মাদাম দ্যু বারি: অষ্টাদশ শতকের এক অসাধারণ ফরাসি নারীর কাহিনী

শিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 3 Sept 2020, 05:28 AM
Updated : 3 Sept 2020, 05:28 AM


এমন এক মহিলার জীবনের গল্প বলবো এখানে, যাঁর সম্পর্কে ভলতেয়ারের মতো মহান চিন্তক বৃদ্ধ বয়সে একটি কবিতা লিখেছিলেন:

Quoi, deux baisers sur la fin de la vie !
Quel passeport vous daignez m'envoyer !
Deux, c'est trop d'un, adorable Égérie,
Je serai mort de plaisir au premier.

কবিতাটির বাংলা অনুবাদ হতে পারে:

একি! জীবনের শেষপ্রান্তে, পাঠালে কী সাহসে
এ কেমন ছাড়পত্র! এঁকে দুখানি চুম্বন!
আহা! দুটি কেন? প্রথমের পুলক-আবেশে,
হে প্রেরণাদায়িনী! হবে নিশ্চিত মরণ!

অষ্টাদশ শতকে রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের আমলে জঁ বেক্যু নামে এক রোস্ট-কারিগর ছিলেন প্যারিসে। জঁ-এর এক ছেলে ফাবিয়্যাঁ বেকুকে প্যারিসের সুন্দরতম পুরুষ মনে করা হতো। সেভরিন বোন নামে এক অভিজাত বিধবা মহিলা ফাবিয়্যাঁর প্রেমে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়েই করে ফেলেন, যদিও বেশ ঝুঁকি নিয়ে, কারণ এই বিয়ের কারণে সেভরিন বোন তাঁর আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে যুগে সাধারণ পরিবারের কাউকে বিয়ে করলে অভিজাতেরা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতেন। তবে এই দুর্নাম বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি সেভরিনকে– একটি কন্যার জন্মের পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।

ফাবিয়্যাঁ বেক্যু নাম বদলে হয়ে যান 'ফাবিয়্যাঁ দ্য কাতিঈনি'। কাজটা সে যুগে আইনসঙ্গত ছিল না, কারণ নিজের পারিবারিক নামে 'দ্য+স্থাননাম' ব্যবহার করার অধিকার শুধু অভিজাত বংশের লোকদেরই ছিল। ভুয়া অভিজাত ফাঁবিয়্যাঁ দ্য কাতিঈনি প্যারিস ছেড়ে জার্মান সীমান্তে লোরেন অঞ্চলে চলে গেলেন। সেখানে রাজা চতুর্দশ লুইয়ের এক প্রাক্তন প্রেমিকা কাউন্টেস ইসাবেল লুদ্র-এর বাড়িতে পাচকের কাজ নেন এবং তাঁর প্রধান পরিচারিকাকে বিয়ে করেন।

দ্বিতীয় সংসারে ফাঁবিয়্যাঁ সাতটি সন্তানের জনক হন, যার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিল আন বেক্যু। আন বেক্যু কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতো, স্থানীয় এক গীর্জার যাজক-নানদের কাপড় সেলাইয়ের ফরমায়েশ নেওয়া কিংবা মাল ডেলিভারি দেবার প্রয়োজনে তাকে গীর্জায় আসা-যাওয়া করতে হতো। আসা-যাওয়ার এক পর্যায়ে গোমার দ্য ভোবারনিয়ে নামে এক যাজকের সঙ্গে আনের শারিরীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আন গর্ভবতী হয় এবং ১৭৪৩ সালের ১৯শে আগস্ট এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। কন্যার নাম দেওয়া হয় জান। এর পর এক ব্যাংকারের সঙ্গে সম্পর্ক হয় জানের এবং পুনরায় সে গর্ভবতী হয়। এবার একটি পুত্র সন্তান, যার নাম রাখা হয় ক্লদ। ক্লদ মাত্র ১০ মাস বয়সে মারা যায়।

এর কিছুদিন পর বিয়ার দ্যু মোসোঁ নামে স্থানীয় এক ব্যাংকারের সুনজরে পড়েন আন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে দ্যু মোসোঁই ছিল আনের মৃত পুত্রসন্তানের জনক। এই ধনী ব্যাংকার আন এবং তার কন্যাকে প্যারিসে নিয়ে আসেন। দ্য মোসোঁ তাঁর ইতালীয় মিসট্রেস ফ্রন্সেসকার বাড়িতে পাচিকার কাজ দেন আনকে। পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, আনের পিতা ফাবিয়্যাঁ এবং পিতামহ জঁও ছিল পাচক। ১৭৪৯ সালে দ্যু মোসোঁর এক কর্মচারী নিকোলা রঁসোর সঙ্গে বিয়ে হয় আনের। নিকোলাকে এক দোকানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কর্সিকা দ্বীপে। আনের ইতিহাস আপাতত এখানেই শেষ।

ফ্রন্সেসকা জানকে খুবই আদর করতেন। তিনি কিশোরী জানকে শেখালেন, কীভাবে পুুরুষদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে হয়। এই বাড়িতেই নাগরিক বিলাসিতার সঙ্গে পরিচয় হয় জানের। 'জান দ্য ভোবারনিয়ে' নাম দিয়ে দ্যুমোঁসোঁ এবং ফ্রন্সেসকা জানকে ভর্তি করে দেন প্যারিসের সেন্ট অর গীর্জার কনভেন্টে। নয় বছর সেই কনভেন্টে অবস্থান করে জান লিখতে ও পড়তে শেখেন, শেখেন অংক, অঙ্কন, সঙ্গীত, নৃত্য, সূচীকর্ম এবং অবশ্যই ধর্ম।


জানের বয়স যখন ষোল তখন (কেউ কেউ বলে) দ্যুমোসোঁর চোখ পড়ে উঠতি যৌবনা জানের দিকে। ফ্রন্সেকার ইর্ষার কারণেই হোক, কিংবা হোক অন্য কোনো কারণে, ১৭৫৯ সালে জানের কনভেন্টের খরচ বন্ধ হয়ে যায়। জান প্যারিসের রাস্তায় একা। প্যারিসের গলিতে কমদামি অলঙ্কার ফেরি করে বিক্রি করতেন। অবশেষে লামেতয নামে প্যারিসের হেয়ার-ড্রেসারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন জান। লামেতযকে প্রায় বিয়ে করেই ফেলেছিলেন জান, কিন্তু পরে পিছিয়ে আসেন, যদিও লামেতযকে ছাড়ার আগে তার জমানো সব টাকাপয়সা জান নয়ছয় করেন। এর পর জানকে প্যারিসের শহরতলী লা কুরনভে এক অভিজাত মহিলা কৃষিখামারীর বাড়িতে কাজ নেন। জানের জন্মদাতা গোমার দ বোভারনিয়ের ভাই এই কাজ পেতে সাহায্য করেন। লা কুরনভ এখন প্যারিসের অংশ, কিন্তু অষ্টাদশ শতকে লা কুরনভ নিছকই গ্রাম। ঐ অভিজাত পরিবারে থাকতে থাকতে জান অভিজাতদের আদব-কায়দা রপ্ত করে নেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই জানকে বিদায় করে দেওয়া হয়, কারণ বাড়ির মালকিনের দুই তরুণ পুত্র সুন্দরী জানের প্রতি খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

