মুজিবোস্কোপ-২

শিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 10 Jan 2021, 05:50 PM
Updated : 10 Jan 2021, 05:50 PM



শোণিত সোপানে জীবন দর্শন

জমাট হতে থাকা রক্তে মিলিটারি বুটের ছাপ নেমে গেছে দোতলার সিঁড়ির সর্বশেষ ধাপটি পর্র্যন্ত। ওপর থেকে যখন গড়িয়ে পড়ছে শর্টরেঞ্জ ব্রাশফায়ারে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া বিশাল দেহটি, মৃত্যুর অসীম অন্ধকার যখন দখলে নিচ্ছে অর্ধনিমীলিত দুই চক্ষুগোলকের সমগ্র পরিধি, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে উচ্চতর থেকে নিম্নতর সোপানে গড়াতে থাকা রক্তে বিম্বিত হলো ফেলে আসা জীবনের এক ঝাঁক এলোমেলো স্মৃতি, বায়োস্কোপের চকিত ফ্লাশব্যাকের মতো। মুজিবোস্কোপ। উচ্ছৃঙ্খল, অবাধ্য পুত্রের হাতে নিহত বদ্বীপ অঞ্চলের এক হতভাগ্য রাষ্ট্রপিতার শোণিত সোপানে জীবন দর্শন।

ক. কোলকাতার দাঙ্গা

কোলকাতায় এসে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছি। হাইস্কুলে থাকতেই হাতে দরখাস্ত ধরিয়ে দিয়ে চন্দ্রনাথ আমার ভবিষ্যৎ পেশা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। দাবি জানানো আর দাবি আদায় করাই আমার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকার হোস্টেলে থাকি। মুসলমান ছাত্রদের বিপদে-আপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াই। ওদের নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রিন্সিপাল জুবেরি সাহেবের সঙ্গে আমাকেই দেনদরবার করতে হয়। মুসলিম লীগের কোনো কর্মী দেশ থেকে কোলকাতায় আসলে আমার রুমই তাদের একমাত্র ঠিকানা।

হোস্টেলের অডিটোরিয়ামে মিটিং করি। ইসলামিয়া কলেজের একমাত্র হিন্দু শিক্ষক নারায়ণবাবু আমাকে ¯েœহ করেন, প্রশ্রয় দেন। এমন শিক্ষক খুব বেশি দেখিনি। হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে নারায়ণ স্যার দুর্দশাগ্রস্থ ছাত্রদের সাহায্য করতেন, হিন্দুমুসলমান ভেদাভেদ করতেন না। যদি বলতাম: 'স্যার রুম লাগবে!' উনি বলতেন 'দখল করে নাও, তবে দেখো, কোনো অভিযোগ যেন না আসে!' আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস কেউ করতো না।

আমি ছিলাম পার্টটাইম ছাত্র, ফুলটাইম রাজনৈতিক কর্মী। রাত জেগে লেখাপড়া নয়, কর্মীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতাম। 'পাকিস্তান না হলে অখ- ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।' Ñ এটা আমার কাছে পরম সত্য বলে মনে হতো তখন। ভুল অবশ্য ভেঙেছিল, তবে 'দিল্লীকা লাড্ডু' পাকিস্তান আসার পর।

আবুল হাশিম সাহেব বলতেন: 'শুধু হিন্দুদের গালাগালি করে পাকিস্তান আসবে না! মুসলমান ছেলেদের লেখাপড়া করতে হবে।' বেকার হোস্টেলে তিনি আমাদের রাজনৈতিক ক্লাস নিতে আসতেন। আমি কিছুক্ষণ মুখ দেখিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ভাগতাম। পাকিস্তানই যদি না আসে, তবে এই সব ফালতু ক্লাস করে কী লাভ! বন্ধুদের বলতাম: ' তোমরা পণ্ডিত হও। আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপর বসে বসে আলোচনা করা যাবে!'

সুহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এতগুলো বছর পরেও চিনতে পেরেছেন তিনি আমাকে। কী আশ্চর্য! আমার নামটাও মনে আছে। এমন স্মৃতিশক্তি না থাকলে বড় নেতা হওয়া যায় না।

অবশেষে জিন্নাহ সাহেব ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ডাক দিলেন। লেড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। দিল্লী নয়, করাচি নয়, দাঙ্গার জন্যে বেছে নেওয়া হলো বাঙালির শহর কোলকাতা। হিন্দু-মুসলমান দুই দলই মারমুখী। কে, কখন, কাকে, কেন যে মেরে ফেলবে বোঝা মুস্কিল। হত্যার জন্য যে কোনো অজুহাতই যথেষ্ট। ছুড়ি-বন্দুক-কেরোসিনের টিন হাতে তৈরি সবাই। পান থেকে চুন খসার অপেক্ষা। মানুষ যেন পাগল হয়ে গেছে। সেদিন দেখলাম, জংধরা ট্রামলাইনের উপর বসে একটা মুসলমানের লাশকে ভোঁতা দা দিয়ে কোপাচ্ছে এক হিন্দু গৃহবধূ। হাতে তখনও শাখা, কপালে সিঁদুর। মাথার চুলে কতদিন চিরুনি পড়েনি কে জানে। মস্তিষ্ক বিকৃত। ওর ছেলে-মেয়ে-স্বামীকে ওরই চোখের সামনে নাকি খুন করেছে মুসলমান গুন্ডারা।

সুহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশমতো ইসলামিয়া কলেজের মুসলমান ছাত্রদের নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি আশেপাশের মুসলমানদের সংগঠিত করার।

এ মুহূর্তে বেকার হোস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। ছাদ থেকে হিন্দু-মুসলিম দুই এলাকাই দেখা যায়। একি! এমন দুধের বাচ্চাকেও ওরা বাঁচতে দেবে না! চারদিক থেকে ছুরি-কিরিচ বাগিয়ে, কেরোসিনের টিন হাতে এগিয়ে আসছে মারমুখী জনতা। বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ফলের ঝাঁকা মাথায় থর থর করে কাঁপছে এক কিশোর। হিন্দু না মুসলমান? চেহারায় একই রকম মৃত্যুর বিভীষিকা। সময় শেষ, বুঝে গেছে ছেলেটা। আতঙ্কে বমি করে দিল। ছোট হয়ে আসছে বৃত্তটা! আল্লাহ! কত বয়স হবে ওর, আমার রাসেলের বয়সী, আট কিংবা দশ! দু'হাতে পেট চেপে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটা। মানুষ মারতে, মরতে সময় লাগে না!

লাশটা ম্যানহোলে ঢুকিয়ে দিয়ে নতুন শিকারের সন্ধানে ছুটে গেল মারমুখী জনতা।

এই কিশোরের রক্তের ধারা আমার দিকে কেন গড়িয়ে আসছে? আমিতো এখন অনেক ওপরে! তাজা রক্ত এখনও জমাট বাঁধার সময় পায়নি। ওর না আমার, রক্তটা কার সেটাইতো বুঝতে পারছি না।

চশমাটা ছিঁটকে পড়েছে উপরের কোনো সিঁড়িতে। স্কুলে থাকতেই চোখে অপারেশন হয়েছিল। ১৯৩৭ সাল থেকে চশমা পড়ছি। আর এখনতো বয়স হয়েছে। চশমা ছাড়া কাছেও ভালো দেখি না আজকাল। চশমা দিয়েও যদি ঠিকঠাকমতো দেখতে পেতাম, তাহলে কি আজ এই পরিণতি হতো আমার, আমাদের?

