযোগ হয় না।
এখান থেকে এগিয়ে গেলে চরসুর মূল আকর্ষণ বিশাল গম্বুজঘেরা বাজার। এটার ঘের কত বড় ধারণা করতে পারি না, আড়াইশ তিনশ মিটারের কম হবে না। কয়েক ধাপ সিড়ি বেয়ে ঢোকার পথ, সেখান থেকে আবার একপ্রস্থ সিড়ি ভাঙতে হয়। এই ফ্লোর যেন বিশাল চওড়া বৃত্তাকার ব্যালকনি, মধ্যিখানটা পুরোটা খোলা। সেখান দিয়ে নিচে তাকালে নিচ তলার পুরো ফ্লোর জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় মাছ-মাংশের দোকান। আমাদের কাঁচা বাজারের মতো গরু বা খাসির রান ও সিনা ঝোলানো, সাজিয়ে রাখা চামড়া ছাড়ানো মুরগি। আবার ফ্রিজের মধ্যে হিমায়িত মাংশের দোকানও কম নেই। তবে এই বাজারে হিমযন্ত্রটিকে বেমানান লাগে। দোতলার এই ফ্লোরটির যেদিকে তাকাই কেবল শুকনো ফল, বাদাম ইত্যাদির দোকান। বাজারের গমগম শব্দ না থাকলেও মানুষের সমাগম, কেনাকাটা Ñ কোনোটারই কমতি নেই। এরকম বাজারে ট্যুরিস্টদের কেনার মতো একমাত্র জিনিস শুকনো ফল আর বাদাম ইত্যাদি। সেকারণেই আবদুল্লা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে বুঝতে পারি। দোকানিদের সামনে থরে থরে সাজানো কাঠবাদাম, পেস্তা বাদাম, কাজু বাদাম, চীনা বাদাম, আখরোট, আলুবোখারা, শুকনো ডুমুর, কিসমিস, খেজুর, নাম না জানা ফলের বীজ। সব দোকানেই একই জিনিস। সেখান থেকে ইচ্ছেমতো খেয়ে স্বাদ পরখ করে অর্ডার দেওয়া যায়, দোকানির কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। দামে শস্তা বলে কিংবা খদ্দেরের এই স্যাম্পল খাওয়ার খরচও দামের মধ্যে ঢোকানো থাকে কেউ আপত্তি করে না। এমনকি এটা ওটা খেয়ে না কিনে চলে গেলেও সমস্যা নেই। ফলে যে দোকান থেকে আমাদের দলটি পুরো সদাই করে, সেখান থেকে বিরামহীন খেয়ে আমাদের সবার বাদামে অরুচি চলে আসে।
বড় গম্বুজের ভেতর থেকে নেমে এলে পাশের বাজারটির একপাশে কাঁচা ফল, পেয়াঁজ, রসুন, আদা সহ মসলাপাতির দোকান। মসলার পরিচিত মিষ্টি ঝাঁজালো গন্ধে চারপাশ ভরে আছে। অন্যপাশে তাকালে চূড়া করে রাখা জাফরানের উজ্জল আভায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বাজারের এই অংশটিকে আমাদের খুব পরিচিত মনে হয়। এক সময় বড় মুদি দোকানে গেলে এরকম বাজারের ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখা যেতো। আজকাল প্যাকেট করা বিপনন ব্যবস্থায় সেই স্মৃতিময় ঘ্রাণ কেবলই অতীত। বাজারের এই অংশের বাইরে পথের পাশে দেখা যায় তাজা ফল, শাক-সবজি সাজিয়ে বসা দরিদ্র চেহারার মহিলাদের। খোবানি, খেজুর, কিসমিসের মতো শুকনো ফল নিয়ে বসেছে কেউ কেউ, নানান রঙে প্রক্রিয়াজাত একই ফল তৈরি করেছে বহুবর্ণ কোলাজ। তাজা ফলের মধ্যে আপেল আর কমলাই চোখে পড়ে বেশি। কমলা আর জাফরানের মিলিত রঙে বাজারের একাংশ পায় বাড়তি উজ্জলতা। বাজারে তরমুজ বিক্রির ওপর মেয়রের আচমকা নিষেধাজ্ঞার কারণে কিংবা মৌসুম নয় বলেই হয়তো চোখে পড়েনি তরমুজ। এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টা সত্যিই মজার। ২০১১ সালে