রুপালি ধ্বংসস্তুপ ও একটি গোলটেবিল বৈঠক

বাকী বিল্লাহ
Published : 25 Jan 2008, 07:23 PM
Updated : 25 Jan 2008, 07:23 PM


সিডরের পরে, ছবি: ফিরোজ আহমেদ

সবুজ প্রকৃতি চাঁদের আলো ধারণের জন্য যথাযথ নয়। রাস পূর্ণিমার রাতে বলেশ্বরের তীরে দাড়িয়ে এটিই লক্ষ করা গেল। বিস্তীর্ণ বলেশ্বরের শান্ত বুক আর গুড়িয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি-গাছপালার ওপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে জোছনা যেন একেবারে ফেটে পড়ছে। দূরে ঝুলতে থাকা একখণ্ড রুপালি টিনের ওপর চাঁদের সর্বাত্মক ঝাপ দেয়ার দৃশ্য দেখে অন্য কোনো সময় হলে অচেতনেই হয়ত কাব্য বেরিয়ে পড়ত, ‌'ও চাঁদ তুমি কেন মাটিতে নেমে এলে।' প্রকৃতির এক অগ্নিচোখ (সিডর) তার খাণ্ডবদাহনে সব ছারখার করে দিলেও আরেকটি চোখ মমতামাখানো আলোয় চারপাশ ছাপিয়ে দিয়ে যেন আশ্বস্ত করতে চাইছে–না, প্রকৃতি শুধু কেড়েই নেবে না, মানুষের সাথে

…….
সিডরের পরে, ছবি: ফিরোজ আহমেদ
……..
আবারো বাঁধবে ভালোবাসার যৌথ বসত। দৃশ্যকল্পের এরকম ভয়ংকর অনুপমতায় খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা পরাবাস্তবতার আমদানী ঘটতে পারত। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা ভাসমান মানব শিশু ও মায়া হরিণের শব তখনো স্মৃতিতে এত জান্তব যে চেতনায় ভাবালুতা প্রবেশের রন্ধ্রে তা গরম কাঠকয়লার মতই অস্তিত্বশীল।

কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পদ্ম হঠাৎ একটি উদ্ভট প্রশ্ন করে এসব নানা অপচিন্তার ছটফটানি থেকে আমাকে মুক্ত করল। পদ্ম ইউডা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টসে পড়ে, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী। পদ্ম সম্পর্কে একটি কথা বলা দরকার। অসাধারণ কয়েকটি গণসঙ্গীতের স্রষ্টা সে। ওর সৃষ্টি 'হাতে হাত চোখে চোখ' `রাত যায় আসে রাত' 'এক দেশের সব স্বপ্নওয়ালা' বিভিন্ন ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফেরে। দু সারিতে সমান্তরাল ভাবে স্থাপিত গণকবরের পাশে অনেক সময় নিবিষ্ট মনে দাড়িয়ে পদ্ম যে প্রশ্নটি ছুড়ে দিল তা হল, এখানে ১১টি কবর বাচ্চাদের, বাকিগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের, কিন্তু সব কবরই একই সাইজের কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি দিলাম না। তাফালবাড়ি লঞ্চঘাট ছেড়ে ক্যাম্পের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। উত্তরের আশা না করে সেও হাঁটা ধরল। আমরা এখানে এসেছি কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচি, খেলাঘরের যৌথ ত্রাণ ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। জায়গাটা বাগেরহাট জেলার শরণখোলা থানার সাউথখালী ইউনিয়ন।