খ. গাদ্দাফি

'এক্সেলেন্সি, আমি আপনার সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ বন্ধুত্ব করতে চাই। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আপনি মুজিব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ করুন। আমরা আপনাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করবো। আর সেক্ষেত্রে আমি গাদ্দাফি মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারি। তবে এ জন্যে প্রথমেই আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, আপনার দেশের নামটা পরিবর্তন করুন। 'বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র' হবে আপনার দেশের উপযুক্ত নাম।'
আমার মুখে তখন পাইপ। গতকাল বাদশাহ ফয়সলও এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে আমি উত্তর দিলাম: প্রিয় কর্নেল, আপনার প্রস্তাব সুচিন্তিত এবং অতি উত্তম। কিন্তু এ মুহূর্তে এ প্রস্তাব কার্যকর করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে আমি দুঃখিত। লিবিয়া আর বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য আছে। লিবিয়ায় অমুসলিম জনসংখ্যা নেই বললেই চলে, কিন্তু বাংলাদেশে অমুসলিমদের সংখ্যা প্রায় এক কোটির মতো। প্রিয় কর্নেল, পরম করুণাময় আল্লাহতালা শুধু আল মুসলেমিন নন, তিনি রাব্বুল আল আমীনও বটেন। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবার শ্রষ্টা তিনি এবং তিনি মহান। আমি যদি বাংলাদেশকে শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র ঘোষণা করি, তবে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যায় করা হবে না কি?
আমার এ ধরনের উত্তরে গাদ্দাফি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁর ভ্রুযুগল একটু কুঁচকে উঠলো, যদিও কিছুক্ষণের জন্যে।
১৯৭৩ সালের শেষার্ধের ঘটনা। আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে গিয়েছিলাম সদলবলে। বহু নেতার সঙ্গে দেখা ও আলাপ হয়েছে ইতিমধ্যে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কারা শত্রু আর কারা মিত্র চিনতে চেষ্টা করেছি আলাপের ফাঁকে ফাঁকে, যতটা আমার বুদ্ধি ও ক্ষমতায় কুলায়। জীবনের বেশিরভাগ সময় বিরোধীদলের রাজনীতি করে জেলে কাটিয়েছি। রাজনীতিটা হাতে-কলমে শিখেছি। লিডার ছিলেন, মাওলানা ছিলেন, তাঁরা হাতে ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছেন আমাকে। কিন্তু ক্ষমতা ও প্রশাসন চালানোর ব্যাপারটা আমার জন্যেও নতুন বটে। এক্ষেত্রে আমার কোনো গুরুও নেই। কাজ করতে করতে শিখছি আমি প্রতিনিয়ত এবং স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ভুল হচ্ছে অনবরত। আমি ভুল করছি, ভুল সংশোধন করছি। যে কাজ করে, ভুল তাকে করতেই হবে। সেই ভুল করে না, যে কাজ করে না।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে একদিন গাদ্দাফির কটেজে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম সদলবলে। প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির বেশভূষা ও চালচলন খুবই সাধারণ। হয়তো মরুভূমির কড়া রোদে ঝলসে, গড় আরব যুবক যেমন হয়ে থাকে, গাদ্দফির চেহারায় রুক্ষতার ছাপ, ব্যবহার কর্কশ আর মেজাজও খানিকটা উগ্র। পোশাক-পরিচ্ছদে ধর্মীয় অনুশাসন তিনি মেনে চলেন না, কিন্তু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে দাবি করে থাকেন। লিবিয়ার আভ্যন্তরীণ সঙ্কট সমাধানে ইতিমধ্যে কামিয়াব হয়ে গাদ্দাফির এখন তাঁর আঞ্চলিক নেতৃত্ব গ্রহণের খায়েশ হয়েছে।
গাদ্দাফির কটেজের ড্রয়িংরুমে বসে কথা হচ্ছিল। দুই দিকের সোফায় বাংলাদেশ ও লিবিয়ার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা চুপচাপ বসে। মধ্যে সোফায় আমরা দুই নেতা। দোভাষীর মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রুশমার্কিন ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করলাম দুজন। মাঝে-মধ্যে হাস্যকৌতুকে কূটনৈতিক আলাচনার স্বাভাবিক গম্ভীর পরিবেশ লগুতর হয়েছিল।