জান আবার রাস্তায়। পেট চালাতে সে অলঙ্কার ফেরি করে বিক্রি করতো রাস্তায়। এর পর চাকরি নিল এক পোশাকের দোকানে। একেতো বয়স কম, তার উপর অসাধারণ সুন্দরী জান নজর কাড়লো অনেকের। এর পর জঁ ব্যাপতিস্ত দ্যু বারি নামে দুর্নীতিপরায়ণ এবং চরিত্রহীন এক কাউন্টের নজরে পড়ে জান। পূর্ণকালীন পেশায় দ্যু বারি যুদ্ধসামগ্রীর কন্ট্রাক্টর ছিলেন। একটি খণ্ডকালীন পেশাও ছিল তাঁর: প্রমোদবালার দালাল ছিলেন তিনি। একটা ক্যাসিনোও ছিল এবং এই ক্যাসিনোতেই জানকে তিনি প্রথম দেখেন। একাধিক মেয়েকে বান্ধবী হিসেবে রাখতেন দ্যু বারি আবার বান্ধবীদের যৌনসেবা দিতেও পাঠাতেন উচ্চপদস্থ অভিজাতদের কাছে। মা আনের মতো জানেরও নীতিবোধ খুব উচ্চমানের ছিল না, বলা বাহুল্য। দ্যু বারি জানকেও পাঠাতে শুরু করলেন বিভিন্ন অভিজাত ব্যক্তির প্রাসাদে। জানের বিখ্যাত খদ্দেরদের একজন ছিলেন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী ডিউক অব রিশলিউ। রিশলিউর প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রশ্নহীন, কারণ প্রথমত তিনি ছিলেন রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ধর্মপুত্র এবং দ্বিতীয়ত, তিনি নিজেকে চতুর্দশ লুইয়ের স্ত্রী অর্থাৎ পঞ্চদশ লুইয়ের মায়ের প্রেমিক বলে দাবি করতেন।

রেনেসাঁর সময় থেকেই প্যারিসের অভিজাত এবং ধনী বুর্জোয়া পরিবারগুলোতে সান্ধ্য আড্ডার সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল। সেই আড্ডায় আলোচনায় মগ্ন হতেন নামিদামি সাহিত্যিক-দার্শনিক, শিল্পী, রাজনীতিক। সথে খাদ্য-পানীয়তো থাকতোই। এসব আড্ডাকে বলা হতো 'সালোঁ'। একেকটি সালোঁর মধ্যমণি হতেন সাধারণত একজন সুন্দরী, শিক্ষিতা, ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। কাউন্ট দ্যু বারি এসব সালোঁতে যেতেন, সাথে বগলদাবা করে নিয়ে যেতেন অপরূপ সুন্দরী জানকে। সালোঁর আলোচনায় অংশগ্রহণ করার মতো বুদ্ধিজৈবনিক যোগ্যতা জান ইতিমধ্যে অর্জন করেছিলেন শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

অষ্টাদশ শতকের প্যারিসের সুন্দরীদের মধ্যে অগ্রগণ্য জানের মুখম-লের আকার ছিল হৃদপিণ্ডের মতো, ঘন, সোনালি চুল কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘাড়ের উপর এসে পড়তো, চোখদুটো ছিল (পূর্ব এশীয়দের মতো) আলমন্ড বাদামের আকৃতি, চোখের মণি, কেউ বলেছেন নীল রঙের, কেউ বাদামি। একেতো অতূলনীয়া সুন্দরী, তার উপর অভিজাত চালচলন রপ্ত ছিল, যৌনকর্মেও ছিল চৌকশ, সুতরাং খুবই চাহিদা ছিল জানের অভিজাত মহলে। দ্যু বারি ভাবলেন, এই অমূল্য সম্পদ হেলায় নষ্ট করা যাবে না এবং যা করার খুব তাড়াতাড়িই করতে হবে। দুটি ভয় ছিল দ্যু বারির: প্রথমত, প্রতিদিন এত বেশি সংখ্যক খদ্দের সামলাতে হলে অচিরেই জানের কমনীয়তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, তখনও পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়নি বলে সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি যৌনরোগ সংক্রমিত হতে পারে জানের শরীরে এবং দ্য বারির নিজের শরীরেও। দ্যু বারি চাইছিলেন জানকে দিয়ে বিশাল কোনো দাঁও মারতে (বা ফরাসিতে যেমন বলে:se faire des couilles en or বা বাংলায় 'নিজের অণ্ডকোষ স্বর্ণমণ্ডিত করতে')।

রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের বয়স তখন ৫৭ বছর, সে যুগের হিসেবে তিনি বুড়ো। রাণী তখন সদ্য বিগত হয়েছেন। মারা গেছে বেশ কয়েকটি ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, এমনকি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী রাজপুত্র। যক্ষ্মারোগে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রমোদ-সঙ্গিনী মাদাম দ্য পম্পাদুর। শোক অপনোদন করতে একজন প্রমোদ-সঙ্গিনী প্রয়োজন বৈকি! ফরাসি রাজারা কয়েক শ বছর ধরেই প্রমোদ-সঙ্গিনী রাখছিলেন এবং জনগণের তাতে কোনোই আপত্তি ছিল না, কারণ রাজার যদি মন খারাপ থাকে, তবে রাজ্যের কী হবে! রিশলিউ চাইলেন, এমন একজনকে রাজার মিসট্রেস করে রাখতে, যার মাধ্যমে তিনি রাজার উপর প্রভাব বজায় রাখতে পারবেন। এ কাজে জানের চেয়ে উপযুক্ত আর কে হতে পারে? রাজার উপর যারা প্রভাব খাটাতে চান, তারা সবাই সঙ্গিনীর খোঁজে ছিলেন। 'কার আগে কন্যা কে করিবে দান লেগে গেল কাড়াকাড়ি! রিশলিওর প্রতিদ্বন্দ্বী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোয়াসলও জানকে দেখেছিলেন, কিন্তু জানকে ওঁর তেমন সুন্দরী মনে হয়নি। রাজার প্রধানতম ভৃত্য দমিনিক ল্যবেলের সহায়তায় রাজাকে 'কনে দেখানো' হলো। দীর্ঘদিনের ভৃত্য ল্যবেলের কাজই ছিল রাজার জন্যে বান্ধবী জোগাড় করা। পেশাদার যৌনকর্মী ছিলেন জান, কামসূত্র গুলে খেয়েছিলেন। প্রথম সিটিঙেই রাজা রিরংসায় যেন পাগল হয়ে গেলেন।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জান অভিজাত নয় এবং ল্যবেল রাজাকে জানালেন যে জান আসলে প্যারিসের রাস্তার প্রমোদবালা। কুছ পরোয়া নেই। 'পিরিতে মজিলে মন, কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম!' একজন অভিজাতকে খুঁজে বের করতে হবে যিনি জানকে লোকদেখানো বিয়ে করবেন এবং রাজসভায় তাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন। দালাল জঁ ব্যাপতিস্ত দ্যু বারিই এ কাজটা করতে পারতেন, কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বলে তাঁর পক্ষে এই হিল্লা বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। ব্যাপতিস্ত দ্যু বারি ঘুস দিয়ে গীর্জা থেকে জানের জন্যে একটি নকল জন্মনিবন্ধনপত্র বের করলেন এবং তাতে তাঁর বয়স কয়েক বৎসর কমিয়েও দিলেন, হয়তো মাতামহের ভুয়া অভিজাত নামও যোগ করলেন, দ্য কাতিঈনি। জঁ ব্যাপতিস্তের এক ছোটভাই ছিল গিওম। জঁ ব্যাপতিস্ত যে পরিমানে ধুরন্ধর, ছোটভাই গিওম সে পরিমাণে মাথামোটা, মোটাসোটা, তদুপরি খর্বকায়। এই ভাইটিকেই কাজে লাগালেন জঁ ব্যাপতিস্ত। জানকে হিল্লা বিয়ে করতে রাজি হলো গিয়োম এবং বিনিময়ে তাকে দেওয়া হলো বছরে ৫০০০ পাউন্ডের পেনশন (সে যুগে অনেক টাকা, কারণ মাদাম দ্যু বারিকে রাজা মাসোহারা দিতেন ৩০০ পাউন্ড এবং এটাও অনেক টাকা সে কালের বিচারে), কয়েকটি জমিদারি, একটি প্রাসাদ এবং আরও অনেক কিছু। জানের দালাল জঁ ব্যাপতিস্ত দ্যু বারিও খালি হাতে বিদায় হলেন না। তাকেও দেওয়া হলো ভালো রকম আয় সহ বড় একটি পদ।


১লা সেপ্টেম্বর ১৭৬৮ তারিখে জানের জন্মদাতা পিতা গোমার দ্য ভোবারর্নিয়ে লোরেন থেকে প্যারিসে এসে এই বিয়ে পড়ালেন। বেক্যু বা ভোবার্নিয়ের তুলনায় আইনসঙ্গতভাবে দ্যু বেরির মতো অভিজাত নাম পেয়ে জানের আনন্দের সীমা রইল না। পিতামহ ফাবিয়্যাঁ বেক্যু যা করতে পারেনি, নাতনি জান সেটা করে দেখালেন। কিন্তু সমাজে নববধূকে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া তখন শেষ হয়নি। এমন একজন ধর্মমায়ের প্রয়োজন যিনি রাজপ্রাসাদের কোনো ভোজসভায় অভিজাত সমাজে জানকে পরিচয় করিয়ে দেবেন। অতি প্রাচীন এক অভিজাত পরিবারের এক অতিবৃদ্ধ কাউন্টেস গালার দ্য বেয়ার্ন এই কাজ করতে রাজি হলেন এই শর্তে যে তার জুয়াখেলার বিপুল ঋণ রাজা পরিশোধ করে দেবেন।

মাদাম গালার দ্য বেয়ার্নতো জানতেন, মাদাম দু বারি আসলে কে। গায়ের জোরে কি দিনকে রাত করা যায়? কেউ যদি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়! তখন কোথায় যাবে রাজার সন্মান, এমনকি তাঁর নিজের সম্মানও? এই সব দুশ্চিন্তায় প্রাসাদের হলরুমে ঢোকার সময় বৃদ্ধা কাউন্টেস আছাড় খেয়ে পা মচকে ফেলেছিলেন। সুতরাং পিছিয়ে গেল মাদাম দ্যু বারির উপস্থাপন অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় বার যখন দিন ঠিক হলো, শিকার করতে গিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে রাজা হাত ভেঙে ফেললেন। অবশেষে ২২শে এপ্রিল, ১৭৬৯ তারিখে ভার্সাই প্রাসাদের শিশমহল হলরুমে মাদাম দ্যু বারিকে আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সভাসদদের সঙ্গে। বাইরে অপেক্ষমান উৎসুক জনতার সামনেও হাজির হয়েছিলেন রাজা মাদামকে বগলদাবা করে। কথাপ্রসঙ্গে বলি, চতুর্দশ লুইয়ের তৈরি ভার্সাইয়ের মতো সুন্দর রাজপ্রাসাদ, এমন পরিকল্পিত, চমৎকার উদ্যান পৃথিবীতে নেই এবং আমি যতদূর দেখেছি, এই প্রাসাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ইওরোপের বেশির ভাগ রাজাপ্রাসাদ নির্মিত হয়েছে।

সেদিন জানের পরনে ছিল অতি প্রশস্ত প্যানিয়ারযুক্ত গাউন (গাউনকে ফোলানোর জন্যে হালকা ধাতুনির্মিত খাঁচাকে বলা হয় 'প্যানিয়্যার' বা ফরাসিতে 'পানিয়ে' যার অর্থ 'ঝুড়ি' বা 'খাঁচা')। গাউনের রঙ ছিল সাদা, সোনার এমব্রয়ডারি করা এবং এখানে-ওখানে রতœখচিত। রতœগুলো রাজা আগের দিন রাতেই পাঠিয়েছিলেন দ্যু বারিকে। রিশলিউ বিশেষভাবে ফরমায়েশ দিয়ে জানের জন্যে এই গাউন তৈরি করিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা লিখেছেন, এমন স্ন্দুর ও দামী পোশাক আগে কখনও দেখা যায়নি (ফ্রান্সের ভার্সাইতে যদি না দেখা যায়, তবে সে সময় পৃথিবীর কোথাও দেখা যাবার কোনো কারণ নেই!) মাদাম দ্যু বারির কেশকলাপও নাকি দেখার মতো হয়েছিল। চুল ঠিকঠাক করতে জানের এত সময় লেগেছিল যে তিনি ঠিক সময়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি।