ফেরার পথে কিছুদূর এগিয়ে সামনে একটা জটলা। ছোট একটা পিক আপে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। কার কার্ড আছে কার কার্ড নেই এসব আলোচনা, 'ওমুক পাঁচফির-সাতফির নেছে, মোর একফিরও জোটলে না' জাতীয় আহাজারি পেরিয়ে একটু সামনে এসে পাওয়া গেল উদাস চেহারার ছোটখাট মধ্যবয়স্ক এক লোক। স্পষ্ট বোঝা গেল, ত্রাণের দড়ি টানাটানিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক নন। বেশি ভাব বিনিময়ের দরকার হল না। পিঠে হাত রেখে আস্তে করে বললাম, চলেন, বাজারে গিয়ে চা খাই। তিনি চললেন আমাদের সাথে। হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে জানতে চাইলাম, পরিবারের সবাই আছে তো ঠিকঠাক? খুব স্পষ্ট এবং স্বাভাবিক গলার উত্তরে জানা গেল, তার ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতি নেই। আরেকটু এগোতেই অন্য একজন দাঁড়ালেন সামনে। কিছুক্ষণ আগে যুক্ত হওয়া আমাদের নতুন সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলেন, বক্কার, যাও কোম্মে? জানা গেল, আমাদের সঙ্গীর নাম বক্কার, সম্ভবত আবু বকর। বক্কার কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু বললেন, আও। আরো একজন যুক্ত হল আমাদের সাথে।


সিডরের পরে, ছবি: ফিরোজ আহমেদ

আমাদের ক্যাম্প অর্থাৎ তাফালবাড়ি স্কুল এন্ড কলেজ ছাড়িয়ে বাজারের মোড়। সেখান থেকে আরো সামনে এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় একটা চায়ের দোকান। এটা হয়ত আজ কালের মধ্যেই চালু হয়েছে। ছোট একটা একচালা, সামনে দুটো বেঞ্চ। আশেপাশের অনেক বড় এলাকার কেন্দ্র তাফালবাড়ি বাজার। এখন ত্রাণের আশায় এই বাজারকে ঘিরে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের আনাগোণা। এর বাইরে আছে ত্রাণ কর্মীরা। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সময়টা খারাপ না। দোকানে আগে থেকেই ছিল যুবক দোকানী কালাম, তার চাচাতো ভাই তাহের ও জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা অনেক বয়স্ক একজন। চায়ের অর্ডার হল, আলাপ পরিচয় হল এবং গোলটেবিল বৈঠকও শুরু হল, যদিও গোল বেঞ্চি বৈঠক বলাটাই বেশি সঙ্গত। আমি আর পদ্ম ছাড়া উপস্থিত পাঁচজনের মধ্যে চারজনই দুপুরে আমাদের লঙ্গরখানার খিচুড়ি খেয়েছেন, সবাই খিচুড়ির সাথে ফুলকপি ও আলুর টুকরো পেয়েছেন। যে কারণে লঙ্গরখানা সংশ্লিষ্ট হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পরে বেশ একটা সম্মানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলাম এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকের সঞ্চালকের দ্বায়িত্ব পেয়ে গেলাম। আলোচনা শুর করল তাহের। কয়েকদিনে সবচেয়ে বেশি শোনা বাক্যটি দিয়েই সে কথা পাড়ল, যারা মরেছে তারাই বেঁচেছে, বেঁচে গিয়ে তার হয়েছে মরণদশা। বুড়ি মা, বিধবা দুই ভাবি আর তার ছেলেমেয়েদের সারা বছর কী খাওয়াবে? 'তেরান খাইলাম নয় এক মাস, হেইফির?' সতের সদস্যের পরিবারের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে তারা তিন ভাই বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল, নৌকা আর জালের মায়া ছাড়তে পারেনি। দু'ভাই মরেছে, তাহের বেঁচে আছে। নৌকা, জাল, ঘরবাড়ি সবই গেছে। সুযোগ নিয়ে আমি মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আর ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা নিয়ে লম্বা এক দার্শনিক বক্তব্য দিয়ে দিলাম। দেখা দেল দার্শনিকতায় তাদের অনুরাগ কম নয়, তারা মন দিয়ে আমার কথা শুনলো এবং বুঝল। বক্কার লজ্জা ভেঙে স্পষ্ট জানাল, এতকিছুর পরেও যে সে বেঁচে আছে সেই আনন্দ কম না। অন্যরাও মানল কিন্তু তাহের মানল না। সে না-সূচক মাথা নেড়ে গেল।

