নাজলী লায়লা মনসুর-এর সাক্ষাৎকার

admin
Published : 4 Sept 2008, 09:12 AM
Updated : 4 Sept 2008, 09:12 AM

বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব নাজলী লায়লা মনসুর-এর জন্ম ১৯৫১ সালে রাজশাহী শহরে। চিত্রকলায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত ১৯৬৮ সালে তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজ-এ হলেও সমাপ্তিটুকু ঘটে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম


নাজলী লায়লা মনসুর

বিশ্ববিদ্যালয়-এর চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিত ছবি আঁকার কাজ চালিয়ে গেছেন। অংশ নিয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির বার্ষিক প্রদর্শনী এবং এশীয় দ্বিবার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনীসমূহে। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারিতে ২০০০ সালে। এরপর ২০০২ সালে ভারতের নয়াদিল্লির ললিতকলা একাডেমিতে তাঁর আরেকটি ছোট্ট প্রদর্শনী হয়। এ-পর্যন্ত তাঁর সবশেষ প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে, ২০০৫ সালে। তিনি তাঁর শিল্পকর্মের জন্য দেশেবিদেশে নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। নাজলীর ব্যক্তিজীবন, শিল্পীজীবনসহ বিবিধ প্রসঙ্গে এই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতাটুকু চট্টগ্রামে তাঁর পাহাড়ের কোলঘেঁষা বাড়িতে নেয়া হয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলম খোরশেদএহসানুল কবির

আলম খোরশেদ: আমরা জানি আপনি সমকালীন বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির চিত্রশিল্পী। এই জায়গাটিতে পৌঁছাতে আপনাকে নিশ্চয়ই দীর্ঘ,

…….
Lovers and dead fish, Acrylic on canvas, 122 x 92 cm, 2008
…….
ঘটনাবহুল এক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আপনার একান্ত নিজস্ব সেই শিল্পযাত্রার গল্প বলুন।

নাজলী লায়লা মনসুর: আর সবার মতো আমিও ছোটবেলায় ছবি আঁকতাম। চট্টগ্রামে খাস্তগীর স্কুলে পড়ার সময়, ছবি আঁকায় আমার আগ্রহ দেখে অংকনশিক্ষিকা নমিতা দিদিমণি আমার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন। বলতে পারেন, তাঁর তত্ত্বাবধানেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমার ছবি আঁকার শুরু। আমার বড়বোনও ছবি আঁকার ব্যাপারে আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন। ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট হওয়াতে পরিবারের সবাই আমাকে সব ব্যাপারে উৎসাহ দিত। মেট্রিক পাশ করার পর আমার বড়বোন আমাকে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। উনি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যকলার ছাত্রী। তাই তার সঙ্গে তৎকালীন শিল্পকলার অঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের যোগাযোগ ছিল। যাই হোক, আর্ট কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন এখনকার অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, যেমন অলকেশ ঘোষ, আসেম আনসারী, মনসুর-উল-করিম, হাসি চক্রবর্তী, চন্দ্রশেখর দে, কাজী হাসান হাবীব, বনিজুল হক ও আরো অনেকে।

তখনও জয়নুল আবেদীন স্যার ছিলেন অধ্যক্ষ। তবে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে মাত্র দুইবার। একদিনের ঘটনা এখনো স্পষ্ট মনে আছে — খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা বারান্দায় অপেক্ষা করছিলাম বৃষ্টি থামবার জন্য। কেউ বেরোতে সাহস করছিলাম না। বারান্দায় সবাইকে দাঁড়ানো দেখে জয়নুল স্যার বললেন, 'সামান্য বৃষ্টিতেও যদি ভিজতে না পার তোমরা শিল্পী হবে কীভাবে?'

