আদিম মানবীর ঋতুচক্র

স্বাগতা দাশগুপ্তস্বাগতা দাশগুপ্ত
Published : 20 May 2022, 05:46 PM
Updated : 20 May 2022, 05:46 PM


আজ অনেকগুলো ঋতুচক্র পেরিয়ে এসে আমার জানতে ইচ্ছে করে, অনেক অনেকদিন আগে পূর্বতন মেয়েরা, আমাদের আদিম মানবীরা কেমন করে কাটাতেন মাসের এই সময়টা? কী ব্যবস্থা ছিল তাঁদের জন্য? স্বাভবিক জীবনযাপন থেকে তাঁরা কি ব্রাত্য হয়ে থাকতেন এই সময়ে? কী কী কুসংস্কারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁদের? কী কী বিধিনিষেধ? যখন আজও আমাদের সমাজে এ নিয়ে রাখঢাক, বিধিনিষেধ আছে। এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ নয়। বিশেষ করে উপমহাদেশের মেয়েদের জীবনের নিরিখে এ-কথা জানা বুঝি আরও কঠিন। সেসময়ের মেয়েরা তো আর এ-বিষয়ে লিখে যাননি। তাও যতটুকু উপাদান হাতে মেলে, আমরা দেখার চেষ্টা করি।

আমরা প্রথমেই যাব রোমান দার্শনিক প্লিনি দ্য এল্ডারের (২৩/২৪-৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) কাছে, যিনি 'ন্যাচারাল হিস্ট্রি' নামে তাঁর সময়ের একটা বিশ্বকোষ লেখেন। তাতে মাসিকের রক্ত বিষয়ে লিখেছিলেন, 'এর সংস্পর্শে টাটকা দ্রাক্ষারস টকে যায়, শস্য নষ্ট হয়, গাছের কলম যায় মরে, বাগানের সব বীজ শুকিয়ে যায়, ঝরে যায় গাছের ফল, স্টিলের ধার চলে যায়, চকচকে হাতির দাঁত হয়ে যায় ম্যাড়ম্যাড়ে, মৌচাক নষ্ট হয়, এমনকী ব্রোঞ্জ আর লোহায় মুহূর্তে লেগে যায় জং, বাতাস ভরে ভয়ানক দুর্গন্ধে; এর স্বাদ চেখে দেখলে কুকুরেরা পাগল হয়ে ওঠে আর সেই কুকুর কামড়ালে দেহে যায় ভয়ংকর বিষ… এমনকী একটা ছোটো পিঁপড়েও এ-সম্পর্কে সজাগ, ভুট্টাদানায় এর স্বাদ পেলেই তা ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর কক্ষনো তা স্পর্শ করে না।' প্লিনির এই মত সে-যুগে কতটা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল তা আমরা বোঝার চেষ্টা করব। এর জন্য আমাদের হাতে আছে মোটের ওপর দু-রকমের উপাদান। প্রথমটা হল, বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আর প্রাচীন কাব্য। ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে আমরা ঋতুমতী মেয়েদের উপর কী কী বিধিনিষেধ ছিল তা জানতে পারি। এই সময়ে মেয়েদের সাথে পুরুষদের কী কী করণীয় তাও আছে। জানা যায় বিভিন্ন যজ্ঞাদিতে রজঃস্বলা মেয়েদের জন্য কী বারণ বা প্রতিকার ছিল। আর প্রাচীন কাব্য থেকে সমাজের অবস্থার কথা আন্দাজ করা যায়। দ্বিতীয় উপাদান, আধুনিক কালে নানা আদিবাসী সমাজের ওপর সমাজবিদদের করা নানান সমীক্ষা। যা থেকে তাঁদের মাসিকবিষয়ক ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, বিশ্বাস ইত্যাদি জানা যায়। যেহেতু জনজাতির মানুষদের মধ্যে অনেক আদিম রীতিনীতি আধুনিক সময়েও বর্তমান, তাই আমরা এইসব সমীক্ষা থেকে আদিম মানুষের ঋতুচক্র বিষয়ে বেশ খানিকটা আন্দাজ করে নিতে পারি। তবে আমার অজ্ঞানতার কারণে এইসব জনজাতির নামের উচ্চারণ বাংলায় লিখলে কখনো কখনো ভুল হয়ে যেতে পারে কিনা, তাই যেমনটা আমি বইপত্র থেকে পেয়েছি, সেইরকম ইংরেজি হরফেই নামগুলো লিখছি।

