রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে আমলাদের প্রভাব

আবদুস সেলিমআবদুস সেলিম
Published : 14 April 2022, 02:54 PM
Updated : 14 April 2022, 02:54 PM


পৃথিবীতে যত ধরনের বড়বড় পুরস্কার দেয়া হয়, বিশেষ করে শিল্পসাহিত্যে, তা কখনই নির্বিবাদে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তা সে নোবেল, অস্কার, পুলিৎজার, কিংবা বুকারই হোক। পুরস্কার এবং বিতর্ক জ্ঞাতিভাই। তবুও পুরস্কার দেয়া হয়, পুরস্কার দেয়া নিয়ে বিতর্কও হয় এবং সময়ে তা সয়ে যায়; পরবর্তীকালে আবার পুস্কার এবং আবার বিতর্ক।

মানতেই হবে যারা শিল্পসাহিত্যে নিবেদিত তাঁরা যতই পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে উদাসীনতা প্রকাশ করুন না কেন, তাঁদের সুপ্ত ইচ্ছা পূরণের একটি মাধ্যম অবশ্যই তাঁর শিল্পকৃতির স্বীকৃতিসহ কোন না কোন ভাবে পুরস্কারপ্রাপ্তি। এই কথাটি সরলভাবে স্বীকার করেছেন চিলির অতিপরিচিত সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা তাঁর মেময়ার্স বা অত্মজীবনীতে যখন তিনি ১৯৭১-এ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, যদিও তিনি বিশ্বাসে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক। অবশ্য সবাই জ্যঁ পল সার্ত্র নন যিনি একমাত্র সাহিত্যিক ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গভীর প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থানের জন্য। সে যাই হোক, পুরস্কারপ্রাপ্তি শিল্পসাহিত্যিকদের জীবনে একটি স্মৃতিময় রঙিন ঘটনা নিঃসন্দেহে, কিন্তু সব পুরস্কারই ওই প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াতেই প্রদান করা হয় এবং ফলে পুরষ্কারের পরিচ্ছন্নতাকে সম্পূর্ণভাবে বিতর্ক বিবর্জিত করা সম্ভব হয় না–বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে।

কিন্তু একটা বিষয় অবশ্যই বিবেচ্য। ঐসব পুরস্কার যাদের দেয়া হয়–তা সে যাকেই দেয়া হোক না কেন–তাঁরা কিন্তু নিজনিজ ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মকাণ্ডের জন্য বিদগ্ধজনদের কাছে–অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বজুড়ে–সুপরিচিতই। বিতর্কটা কিন্তু তাঁদের পরিচিতি নিয়ে নয়, বিতর্কটা মূলত তাঁদের যোগ্যতার মাপকাঠি নিয়ে। আর শিল্পসাহিত্যের অবদানে আপেক্ষিকতা, ভাললাগা না লাগার পক্ষপাত তো বিতর্ক সৃষ্টি করতেই পারে।


সম্প্রতি দু-এক বছর ধরে বাংলাদেশে বিষয়টি অধিকতর অপরিচ্ছন্নতার মালিন্যে আক্রান্ত বলে ধারণা হয় যার কারণে এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটির প্রতি অধিকাংশ শিল্পসাহিত্য-সম্পৃক্ত বিদগ্ধ মানুষের আস্থায় টান পড়েছে। ঢালাওভাবে বিচার না করে নির্দিষ্ট করে দুটি ঘটনা বেশ সমালোচনার অঙ্গুলি তুলে ধরেছে যা সবারই জানা: ২০২০ স্বাধীনতা পুরস্কার দেবার ঘোষণা হয়েছিল এক অজ্ঞাতকুলশীল সাহিত্যিক এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মেদ, এবং ২০২১-এ তাঁর চাইতে আরও অধিক অজ্ঞাতকুলশীল সাহিত্যিক আমীর হামজা-র পক্ষে, যাদের নাম পরবর্তীকালে বিতর্ক ও প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাহার করা হয়েছে। রহস্যজনক হলো দ্বিতীয় জনের বিরুদ্ধে খুনের দায়ে কারাদণ্ডের আদেশ ছিল যা গোপন করা হয়েছিল। অবশ্য তাতে দোষ নেই কোন, কারণ কথিত আছে বাল্মীকিও দস্যু থেকে বিশ্বনন্দিত কবি হতে পেরেছিলেন। কিন্তু যে ব্যক্তিদ্বয়ের নাম বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে আগে কখনও উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি, যাদের সাহিত্যকর্মের সাথে কোন ওয়াকিবহাল সাহিত্যপাঠক বা প্রেমীদের কোন পরিচয়ই হয়নি তাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার শুধুমাত্র আমলাদের সুপারিশে কীভাবে পুরস্কৃত হন এবং সমভাবে তিরস্কৃতও হন, তার গোড়াতে যেতে হলে ঐ পুরস্কার প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার সাথে অন্যান্য দেশের প্রক্রিয়ার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করা আশু প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তবে তার আগে জানতে ইচ্ছে করে যে আমলারা জনপ্রশাসনের দায়িত্বে আছেন এবং যারা এই পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়ার কর্ণধার তাঁরা দেশের সুখ্যাত শিল্পসাহিত্যিকদের নামের সাথে পরিচিত নন কেন এবং একজন দণ্ডিত মানুষের নামই বা কীভাবে তাঁদের দৃষ্টির অগোচরে চূড়ান্ত হয়? পুরস্কার ঘোষণার পর অবশ্য তাঁদের একগুচ্ছ শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সম্ভবত কিছু আমলাজ্ঞাতিত্বে উদ্বুদ্ধ সুধীরা বলতে চেয়েছিলেন সমাজের অবহেলিত এবং তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত অথচ স্বশিক্ষিতরা কি পুরস্কারের যোগ্য নন? বিচারটা কিন্তু তা নয়, বিচারটা হলো যাকে পুরস্কৃত করতে চাই আমরা, তিনি কতটা ঐ পুরস্কারের যোগ্য।
আমি অনেক তথ্য ঘেঁটে জানতে পেরেছি যে এমন পুরস্কারের প্রচলন সারা বিশ্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে কমবেশি প্রচলিত। যেমন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে রয়েছে পদ্ম পুরস্কার বা পদ্ম এওয়ার্ড। এই পুরস্কার প্রক্রিয়াটির সাথে আমাদের প্রক্রিয়ার অনেক মিল আছে আবার সেই সাথে অমিলও অনেক। এই পুরস্কারের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রস্তাব আহ্বান করা হয় যার ভেতর রাজ্যপাল, সরকারি আমলা, কর্মকর্তা এবং পূর্বে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গরা আছেন। আমাদের সাথে এই ব্যাপারে তাঁদের অনেকটাই মিল। কিন্তু এর পরে যে কাজটা হয় সেখানেই অমিল। সম্ভাব্য পুরস্কারের যোগ্য ব্যক্তিদের এই নামগুলো পদ্ম এওয়ার্ড কমিটিতে পাঠানো হয়, যে কমিটির প্রধান পদাধিকার বলে মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং সদস্যরূপে (পদাধিকার বলে) স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সচিব। এই কমিটির অন্যতম অপরাপর সদস্যরা হলেন চার থেকে ছয় জন বিশিষ্ট নাগরিক যাদের তালিকা প্রয়োজনমত পরিবর্তমান। আমার জানা নেই আমাদের কোন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার কমিটির গঠন এমন কি না। সম্ভবত নয়, কারণ তাহলে অমন অজ্ঞাতকুলশীল সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করা তো দূরের কথা পুরস্কারের খসড়াতেও তাঁদের স্থান হতো না।