স্যারের এই কথাটা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। সেটা ছিল ১৯৬৮ সালের ঘটনা। তখন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গোটা দেশ উত্তাল। আমাদের কলেজ তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে মাঝখানে, আন্দোলনের প্রবল ধাক্কা এসে লাগে সেখানেও। আর্ট কলেজে আমার শিক্ষাজীবনের সাত-আট মাস না যেতেই এই আন্দোলনের কারণে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কী আর করা, ভর্তি হলাম বাড়ির পাশের হলিক্রস কলেজে। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হই ইডেন কলেজে। বিএ পাশ করে কী করব ভাবছি, এমন সময় জানতে পারি শিল্পী রশিদ চৌধুরী, উনি আর্ট কলেজেও আমার শিক্ষক ছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় মাস্টার্স চালু করেছেন। ওখানে ভর্তি হওয়ার জন্য চারুকলার ছাত্র থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল না তখন। এবারও আমার বড়বোনই খবরটা পেয়ে আমাকে পরামর্শ দিলেন ওখানে ভর্তি হতে। ভর্তি হয়ে গেলাম খুব আগ্রহ নিয়ে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফয়েজুল আজিম জ্যাকব আমার সহপাঠী ছিল। সেও এসেছিল আমার মতোই সাধারণ বিএ পাশ করে। আমরা '৭৪-এর ব্যাচ হলেও রেজাল্ট নিয়ে বেরোই '৭৬-এ। আমার সত্যিকারের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষা বলতে এই দুবছরই। শিল্পী রশিদ চৌধুরী যেমন গুণী শিল্পী, তেমনি ছিলেন সুযোগ্য শিক্ষক ও আন্তরিক তত্ত্বাবধায়ক। তাঁর কাছে আমরা সবাই ঋণী। আমি বিশ্বাস করি, প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটুকু করতে রাজি থাকলে আর একজন ভালো শিক্ষক পেলে অল্প সময়ের মধ্যেও অনেককিছু শেখা সম্ভব।

আ খো: এ তো গেলো ছবি আঁকা বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান আহরণের কথা। ক্যানভাসে-তুলিতে নিজের মত করে ছবি আঁকা এবং সেইসব ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করা শুরু করলেন কখন, কীভাবে?

না লা ম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোতে না বেরোতেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। অবশ্য আমি সৌভাগ্যবান যে আমার বিয়ে হয়েছিল চারুকলা বিভাগেরই শিক্ষক, চট্টগ্রামের এক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিবারের ছেলে আবুল মনসুর-এর সঙ্গে। বিয়ের পর আমি চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিই। ওখানে আমি চারুকলার ইতিহাস পড়াতাম। এদিকে বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে দুটো সন্তানের মা হই আমি। ফলে তখন ছবি আঁকার কোন ফুরসৎই ছিল না। ছেলেদুটো একটু বড় হলে ওদের মধ্যে ছবি আঁকার আগ্রহ দেখতে পাই। ওদের সঙ্গে খেলাচ্ছলে আমিও একটু আঁকাআঁকি করতাম। ওরা একটু বুঝদার হয়ে যাওয়ার পরই আমি আবার নিয়মিতভাবে ছবি আঁকতে শুরু করি। অংশ নিতে শুরু করি শিল্পকলা একাডেমির বার্ষিক প্রদর্শনী এবং এশীয় দ্বিবার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনীতে। এভাবে কয়েক বছরে আমার বেশ কিছু ছবি জমে যায়। সেই ছবিগুলো দিয়ে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারিতে ২০০০ সালে আমি প্রথম একক প্রদর্শনী করি। উদ্বোধন করেছিলেন বেগম মুশতারী শফি। এ-প্রদর্শনীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পরের বছরই ঢাকার আর্ট কলেজের জয়নুল গ্যালারিতে আমি আমার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী করি। এই প্রদর্শনীটি আমার কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে সাধারণ দর্শকদের বিপুল অংশগ্রহণের কারণে। আমি সবসময়ই চেয়েছি আমার ছবি যেন সবার বোধগম্য হয়, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই যেন এতে কিছু না কিছু অর্থ খুঁজে পায়।

জয়নুল গ্যালারিটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে একেবারে পথের পাশে অবস্থিত হওয়াতে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ পথচলতি মানুষ আমার প্রদর্শনীতে ভিড় জমায়। এরপর ২০০২ সালে ভারতের নয়াদিল্লির ললিতকলা একাডেমিতে আমার আরেকটি ছোট্ট প্রদর্শনী হয়। আসলে আমি সেখানে তখন আরো কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে একটি ফেলোশিপে কাজ করছিলাম। কথা ছিল কর্মশালা শেষে সবার কাজ নিয়ে একটি যৌথ প্রদর্শনী হবে। কিন্তু দেখা গেল এ-ব্যাপারে অধিকাংশ শিল্পীরই কোনো গরজ নেই। আমি তখন একাই আমার দেশের সম্মান রক্ষার্থে রাতদিন ছবি এঁকে মোটামুটি মানসম্পন্ন একটা প্রদর্শনী দাঁড় করাই। এ-পর্যন্ত আমার সবশেষ প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে, ২০০৫ সালে। তো, সংক্ষেপে এই হল আমার ছবি আঁকাআঁকি ও প্রদর্শনীর সালতামামি।

আ খো: প্রত্যেক শিল্পীই তার শিল্পকর্মে নিজস্ব কোনো ভাবনা কিংবা দর্শন প্রকাশ করতে চায়। আপনার ছবিতেও কি সেরকম কোনো বিশেষ বোধ বা বক্তব্যকে ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী আপনি?

