দু’ হাজার বিশে সাংস্কৃতিক যেসব ব্যক্তিত্ব হারালাম

পূরবী বসু
Published : 31 Dec 2020, 01:18 PM
Updated : 31 Dec 2020, 01:18 PM

গত এক বছরে (জানুয়ারি ২০২০ থেকে ডিসেম্বর, ২০২০) বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি সফল অথবা জাতীয় পর্যায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত ও অতিশয় বিখ্যাত যতজন বাঙালি মারা গেলেন, একাত্তর ছাড়া, আমার স্মরণকালে আর কখনো এত অল্প সময়ের ভেতর এতজন গুণীর, এমন স্মরণীয় ও বরণীয় প্রখ্যাত বাঙালির, মৃত্যু ঘটেছে বলে মনে হয় না। এর ভেতর বিশ্ব মহামারী কোভিড ১৯-এ সরাসরি আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন, কারো চলমান ব্যাধির সঙ্গে করোনা যুক্ত হয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি করেছিল, সেটাই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বেশির ভাগ মৃত্যু-ই হয় করোনা-বহির্ভূত শারীরিক অন্যান্য অসুস্থতার কারণে। গত বছরে মৃত্যু বরণকারী সেই সব কৃতিমান খ্যাতিমান বাঙালি গুণীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবার উদ্দেশে তাঁদের প্রত্যেকের নাম, সংক্ষিপ্ত জীবনী ও প্রধান অবদানের কথা স্বল্প পরিসরে গ্রন্থিত করার চেষ্টা করেছি নিচে। সকলের জন্যে সমান বা এক-ই রকম তথ্য দিতে পারিনি। প্রখ্যাত এই ব্যক্তিদের সম্পর্কে লেখার দৈর্ঘ কোনভাবেই তাঁদের অবদানের সূচক নয়। তথ্যের প্রতুলতা, জীবনের বর্ণিলতার আধিক্য, তুলনামূলকভাবে তাঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের পরিচিতির ঘাটতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিবেচনায় কারো সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বেশি, আবার কারো সম্পর্কে কম লেখা হয়েছে ।

গ্রন্থনা: পূরবী বসু


ড. আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০) একজন অসাধারণ চিন্তাবিদ ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জাতির যে কোন বিপদে সবসময় সবার আগে এগিয়ে এসে তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশকে বিপদমুক্ত করে এনেছেন। তাঁকে তাই জাতির বিবেক ও পথপ্রদর্শক বলে বিবেচনা করতেন বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগন। তার বহু সাহিত্যকর্মের মধ্যে "মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য" সুনাম কুড়িয়েছে। নির্ভেজাল অসাম্প্রদায়িক আনিসুজ্জামান বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়বাদকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসে বহুবার সরকারের কুনজরে পড়েছেন। তিনি ৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গিয়ে ২০২০ এর গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন পর্যন্ত সকল সুস্থ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। উল্লেখযোগ্য বই 'মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য' ছাড়াও ,'বাঙালি নারীঃ সাহিত্যে ও সমাজে' সহ আরও বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক, পশ্চিম বাংলা থেকে আনন্দ পুরস্কার এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মভূষণ উপাধি
অর্জন করেন সাহিত্যে অমূল্য অবদানের জন্যে।


মুর্তজা বশীর (১৯৩২-২০২০); মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। তিনি একাধারে অধ্যাপক, গবেষক, কবি, লেখক, চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক এবং মুদ্রা ও ডাকটিকিট বিশারদ। উপমহাদেশের ভাষাবিদ, চিন্তক ডক্টর মোহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র। বাম ধারার রাজনীতি করতে গিয়ে পার্টির জন্যে পোস্টার তৈরির মধ্য দিয়েই শিল্পী জীবনের শুরু। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ ও আমিনুল ইসলামের কাছে ছবি আঁকার পাঠ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- 'কাচের পাখির গান, 'গল্প সমগ্র', 'ত্রসরেণু', 'তোমাকেই শুধু', 'এসো ফিরে অনুসূয়া', 'সাদায় এলিজি', 'আল্ট্রামেরিন', 'মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে', 'অমিত্রাক্ষর, 'মূর্ত ও বিমূর্ত', ও 'আমার জীবন ও অন্যান্য'। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস সর্বক্ষেত্রেই তার বিচরণের সাক্ষী এই বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পুস্তকপ্রকাশ। তাঁর মৃত্যুর কারণ করোনা সংক্রমণ। তিনি সাহিত্য ও শিল্পে অবদানের জন্যে একুশে ও স্বাধীনতা পদক অর্জন করেন।


অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ( ১৯৩৩ — ২০২০) বহু বছর থেকে জার্মানিতে বসবাসকারী একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও চিন্তাশীল গদ্যকার। তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ বিষয়বৈচিত্রে যেমন, নান্দনিকতা ও বৈদগ্ধে তেমনি বিশাল ও স্বতন্ত্র। তাঁর ছন্দনৈপুণ্য ও ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার এবং পুননির্মাণ তাঁর সৃষ্টিতে অসামান্য মাত্রা যোগ করেছে। একজন প্রকৃত সৃষ্টিশীল বাঙালি ও চিন্তক হিসাবে বিশ্বময় পরিচিতি দিয়েছে তাঁকে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টোরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এর পর থেকেই তিনি জার্মান ভাষায় লিখিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ শুরু করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে কয়েক বছর অধ্যাপনা করার পর ফেলোশিপ নিয়ে জার্মানি যান ১৯৭১ সালে এবং বাকি জীবন বাংলা সাহিত্যের চর্চা ও বাংলা পড়িয়ে জার্মানিতেই থেকে যান। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ভারত ও জার্মানির মধ্যে সুসম্পর্ক ও আরো ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনের জন্যে জীবনভর নিবিড়ভাবে কাজ করেন। জার্মান সরকার প্রীত হয়ে তাঁকে গ্যাটে পুরস্কারে ভূষিত করেন। তিনি সারাজীবনে প্রচুর লিখেছেন যাঁর মূল্যায়ণে পৃথিবী জুড়ে সতীর্থ কবিসাহিত্যিকগন তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁর লেখার মান উঁচু, যেমন তা তীক্ষ্ণ, পরিণত ও স্বতন্ত্র। তাঁর প্রকাশিত লেখার সংখ্যা বা পরিমানের প্রাচুর্য-ও বিষ্ময়কর। অলোকরঞ্জন মনীষা এবং সংবেদনশীলতায় বাংলাসাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ও সাঁওতালি কবিতা জার্মান ও ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন, এবং প্রচুর ফরাসি ও জার্মান সাহিত্য বাংলায় তর্জমা করেছেন। তিনি ২০টিরও বেশি কবিতার বই লিখেছেন। এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর স্বতন্ত্র গদ্যশৈলীর জন্য তিনি সুপরিচিত। তিনি জীবনভর প্রচুর পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন । তার মধ্যে আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুধা বসু পুরস্কার , জার্মানিতে গ্যাটে পুরস্কার, ভারত থেকে আনন্দ পুরস্কার , প্রবাসী ভারতীয় সম্মান , রবীন্দ্র পুরস্কার , তাঁর কবিতার বই মরমী করাত (অনুবাদ করেছেন দ্য মিস্টিক্যাল স অ্যান্ড আদার পোয়েমস) এর জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং প্রবাসী ভারতীয় সম্মান অর্জন করেন ।