বিভিন্ন আদিম সমাজ বিভিন্নভাবে ঋতুচক্রের ভয়াবহতার কথা বলে। মাসিকের রক্ত পুরুষদের জন্য নাকি মারাত্মক ক্ষতিকর! তবে ভয়ের সাথে সাথে কোথাও এর প্রতি শ্রদ্ধাও মিশে ছিল। চাঁদের গতি, বিভিন্ন ঋতুর আসা-যাওয়া, জোয়ার-ভাঁটা, সূর্যাস্তের পরের অন্ধকার— ইত্যাদির সাথে মাসিককে যুক্ত করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এর বেশিরভাগটাই পুরুষদের বানানো। নিউজিল্যান্ডের Maori জনজাতির মানুষরা ভাবেন মাসিকের রক্তে যে ভয়ংকর 'কাহুকাহু' থাকে তা আসলে মানুষের শরীরের জীবাণুরই ব্যক্তিরূপ, এবং তা পুরুষের সর্বাধিক ক্ষতি করতে পারে। পাপুয়া নিউ গিনির Mae Enga জনজাতির বিশ্বাসও কাছাকাছি— রজঃস্বলা মহিলা বা মাসিকের রক্তের সংস্পর্শে পুরুষেরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, ভয়ানক বমি হতে থাকে, রক্ত কালো হয়ে যায়, শরীরের রস শুকিয়ে চামড়া কালো হয়ে ঝুলে পড়ে কারণ মাংস পচে যায়, বুদ্ধি নষ্ট হয়, ধীরে ধীরে মৃত্যু আসে। কানাডিয়ান টেরিটোরি ইউকোনের Tinne Indian আদিবাসীদের ভাবনায় মাসিকের রক্ত নারীত্বের নির্যাসে ভরা, এসময়ে মেয়েদের পুরুষের কাছাকাছি যেতে নেই, বিশেষত যুবকদের কাছে, কারণ এর ফলে ওঁরা পুরুষত্ব হারাতে পারেন। তবে অন্যদিকে এই রক্তের কতগুলো উপকারী দিকও আছে। যেমন কুষ্ঠ, গয়টার, মৃগি ইত্যাদি রোগ সারানো, প্রেমে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করা, অশুভ আত্মাদের দূরে সরানো ইত্যাদি। এমনকি কখনো কখনো দেবতার উদ্দেশেও নিবেদিত হয় এই রক্ত। কুমারী মেয়ের মাসিকে ব্যবহৃত প্রথম কাপড়টি নাকি প্লেগ সারাতে পারত। এইসব বিশ্বাস সত্তেও মোটের ওপরে প্লিনির মতের দিকেই কিন্তু পাল্লা ভারী ছিল।

