দক্ষিণ এশিয় ইংরেজি কথাসাহিত্যের মানচিত্র

রিফাত মুনিম
Published : 18 March 2018, 03:17 PM
Updated : 18 March 2018, 03:17 PM

এরকম একটি সেমিনারে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। শ্রোতাদের মধ্যে পরম পূজনীয় কয়েকজন লেখক রয়েছেন যাদের সামনে বক্তৃতা দেওয়াটা অনেক বড় প্রাপ্তি। সত্যি কথা বলতে তাঁদের সাহিত্যকৃতির বিভিন্ন দিকই সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই শুরুতেই তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে আমাকে এরকম একটি বিরল সুযোগ প্রদানের জন্য।
আজ আমি দক্ষিন এশিয় সাহিত্য সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা উপস্থাপন করবো। একজন সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদকের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি পর্যবেক্ষণগুলোকে ধরার চেষ্টা করেছি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হওয়ার সুবাদেই এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস, দ্য গ্লাস প্যালেস, দ্য গাইড এবং দ্য গড অব স্মল থিংস-এর মতো উপন্যাসগুলোর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। শুধু অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাসখানির বাংলা অনুবাদ হাতে পেয়েছিলাম আগেই, তবে কখনো শেষ করা হয়নি। শ্রেণীকক্ষে নয়, এই বইগুলোকে প্রথম দেখেছিলাম মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্রদের আবাসিক হলের রুমে। এগুলো তাদের পাঠ্য ছিল। আমরা ছিলাম স্নাতক প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র; আমাদের ক্লাসরুম কিংবা হলরুম – দুইই জুড়ে থাকত রোমান্টিক, ভিক্টোরিয়ান ও আধুনিক যুগের সব ইংরেজি উপন্যাস। চেনা প্রতিবেশের বাইরে সম্পূর্ণ অচেনা পটভূমিকায় নির্মিত এই গল্পগুলোর মধ্যে প্রবেশ করতে আমার বেশ কষ্ট হত, যদিও এগুলো ছিল ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সব নিদর্শন, ভাষিক এবং নান্দনিক সৌকর্যে অতুলনীয়।

স্কুল এবং কলেজের দিনগুলোতে বাংলা অনুবাদে সেবা ও প্রজাপতি প্রকাশনীর এমন অনেক বই মোহমুগ্ধের মতো এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি যেগুলোও অচেনা পটভূমিকায় রচিত। বাংলা অনুবাদের জন্য কিনা জানি না, তবে সেবা কিংবা প্রজাপতির অনুবাদগুলো পড়ার সময় সমাজ, সংস্কৃতি ও সময়ের সাথে এই বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করিনি। সবথেকে বেশি মনে দাগ কেটেছিল জ্যাক লন্ডনের দ্য সী উলফ । পুরো গল্পটি ছিল সমুদ্রের অথৈ জলে দিক হারানো একটি জাহাজকে কেন্দ্র করে। অনেক সংগ্রাম আর অনেক রক্তপাতের পর যখন তারা তীরের সন্ধান পায়, গল্পটি তখনি শেষ হয়ে যায়। তাই এই অসাধারন উপন্যাসের পটভূমিকা হিসেবে থেকে যায় এক অথৈ সাগর এবং সেই সাগরে হারানো এক কল্পিত জাহাজ। একজন আমেরিকান পাঠকের কাছে এই দৃশ্যকল্পটি যতখানি অচেনা একজন বাংলাদেশি পাঠকের কাছেও ঠিক ততখানি। অথবা ব্রিটিশ লেখক হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডের শী এবং দ্য রিটার্ন অব শী । দুটি উপন্যাসেরই গল্প ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা মহাদেশের পাহাড় শোভিত গহীন অরণ্যে। এখানেও কল্পনাপ্রবণ পাঠক মাত্রই অতিক্রম করে যেতে পারেন দেশ ও কালের সীমানা। কিন্তু ইংরেজি উপন্যাসগুলোতে এই সীমানা অতিক্রম করা সম্ভব হত শুধুমাত্র গ্রাম নিয়ে লেখা গল্পগুলোর ক্ষেত্রে। যেমন থমাস হার্ডির উপন্যাস টেস অব দ্য ডিআরবারভাইলস

