পদকের পোদ্দারী

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
Published : 25 Feb 2020, 06:44 AM
Updated : 25 Feb 2020, 06:44 AM


সুন্দরবনে রূপসা ও শিবসা যেখানে মিশেছে সেই নলেনের মোহনায় যখন তারা পৌঁছাল তখন ঘোর সন্ধ্যা। খুলনা থেকে দুপুরে রওনা দিয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বায়োলজি স্কুলের ২৫ জন ছাত্র ছাত্রী। শ্রাবণের এ সময়টাতে সাধারণত: কেউ এভাবে বাদা ভ্রমণে বের হয় না। কিন্ত মানুষ ও প্রকৃতির বিশেষ একটা ব্যবস্থাপনা বোঝার জন্য অসময়ের এই শিক্ষা সফর। শশ্রুমন্ডিত অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমেদ বিগত বেশ কয়েক বছর সুন্দরবনের একটি বিশেষ প্রজাতির গাছ ও প্রাণির মধ্যে মোহনীয় সম্পর্কের স্বরূপ সন্ধানে নেমেছেন। তাঁর ধারণা একটা বিশেষ কো-রিলেশন আছে এ ব্যাপারটার মধ্যে। গাছের জীবন আছে স্যার জগদীশ চন্দ বসু তা বলে গিয়েছেন আর প্রাণির তো জীবন আছেই। এই দুই জীবনের মধ্যে ভাব বা মেলবন্ধন কি হতে পারে না? দু'জনে দু'জনার এ ধারণা যেমন আছে এবং তেমনি 'আজ দু'জনার দুটি পথ দু'দিকে গেছে বেঁকে' জাতীয় ব্যাপার স্যাপারও আছে। আবার 'রেল লাইন চলে সমান্তরাল-দু'জন দু'জনের নেয় না খবর এমনি আড়াল' এমন একটি অবস্থা কিনা আসহাব উদ্দীন আহমেদ তা ভাবনায় দিনাতিপাত করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু মুরশিদ মাওলার রুহানী সেবায় তিনি এমন ধরনের একটা উপলব্ধির সন্ধান পেয়েছেন। ইদানীং আসহাব উদ্দীন বিজ্ঞানের সাথে সুফিতত্ত্বের সংলাপ, মিল অমিল, পার্থক্য ও ঐকমত্য বিধানের বিষয়াবলী নিয়েই ভাবেন বেশি।

নলেনের বন অফিস থেকে পাশ নিয়ে ২ জন সশস্ত্র গার্ডসহ রাত আটটার দিকে তাদের লঞ্চ 'রূপসী খুলনা' গভীর বাদার পথে পশুর নদীর ভাটির পথে রওনা দিল। ভোর নাগাদ তাদের কচিখালি পৌঁছার কথা। সেখানে দিনভর একটি বিশেষ গাছের মানবিক আচরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ করবে এই গবেষক দল। সমুদ্রতটে আনন্দ বিহারের পরিকল্পনা তো আছেই, তবে যথাসতর্কতার নির্দেশনা দেয়া আছে সবার প্রতি, কেননা গতবার ২ জন মেধাবী তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই সাগর সৈকতে সাঁতার কাটতে যেয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়। অনন্তের পথে তাদের যে যন্ত্রনাময় যাত্রায় যেতে হয়েছিল তা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কাঁদিয়েছিল।

ছেলেমেয়েরা রাতের আহার সেরে লঞ্চের দোতালা পাটাতনে মিলিত হয়েছে সুনিবিড় অন্ধকারে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য ও নৈঃশব্দের নানা সুর ও সাধনার সাহচর্য লাভের জন্য। গানের আসর বসাতে চেয়েছিল আলো ঝলমল পরিবেশ রচনা করে। আসহাব উদ্দীন সাহেব 'না' করে দিয়েছেন- বলেছেন বনের প্রাণিকুলের সুখ নিদ্রার আঘাত ঘটানো কারো পক্ষে সমীচিন হবে না। তিনি মনে করেন এমনিতে সুন্দরবনের পর্দা পুসিদা ও সৌন্দর্যের স্বাতন্ত্র নানানভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে নানান কিসিমের মানুষের মাতামাতিতে। তেলবাহী