বছর পাঁচেক মাত্র রাজার প্রমোদ-সঙ্গিনী ছিলেন মাদাম দ্যু বারি, যেখানে মাদাম পম্পাদুরের সঙ্গে রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সম্পর্ক ছিল প্রায় কুড়ি বছর। যেহেতু পঞ্চদশ লুইয়ের পর ফ্রান্সের আর কোনো রাজার প্রমোদ-সঙ্গিনী ছিল না, সেহেতু মাদাম দ্যু বারিই ফরাসি রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সর্বশেষ রাজকীয় প্রমোদ-সঙ্গিনী। রাজকীয় আদব-কায়দা তিনি ভালোই শিখেছিলেন। ভালোবেসে রাজা তাঁকে ডাকতেন 'মাদমোয়াজেল অ্যাঞ্জেল'। এই নামে জানের জন্মের প্রতি ইঙ্গিত আছে বলে সন্দেহ করেছেন ইতিহাস-ভাষ্যকারেরা (যীশুর জন্ম হয়েছিল এক দেবদূতের মাধ্যমে এবং জানের জন্মদাতা গীর্জার যাজক!)। রাজা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন তার ঠিক উপরের আপার্টমেন্টেই থাকতে মাদাম দ্যু বারি। দুই অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে গোপন সিঁড়ি ছিল এবং সেই সিঁড়ি দিয়ে প্রয়োজনমতো উপরে উঠে আসতেন রাজা পঞ্চদশ লুই। রাজা জানের জন্যে ছিলেন (বাংলায় যাকে বলে একেবারে) জানপরাণ বা লবেজান। এতটাই ভালোবাসতেন এই বৃদ্ধ রাজা তাঁর তরুণী ভার্যাকে যে জানের মা আনকে কাউন্টেস খেতাব দিয়েছিলেন তিনি, দিয়েছিলেন বিলাসবহুল এক অ্যাপার্টমেন্ট। রাজা নাকি একবার বন্ধু ডিউক অব নোয়াইকে অন্তরঙ্গ আলাপে বলেছিলেন মাদাম দ্য বেরি তাঁকে কী পরিমাণ আসঙ্গসুখ দিয়ে থাকেন। 'ইওর এক্সেলেন্সির এমনটা মনে হচ্ছে, কারণ', উত্তর দিয়েছিলেন ডিউক অব নোয়াই: 'ইওর এক্সলেন্সি কোনোদিন প্রমোদপল্লীতে যাননি!'

রাজা মাদাম দ্যু বারিকে বিভিন্ন মন্ত্রণাসভায় আমন্ত্রণ জানাতেন, কিন্তু রাজনীতিতে মাদাম দ্যু বারির তেমন আগ্রহ ছিল না। তাঁর পছন্দ ছিল সাজগোজ, অলঙ্কারপাতি এবং একজন পেশাদার যৌনকর্মীর মতো রাজাকে সর্বোচ্চ মানের আসঙ্গসুখ দেওয়া। রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের অন্যান্য প্রমোদ-সঙ্গিনী, যেমন মাদাম দ্যা পম্পাদুরের মতো রাজনৈতিক ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাতেন না দ্যু বারি। কিন্তু যেহেতু মন্ত্রী রিশলিউ ছিলেন তাঁর অভিভাবক, ওঁর আদেশে রাজার কয়েকটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন বৈকি। কোনো কারণে এক কাউন্ড দম্পতি– কাউন্ট ও কাউন্টেস লুসেনের মৃত্যুদ- হয়েছিল। মাদাম দ্যু বারি কাউন্ট দম্পতির মৃত্যুদ- মওকুফ করতে অনুরোধ করেছিলেন রাজাকে। রাজার পায়ে পড়ে ছিলেন মাদাম দ্যু বারি, যতক্ষণ না রাজা ক্ষমা করতে রাজি হয়েছেন। 'আপনি আমার কাছে এই প্রথম একটি সুবিধা চাইলেন এবং কী আশ্চর্য! সেই সুবিধাটা নিজের জন্যে নয়, অন্য কাউকে ক্ষমা করার জন্যে। আমি খুবই খুশি হয়েছি, মাদাম!' বলেছিলেন রাজা মাদাম দ্যু বারির প্রশংসা করে। আরও এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড তিনি মওকুফ করিয়েছিলেন যে কিনা এক মৃত শিশুর জন্ম দিয়ে সেই মৃত্যুর খবর পুলিশকে জানায়নি (সেযুগে এটা মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য অপরাধ, হয়তো এ যুগেও, কারণ প্রসূতি যে শিশুটিকে খুন করেননি তার প্রমাণ কী!)।

মাদাম দ্যু বারি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভালোমানুষ। যারা তাঁর বিরোধী ছিল, এমনকি তাঁকে যারা ঘৃণা করতো, তাদের প্রতি মাদাম পম্পাদুরের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতেন না মাদাম দ্যু বারি। তিনি সর্বান্তকরণে চাইতেন, সবার ভালো করতে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে। কিন্তু তবুও খুব বেশি লোক কথা বলতো না মাদাম দ্যু বারির সঙ্গে। তাদের দুঃখ একটাই– একটা রাস্তার প্রমোদবালা কীভাবে রাজপ্রাসাদে স্থান পায়, কীভাবে তাঁদের মতো অভিজাত হয়ে উঠে! লোকের হাসি-টিটকারির ভয়ে রাজার সঙ্গেও বাইরে বেরুতেন না তিনি। সুতরাং বেশির ভাগ সময় ঘরে একা একাই সময় কাটাতে হতো মাদাম দ্যু বারিকে।

