‘সে-সত্য জানার আগে মিলনের মুহূর্ত ফুরাল’! (প্রথম পর্ব)

আবেদীন কাদেরআবেদীন কাদের
Published : 7 July 2021, 08:21 AM
Updated : 7 July 2021, 08:21 AM


১.
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই একটি ভূতলবাসী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়ি। কিন্তু বিষয়টি বাড়িতে এবং বন্ধু বান্ধবদের থেকে সম্পূর্ণ গোপন রাখতে সক্ষম হই। আমাকে যে সামান্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাই করতাম। কিন্তু এর ফলে আমার লেখাপড়ার মানে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার খুব ক্ষতি হয়। যদিও আমি প্রায় দিন রাতের সারাক্ষণই আড্ডা দেই আর বইপত্র পড়ি, তবে সেসব বইপত্র আমার নিজের পছন্দের। এসবের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার কোন সম্পর্ক ছিল না। আর দিচ্ছিলাম খুব আড্ডা সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে, তারাও অনেকে রাজনীতির এবং শিল্পের ঘোরে ছিলেন। কিন্তু বাবা মায়ের স্বপ্নকে যে গুড়িয়ে দিচ্ছি, সেটা আমাকে ভীষণ পীড়া দিত মনে। সারাক্ষণ মায়ের মুখখানা মনে পড়তো। বাবা হয়তো কষ্ট পেতেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, কোনদিন ক্লাসে যাই না, এর সঙ্গে কোন সম্পর্কই প্রায় রাখি না। মা শুধু বাড়ি যেতে খবর পাঠাতেন, ভয়ে যাইনি। বাবা কোনদিন কিছু বলেননি, অনুযোগও করেননি। এতে আমার মনটা আরও বেশি খারাপ হত। একটা সময়ে আমার ভেতরের দুশ্চিন্তার কারণে প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। রাতে ঘুমুতে কষ্ট হত, ঘুমালে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। মা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন, কিন্তু কিছু বলেননি। দুয়েকবার ঢাকা এসে বলেছিলেন যেন বাড়ি গিয়ে তাঁর কাছে কিছুদিন থাকি। পরে না হয় ইচ্ছে হলে পড়াশুনা করা যাবে, না করলে ক্ষতি নেই। বাড়িতে তাঁর কাছে থাকলেই তিনি খুশি। বিষয়টা নিয়ে এক সময় একাকী খুব ভাবতে থাকলাম। এই দেখতে দেখতে অনার্স পরীক্ষা চলে এলো। আমার পেছনের প্রায় দুই বছরের টিউটোরিয়াল দেয়া হয়নি, কোন পরীক্ষা না। একেবারে অথৈ জলে পড়লাম। দিনকয় বইপত্র কিছু গুছিয়ে বসে ভাবলাম পরীক্ষায় বসবো কিনা। এদিকে ফর্ম পূরণ করার অনুমতি লাগবে, কারণ আমি তেমন কোন ক্লাস করিনি, সাবসিডিয়ারিও দিতে হবে। সব মিলিয়ে আমি একেবারে মহা বিপদে। সিদ্ধান্ত নিলাম ফেল করলেও বসবো পরীক্ষায়। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কিছুদিন আগে বিভাগ থেকে উপাচার্য হয়েছেন। তাঁর শরণাপন্ন হয়ে অনুমতি সংগ্রহ করলাম পরীক্ষায় বসতে। চোখ কান বন্ধ করে ঘরের দরোজা কয়েক সপ্তাহ বন্ধ করে পরীক্ষা দিলাম। কোন মতে উৎরে গেলাম। রেজাল্টের আগে সারাদিন আড্ডা দেই লাইব্রেরি পাড়ায়। সেসময় রাজার মাধ্যমে আমার এক আড্ডার দিন পরিচয় হয় এক সুদর্শন তরুণের সঙ্গে। সে গল্প লেখে। আহমদ বশীর। দিন দুয়েক আড্ডার পরই আমাদের মাঝে এক বন্ধুত্বের রসায়ন সৃষ্টি হল, তার কারণ সাহিত্য নয়, বরং বশীরের রাজনৈতিক ঝোঁক! কিন্তু যদিও সেটা তখনও পরিষ্কার নয় আমার কাছে, কিন্তু বুঝতে পারি সমাজের প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য ওঁর প্রাণ কাঁদে। গল্পের যেসব উপাদান বা নির্মিতি নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়, সেখানে বুঝতে পারি ওঁর অনেক কিছুই আমার চিন্তার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। সবচেয়ে বড় কথা, বন্ধুদের জন্য ওঁর বুকের উষ্ণতাটা সহজেই বোঝা যেত। খুব মেধাবী মানুষ, আর অসাধারণ সেন্স অফ হিউমার, কিন্তু তুলনাহীন মানবিক! এর কিছুদিনের মধ্যেই বশীরের বন্ধুদের সবাই প্রায় আমার বন্ধু হয়ে যান। সবাই তরুণ লেখক। জাহিদ, জুবেরী, সেলিম রেজা, সারোয়ার কবীর আরও দুয়েকজন। ওঁদের সঙ্গ এবং আড্ডা আমার ভেতরের বিষণ্ণতা অনেকখানি কাটিয়ে দেয়। আমি অনেক শক্তি পাই মনে। যদিও নিজের ভেতরের বিষণ্ণতা বা হতাশা বা বাবা মায়ের স্বপ্ন থেকে যে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছি তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কারো সঙ্গে কথা বলিনি। কিন্তু বশীর বুঝতে পারেন। হয়তো জাহিদ জুবেরীও পারেন, কিন্তু কেউ কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করেননি। দুয়েক রাত বশীরের বাসায় কাটানোর সময়, কিছুটা নেশাচ্ছন্ন হওয়ার ফলেই হয়তো আমাদের দুজনের কথাবার্তা একটু অন্যরকম হয়েছিল। আর সেসব দিনে নেশার উপাদান বেশির ভাগ সময়ই ছিল গাঁজা। সন্ধ্যা থেকে কয়েক ঘণ্টা আড্ডায় সেবন করলে রাতে বাড়ি না ফিরে বশীরের সঙ্গে কাটালে শুয়ে শুয়ে বা বসে বসে অনেক অগোছালো কথাবার্তা হত, তাতেই বশীর আমার ভেতরের দীর্ঘদিনের জমাট বাঁধা তীব্র হতাশার বিষয়টি টের পেয়েছিল মনে হয়। সেটা পরে ওঁর কিছু কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম। ওঁর এই বুঝতে পারাটা আমাদের দুজনকে খুব গভীর এক বন্ধুত্ব মেশানো ভ্রাতৃত্ববোধে জড়িয়ে দেয়। সেটা অন্যরা না বুঝলেও আমি বুঝতে পারতাম।