মাসিকের সময়ে কি মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হত? অনেক আদিম সমাজেই মাসের চার-পাঁচদিন তা করা হত। নানা জনজাতির মধ্যে এর নিদর্শন মেলে। গাছ লাগানো, চাষের কাজ, রান্নাবান্না, পুরুষের সংসর্গ এড়িয়ে তাঁরা গিয়ে থাকতেন গ্রাম থেকে দূরে গাছের পাতা আর বাকল দিয়ে তৈরি 'মাসিক-কুটিরে' (menstrual hut)। নিউ গিনির আরাপেশ পাহাড়ে নাকি এমন কুটীরের সন্ধান মেলে। সমাজ থেকে এইসময়ে দূরে থাকলে বুঝি কারোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না! এস্কিমোরা বিশ্বাস করেন ঋতুমতী মেয়েরা শিকারের জন্য অশুভ। তাঁদের মাসিকজনিত দূষণ থেকে এক ধরনের বাস্প তৈরি হয় যার সংস্পর্শে শিকারিরা এলে শিকার তাঁদের দেখতে পায়, ফলত ধরা দেয় না। পশ্চিম সুদানের Habbe জনজাতির মানুষদের মধ্যে যে-স্বামীর স্ত্রী ঋতুমতী সেই স্বামী শিকারে যান না, এটাই প্রচলন। দক্ষিণ ভারতের Bukka মেয়েদের এসময়ে সমুদ্রে যেতে মানা, কারণ তাঁরা মাছ ধরায় ক্ষতি করতে পারেন। ঋতুমতী মেয়েদের শুঁটকি মাছ বা শুকনো মাংস খেতে দিতেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার Sekani Indian জনজাতি, কারণ তাঁরা টাটকা খেলে তা শিকারির জন্য অশুভ হতে পারে। মালেশিয়ার ইফালুক দ্বীপবাসীরা স্বাধীন কামজীবন যাপন করেন। তা সত্তেও মাছ ধরার মরসুমে পুরুষেরা থাকেন মেয়েদের থেকে দূরে, নৌকোয়। শিকারের সঙ্গে সঙ্গে চাষবাসেও রজঃস্বলা মেয়েদের কুপ্রভাব পড়ার আশংকা দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার Arunta জনজাতির মেয়েরা মাসিকের সময়ে তাঁদের প্রধান খাবার, ইরিয়াকুরা কন্দ সংগ্রহ করতে পারেন না, কারণ তাতে সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরে ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত মালেকুলা দ্বীপে ঋতুমতী মেয়ে শুধু নন, তাঁর সঙ্গী পুরুষটিও বাগানে ঢুকতে পারবেন না, যে-বাগানে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। আবার ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল সুলাওয়েসির Toradja মহিলার স্কার্টে রক্ত লেগে থাকলে তিনি তামাকের ক্ষেতে ঢুকতে পারবেন না, যদিও সেই রক্তমাখা স্কার্টই ধানক্ষেত থেকে শুয়োর তাড়াতে কাজে লাগে।