ট্যাংকার, সারবাহী বার্জ ডুবছে সুন্দরবনের নদীতে, বনের বাতায়নে বিশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ পরিকল্পনায় দেশী বিদেশী বেনিয়ারা। সিডর আইলার আক্রমণ ও তার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফল তো আছেই। তিনি লঞ্চের শুধু হেডলাইট বাদে অপরাপর সকল আলো নিভিয়ে গভীর আত্মিক পরিবেশ রচনার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন নিশিথ নিশ্চুপ নিরাপত্তার অনুভব শুধু উপলব্ধির জন্য। দিনের কাজ রাতে আর রাতের কাজ দিনের করা প্রকৃতিসম্মত বা 'বাস্তবতা বান্ধব' নয়। সংঘাত ও সংঘর্ষের কারণ সৃষ্টি হয় বৈপরীত্যের বলয়ে। আসহাব উদ্দীন এটা দেখে খুব ব্যথা পান যে দেশের আমলারা রাজনীতিবিদদের মত আর রাজনীতিবিদেরা আমলাদের আচরণে নিষ্ঠাবান হয়ে পড়েছেন। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তবায়নে বালসুলভ আচরণের বাড়াবাড়ি চলছে তো চলছে। দেখা যাচ্ছে যার যা মানায় না- যার যা করার কথা না সে বিজ্ঞের মত তা করছে। আসহাব উদ্দীন মর্মাহত হন যখন দেশের জনৈক মন্ত্রী মনে করেন দিনের আলো বাঁচানোর জন্য সময় সদ্ব্যবহার্থে সময় গননা ১ ঘন্টা এগিয়ে আনার যে ব্যবস্থাপনা পৃথিবীর বহুদেশে অক্টোবর নভেম্বরে করা হয়, তিনি বিজ্ঞের মত বল্লেন সেদিন, এবার বাংলাদেশে শুরু করা অভ্যাসটি যদি সবাই ভাল মনে করেন তাহলে তার সরকার সদয় হয়ে সারা বছরের জন্য এই ব্যবস্থা জারী করবেন। এটা করে তিনি বা তারা দেশ ও জাতিকে 'কলঙ্কমুক্ত' তো করবেনই, গভীর 'কৃতজ্ঞতায়' অশেষ সম্মানের ভাগিদার করবেন। চাই কি এ জন্যে হয়ত বিশাল পদক পেয়ে যেতে পারেন তাদের প্রধান পুরোহিত। দেশে ও সমাজে আরেক অদ্ভুত আচরণ দেখে আসহাব উদ্দীন যুগপতভাবে বিস্মিত ও বিব্রত বোধ করেন। তিনি মর্মাহত হন এটা দেখে যে একজনের ভূমিকা বা সাফল্যকে অন্যের আত্মসাৎ করতে চাওয়ার প্রবণতা আবার তা অর্জনে ব্যর্থ হলে অন্যের সাফল্যকে পুরোটাই ব্যর্থ করে দেয়ার সফলতার সন্ধানে যেন নামেন সবাই।

রাত দুটো হবে সম্ভবত: আসহাব উদ্দীন তখন গভীর ঘুমে। স্বপ্ন নয়ত? হয়ত! তার মনে হল তিনি বিশাল এক মিলনায়তনে বসে আছেন। খুব শীঘ্র সেখানে একটা আন্তর্জাতিক টাইপের সম্মেলন শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে। বিশাল মঞ্চ চারধারে গোলাকার বসার জায়গা। উপর নীচে বিস্তৃত অনেকটা রোমের সেই এ্যাম্পিথিয়েটারের মত, গাজীপুরের জমিদার বাড়ীর নাট্যমঞ্চের মত। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল তার সিটেই একটা ফোল্ডার জাতীয় প্যাকেট। এর ভেতর অনেকগুলো কাগজপত্র কিন্তু সেগুলো এমন ভাব ও ভাষায় লেখা তিনি তা পড়তে পারলেন না। তবে ছবি আঁকা আছে কয়েকটি তা দেখে তার মনে হল পদক জাতীয় কিছু। তার মনে হল পদক বিতরনের কোন অনুষ্ঠান অথবা পদক বিষয়ক কোন কর্মশালায় তিনি এসেছেন। মিলনায়তনের আকার ও অঙ্গসৌষ্ঠব দেখে তার মনে হল নিছক কোন সেমিনার বা ওয়ার্কশপে আসেননি তিনি, এটি বড় ধরনের কোন সম্মেলন টম্মেলন হবে। এর মধ্যে শত শত কবুতর পাখা মেলে মিলনায়তন জুড়ে এমনভাবে উড়তে লাগল