এদিকে জাহাঙ্গীরনগরে আর যাওয়া হবে না, রেজাল্ট হয়েছে, তাই ঢাকায় ভর্তি হয়ে এক সময় এম এ পরীক্ষা দেয়া যাবে, এমন সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটা করলামও। কিন্তু সেই আগের মতোই কোন ক্লাস করা বা পড়াশুনা নেই, বিভিন্ন পছন্দের বইপত্র নিয়ে মেতে থাকা। বশীর এম এ পরীক্ষার আগে অনেকটা সময় আমাকে ভীষণ মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল। বাড়িতে মা খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠাতেন ছোট ভাইয়ের হাতে, সে তখন ঢাকায় কবি নজরুল কলেজে আই এস সি পড়ছে। মায়ের চিন্তার কারণ আমার পড়াশুনা নয়, বরং আমার স্বাস্থ্য এবং বিষণ্ণতা নিয়ে। তিনি সব সময় বলতেন, 'আমাদের যে সামান্য জমি জিরাত আছে, এসব দেখলে আর বাড়ির কাছে স্কুলে পড়ালেই তোমার চলে যাবে, শুধু বাড়িতে আমার কাছে থাক!' আমি একদিকে সারাক্ষণ মাকে মিস করতাম, অন্যদিকে কিছুতেই বন্ধু বান্ধব, আড্ডা, বইপত্র এবং ঢাকা ছেড়ে থাকতে চাইতাম না। এম এ পরীক্ষা কোন রকমে কোন প্রস্তুতি ছাড়া দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম মায়ের সঙ্গে কিছুদিন থাকার জন্য। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পরীক্ষার আগের রাতে মাঝে মাঝে আমি, জাহিদ হায়দার এবং আরও দুয়েকজন বশীরের ঘর থাকতাম। আমি ঘুমাতাম, নয়তো সিগারেটের তামাকের সঙ্গে গাঁজা মিশিয়ে সিগারেট বানিয়ে সবাইকে দিতাম এবং নিজে খেতাম। এর মধ্যে কী আর পড়াশোনা, বোঝাই যেত কী হবে! কিন্তু জাহিদ এবং বশীর দীর্ঘক্ষণ বই ও নোট নিয়ে পড়তো। আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমাতাম মধ্যরাতের পর। মোমেন আল হায়দার বা আরও দুয়েকজন কিছু আলোচনা করে সন্ধ্যার কিছু পরে বাড়ি চলে যেত। আরেকজন সেই সন্ধ্যাগুলোতে মধ্যরাত অবধি বশীরের ঘরে বসে গাঁজা খেত এবং নকলের জন্য ছোট ছোট কাগজে উত্তর লিখত, ভদ্রলোক নাটকের বিখ্যাত লোক। নকলের সুবিধার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে টাঙ্গাইলের একটি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিচ্ছিল। পরে সে টেলিভিশনে চাকুরী নেয়। বশীর নিজের পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধৈর্য নিয়ে এই লোকটিকে নকল লিখতে ডিকটেশন দিত। ওঁর এই বিষয়টাকে আমি অনৈতিক নয়, বরং মানবিক হিশেবেই দেখতাম! এভাবেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা শেষ হয় যা আমার জীবনে জাগতিক কোন কিছুই বয়ে আনেনি, আর মানসিকভাবে বিষয়টি আমাকে কোনদিনই টানে নি। কিন্তু আমি যে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার বিরোধী ছিলাম তা নয়, বরং আমি ভিন্নভাবে উচ্চতর পড়াশুনার জন্য মনে মনে ভাবতাম।

পরীক্ষার কয়েকদিন পর বাড়ি গেলে মা অনেকটি স্বস্তি পান, ভেবেছেন আমি দীর্ঘদিন থাকবো। আমিও সেরকম ভেবেছি। বাবা দুয়েকদিন জিজ্ঞেস করেছেন, রেজাল্টের পর কী করবো। তবে সেটা একেবারেই সামান্য। বাড়িতে থাকলে তিনিও হয়তো খুশী হতেন মায়ের মতো। এটা হয়েছিল সম্ভবত প্রায় বারো তেরো বছর আমি বাড়ির বাইরেস্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে, এবং এ সময়টায় একেবারেই বাড়িতে বেশি থাকিনি। যাহোক, বাড়িতে গিয়ে ছেলেবেলার সহপাঠী এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আবার নতুন করে জমে উঠল বাজারে চায়ের দোকানে, আমার বাল্যবেলার বন্ধু দুলালের কাপড়ের দোকানে। সকালে নাস্তা খেয়ে চলে যাই, আড্ডা দিয়ে এসে দুপুরে বাড়িতে খেয়ে আবার বিকালে সেখানে যাই, ফিরতে অনেক রাত। মা ভাত নিয়ে অপেক্ষা করে ঘুম জড়ানো চোখে হ্যারিকেনের আলোতে বসে থাকেন। আমি এলে আবার ভাত ছোট চুলায় গরম করে দেন, টুকিটাকি কথা বলেন। আমার ভীষণ মন খারাপ হয় মাকে এভাবে জাগিয়ে রেখে কষ্ট দিতে, কিন্তু আড্ডায় বন্ধুদের রেখে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরতেও পারি না। এর মাঝে একদিন পরিচয় হয় জাজিরায় আসা নতুন ডাক্তার সাখাওয়াতের সাথে। সামান্য আলাপেই বন্ধুত্ব হয়। রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ে আমাদের চিন্তার অনেক সাদৃশ্য আছে। সাখাওয়াতের বাড়ি চরমুগরিয়া। সপ্তাহখানেক পর সে বাড়ি থেকে ফিরে আমাকে বলে আমি চরমুগরিয়া কলেজে পড়াবো কিনা। ওদের একজন ইংরেজির শিক্ষক দরকার।


বাড়িতে এসে রান্না ঘরে খেতে বসে মাকে বিষয়টা বললাম। মা একটু বিষণ্ণ হয়ে বললেন, 'এতদিন পর বাড়ি আইলা, বললা কয়েকদিন থাকবা, এখনই চাকুরিতে যাইবা! তবে চরমুগরিয়া বাড়ির কাছে, প্রতি শুক্রবার বাড়ি আইতে পারবা। দেখ, পছন্দ হইলে যাও, তোমার বাবার সঙ্গে একটু পরামর্শ করো।' আমি মাকে বললাম, 'আচ্ছা আমি বাবার সাথে আলাপ করবো।' বুঝলাম মার মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। কিন্তু পড়া শেষ করার পর কাজ তো একটা কিছু করতে হবে, তাছাড়া দুইটা ভাই কলেজে, এর পরের ভাই ও ছোটবোন স্কুলে। ওদের সবার ব্যয় মার পক্ষে দেয়া কঠিন। জমি থেকে যা আসে তাতে স্বচ্ছন্দে বাড়ির ব্যয় চলে যায়, কিন্তু কলেজে হোস্টেলে ওদের ব্যয় প্রতি মাসে নগদ দিতে হয়। জমি চাষ করে বড় কাকা ও বাবা অনেক, কিন্তু ফসল তুলতে যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তাতে খুব বেশি একটা কিছু বছরের শেষে থাকে না। তখনও আমাদের ওখানে মাত্র আউস আর আমন ধান। এছাড়া রবি শস্য সব চলে যায় ক্ষেতের চাষের ব্যয়, সার, পোকার ঔষধ, আর বিপুল পরিমাণ ঘাস তুলতে নিড়ানির পেছনে। সেদিন আসরের নামাজের পর বাবা চা খেতে খেতে আগের দিনের খবরের কাগজ দেখছেন, আমি কাছে গিয়ে চরমুগরিয়া কলেজের কথা বলতে, তিনি বললেন, 'তোমার ভাল লাগলে যাও। তবে এরকম মফঃস্বল জায়গায় কি তোমার ভাল লাগবে! তুমি কোন জেলা শহরের কলেজে দেখতে পারো। তবে আপাতত যোগ দাও, এরপর চেষ্টা করো, আর যদি বি সি এস পরীক্ষা দিতে চাও, তাহলে প্রস্তুতি নিতে পারো।' আমার মনে হল বাবা কলেজে পড়ানোকে অপছন্দ করছেন না। বিকেলে বাজারে আড্ডায় গিয়ে ডাক্তার শাখাওয়াতকে বললাম, 'মার অমত নেই, যেতে পারি তোমাদের চরমুগরিয়া কলেজে।' শাখাওয়াত আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।