'এক্সেলেন্সি, আপনার কথা অনেক শুনেছি এবং জেনেছি। আপনার জীবন যে শোষিত মানুষের জন্যে উৎসর্গীকৃত, তাও আমার অজানা নয়। নিজের কর্মদক্ষতায় আপনি লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন– এ জন্যে আপনাকে অভিনন্দন। আমরাও চাই, আপনি মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করুন। কিন্তু বাংলাদেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে এখনও অনেক সমস্যা। এই পর্বত-প্রমাণ সমস্যার সমাধান না করে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়া আমি শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব নয়।'
গাদ্দাফি তাঁর প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে আরবিতে কিছু আলোচনা করলেন যা দোভাষী অনুবাদ করলো না। কর্নেলকে কিছুটা চিন্তিতই মনে হচ্ছিল। আলোচনা শেষ হলে তিনি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন: 'এক্সেলেন্সি, আমি ঘোরপ্যাঁচের মানুষ নই। সোজাসাপটা কথায় বিশ্বাসী। আমি যতদূর জেনেছি, আপনিও অনেকটা আমার মতোই, সোজা কথার মানুষ। আপনার কথার সঙ্গে আমি একমত নই, কিন্তু আপনার ব্যক্তিত্ব ও ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখন বলুন এক্সেলেন্সি, আমাদের কাছে আপনি কী প্রত্যাশা করেন।
'আমরা চাই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে লিবিয়া স্বীকৃতি দিক।' আমার তড়িৎ জবাব।
'এই মাত্র?'
'হ্যাঁ শুধু এটকুই। আপনি হয়তো ভেবেছেন, আমরা বাঙালিরা মিসকিনের জাত। সাহায্য ভিক্ষা করবো আপনার কাছে। না, ভিক্ষা চাই না, স্বীকৃতি চাই। আপনারা আরবেরা আমরা অনারবদের পাত্তা দিতে চান না– আমি জানি। আপনারা ভাবেন, আমরা চিরঅভাবী, কিসিঞ্জারের ভাষায় 'তলাবিহীন ঝুড়ি'; আমরা শুধু সাহায্যই চাই। হয়তো আমাদের ঠিক মুসলমানও মনে করে না আরবদের অনেকে। কিন্তু মনে রাখবেন, দিন বদলাবে। আরবেরাও একদিন গরীব ছিল। আমাদের দেশের বাদশাহদের পাঠানো টাকায় মক্কামদিনার লোকের অন্নসংস্থান হতো। আপনি জানেন নিশ্চয়ই, মুসলিম জাহানে আমরা অর্থাৎ অনারবেরাই সংখ্যাগুরু। ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ।'
মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল বলে কর্নেলকে কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম। গাদ্দাফি একটু বিব্রত হলেন আমার কথা শুনে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন: 'এক্সেলেন্সি আপনার প্রস্তাব আমরা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবো। কোনো কথা দিচ্ছি না এ মুহূর্তে, কিন্তু এটা জেনে রাখুন যে আপনাদের স্বীকৃতি দিতে আমাদের সময় লাগবে।'
আন্তরিক কোলাকুলি ও প্রথাগত বিদায়চুম্বনের পর গাদ্দাফি হেসে বিদায় নিলেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের চেহারায় কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। মনে হলো, গাদ্দাফির উপস্থিতি একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে লিবিয়ায় এবং সর্বত্র, যেখানেই তিনি যান না কেন।
বাংলাদেশের জনগণ কি আমাকে ভয় পায়? আমাকে কি ঘৃণা করে তারা?
কয়েক ফোটা ঘন রক্ত ঝরে পড়লো আমার চোখের পাপড়ির ঠিক সামনে। এটাই কি উত্তর?
আমার আজীবনের লক্ষ্য ছিল, আমি যেমন তাদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, তারাও আমাকে ভালোবাসুক। তোমাদের জন্যে আমি আমার জীবনের চব্বিশটি বছর উৎসর্গ করেছি। ক্যারিয়ার, পরিবার, টাকাপয়সা কোনো কিছুর পরোয়া করিনি। বিনিময়ে আর কিছু না, তোমাদের কাছ থেকে একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম।
হায়! পাঁচটা বছরও আমাকে সময় দিল না তোমরা আমাকে। জন-জামাই-ভাগিনা – তিন হয় না আপনা। যুগান্তরের বাংলা প্রবাদ সত্য হলো। জন কিংবা যম, পার্থক্য নেই খুব একটা, আমার ক্ষেত্রে। (ক্রমশঃ)

