তানভীর মাহমুদ: নিবেদনের যাত্রাপথে

তানভীর মাহমুদতানভীর মাহমুদ
Published : 28 Oct 2019, 04:59 AM
Updated : 28 Oct 2019, 04:59 AM


একটি বিস্তারের মাঝে অন্তর ও অলংকার

ধরো, একটা ভ্যালিতে রৌদ্র কিরণ এবং ছায়ার মাঝে একটা সাইকেল এগুচ্ছে — এই ছবির অন্তরে এক সুর, আবার অলংকার হিসেবে এক সুর খেলা করে।

এই কয়েকটি অস্তিত্বের উপস্থিতি মিলে যা গড়ে উঠল তা তন্ময়তা, মগ্নতা ও ধ্যান। কী দিয়ে একে ভাষায় আনা যাবে — এই ধ্যান, এই তন্ময়তাকে?

ধরো ঘটনাটিই কবিতা। ঘটনার মোজাইকে যে অনিয়ত অবয়ব একটি বাস্তবকে আধার দেয় সেখানে কবিতা জন্ম নেয়। এর মাঝে আমরা যে রূপবৃন্দের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছি তারা বেশ আগ্রহোদ্দীপক। কেননা রূপ বরাবরই আড়াল করে। কেননা তুমি রূপের ভেদ বুঝতে যেয়ে দিশেহারা হও, শ্রান্ত হও, তোমার সময় ও জীবন বয়ে যায়, তোমার ত্বক ছেয়ে ঝরে পড়ে দৃশ্য সব। কেননা, রূপের পাশেই তোমার নিজের অধরা আকাশ বিরাজ করে, যা কিছু তুমি নও তাও বিরাজ করে, আকাশকে যা ধরে রেখেছে বিরাজ করে তাও — আর তোমাকে দেখে চলে এরা।

অরূপের কথা তো আগেই বলেছি। অরূপ তার ছায়া ধরল আমাদের সামনে, যা মনোহর।

মগ্নতাকে গভীর করে তুলতে পারে সন্তের মত এক স্বর। সেই স্বর আপাত অমসৃণ বুণটের — ছোঁয়া যায় এমন।

স্বরের স্পর্শগ্রাহ্যতা নিয়ে ভেবেছ কখনও? শ্রুতি থেকে মরমে, একই সময়ে তোমার ত্বকে এবং সমগ্র অস্তিত্বের সকল নামহীন প্রান্তে ও গহীণেও পৌঁছে যায়… তুমি সেই স্বরকে ছুঁয়ে দেখো প্রতিনিয়ত — এমন সঙ্গম।

সেই স্বরের মেঘ আবার শ্রুতি ও দৃশ্য অতিক্রম করে অবয়বহীন ও অনির্বচনের জগতে নিয়ে যায় আমাদের।

অবয়বহীন ও অনির্বচন যে জগত, তা তোমাকে তেমন এক সত্তার দিকে নেবে যে সত্তা অবয়ব ও ভাষার পূর্বগামী। সেকি চিহ্নের জগত? সংকেতের জগত? যা থেকে বিয়োজন ঘটাতে ঘটাতে তোমার ভাব ও অনুভবের একটি ক্ষীণদেহী প্রতিনিধি হয়ে ভাষার সূচনা করেছিল।

বস্তুত আরও পূর্বগামী সে জগত। যেখানে অনুভূতির স্রোতে বিবশ ছিল সত্তা। মহাপ্রাণের সাথে সংযোগের জগত। আমরা যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি তাকে নিজের মত করে চিনে নেবার প্রত্যয়ে।

কবির সীমাবদ্ধতাই হল — তাকে কথার বাহনে এগুতে হয়। তবে তার আরাধ্য হয় ফর্ম ও ধ্বনির পূর্বগামী সেই জগত ও সত্তার অনুসন্ধান। শব্দের বাহন আমাদের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ। কিন্তু, যতই হারিয়ে ফেলি বিমূর্ত ও অধরা, অনির্বচন জগত কবিতাকে ঘিরেই থাকে। এ এক এমন বাস্তব যা তুমি ধরতে চাইছ এই জেনে যে যে সে ধরা দেবে না।