পরের সপ্তাহে দুজনে লঞ্চঘাটে! বন্ধুরা দুয়েকজন জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছি! দুপুর দুটোর দিকে লঞ্চ আসতো ঢাকা থেকে, তাই একটার মধ্যে খেয়ে মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বাড়ির বার হব, মা বললেন, 'তোমার মেজো চাচীর সঙ্গে দেখা করে যেও।' হাতে কিছু আঁচার আর গুড় দিলেন। আমি আঁচার সামলাতে বেশ বেগ পেলাম, পুরনো হরলিক্সের বোতল, তার মধ্যে ঘরের ভাঙানো সরিষার তেলের মধ্যে বিভিন্ন মশলা দিয়ে তৈরি করা জলপাইয়ের আঁচার। মেজো চাচী খুব পছন্দ করেন ঝাল খিচুরির সঙ্গে খেতে। আমি ব্যাগ ও আঁচার আর গুড় নিয়ে হাঁটছি, মা বৈঠক খানার সামনে কলাগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর পেছন ফিরি, মার ছবিটা দূর থেকে দূরতর হচ্ছে! কেন জানি না জীবনের প্রতিটা সময় এই বাড়ি থেকে বের হয়ে দূরে যাওয়ার সময়টার মতো বেদনাদায়ক কোন অভিজ্ঞতাই আমার আর নেই। বেশ কিছুক্ষণ কিছুই আর ভাবতে পারি না। মিনিট দশেক হেঁটেই লঞ্চঘাট। রাস্তায় প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনদের অনেকে জিজ্ঞেস করেন এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছি, এখন তো ঢাকার লঞ্চ নেই। সবাইকেই বলি, একটু মাদারীপুর যাব। মনটা ভার হয়ে রইলো, মার মুখখানা বার বার মনে পড়ছে। লঞ্চঘাটে কয়েকটি চায়ের দোকান। একটিতে দেখলাম বেঞ্চে শাখাওয়াত বসে আছেন, নীল হাফ হাতা সার্ট প্যান্টে গুঁজে দেয়া, একটু স্ফীতকায় হয়েছে ভূরিটা, যা এমনিতে বোঝা যায় না। দেখেই জিজ্ঞেস করলো, 'আরে দোস্ত, কতক্ষণ বসে আছি, একটা লঞ্চ ছেড়ে দিলাম। তুমি বাড়ি থেকে বের হতে এতো দেরী করলে!' আমার ছেলেবেলার সহপাঠী সহর আলীর ছোট ভাই তাহের চায়ের দোকানের মালিক, কিছু বলার আগেই ঘন দুধ দিয়ে চা এগিয়ে দিল। আমি খুব একটা চা অনুরাগী নই, কিন্তু ছোট ভাই তাহের চায় ওঁর হাতে চা খাই। হাতে নিলাম কাপটা। দূরে লঞ্চের আওয়াজ শুনলাম। চা পিরিচের ওপর ঢাললাম যাতে ঠাণ্ডা হয় দ্রুত। তাহের অনুযোগ করে বলল, 'ভাই করেন কী! এতে কি চায়ের সাধ থাকে, লঞ্চ আসতে এখনও কুড়ি পঁচিশ মিনিট, আপনি ধীরে সুস্থে খান!' আমার মনটা কেমন যেন বেদনাক্রান্ত, কাউকে বলতে পারছি না, মার জন্য ভাবছি। কলেজে পড়াতে যেতে দিতে তাঁর অনীহা নেই, কিন্তু এত বছর পর এলাম পরীক্ষার পর, ভাবছিলেন বেশ কিছুদিন নিরালায় থাকবো তাঁর কাছে! দুপুরে রান্নাঘরে তাঁর পাশে বসে থাকার সময় নিভৃতে অনেক কথা বলেন মা। মামা বাড়ির কথা, প্রতিবেশীদের কথা। এবার ফসলাদি কেমন হয়েছে, বড় কাকা আর বাবা কেমন ভাবনায় থাকেন সংসার নিয়ে, এসব বলেন। ছোট ভাইবোনরা দুতিনজন ঢাকায় যাবে কলেজে, কীভাবে চলবে, এসব নিয়ে কথা বলেন। নানা বাড়িতে মায়ের কিছু নিজের জমিজমা আছে, কিনেছিলেন এক সময় কম দামে, বর্গা দেয়া। সেসব ছোট মামা দেখাশুনা করেন, মাঝে মাঝে মাকে কিছু টাকাকড়ি সেখান থেকে দেন। মা সেসব দিয়ে ভাবছেন একটি ভাইয়ের কলেজের ব্যয় চালাতে পারবেন। বললেন, দরকার হলে সামান্য কিছু জমি সেখান থেকে বিক্রি করে দেবেন, যদিও আবার বললেন, 'এত ভাল ফসল হয়, বেচতে ইচ্ছে করে না।' আমার সঙ্গে এসব ছোট খাটো বিষয় নিয়ে কথা বলায় এক ধরনের আনন্দ মায়ের। আমি চলে যাওয়াতে সেটা হারাবেন। আবার দীর্ঘদিন কাছে রাখাও আমাকে সম্ভব না। এসব কথা বলেন খুব কোমল কণ্ঠে। আমি চুপ করে শুনি, কখনও কিছু বলতে পারি না। তাহেরের দোকানে চা খেতে খেতে এসব ভাবছিলাম, কিছুটা বিষণ্ণ ছিলাম মনে হয়! হঠাৎ শাখাওয়াত জিজ্ঞেস করলো, অ্যানি থিং রং দোস্ত!' বললাম, 'আরে না, মা একটু চিন্তা করবেন, এই যা।'