তাসখন্দের মেয়রের এক ফরমানবলে নগরীর সব বাজারে রসালো এই ফলটির বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। কারো মতে এটিতে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল মেশানোর কারণে, আবার কারো মতে হাসপাতালগুলোতে তরমুজ খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় এমন অনেক আজগুবি নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনা আছে। ২০০২ সালে সারা দেশে নিষিদ্ধ করা হয় বিলিয়ার্ড হলগুলো। কারণ হিসেবে খোলাখুলিভাবেই বলা হয় যে, এসব জায়গায় মদ সিগারেটের মারাত্মক দৌরাত্ম্য মানুষকে বখে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর স্বাধীন উজবেকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভের নির্দেশে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উজবেকিস্তানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচি থেকে সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়টি। তাঁর নিজের কিংবা তাঁর উপদেষ্টাদের মতে পাশ্চাত্য ধাঁচের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মডেলের জায়গায় উজবেক মডেল প্রতিস্থাপন করার জন্যই এই পদক্ষেপ।
কোলাহলময় নানান জাতির বিচিত্র জটলা, দেশী-বিদেশী ফলের বিপুল সম্ভার, অস্বাভাবিক উজ্জল বর্ণিল পোশাক, দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা এশীয় পসরার উজ্জল আভা, দূর দূরান্তের উদ্দেশে হেঁটে চলা ঘোড়ার ওপর আসীন সফেদ দাঁড়ির নূরানী চেহারার মানুষ, খচ্চর আর উট– সব যেন গলিত তেলের ওপর ভাসতে ভাসতে দক্ষিণায়নের রোদে চকচক করছে– বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এরকমই ছিল তাসখন্দের কোনো বাজারের বর্ণনা। এখন আর এই দৃশ্য কল্পনা করা যায় না, যদিও একটা জমজমাট বাজারের অতি পরিচিত দৃশ্য এটা। এই চরসু বাজারেই একসময় পথগায়ক, দড়াবাজ, ভেলকিবাজ, সার্কাসের ভাঁড়েরা জনসমক্ষে উপস্থাপন করতো নিজেদের কসরত। আমাদের গ্রামের সাপ্তাহিক হাটগুলোতে হুবহু না হলেও প্রায় এরকমই দেখা যায়। হাটের পথে অনেক দূর থেকে শোনা মৃদু গুঞ্জন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, কাছাকাছি হলে অনুভূত হয় জীবনের অস্তিত্ব, টের পাওয়া যায় মানুষের অনিঃশেষ কর্মচাঞ্চল্য। আজকাল কাঁচা বাজারে সেকালের মতো কেউ সখ করে যায় না, কিন্তু ঝানু ট্যুরিস্টের মতো আমরা মশহুর বাজারটি আলগোছে দেখে বুঝতে পারি, মানুষের অকৃত্রিম জীবনযাত্রা বোঝার জন্য এরকম বাজারই আসল জায়গা। চরসু বাজারের প্রাচ্য দেশীয় চরিত্র ও ঘ্রাণ, কৃত্রিমতাবর্জিত পরিবেশই ভিনদেশী মানুষদের এখানে টেনে আনে। ট্যুরিস্টদের বিরামহীন আনাগোনার কারণে সাধারণ বাজারের চেয়ে এটি বহুগুন বেশি সাফসুতরোও বটে। শতাব্দীপ্রাচীন বাজারটি থেকে যখন বের হয়ে আসি, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। অদূরে মাথা তুলে রোদ পোহাচ্ছে কুকেলদাশ মাদ্রাসার ফিরোজা গম্বুজ।