গ. বিহারি বদরুদ্দীন

'শেখের মাথায় কিচ্ছু নাই। হামবাগ একটা। শুধু মুখের জোরে রাজনীতি করে গেলো। জনগণের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রপিতা হয়ে গেছে!' আমার সম্পর্কে এই সব কথা কি তোর কানে এসেছে? মুসিবত, তোর কি মনে হয়? আমি কি আসলেই একটা বোকাসোকা, মাথামোটা লোক?'
অনুজপ্রতীম সাংবাদিক এ. বি.এম মুসাকে জিগ্যেস করেছিলাম একদিন। সাংবাদিক ত্রিরতœ: গাফফার, ফয়েজ আর মুসাকে আমি ডাকতাম যথাক্রমে আপদ, বিপদ আর মুসিবত বলে। মুসিবত দোনামনা করছে বলে আমি তাকে সাহস দিলাম: 'প্রেসিডেন্ট বলে ভয় পাস না? মন খুলে সত্য কথা বল। হা হা হা।'
'মুজিবভাই, বাংলাদেশের জননেতা হওয়ার জন্য বড় মাথার দরকার নাই, বড় একটা কইলজা দরকার। শেরেবাংলা, ভাসানী, সুহরাওয়ার্দী প্রত্যেকের কইলজা বড় ছিল বলেই মানুষ এখনও তাদের কথা বলে। কিন্তু রাষ্ট্রপিতা হওয়ার জন্যে আরও বড় কইলজা দরকার। যত বড় দরকার, তত বড় কইলজা এই তিনজনের কারও ছিল না।'
'তোর কাছে কী প্রমাণ আছে যে আমার কইলজা হুজুর কিংবা নানার চেয়ে বড়?'
'এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু প্রমাণ হাতে আসতে দেরি হবে না।'
আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম: 'হৃদয় বড় নাকি ছোট, সেটা আমার জিজ্ঞাস্য নয়, মুসা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষিত লোকজনের যে মূল্যায়ন আমার সম্পর্কে, ঐ যে অর্থাৎ প্রশাসন চালানোর মতো বুদ্ধি আমার নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি, সেই ধারণাটা সঠিক কিনা।'
'মুজিবভাই, সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে আপনি আজীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, সে রাজনীতিবিদ হিসেবেই হোক, কিংবা হোক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। আপনার অতি বড় শত্রুও আপনার দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করে না। প্রশাসককে অবশ্যই দেশপ্রেমিক হতে হবে; প্রশাসনের লোকজন চৌকশ হলেই চলে, দেশপ্রেমিক হলে সোনায় সোহাগা।
প্রশাসন হচ্ছে একটি গাড়ি এবং আপনি সেই গাড়ির চালক। চালকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। সমস্যাটা গাড়িতে। একটা হালভাঙা নৌকায় আপনি দেশপ্রেমের পাল খাটানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ঔপনিবেশিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত আমলারা আপনার মতো স্বাধীন প্রশাসকের কথামতো চলতে পারবে না, চলতে জানবে না, চলতে চাইবে না– এটাই স্বাভাবিক নয় কি? এই আমলারাই আবার নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকার জন্যে আপনাকেই দোষ দেবে, সেটাও অস্বাভাবিক নয়।'
'অনেকে বলে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট থাকলেই নাকি দেশ ভালো চলতো।'