ঋতুচক্র চলাকালীন সংগমে লিপ্ত হওয়া নিয়েও অনেক বিধিনিষেধ। সেসব লঙ্ঘন করলে প্রজননের দেবতা শাস্তি দেবেন বলে মনে করা হত কোনো কোনো আদিম সমাজে। প্রাচীন পার্সিয়াতে এই বিধি মেনে চলা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে এর অবমাননায় শেষ বিচারের দিন অবধি নরকে জ্বলেপুড়ে যাওয়ার শাস্তির কথা উল্লেখ করা হত। কোরাণেও ঋতুমতী মেয়েদের সাথে সংগমে বারণ আছে। ২ নম্বর সূরার ২২২ সংখ্যক আয়াত অনুসারে, 'এবং তাহারা ঋতু সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করিতেছে, বল (হে মহম্মদ,) উহা অশুচি, অতএব ঋতুকালে স্ত্রীলোকদিগকে তোমরা পৃথক করিবে, এবং যে পর্যন্ত তাহারা শুচি না হয় তাহাদের নিকটবর্তী হইও না, তাহারা শুদ্ধ হইলে পর (স্নান করিলে) তোমাদিগের প্রতি ঈশ্বর যে আদেশ করিয়াছেন, সেই ভূমি দিয়া তাহাদের নিকটে যাইও, সত্যই ঈশ্বর প্রত্যাবর্তনকারী ও শুদ্ধাচারীদিগকে প্রেম করেন।' এই প্রসঙ্গে আমি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনুদিত 'কুরআন শারীফ', যা সম্ভবত বাংলায় কোরানের প্রথম অনুবাদ, বই থেকে উক্ত আয়াতের পাদটীকাও তুলে দিলাম। 'ইহুদিগণ স্ব-স্ব স্ত্রীর ঋতুকালে দূরে থাকে, তাহাদের মুখের প্রতি দৃষ্টি করে না, তাহাদের সঙ্গে কথোপকথন ও একত্র ভোজন অবৈধ বলিয়া জানে। ঈসায়ী পুরুষেরা ইহার বিপরীত আচরণ করে, তাহারা ঋতুমতী স্ত্রীলোকের সঙ্গে কথোপকথন ও একত্র ভোজন এবং একত্র শয়ন ও ক্রিয়াদি করিয়া থাকে। ওহদার পুত্র সাবেত স্বীয় ভার্যা ঋতুমতী হইলে কিরূপ আচরণ করিতে হইবে এ বিষয়ে হজরতকে প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তাহাতেই ঈশ্বরের এই বাণী অবতীর্ণ হয়।' জুডেও-ক্রিশ্চান গ্রন্থে ঋতুমতী মহিলার জন্য নিয়মরীতির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় লেভিটিকাস ১৫:১৯এ, রজঃস্বলা মেয়েরা সাতদিন আলাদা থাকবেন। যদি কেউ তাঁদের এসময়ে স্পর্শ করেন, তিনিও এই ক-দিনের জন্য অশুচি হয়ে যাবেন। লেভিটিকাস ২০:১৮এ শাস্তি আরও কঠোর ছিল। দুজন দোষীকেই সমাজে একঘর করে দেওয়া হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার একটা জনজাতির মানুষরা বিশ্বাস করেন যে রজঃস্বলা মেয়ের সাথে কামে লিপ্ত হলে পুরুষের হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ১৯৬১ সালে উইলিয়ম স্টিফেন্স বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে একটা স্টাডি করে দেখেন যে ৪০টা সমাজে এমন ধারণা আছে যে মাসিক চলাকালীন সংগম পুরুষটির জন্য ক্ষতিকর। তা এই সংগম কি শুধু পুরুষদের জন্যই ক্ষতিকর? না কি মেয়েদের জন্যেও কোনো ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল? খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতকে গ্রীক চিকিৎসাবিদ সোরানাস লেখেন যে এই সময়ে সংগম এড়িয়ে চলাই উচিত কেননা এমনিতেই জরায়ুর ওপর চাপ বেশি। একই সঙ্গে ক্ষরণ আর গ্রহণ— এই দুইই চলা মুশকিল। তবে আদিবাসীদের মধ্যে ঋতুকালীন সংগমে মেয়েদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনার ভয় খুব কম। রাশিয়ান ফেডারেশনের Reindeer Chukchi জনজাতির মধ্যে এই বিশ্বাস আছে যে এই ধরণের সংগমে মেয়েরা আরও জীবাণুমুক্ত হন। একটা খুব ব্যতিক্রমী উদাহরণের কথা উল্লেখ করব। আফ্রিকার দক্ষিণে Kgatia জনজাতির মধ্যে এই বিশ্বাসের সন্ধান মেলে যে এক রজঃস্বলা মেয়ে এক গরম রক্তের পুরুষের সাথে (যাঁর রক্ত ঠান্ডা হয়নি বা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আসেনি) মিলনের ফলে মেয়েটির মাসিক নাকি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ পুরুষের রক্ত মেয়েটির অসুস্থতার কারণ হল। তবে এই বিশ্বাস সত্যিই বিরল।

আরেকটা উদ্বেগ হল ঋতুকালীন সংগম হলে ভাবী সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। রোমান দেবতা ভালকানের অস্বাভাবিকতার কারণ হিসেবে জুনো আর জুপিটরের মাসিককালীন মিলনকেই দায়ী করা হয়। ফ্রান্সে দীর্ঘকাল এই বিশ্বাস ছিল যে এই সময়ে মিলনের ফলে জন্মানো বাচ্চা দুর্বল, আকারে ছোটো, রুগ্ন, মৃত্যুশীল আর ভয়ানক দুর্গন্ধযুক্ত হয়। দুর্গন্ধের কারণ যেসময়ে তাঁকে ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যেই নিহিত আছে। কুষ্ঠ, সিফিলিস, আলসার ইত্যাদি রোগেরও শিকার হতে পারেন সেই নবজাতক।