জানের সাবেক দালাল এবং পরবর্তীতে ভাসুর জঁ ব্যাপটিস্ত দ্যু বারি ভ্রাতৃবধু জানকে অভিজাত সহবৎ শেখানোর জন্যে লঙ্গদক এলাকা থেকে নিয়ে এসেছিলেন ক্ল্যার ফ্রঁসোয়াজ নামে এক শিক্ষিকাকে। এছাড়া মার্শাল মিরপোয়া নামে এক অভিজাত নারীও ভালো রকম ঘুসের বিনিময়ে জানের বান্ধবী হয়েছিলেন। রাজা পঞ্চদশ লুই মাদাম দ্যু বারিকে এক ভৃত্য উপহার দিয়েছিলেন। এই ভৃত্যের নাম ছিল জামর (জামির, জামিল, জামাল?)। ঐতিহাসিকেরা লিখেছেন, জামর ছিলেন আফ্রিকান বান্টু বংশোদ্ভূত এবং তার জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রামে (আরও প্রায় ত্রিশ বছর পর সংঘঠিত হওয়া ফরাসি বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন জামর এবং কাগজপত্রে নিজের জাতীয়তা লিখেছিলেন:বাঙালি)। রাজা পঞ্চদশ লুই প্যারিসের দাস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন জামরকে। এই তিনজন ছাড়া আর বিশেষ কেউ মিশতো না জানের সঙ্গে।

মাদাম দ্যু বারির দিন শুরু হতো জামরের হাতে এক কাপ গরম চকলেট খেয়ে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান থাকলে চুল বাঁধতে আসতেন সে যুগের বিখ্যাত কেশশিল্পী নোকেল, প্রতিদিন চুল বেঁধে দিতেন বার্লিন নামের আরেকজন কেশশিল্পী। তার পর পছন্দসই একটা পাতলা গাউন আর ম্যাচিং করা অলঙ্কারপাতি পরে মাদাম ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসতেন। এর পর স্যাঁকরা, দর্জি, বিভিন্ন কারুশিল্পী, চিত্রকরেরা হাজির হতেন একে একে যার যার নমুনা কিংবা পণ্য নিয়ে। যদিও শিক্ষিত ছিলেন না খুব একটা মাদাম দ্যু বারি তবুও আসবাব, স্থাপত্য, পোষাক, গ্যাস্ট্রোনমি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই নতুন উদ্ভাবনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। মাতামহ এবং মা রাঁধুনি ছিলেন বলেই হয়তো খাবারের প্রতি ভালোবাসাটা জন্মসূত্রেই পেয়েছিলেন মাদাম দ্যু বারি। এখনও বেশ কয়েকটি স্যুপ আছে মাদাম দ্যুবারির নামে। পোশাকের ক্ষেত্রে মাদাম দ্যু বারি প্রবর্তন করেন স্ট্রাইপ কাপড় যা অধ্যাবধি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রত্যেক রাজার আমলে তৈরি ভবন, আসবাস, খাবার, ফ্যাশন, কেশকলাপ বা হেয়ার-স্ট্যাইল ইত্যাদির পৃথক, অনন্য শৈলী ছিল– চতুদর্শ লুই এবং পঞ্চদশ লুই ফরমায়েশে তৈরি চেয়ার বা টেবিল এক রকম নয়। অনেকটা জান দ্যু বারির পছন্দের ভিত্তিতেই নাকি ষোড়শ লুইয়ের স্টাইল সৃষ্টি হয়েছিল।


শিক্ষিত লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর। ভলতেয়ারের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা করতে যেতেন। ভলতেয়ারের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একদিন ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ব্রিসোঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল মাদাম দ্যু বারির। ব্রিসোঁ তখন তরুণ, অখ্যাত, মাত্র প্যারিসে এসেছেন ভাগ্যাস্বেষণে। ভলতেয়ারের রচনা পড়ে ব্রিসোঁ তাঁকে গুরুপদে বরণ করেছিলেন, কিন্তু পরিচয় ছিল না তাঁর সঙ্গে, ভলতেয়ারের মতো নামীদামি লোকের বাড়িতে ঢোকার সাহসটুকুও ছিল না। মাদাম দ্যু বারি ব্রিসোঁকে নিজে থেকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ভলতেয়ারের সঙ্গে। ভলতেয়ারকে কোনো চিঠি হয়তো লিখেছিলেন মাদাম দ্যু বারি, চিঠির কাগজে ওষ্ঠরঞ্জনী মাখা ঠোঁটের দুটি ছাপ দিয়ে, যার উত্তরে ভলতেয়ার লিখেছিলেন একটি চার্লাইন বা চতুর্পঙতি যার অনুবাদ লেখার শুরুতে দেওয়া হয়েছে।

সবাই ভাবছিল, পঞ্চদশ লুইয়ের নাতি ষোড়শ লুইয়ের বিবাহ-অনুষ্ঠানে ছোট জাতের মেয়ে, প্রাক্তন প্রমোদবালা মাদাম দ্যু বারিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। কিন্তু তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হলো শুধু নয়, সেজেগুজে সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো মাদামকে শ্রেফ রাজাকে দৃষ্টিসুখ দিতে। বিয়ের কনে মারি অন্তোয়ানেত অস্ট্রিয়ার সম্রাটের কন্যা, বছর পনেরো বয়স। মাদাম দু বারিকে এত গুরুত্ব পেতে দেখে এক সভাসদকে মারি অন্তোয়ানেত ওঁর পরিচয় জিগ্যেস করলেন। 'ওঁর কাজ রাজাকে আনন্দ দেওয়া!' শুনে নাতবৌ মারি অন্তোয়ানেত উত্তর দিল: 'ও তাই নাকি! সেক্ষেত্রে আমিই হবে ওঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। আমিওতো রাজাকে আনন্দ দিতে চাই!' সভাসদ মারি অন্তোয়ানেতকে বলেছিল: '(দাদাশ্বশুর) রাজাকে অমনধারা আনন্দ না দিলেই আপনি ভালো করবেন!'