দেবেশ রায় (১৯৩৬-২০২০) জন্ম ১৯৩৬ সালে পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক। কলেজে অধ্যাপনা করেছেন বহু বছর। আকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত তিস্তাপারের বৃত্তান্তের জন্যে। । বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, দাঙ্গার প্রতিবেদন, খরার প্রতিবেদন, সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত, মফস্বলি বৃত্তান্ত, বরিশালের যোগেন মন্ডল, শরীরের সর্বস্বতা, তিস্তাপুরাণ, করপোরেট ইত্যাদি। ১৪ মে, ২০২০ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।


রাহাত খান (১৯৪০-২০২০) কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বিখ্যাত গ্রন্থ অমল ধবল চাকরী, দিলুর গল্প, হে অনন্তের পাখী। বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক পেয়েছেন। ইত্তেফাক গ্রুপে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেন। ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খোলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি। ২০২০ সালের ২৮ আগস্ট তিনি মৃত্যু বরণ করেন।


রশীদ হায়দার (১৯৪১-২০২০) কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। সাবেক নির্বাহী পরিচালক, নজরুল ইন্সটিটিউট। জিয়া হায়দারের অনুজ ও দাউদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, মাকিদ হায়দারের অগ্রজ রশিদ হায়দারের পরিবারে প্রায় সবাই লেখক। সাহিত্যকর্মের জন্যে রশীদ হায়দার বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য বই, স্মৃতি ১, স্মৃতি ২, আমার প্রেমের গল্প, গল্পসমগ্র ১, যুদ্ধ ও জীবন, গল্পসমগ্র ২, সামান্য সঞ্চয়, তিনটি প্রায়োপন্যাস, যদি দেখা পাও। ২০২০ সালে ১৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।


কামাল লোহানী (১৯৩৪-২০২০) কামাল লোহানী ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। সংস্কৃতির অমিয় সাধক, ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী করোনাতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উদীচী, বাংলাদেশ -এর কর্ণধার ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০২০ সালে ২০ জুনে তিনি মৃত্যু বরন করেন।


জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৯৪৩-২০২০)–জাতীয় অধ্যাপক প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, লেখক। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার পক্ষে অনেক বক্তব্য রাখেন ও প্রবন্ধ লেখেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী জামিল রেজা চৌধুরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একুশে পদক লাভ করেন। বুয়েটে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করে পরে এশিয়াপেসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যন্সেলরের পদ অলংকৃত করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, ইনডোর স্টেডিয়াম ইত্যাদি বহু জাতীয় প্রকল্পে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। দেশের বহু বিখ্যাত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে তাঁর অবদান রয়েছে। ২০২০ সালে ২৮ এপ্রিল তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

নীলোৎপল সাধ্য (১৯৫৫-২০২০) নীলোৎপল সাধ্য ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ধোবাউড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ সাধ্য গ্রামে তবলা বাজাতেন এবং ফুটবল খেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অতি অল্প বয়সে কাকা সুনীল সাধ্যর কাছে গানে প্রথম হাতেখড়ি। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময়েই প্রথম একটি জারিগানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন নীলোৎপল। তাঁদের গ্রামে সংগীত জানা একজন মানুষের বাড়িতে রেডিওতে কলকাতার আকাশবাণীর সংগীত শিক্ষার আসর প্রতি রবিবার শুনতে যেতেন। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মায়। তবে প্রথম যেদিন সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জনের কাছে তিনি গান শেখার সুযোগ পান, তাঁর নিজের ভাষায়, 'সেদিন মনে হয়েছিল যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই আমার সামনে বসা। মনে হলো যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি এটাই।' তিনি সবসময় বলতেন, 'রবীন্দ্রনাথের গান আমার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। সমস্ত গ্লানি ও মলিনতা থেকে দূরে রাখে।' পেশায় তিনি বাংলাদেশ টিএনটি বোর্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি করে অবসরগ্রহণ করেন ২০১৬ সালে। কিন্তু পেশা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি সংগীতের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯৮১ সালে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ময়মনসিংহ শাখার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২৬ বছরের নীলোৎপল সাধ্যর সাংস্কৃতিক জীবনের সূচনা। রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাদানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব শুদ্ধাচারী ও আবেগপ্রবণ। সংগীতের শিক্ষাদানে ব্যতিক্রমী পদ্ধতিটি তিনি শিখেছিলেন তাঁর গুরু ওয়াহিদুল হকের কাছ থেকে। তাঁর আদর্শ ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুর পর নীলোৎপল সাধ্যর জীবনের সাধনা ছিল তরুণ প্রজন্মকে শুদ্ধভাবে রবীন্দ্রসংগীত শেখানো এবং রবীন্দ্রচেতনায় উদ্বুদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতির রুচিবান বাঙালি হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে ছড়িয়ে দেবার সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। নীলোৎপল সাধ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সাল থেকে সংগীত বিভাগে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক হিসেবে খণ্ডকালীন অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকে ত্রিশালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও সংগীত বিভাগে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিনি সারাদেশে চল্লিশ বছরে কমপক্ষে সহস্রাধিক সংগীতকর্মশালা করেছেন। পশ্চিম বাংলায়ও তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। যদিও এই মহান গায়ক, সংগঠক, প্রচারবিমুখ শিল্পী ক্যান্সারে ভুগছিলেন কয়েক বছর ধরে, তিনি করোনাকালে মারা যাওয়ায় শহীদ মিনার দূরে থাক তাঁর প্রাণপ্রিয় ছায়ানটেও আনতে দেয়া হয়নি তাঁর মৃতদেহ। এটা সকলের মনেই গভীর কষ্টের জন্ম দেয়। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, শিক্ষক তথা সংগীত গুরু। রবীন্দ্রসংগীত চর্চার বিশাল মাপের সংগঠক নীলোৎপল সাধ্য ওয়াহিদুল হকের ভাবশিষ্য, জীবদ্দশায় ওয়াহিদুল হকের ছায়াসঙ্গী এবং তাঁর মৃত্যুর পর ওয়াহিদুল হকের কাজকে অব্যাহত রাখার সারথী ছিলেন নীলোৎপল সাধ্য।


এন্ড্রু কিশোর (১৯৫৫-২০২০) একজন গায়ক, ও নাটক ও চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠদানের জন্যে বিখ্যাত। চলচ্চিত্রে তাঁর অতি জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে, জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে, হায়রে মানুষ রঙিণ ফানুষ, আমার সারা দেহো খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন, সবাই তো ভালোবাসা চায়, ভেঙেছে পিঞ্জর, মেলেছে ডানা ইত্যাসি। তিনি বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশে চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দেন। তাকে "প্লেব্যাক সম্রাট" বলে আখ্যা দেয়া হয়।
রাজশাহীতে জন্ম, রাজশাহীতেই মৃত্যু। পিতার নাম ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ । মাতা মিনু বাড়ৈ রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। মায়ের কাছেই তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়েছিল। তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে রাজশাহী। তার মাতা ছিলেন সংগীত অনুরাগী, তার প্রিয় শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার। প্রিয় শিল্পীর নামানুসারে তার সন্তানের নাম রাখেন 'কিশোর'। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেই তিনি সংগীতাঙ্গনেই পা রাখেন।
কিশোর ছয় বছর বয়স থেকে সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি রাজশাহী বেতারে নজরুল, রবীন্দ্র, লোকসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান শাখায় তালিকাভুক্ত হন। চলচ্চিত্রে তার প্রথম গান মেইল ট্রেন (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের "অচিনপুরের রাজকুমারী নেই"। বড় ভাল লোক ছিল (১৯৮২) চলচ্চিত্রের "হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস" গানের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি আরো সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি পাঁচবার বাচসাস পুরস্কার ও দুইবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
তার স্ত্রীর নাম লিপিকা অ্যান্ড্রু ইতি। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। রাজশাহী খৃষ্টান গোরস্থানে তাকে সমাধিস্ত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর কারণ ক্যন্সার। তিনি দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেন।


আবুল হাসনাত (১৯৪৫-২০২০) বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদক। কর্মজীবনের প্রথম ছাব্বিশ বছর সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক হিসেবে কাটিয়ে দেন। পুরণো দৈনিক সংবাদ-এর মূল আকর্ষন এর "সাহিত্য সাময়িকী" বিভাগ। প্রগতিশীল সংবাদপত্র সংবাদের প্রচন্ড দুর্দিনেও কখনো তিনি এই কাগজ থেকে বিচ্ছিন্ন হন নি। এর অন্যতম কারণ দেশের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন ছাত্রাবস্থা থেকেই। পরে বেঙ্গল গ্রুপের সাহিত্যপত্রিকা কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটির শুরু থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। সাহিত্য সম্পাদক ছাড়া তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি একজন নিভৃতচারী কবি। মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লিখতেন। তিনি চিত্রশিল্পের একজন বড় সমঝদার ও সমালোচক ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত চিত্র সংগ্রহশালা অনেক প্রাতিষ্ঠানিক গ্যালারীর চাইতে সমৃদ্ধশালী। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।


জিয়াউদ্দিন তারিক আলী (১৯৪৫-২০২০)- সাংস্কৃতিক নেতা, প্রগতিশীল চিন্তক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরেরে অন্যতম ট্রাস্টি (অছি)। দেশের সকল সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। করোনা আক্রমনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে সংগীত শিক্ষা নেন। এছাড়া ছায়ানটের সঙ্গে আজীবন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৭০-১৯৭১ সালে গণসঙ্গীতের দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তিনি রাজপথে গান গেয়ে বেরিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে লড়াইয়ে যোগ দেন। মুক্তিসংগ্রামের শিল্পী দলের সদস্য হয়ে শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, মুক্ত এলাকায় যোদ্ধাদের গানের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণে এই দলের ছিল বিশেষ ভূমিকা। লিয়ার লেভিন ধারণকৃত সেই দলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ফুটেজ কয়েক দশক পরে উদ্ধার করেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ যা দিয়ে তাঁরা নির্মাণ করেন 'মুক্তির গান' প্রামাণ্যচিত্র। মুক্তির গান বর্তমান তরুণদের আলোড়িত করে। তারিক আলী ছিলেন এই প্রামাণ্যচিত্রের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব।


বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬-২০২০) লেখক, শিক্ষাবিদ ও চিত্র সমালোচক। তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং শিক্ষা ও গবেষনাক্ষেত্রে অবদানের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। তিনি একজন কথাশিল্পী হলেও বেশি সুনাম অর্জন করেছেন মননশীল রচনার জন্যে। উল্লেখযোগ্য বই বাংলাদেশের জাতীয়তা ও মৌলবাদ, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা, নৈঃশব্দের সংস্কৃতি।


অরুণ সেন (১৯৩৬-২০২০) অরুণ সেনের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গের হলেও তিনি আজন্ম কলকাতাবাসী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ শেষ করে কলকাতারই একটি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। অরুণ সেন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট লেখক। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বৈশিষ্ঠ্য এবং প্রাঞ্জল গদ্য ব্যাপক সমাদৃত। বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ ও চর্চার কারণে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে বাংলাদেশ বিষয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রিত হন। সেখানকার কর্মসূত্রে বাংলা বিভাগের ওই বিষয়ের পাঠক্রম তৈরি করেন তিনিই। বাংলাদেশ ও তার সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক লেখালেখি, সেমিনারে ভাষণ বা পাঠ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয়তা সর্বজনবিদিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই সাহিত্যের বাংলাদেশ, বিষ্ণু দে, আধুনিক কবিতা, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, বাংলা বানান ইত্যাদি। বাংলাদেশের সমাজ ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বহু বছরের চর্চার ফসল বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর কয়েকটি বই: দুই বাঙালি, এক বাঙালি, বাংলা বই বাংলাদেশের বই, দুই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য।


নিমাই ভট্টাচার্য (১৯৩২-২০২০) একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখক ও সাংবাদিক। পশ্চিম বাংলায় জন্ম হলেও আদিনিবাস পূর্ববাংলার যশোরে। প্রায় ১৬০টি উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু যে উপন্যাস সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং যা তাঁকে অমরত্ব দেবে সেই উপন্যাসের নাম 'মেমসাহেব'। নিমাই ভট্টাচার্য্য তাঁর সময়ের অন্যতম সাহিত্যিক যাঁর রচনার যথেষ্ট ইতিবাচক মূল্যায়ণ হয়নি বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। ২০২০ সালে ২৫ জুন তিনি কোলকাতায় মৃত্যু বরণ করেন।


সাইদা খানম (১৯৩৭-২০২০) প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নারী আলোকচিত্র শিল্পী। সাইদা খানমের ফটোগ্রাফিতে আগ্রহ জন্মে অনেক ছোটকাল থেকে। যখন তার খালা তার জন্য আমেরিকা থেকে ভাল ক্যামেরা নিয়ে আসেন। ফটোগ্রাফার হিসেবে তার হাতেখড়ি এবং প্রেরণা ছিল বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকার প্রচ্ছদসমূহ। ১৯৫৬ সালে চাকুরী জীবন শুরু করেন তখনকার দিনের একমাত্র নারী পত্রিকা 'বেগম'-এ কাজের মাধ্যমে। তার তোলা ছবি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সুনাম অর্জন করে। সাইদা খানম কাজ করেছেন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের সাথে, তাঁর তিনটি ছবিতে। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন সাইদা খানম। ওই বছরই জার্মানিতে ইন্টারন্যশনাল অ্যাওয়ার্ড 'কোলন' পান তিনি। ভারত, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ ক'টি দেশে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তিনি অনেক ছবি তুলেছেন। তিনি একুশে পদক বিজয়ী আলোকচিত্র শিল্পী। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট তিনি মৃত্যু করেন।


মকবুলা মনজুর (১৯৩৮-২০২০) বাংলাদেশের লেখক, ঔপন্যাসিক, শিক্ষক ও সম্পাদক। সৈয়দুর রহমান তার 'হিস্টরিক ডিকশনারি অব বাংলাদেশ' গ্রন্থে তাকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন ও হাসান হাফিজুর রহমান-এর পাশাপাশি আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে অবদানকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলা উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে লেখিকা সংঘ পুরস্কার ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। তিনি জীবনে অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন। তার ভেতর "কালের মন্দিরা" সবচাইতে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এছাড়া অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে কনে দেখা আলো , নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস, নদীতে অন্ধকার, লীলা কমল, বাউল বাতাস, ছায়াপথে দেখা ও একটাই জীবন ইত্যাদি। 'কালের মন্দিরা' বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি জাতীয় আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরস্কার অর্জন করে ১৯৯৭ সালে। ৮২ বছরে বয়সে তিনি ২০২০ সালে ৩ জুলাই মৃত্যু বরণ করেন।


পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (১৯৪৯-২০২০) আত্মমগ্ন ও নির্জন কবি হিসেবে মননশীল পাঠকের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আদৃত। কলকাতার দমদমের সন্নিকটে সিথির মোড়ে থাকতেন। বাম রাজণীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ দেবী বেরোয় ১৯৭০ সালে । এই গ্রন্থ সকলের চোখে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থুল পড়ে যায়। এরপর রাত্রি চতুর্দশী, টেবিল, সাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ, নবান্ন , বহিরাগত, দূরের সন্ধ্যা একে একে অনেক কাব্যগ্রন্থ বের হয়। তিনি ২০২০ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।


ঊষা গাঙ্গুলি (১৯৪৫-২০২০) দুই বাংলায় সুপরিচিত নাট্যনির্দেশক ও অভিনয়শিল্পী ঊষা গাঙ্গুলি। মাতৃভাষা হিন্দি হলেও কলকাতায় বাংলায় এবং হিন্দিতে নাটক করে মঞ্চ মাতিয়ে রাখেন। নারীবাদী নাট্যশিল্পী ও সমাজকর্মী ঊষা গাঙ্গুলি বিবাহসূত্রে বাঙালি ছিলেন। রুদালী তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কীর্তি। নারীবাদী দৃষ্টিকোন বিশেষত নাটকে নারীর নিরাপত্তা ও স্বাবলম্বিতা ফুটিয়ে তুলতে তাঁর তুলনা ছিল না। ২০২০ সালে ১৩ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন।


আলম তালুকদার (১৯৫৬-২০২০) করোনার বলি জনপ্রিয় ছড়াকার ও মুক্তিযোদ্ধা আলম তালুকদার। আলম তালুকদার 'চাঁদের কাছে জোনাকি' ছড়ার বইয়ের জন্য ২০০০ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া পালক অ্যাওয়ার্ড, জয়নুল আবেদিন পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পান। বই, এক স্বাধীন, তিন রাজাকার, দশ ফালি রোদ। ২০২০ সালে ৮ জুলাই মৃত্যু বরণ করেন।


দাউদ আল হাফিজ (১৯৬৫-২০২০) নব্বই দশকের অন্যতম কবি দাউদ আল হাফিজ এর জন্ম শৈলকুপার কবিরপুর গ্রামে। ১৯৮১ সালে শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে যশোর শিক্ষাবোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে মেধা তালিকায় ২য় স্থান অর্জন করেন। তিনি ইংরেজিতে এম এ পাশ করেন। ১৯৯৩ সালে T S Elliot নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। পরে "আনাবাস" নামে আর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে তিনি লেখালেখি করতেন। শৈলকুপায় শিশুদের জন্য তিনি একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েকবছর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন কবি দাউদ আল হাফিজ। সকলের থেকে সবক্ষেত্রেই একটু আলাদা ধাচের। তিনি লেখালেখি, সাহিত্য আড্ডা পছন্দ করতেন। অনুবাদ, সমালোচনা, সম্পাদনা করতেন। খন্দোকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ পত্রিকার তিনি সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০১ সাল পর্যন্ত। ঢাকার যান্ত্রিক জীবন ত্যাগ করে দীর্ঘদিন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে শৈলকুপায় পরিবারের সাথে বসবাস করতেন। ২০২০ সালে ২৯ জুন মৃত্যু বরণ করেন।


আলেয়া চৌধুরী (১৯৫৬- ২০২০) বাংলাদেশের কবি। গত চার দশক ধরে প্রবাসী। গত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত নিউ ইয়র্ক শহর ও আশেপাশেই বসবাস করছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন লেখাপড়া না করা অবস্থায় গ্রাম থেকে প্রথমে ঢাকা চলে আসেন বিদ্রোহী আলেয়া। সম্পূর্ণ একা। এরপর প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে, পরে ইউরোপে এবং শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রকম পেশায় খুব সংগ্রামময় জীবন কাটাতে হয় আলেয়াকে। এর-ই ভেতর কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে তার কঠিন চিকিৎসা সমাপ্ত করে জয়ীও হন। ছোটবেলা থেকেই কবিতা আন্দোলিত করতো আলেয়াকে। সময় এবং সুযোগ পেলেই তার কবিতা লেখার খাতাখানি খুলে বসতেন। নিজের খুশিমতো কবিতা লিখতেন। বহু সংঘাতের ভেতর দিয়ে গিয়েও তিনি কখনো তার কবিসত্তা হারান নি। তার গ্রন্থ সংখ্যা অর্ধ ডজনের বেশি। তিনি সারাজীবন অবিবাহিত থাকেন। তার এরকম দুর্লভ জীবন গাথার সংবাদ পেয়ে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যলয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর পড়তে এসে বাংলাদেশের ছাত্রী দীনা হোসেন (ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের কনিষ্ঠা কন্যা) আলেয়ার সংগ্রামময় জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেন। ২০২০ সালে ৪ আগস্ট মৃত্যু বরণ করেন।


সুব্রত মুখোপধ্যায় (১৯৩৫—২০২০ )পশ্চিমবঙ্গের লেখক। ঔপন্যাসিক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ২০১২ সালে তাঁর বীরাসন উপন্যাসের জন্যে আকাদেমী পুরস্কার পান। এছাড়া তাঁর প্রাপ্ত আরো নানা পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে বঙ্কিম সাহিত্য পুরষ্কার। বিক্রমমপুরে জন্ম গ্রহণ করা সুব্রত মুখোপধ্যায়ের অন্যান্য উপন্যাস অগ্নিবীজ, উদ্ভট সাগর, গর্ভগৃহ, আয় মন বেড়াতে যাবি, কালান্ত, আলতাপা, নিগড় ইত্যাদি। ২০২০ সালে ১৮ মার্চ ৬৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫-২০০০) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং কবি। তিনি অস্কার বিজয়ী জগৎবিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪ টিতে অভিনয় করেছেন । তাঁর প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার'। সেই পঞ্চাশের দশকে অপুর সংসার চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেই দর্শকের মন কেড়েছিলেন সৌমিত্র।
পঞ্চাশের দশকের অভিনেতা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজীবন অভিনয় করে গেলেও অভিনেতা হিসেবে এতোটুকু ঔজ্জ্বল্য হারান নি। । বরং একের পর এক ছবিতে অভিনয় দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। আমৃত্যু, ৮৫ বছর বয়সেও, মঞ্চ আর ছায়াছবি দুই ক্ষেত্রেই সক্রিয় চরিত্রাভিনেতা ছিলেন। নিজেকে বরাবর বলতেন থিয়েটারের মানুষ। তাঁর দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।

কবিতার বই লিখেছেন ১৪টি। শিল্পক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্যে ফ্রান্স সরকার তাঁকে দিয়েছে সে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার। স্বদেশে তিনি আগে থেকেই সন্মানিত হয়েছেন পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে-সহ বহু পুরষ্কারে। গোটা ভারতের সর্বসেরা নায়ক হিসেবে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন সুমন ঘোষের 'পদক্ষেপ" ছবিতে অভিনয় করার জন্যে। এতো সুনাম করা সত্ত্বেও কখনো বম্বে পাড়ি জমাননি।


ড. আলী আসগর (১৯৩৬-২০২০) তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, গবেষক, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক ও সংগঠক। অধ্যাপক আলী আসগর কর্মজীবনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। সুদীর্ঘকাল তিনি জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে গড়ে তুলেছেন 'বিজ্ঞান খেলাঘর'। বিজ্ঞান মেলার আয়োজনের মূল উদ্দীপক ছিলেন। জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যুক্তি ও মুক্ত বুদ্ধির আন্দোলনের , অসাম্প্রদায়িকতার প্রচারে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন। প্রতিটি শিশুর মধ্যে তিনি অমিত সম্ভাবনা দেখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিশুদের সঠিক গন্তব্যের সন্ধান দিতে পারলে তারা নিজেরাই পথ খুঁজে নিতে পারবে। খেলাঘরের লেনিন চৌধুরীর ভাষায়, " মাথাভরা বাবরি চুল, প্রাণবন্ত উচ্ছল দেহভঙ্গি, আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় কথা বলে যাচ্ছেন একজন স্বাপ্নিক মানুষ। শব্দের পর শব্দেরা বেরিয়ে এসে মায়াজাল রচনা করছে, অন্যদিকে মোহাবিষ্ট শ্রোতাবৃন্দ—এই দৃশ্যকাব্য আর রচিত হবে না। একজন বুড়ো শিশু অনায়াসে মিশে যেতেন শিশু-কিশোরদের সঙ্গে। শিশুদের শোনাতেন স্বপ্ন নির্মাণের গল্প, শোনাতেন জ্ঞানবিজ্ঞানের হিরণ্ময় জগতের বর্ণনা। নির্ভয়ে আপন বিশ্বাস এবং আস্থার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, 'মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। অতএব স্বপ্ন দেখো, অনেক বড় স্বপ্ন।


শিশির ভট্টাচার্য্য (১৯৪০-২০২০) অধ্যাপক ড. শিশির ভট্টাচার্য বরিশালের উজিরপুর থানার ঢামুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিশির ভট্টাচার্য ১৯৮০ সালে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞান (এস্ট্রোফিজিক্স) বিষয়ে পিএইচডি করেন। তিনি ২০১৯ সালে বাংলা একাডেমীর 'মেহের কবীর পুরস্কার' অর্জন করেন। গণিত ছাড়াও তিনি মহাবিশ্ব ও মহাজাগতিক বিষয়ের ওপর বেশ কিছু বই রচনা করেছেন। তার বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তারপর অবসর গ্রহণ করেন।
আশির দশকে মহাকাশ গবেষণার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। লিখেছেন বিজ্ঞানবিষয়ক বহু বই। সজ্জন ব্যক্তি শিশির ভট্টাচার্য্য মৃত্যুকালে স্ত্রী ও দুই পুত্র রেখে যান।


কালিদাস কর্মকার (১৯৪৬-২০২০) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকার। তার আঁকা ছবি দেশে বিদেশের বহু গ্যালারিতে রয়েছে। তিনি শিল্পকলা একাডেমী পদক ও একুশে পদক অর্জন করেন তাঁর ছবির জন্যে। তিনি Viscosity Printing এর জন্যে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর অঙ্কিত চিত্রের বহু প্রদর্শনী হয় দেশে বিদেশে। ফ্যাশন দুরস্ত কালিদাস কর্মকার খুব প্রফুল্লচিত্তের আধুনিক মানুষ ছিলেন, তাঁর বহু বিদেশী গুণগ্রাহী রয়েছে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে।


আলী যাকের (১৯৪৪-২০২০) প্রখ্যাত অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক। তাছাড়া তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। তিনি এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশন্স লিমিটেড -এর মালিক ছিলেন। আলী যাকের ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ছিলেন। তিনি তার নাটকের দলে ১৫ টি নাটক পরিচালনা করেন এবং ৩১টি নাটকে অভিনয় করেন। তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের জন্যে তিনি একুশে পদক অর্জন করেন। চার বছর ধরে তিনি ক্যান্সারর সাথে যুদ্ধ করছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি কভিড ১৯ পজিটিভ বলে শনাক্ত হন। তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেত্রী সারা যাকের। আলী যাকের অভিনীত কালজয়ী নাটকের মধ্যে কোপিনিকের ক্যাপ্টেইন, গ্যেলিলিও, নূরুলদিনের সারাজীবন, ম্যাকবেথ, অচলায়তন, দেওয়ান গাজীর কিসসা বিখ্যাত।


ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান ( ১৯৫৮– ২০২০) বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান কোভিড ১৯-এ আক্রমণের কারণে রাজধানীর এক হাসপাতালে মারা যান।
তাঁর শরীরে করোণা ভাইরাস সংক্রামিত হলে বারোদিন আগে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে থাকাকালীন তিনি নিউমোনিয়ায় ভোগেন। এছাড়া তাঁর ডায়েবিটিস ছিল। শাহাদাত হোসেন খান কুমিল্লার ব্রাহ্মমনবাড়িয়ার এক ঐতিহ্যশীল সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান একজন প্রসিদ্ধ সেতারবাদক ছিলেন।
তাঁর পিতামহ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের অনুজ ওস্তাদ আয়েদ আলী খান উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছিলেন। .তাঁর দুই চাচা ছিলেন ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান ও সংগীত গবেষক ও সংগীত রচয়িতা মোবারক হোসেন খান। সংগীতে তাঁর অবদানের জন্যে ১৯৯৪ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এছাড়া রাজ্য সংগীত একাডেমী, কলকাতা থেকে তাঁকে সম্বর্ধিত করা হয়। .
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম এ করেন শাহাদাত হোসেন। তিনি আমেরিকার কালিফোর্নিয়া শহরের আলী আকবর খান সংগীত কলেজ থেকে "বিদ্যা অলঙ্কার" উপাধি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের গ্র্যান্ড ইউনিয়ন অর্কেস্ট্রার সঙ্গে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশে মিউজিক কলেজ ও শিল্পকলা ইন্সটিটিউটে সরোদ বাজনা শেখাতেন তিনি। তিনি আলি আকবর খানের ভাগ্নে ছিলেন। তিনি বিবাহিত ও দুই কন্যা সন্তানের পিতা। তাঁকে মীরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়।


সুধীর চক্রবর্তী (১৯৩৪-২০২০) হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি। অধ্যাপক, লেখক, গবেষক, সংগীতজ্ঞ এবং লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ। পৈতৃক ভিটে নদিয়া জেলার দিগনগরে কিন্তু ছেলেবেলার বেশ অনেকটা সময় কেটেছে হাওড়ার শিবপুরে। অনুসন্ধানভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে, বিশেষত রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনপন্থা, কর্তাভজা, বাউল-ফকির, সাহেবধনী, বলরামী বিষয়ে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। সুধীর চক্রবর্তী নিজেকে কৃষ্ণনাগরিক হিসেবে পরিচয় দেন। বারো বছর বাংলা সংস্কৃতি ও মননের পত্রিকা ধ্রুবপদ প্রকাশ করেছেন কৃষ্ণনগর থেকে। তিনি কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন, ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল অব্দি মূলত সাহিত্যের অধ্যাপনা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কলেজে অতিথি অধ্যাপকের কাজও করেন। অধ্যাপনার সাথেই চালিয়ে গেছেন লেখা ও গবেষণার কাজ এবং লিখেছেন ষাটেরও অধিক বই। তার বই "বাউল ফকির কথা"-র জন্য ২০০২ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার এবং ২০০৪ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি। এছাড়া আরো বহু পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৪।


মনজুরে মওলা (১৯৪০-২০২০) সাবেক সচিব, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যবোদ্ধা, এবং আরো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মনজুরে মওলা করোনার আক্রমনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ৮০ বছর বয়সে। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। আলোকিত, প্রাজ্ঞ, বিনয়ী এবং প্রাঞ্জল বক্তা মনজুরে মওলার এই বছরই বেরিয়েছে একটি কাব্য গ্রন্থ। নাম 'জোরে শ্বাস নাও'। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, দার্শনিকতা ও অপরূপ ছন্দের সমাবেশ বইটিতে। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মনজুরে মওলা বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আশির দশকের শুরুতে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। বাংলা একাডেমিতে 'একুশ আমাদের পরিচয়' শিরোনামে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা, যার পরিধি আজ ব্যপক আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ "'বাংলা একাডেমি গ্রন্থ মেলা'কে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র মতো জাতীয় চেতনায় রূপান্তরের ঘটনার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া, ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কার, প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালার আয়োজন, আরজ আলী মাতুব্বর বা খোদা বক্স সাঁইয়ের মতো লোকমনীষাকে ফেলোশিপ দেওয়ার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ডেভিডসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা আনিসুজ্জামানের পুরনো বাংলা গদ্যের মতো বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন মনজুরে মওলা। 'ভাষা শহীদ গ্রন্থমালার' ১০১টি বই বাংলা একাডেমি থেকে একযোগে প্রকাশ করা তাঁর অসামান্য কীর্তি। এগুলো ছাড়াও 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করা উচিত যেটি তার সময়ে প্রকল্প হিসেবে গৃহীত হয় এবং প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায়।
তাঁর অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে, গোয়েন্দাগল্পের ইতিহাস, এলিয়ট নিয়ে গবেষণা, ইবসেন অনুবাদ, সুধীন দত্তের 'দশমী'কাব্যগ্রন্থ নিয়ে নষ্টনীড় নামে আস্ত একটি প্রবন্ধের বই রচনা এবং রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একাধিক গ্রন্থ । তার আরেকটি দুঃসাহসী কাজ ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শ্রাবণ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ। শ্রাবণে বিনাদ্বিধায় সমসাময়িক লেখকদের লেখার সমালোচনা প্রকাশিত হত।
রবীন্দ্রনাথের মতোই মনজুরে মওলা মৃত্যুকে পরিশেষ ভাবেননি, ভেবেছেন অন্য এক জীবনের প্রারম্ভ হিসেবে। মাটি হেরে যায় গ্রন্থের কবিতায় আমরা সেই ইঙ্গিত দেখতে পাই:
আমাদের চলাফেরা
চুপ হ'য়ে আসে,
আমাদের
ঢেকে দ্যায় মাটি।
তবু
আমরাই দূর্বা হই,
আমরাই চাল বেয়ে
কুমড়ো হয়ে ফুটি।
মাটি হেরে যায়।
মাটি হেরে যায়।।

রাজু আলাউদ্দিনের ভাষায়, তিনি আমাদের শোনালেন "অন্য এক সত্য: মৃত্যু মানে মৃত্যু নয়; রূপান্তর, অন্য এক জীবন: দূর্বা আর কুমড়োর মধ্য দিয়ে জীবনের উত্থান। তিনি এই অদম্য জীবনের বিজয়ী বীর। আমাদের মন ও মননের বীরোত্তম। তিনি যে বলেছেন কাপুরুষ কোনোদিনই হয় না তো কবি", তাঁর সেই দুঃসাহসী, প্রথাবিরোধী উপলব্ধি-ই যেন তুলে ধরেছেন তিনি ওপরের লাইন কটিতে যেখানে মাটি হেরে যায় কিন্তু আমরা বেঁচে থাকি দূর্বা বা কুমড়া ফুল হয়ে।"


আদিত্য কবির ( ১৯৭০-২০২০)ঃ কবি, লেখক ও সৃজনশীল বিজ্ঞাপন ব্যক্তিত্ব আদিত্য কবির রাতে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করে মারা যান বলে জানিয়েছে তার ঘনিষ্টজনরা।
ক্যারোট কমিউনিকেশন নামের একটা বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন কবি আদিত্য কবির। এর আগে বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকে অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। আদিত্য তার কর্মজীবনের শুরুতে সাংবাদিকতা করেছেন। আজকের কাগজ ও ভোরের কাগজ পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে প্রথমে লোকের চোখে পড়েন আদিত্য। আজকের কাগজে নব্বুইয়ের দশকে কিছুদিন কাজ-ও করেন। আদিত্য কবির জনপ্রিয় বিনোদন পাক্ষিক আনন্দভুবনের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তারপর এক সময় সাংবাদিকতা ছেড়ে চলে যান বিজ্ঞাপনের জগতে। ১৫ বছর বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেছেন তিনি। সাংবাদিকতার পর পেশা জীবনে পরিবর্তন আনলেও বরাবর গল্প ও কবিতা লিখে গেছেন আদিত্য। তার বাবা হুমায়ুন কবির। দেশের খ্যাতিমান কবি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। অতি অল্প বয়সে রাজনৈতিক কারণে আততায়ীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি ১৯৭২ সালে। মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হলের হাউজ টিউটর (সকলের কাছে "রেবু আপা" বলে পরিচিত) ছিলেন। আদিত্যর অসময়োচিত প্রয়াণে মিডিয়াঙ্গণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।


আবু তাহের (১৯৩৬-২০২০)ঃ ব্যতিক্রমী শিল্পী ও ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী আবু তাহের লোকান্তরিত হয়েছেন ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ শুক্রবার । বাংলাদেশে যাঁরা বিমূর্ত প্রকাশবাদ ঘরানায় শিল্পচর্চা করতেন, তাঁদের ভেতর তিনি অন্যতম । তাঁর শিল্পী জীবন খুব সহজ ছিল না । অভাবিত পরিশ্রম করে, লেগে থেকেছেন শিল্পী হবেন বলে । এবং একদিন সফলও হয়েছিলেন । তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছেন : "আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে শিল্পচর্চার ক্লাসিক চিন্তা কঠিন বিষয় । (একজন শিল্পীকে) নিরলস পরিশ্রম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অর্থনৈতিক দীনতা আর হতাশা সম্বল করে চলতে হয় অনিশ্চিতের পানে, এদিকে জীবনের চাহিদাকে অস্বীকার করা সামাজিক মানুষের জন্য অসম্ভব । কম্প্রোমাইজ করতে করতে ভেতরের আগুন নিভে যায় । অবক্ষয় বঞ্চনার আঘাতে আসল মানুষটির মৃত্যু ঘটে । আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করা পরিবশে একজন শিল্পীর জন্য আনন্দলোকের সাধনা করা এবং তাতে নূন্যতম সমর্থন পাওয়া সত্যি একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার ।
ছোটবেলায় পড়াশুনা ভালো লাগত না । কেবল স্কুল পালিয়ে কুম্ভকারদের পাড়ায় গিয়ে বসে বসে তাদের কাজ দেখতেন। ওদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে হুকা খেতাম, বিড়ি টানতেন। বিকেলে বাড়ী ফিরলে বিচার বসতো । তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতেন তাঁর মা। একবার শিল্পী হবার লোভে ক্লাস এইটে পড়াকালীন বাড়ি থেকে কিছু টাকা ও গহনা লুকিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। কিন্তু কাগজে বিজ্ঞাপন দেযার ফলে শীঘ্র-ই ধরা পড়ে গৃহে গমন ও স্কুলে ফেরৎ। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ করে পরিবারের সকলের বাঁধার মুখে ১৯৫১ সালে গ্রাম থেকে ঢাকাতে এসে আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তখন আর্ট স্কুলে ছাত্র হতো না । ছাত্রদের কোনো ভবিষ্যতও ছিল না । ভবিষ্যৎ অন্ধককার দেখে আর্ট কলেজের পাশাপাশি নাইট কলেজে পড়েছেন। অনেক স্কুলে মাস্টারী করেছেন। আর্ট স্কুলের জীবনে বন্ধুদের মাঝে ছিলেন শিল্পী আব্দুল বাসেত, দেবদাস চক্রবর্তী, কাজী আবদুর রউফ । ছবি আঁকার জন্যে অনেক কষ্ট করেছেন। তার স্ত্রী বটি দিয়ে প্রথম প্রথম ছবি কেটে ফেলতেন। পরে অবশ্য অন্যদের সঙ্গে তিনি হন তার ছবির বড় পৃষ্ঠপোষক। 'আর্ট সার্কেল' নামে তাঁর যে শিল্পীদের একটি গ্রুপ ছিলো, সেখানে অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে আছেন : সমরজিৎ রায় চৌধুরী, এনায়েত হোসেন, মতলুব আলী, আব্দুস শাকুর শাহ, চন্দ্র শেখর দে, বীরেন সোম, স্বপন চৌধুরী প্রমুখ। একজন শিল্পীসুলভ বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করে এ জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন শিল্পী আবু তাহের।


মান্নান হীরা (১৯৫৬-২০২০) নাট্যকার ও নির্দেশক। সিরাজগঞ্জে জন্ম। সেখানেই বড় হয়েছেন। মান্নান হীরার আকস্মিক মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পথনাটক আন্দোলনসহ দেশের নাট্যাঙ্গনে তার অনন্য অবদান জাতি স্মরণ রাখবে। পরদিন
দুপুরে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মান্নান হীরার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাঁর অগ্রজ ও অনুজেরা শিল্পকলা একাডেমিতে মান্নান হীরার সাদাকালো ছবির পাশে লেখা ছিল—'নাটক আমার বুকেরও ধন, নাটক আমার সোনার সন্তান/ নাটক আমার প্রিয় ভূমি, আমারও জীবন মরণ।'সারা জীবন মিশে ছিলেন নাটকের সঙ্গে। নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন নাটকে—মঞ্চে, টেলিভিশনে ও পথনাটকে। তাঁর নাটকের গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য ছিল নিরন্ন মানুষ ও দরিদ্র জনপদ। তিনি বাংলাদেশের পথনাটক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। মান্নান হীরা ছিলেন বাংলাদেশের পথনাটক পরিষদের সভাপতি। তিনি হৃদপিন্ডের জটিলতায় ভুগছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই জটিলতাতেই মৃত্যুবরণ করেন।


আব্দুল কাদের (১৯৫২-২০২০) স্বনামধন্য এই অভিনেতার আসল নাম আবদুল কাদের হলেও তার প্রথম নাটক "কোথাও কেউ নেই"-এ তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় চরিত্র "বদি ভাই" -এর কারণে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি "বদি ভাই" বলেই বেশি পরিচিত। আজ থেকে ২৬ বছর আগে, ১৯৯৪ সালে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের "কোথাও কেউ নেই" জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকে তিনি মাস্তান সর্দার বাকের ভাইয়ের বিশ্বস্ত অনুচর বদি ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
আড়াই দশক পরেও সেই নাম এখনও দর্শকদের মন থেকে মুছে যায়নি। এর পর একে একে টেলিভিশিনে অনেক নাটকেই তিনি অভিনয় করেন, বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ রচিত জনপ্রিয় নাটকগুলিতে অভিনয় করেই তাঁর অভিনয় শিল্পে সবচেয়ে বেশি সুনাম হয়। পরবর্তীকালে তিনি হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত প্রতিটি টেলিভিশন নাটক ছাড়াও অন্যদের লিখিত ও পরিচালিত বেশ কিছু নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেন। এছাড়া তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'ইত্যাদি'র নিয়মিত শিল্পী। আব্দুল কাদের মুখ দেখিয়েছেন বড় পর্দায়ও। ২০০৪ সালে রিয়াজ ও শ্রাবন্তী অভিনীত 'রং নাম্বার'সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন। আব্দুল কাদের অভিনয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও এটি তার মূল পেশা নয়। তিনি একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন শীর্ষ পদে। কিন্তু সেই পেশার ফাঁকে ফাঁকেও তিনি অভিনয় করেছেন। আব্দুল কাদের কয়েকশো টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাস্যরসাত্মক চরিত্রে। আব্দুল কাদের দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসার জন্যে গেলে ধরা পড়ে তার প্যাঙ্ক্রিয়াসের ক্যান্সার যা শরীরময় ছড়িয়ে গেছে। এই শরীর কিমোথেরাপীর ধকল সইতে পারবে না বলে দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। দেশে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁর শরীরে কোভিড-১৯ ধরা পড়ে যা তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে বলে মনে করা হচ্ছে।


এমাজউদ্দিন আহমেদ (১৯৩৩-২০২০)ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক। শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জব্যে তিনি একুশে পদক লাভ করেন ১৯৯২ সালে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় ছাত্র নেতৃত্বে আসেন এমাজউদ্দিন। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। ২০২০ সালের ১৭ জুলাই তিনি ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।


তাপস পাল (১৯৫৮-২০২০) বাংলা চলচ্চিত্রের অতি জনপ্রিয় অভিনেতা। বিশেষ করে মহুয়া রায়চৌধুরী ও দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে তার ছবিগুলো দর্শকপ্রিয় হয়। তিনি পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগেসে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জনসভায় নারী-অবমাননাকর বক্তব্য রেখে নিন্দিত-ও হন। অভিনয়ের জন্যে তিনি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। হৃদপিন্ডের অসুখে মারা যান তাপস।

মালেকা পারভীন বানু (১৯২৯-২০২০) এক সময়ের অত্যন্ত বিখ্যাত গায়িকা মালেকা পারভীন বানু ঢাকার রেডিও পাকিস্তানে প্রথম মুসলিম শিল্পী। তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হকের ভাগ্নী বিখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও ভাষাসংগ্রামী সারা তৈফুরের কনিষ্ঠা কন্যা। দাম্পত্যজীবনে তিনি ডঃ লতিফুর রহমানের স্ত্রী ছিলেন।


মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (১৯৩৮-২০২০); জন্ম সিলেটে, মৃত্যু কলকাতায়। করোনায় মৃত্যু হয় তাঁর। বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। বিশেষ করে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে প্রায় এককভাবে দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ করেছেন। অনেক পুরস্কারের মধ্যে আকাদেমী পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার ও খগেন্দ্রনাথ মিত্রস্মৃতি পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।


আজাদ রহমান (১৯৪৪-২০২০) বাংলাদেশের বিখ্যাত সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গায়ক। বর্ধমানে জন্ম। রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনা ও গান শেখা। অতঃপর বাংলাদেশে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। কন্ঠশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও কর্মজীবন সংগীত পরিচালনা ও চলচ্চিত্রে সংগীত যোজনায় কেটে যায়। সংগীতে অবদানের জন্যে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০২০ সালের ১৬ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


সুফিয়া আহমেদ (২০ নভেম্বর, ১৯৩২ – ৯ এপ্রিল, ২০২০ ) ভাষাসৈনিক ও দেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ ৮৭ বছর বয়সে ১০ এপ্রিল মারা যান। তিনি বার্ধ্যক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভেঙে যে মিছিল বের হয়, তার অগ্রসেনানী ছিলেন এই নারী। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০০২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিমের মেয়ে সুফিয়া আহমেদ। তার স্বামী ছিলেন দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ।


আলাউদ্দিন আলী (২৪ ডিসেম্বর ১৯৫২ – ৯ আগস্ট ২০২০) ঢাকাই চলচ্চিত্রের বহু হৃদয়কাড়া গানের গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী সুরের ভুবন ছেড়ে চলে যান ৯ অগাস্ট। ৬৮ বছর বয়সী এই সুরস্রষ্টা ক্যান্সারের পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন।

একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায', প্রথম বাংলাদেশ- আমার শেষ বাংলাদেশ, ভালোবাসা যতো বড়ো জীবন তত বড় নয়, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, হয় যদি বদনাম হোক আরো, আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টা', সুখে থাকো ও আমার নন্দিনীসহ কালজয়ী অসংখ্য গানে পেছনের কারিগর আলাউদ্দিন আলী।
১৯৬৮ সালে বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন তিনি, আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে বেহালাবাদক হিসেবে। সেসব দিনে আনোয়ার পারভেজসহ প্রখ্যাত অনেক সুরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আলাউদ্দিন আলী। চলচ্চিত্রের সংগীতে বেহালা বাজাতে গিয়ে তার সংগীত পরিচালনার আগ্রহ তৈরি হয়।
১৯৭২ সালে দেশাত্মবোধক গান 'ও আমার বাংলা মা' গানের মাধ্যমে জীবনে প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার। গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৭৯ সালে, সুন্দরী সিনেমার জন্য ১৯৮০ সালে এবং কসাই ও যোগাযোগ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া ১৯৮৫ সালে শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আলাউদ্দিন আলী। খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্রেও তিনি সংগীত পরিচালনা করেছেন।