কুমার চক্রবর্তীর স্নায়যুদ্ধের কবিতা

জহর সেন মজুমদার
Published : 15 May 2022, 07:45 PM
Updated : 15 May 2022, 07:45 PM


… উৎসর্গ করো অশ্রু…

লিখতে লিখতে একজন কবির কবিতা কখন 'শব্দভ‚মির নীল ঘর' হয়ে ওঠে? লিখতে লিখতে একজন কবির কবিতা কীভাবে নিষিদ্ধ জাদুঘরের ভেতর ক্রমশ অদৃশ্য গোলাপ হয়ে ওঠে? লিখতে লিখতে একজন কবির কবিতা কোথায় দেহ ছেড়ে জৈব জীবন ও তার বেদনাহত ছায়াদের 'গোপন অসুখ' হয়ে ওঠে? লিখতে লিখতে একজন কবির কবিতা কেনই-বা সময়কে দাঁড় করিয়ে রেখে মৃত্যুর কড়ি ও কোমল গুনতে গুনতে 'সংকেতের নিবিড় ব্যবস্থাপত্র' হয়ে দাঁড়ায়? এইসব প্রশ্নমুখী গুপ্তলিপি নিয়েই মূলত ও মুখ্যত প্রবেশ করতে হবে কবি কুমার চক্রবর্তীর কবিতার অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের ভেতর―যেখানে 'সূর্যগ্রহণের মনস্তাপ' ও 'চন্দ্রগ্রহণের ভাসান' একইসঙ্গে বিম্ব ও প্রতিবিম্বের মতো ভেসে উঠে মুহূর্তে স্তব্ধ করে দিয়ে যায় আমাদের ভাষা, চেতনা ও নৈঃশব্দ্যের লিমেরিক; লালিত বিষুব রেখার ভেতর তখন কবিতার পঙ্ক্তি নয়―শোনা যায় সামগ্রিক মহাপ্রাণধ্বনি… শোনা যায় অসুস্থতার পরাবাস্তবে দাঁড়িয়ে একজন কবি সবকিছু ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে একটানা আমাদের ডেকে চলেছে―'সুস্থ হয়ে এসো'…'সুস্থ হয়ে এসো'… কিন্তু কতখানি সুস্থ হলে আমরা খুঁজে পাব আমাদের হারানো অঙ্গ? আমাদের সূর্যাস্তের রং? অব্যক্ত জীবনের খনিজ বেদনা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে মেয়েদের কপালের টিপের মতো, সন্ধ্যা ও গোধূলির তিলকরেখার মতো…

… বন্দনা করি ষড়ঋতুর পদধ্বনি …

আসলে কবিতা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই এক আশ্চর্য অনুভ‚তিলব্ধ সন্ধ্যা ও সম্মোহনের কথা মনে পড়ে যায়; শীতকালের এক অল্প মেঘের সন্ধ্যায় পঞ্চাশের গুরুত্বপূর্ণ কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর বাড়ি গিয়েছি―প্রণবেন্দুদা তখন তাঁর 'নিঃশব্দ শিকড়' নামের এক কাব্যগ্রন্থের পাÐুলিপি প্রস্তুত করছেন; যাঁরা তাঁকে জানেন, তাঁরা এও ভালো করেই জানেন যে এই মগ্নচৈতন্যের মানুষটি খুব বেশি কথা বলা পছন্দ করতেন না এবং অন্যরা প্রগলভ বাক্যব্যয় করুক―এমনটাও চাইতেন না; আমরা কেউ কেউ এই সত্য জানতাম এবং জানতাম বলেই তাঁর মুখোমুখি বসে থাকতাম―নিঃশব্দ―চুপচাপ এবং বুঝতাম এও যে এভাবেই তাঁর সঙ্গে বহুকথার অন্তরঙ্গ সাঁকো নীরবে নিঃশব্দে ক্রমাগত প্রবাহিত হচ্ছে; সেদিনের সেই সন্ধ্যায় প্রস্তুত পাÐুলিপি থেকে প্রণবেন্দুদা খুব ধীর ও মগ্ন স্বরে একটানা বেশকিছু কবিতা পড়ে শোনাচ্ছিলেন; কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ ও সমাধিস্থ ―তারপর খুব মৃদু জিজ্ঞেস করলেন―কী মনে হচ্ছে এই কবিতাগুলো সম্পর্কে? আমি বিহ্বল―মনে আছে, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অর্ধস্ফুট বিড়বিড় করে শুধু একটা কথাই দু-তিনবার বলে উঠেছিলাম :