রাজার নাতিবৌ মারি অন্তোয়ানেত ভিয়েনা থেকে এসেই মাদাম দু বারির বিরুদ্ধপক্ষে যোগ দিলেন। অস্ট্রিয়ার সম্রাটের কন্যা মেনেই নিতে পারছিলেন না ভার্সাই রাজপ্রাসাদের এই অনাচার। একজন প্রমোদ-সঙ্গিনী কেন রাজপ্রাসাদে থাকবে? অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে ভিয়েনা থেকে প্যারিসে চলে এসেছিলেন বলে মারি অন্তোয়ানেত জানতেন না যে তাঁর পিতারও একাধিক প্রমোদ-সঙ্গিনী ছিল। মাদাম দ্যু বারির উপস্থিতি সহ্য করতে পারতো না পঞ্চদশ লুইয়ের মেয়েরাও। বেশ কয়েকটি মেয়ে ছিল পঞ্চদশ লুইয়ের। এরা বিয়ে করেনি একজনও, কেউ কেউ গীর্জার সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়েছিল। এই আইবুড়ো পদি পিসি (পিউরিটান) ননদেরা নতুন বৌয়ের কান ভারী করতে লাগলো।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোয়াসল মারি অন্তোয়ানেত আর ষোড়শ লুইয়ের বিয়ের ঘটক ছিলেন। শোয়াসল ছিলেন রিশলিউর প্রতিদ্বন্দ্বী। মারি অন্তোয়ানেতকে শোয়াসল দ্যু বারি সম্বন্ধে সাবধান করলেন। এত শত কানকথা আর উপদেশ শুনে শুনে মারি অন্তোয়ানেত এত বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলেন দাদাশ্বশুরের সর্বশেষ প্রেমিকাকে যে তাঁর সাথে বাক্যবিনিময় করতেও তিনি অনিচ্ছ'ক ছিলেন। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে এতটাই দৃষ্টিকটু হয়ে উঠলো যে কূটনৈতিক শিষ্টাচার প্রায় লঙ্ঘন করছিল। এক পর্যায়ে মারি অন্তোয়ানেতের অপমানকর আচরণ সম্পর্কে মাদাম দ্যু বারি রাজার কাছে অনুযোগ করলেন। রাজাও মারি অন্তোয়ানেতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূতের কাছে। ভিয়েনা আর প্যারিসের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার উপক্রম হলো। ভিয়েনা থেকে সম্রাজ্ঞী মা এবং তাঁর শিক্ষকেরা বার বার মারি অন্তোয়ানেতকে দ্যু বারির সঙ্গে অন্ততপক্ষে সৌজন্য বিনিময়ের জন্যে চাপ দিচ্ছিলেন। নিতান্ত বাধ্য হয়ে মারি অন্তোয়ানেত জীবনে একটি মাত্র বাক্য বলেছিলেন মাদাম দ্যু বারিকে: 'আজ ভার্সাইতে প্রচুর লোক! নববর্ষ উপলক্ষে, তাই না!' বাক্যটি ফরাসি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।

একাধিক কবি নোংরা, যৌনগন্ধী চটি সাহিত্য রচনা করেছিলেন মাদাম দ্যু বারিকে নিয়ে। একটি রচনার শিরোনাম ছিল 'ফ্যাশনেবল মেয়ের সুশিক্ষা' বা 'উন্মাদ রাজার দেবতায় রূপান্তর'। কয়েকটি নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছিল মাদাম দ্যু বারি ও রাজাকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোয়াসল কলকাঠি নাড়ছিলেন যাতে ফকল্যান্ড দ্বীপের মালিকানা নিয়ে স্পেনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে ফ্রান্স স্পেনকে সমর্থন করে। মাদাম দ্যু বারি এই খবর দিলেন রাজাকে। রাজা যুদ্ধ চাইছিলেন না। শান্তিকামী রাজা অনতিবিলম্বে শোয়াসলকে পদচ্যুত করলেন। এতে দ্যু বারির প্রতি মারি অন্তোয়ানেতের ঘৃণা সমধিক বৃদ্ধি পেলো। দ্যু বারির সঙ্গে পিতার যৌন সম্পর্কের পাপস্খালনের উদ্দেশ্যে ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৭৭০ তারিখে পঞ্চদশ লুইয়ের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা লুইজ গীর্জায় সন্ন্যাসিনী হয়ে গেলেন। লুইজের মাথায় আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাসিনীর চাদর পড়ালেন মারি অন্তোয়ানেত।

ফরাসি বিপ্লবের হোতারা ষোড়শ লুইয়ের পত্নী রাণী মারি অন্তোয়ানেতের দোষ দিতেন এই বলে যে তিনি রাজকীয় অর্থের অপচয় করতেন। অপচয়ে মাদাম দ্যু বারিও কম যেতেন না। প্রতি মাসে রাজা তাঁকে হাতখরচ দিতেন ৩০০ পাউন্ড, সে যুগের হিসেবে অনেক টাকা। তবুও প্রতি মাসেই ঋণ হতো দ্যু বারির। এই মহিলা খরচ করতে পারতেন বটে। পোষাক আর অলঙ্কারে ব্যয় করতেন তিনি সব টাকা। এক পর্যায়ে তাঁর ঋণের পরিমাণ তিন লক্ষ পাউন্ডে দাঁড়িয়েছিল। এ যুগের হিসাবেও এটা অনেক টাকা বটে।

হায়! 'কপালে সবার নাকি সুখ সয় না! সবাইতো সুখী হতে চায়!' সব বিরোধিতার অবসান হয়ে মাদাম দ্যু বারির সুখের সময় যেই শুরু হলো, তখনি রাজার মৃত্যু হলো গুটিবসন্তে, ১৭৭৪ সালের ১০ই মে। মৃত্যুশয্যায় রাজার পাশে উপস্থিত ছিলেন রাজার দুই কন্যা এবং মাদাম দ্যু বারি। মৃত্যু সন্নিকট বুঝে রাজা জানকে নিজের বাড়ি চলে যেতে অনুরোধ করেন, জান যাতে সংক্রমিত না হন এবং রাজাও মুত্যুকালীন খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা: পাপ স্বীকার, প্রার্থনা ইত্যাদি শুরু করতে পারেন। এই যে সংক্রমণ এড়ানোর জন্যে জানকে চলে যেতে বলা– এটাও জানের প্রতি বৃদ্ধ রাজার ভালোবাসার নিদর্শন নয় কি?

স্ত্রীর প্ররোচনায় ষোড়শ লুই পিতামহের এই সর্বশেষ প্রেমিকাটিকে পছন্দ করতেন না। অবশ্য ষোড়শ লুই এতটাই দ্বিধাচিত্ত লোক ছিলেন যে তিনি নিজে কী পছন্দ করতেন বা না করতেন তা বলা মুশকিল। সব সময় তিনি অন্য কারও, প্রধানত রাণী মারি অন্তোয়ানেতের কথামতো কাজ করতেন। রাজার মৃত্যুর পর পরই রাজা ষোড়শ লুই দ্যুবারিকে প্রথমে নির্বাসন দিলেন। নির্বাসন অবশ্য দীর্ঘায়িত হয়নি। বছর খানেক পর থেকেই দ্যু বারি প্যারিসের অদূরে ল্যুভসিয়েন প্রাসাদে বাস করার অনুমতি পান। পঞ্চদশ লুই এই প্রাসাদটি মাদামকে ভোগদখলের স্বত্বে/শর্তে দান করেছিলেন।