এর সাথে ভিন্ন এক সম্বন্ধে এগুনো যাক তবে। বরং আমরাই কবিতায় ঘিরে দেব যা ধরা দিচ্ছে না সেই জগতকে। একে আমরা গড়েও তুলব, অবয়ব দেব – যেমন করে ছনে ছেয়ে ঘর তুলি। এমন করে ভাষার নতুন জন্ম হোক।

তবে

সঙ্গীতের দিকে যদি আরেকবার ফিরি। দেখব সেই সন্তের কন্ঠ যা তাকে স্বর দিল তা কত অনাড়ম্বর, ভূষণহীন, নিরাভরন ও সহজ। আত্মার অনুসন্ধান ও দীর্ঘ সাধনা পরমের কন্ঠে ফুলে ফলে ছেয়ে যায়।

সমর্পনের সাধনা

সাধনার পথিক নিজেকে সমর্পন করেন, বিলীণ হন। এক পর্কযায়ে সাধক নিজেই সমর্পণ হয়ে ওঠেন। সাধকের কন্ঠ তখন হয়ে ওঠে মসৃণ। মনসুর আল হাল্লাজ এবং খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী এর তুলনা দেখতে হবে।

মনসুর আল হাল্লাজের বোন প্রতি রাতে রহস্যের জগত থেকে প্রাপ্ত যে ঐশী সুরা পান করতেন, মনসুর তা এক রাত মাত্র পান করেছিলেন। এরপর তিনি নিজেকে খোদা বলে ভাবেন। বলতে থাকেন আনাল হক আনাল হক — আমিই সত্য, আমিই সত্য। খাজা মুঈনুদ্দিনকে মনসুর হাল্লাজের কথা বলায় তিনি জবাব দিয়েছিলেন, মনসুর যে নদীর এক বিন্দু পেয়ে রহস্য প্রকাশ করে দিয়েছিল তেমন হাজার দরিয়া মুঈনের ভেতর প্রতিনিয়ত বয়ে যায় তবু মুঈন নীরব থাকে।

নিবেদনের ভাষা হবে সহজ ও নিরাভরণ

এই প্রস্তাব জবাব দেয় ধ্রুপদী সঙ্গীতে কন্ঠের যেসব বৈচিত্র্য দেখি আমরা সে বিষয়ে কিছু প্রশ্নের, এবং কিছু বার্তাও দেয়।

গোলাম মুস্তাফা খাঁ এর কন্ঠ যেমন কিছুটা অমসৃণ, তা তার কন্ঠের ওপর পড়া তার ধ্যানের ও সাধনার ছাপ। তার প্রত্নমানসের ছাপ। কন্ঠকে মনোহর করে তোলার চেয়ে সঙ্গীতের ও পরমের মূলকে ধরতে চাইবার সাধনা সেখানে স্পষ্ট। গোপন করার ইচ্ছের চেয়ে সমর্পনের অধীর ও বাঁধ ভাঙা আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য সেখানে। অন্যদিকে আমীর খাঁ সাহেব – মসৃণ কন্ঠে লুকিয়েছেন সব অন্তর্গত বেদনার ছাপ। যেন — প্রস্তরের নির্বান পেল যত সৌরঝড়।

এই মসৃণ কন্ঠের ভাষা এমন হবে যেমন করে জলরাশি গভীরতম সমুদ্রের তলদেশে থাকে। জলরাশির আবেগ তরঙ্গের প্রবলতায় উন্মত্ত থাকে, তবু জলরাশির বুকের ওপর থেকে গভীরের সেই আন্দোলনকে, জলের প্রবল চাপকে, তার ভেতর চলমান আবেগ ও গতির সংঘর্ষের ও সম্মিলনের শক্তিকে বোঝা যায় না। নিবেদনের গান তেমনই।

একজন সাধক বা নিবেদনকারী কত কারুকাজ ও কৌশল তার ভেতর খেলিয়ে চলেন সেসব আন্দোলন আরাধ্যের সামনে না নিয়ে এসে কেবল সহজ নিবেদনটুকু করেন। কেননা যার সামনে নিবেদন করছেন তাকে মুগ্ধ করতে কৌশল ও চমৎকারিত্বের প্রয়োজন নেই। আরাধ্যের প্রসারিত হাতের সামনে, প্রেমের সামনে কেবল নিবেদনই মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে। সমর্পিত আত্মা, যে নিজেকে বিলীন করতে চাইছে, সেখানে সেই আত্মাই সব।