রাত বাড়ল, দোকান বন্ধ হল, কেরোসিনের গুরুত্ব বিচারে চেরাগ বন্ধ করা হল কিন্তু চাঁদের আলোয় রুপালি ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে আমাদের বৈঠক চলতে লাগল। বুড়ো লোকটি শুধুমাত্র একবারের জন্য হাঁটুর মধ্যে থেকে মাথা বের করে বলল, 'মোগো এলেকা অইছে মা ফাতেমার ব্যাভার (যৌতুক)। এডু যহন গ্যাছে তহন বোজ, কেয়ামতের আর দেরি নাই।' বক্কর একথা শুনে ক্ষেপেই গেল, 'ভারি আমার ব্যাভার, দ্যাহেন দেহি ব্যাভারের কী ছিরি!' এ রকম অনেক বিষয়েই আমরা একমত হলাম, অনেক বিষয়ে হলাম না। কিন্তু সুন্দরবনের ব্যবহার নিয়ে আমার একটি বক্তব্যে রীতিমত প্রতিরোধের সামনে পড়লাম। যখন বললাম,বনের গাছ কেটে তারা নিজেদের জন্য এতবড় বিপদ ডেকে এনেছে তখন সমস্বরে আপত্তি উঠলো। বুড়ো এবার মাথা বের না করেই গোজগোজ করে জানাল, এ কথার কোনো ভিত্তি নেই, জঙ্গল আল্লাহর দান, গাছ কেটে এটা কমানো যায় না। যেখানে আমরা বসে আছি এখান থেকে তিন কিলোমিটার সামনেই বলেশ্বর পাড়ি দিলে গহীন বন। মাছ ধরার পাশাপাশি টুকটাক গাছ চুরি এখানকার লোকের বৈধ পেশা হিসেবেই স্বীকৃত। তাহের স্পষ্ট বলে দিল, বনের গাছে তাদের হক আছে। এটা কাটলে চুরি হয় না। 'মোরা আর কয়ডা গাছ কাডি? ফরেস্টাররা এলেকা ব্যাড় দিয়া দিয়া কাডে, কাইডা সাফ কইরগা হালায়। মোরা যেডুন কাডি তাতে গোড়া থাহে, আবার গাছ অয়। ওরা সাফ কইরগা হালায়। জঙ্গলের মায়া মোগোচে বেশি কারো নাই।'

রাত হয়ত ভোর হয়ে যেত। কিন্তু ক্যাম্পে ফিরতে হবে, জাহিদ মামুনের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। জাহিদ মামুন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত টিম লিডার। উঠে পড়ি, ক্যাম্পে গিয়ে খিচুড়ি খাই, কম্বল গায়ে শুয়ে পড়ি। একটি নারীকণ্ঠ জানালায় খটখটায়, 'ঢাহার ভাইরা, ও ঢাহার ভাইরা, এট্টা কম্বল দেবা নাহি?' কেউ একজন উত্তর দেয়, আমরা এখনো কম্বল দিচ্ছি না। এবার সম্মিলিত নারীকণ্ঠের খিলখিল হাসি, 'খালি খেচুরি খাইলে অয়, পোলাপান নিয়া শোব না? ঐ হাসি, আকাঙ্ক্ষার তাগিদ স্পষ্ট করে দেয়, তারা ঘুরে দাঁড়াবে।

পরদিন বিকেলে রামপাল থানার পশুর নদীর তীরে সন্ন্যাসী গ্রামে গিয়েও দেখি সেই একই মানুষ। আকাঙ্ক্ষার তাগিদে উন্মুখ। ত্রাণ নেয়ার সময় মাথা নত করেনি, সোজা হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে হকদারের মত। বুকের মধ্যে হাহাকার বাজে। এরা তো আমাদেরই মানুষ, শক্ত, শৃঙ্খলহীন। কিন্তু যোগাযোগটা সবসময় হয় না। এমনকি এই যোগাযোগও হল ঘূর্ণিঝড় নামক একটা উপলকে কেন্দ্র করে। বাকি সারাটা বছরই হয়ত এই রুপালি ধ্বংসস্তুপ, উপকূল আর অসাধারণ এইসব সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগের স্মৃতিটুকু নিয়ে চলবে নিজের সাথে নিজের বিপ্লবী রাজনীতি! আমরা আমরা খেলা!

(লেখাটি ১/১২/২০০৭ তারিখে অনলাইন ফোরাম সামহোয়ারইনব্লগে প্রকাশিত। এখানে লেখকের অনুমতিক্রমে পুনপ্রকাশিত।)