শীত চলে গেছে, মার্চের শুরু, বেশ বসন্তের হাওয়া নদীর পাড়ে, কিন্তু একটু গরম পড়তে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে লঞ্চ চলে এলো। আমি তাহেরকে চায়ের দাম দিতে গেলে বলল, 'ভাই, অনেকদিন আসেন না, আজ সামান্য চা খেয়েছেন, তা আবার দাম দেবেন?' তবুও আমাকে টেনে রেখে শাখাওয়াত জোর করে চায়ের দাম দিলেন। ঢাকা থেকে আগত মানুষ প্রথমে নামলেন, লঞ্চের অনেকেই আমাদের এলাকার, তাই চেনেন আমাদের। তারাই উপরে আমাদের ব্যাগ রেখে জায়গা করে দিলেন। বসার জায়গায় ঢুকেই দেখি সামাদ ভাই, আমার একটু সিনিয়র, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, তিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ। স্কুলে পড়ার সময় আমার ফুফাতো বোন, জমিরুদ্দিন শিকদারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল, পরে কেন জানি হয়নি। তিনি আই এস সি পাশ করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশু চিকিৎসা বিষয়ে পড়েন। বেরিয়েছেন কিছুদিন আগে, নতুন সরকারী চাকুরী, সেই চাকুরী স্থল শিবচর যাচ্ছেন। প্রায় আট দশ বছর পর দেখা। খুব আন্তরিকভাবে কাছে বসালেন, অনেক কথা হল। যদিও ঘণ্টা দেড়েক পর তিনি গঙ্গানগর স্টেশনে নেমে গেলেন। আমি জানালার পাশে বসে নদীর দুই পাড়ের দৃশ্য দেখতে থাকলাম, সেই একই দৃশ্য যা আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে দেখে অভ্যস্ত। রাখালরা নদীতে গরু গোসল করাচ্ছে, নিজেরা দুপুরের পর স্নানাদি সারছে, আর গাঁয়ের বউঝিরা কাপড় ধুয়ে, কলশীতে পানি ভরে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিচ্ছে, ছোট বালক বালিকারা নদীর পানিতে লাফালাফি করছে। আমি বিষণ্ণতা কাটাতে এক মনে সেসব দেখছিলাম আর কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর পর একেটি স্টেশনে থামছে লঞ্চ আর যাত্রীদের ওঠা নামা দেখছিলাম। শাখাওয়াত অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ব্রিজ খেলায় মেতে উঠলো। আমি তাসে কোনদিন আনন্দ পাই না! দেখতে দেখতে শেখপুরা ঘাট ছাড়িয়ে মাদারীপুরের কাছাকাছি চলে এলো। তিন চার ঘণ্টার পথ। কিন্তু বেলা পড়ে এসেছে। মাদারীপুরে যখন নামলাম, তখনও সন্ধ্যা হতে অনেক বাকী। শাখাওয়াত একটা রিকশা নিতে চাইলো চরমুগরিয়া পর্যন্ত, আমি বললাম মিনিট দুয়েক পর মেজো কাকার মইসেরচরের বাসায় এক মিনিট থামতে হবে আঁচার আর গুড় দিয়ে যেতে হবে। লঞ্চঘাট মইসেরচরেই, ঘাট থেকে কাকার বাসা হেঁটে মিনিট দুই তিনেকের পথ। রিকশা বাসার সামনে থামিয়ে আমি ভেতরে গিয়ে চাচীর হাতে আঁচার গুড় দিলে চাচী কিছুতেই ছাড়বেন না, আমি বললাম, দিন দুই পর আসবো। চরমুগরিয়া থেকে কাকার বাসায় আসতে রিকশায় আধা ঘণ্টার পথ। এই বলে সন্ধ্যার আগে আগে চরমুগরিয়া গিয়ে পৌঁছলাম। বাজারে রিকশা ঢুকতেই শাখাওয়াত ওঁর বাবার চেম্বারে মুখ বাড়িয়ে ডাক দিলেন। ওঁর বাবা রোগী দেখতে দেখতে তাকিয়ে হাসলেন, বাসায় যেতে বললেন।


চরমুগরিয়া জায়গাটি শহর এবং গ্রামের মাঝামাঝি এক উপশহরের মত, একেবারে সবুজ, ছিমছাম গাছপালায় ঘেরা। পাশে নদী। নদীর পাড় ধরে অনেকগুলো লম্বা টিনের গুদাম ঘর, যেগুলো পাটের গুদাম হিশেবে ব্যবহার হত এক সময়। এখনও ব্যবহার হয়, কিন্তু পাটের আমদানি কম বাজারে। এটি ছিল নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুরের মত বড় পাটের কারবারের জায়গা। ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং আশপাশের সকল জায়গা থেকে পাটের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাট কিনে চালান করতো চাঁদপুর বা নারায়ণগঞ্জে, সেখান থেকে যেত বিলেতের ডান্ডি। পাট ব্যবসায়ীদের হাতে বিপুল টাকা ছিল। এখন সে রকম রমরমা নেই, কিন্তু জায়গাটি ছিমছাম আছে। ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ এক সময় হিন্দু টাকা লগ্নিকারীরা ছিল, দুচারজন মুসলমান ব্যবসায়ী ছিল। এখন সব বদলে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জায়গাটিতে আরও বদল হয়েছে, এলাকায় আওয়ামী লীগের সাথে সাথে বামপন্থী কোন কোন দল শক্তিশালী হয়েছে, তার মধ্যে সিরাজ শিকদারের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের প্রভাব আছে বেশ।