আমি আরও দুটো দেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদান প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করেছি: যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আসলে একটি ভোক্তা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, ফলে তাদের সকল প্রক্রিয়াই ঐ ভোক্তা বিশ্বাসে প্রতিস্থাপিত। সেখানে সরকার অনুমোদিত একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান আছে যে প্রতিষ্ঠান সারা বছর ধরে সারা দেশ থেকে পুরস্কৃত হবার মতো সম্ভাব্য নাম সংগ্রহ করে (অবশ্য অন্যান্য সামরিক ও জনপ্রশাসন পুরষ্কারের বিষয়টি ভিন্নতর) এবং সরকারের কাছে প্রস্তাব আকারে পাঠায়। এরপর রাষ্ট্রপতি তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শে একটি কমিটি গঠন করেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, এবং এই সিদ্ধান্তে সিনেট কমিটির উভয় দলের প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক। তবে রাষ্ট্রপতির মতামতের গুরুত্ব সবসময়ই বিবেচনাতে থাকে। যুক্তরাজ্যের বিষয়টি অনেক গণতান্ত্রিক। প্রতি বছর একটি দশ সদস্যের কমিটি প্রস্তুত করা হয় পার্লামেন্টে এবং এই সদস্যদের অধিকাংশ সদস্যই নির্বাচিত হন দেশের শিল্পসাহিত্যের এবং অপরাপর বিষয়ে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভেতর থেকে। তাঁরা যে নির্বাচন করেন সেটাই চূড়ান্ত।

আমরা এতোটা গণতান্ত্রিক হতে পারব কি না সন্দেহ, কিন্তু ভারতে যে নিয়ম চালু আছে সেটার অনেকটাই অতি সহজেই সংশোধন করে আমাদের মতো করে গ্রহণ করতে পারি, আর সেটা হলো কমিটির স্থায়ী প্রধান পদাধিকার বলে মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং সদস্যরূপে (পদাধিকার বলে) স্বরাষ্ট্রসচিব (অথবা অন্য কোন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব) এবং রাষ্ট্রপ্রধান/প্রধানমন্ত্রীর সচিব থাকবেন কিন্তু অন্য সদস্যরা হবেন পরিবর্তমান ভাবে আমাদের সুশীল সমাজের সদস্যরা যাদের পুরস্কার প্রাপ্তব্য বিষয়াদির উপর স্বীকৃত অবদান আছে এবং সেইসাথে নিশ্চিত করতে হবে সর্বদা এই কমিটিতে তাঁদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে।

এই প্রক্রিয়া যে সকল বিতর্কের অবসান ঘটাবে তাতে নিঃসন্দেহ হবার কোন অবকাশ নেই, কিন্তু অকস্মাৎ অজ্ঞাত কোন ব্যক্তি, যার আদৌ কোন পরিচিতি বা গুণগত অবদান নেই পুরস্কারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাঁকে ভুল করে পুরস্কৃত করার প্রবণতাটা অন্তত রোধ করা যাবে। পুরস্কারের পরিচ্ছন্নতার সূচনা দ্রুতই কাম্য।