না লা ম: একটা বোধ আমার ভেতরে খুব গভীরভাবে কাজ করে। সেটা হলো, সবার মাঝে থেকেও আমরা প্রত্যেকেই খুব একা। আমার ছবিতে দেখবেন অনেক মানুষের প্রতিকৃতি আছে। কিন্তু ওই অনেক মানুষের ভেতরেও আমি চেয়েছি প্রত্যেকটা মানুষের একাকীত্ব ও স্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তুলতে। পরিবারে, পেশায়, সাংসারিক জীবনে আমাদের সব ধরনের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতার পরেও, সব হাসি-আনন্দের ভেতরেও, কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বিষাদ ও নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে থাকে। সেই বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদই আমার ছবির কেন্দ্রীয় বোধ।

আ খো: ব্যক্তিগত বোধ, উপলব্ধির বাইরে আমাদের পরিপার্শ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো কি আপনার ছবিতে আসে?

না লা ম: আমি চারপাশের পরিচিত দৃশ্যকেই আমার ছবির বিষয় করি। বিষয় নির্বাচনের ভিতর দিয়েই আমাদের সামাজিক বৈষম্য, অসঙ্গতি, রাজনৈতিক অনুষঙ্গ, পরিবেশের ভাঙচুর প্রভৃতি আমার ছবিতে আসে।

এহসানুল কবির: আপনার ছবিতে আমাদের চিরচেনা রিকশা বাহনটিকে আসতে দেখি ঘুরেফিরে। এর কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা আছে?

না লা ম: সত্যি বলতে কী, আমার নিজের জীবনে রিকশাটাই সবচেয়ে ব্যবহৃত বাহন। রিকশায় চড়েই কলেজে যেতে-আসতে হয়। রিকশায় চড়ে ঘুরতে আমি পছন্দ করি খুব। রিকশা খুব আস্তে চলে বলে চারপাশের দৃশ্যগুলো খুব সহজে সুন্দরভাবে দেখা যায়। এক রিকশায় বসে আরেক রিকশাকেও খুঁটিয়ে দেখা যায়। ফলে, অবচেতনভাবেই আমার শিল্পকর্মে রিকশা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।

আ খো: আমরা জানি, রিকশা ও রিকশাচিত্র আমাদের লোকশিল্পের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শিল্পকৃতি হিসাবে রিকশাচিত্রকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আপনার শিল্পকর্মে এর কী ধরনের প্রভাব আছে?

না লা ম: রিকশাচিত্রের মধ্যে এমন একটা স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপার আছে যেটা খুব সহজেই আমাদের একান্ত নিজস্ব শিল্প-আঙ্গিক হিসাবে পরিচিত হতে পারে। এই সম্ভাবনাটাকে আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি এবং আমার ছবিতে একে ব্যবহার করি। বিশেষ করে রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি আমাদের রিকশাচিত্রীদের কাছে ঋণী। আমার ছবিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ও বর্ণবৈচিত্র্যের ব্যাপারটা রিকশাচিত্র থেকেই এসেছে।

আ খো: আপনার চিত্রকলার আলোচনায় অনেকেই নারীবাদের প্রসঙ্গ এনেছেন। এর কি কোনো যৌক্তিকতা রয়েছে? আপনি নিজে এই নারীবাদ ব্যাপারটিকে কীভাবে, কোন চোখে দেখেন?

না লা ম: আমি নিজে কখনো সচেতনভাবে নারীবাদের চর্চা করি নি। নারীবাদী অনুষঙ্গ আমার ছবিতে এসে থাকলে সেটা আমার সার্বিক সমাজ-পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবেই এসেছে। আমি আগেই বলেছি, আমি সমাজের অসঙ্গতি ও বৈষম্যকে ছবিতে তুলে আনতে চাই। নারীর প্রতি বৈষম্যও এর একটা উদাহরণ। তবে, আমি মনে করি এভাবে নারী-পুরুষ আলাদা করে না ভেবে মানুষের মানবিক উৎকর্ষের মানদণ্ডেই সবকিছু বিচার করা দরকার।

এ ক: নারীকে পণ্য বানিয়ে বিক্রয় করবার কিংবা নারীর শরীরকে পণ্যের মতো প্রদর্শন করবার বিরুদ্ধে বক্তব্য পাই আপনার ছবিতে। এগুলি কি আপনার সচেতন চিন্তার ফসল নয়?