রাতে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম শাখাওয়াতের বাসায়। ওঁর বাবা এলাকার ডাক্তার, মধ্য পঞ্চাশে বয়স, সুন্দর দেখতে, অমায়িক ব্যবহার। শাখাওয়াতের মা খুব রূপসী ছিলেন এক সময় বোঝা যায়, অমায়িক এবং ভীষণ স্নেহপ্রবণ। ওঁরা তিন ভাই এক বোন। বোনটি সবার ছোট, আই এ পড়ে। মাঝে দুই ভাই, ফরহাদ মেঝো, মাদারীপুর কলেজে পড়ে, ছোট ভাইটি এবার বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে। ছোট গুছানো বাড়ি শাখাওয়াতদের। খুব ভাল লাগলো পরিবারের সবাইকে। সকালে নাস্তা খেয়ে শাখাওয়াত আমাকে নিয়ে হাইস্কুলে গেল, লম্বা দোতলা বিল্ডিং, বিরাট মাঠ এবং স্কুলের চারপাশ এবং পরিপার্শ্ব ভীষণ সুন্দর। বোঝা গেল অনেকদিনের পুরনো নামকরা স্কুল। স্কুলের হেডমাস্টার সবার শ্রদ্ধেয়, খুব শান্ত এবং ভীষণ বিনয়ী ভদ্রলোক। স্কুলে বিল্ডিং এর কিছুটা জায়গা এবং কয়েকটি কক্ষ ছেড়ে দেয়া হয়েছে কলেজের জন্য। দোতলার একটি সুন্দর কক্ষে প্রিন্সিপাল সাহেব বসেন, সেখানেই সব শিক্ষকরা বসেন। অন্য কয়েকটি কক্ষে ক্লাস হয়। আপাতত মানবিক এবং বাণিজ্য শাখায় ইন্টারমেডিয়েট ক্লাস শুরু হয়েছে। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব কলেজ কমিটির সভাপতি। এছাড়া এলাকার বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য মানুষ কমিটিতে আছেন। প্রিন্সিপাল সাত্তার সাহেব অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পি এইচ ডি করতেন শিক্ষা বিষয়ে আই ই আর -এ, কিন্তু কী খেয়ালে ডিগ্রী শেষ না করেই মাঝপথে ছেড়ে দেন। শিক্ষকতাই করেন। তাঁর সঙ্গে আলাপে খুব মেধাবী মানুষ মনে হয়েছে। ইংরেজি লিখতেন সত্যিই সুন্দর। তাঁর কক্ষে প্রথমে গিয়েই সাক্ষাৎ হয় আমার শ্রদ্ধার মানুষ অধ্যাপক অখিলবন্ধু সাহার সাথে। কিংবদন্তী অধ্যাপক মাদারীপুরের। আমাদের প্রিয় কবি প্রিয় মানুষ অসীম সাহার বাবা। তিনি মাদারীপুর কলেজ থেকে অবসর নিলে এই নতুন কলেজের প্রতিষ্ঠাতারা তাঁকে জোর করে ওখানে কিছুদিন পড়ানোর জন্য নিয়ে যান। দুধে আলতা রঙ, অতিশয় সুদর্শন এমন অমায়িক পণ্ডিত মানুষ আমি জীবনে কম দেখেছি। তিনি সপ্তাহে দুই তিন দিন যেতেন। ক্লাস নিতেন। আমি দ্বিতীয় দিন থেকে আই এ ও আই কম ক্লাসে দুটো ইংরেজির ক্লাস নেয়া শুরু করি। ছাত্র সংখ্যা কম। কয়েকজন ছাত্রী আছে, তার মধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কন্যা, শাখাওয়াতের একমাত্র বোন, আর কলেজের কাছের দুতিনটে মেয়ে ক্লাসে পড়ে। সবাই খুব শান্ত মনে হল। আমি এর আগে কোনদিন কলেজে পড়াই নি। তাই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো মানুষ, কীভাবে পড়াবো ঠিক জানি না। তবুও খুব সাধারণ ক্লাসের বই এবং ব্যাকরণ পড়ানো শুরু করলাম। কিন্তু কবিতা বা গল্প পড়াতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ছাত্রদের ইংরেজি ভাষার মৌলিক জ্ঞান দুর্বল। যতোটা সম্ভব খুব খাটাখাটুনি দেয়া সম্ভব দিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে একটু ঘষামাজা করার চেষ্টা করলাম। আমার চেষ্টা বা কিছুটা স্নেহমিশ্রিত মমতা সম্ভবত ছাত্ররা বুঝতে পারলো। কেমন যেন সবাই খুব সহজ হয়ে গেল আমার সঙ্গে। আমিও ভীষণ সময় ও শ্রম দিয়ে ওদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করার চেষ্টা করতে থাকলাম। একটি সুন্দর পুরনো দিনের হিন্দু বাড়িতে, যেটি সরকার বা এলাকা থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে, সেখানে আমি, প্রিন্সিপাল সাত্তার সাহেব ও আরও দুজন তরুণ প্রভাষক থাকতাম। দিন দশেক শাখাওয়াতদের বাড়িতে পরম যত্নে শাখাওয়াতের মায়ের রান্না খেয়ে আমি এই বাড়িতে উঠে আসি। চরমুগরিয়া এলাকাটা সবুজ গাছপালায় ঘেরা অসাধারণ সুন্দর স্বাস্থ্যকর এলাকা। মানুষরাও ভীষণ রাজনীতি সচেতন কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি খুব অমায়িক আচরণের। শাখাওয়াতের ভাই ফরহাদ আমার ছোট ভাইয়ের মতো সার্বক্ষণিক সঙ্গী, সব জায়গায় নিয়ে যায়, অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বেশ কয়েকজন আমার বয়সী এলাকাবাসীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বিকেলে বাজারে কোন চায়ের দোকানে বা রব সাহেবের ঔষধের দোকানে বসে আড্ডা হয়, সবই রাজনীতি এবং এলাকার বিষয়ে কথাবার্তা।

এর মধ্যে রিকশায় দিন দুয়েক কয়েক ঘণ্টার জন্য মেঝো চাচীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এসেছি। চাচী বার বার বলেন বাসায় থেকে চরমুগরিয়ায় রিকশায় গিয়ে ক্লাস করতে। ওখানে কী খাই, কোথায় থাকি, এসব চাচীর ভাল লাগে না। চাচীকে বোঝাই, আমি ওখানে খুব ভাল আছি। আর সময় পেলেই বিকেলে মাঝে মাঝে চলে আসি মাদারীপুর কৃষি ব্যাংকে আমার কাজিন এবং জানী দোস্ত শেখ আজহারের সঙ্গে দেখা করতে। আজহার তখন কৃষি ব্যাংকে, মাদারীপুরে পোস্টেড। আজহার একটু দ্রুত কাজ সেরে দুই ভাই গিয়ে বসি কোন চায়ের দোকানে। হাজার বিষয়ে কথাবার্তা। বুঝতে পারি ঢাকা ছেড়ে ওঁর থাকতে অসুবিধা হচ্ছে মানসিকভাবে, কিন্তু কী আর করা! পেশা, তাছাড়া পরিবারের প্রতি আজহার ভীষণ দায়িত্ববান মানুষ!


এভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু সমস্যা হল হাতে পড়ার কিছু নেই, যে কয়েকখানা বই সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম তা কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ। মাদারীপুর পাবলিক লাইব্রেরী এবং চরমুগরিয়া স্কুল লাইব্রেরীতে হানা দিলাম, তেমন ভাল বই ওখানে নেই, কিন্তু চরমুগরিয়া স্কুলের লাইব্রেরিতে পুরনো দিনের বেশ কিছু মূল্যবান বই পেয়ে গেলাম। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক কিছু উপন্যাস, কবিতা, রবীন্দ্রনাথের সকল বই, ইংরেজি সাহিত্যেরও ভাল কিছু বই ওখানে পাই। বোঝা গেল এসব বই চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে স্কুল লাইব্রেরির জন্য কেনা হয়েছিল। স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব প্রায় আমার বাবার বয়সী, অসাধারণ কোমল একজন মানুষ, স্নেহপ্রবণ, আমার বই পড়ার ক্ষুধা দেখে একটু বিস্মিত হলেও নিজে আমার সঙ্গে খুঁজে খুঁজে দেখেন আলমারিতে কী কী বই আমি পড়তে পারি। স্কুলের পাশেই প্রধান শিক্ষকের পাচিল ঘেরা সুন্দর বাড়ি। তাঁর কন্যা আমার ছাত্র, সে কারণে তিনি আমায় একটু বেশি স্নেহ করেন। আলাপ করতে গিয়ে দেখি তিনি নিজেও সাহিত্য এবং ইতিহাস বিষয়ে খুব উৎসাহী। শিক্ষকতার মাঝে অনেকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে তিনি এম এ পরীক্ষায় খুব ভাল ফল নিয়েই পাশ করেছেন।