―এসবই সত্তালালিত স্নায়ুকম্পনের কবিতা …
―এসবই শিকড়পালিত স্নায়ুকম্পনের কবিতা …
―এসবই শীৎকারতাড়িত স্নায়ুকম্পনের কবিতা …

আমার এই অর্ধস্ফূট মতামতে খুব খুশি হয়েছিলেন প্রণবেন্দুদা; তিনি যে 'স্নায়ুকম্পন' বাক্যবন্ধ ব্যবহারে যারপরনাই প্রীত হয়েছিলেন, তাও কিন্তু সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমি, যখন তিনি নিজের অজান্তেই আমার দিকে ফিরে বলছেন অথচ একদমই আমাকে বলছেন না, সেইরকম এক নৈর্ব্যক্তিক চেতনাসংলগ্নতায় খুব আস্তে আস্তে বলে চলেছিলেন একটাই কথা :

―স্নায়ুকম্পনের আগে বোধাক্রান্ত শব্দটা বসালে না কেন?
―বসাও, বসাও
―বোধাক্রান্ত শব্দটা বসাও …

সে এক অদ্ভুত সন্ধ্যা, এক অদ্ভুত ঘোরলাগা সম্মোহিত পাঠমালা―আমি সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, আমি সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম―রাতের দিকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বারবার মাথার ভেতর সুতীব্র ও সুতীক্ষ্ণ গেঁথে যাচ্ছিল কিছু তরঙ্গায়িত বাক্যমালা… বোধাক্রান্ত… বোধাক্রান্ত… বোধাক্রান্ত স্নায়ুকম্পনের কবিতা… কে লেখে? কারা লেখে? কেনই-বা লেখে? আজ আবার কুমার চক্রবর্তীর কবিতা পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনের সেই সন্ধ্যা… সেদিনের সেই সম্মোহন… সেদিনের সেই বাক্যহীন অথচ নীরব নিঃশব্দ বাক্যতরঙ্গমালা… পড়তে পড়তে বহুদিনের স্মৃতি ও দংশনের ভেতর আবার যেন মনে পড়ে যাচ্ছে প্রণবেন্দুদা কথিত সেই 'বোধাক্রান্ত' শব্দটির কথা, স্নায়ুকম্পনের আগে যে শব্দটি ঘোরলাগা অবস্থায় প্রণবেন্দুদা বীজরোপণের মতো মাথার ভেতর গেঁথে দিয়েছিলেন… আর সেই গাঁথা সপ্তশতী থেকে মনে মনে প্রশ্ন উঠছে পুনরায়―তাহলে কি আমাদের মতো কেউ কেউ যারা বোধাক্রান্ত স্নায়ুকম্পনের কথাকল্পই কবিতার আকারে ক্রমাগত লিখে চলেছি একটানা―কুমার চক্রবর্তীও কি সেই একই কাজ ক্রমাগত আমাদেরই মতো করে চলেছেন? মুখ্যত এই নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত প্রশ্নেরই অবশ্যম্ভাবী উত্তর―হয়তো-বা কুমার চক্রবর্তীর কবিতা―তা নয়তো কেনই-বা তিনি আমাদের মতো ক্রমাগত 'একাকী নিঃসঙ্গতায়' ও 'শোকমিছিলের মতো স্তব্ধতায়' ক্রমাগত লিখে চলবেন একের পর এক সত্তাজাত স্নায়ুকম্পনের কবিতা? ক্রমাগত লিখে চলবেন শিকড়জাত স্নায়ুকম্পনের কবিতা কিংবা শীৎকারজাত স্নায়ুকম্পনের কবিতা? কম্পনের এই সুরঙ্গবীক্ষণ থেকেই তো তিনি এইসব লেখেন আর আমরাও তো এইসব স্বপ্নসমন্বিত কৃষ্ণপক্ষের ভেতরে ঢুকে যাই―দেখি সেইখানে চাপচাপ পড়ে আছে প্রেম মৃত্যু ও চিন্তার বহুবিধ সাংকেতিক অন্ধকার―ঘুমোতে ঘুমোতে কিংবা জেগে থাকতে থাকতে কুমার একা একাই নিজের ভেতর 'ভারাক্রান্ত বাস্তবতা' চিরে খুঁজতে থাকেন 'নিরিবিলি হাহাকারবোধ'―যা আসলে সর্বদাই এক শরীরী স্নায়ুকম্পন―যা আসলে সর্বদাই এক সংবেদী স্নায়ুকম্পন―তা নয়তো কেইন-বা তিনি লিখবেন এইসব 'ধ্বনিশীল অস্তিত্বের' নেশাগ্রস্ত পঙ্ক্তিমালা―আমরা পড়ি―আমরা পড়ি―আর পড়তে পড়তে বুঝে যাই অনির্বচনীয় অনুবোধ আর হৃদয়প্রশস্ত বিন্বিত ব্যাপ্তি কীভাবে চলে আসে কবিতার ভেতর, পংক্তিমালার ভেতর, এমনকি স্বর ও সংকেতের ভেতর? এই সূত্রে তিনটি কবিতার উদাহরণ দেয়া আবশ্যক :