সেই তুলনায় আইরিশ লেখকদের নাটক, কবিতা, উপন্যাসগুলোতে আমি অনেক সহজেই অনুপ্রবেশ করতে পারতাম। বাংলা সাহিত্যের প্রভাবেই আমার ভেতরে নিরন্তর পদ্মা নদীর মাঝি এবং তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস দুটিকে কেন্দ্র করে নিরন্তর এক সংলাপ চলতোঃ জেলেদের জীবন নিয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম এই উপন্যাস দুটির ভেতরে কোনটি আসলে শ্রেষ্ঠ? তাই হয়তোবা জন মিলিংটন সীং-এর রাইডার্স টু দ্য সী নাটকটি আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে ওঠে। এটি সমুদ্রপাড়ের একটি জেলে পরিবারের সংগ্রামমুখর জীবনের ছবি। এমনকি যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অতি আধুনিকবাদী( high-modernist) ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রসংগ আসত তখনও আমার প্রিয় ছিল স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো। আর কবিতায় সবসময়ই আমাদের প্রিয় ছিল ডব্লিউ বি ইয়েটস (W B Yeats) । সম্ভবত আমাদের ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার অভিন্নতার কারনে আইরিশ সাহিত্যিকদের লেখার সাথে আমি নিজেকে বেশি সম্পৃক্ত করতে পেরেছি, ঠিক যেমন করতে পেরেছি লাতিন আমেরিকান গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের সাথে।

এরপর হাতে তুলে নিই এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস, দি গ্লাস প্যালেস, দি গাইড এবং দি গড অফ স্মল থিংস। এবং এই প্রথম ইংরেজি ভাষায় এমন সমাজ ও মানুষের দেখা পেলাম যাদেরকে একদম নিজের বলে মনে হল; মনে হল এদের সাথেই আমি বেড়ে উঠেছি। এটা একেবারেই আলাদা রকমের অনুভুতি ছিল যা আমার পাঠের অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণ নতুন এক মাত্রা দিয়েছিল।
তারপর পড়ি সালমান রাশদী, শশী থারুর, হানিফ কুরেইশী, খুশবন্ত সিং, অমিত চৌধুরী, অনিতা দেশাই, নয়নতারা সাহগাল, ঝুম্পা লাহিরি এবং রমেশ গুনেসেকেরার উপন্যাস । এদের প্রত্যেকেই ইংরেজি উপন্যাসসাহিত্যে স্থায়ী সফলতার ছাপ রেখেছেন। আরো অনেক নতুন লেখকরা আসছেন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পাচ্ছেন। এসব তরুনদের ভেতরে উল্লেখ্ করতেই হয় কামিলা সামসি, মোহাম্মাদ হানিফ, অরভিন্দ আদিগা, দীপক উন্নিকৃষ্ণান, অনুক অরুদপ্রাগাসাম এবং আঞ্জুম হাসানের নাম। এই তালিকা আরও দীর্ঘ। আক্ষরিক অর্থেই দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোতে এবং কিংবা দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের লেখকদের কাছ থেকে উচু মানের সাহিত্যের যেন এক বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে।

বাংলাদেশের(অথবা বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত) সাহিত্যিকেরাও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফলতার উজ্জ্বল ছাপ রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, এবং সমাজ শিল্পিত হয়ে উঠে এসেছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, খাদেমুল ইসলাম, নিয়াজ জামান, আদিব খান,ওয়াসি আহমেদ, তাহমিমা আনাম, কাজী আনিস আহমেদ, মাহমুদ রহমান, জিয়া হায়দার রহমান, মনিকা আলী, শর্বরী জোহরা, ফারাহ গুজনভি, শবনম নাদিয়া, মারিয়া চৌধুরী, সাদ হোসেন, শাজিয়া ওমর এবং ইখতিসাদ আহমেদসহ আরো অনেকের লেখার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার সাহিত্যের চিত্রটিও অসংখ্য মেধাবী কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের পদচারণায় সদাচঞ্চল।

তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাংলাদেশকে ভারত এবং পাকিস্তানের সাহিত্যিকদের লেখাতেও খুঁজে পাওয়া যায়। আর এই সত্যের ভিতরই নিহিত আছে দক্ষিণ এশিয় কথাসাহিত্যের আসল সৌন্দর্যঃ রাজনীতিবিদরা আত্মপরিচয় খোঁজার নামে ভূগোলের সীমানায় যে কৃত্রিম কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে তাকে সমূলে উৎপাটন করতে পেরেছে সাহিত্যিকরা। তাই বাংলাদেশের জন্মের গল্প ভারত এবং পাকিস্তানের অনেক লেখকের উপন্যাসেই মুখ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রাশদীর মিডনাইটস চিলড্রেন উপন্যাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে আছে। শুধু তাই নয়, নয়নাভিরাম যে সুন্দরবন রয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল জুড়ে তার কাল্পনিক সম্ভাবনার বিস্তৃত ব্যবহারও রয়েছে এই বইয়ে। অথচ বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বন বাংলা উপন্যাসে প্রায় অনুপস্থিত বললেও অত্যুক্তি হয় না। কবিতার কল্পনা তাকে ছুঁতে পেরেছে, তবে উপন্যাসের কল্পনা পারেনি। দক্ষিণ এশিয় ইংরেজি উপন্যাসে সুন্দরবনকেও পাওয়া যায় বিভিন্ন মাত্রায়। মিডনাইটস চিলড্রেন-এর সুন্দরবন অতিকাল্পনিক যেখানে বনের গহীনে কোন মন্দিরে অলৌকিক এক নারীর আবির্ভাব রাশদীর স্বতন্ত্র জাদুবাস্তবতাকে পুষ্টি যোগায়। অমিতাভ ঘোষের সুন্দরবনেও কল্পনার ছোঁয়া লেগেছে , তবে তাঁর সুন্দরবন বাস্তবের অনেক কাছাকাছি বলে মনে হয়। ঘোষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যে সুন্দরবন তার বাইরে আসেননি, কিন্তু তাতে কি? সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি আসলে বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশে একই রকম। ভারতের সুন্দরবনে যে ডলফিন প্রজাতিকে বিপন্নপ্রায় হিসেবে দেখানো হয়েছে হাংরি টাইডে, তা বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশের ডলফিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের নদী ও সমুদ্রের বিপন্ন ডলফিন নিয়ে এমন আবেদনস্পর্শী গদ্যের উদাহরণ সাহিত্যে বিরল।