কলেজের সামান্য ক্লাস নেয়া ছাড়া হাতে অফুরন্ত সময়, বই আর পত্রিকা পড়ি। আর জার্নাল লিখি, ঢাকায় ফেলে আসা বন্ধুদের প্রচুর চিঠি লিখি! কেন জানি না চিঠি লেখা সে সময় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। চরমুগরিয়ায় একটি জিনিস দেখেছি, তাহলো খুব তাজা ভাল মাছ আর শাকসবজি পাওয়া যায়, সকালে বাসার পাশে চায়ের দোকানে নাস্তা করতে গেলে ঘাটি মাখন পাওয়া যেত যা গোয়ালা দুধ থেকে তুলে চায়ের দোকানে দিত। সেই মাখন পাউরুটিতে মাখিয়ে দারুণ লাগতো, সঙ্গে ঘন দুধের চা! এই খাটি মাখন দেখে আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়তো, বাবা বাজারে নিয়ে গিয়ে নাবিস্ক বিস্কুটের সঙ্গে সদ্য তোলা মাখন দিয়ে খেতে দিতেন সুবল ঘোষের দোকানে। মেজো কাকা মাদারীপুর গেলে বাসা থেকে সকালে মিলন সিনেমা হলের সামনে নিয়ে গিয়ে খাটি ঘোল ও মাখন দিয়ে পাওরুটি খেতে দিতেন, সঙ্গে কাঁচাগোলা, বা সন্দেশ।

মাঝে মাঝে আমি প্রিন্সিপাল সাত্তার সাহেবের সঙ্গে বাজারে যেতাম সকালে, সবকিছু কিনে আনতাম, একটি তরুণ ছেলে আমাদের রান্না করতো ভীষণ সুস্বাদু হত তার হাতের রান্না। কয়েকদিন পর মনে হল ওজন বেড়ে যাচ্ছে, তাই সচেতন হয়ে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিলাম।

চরমুগরিয়ার আরেকটি বিষয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাহলো সন্ধ্যায় অনেক বাড়ি থেকে গানের রেয়াজের আওয়াজ ভেসে আসতো। বিদ্যুৎ ছিল, কিন্তু অনেক বাড়িতেই হ্যারিকেনের আলো, ঘরবাড়ি টিনের ও কাঠের বেশি, কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন! আর কিছুদিন পর পরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত বাজারের হল ঘরে। অনেক মানুষ উপভোগ করতো। মাঝে মাঝে স্কুলেও হত। আমার ছাত্রীদের কেউ কেউ গান করতো। চরমুগরিয়া এক সময় হিন্দু প্রধান এলাকা ছিল। এখনও ছাত্র ছাত্রীদের অনেকেই হিন্দু। এসব হিন্দু ছাত্রীরা খুব ভাল গান করতো। একদিনের অনুষ্ঠানে দেখি একটি ভীষণ রূপসী, আমাদের কলেজের ছাত্রী অসাধারণ গান করছে। শুরু করেছিল হৈমন্তী শুক্লার জনপ্রিয় গান, 'তুমি চলে গেলে চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার বলার কিছুই ছিল না!' আমি এত তন্ময় হয়ে শুনছিলাম যে কেউ আমাকে লক্ষ করছে কিনা তা দেখিনি। পাশে বসা ছিলেন শাখাওয়াতের মামা, আমাদের বয়সী, ইতোমধ্যে যিনি বন্ধু হয়েছেন, সেই রব সাহেব। তিনিই কী ভেবেছেন জানি না। অনুষ্ঠানের পর আমাকে বলেন, 'আপনি পছন্দ করলে আমি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারি!' আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। এরপর জানলাম মেয়েটি মেধাবী ছাত্রী, কিন্তু ইংরেজি তার একিলিসের গোড়ালি, বার দুয়েক একইভাবে এ বিষয়ে তার বাধা হয়েছে আই এ পরীক্ষায়। এরপর কলেজে তাকে ক্লাসে দেখেছি। মেয়েটিকে দেখলে খুব খারাপ লাগতো, হয়তো বিধাতা তাকে সব দিয়েছেন, ধনী বাবার কন্যা, রূপসী, কিন্তু এই এক বাধা তার আই এ পরীক্ষায়! চরমুগরিয়া ছাড়ার পরও অনেকদিন মেয়েটির মুখখানা মনে পড়তো!

কলেজের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না নতুন কলেজ বলে, তাই প্রথম মাসের মাইনে পেলাম যোগ দেয়ার প্রায় ছয় সপ্তাহ পরে। এই ছয় সপ্তাহ বাড়ি যাওয়া হয়নি, মা হয়তো খুব দুশ্চিন্তা করছেন। আমি চিঠি দিয়ে যদিও জানিয়েছি সব খবর। মাহিনা পেয়ে প্রিন্সিপাল সাত্তার সাহেবকে জানালাম আমি সপ্তাহের ছুটির সময় দিন দুয়েকের জন্য বাড়ি যাব। তিনি বললেন, 'স্বচ্ছন্দে'! খেতে খুব বেশি টাকা লাগতো না, থাকার জায়গা কলেজের, তাই মাহিনার প্রায় সত্তর বা আশি শতাংশ টাকা জমে যেত! আমি এক বিকেলে সবচেয়ে ভাল শাড়ির দোকানে গিয়ে খুব ভাল শাদা জমিনে সবুজ এবং নীল পাড়ের দুটো শাড়ি কিনলাম মায়ের জন্য। মা সাধারণত তাঁতের শাড়ি পরতেন, কিন্তু কোথাও বাইরে গেলে এধরনের শাড়ি পরতেন। আর পাবনার মিলের শাদা শাড়ি ব্যবহার করতেন নামাজের জন্য। তাই একটি নামাজের শাড়িও কিনলাম। এসব কেনার সময় মনে হয়নি, পরদিন বাড়ি রওয়ানা দেয়ার আগে ভাবলাম বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবীর কাপড় কিনি। ভাল সূতির কাপড় কিনলাম। এরপরও বেশ কিছু টাকা রয়ে গেল হাতে। বাড়িতে পৌঁছে মাকে কাপড় আর টাকাগুলো দিয়ে দিলাম। মা কেন জানি না বাবাকে দিতে বললেন। বাবাকে দিলে বাবা হেসে বললেন মার হাতে দিতে। যদিও ছাত্রজীবন থেকে আমি টুইশানি করি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটাই আমার প্রথম চাকুরীর রোজগার।