'আমি তা মনে করি না। তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করলে আপনার সংসারেই আগুন জ্বলতো। এত দিনে বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই যে শেখ মণি তাজউদ্দীনকে সহ্য করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা একদিকে আপনার ভাগিনা মণি এবং অন্যদিকে আপনার প্রিয় সিরাজ তাজউদ্দীনকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল শুধু ইন্দিরা গান্ধীর প্রশাসন তাজউদ্দীনের উপর আস্থা রেখেছিল বলে। শ্রীমতি গান্ধীর বিরোধিতা করার মতো ক্ষমতা কিংবা সাহস তাদের দুজনের কারোরই ছিল না।
তাজউদ্দীনের যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু রাজনীতিতে ভালো করার জন্যে যোগ্যতা থাকাটাই যথেষ্ট নয়। তাজউদ্দীন ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন করা মুশকিল ছিল কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেউ মেনে নিত না। আগে পরে গিট্টু লেগেই যেতো এবং সেই গিট্টু খুলতে আপনি বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতার রাশটা নিজের হাতে নিতে হতোই। গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে, প্রথম থেকেই ক্ষমতা আপনি নিজের হাতে রেখেছেন, সে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই হোক, কিংবা প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
আমি নিশ্চিত, যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করার ক্ষমতা এক শেখ মুজিব ছাড়া আর কারও ছিল না। এত শত ভাঙা ব্রিজ আর অকেজো কলকারখানা মেরামত করে বাংলাদেশটাকে কয়েক মাসের মধ্যে আপনি চালু করে দিলেন। এটা কি সোজা কথা? আপনি ছাড়া আর কার কথায় শ্রীমতি গান্ধী এত দ্রুত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হতেন? আর কোন নেতা রাশিয়ানদের পটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর মাইনমুক্ত করতে পারতেন এবং তাও এত কম সময়ের মধ্যে? না, মুজিব ভাই, প্রশাসক হিসেবে আমি অন্তত আপনার কোনো দোষ দেখি না।'
'আচ্ছা বাদ দে। মুসা তুইতো অনেক খবর রাখিস। সাংবাদিক এস. জি. এম. বদরুদ্দীনের কোনো খবর জানিস?'
'বিহারি বদরুদ্দীন?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে আমরা এই নামেই ডাকতাম বটে। ব্যাটা সব সময় আমার পিছনে লাগতো। আমার পরিবার নিয়ে কুৎসা রচনা করতেও তার রুচিতে আটকাতো না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রিপোর্টের একটা মিথ্যা, বিকৃত ভার্সন ছাপিয়েছিল সে মর্নিং নিউজে। মনে আছে?'
'খুব মনে আছে। ওর পত্রিকা অফিসে আমরা দুই দুই বার আগুন দিয়েছি, সেটাও ভুলি নাই। কিন্তু আপনার এত ব্যস্ততার মধ্যে ঐ ব্যাটা বিহারির খোঁজ করছেন কেন?'
'একটু খোঁজ করে দেখ না, বদরুদ্দীন এখনও বেঁচে আছে, নাকি বেঘোরে মরেই গেল মুক্তিযুদ্ধে?'
'আপনি যখন বলছেন, তখন খোঁজ করে দেখবো বৈকি।'
কয়েকদিন পরেই মুসা বদরুদ্দীনকে আমার সামনে হাজির করেছিল। বদরুদ্দীন প্রাণভয়ে লুকিয়ে ছিল লালমাটিয়ার এক বাসায়।