তাতে তাঁর মনে হল তারা শীতল বাতাসের ব্যবস্থা করছে। এমন প্রাকৃতিক তাপানুকুল ব্যবস্থাপনায় তিনি বিশেষ মুগ্ধ হলেন। ব্যাপারটি তার গবেষণার বিষয়ের কাছাকাছি। তার আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষা: যন্ত্র নয়, প্রকৃতি ও প্রাণীজগত থেকে আসুক সরাসরি সেবা। পুরো মিলনায়তনে এমন একটা শীতল অথচ মোলায়েম ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ফিরে এল, যেন সবাই বিশেষ সম্মেলনে সানন্দ সাহচর্য লাভ করতে পারে প্রজ্ঞাময় পরিবেশের।

আসহাব উদ্দীন তার চেনাশুনা বা জানা কাউকে দেখছেন না। সেখানে এক এক জায়গায় জটলা করে আছে বিভিন্ন প্রাণীকুল। সাদা রংয়ের বিড়াল, রঙ্গিন কাকাতুয়া, বাহারী বানর, চিত্রাহরিণ, পাখী, প্যাচা, পানকৌড়ি আরো কত কিছু। একেক গ্রুপের জন্য একেকটা এলাকা বসার জন্য। সকলের রংয়ের বাহারে এবং সুশৃঙ্খলভাবে বসার কারণে পুরো মিলনায়তনটি মনে হল ক্যানভাসে আঁকা রঙ্গীন চিত্রকর্ম। আসহাব উদ্দীন মনে করতে চেষ্টা করলেন বিশাল স্টেডিয়ামে ছেলেমেয়েরা রঙ্গীন ডিসপ্লে কার্ড উল্টিয়ে যেমন চিত্রমালা তৈরী করে তেমন। এখানে কোন কৃত্রিমতার বালাই নেই-বিভিন্ন রংয়ের ও প্রজাতির পশু পাখি সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান নিয়ে এই চিত্রময় পরিবেশ রচনা করেছে। আসহাব উদ্দীন দেখলেন সবাই কেমন সুশৃঙ্খল এবং পরিবেশের যথাগাম্ভীর্য বজায় রেখে চলেছে। কিছক্ষণের মধ্যে তাঁর কাছে প্রতীয়মান হল এটি আসলে একটি আন্তর্জাতিক না হলেও অন্তত জাতীয় পর্যায়ের পদক প্রদান অনুষ্ঠান। তিনটি বিষয়ে বা তিনজনকে পদক প্রদান করা হবে এ ধরনের একটা আয়োজন চলছে তিনি বুঝতে পারলেন। বড় মুশকিল হল তিনি তাদের ভাষা না পড়তে বা না বুঝতে পারছেন। এক পর্যায়ে এক মিনিটের মত সময়ে আসহাব উদ্দীন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন এবং সে ঘোর কেটে গেলে তিনি যেন সেখানকার কথা বোঝার ক্ষমতা ফিরে ফেলেন। যে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তা তিনি এখন সুস্পষ্ট বুঝতে পারছেন। তিনি দেখলেন অত্যন্ত সুদর্শন প্রকৃতির একটি নাদুস নুদুস বাঘ এলেন মঞ্চে, তার দু'পাশে সুদর্শন সুনয়না হরিণ, তাগড়া ধরনের একটি মহিষ, স্বাস্থ্যবান ও সুশ্রী শিয়াল এবং পেখম তোলা ময়ুর একই সাথে মঞ্চে নিজ নিজ আসনে বসলেন। ঘোষণা এলো সুন্দরবন রাজ্যে বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালনকারীদের বিশেষ পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছেন বাবাহকু (বাঘ, বানর, হরিণ ও কুমির) পর্ষদের প্রেসিডিয়াম প্রধান পরম সম্মানীয় সুন্দর মিয়া। তাঁর সাথে আছেন পর্ষদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও তথ্য বিভাগের প্রধান হরিণা হাপান, শান্তি ও সংঘর্ষ মোকাবেলা বিভাগের প্রধান মশিয়ান মহিষা, পর্ষদের আইন সভার প্রধান শিয়ালেন্দু মামাইয়া এবং পদক নির্বাচক মন্ডলীর সভাপতি ময়ুরানা মাধাভান। বোঝা গেল জাতীয় পদক প্রদান অনুষ্ঠান হওয়ায় এখানে পর্ষদের প্রেসিডিয়াম প্রধান, আইনসভা 'বনে জঙ্গলের' প্রধান পুরোহিত (স্পিকার), পদকের গুরুত্ব ও তাৎপর্যবাহী শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের প্রধান এবং পদক নির্বাচক মন্ডলীর প্রধান উপস্থিত আছেন। আসহাব উদ্দীনের কাছে আয়োজনটি অত্যন্ত পরিশীলিত ও তাৎপর্যমন্ডিত মনে হল। ঘোষক অনুষ্ঠানের কাঠামো জানিয়ে দিলেন সকলকে-প্রথমে 'পদকের পোদ্দারী' সম্পর্কে মূল কর্মপত্র পেশ করবেন কান্ডজ্ঞান প্রসারন ফাউন্ডেশনের প্রধান প্রদায়ক শঙ্খ শাখালিয়া। ঘোষক উল্লেখ করলেন শঙ্খ শাখালিয়া ইনস্টিটিউট অব ফরেষ্টোলজির সম্মানিত ফেলো এবং পদক অর্জন বর্জন ব্যবহার ও অপব্যবহার বিষয়ক অভিসন্দর্ভের রচয়িতা। তিনি নিজে কখনো কোন পদকে ভূষিত হননি কিন্তু পদকের নাড়ি নক্ষত্র তার নখদর্পনে। সুন্দর মিয়ার বিশেষ আগ্রহে এবারের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তাকে পদক সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষ নিবন্ধ উপস্থাপনের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

শঙ্খ শাখালিয়ার মাথায় লাল রংঙের ঝুটি। প্রবন্ধ উপস্থাপনের আগে তিনি মঞ্চে উপবিষ্ট সুন্দর মিয়া ও তাঁর সহকর্মী সতীর্থ অতিথিবৃন্দকে যেভাবে কুর্নিশ জানালেন তাতে তার ঝুটির ছন্দময় আন্দোলনে আসহাব উদ্দীন বেশ তৃপ্তি পেলেন। বোঝা যায় শঙ্খ শাখালিয়া বিশেষ বংশীয় গোত্র থেকে উঠে এসেছেন। পরে জানতে পারেন আসহাব উদ্দীন, শঙ্খর বাবা সিনিয়র শাখালিয়া সুন্দরবনের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসৈনিক ছিলেন, স্বাপ্নিক তাত্ত্বিক হিসেবে ছিলেন বিশেষভাবে খ্যাত। তিনি সকলকে পর্ষদ গঠন পরিচালন বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ধারণা বিলাতেন এবং অনেক ব্যাপারে ফর্মুলা দিতেন। নিজে কোনদিন কোন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আসেননি কিন্তু পরিচালনার পরামর্শক ছিলেন। আসহাব উদ্দীনের মনে পড়ে চিকিৎসা বিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি আছে এমন পন্ডিতপ্রবর ডাক্তার আছেন কিন্তু তিনি একদিনও রোগী দেখেননি। তার দেশে ঝাকড়া চুলের এক পলিটিক্যাল থিওরিটিশিয়ান ছিলেন, নিজে কোনদিন তার থিওরি প্রয়োগই করতে যাননি। যাহোক, সিনিয়র শাখালিয়াকে এখনো পর্ষদের প্রবীণ সদস্যরা বেশ সম্মান ও সমীহ সহকারে স্মরণ করেন।

শাখালিয়া তার প্রবন্ধে দেখালেন পদক প্রদানে যেমন একটা বিশেষ উদ্দেশ্যময়তা কাজ করে পদক প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্যময়তা পরিলক্ষিত হয়। একটু পিছনের ইতিহাস থেকে উদাহরণ টেনে আনলেন শাখালিয়া- এক সময় এই পর্ষদ রাজ্যের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান-প্রধান ছিলেন যারা নিজ দপ্তরের বা অধিক্ষেত্রে কি ঘটছে বা ঘটাচ্ছেন সেদিকে নজর না দিয়ে কিভাবে বাইরের বাহবা অর্জন করা যায় সে ব্যাপারে বেশী মনোনিবেশ বিনিয়োগ করতেন। নিজেকে 'বিশেষ ধ্যান ধারনার প্রবর্তক' হিসেবে প্রচারের দিকে নজর দিতেন বেশী। আর বাইরের সংস্থা তার সেই বাহ্যিক ব্যবস্থাপনার ভোল দেখে ভদ্রতার খাতিরে হয়ত সামান্য একটু প্রশংসাই করলেন- তিনি এবং তার