মাসিকের সময়ে মেয়েদের কামভাব জাগে না— এমন বিশ্বাসেরও নজির মেলে বই কী! বলাই বাহুল্য, এমনকী আধুনিক সমাজেও। তবে আফ্রিকায় তানজানিয়ার Ngulu জনজাতির রজঃস্বলা মেয়েদের মধ্যে আরও বেশি কামভাব জাগ্রত হওয়ার কথা নথিভুক্ত আছে। জনৈক নৃতত্ত্ববিদ লিখেছেন এসময়ে তাঁদের প্রজননক্ষমতা আর আসক্তি তুঙ্গে থাকে বলেই Ngulu মেয়েদের থেকে পুরুষদের দূরে থাকা উচিত। ইহুদি ধর্মযাজক আন্টারম্যান জানিয়েছেন যে এক ইহুদি মহিলাকে রোমানরা তুলে নিয়ে বিক্রি করে দিলে তিনি ঋতুচক্রের দোহাই দিয়েই লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই পান। আফ্রিকার দক্ষিণে Tswana জনজাতির মধ্যে মাসিকের সময়ে মিলন সম্ভব নয় এই বিশ্বাস এমনই বদ্ধমূল যে অনেক মেয়েরাই তাঁদের অপছন্দের পুরুষকে মাসিকের দোহাই দিয়ে অন্তত কিছুকাল ঠেকিয়ে রাখতে সফল হন। ক্যারোলিন দ্বীপের Trakese আর নিউজিল্যান্ডের Maori জনজাতির মধ্যে এই সময়ে সংগম করা নিয়ে কোনো বাছবিচার নেই। এমনকী পাপুয়া নিউ গিনির মানুস দ্বীপের বাসিন্দারা মাসিক চলাকালীন মিলনকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। পূর্ব আফ্রিকার A-kamba দম্পতিরা এই সময়েই মিলিত হন যাতে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাঁদের জন্মহার কম বলেই বুঝি এই প্রচলন।

এবার আমরা উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ আর কাব্য থেকে ঋতুমতী মেয়েদের বিষয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করি। বৈদিক যুগে ধারণা ছিল যে রজঃস্বলা মেয়েরা দূষিত, তাই তাঁদের নানা আচার-অনুষ্ঠান থেকে আংশিক বা পুরোপুরি বাদ দেওয়া হত। যা এমনকী আজকের দিনেও সত্যি। ডাচ ইন্দোলজিস্ট জে. গোণ্ডার 'Vedic Rituals: the nonsolemn rites' এই গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় ঋতুমতী মেয়েরা যেন বেদপাঠ করা হচ্ছে এটা না দেখেন, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে না তাকান। মনুস্মৃতিতে আছে— তাঁরা ব্রাহ্মণদের খাওয়াও দেখবেন না। রজঃস্বলা স্ত্রীর সাথে স্বামী মিলিত তো হবেনই না উপরন্তু এক বিছানায় শোওয়াও মানা, মিলিত হলে সেই পুরুষের নির্দিষ্ট শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। ব্রাহ্মণরা তাঁদের সাথে কথা বলবেন না। তাঁদের হাতের ছোওয়া খাবার খাবেন না। এসময়ে কেউ তাঁদের স্পর্শ করলে তাঁকে শুদ্ধ হতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি মহাভারতে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আমরা সবাই জানি, রাজসভায় তাঁর বস্ত্রহরণের সময়ে দ্রৌপদী রজঃস্বলা, তাই একবস্ত্রা ছিলেন। আমাদের বিভিন্ন শ্রৌতসূত্র আর ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে আয়োজক পুরুষটির সাথে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