ক. সত্তাজাত স্নায়ুকম্পন :

আমরা ভাবনার দিকে যা কিছুই আসে
সবটাই মনোবাস্তবতাগ্রস্ত। ঘাস সমাহিত গান
এভাবে ঋতুর কাছে এসে―ঊর্ধ্বে উঠে
দেশলাই জ্বেলে তারাদের কর্মফল দেখি।
সারা দিন একা একা
সাপলুডু খেলি আর কৃষিবাস্তবতাময়
ধানখেতের দিকে তাকিয়ে পৌনঃপুনিক
নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হই এখন আবার।

(অবলুপ্ত সৌন্দর্যের ত্রাস : হারানো ফোনোগ্রাফের গান)

খ. শিকড়জাত স্নায়ুকম্পন :

বহু কষ্টে বৃক্ষ আর আকাশের যৌথ সা¤্রাজ্য থেকে
পেয়ে গেছি নিয়ন্ত্রিত ভাষা আর গান
আমাদের বিবেচনাদিন এসে গেল
দেখা হলো অলংকারময় ক্রোড়পত্র
দেহবোধে বিকেলশাসিত এক আপেল বাগান
আজ তাই বাজে ভ‚তাত্তি¡ক সূচনাসংগীত।

(গোধূলির নকটার্ন : লগপুস্তকের পাতা)

গ. শীৎকারজাত স্নায়ুকম্পন :

বৃষ্টি তুমি আসো, ভিজে ভিজে বাকনিহিত
সম্ভাবনা ব্রিফকেসে নিয়ে, আমি চলে আসি
শুয়ে থাকি মালতিকে নিয়ে দ্বিতলের কুঠুরির ঘরে
সকালের সঙ্গমের পর, ভবিষ্যদ্বাণীহীন, হায়
অথবা এই উদ্ভাবনা কবিতাবিষয়ক যার আছে
মন্থর মন্দাক্রান্তা; দূর ও নির্জন ছন্দের বাগান
রচনাবলির বুক ভরা মৃদুল আর্দ্রতা, কখনও
লালন করে সহানুভ‚তির আয়ু। তুমি আসো
চোখের আয়নার মতো, সাদা সাদা প্রতিবিম্বময়―
কালক্রমে গন্ধকেও বিপুল করে, আর আমরা
সকালের সঙ্গমের পর, আত্মভোলা, দেখি তোমার
বুকের গোলাপ সুরতরঙ্গের মতো ধারণাতীত
যা আসে লাস্যময় আকাশের অক্ষরবৃত্তের বেশে

(সকালে বৃষ্টির সময়… : আয়না ও প্রতিবিম্ব)

পর্যায়ক্রমিক স্নায়ুকম্পনের এই তিনটি তরঙ্গই মুখ্যত কবি কুমারের কবিতার মূল অবলম্বন ও আলম্বন বিভাব। প্রথমত সত্তাজাত স্নায়ুকম্পন নিয়ে যখনই তিনি নিজের একাকী আত্মবোধের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণার দিকে ফিরে তাকিয়েছেন―তখনই তাঁর মনে হয়েছে যে তিনি জন্ম নেবার পর থেকেই এক 'ভুল জীবন' ও 'ভুল ঠিকানা'র মর্ত্যজীবনে আচম্বিতে ঢুকে পড়েছেন। ফলে যে আত্মদগ্ধ দেহকথার বস্তুজগৎ ক্রমাগত তাঁকে মস্তিষ্ক ও মেধায় টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে, ভ্রমাত্মক আত্মযন্ত্রণায় ক্রমাগত তাঁকে অবিন্যস্ত ও উৎকেন্দ্রিক করে তুলছে―এ সবেরই অদৃশ্য কারণই হচ্ছে এই 'ভুল জীবন' ও 'ভুল ঠিকানা'র পরাভ‚ত ঋতুবিপর্যয়। এই জাগতিক বস্তুজগৎ আসলে কোনোভাবেই তাঁর চাওয়া-পাওয়ার ভাসমান চৈতন্য বোঝে না, তার হৃদয়জাত স্বপ্ন ও বহুবাচনিক শতজাগ্রত উদ্ভাবনা বোঝে না―এমনকি তাঁর মনোবিজ্ঞানের গাঢ় রস ও ধ্বনির রূপান্তরিত পঙ্ক্তিবিন্যাসগুলোও বোঝে না। সুতরাং এই ছদ্মবাস্তবতার ভেতর নিমজ্জিত অস্তিত্বের প্রাত্যহিক অর্থহীন নিয়মাবলি পালন করে কী হবে? কী লাভ? এই ক্লান্তি ও অবসাদ থেকেই তিনি তাঁর 'প্যান্ডোরার বাক্স' কবিতায় 'ভুল জীবন' যাপনের কথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন এবং 'দ্ব›দ্ব এবং দ্যোতনায়' নামের কবিতায় 'ভুল ঠিকানার ঘর'-এর মধ্যে যে অসমাপ্ত স্মৃতিবিভ্রম দেখা দিয়েছে―তাও কিন্তু একাকী ও এককভাবে মেনে নিয়েছেন। এই সূত্রে 'অন্ধ রাত', 'সূত্র' এবং 'মনস্তাত্ত্বিক' কবিতাগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায় তাঁর সত্তাজাত স্নায়ুকম্পনের গুপ্ত রেখা ও গুপ্ত লিপি। দ্বিতীয়ত শিকড়জাত স্নায়ুকম্পন একদিকে যেমন তাঁর কবিতাকে নিসর্গপ্রকৃতির বোধের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, অন্যদিকে তেমনই বঙ্গীয় নশ্বরতার ভেতর শিকড়হীন সত্য ও সর্বনাশের ছবি নানা ভাষ্যে এঁকে দিয়েছে। আসলে জীবন সবসময়ই এক চিরকালীন সমাধিক্ষেত্র। দু-দণ্ডের এই সমাধিক্ষেত্রে কাঁকড়ার মতো চলতে চলতে কবি কুমার স্পষ্টতই অনুভব করেছেন―এ সবই এক 'প্রহেলিকার ক্রীড়া'। স্মৃতিভারাতুর আত্মার অনুসন্ধানের মধ্যদিয়ে যেতে যেতে কবি কুমার বারবার এই প্রহেলিকার ভেতর সুতীব্র পিপাসায় গাছ কিংবা বৃক্ষস্বরূপের ভেতর মিশে যেতে চেয়েছেন―কেননা তিনি স্পষ্ট জানেন যে―'গাছেরা মহান, তারা জানে কী করে মৃত্যুর পর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একা'। কিন্তু মানুষ কি পারে? পারে না―কারণ তার তো অনন্তকালীন সেই শিকড় ও পরিব্যাপ্তিই নেই। তাই 'সমুদ্র' নামের কবিতায় জল ও মাটির নৈকট্যে অবলীন হবেন বলেই তিনি একসময় প্রগাঢ় পার্থিবতা থেকেই বিষাদ ও আক্ষেপে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে ওঠেন :