দপ্তর সেটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পর্ষদ মাঝে প্রচারে নামতেন। সেই পদক বা স্বীকৃতির তকমাকে তিনি বা তারা একবার পর্ষদের সবার নামে উৎসর্গ কখনো বা পর্ষদ প্রধানকেও উৎসর্গ করতেন। তাতে স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন পর্ষদগণ পুরস্কার বা পদকের বড়ত্ব নিয়ে বড় ধারণা পোষণ করতেন। শাখালিয়া উদাহরণস্বরূপ এটাও তুলে ধরেন অনেক সময় তল্পিবাহক অধিনস্তদের ব্যবহার করা হয় অন্যের কাছ থেকে ডিগ্রি সংগ্রহে। এক সময় এই বাবাহকুর রাজ্যে যে যত ডিগ্রি যোগাড় করে দিতে পারবে তার পদোন্নতি তত, এমনকি চাকরীর বয়স তত বাড়ার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাধ্য হয়ে অনেকে ঘরে বাইরে নানান সংগঠন নিজেরা তৈরি করে তার ব্যানারে পদক দিয়ে প্রচারে প্রসারে তা বাড়িয়ে তুলেছেন। প্রাচীনকালে এমনকি নিকট অতীতেও সব সময় ক্ষমতাসীন বা তাদের তল্পিবাহক, স্তাবক ও বিশ্বস্ত অনুসারীদেরকে হাতে রাখার জন্য পদক, সনদ, এনাম, জায়গীর ইত্যাদি দিত। আর এসব এনাম পাবার জন্য পদকলোভীরাও নিজেদের ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র ও মর্যাদার মাথা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। পরবর্তীকালে দেখা গেছে এই পদক প্রদান প্রথা অনেকটা গাধার সামনে মুলা ঝোলানোর মত পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলেন। নিজের পক্ষের হলে পদক দেয়ার নিয়মকানুন মানার প্রয়োজন পড়ত না। শঙ্খ শাখালিয়া দূরবর্তী এক লোকালয়ের এক সময়কার রীতিনীতি তুলে ধরে বলেন- সেখানে পদক প্রদানের জন্য মৌসুমী ও ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠত-তাদের কাজ ছিল যাকে পদক দেয়া হবে তার কাছ থেকেই বিনিময় নিয়ে তাকে পুরস্কৃত করা হতো। আর নিজ সমর্থনে প্রাপ্ত সেই পদকের পোদ্দারীতে মেতে উঠত সেই সমাজের ভুঁইফোড় সব পদবীধারীরা। পদক আর সম্মাননায় তাদের ঘর ভরে উঠত। কেউ কেউ এমনও বলতেন ঘরে পদক রাখার জায়গা নেই, 'নগদ' অর্থ দিলে ভাল হয় ইত্যাদি। সনদ প্রদান ও প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে পেশাজীবি, একাডেমিক কিংবা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছাকাছি আসার মুখরোচক ঘটনা উল্লেখ করে শঙ্খ শাখালিয়া তার প্রবন্ধের ইতি টানেন।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে খেতাব বিতরণের সংস্কৃতি কিভাবে ধারণা ও প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন হতে হতে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে বিজ্ঞ গবেষক শঙ্খ শাখালিয়ার এমন একটা সুশোভন উপস্থাপনা করলেন। আসহাব উদ্দীনের কাছে যথেষ্ট বুদ্ধি ও চিন্তাউদ্দীপক বলে মনে হল। তার কাছে এটাও মনে হল বাবাহকুর এই গবেষক এতসব সত্য তথ্য উপাত্ত পেল কোত্থেকে এবং বাবাহকু পর্ষদ সুন্দরবনে বসবাস করে এ ধরনের উপলব্ধি যদি অর্জন করতে পারে তার পাড়া-প্রতিবেশীরা কেন তা পারে না। আসহাব উদ্দীনের হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় লঞ্চটি নদীর ডুবোচরে ধাক্কা খেলে।