না লা ম: সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী-বৈষম্য এবং সামাজিক অসমতা ও পীড়নের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ওগুলো আমার ছবিতে এসেছে। বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে সেগুলো আসে নি। এ-ব্যাপারগুলোকে আমি সামগ্রিক শোষণ ও বৈষম্যের অংশ হিসেবেই দেখতে ও দেখাতে চাই। এটাই আমার ছবির মূল সুর।

আ খো: আপনার ছবিতে আমরা প্রায়শই ব্যান্ডেজ-মোড়ানো একটা ফিগারকে নিষ্ক্রিয়ভাবে পড়ে থাকতে দেখি। এর তাৎপর্য কী?

না লা ম: ছবি আঁকতে আঁকতে একটা পর্যায়ে আমার মনে হলো, আমি অন্য সবার কথা বলছি, অন্যদেরকে আমার ছবিতে ফুটিয়ে তুলছি — কিন্তু আমার অবস্থানটা কোথায়? সমাজের অসঙ্গতি বা বৈষম্যগুলোর নিরসনে আমি কী ভূমিকা রাখছি –এ-বিষয়টা আমাকে খুব পীড়া দিতে লাগলো। তখন আমার ছবিতে ওই ব্যান্ডেজ-মোড়ানো ফিগারটা এসেছে। এর মাধ্যমে আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে, আমরা প্রত্যেকে যেন একেকটা ব্যান্ডেজের ভিতরে নিষ্ক্রিয়ভাবে গুটিয়ে আছি। ব্যান্ডেজটা কিন্তু খুব কোমল, আমরা চাইলেই ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারি; কিন্তু আমরা তা করছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও কিন্তু এর দায় এড়াতে পারি না।

আ খো: আপনার একেবারে সাম্প্রতিক কালের ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি আপনি নিজেই আপনার আগের চিত্রকর্মগুলোকে পুনরায় উপস্থাপন করছেন বেড-কভার, সোফা-কভার বা টেবিল-ক্লথের মতো আটপৌরে গেরস্থালি জিনিসপত্রের মধ্যে। এর কারণ কী?

না লা ম: একসময় আমার মনে হলো, চিত্রকর্মকে আমরা খুব বেশি নান্দনিক করে তুলছি, একে ড্রয়িংরুমের দেওয়াল কিংবা হোটেল-লবির শোভা

……..
Usable Painting (On bed & curtain), Acrylic on canvas, 153 x 122 cm, 2005
………
বাড়ানোর উপকরণ হিসাবেই ব্যবহার করছি। এর মাধ্যমে ছবির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমি এটা মানতে পারি না। তাই, নিজের ছবিগুলোকেই আমি সচেতনভাবে নামিয়ে এনেছি প্রাত্যহিক জীবনের নানান অনুষঙ্গে। এর মাধ্যমে ছবির একটা ব্যবহারিক মূল্যও খুঁজতে চেয়েছি।

আ খো: শিক্ষানবিশি, শিক্ষকতা, শিল্পীজীবন ও সংসারধর্মপালন — জীবনের এতসব বিচিত্র পর্ব পার হয়ে এই পর্যায়ে এসে আজ মানুষ, সমাজ, শিল্প বিষয়ে সামগ্রিকভাবে আপনার উপলব্ধি কী?

না লা ম: আমার মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট হলো প্রেমহীনতা। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান হলো প্রেম। মানুষের সঙ্গে মানুষের শুধু নয়; পশু-পাখি, গাছ-পালাসহ পুরো জগৎটার প্রতি ভালবাসা ও একাত্মতার বোধই মানুষের সত্যিকার কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আমাদেরকে, বিশেষ করে শিল্পীদেরকে, এই বিষয়টার প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

চট্টগ্রাম, জুন ২০০৮

২.
নাজলী লায়লা মনসুর-এর ছবি (১৯৮৭ – ২০০৮)
————————————
ছবির সংখ্যা: ২৮
————————————

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts