নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুর্নাহর সাক্ষাৎকার: স্মৃতি খুব জরুরি, এটাই সবকিছুকে বাস্তব করে তোলে

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 9 Oct 2021, 05:45 AM
Updated : 9 Oct 2021, 05:45 AM


এ বছর সাহিত্যে নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুর্নাহ'র জন্ম জানজিবারে ১৯৪৮ সালে। বেড়ে ওঠাও সেখানেই। ১৯৬৮ সালে তিনি পড়াশুনার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। নাইজেরিয়ার বায়েরো ইউনিভার্সিটি কানো'তে দুই বছর পড়াশুনার পর তিনি ইংল্যান্ডে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণের জন্য ১৯৮২ সালে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।
পরবর্তীকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি শিক্ষকতা করেন দীর্ঘদিন। এ পর্যন্ত তার দশটি উপন্যাস আর বেশ কিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। উত্তরউপনিবেশ নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু গবেষণাপ্রবন্ধ। এখানে অনূদিত এই সাক্ষাৎকারটি ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ গৃহীত হয়েছিল ফাবিয়েন রথ, মারা হল্জেন্থাল, লিসা জিঙ্গেল কর্তৃক। তাদের সেই সাক্ষাৎকারটি প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদের অনুবাদে বিডিআর্টস-এর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। বি.স.

আবদুলরাজাক গুর্নাহ'র সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ফাবিয়েন রথ, মারা হল্জেন্থাল, লিসা জিঙ্গেল
অনুবাদ: আলম খোরশেদ

প্রশ্ন : বিশ্বসাহিত্য, উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য কিংবা বৈশ্বিক দক্ষিণের সাহিত্য এইসব বর্গ কিংবা অভিধাসমূহকে আপনি কী চোখে দেখেন? আপনার লেখালেখি কিংবা সাধারণভাবেই সাহিত্যের বিশেষণ হিসেবে এগুলোকে কি আপনি প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ এবং/অথবা উপকারী বলে মনে করেন? আপনি কি নিজেকে এইসব অভিধা-চিহ্নিত একজন সাহিত্যিক বলে মনে করেন?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : নিশ্চয়ই এরা উপকারী। প্রথমত প্রাতিষ্ঠানিক কারণে এরা উপকারী। এদেরকে বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে তুলনা হিসাবে কিংবা প্রকাশনার প্রয়োজনে ও বিপণনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে, কেননা এর মাধ্যমে আপনি পাঠককে একটা বার্তা দিতে পারেন, ফলে তিনি হয়তো এতে আগ্রহী হবেন। তাদের এই সাংগঠনিক ব্যবহারটুকু ছাড়া এমনিতেই নিজগুণে তাদের আর কোনো উপকারিতা রয়েছে কি না আমি নিশ্চিত নই। আমি নিজেকে বর্ণনা করার জন্য এইসব অভিধা ব্যবহার করব না, কেননা তারা কোনো বিশেষ গুণের অনুষঙ্গ নয়, নয় কোনো শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়াও। এরা সাহিত্যের বর্ণনার কাজে লাগে এবং এর মাধ্যমে তাকে সংগঠিত হতে সাহায্য করে, উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচকদেরকে এর বিষয়ে আলোচনা করতে এবং এর মধ্যে বিশেষ কোনো বিন্যাস খুঁজে পেতেও সাহায্য করে বৈকি। অন্যদিকে এরা এধরনের সাহিত্যের ব্যাখ্যাকে একপ্রকার সীমাবদ্ধ করে ফেলে, কেননা এই বিশেষ বর্ণনাটুকুর চাইতেও তারা অধিক কিছু।

প্রশ্ন : আপনি কি তাহলে নিজেকে একজন উত্তর-ঔপনিবেশিক কিংবা বিশ্ব-সাহিত্যের লেখক বলে চিহ্নিত করবেন?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : আমি এই দুটো অভিধার কোনোটাই ব্যবহার করব না। আমি নিজেকে অমুক সাহিত্যের তমুক লেখক বলতে রাজি নই। সত্যি বলতে কি, আমি নিশ্চিত নই, আমি আমার নাম ছাড়া আর কোনো ভাবেই নিজেকে ডাকতে চাইব কি না। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমি অনুমান করি, কেউ যদি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে, "আপনি কি একজন… ঐ কী যেন বলে .. ওদেরই মতো কেউ?" আমি তখন সম্ভবত উত্তর দেবো, " না।" কেননা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আমি চাইব না আমার নামের একটা অংশ ওরকম খর্বিত কোনো অর্থ বহন করুক। অন্যদিকে এটা নির্ভর করে প্রশ্নটা ঠিক কেমন করে করা হয় তার ওপর, যেমন ধরুন একজন সাংবাদিক যখন সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেন, "আপনি কি একজন বিশ্ব-সাহিত্যের লেখক?" তখন সেখান থেকে ফিরে গিয়ে তিনি আসলে কী লিখবেন? কেননা আমি তো সেটা নই। আমি আরও জটিলতর কোনো একটা কিছু।

প্রশ্ন : এই বর্ণনাটা কি খুব জরুরি?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : আমি নিজেকে যেভাবে ভাবি, তার জন্য এটা জরুরি নয়, কিন্তু একজন সাংবাদিকের জন্য এটা খুব জরুরি হতে পারে, কেননা তিনি তাঁর বোর্ডে আমাকে গেঁথে দিয়ে বলবেন, ইনি একজন বিশ্ব-সাহিত্যের লেখক। আমি তাঁকে এই নামেই ডাকি। আমি আপনাকে এখন যেরকম জটিল করে উত্তর দিচ্ছি, ঐ জাতীয় লোকেদের ক্ষেত্রে সেরকম বলা থেকে বিরত থাকার একটা সহজাত প্রবণতা কাজ করে আমার মধ্যে।

প্রশ্ন : আমাদের পরের প্রশ্নটি এর আগের প্রশ্নের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত: বিশ্ব-সংস্কৃতিকে প্রায়শই উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের সংস্কৃতি নামক দুটো আলাদা ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। আপনি এই অভিধাগুলোকে কীভাবে দেখেন, বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : পৃথিবীটা তো আসলে উত্তর আর দক্ষিণের হিসাবে তৈরী নয়, কিন্তু একে এভাবে বর্ণনা করাটাকে কেতাদুরস্ত বলে মনে করা হয়। এর আগের প্রয়াস ছিল অন্যধরনের কিছু শব্দ যেমন, 'তৃতীয় বিশ্ব', 'অনুন্নত বিশ্ব' ইত্যাদির মাধ্যমে বর্ণনা করা, এখন এই উত্তর, দক্ষিণকে হয়তো সেগুলোর চাইতে বেশি ভদ্রস্থ বলে মনে করা হয়। তবে এটা বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক পার্থক্যকেই বর্ণনা করে এবং এর মাধ্যমে আরেকটি কুৎসিত শব্দ 'ঔপনিবেশিকতা'র বিলোপ সাধন করে, তাই এই বিষয়গুলোর আলোচনায় উত্তর-দক্ষিণের প্রয়োগটা তবু মন্দের ভালো। এই তথাকথিত উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যেকার পার্থক্যকে ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদই আসলে সংহত করেছে এবং এখনও করে চলেছে, মূলত সেই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের সূত্রে পাওয়া পার্থক্যসমূহের ভিত্তিতেই। অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে, পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে এবং উত্তর, দক্ষিণ অভিধাদুটো নিখুঁত না হলেও এই সব পার্থক্য বর্ণনার কাজে অন্তত এক ধরনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে। এই অভিধাগুলোকে কোনো পরিসর হিসাবে দেখা উচিত নয় আমাদের: এর সঙ্গে যোগাযোগ বরং দৃষ্টিভঙ্গির, বোঝাপড়ার ও প্রত্যাশা ইত্যাদির। আপনি চীনের এমন কিছু অংশ দেখবেন যারা পশ্চিমের মতোই সমান ধনী অথচ অন্য কিছু অংশ তা নয়। এটা কোনো জায়গার বর্ণনা নয়। আপনি যখন এর মাঝামাঝি অবস্থান নেন, তখনও কিছুটা অঞ্চলের ধারণার মধ্যেই থাকেন, কেননা সেই মাঝামাঝিটুকু ঠিক উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যবর্তী কিছু নয়, বরং এই দুটো অভিধার কাছাকাছিই কোনো একটা অনির্ধারিত অবস্থান। সেখানেই আমার ধারণা, আপনারা নিজেদেরকে উদারপন্থি হিসাবে স্থাপন করে বিশ্বনাগরিক, ফলত যথার্থ মানুষ হিসাবে দেখাতে চান। কিন্তু তারপরও সত্যিকার পার্থক্য কিন্তু আছেই, যে-ধরনের জীবন আপনারা যাপন করেন, তা আপনি যে-ই হোন এবং উত্তর দক্ষিণ যেখানেই থাকুন, আমাদের জীবন কিন্তু তা থেকে আলাদাই থাকে, তা সেটা আপনারা চান আর না চান। এই সংস্কৃতিতে রাষ্ট্র, সমাজ আপনি কিছু না করলেও আপনাদের যা প্রয়োজন তার যোগান দেয়; হাসপাতাল, স্কুল, কল্যাণভাতা এবং অন্য অনেক কিছু। অপরাপর দেশগুলোতে এরকম কিছুই নেই, ফলে এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে একেবারে বাস্তব কিছু তফাৎ রয়েছে, যার নানাবিধ কারণ থাকলেও মূলত ঐতিহাসিক ঘটনাবলিই এইসব পৃথক সমাজের স্রষ্টা।

প্রশ্ন : সমকালীন রাজনীতি প্রসঙ্গে বলি- 'শরণার্থী সমস্যাটা' কি বহু কিছু পাল্টে দেয়? তারা যখন, ধরুন জার্মানিতে আসে, তখন তো জার্মানিকে পাল্টে দেয়, এবং এভাবে আরও অনেক দেশই এরকম পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য রয়েছে।

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : আমি বলছি না যে, জগতের সবকিছু চিরস্থানু, অতএব নিশ্চয়ই পাল্টাচ্ছে তারা। অন্যদিকে, কারা বা কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি পাল্টায়, যেমন ধরুন দশ লক্ষ শরণার্থী জার্মানিতে এল, তো কার বেশি পাল্টানর সম্ভাবনা, জার্মানির না শরণার্থীদের? তো এটাই আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার: নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পরিবর্তন আসবে। যেমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভবিষ্যতের শরণার্থীরা একটা শর্তেই এই দেশে ঢুকতে পারবে, আর সেটা হচ্ছে তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে ইংরেজি শেখা শুরু করতে হবে। এতে সেরকম কোনো সমস্যা না থাকলেও এটাও সত্য যে, এই শর্তটার মধ্যেই নিহিত, তোমাদেরকে আমাদের মতো হয়ে যেতে হবে।

প্রশ্ন : সমকালীন সমাজের জন্য বিশ্ব-সাহিত্য কোন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ? আপনার কি মনে হয় এই ধারার লেখকদের বিশেষ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়? যদি তা মনে করেন, তাহলে ঠিক কোন ধরনের দায়িত্ব এগুলো?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : আমার মনে হয় না এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য বর্গ। প্রথমে আমি তর্ক তুলতে চাই আপনি এর কী অর্থ করেন জানতে চেয়ে। এটার মানে কি ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান সাহিত্য, হয়তো এমনকি প্রাচীন পারসিক ও চৈনিক সাহিত্য, কিংবা অন্য কোনো প্রাচীনতর সাহিত্য না কি এটা স্রেফে পৃথিবীর সাহিত্যকে বোঝায়? পৃথিবীতে সাহিত্য আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? অবশ্যই এই ক্ষেত্রে বিশ্ব-সাহিত্য সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা তারা তা সৃষ্টি করছে, ব্যবহার করছে এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণও করছে। আমি পৃথিবীর সাহিত্যের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশের কথাই জানি, তাই এ নিয়ে ঢালাও কোনো মন্তব্য করব না। যেমন আমি চৈনিক সাহিত্যবিষয়ে কিছুই জানি না, এবং পৃথিবীতে এমন আরো ভাষা নিশ্চয়ই রয়েছে যাদের কথা আমি জানি না অথচ তাদের নিজেদের সাহিত্য পর্যন্ত রয়েছে। এই হিসেবে বিশ্ব-সাহিত্য ব্যাপারটা হয়তো অতটা জরুরি নয়, উদাহরণস্বরূপ, "টাকা" যেমন জরুরি, কেননা এটা আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করি, এটা আমাদের জীবনেরই অংশ, যে-অর্থে বিশ্ব-সাহিত্য নয়। অবশ্যই আপনি তাক থেকে একটা বই বার করে জিজ্ঞেস করতে পারেন, "আপনি এর সম্পর্কে কী ভাবেন?" কিন্তু বিশ্ব-সাহিত্য যেমনটি মনে হয় তেমন তুলনাসাধ্য কিছু তো নয়। বিশ্ব-সাহিত্যের দায়িত্ব কী? আবারও এটা নির্ভর করে আপনি এই বাক্যাংশটির মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছেন, প্রশ্নটির একটি নৈতিক মাত্রাও রয়েছে। পৃথিবীর সাহিত্যসমূহের একটি ভূমিকা এর পাঠকশ্রেণিকে এগিয়ে দেওয়া, তবে সেটাও নির্ভর করে আপনি কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের কথা বলছেন। কেউ বলতে পারেন একজন লেখকের দায়িত্ব সেই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ধারণাসমূহকে চ্যালেঞ্জ করা। সেই ধারণাগুলো হতে পারে সমাজের শ্রদ্ধার মানদণ্ড বিষয়ে, পরিবারকাঠামো, শুদ্ধতাবোধ কিংবা যৌননৈতিকতা সংক্রান্ত। অন্যদিকে এটিকে কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয়, ধ্বংসাত্মক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলেও ভাবতে পারে। লেখকের দায়িত্ব বিষয়ে বিচার করতে পারেন কেবল পাঠকেরাই। এটা কঠিন। আমরা মূল্যায়ন করার আগে এটিকে বরং লেখকের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

প্রশ্ন : বাই দ্য সী উপন্যাসটা লিখতে আপনার মোট কতটা সময় লেগেছে? আমরা জানি আপনাকে এর মধ্যে অন্য দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে, তবু উপন্যাসের ভাবনাটি মাথায় আসা থেকে একেবারে প্রকাশ করা পর্যন্ত সময়টা কতটা দীর্ঘ ছিল?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : এটা প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে .. আমার ধারণা আমি এটার লেখা ১৯৯৯ সালের শেষদিকে সম্পূর্ণ করি। আমি বলব লেখালেখির কাজটাতে বছরখানেক লাগে, হয়তো কিছুটা বেশি, তারপর প্রকাশক যেদিন বললেন, হ্যাঁ এটা আমরা করতে চাই, এবং আপনি চুক্তি সই ইত্যাদি করেন, সেদিন থেকে বই আকারে এটি দোকানে হাজির হওয়া পর্যন্ত আরও বছরখানেকের মতো লাগে, যদি অবশ্য প্রকাশকেরা কিছু পাল্টাতে কিংবা বইটা পুনর্লিখনের কথা না বলেন। বাই দ্য সী বইটার ক্ষেত্রে এই সময়টা ছিল বছরখানেকের মতো, তবে আমার মতো কারও কারও বেলায় আরও বেশিও লাগতে পারে, যে থাকে ব্রাইটনে কিন্তু কাজ করে ক্যান্টারবারিতে, ফলত যাকে প্রায় প্রতিদিনই এতটা পথ আসা যাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়। আমার মনে হয় মাত্র একটা দিন আমাকে কাজে যেতে হয়নি, আর আমি কাজ ও লেখালেখি একসঙ্গে করতে পারি না, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন, কেননা তখন সেটা করার মতো শক্তিই অবশিষ্ট থাকত না আর। পরে লেখালেখির জন্য বিশেষ সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হতো আমাকে, যদিও খোদ লেখার কাজটাতে খুব বেশি সময় লাগত না, লেখার সব রসদ যদি হাতের কাছে থাকে। আসলে প্রস্তুত হওয়ার জন্য, মনের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে নিতেই সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। একবার যদি সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারেন যখন আপনি নিশ্চিত যে, আপনি লিখতে শুরু করে দিতে পারেন, সেখান থেকে ধরুন, অন্তত আমার ক্ষেত্রে বছরখানেকের কিছুটা বেশি সময় লাগে, আর তারপর আপনি আশা করতে থাকেন যে, প্রকাশক বা সম্পাদক ফিরে এসে আপনাকে বেশিকিছু পাল্টাতে বলবে না, কেননা তাহলে আরও বছরখানেক লেগে যেতে পারে, আপনার অন্যান্য কাজের ফাঁকে সময় বার করার জন্য.. তখন আপনার অন্য কাজের এত ব্যস্ততা থাকতে পারে যে, আপনি হয়তো এক নাগাড়ে কয়েক ঘণ্টার বেশি সময় বারও করতে পারবেন না কাজটার কাছে ফিরে যেতে এবং নতুন করে শুরু করতে আবার। নতুন করে লেখার কাজটাও মূল লেখার মতোই দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া হতে পারে।

প্রশ্ন : আপনার মনের মধ্যে দানা-বাঁধা ভাবনাগুলো নিয়ে আপনি যখন চিন্তা করতে বসেন, তখন সেই সৃজনী প্রক্রিয়ায় স্মৃতির কী ভূমিকা থাকে? আপনার নিজস্ব স্মৃতি, পরিবারের স্মৃতি কিংবা অন্য কোনো ধরনের সম্মিলিত স্মৃতি?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : অবশ্যই স্মৃতির একটা ভূমিকা রয়েছে এতে, তবে এটা ঠিক আমার কিংবা আমার পরিবারের কারও ওপর সংঘটিত ঘটনাবলির কথা মনে করার অর্থে নয়। আমার মনে হয় না আমি এমন কোনো গল্প লিখেছি যেখানে একটি সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে আমার কোনো স্মৃতির ওপর নির্ভর করে, তবে আমার জানা আত্মীয় কিংবা চেনামানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার টুকরোটাকরা উল্লেখ হয়তো থাকতে পারে। শেষ কথা, গল্প কোনো সত্যকে তুলে ধরে না, তবে গল্পের ছোট্ট কোনো ঘটনা হয়তো ঘটে থাকতে পারে আমার জীবনে বা আমি যার কথা শুনেছি, অনেকে যার সঙ্গে আরও ঘটনার সমান্তরাল কিংবা সংযোগ খুঁজে পাবে, তবে সেটাও নির্ভর করে কী ধরনের গল্প আপনি লিখছেন তার ওপর। কোনো পূর্বনির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে যারা লেখেন না তাঁদের চাইতে গোয়েন্দাগল্প কিংবা নাটকীয় উপন্যাসের মতো সুনির্দিষ্ট কাঠামোভিত্তিক গল্পের লেখকদের এই কাজটা হয়তো একটু অন্যভাবে করতে হয়, কেননা সেখানে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনাকে ঘটাতেই হয়। এটা এমন নয় যে, আপনার মনে হলো, "বাহ এটা তো সুন্দর একটা গল্প, আমি এটাকে ব্যবহার করব", বরং আপনি আপনার চিন্তার সঙ্গে একটা যোগসূত্র দেখতে পান যেটা আপনার মনের অন্য কোনো একটা বিষয়কে ব্যাখ্যা কিংবা তার বোধকে বিস্তৃত করে এবং এভাবেই তা এগিয়ে চলে। কিন্তু মুশকিল হলো, আপনি হয়তো আদতে কী ঘটেছিল, বা ঘটেছিল বলে আপনি ভেবেছেন, কিংবা এমনও হতে পারে আপনি ভাবছেন তা ঘটেছে কিন্তু আসলে তা ঘটেইনি এই বোধটাকেই হারিয়ে ফেলবেন– লোকে হয়তো বলছে এটা ঘটেছে, কিন্তু আপনি বলছেন না, কেননা এর স্মৃতিটাকেই যে আপনি পাল্টে ফেলেছেন। এই ব্যাপারটা স্বপ্নের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে: আপনি যদি কিছু একটা কল্পনা করে থাকেন যা একদিন আপনার কাছে সত্য বলে প্রমাণিত হয় এবং কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ না করে, তাহলে ছয় বছর পরে সেটাই সত্য। আপনি আসল ঘটনা ভুলে গেছেন, আর এভাবেই কল্পনা ও স্মৃতি কাজ করে; স্মৃতি খুব জরুরি, এটাই সবকিছুকে বাস্তব করে তোলে, তবে সেটা এমন নয় যে, আপনাকে তা একটা আস্ত গল্প তুলে দিল আর আপনি তা আপনার আখ্যানের ভেতর বসিয়ে দিলেন।

প্রশ্ন : সাহিত্যে এই দক্ষিণ-দক্ষিণ সম্পর্কের বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : সাহিত্যের বর্ণনায় এই দক্ষিণ-দক্ষিণ সম্পর্কের বিষয়টা তেমন নতুন কিছু নয়। ধরুন, কেউ যখন বলেন যে, আমার কাজের আগ্রহের ক্ষেত্র ভারত মহাসাগর, সেটাই তো একটা দক্ষিণ–দক্ষিণ সম্পর্কের বিষয়,ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি পরস্পর-সম্পর্কিত ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারণা, যা নিয়ে গোড়া থেকেই আমি লিখে আসছি আমার গল্প-উপন্যাসে এবং অতিসম্প্রতি আমার কিছুকিছু বিদ্যায়তনিক কাজে। এটা একটা চলমান ঘটনা, বিশেষ করে আমাদের মতো বিশ্বনাগরিকদের কাছে যারা ঠিক পশ্চিম-কেন্দ্রিক নয়; ফলত কিছু লোকের কাছে এটাকে হঠাৎ করে একটা ফলদায়ী শব্দবন্ধ মনে হলেও, এটা কিন্তু অনেকদিনের পুরনো একটি ব্যাপার।

প্রশ্ন : সবশেষে জানতে চাইব, আপনার জীবনে কি এমন কিছু বা এমন কারও অস্তিত্ব আছে যা আপনার লেখার শৈলী, বিশেষ করে আপনার উপন্যাস লেখার আগ্রহের বিষয়ে প্রভাব রেখেছে?

আবদুলরাজাক গুর্নাহ : আমি এভাবে বলব না। এটা এমন নয় যে, আমি কোথাও বলেছি একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে আমি এটা করব, বরং একটা বয়সে পৌঁছানর পরেই হয়তো আমার মনে হয়েছে, আমি এটা করতে চাই, যেমন, খুব কম বয়সে, অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমার ইংলন্ডে আসা এবং এখান থেকে ওখানে ভেসে বেড়ানো। একজন আগন্তুকের জীবন, কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে নিজের পথ খুঁজে ফেরা, নিজের বাড়িঘরকে একপ্রকার পরিত্যাগ করা- এই বিষয়গুলিই বরং আমাকে প্রভাবিত করেছে। আমি ভার্জিনিয়া উল্ফ নই, যিনি দশ বছর বয়সেই জানতেন তিনি লেখক হতে চান। আমি নিজেকে একদিন টুকিটাকি লেখা লিখতে আবিষ্কার করি, লোকেরা যেমন করে থাকে, এবং এইসব ভাবনার প্রকাশে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জমে যায়, একটা সময় আসে যখন আমি ভাবি: এগুলো কী? আমি এসব কী করছি? আর তখনই আপনি একটি জায়গায় পৌঁছান যখন এই টুকিটাকি লেখা আর সত্যিকার লেখালেখির তফাতটা বুঝতে পারেন। আমি কিছু একটা লিখি, তারপর তাকে গোছাতে হয়, ফলে এটা স্রেফ সখের লেখালেখির চেয়ে বেশি কিছু, কেননা এটা আপনাকে শরীরমন দিয়ে করতে হয়। এরপর কোনো একসময় এটাকে উপন্যাসের মতো, বা সেরকম একটা কোনো প্রক্রিয়ার মতো মনে হয়, তখন আপনাকে সেটা আরও ভালো আরও উন্নত করার চেষ্টা করতে হয়, এবং কেউ যদি সেই কাজটার প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন আর তা থেকে বেরুনোর পথ থাকে না, আপনি আরও ভালো হতে চেষ্টা করেন, একজন প্রকাশক খুঁজে বার করার প্রয়াস পান এবং এভাবেই তা চলতে থাকে। অতঃপর একদিন আপনি একজন লেখক হয়ে ওঠেন।

ফ্রাঙ্কফুর্ট
২১ জানুয়ারি ২০১৬