স্বভাবতই এই আয়োজনের যোগ্যতা বিবাহিত (গার্হস্থে উত্তীর্ণ) পুরুষদেরই থাকত। কিন্ত মাসিকের রক্ত দূষিত হওয়ার কারণে রজঃস্বলা স্ত্রী, সাথে সন্তানসম্ভবাদেরও এইসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ ছিল। বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রমতে, যেহেতু এই সময়ে তাঁর গায়ে ব্রাহ্মণ-হত্যার রং আছে, ঋতুমতী স্ত্রী যজ্ঞে নিবেদিত দ্রব্য ছোঁবেন না, দেখবেনও না। অন্যদিকে তাঁর এই অংশগ্রহণ করতে না পারায় কি কোনো ক্ষতি হল? তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে যে শপথ নেওয়ার দিনে স্ত্রী যদি 'অস্পৃশ্য' হন তাহলে আদ্ধেক অনুষ্ঠানই বিফলে গেল। তাহলে উপায় কী? উপায় হল স্ত্রীকে ছাড়াই পুরুষটি উপাসনা সম্পূর্ণ করবেন। কিন্তু আদ্ধেক অনুষ্ঠান বিফলেও গেল, আবার সম্পূর্ণও করবেন এ কেমন কথা! পরের দিকে শ্রৌতসূত্র এ-ব্যাপারে আরও উন্নত সমাধান দেয়। রজঃস্বলা স্ত্রীর তাগা (যা অনুষ্ঠানের সূচনায় তাঁকে পরানো হয়েছিল) বেদির পশ্চিমে (বা পেছনে) বিছিয়ে রাখতে হবে, সুতোর প্রান্ত উত্তরমুখে রেখে— অপাস্তম্ভা শ্রৌতসূত্র অনুযায়ী। কাত্তায়ন শ্রৌতসূত্র বলছে, এসময়ে স্ত্রী বেদির কাছাকাছি বালির ওপর বসে থাকবেন, তিনদিন পর জল আর গোমূত্র দিয়ে স্নান করে আবার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন। বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র পরে আরও জটিল সমাধান দেয়। অনুষ্ঠান বা তার আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোয় রজঃস্বলা স্ত্রী বসবেন যজ্ঞের বাসন মাজার জায়গায় বালি বিছিয়ে, যে-স্থান আদ্ধেক বেদির মধ্যে, আদ্ধেক বাইরে, ফলে স্ত্রী অনুষ্ঠানে রইলেন আবার রইলেন না। অন্যান্য দিন তিনি পত্নীশালায় থাকবেন। তিনদিন পর সেই একইরকমভাবে জল আর গোমূত্র দিয়ে শুদ্ধ হয়ে যোগ দেবেন অনুষ্ঠানে।

মেয়েদের প্রথম মাসিক হয়ে গেলে গ্রন্থভেদে তিন মাস থেকে তিন বছরের মধ্যে তাঁদের বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আছে। বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রে, প্রথম মাসিক হওয়ার তিন বছরের মধ্যে বাবা মেয়ের বিয়ে না দিলে তিনি ভ্রূণহত্যার অপরাধে অপরাধী। মনু বলছেন, এই সময় পেরিয়ে গেলে প্রতিবার মেয়ের মাসিক হলে বাবা নরকে যাওয়ার শাস্তি পাচ্ছেন। আমাদের মহাকাব্যেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। মহাভারতে কন্যা দময়ন্তী প্রাপ্তযৌবনা হলেই ভীম তাঁর জন্য পাত্র খুঁজতে তৎপর হন। কুন্তী লজ্জিত তাঁর মাসিক হওয়ার পরেও তিনি কুমারী আছেন বলে। শর্মিষ্ঠাও চিন্তিত মাসিক হয়ে গেলেও তাঁর জন্য পাত্র নির্বাচন করা হয়নি বলে। যযাতি গালবকে অনুমতি দিচ্ছেন তাঁর কন্যাকে নিয়ে বিভিন্ন রাজাদের কাছে যাওয়ার জন্য। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাত্র না পাওয়া গেলে মহাকাব্যে যে-সমাধান উল্লেখযোগ্য তা হল স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা। কাজেই স্বয়ম্বর কিন্তু খুব গৌরবময় নয়। বৌধায়ন ধর্মশাস্ত্রে বলা হচ্ছে প্রথম মাসিক হওয়ার পরে তিন বছর কন্যা বাবার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবেন। সেই সময়ে বিবাহ না হলে চতুর্থ বছরে তিনি নিজেই স্বামী খুঁজে নিতে পারেন। মনুস্মৃতিও একই কথা বলছে। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে মেয়েদের নিজে পাত্র খুঁজে নেওয়ায় কোনো অপরাধ নেই। তবে এক্ষেত্রে পিতৃগৃহ থেকে বিবাহের গয়না ইত্যাদি উপহার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মাসিক হয়ে যাওয়া মানেই যে মেয়েটি প্রজননক্ষম এ-বিষয়ে প্রাচীন উপমহাদেশ রীতিমতো সজাগ ছিল। প্রথম মাসিক হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়েটি কুমারী থাকলে তাঁর প্রতিটা মাসিককেই একটি পুরুষ-সন্তান জন্ম দিতে না পারার কারণে অপচয় হিসেবে দেখা হত।