এবার আমি কামিলা সামসি নামের এক পাকিস্তানি লেখকের একটি উপন্যাস নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করবো। উনপ্যাসের নাম কার্টোগ্রাফি (Kartography)। মানচিত্র আঁকার বিজ্ঞানকে ইংরেজিতে কার্টোগ্রাফি (Cartography) বলা হয়। উপন্যাসের ঘটনাস্থল পাকিস্তানের করাচী শহর আর গল্পকে সামনে টেনে নিয়ে যায় পর্দার আড়ালে থাকা ১৯৭১-এর এমন এক ঘটনা যার উৎস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। রাহীন নামের এক নারী গল্পটি বলছে – করিম নামের এক পুরুষের সাথে তার সম্পর্কের গল্প। দুজনেই করাচীর অভিজাত শ্রেণীভুক্ত। রাহীন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আর করিম চাপা স্বভাবের। আবাল্য বন্ধু একে অন্যের, পরে প্রণয়। বন্ধুত্ব তারা জন্মসূত্রেই পেয়েছে –তাদের বাবা-মায়েরাও একে অন্যের বন্ধু। তাদের দূরত্ব শুরু হয় যখন করাচীতে আরেক দফা রাজনৈতিক সহিংসতা শুরুর পরে করিমের বাবা-মা তাকে লন্ডনে নিয়ে যায়। রাহীন আমেরিকার একটি কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকেই নিয়মিত চিঠি পাঠায় করিমকে, কিন্তু করিম যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে উদাসীন। শুধু একটি চিঠির মাধ্যমে রাহীনকে জানায় যে সে মানচিত্র আঁকার বিজ্ঞানে মনোনিবেশ করেছে। রাহীন বুঝতে পারে করিম দূরত্বের এক দেয়াল তুলে দিয়েছে তাদের মাঝখানে।
রাহীন ছাড়ার পাত্র নয়। সে খুঁড়তে থাকে এবং খুঁড়তে খুঁড়তে তাদের বাবা-মায়েদের অতীতে পৌঁছে যায়। আগে থেকেই সে এবং করিম জানত যে, করিমের মা ছিল রাহীনের বাবার বাগদত্তা আর রাহীনের মা করিমের বাবার বাগদত্তা। এই গল্প শুনেই তারা বড় হয়েছে; তাদের বলা হয়েছিল যে এটা এক ধরনের বাগদত্তা পাল্টে নেয়ার খেলা। রাহীন নিজে এনিয়ে কখনো তেমন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু অতীত খুঁড়তে গিয়ে সে জানতে পারে যে তার বাবা করিমের মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, কারন বাঙালি গেরিলারা পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করছিল। করিমের মা পূর্ব পাকিস্তানের মেয়ে, এখন যা বাংলাদেশ। আর তাই এই ভাঙন। শুধু তাই নয়, একদিন উগ্রপন্থী এক পাকিস্তানি করিমের মা বাঙালি বলে তাকে অপমান এবং গালিগালাজ করে। এরপরই রাহীনের বাবা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়: সে বিয়ে করতে রাজি নয়। ১৯৭১-এর করাচীতে রাহীনের বাবার এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত করিমের মায়ের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। সামাজিকভাবে সে অরক্ষিত হয়ে পড়ে এবং তাকে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। করিমের বাবাই তখন হাত বাড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। রাহীন অবশেষে বুঝতে পারে যে করিম আসল সত্যটি অনেক আগেই জেনে গেছে। তার মায়ের এই ক্ষতের কারনেই সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।

১৯৭১-এর প্রেক্ষাপট কিংবা যুদ্ধোত্তর সময়পর্বে বাংলাদেশের প্রশ্ন উঠে আসে বেশ কয়েকবার। উপন্যাসের মূল সুর বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। একজন পাকিস্তানি লেখক যে এতটা নির্মোহ এবং নৈব্যক্তিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে পারে এবং নির্দ্বিধায় পাঞ্জাবী শাসকশ্রেণীর পুরুষতান্ত্রিক ন্যারেটিভের বিরোধিতা করতে পারে, এ ছিল একজন বাংলাদেশি লেখক হিসেবে এক অসাধারণ পাঠাভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে থেমে থাকেননি সামসি। চোখে আঙুল দিয়ে সে দেখিয়ে দিয়েছে যে পাঞ্জাবী শাসকশ্রেণী বাংলাদেশ যুদ্ধ থেকে আসল শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পারেনি। বরং পাকিস্তান এখনও তার আধিপত্যবাদী শাসনযন্ত্রটি অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর চালিয়ে যাচ্ছে, আর এই অন্ধত্বই বর্তমান পাকিস্তানের রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতার মূল কারণ।

সব থেকে আকর্ষণীয় ছিল করিমের চরিত্র, যে কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে সদা কৌতূহলী। ভারতীয় মানচিত্র নিয়ে তার এই আগ্রহ হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয় সাহিত্যের শক্তিশালী এক প্রতীক। মিডনাইটস চিলড্রেন-এ পাওয়া যাবে মানচিত্র নিয়ে এই আগ্রহের খেলা, অথবা ঝুম্পা লাহিড়ির ছোট গল্প 'পীরজাদা যখন আমাদের সাথে আহার করতেন' (When Mr. Pirzada came to dinner with us )। আর হাংরি টাইড-এ অমিতাভ ঘোষ শব্দ দিয়ে নিখুঁতভাবে এঁকে দিয়েছেন দুই বাংলার মানচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনা থেকে ভারতে পালানো এক উদ্বাস্তু বাঙালি উপন্যাসের এক জায়গায় বলছেন: "আমরা একসময় বাংলাদেশে বাস করতাম। খুলনা জেলায়। আমরা জোয়ার ভাঁটার দেশের মানুষ, থাকতাম সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে। যুদ্ধের বছর আমাদের পুরো গ্রাম ওরা জ্বালিয়ে দেয়। উপয়ান্তর না দেখে আমরা বর্ডার পার হয়ে এপার চলে আসি। পুলিশে ধরল এবং গাড়িতে তুলে আমাদের এমন এক ক্যাম্পে নিয়ে আসল যেরকম জায়গা আগে কখনো দেখিনি। সবকিছু শুকনো আর মাটি এত লাল যে মনে হয় রক্ত লেগে আছে। অথচ এখানে যারা থাকে তাদের কাছে এই ধুলো এতটাই প্রিয় যতটা আমাদের কাছে প্রিয় জোয়ার ভাটার কাদা"।(মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ লেখককৃত)