বৃক্ষ হতে চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম অন্ধকার মাটির ভেতর
সম্প্রসারিত হতে …

হয়তো এই 'শিকড়জাত স্নায়ুকম্পন' থেকেই তাঁর কবিতায় এইভাবে 'বৃক্ষ' আসে, এইভাবে 'পাখি' আসে, আর বৃক্ষ ও পাখির যুগ্ম স্বরূপের ভেতর এইভাবেই তিনি হয়তো সীমাহীন সময় ও সমগ্রের কাছে ক্রমশ এক 'সবুজ আত্মা' রূপে বিকশিত হন। বলতে দ্বিধা নেই যে কবি কুমারের কবিতায় এই 'শিকড়জাত স্নায়ুকম্পন' একদিকে যেমন তাঁকে মাটির ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে গেছে―অন্যদিকে তেমনই এর মধ্যদিয়েই তিনি দেখতে পেয়েছেন মহাজাগতিক সময়ের উল্লম্ফন এবং 'পূর্বপুরুষদের ফেলে যাওয়া কৌম উল্লাস'। তৃতীয়ত তাঁর কবিতার আরও একটা বড় দিক―'শীৎকারজাত স্নায়ুকম্পন', যার ভেতর রয়েছে আদিম ও চঞ্চল 'শারীর-সংস্কৃতি'―যাকে স্বীকৃতি দিতে দিতে 'নিশিভাষ্য' কবিতায় তিনি সূর্য ও চাঁদের ঘর্ষণ থেকে নেমে আসতে আসতে স্পষ্ট বলেছিলেন―'আমরা এসব বুঝে শ্লথ যৌনতায় আমোদিত হই; আমাদের নিজস্ব রূপচরিত্র এই…'। সৃষ্টিতত্ত্বের ভেতর এই যৌনবোধ ও যৌনতা না থাকলে, জল ও মেঘের মধ্যে এই 'যৌনধ্বনি' না থাকলে আমরা কোথায় পেতাম সবুজ বসন্ত? কোথায় পেতাম নীলের নৃতত্ত্ব? কোথায় পেতাম নগ্ন আপেল ও ঘাসফুলের সঙ্গে গুপ্তকোষের অনিবার্য চুক্তিনামা? এই যে আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে 'জীবনের সবুজ সফলতা', এই যে আমাদের চারদিকে ভ‚মি ও ভ‚গোলের ওপর ক্রমাগত নেমে আসছে আশ্চর্য বৃষ্টির সংগম―কবি কুমার সেই সংগমের ভেতরেই পেয়ে যান স্বপ্ন ও সাঁতার―পেয়ে যান বীজ ও বিস্তার। এই আবর্তিত 'বীজাধার' দেখতে দেখতেই তাই তিনি বলতে বাধ্য হন :