মহাকবি কালিদাসের কাব্যেও আমরা রজঃস্রোতের অমঙ্গলজনক অনুষঙ্গ পাই। 'কুমার সম্ভবম্' কাব্যে চতুর্দশ সর্গে শিব-পার্বতীর পুত্র কার্তিক তারকাসুর বধের উদ্দেশে চলেছেন। ৪৭ নম্বর সর্গ বাংলা অনুবাদে এইরকম— 'সৈন্যগণের কলকল শব্দ দ্বারা দিঙ্মুখ ভয়ঙ্কর ও মুখরিত হইয়া উঠিল; অম্বরপথ রজঃপুরিত হইল; চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত গাঢ় ধূল্যন্ধকার দিক্সকলকে ঐরূপ দেখিয়া দিনমণিকে অন্তর্হিত করিয়া ফেলিল। (ঋতুমতী নারীর বসন রজঃপূরিত থাকে, তাহাকে দর্শন করা শাস্ত্রনিষিদ্ধ, তাহাকে দর্শনমাত্র প্রস্থান করিতে হয়, সেইরূপ সূর্য্যদেবও দিগঙ্গনাদিগকে রজঃপূরিত অর্থাৎ ধূল্যবলুন্ঠিত দেখিয়া তিরোহিত হইলেন)'। 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্' নাটকেও রজস্রোতের অপবিত্রতার উল্লেখ আছে। ইন্দ্রের সারথি মাতলি রাজা দুষ্মন্তকে একটা পথ বিষয়ে বর্ণনা করছেন। 'যে বায়ু গগনমার্গে সংস্থিত থাকিয়া মন্দাকিনীকে ধারণ করিয়া আছে, যাহা চক্রাকৃতি আবর্ত্তন দ্বারা জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর অশ্বগণের মুখরশ্মির ন্যায় ধারণ করিয়া রহিয়াছে এবং যাহাতে কোনরূপ রজোমিশ্রণের সম্ভব নাই, সেই প্রবাহ-বায়ুর এই পথ। বামনদেব দ্বিতীয় চরণ দ্বারা এই পথ আক্রমণ করিয়াছিলেন বলিয়া ইহা পবিত্র হইয়াছে।' অর্থাৎ রজমিশ্রিত হলে এই পথ অপবিত্র হত। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত ভাষার 'গাথা সপ্তসতী' কাব্যের (প্রথম-সপ্তম শতাব্দী) একাধিক ছত্রে কিন্তু রজঃস্বলা মেয়ের সাথে মিলনের আভাস আছে। এখানে মেয়েরা মাসিকের সময়ে হলুদমিশ্রিত ঘিয়ের টিপ পরতেন। পুরুষদের একাধিক স্ত্রী থাকতেন। এই কাব্যের একটা ছত্র ইংরেজি অনুবাদে উল্লেখ করছি। 'Having found the top of their husband's arms besmeared with the ghee coloured with turmeric attached to the head of the woman in her menstrual course, the group of her co-wives wept with thick tears.'

এতক্ষণে আমরা খানিকটা ধারণা করতে পারলাম অনেক অনেকদিন আগে মেয়েদের মাসিকের সময়টা মোটের ওপর কেমন কাটত। আমাদের এই উপমহাদেশের পাঁচ হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু মেয়েদের ঋতুচক্র নিয়ে কাজ তেমন হয়নি। সমাজেও এই বিষয়টাকে এখনও বেশ খানিকটা ব্রাত্য করেই রাখা হয়েছে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে উপমহাদেশের ঋতুচক্রের ইতিহাস লেখা হোক, এই দাবী রাখছি। আর পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি এটাও মহা দরকারি বই কী! নইলে আমাদের পূর্বতন মেয়েদের জীবনের কথা আমরা জানব কী করে?