আগেই বলেছি, মাদাম দ্যু বারি কাপড়চোপড় এবং অলঙ্কারের ভীষণ শখ ছিল। পছন্দের রত্ন ছিল হীরা, কান আর গলা হীরা দিয়ে মুড়ে রাখতেন তিনি। ১৭৭২ সালে সে যুগের বিখ্যাত অলঙ্কারশিল্পী শার্ল বোহমারের কাছে মাদাম দ্যু বারির জন্য একটি দামি নেকলেসের ফরমায়েশ করেছিলেন রাজা। ২৮০০ ক্যারেট হীরা ব্যবহৃত হয়েছিল সেই নেকলেসে এবং আজকের বাজার দরে নেকলেসটির মূল্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। রাজার মৃত্যুর পর যে কোনো কারণেই হোক নেকলেসটি আসে রাণী মারি অন্তোয়ানেতের হাতে। রাণী নাকি নেকলেসটি মাদাম দ্যু বারিকে না দিয়ে কালো বাজারে বিক্রি করে দেন। এদিকে বাজারে গুজব রটে যে রাজাকে দিয়ে এক বিশপের পদচ্যুতির আদেশ রহিত করতে রাণী মারি অন্তোয়ানেত সেই নেকলেস ঘুস নিয়েছেন। পুরোটাই হয়তো গুজব। কিন্তু রাজপরিবারের অপচয়ের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হলো এই গুজব এবং বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে রাজা ও রাণীর জনপ্রিয়তা হ্রাসে এই গুজবের ভালো রকম ভূমিকা ছিল। এই ঘটনায় মাদাম দ্যু বারির প্রতি মারি অন্তোয়াতের ঘৃণা আরও বেড়ে যায়।

১৭৮৯ সালে শুরু হয় ফরাসি বিপ্লব। বিপ্লবের আগে পর্যন্ত মাদাম দ্যু বারি ল্যুভসিয়েন প্রাসাদেই ছিলেন, শান্তিতেই ছিলেন। পঞ্চদশ লুইয়ের উপহার দেওয়া ভৃত্য জামর তখনও ছিল মাদামের বাড়িতে। জামরকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতেন মাদাম দ্যু বারি, যেন এক জীবন্ত পুতুল। জামর যে একজন জীবন্ত মানুষ সেটা যেন ভুলেই যেতেন মাদাম দ্যু বারি। জামর ওঁর মালকিনের এইসব পাগলামী মেনে নিতো, কিন্তু সব সময় হয়তো সহ্য করতে পারতো না। প্রতিবেশিরা কিন্তু মাদাম দ্যুবারির সহৃদয়তার জন্যে তাঁকে খুবই পছন্দ করতো। গীর্জায় বাচ্চাদের ধর্ম মা হতে অনুরোধ করা হলে তিনি সাধারণ লোকজনের সেই অনুরোধ রাখতেন। মাদাম দ্যু বারিতে পরিণত হলেও জান নিজের বেক্যু পরিবারের লোকদের বিস্মৃত হননি। নিজের একাধিক আত্মীয়াকে বিয়ে দিয়েছেন অভিজাত পরিবারে।

ষোড়শ লুই সিংহাসনে বসার তিন বছর পর ১৭৭৭ সালে অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় জোসেফ ছদ্মবেশে ফ্রান্সে আসেন বোন মারি অন্তোয়ানেতের সঙ্গে ভগ্নীপতি ষোড়শ লুইয়ের পারিবারিক খিটিমিটি মেটাতে। জান দ্যু বারির সঙ্গে তাঁর ল্যুভসিয়েনের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন সম্রাট, কিন্তু মন্ত্রী শোয়াসলের সঙ্গে দেখা করেননি। এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন মারি অন্তোয়ানেত। মাদাম দ্যু বারিকে খুব একটা আকর্ষণীয়া মনে করতেন না সম্রাট জোসেফ। কিন্তু অতিথি সম্রাটকে অভ্যর্থনা করতে এসে ড্রয়িং রুমে ঢোকার জন্য পথ করে দিতে মাদাম দ্যু বারি ভদ্রতা করে যখন সম্রাটকে বললেন: 'আপনি আগে যান!', সম্রাট উত্তর দিয়েছিলেন: 'মাদাম, আপনিই আগে যাবেন, নারীর সৌন্দর্যের ক্ষমতায় কখনও ভাটা পড়ে না, দি বিউটি ইজ অলওয়েজ দি কুইন!'

রাজকীয় রক্ষী বাহিনীর অফিসার কাউন্ট ব্রিসাক ছিলেন জান দ্যু বারির সার্বক্ষণিক প্রেমিক। সেইমুর নামে এক ইংরেজ কাউন্টের সঙ্গেও দ্যু বারির খণ্ডকালীন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্রিসাক জানকে সাফ জানিয়ে দিলেন: 'মেরি জান! (উভয়ার্থে) হয় আমি, না হয় ও!' ব্রিসাকের অনমনীয় মনোভাবের কারণে সেইমুরের সঙ্গে জান সম্পর্কচ্ছেদ করতে বাধ্য হন। সেইমুর লন্ডন থেকে একটি তৈলচিত্র উপহার পাঠান মাদাম দ্যু বারিকে। চিত্রের শিরোনাম ছিল: 'লিভ মি এলোন!' মাদাম দ্যু বারি সেইমুরকে ছেড়ে ব্রিসাকের প্রতি একনিষ্ঠা হলেন।

ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজকীয় রক্ষীবাহিনী বাতিল করা হয়। মাদামের প্রেমিক ব্রিসাককে পদচ্যুত ও বন্দী করা হয় এবং ১৭৯২ সালের সেপ্টেম্বরের গণহত্যা চলাকালীন ব্রিসাককে হত্যা করা হয়। এ সময় একদিন বাড়ির বাইরে হৈচৈ, রাগান্বিত চিৎকার শুনে মাদাম দ্যু বারি যেই তাঁর ড্রয়িংরুমের জানালা খুললেন, অমনি একটি রক্তমাখা কাপড়ের পুটলি উড়ে এসে পড়লো ঘরে। পুটলি খুলে দেখা গেল, ভিতরে ব্রিসাকের তাঁর ছিন্ন মস্তক। কয়েকটি কারণে বিপ্লবীদের সন্দেহের তালিকায় নাম উঠে এসেছিল মাদাম দ্যু বারির। বিপ্লবের শুরু থেকেই রাজসভার সদস্যরা অস্ট্রিয়া-লন্ডন-জার্মানিতে অভিবাসী হয়েছিলেন আত্মরক্ষার্থে। মাদাম দ্যু বারি রাজসভার এই অভিবাসী সদস্যদের সাহায্য করছিলেন। প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গেও হয়তো তাঁর যোগাযোগ ছিল। আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, অভিজাতদের সঙ্গে মাদাম দ্যু বারির সম্পর্ক কিশোরী বয়স থেকেই।

মাদাম দ্যু বারির মনটা যে কোমল ছিল তার প্রমাণ, চিরশত্রু মারি অন্তোয়ানেতের সঙ্গেও দেখা করতে গিয়েছিলেন মাদাম দ্যু বারি, বিপ্লবের সময়ে, যখন মারি অন্তোয়াতের অবস্থা সঙ্গীন। ওঁর সঙ্গে দেখা করাটাও মাদাম দ্যু বারির পক্ষে বিপদজনক ছিল, কারণ এই সাক্ষাতের কারণে বিপ্লবীরা তাঁকে প্রতিবিপ্লবী হিসেবে সন্দেহ করতে পারতো। ভাঙবে তবু মচকাবে না। মারি অন্তোয়ানেত সেবারেও জান বেক্যুকে একেবারেই পাত্তা দেননি। ১৭৯১ সালে মাদাম দ্যু বারির সমস্ত গহনা চুরি হয়ে যায়। চুরির মাস্টার মাইন্ড ছিলেন এক ইংরেজ কূটনীতিক। কয়েকবার লন্ডনে গিয়েও মাদাম দ্যু বারি তাঁর গহনার হদিশ করতে পারেননি। এদিকে বার বার লন্ডন যাওয়াতে বিপ্লবীরা সন্দেহ করলো যে তিনি সেখানে যাচ্ছেন আসলে অভিবাসী প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

১৭৯৩ সালে মাদাম দ্যু বারিকে সন্দেহভাজনদের তালিকাভূক্ত করা হয়। মাদামের দ্যু বারির প্রধান ভৃত্য জামর ততদিনে জাকোব্যাঁদের দলে যোগ দিয়েছিল এবং মাদাম তাকে চাকরিচ্যুত করেছেন। দীর্ঘদিনের ভৃত্য এই জামরই মাদাম দ্যু বারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন বিপ্লবী আদালতে। অভিযোগপত্রে জামর জানিয়েছিল যে তার জন্মস্থান চট্টগ্রাম এবং তার জাতীয়তা বাঙালি। ল্যুভসিয়েনের ৫৯ জন অধিবাসী মাদাম দ্যু বারিকে নির্দোষ দাবি করে তাঁকে মুক্তি দেবার আবেদন করেছিলেন। সে আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। ৬ই ডিসেম্বর, ১৭৯৩ তারিখে ফুকিয়ে ত্যাঁভিলের পরিচালনায় বিপ্লবী আদালত মাদাম দ্যু বারিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচতে মাদাম দ্যু বারি ঘুস দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার দিন সরকারি নাপিত যখন মাদাম দ্যু বারির ঘাড়ের চুল কামাতে আসে (ঘাড়ের চুল কামানোর কারণ, গিলোটিনের খড়গ যখন ঘাড়ের উপর এসে পড়বে, তখন সেটা যেন চুলে পিছলে না যায় (জল্লাদের জন্যে অনর্থক ঝামেলা!), তিনি তখন তাকে জানান, নিজের অলঙ্কারগুলো কোথায় আছে তিনি জানেন এবং সবই বিপ্লবী সরকারকে তিনি দিয়ে যেতে চান, কিন্তু অলঙ্কারগুলোর তালিকা করার জন্যে তাঁর কয়েক ঘণ্টা সময় দরকার। ডাহা মিথ্যা কথা, যদিও এতে ঘণ্টা তিনেক বেশি বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন মাদাম দ্যু বারি। এই সব অলঙ্কার মাদামের মৃত্যুর পর ১৭৯৫ সালে লন্ডনে ক্রিস্টির নিলামে উঠেছিল।


সাধারণত গিলোটিনে যাঁদের মাথা কাটা হতো, তাঁরা বেশ নির্বিকার থাকতেন, কান্নাকাটি হৈচৈ করতেন না। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা বাঈয়িকে যখন গিলোটিনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঝড়বৃষ্টির ভিতর দিয়ে, মধ্যবয়ষ্ক বাঈয়ি তখন থর থর করে কাঁপছিলেন। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফাজিল দর্শকদের একজন তাঁকে জিগ্যেস করলো: 'তুমি কি কাঁপছো, বাঈয়ি?' নির্বিকার বাঈয়ি উত্তর দিয়েছিলেন: 'হ্যাঁ কাঁপছি, তবে মৃত্যুভয়ে নয়, শীতে!' মাদাম দ্যু বারিকে বধমঞ্চে নিয়ে যাবার জন্যে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তখন তিনি প্রাণভয়ে এতটাই চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগলেন যে পশুর মতো টেনেহিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো গিলোটিনের দিকে। 'কেন আমাকে মারছো তোমরা? কী দোষ করেছি আমি!' চিৎকার করে বলছিলেন মাদাম দ্যু বারি জল্লাদকে, দর্শকদের। গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেখতে প্রচুর দর্শক জড়ো হতো –মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখা ছিল বহু যুগ ধরে ইওরোপের বিনি পয়সার বিনোদন। একদিকে এই দর্শকেরা মাদাম দু বারির কান্নাকাটি দেখে উত্তেজিত হচ্ছিল, অন্যদিকে জল্লাদের কাছে মাথা কাটাটা একটা কাজ বৈতো নয়। 'আমাকে বাঁচাও! আমি বাঁচতে চাই!'–দর্শকদের অনুনয় করছিলেন মাদাম দ্যু বারি। এদিকে ঝামেলা তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইছিল জল্লাদ, কারণ তারতো আরও অনেক মাথা কাটতে হবে। চিৎকার-চেঁচামেচির কারণে মাদাম দ্যু বারি বরং অন্যদের তুলনায় কয়েক মিনিট আগেই মরলেন। যে জনতা থেকে উঠে এসেছিলেন জান, ময়ূরপ্চ্ছু পড়ে কাক থেকে ময়ূর হয়েছিলেন, সেই জনতা নির্দয়ভাবে খুন করলো জানকে।

৮ই ডিসেম্বর, ১৭৯৩ এখন প্যারিসে যেখানে কনকর্ড চত্বর সেখানে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয়েছিল মাদাম দ্যু বারির। তখন তাঁর বয়স ৫০। গিলোটিনে মাথা রাখার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে জল্লাদের প্রতি মাদাম দ্যু বারির সর্বশেষ বাক্যটি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে:

'মসিয়ো, আর একটি মুহূর্ত অপেক্ষা করুন না! পৃথিবীকে শেষবার একটু দেখে নিই!'