২.
বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখতাম বশীরকে আর সুবলকে। সুবল এক চিঠিতে জানিয়েছে সে বি এড- এ ভর্তি হয়েছে, কারণ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে হোস্টেলে থাকার ভাল ব্যবস্থা। আর মিরপুরে একটি স্কুলে চাকুরী নিয়েছে, সঙ্গে টুইশানি আছে কয়েকটা। ক্লাস সামান্য করে, ভালোই আছে। সঙ্গে সেখানে ভর্তি হয়েছে আমার ঢাকা কলেজের বন্ধু এবং ইংরেজির সহপাঠী ওসমান হোসেন খান। বশীরকে খুব মিস করি, রাজা এবং অন্যান্য বন্ধুদেরও মিস করি। বশীর তাড়া দেয় চিঠিতে ঢাকা চলে যেতে। কলেজ, ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গ, থাকার সুন্দর জায়গা এসব কিছু থাকা সত্ত্বেও ঢাকার জন্য, বন্ধুদের জন্য মন কাঁদে! দিনগুলো কোন রকমে কেটে যায়, কিন্তু রাতগুলো খুব বিষণ্ণতায় কাটে। ভাবি আসলে জীবনটা নিয়ে কী করবো, কলেজে পড়িয়ে কাটিয়ে দেব, নাকি বাবার কথা মতো সরকারী চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দেব, নাকি মায়ের ইচ্ছা মতো বাড়িতে ফিরে গিয়ে স্কুলে পড়াবো। মা একদিন বললেন, এক সময় ওখানেও কলেজ হবে, চাইলে সেখানে পড়াতে পারবো। আমার জানী দোস্ত এবং কাজিন আজহার তার কৃষি ব্যাংকে বসে আড্ডা দিতে দিতে পরামর্শ দিয়েছে জাজিরা ফিরে গিয়ে স্কুলটাকে কলেজে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করতে, যেটা আমার জন্য সহজ, চাইলে শাহ কাদের ভাইয়ের সাহায্য নিতে পারি। সেটা হবে বড় কাজ। এসব কিছুই মাথায় আছে, কিন্তু মনটা চায় শুধু লিখতে আর গবেষণা করতে। আর আমার মনের কোণে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাইরে গিয়ে কোথাও আধুনিক ভারতের ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করা, যা আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। ভাবলাম তারই বা কী হবে! একদিকে মার জন্য সারাক্ষণ মন পোড়ে, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন নিয়ে ভাবা, আমি কোনদিকে যাব শেষ অবধি, আমি নিশ্চিত নই। সারাক্ষণ রাতে নির্ঘুম কাটে আর এসব মাথায় ঘোরে। বেশ কয়েক মাস বন্ধুদের দেখি না। পরের মাসের মাহিনা পেয়ে, কলেজ থেকে সাত দিনের ছুটি চাইলাম। দুদিন বন্ধ, আর পাঁচ দিনের ক্লাস প্রিন্সিপাল সাহেব চালিয়ে নেবেন বললেন। আমি ঢাকার দিকে রওয়ানা দিলাম মাদারীপুর থেকে লঞ্চে। বাড়ির পাশ দিয়ে লঞ্চ এগোচ্ছে, কিন্তু আমি নামলাম না। ভাবলাম ফেরার পথে নেমে মার সঙ্গে দেখা করে যাব। যথারীতি সারারাত লঞ্চে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু লঞ্চের আওয়াজে আমার কখনই ঘুম আসে না। এক ধরনের তন্দ্রার মত হয়। খুব সকালে সদরঘাট গিয়ে নেমে প্রথমে আমার স্কুলের কাছে পুরনো দিনের একটি হোটেলে ঢুকে পরোটা সুজি দিয়ে নাস্তা করে চা খেতে খেতে ভাবলাম কোথায় যাব, বশীরের কথা মতো ওঁর ওখানে যাব, নাকি সুবলের ডাকে সাড়া দিয়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ওঁর ওখানে উঠবো। ওখানে ওসমান আছে, সেটি বাড়তি আনন্দের ব্যাপার। এসব ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম আগে বশীরের কাছে গিয়ে স্নান টান করে জাহিদ ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে পরে সুবলের ওখানে যাওয়া যাবে। তাই রিকশা নিয়ে প্রথমে নয়াটোলা মগবাজারে আগে রওয়ানা দিলাম। বশীরের দরোজায় কড়া নাড়তে দেখলাম দোতলার খোলা জায়গা থেকে বশীরের আব্বা হাঁক দিলেন, 'কে?' আমি কোন উত্তর দেয়ার আগেই বশীর চোখ কচলাতে কচলাতে দরোজা খুলে দিয়ে বলল, 'আয় দোস্ত!' সামনের ছোট বসার ঘরটি পেরিয়ে ভেতরে বশীরের ঘর, তার পাশে সাবুর ঘর। আমি ঘরে ঢুকে কাপড় ছাড়ার সময় দেখি সাবু ঢুকে বশীরকে বলছে, 'ভাইয়া তোমার কাছে একটা সিগারেট হবে?' আমাকে দেখে সাবু হেসে দিয়ে বলল, 'ওহ, ভাই এসেছেন!' আমি জিজ্ঞেস করলাম সে কেমন আছে। সাবু ছোট ভাই হলেও বশীরের সব বন্ধুদের সঙ্গেই প্রায় বন্ধুর মত আচরণ তার। বশীর আমাকে নাস্তা খাব কিনা জিজ্ঞেস করলে বললাম খেয়ে এসেছি। কাপড় ছেড়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে বশীরের সঙ্গে হাজারটা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বারোটার উঠে দেখি বশীর কী একটা লিখছে। এরপর স্নান খাওয়া সেরে দুজনে চারটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। টিএন টির মোড়ে দুখুর রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখলাম কেউ তখনও আসেনি। দুদফা চা খেয়ে দুখুর ক্যাশের পাশে বসে আমি আর বশীর আড্ডা দিতে দিতে দেখি শাহনেওয়াজ ও আরও দুয়েকজন এলো। শুরু হল আড্ডা। ধীরে ধীরে জাহিদ জুবেরী এলো, সেখান থেকে মৌচাকের কাছে আরও কিছুটা আড্ডা দিয়ে ঢাকার সাহিত্যের হাল হকিকত নিয়ে কথাবার্তা হল। সবাই ভীষণ উত্তেজিত নতুন ধরনের লেখার স্বপ্ন নিয়ে। জুবেরী জানালো কথাশিল্পী রাহাত খান ও আরও দুয়েকজন সিনিয়র লেখক এবং গল্পকার বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে একটা গল্প লেখকদের সমিতির মতো করার চেষ্টা চলছে। পরের দিন আরেকটা মিটিং আছে শান্তিনগরে এক বাসায়। সেখানে আমরা সবাই যাব এমন সিদ্ধান্ত হল। রাতে বশীরের বাসায় ফিরে দুজনে গল্প করছি। প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে, বশীর চিঠিতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানাবে বলেছিল সেটি জিজ্ঞেস করলাম। বশীর একটু চুপ করে থেকে বলল বিয়ের কথা, কারণ রেখার বাড়ি থেকে বিয়ের আয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি শুনে বললাম, 'চল, বিয়ে করে ফেল!' বশীর বলল, 'আরে বললেই কি সম্ভব নাকি! টাকার দরকার।' বশীর চাকুরির চেষ্টা করেনি গত কয়েক মাস পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর। জাহিদ টেলিভিশনে যোগ দিয়েছে, যদিও কাজটা তাঁর তেমন ভাল লাগে না। জুবেরী তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বিয়ে করে চাকুরী করে। প্রথমে শিশু একাডেমীতে, এরপর সংবাদপত্রে, তাছাড়া সেবা প্রকাশনীতে অনুবাদের কাজও করে। বশীর সব সময় চাইত সার্বক্ষণিক লেখক হতে, কলেজ, সংবাদপত্র বা কোন সরকারী চাকুরী কিছুতেই তাঁর কোন উৎসাহ নেই। কোথাও দরখাস্তও করেনি। হাত খরচের পয়সাটা লেখার মাধ্যমে আর কিছু ওঁর আম্মার কাছ থেকে নিয়ে চলছে, থাকা খাওয়ার অসুবিধা নেই। অন্য বন্ধুদের সেই সুবিধা ছিল না। জাহিদ রশীদ ভাইয়ের রামপুরা বাসায় থাকতো ছাত্র জীবনে, কিন্তু হাত খরচ জিয়া ভাই দিতেন বা কিছুটা লিখে বা টুইশানি করে চালাত, এখন চাকুরি। লেখক হিশেবে প্রস্তুতির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ছিল জাহিদের। বাড়িতে প্রায় চারজন বড় ভাই নামকরা লেখক, বাড়িতে সাহিত্যের সকল প্রয়োজনীয় বইপত্র ছিল। তাছাড়া বাড়ির পুরো পরিবেশটাই ছিল সাহিত্যেময়। জুবেরীরও অনেকটা তাই, বাবা বিখ্যাত দর্শনের অধ্যাপক, বাড়ির পরিবেশ পড়াশুনা বা বিদ্যাচর্চার সহায়ক। বশীরের আব্বা শিক্ষাবিভাগের বড় কর্মকর্তা, তাই সেও পরিবেশ ভাল পেয়েছে, কিন্তু সাহিত্য বিষয়ে আকর্ষণটা তাঁর নিজের পড়াশুনার ফসল। সেলিম রেজা একটু ছোট আমাদের চেয়ে, সারোয়ার কবীরও তাই। কিন্তু এরা সবাই সাহিত্য অন্তপ্রাণ। একমাত্র কাজী হাবীব এসেছে পাবনা থেকে, বশীরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সাহিত্যে আকর্ষণ জন্মায় এবং গল্প লেখা শুরু করে।