আমাদের রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে; সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির পরিবর্তে লালন করে চলেছে বিভাজন এবং জিঘাংসা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে সংখ্যালঘু আর বিরোধী দলের উপর নির্যাতন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন অমোঘ সত্য। এই ব্যর্থতার সূত্র ধরেই আসে সাহিত্যের প্রসঙ্গ, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যিকেরা আমাদের হতাশ করেনি। বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি ভৌগলিক সীমারেখাকে অতিক্রম করে তাঁরা নিরন্তর নির্মান করে চলেছে এমন এক জগৎ যেখানে দেশের কোন সীমানা থাকে না। ভীষণ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও নাইপলের মত দুয়েকজন ভিন্ন পথে হেঁটেছে, ঔপনিবিশেক বিভাজনরীতিকে ধারণ করেছে তাঁদের লেখায়। তবে সবথেকে বড় ধারাটি যে সত্য আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলেছে তা হল দক্ষিণ এশিয়া নানান জাতি এবং গোষ্ঠীর বসবাসে সমৃদ্ধ এক অঞ্চল যেখানে একে অপরের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় লেখা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রতিটি প্রধান ভাষারই ভীষণ সমৃদ্ধ এবং স্বতন্ত্র সাহিত্যের ধারা রয়েছে। অনেক সমালোচকই মনে করেন যে বাংলা, হিন্দী, উর্দু, মলয়লাম, তামিল এবং নেপালি ভাষায় লেখা ছোটগল্প এবং উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় লেখা সমসাময়িক কথাসাহিত্যের চেয়ে অনেক বেশি শিল্পোর্ত্তীন। সর্বোপরি, দক্ষিণ এশিয় কথাসাহিত্য এমন এক জগৎ যার ভেতরে আমরা আমাদের শেষ আশ্রয় খুঁজি যখন আমাদের যাবার মত আর কোন জায়গা থাকে না। এ এক মোহময় জগৎও বটে। এখানে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা আছে, নৃত্যের তাল আছে, আছে কবিতা, প্রেম; অমৃতসরের গণহত্যা, দেশভাগের লক্ষ লক্ষ ক্ষত থেকে ঝরে পড়া রক্ত, অবিশ্বাস, জিঘাংসা, ধর্ষণ ও হত্যা, বাস্তুহারা মানুষের ঢল, পুনরায় যুদ্ধ, রক্ত আর ধর্ষণ, স্বৈরশাসক, একনায়ক, মার্কসবাদী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন আরো কত কি!

এই জগতেই আশা রাখি আমরা, অতীতে রেখেছি এবং ভবিষ্যতেও রাখব। একজন শাসক হয়ে শক্ত হাতে জনগণকে হয়ত শাসন করা যায়, তাই বলে লেখকের কল্পনাকে কি শাসন করা যায়? শাসকের হাত যতই লম্বা হোক না কেন লেখকরা সবসময়ই তাঁদের কল্পনা শক্তির মাধ্যমে সীমা অতিক্রম করার পথ খুঁজে নেবে। তাঁরা প্রমাণ করেই ছাড়বে যে কল্পনাশক্তি রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিভাজনের থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী।

(২২ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত বক্তৃতার বর্ধিত রূপ।)