অনিবার্য দেহতত্ত্ব থেকে জেনে যাই
কায়া মানে ভ‚গোলের কারসাজি…

এর মধ্যেই তো চিরকাল রয়ে গেছে পারদর্শী মৌমাছির গূঢ় উদ্ভাবন। এর মধ্যেই তো রয়ে গেছে প্রেম-চঞ্চল নিশিভাষ্যের―'ভূতাত্ত্বিক সূচনাসংগীত'। নিবিড় মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে মরজীবনের ধূলি ও মাটির নিবিড়তায় যখন বৃষ্টি এসে নামে―যখন ঝলমল করে ওঠে অরণ্য ও গুহাচিত্রের পটভ‚মি―তখন কবি কুমারও (দ্রষ্টব্য―ভাওয়াল : ডিসেম্বর ৯৭) গড়ে তুলতে চান 'মাটির নৃতত্ত্ব' এবং 'ঘাসের যূথ পরিবার'। তখন কবি কুমারও তাঁর আলোড়িত 'আদিবীজ' নিয়ে সম্ভাব্য পার্থিকতার ভেতর বুনো নিসর্গ হয়ে যান আর সুতীব্র বপন ও রোপণের তীব্র তাগিদে এও বলতে বাধ্য হন―'আমি তার দু উরুর উপত্যকায় উল্লাস হয়ে দেখা দিই… ভেঙে পড়ি…'। এ কি শুধু উল্লাস? তা তো নয়।―ভূতাত্ত্বিক সূচনাসংগীত―। ডাহুক ও জলপিপির উদবেলিত ধ্বনিখেলার ভেতর এভাবেই কবি কুমার ডুবে যান তাঁর স্বপ্নপাগল অনিবার্য চাষে, বৃক্ষবোধে এবং দেহবোধে, আর বলেন 'সরলতা' নামের কবিতায়―'বৃষ্টি জীবনের কাছে আমাদের অনেক কথামৃত আছে।' এই কথামৃতই তো তিরন্দাজের মতো 'গোপন গিরিমাটি' ফুঁড়ে দীর্ঘ সৈকতজুড়ে ক্রমশ ছড়ানো এক আদিম ও আদিগন্ত যৌনপিপাসা হয়ে ওঠে। কবি কুমার এই পিপাসা থেকেই বলেন―'পরিণত করি দেহক্রীড়া'। কবি কুমার এই পিপাসা থেকেই বলেন―এসো, তবে নতুন সৃজনে উপনীত হই শিশ্ন আর যোনির কল্লোলে'…। কিন্তু এই সৃজনইচ্ছা ও সৃজনউল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না তাঁর জীবনে, তাঁর কবিতায়। 'তবে এসো হে হাওয়া, হে হর্ষনাদ' বলে প্রত্যক্ষ জীবনকে যতবার তিনি তাঁর সৃজনইচ্ছা আর সৃজনউল্লাস নিয়ে সুতীব্র আহ্বান করেন―ভেতরের ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন ও শূন্যবোধ ততই তাঁকে গ্রাস করে নিতে থাকে মানচিত্রহীন কোনো এক অসম্ভব অন্ত্যধ্বনিতে। তখন অন্তহীন বিমূঢ়তায় নিজের জন্য নিজেই তিনি এলিজি-পাঠ করা ছাড়া অন্য কিছুই আর করে উঠতে পারেন না; তখন জীবনের মিথ্যা নান্দনিকতার আচ্ছন্ন ঘোর ভেঙে যায়, আর সেই অবস্থায় তিনি 'পানশালা' কবিতায় লিখতে বাধ্য হন দুঃসহ উপলব্ধি :

চিহ্নরূপ ছায়াদের হাসির আড়ালে ইদানীং
রক্ত বেরিয়ে আসে।
ঘুম থেকে উঠে দেখি চোখ ঠেলে রক্ত,
দাঁত মাজতে গিয়ে দেখি মুখভরতি রক্ত, রাতে সঙ্গম
করতে গিয়ে দেখি, ওহো শিশ্ন দিয়ে ফিনকির মতো রক্ত;
আবার হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে দেখি রিডগুলোও ছোপ ছোপ
রক্তে ভেসে যায়।