বশীর আর আমি সারাটা দিন কাটাই গল্প করে, আর বিকেল হতেই চলে যাই শান্তিনগর একটি ট্রেডেল মেশিনের ছোট প্রেসে আড্ডা দিতে। প্রেসের মালিক মানিক, মৌচাকের কাছেই রামপুরা রোডে ওদের বাড়ি। জাহিদ, জুবেরী এবং বশীরের আগের পরিচিত। আমি মাত্র চিনেছি ওদের মাধ্যমে। প্রেসের দুটি কামরা, দরোজার কাছেই ছোট ঘরটা অফিস, আর মাঝখানে আরধেকটা দেয়াল দেয়া, ওপাশে বড় ঘরটায় কম্পোজ সেকশন এবং মেশিন। বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ছোট অফিস ঘরটায় তরুণরা এসে জমা হয়, লোকে থই থই করে। এক পর্যায়ে প্রতি চেয়ারে দুজন বসেও জায়গা হয় না, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ মেঝেতে বসে ঝিমোয় খানিকটা আড্ডা দিয়ে। এর মধ্যে জুবেরী আর জাহিদ এক মনে প্রুফ দেখে যায় যতোটা কম্পোজ হয়েছে। বিকেল থেকে পুরিয়া খুলে সিগারেট বানানো শুরু হয়। সম্ভবত দুজন কম্পোজিটর, তাদের ছুটির পর অফিস ঘরের দরোজাটা একটু ভেজিয়ে দেয়া হয়। অফিসটির দেয়াল আর জাপানী দূতাবাসের দেয়াল একটাই। এর মধ্যে গুন গুন করে গান চলতে থাকে। সেলিম রেজা, সারোয়ার কবীর, গল্পকার সৈয়দ কামরুল হাসান এবং আরও কেউ কেউ। বুলবুল চৌধুরী আর কবি সমুদ্র গুপ্ত এলে হাসির ফোয়ারা ছুটতে থাকে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ছোট ঘরটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, মনে হয় কোন শীতার্ত সন্ধ্যায় আমরা কুয়াশার মধ্যে আছি। তক্কাতক্কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে আলবেয়ার ক্যামুতে গিয়ে গড়ায়। ধোঁয়া যত ঘন হয় আমার হতাশা-মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত হয়। কেন সিসিফাস পাথর নিয়ে পাহাড়ে বিরামহীন উঠে যাচ্ছে এই হেঁয়ালি ভরা দার্শনিক প্রশ্নে সবাই হেসে উঠছে। এর মাঝে বার দুই তিনেক সবার কাছ থেকে খুচরো পয়সা সংগ্রহ করে কেউ একজন খালার বিড়ির দোকান থেকে একের পর এক পুরিয়া কিনে আনছে আর ঘরের ধোঁয়া ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। 'বিপক্ষে' পত্রিকার উদ্দেশ্য এবং চারিত্র কী হবে তা নিয়ে জুবেরী আর বশীর কথা বলছে, কিছুটা তর্কও হয় সাহিত্যের আধুনিকতা নিয়ে, কেন অন্যান্য সাহিত্য পত্রিকা থেকে 'বিপক্ষে' আলাদা, কেন এটা শুধু পত্রিকা নয়, এটা একটা সাহিত্য আন্দোলন, সেটা কীভাবে বিশ্লেষণ করা হবে পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তা নিয়েও বেশ কথাবার্তা হয়। হঠাৎ জাহিদ আমার দিকে কিছুটা লাল- হয়ে-ওঠা চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, 'আবেদীন, তোর প্রবন্ধ কী হবে?' আমি কিছুটা বিস্মিত। আমি এই প্রশ্নের ঠিক আগের মুহূর্তেও ভাবিনি এই পত্রিকায় কোন প্রবন্ধ লিখবো। আমি তো দিন সাতেক আগেও জানতাম না এমন একটি পত্রিকার আয়োজন বা অস্তিত্ব সম্পর্কে! বললাম, 'দেব একটা প্রবন্ধ, ভারতীয় রাজনীতি বিষয়ে!' উত্তরটি এমনিতেই মাথায় এসেছিল, কারণ মাস কয়েক যাবৎ আমি ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে কিছুটা পড়াশুনা করার চেষ্টা করছিলাম। সেসব দিনে আমি খুব নেহেরু এবং আজাদের ভক্ত ছিলাম। আর মনে প্রাণে ঘৃণা করতাম জিন্নাহকে। অহেতুক অর্বাচীনের মত কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ভাবতাম। কিছু সত্যিকার কিছু পড়াশুনা করতে গিয়েই আমার মনে সন্দেহ জাগে, আসলে ভারতীয় সমাজ কখনই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ নয়। কিছু পশ্চিমা শিক্ষিত রাজনীতিকরা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়তে চাইলেও আসলে কয়েক হাজার বছরের এই সমাজকাঠামোকে ধর্মনিরপেক্ষ করা এই নেতাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি জাহিদকে বললাম, আমার প্রবন্ধের নাম হবে 'ধর্মপক্ষতা এবং ভারতীয় রাজনীতি'। জাহিদ পত্রিকা বা লেখার বিষয়ে সব সময় অনুপুঙ্খ সিরিয়াস। সঙ্গে সঙ্গে একটা লেখার তালিকাসহ নোটবই বের করে সেখানে লেখার তালিকায় শিরোনামটি লিখেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কত তারিখের মধ্যে লেখা দেব। আমি এক মাস সময় নিলাম। জাহিদ ঠিক এক মাস পরের তারিখ নোটবইতে লিখে রাখলো । আমি ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পেলাম। প্রতিশ্রুতি দিলাম, সময় মত লেখা দিতে পারবো তো! যাহোক, জাহিদের সিরিয়াসনেস আমার মধ্যে সংক্রামিত হল, ভাবলাম যে কোন উপায়েই হোক লেখাটা ঠিক সময়ের মধ্যে শেষ করে ওঁর হাতে তুলে দেব।