দীর্ঘদিনের পরিচিত লোক। শত্রু ছিল, কিন্তু তাতে কী হয়েছে, এক অর্থে সহকর্মীওতো ছিল সে। বদরুদ্দীনকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সে কি কান্না বদরুদ্দীনের। ওর চোখের জল মুজিবকোটের আস্তর আর পাঞ্জাবির কাপড় ভিজিয়ে আমার বুক স্পর্শ করলো।
'ভাই বদরুদ্দীন, বলো তোমার জন্যে আমি কী করতে পারি।'
'শেখ সাহাব, মুঝে শরমিন্দা মৎ কিজিয়ে। ম্যায় জানবুজকে আপকো ইতনা তকলিফ দিয়া। ম্যায় মাফি মাঙনেকি ভি লায়েক নেহি।' কান্নায় গলা বুজে আসে বদরুদ্দীনের।
'তোম কোই গলতি নেহি কী বদরুদ্দীন ভাই, শ্রেফ আপনা ফর্জ নিভায়া। ছোড়ো উসি বাতেঁ। মুজসে তুমহারি কোই মদত হো স্যাকতা হ্যায় তো বলো!'
বদরুদ্দীন পাকিস্তান চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নেপাল হয়ে ওর পাকিস্তানে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিলাম। আসাদ এ্যাভেনিউতে ওর বাড়িটি এখন শত্রু সম্পত্তি। বাড়িটি বিক্রি করার অনুমতি দিলাম এবং শুধু তাই নয়, বিক্রির টাকা পাকিস্তানে নিয়ে যাবারও বিশেষ অনুমতি পাইয়ে দিলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ফোন করে।
কয়েক দিন পরেই আমি আর আমার পরিবারকে অনেক দোয়া করে অশ্রুসিক্ত মুখে বদরুদ্দীন পাকিস্তান রওয়ানা হলো।
'বঙ্গবন্ধু, একটা বিহারির জন্যে আপনি এতগুলো বেআইনী কাজ কেন করলেন, বিশেষ করে যখন এই বদরুদ্দীন আপনার ক্ষতি ছাড়া মঙ্গল চায়নি কোনোদিন?' মুসা জিগ্যেস করে আমাকে।
'ভাইরে, হিন্দুদের গীতায় শ্রীকৃষ্ণ একটা কথা বলেছেন: 'স্বধর্মে মরণং শ্রেয়, পরধর্মো ভয়াবহ!' বদরুদ্দীন বিহারি, পাকিস্তানপন্থী। আমি শেখ মুজিব পাকিস্তানের শত্রু। তো বদরুদ্দীনের স্বধর্ম কী হবে? আমার বিরোধিতা করা নয় কি? আমি আমার স্বধর্ম পালন করেছি, বদরুদ্দীন ওর স্বধর্ম পালন করেছে। মাণিক ভাইয়ের মতো বদরুদ্দিনও সাংবাদিক ছিল। মাণিক ভাই আমার সহযোদ্ধা ছিলেন, বদরুদ্দীন ছিল আমার শত্রুপক্ষ। একই যুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়েছি আমরা। যুদ্ধে আমার বিজয় হয়েছে বলেই শত্রুর প্রতি আমি উদারতা দেখাবো না? মহাকাব্যের নায়কেরা কী করেন?
'ঠিকই আছে মুজিবভাই। কিন্তু আমরা বাঙালিরা যদি যুদ্ধে হেরে যেতাম কিংবা বদরুদ্দীন যদি আপনার জায়গায় থাকতো, তবে ও কি আপনার প্রতি অনুরূপ উদারতা দেখাতো?'
'এর উত্তরতো সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র আগেই দিয়েছেন: 'তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন? আর মুসিবত, শেখ মুজিবের মাপের একজন ব্যক্তির সঙ্গে তুইই বা বিহারি বদরুদ্দীনের তুলনা করছিস কোন আক্কেলে?''
মুসা প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আমার দিকে: 'কয়েকদিন আগে আপনার বিশাল হৃদয়ের প্রমাণ দিতে বলেছিলেন না আমাকে? প্রমাণ কি হাতে হাতে পেলেন?'
এবার অবশ্য আমার অপ্রস্তুত হবার পালা।