আর্তনাদের এই স্বীকারোক্তি, স্বীকারোক্তির এই আর্তনাদ―এর মধ্যেই রয়েছে কবি কুমারের মোহনিয়া কাব্যপরিমণ্ডল। সমুদ্র ও তার বেলাভূমি থেকে সে শাশ্বতের গান ভেসে আসে―পৃথিবী ও তার রৌদ্রধাম থেকে যে মৌমাছির সামূহিক গুঞ্জন সূর্যবন্দনার মতো ধেয়ে আসে―সৃষ্টিতত্ত¡ ও তার হৃদয়াশ্রিত চৈতন্য থেকে যে উদ্ভিন্ন কুসুমের সান্ধ্য চন্দ্রকলা পরিস্ফুট হয়―কুমারের আত্মবোধ ও আত্মসত্তা তার ভেতর দিয়ে চলতে চলতে কোথাও একটা স্থির নিশ্চিত 'নান্দনিক পোতাশ্রয়' খোঁজে। কারণ কবি কুমার জানে―এই 'নান্দনিক পোতাশ্রয়'ই হচ্ছে একটা চিরকালীন আশ্রয়স্থল। কিন্তু কোথায় সেই আশ্রয়স্থল? প্রেম নেই―শ্যামসুন্দর স্বপ্নমুখর কথামালা নেই―শুধু কোনো এক অনির্দিষ্ট কূলপ্লাবী জীবধর্মে ক্রমাগত জন্ম নেয়া ছাড়া সত্যি বলতে আমাদের তো আর কিছুই নেই। কবি কুমার ঠিক এই অসহায় আশ্রয়হীনতা থেকেই বোঝেন―যৌনবোধ ও জীবধর্ম চিরকাল একইভাবে থাকবে―একইভাবে থেকে যাবে―আমরাও শুধু আসব আর যাব―আর ক্রমাগত এই আসা-যাওয়ার মধ্যদিয়েই আমাদের জীবন প্রতিদিন একইভাবে 'মায়ামমতার চাষ করে' যাবে। কিন্তু কোথায় শেষ পর্যন্ত থাকবে এই 'আমি'? ব্যঞ্জনার নিশিডাক শুনতে শুনতে কবি কুমার শেষাবধি স্পষ্ট উপলব্ধি করেন―ঘুম ও জাগরণের ভেতর আমাদের কাজ শুধু একটাই। তা হলো―মানবিক নিঃস্বতার ভেতর অপরাধ করা। অর্থাৎ ছাই মেখে সম্পূর্ণই অবলীন হয়ে যাবে। সুতরাং এই সাময়িক স্বপ্নসম উপস্থিতি এবং তার মায়াময় সামগ্রিক দেহবোধ যেটুকু প্রণয় ও যৌনমিলন চায়―কবি কুমার যেন তার জন্যই শুরু করেন ছায়াযুদ্ধ―তার জন্যই শুরু করেন স্নায়ুযুদ্ধ―আর অপেক্ষা করেন―কাঁটাগাছ চাষ করতে করতে যদি কখনো একবারও 'উদ্ভিদজন্মের হর্ষগীত' কাঠামোহীন এই জীবনটাকে কোনো একটা অসীম কাঠামোর স্থাপত্যে পৌঁছে দিতে পারে।―কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ হয় কি? 'উদ্ভিদজন্মের হর্ষগীত' ক্রমশই দূরে সরে যায়―রক্তমাংসের মানুষ শুধু তার 'দেহবোধ' নিয়ে ডুবে যায় সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন কাল ও মহাকালের ভেতর―যাকে কবি কুমার সঠিকভাবেই চিহ্নিত করে দিয়ে বলেছেন―এ হলো এক চিরন্তন 'বিষাদের দৈবক‚প'―যেখানে ভাষাহীন শূন্যতার গুপ্তস্রোত ছাড়া আর কিছু নেই―আর কিছুই থাকে না―আমরা শুধু ঢেউয়ের ওপর 'একা ও অনুভূতিময়' নৃত্য করতে করতে প্রেম তৈরি করি, চিহ্ন তৈরি করি, নীড় তৈরি করি, স্বপ্ন তৈরি করি, দৃশ্য তৈরি করি―আর এসবের সম্মিলিত আবহে গড়ে তুলি একই ধরনের দর্শন বা দর্শনের কথামালা। কিন্তু কোথাও কি সেই দর্শনও থাকে? কবি কুমার তাই ক্রমশ পৌঁছে যান এক অমীমাংসিত জীবনদর্শনে এবং উপলব্ধি করেন গোটা জীবনটাই আসলে একটা নিজস্ব 'অন্তর্দেশে ভ্রমণ' ছাড়া অন্য কিছুই নয়। আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, সমুদ্রে, বেলাভ‚মিতে, প্রাকৃতিক বাদলসন্ধ্যায় শুধু দুদণ্ড ভ্রমণ করতে এসেছি মাত্র এবং তাই আমাদের একটাই কাজ―তা হলো উড়তে উড়তে, শূন্য থেকে শূন্য মহাকালে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে, নভোচারীর ভ্রাম্যমাণতায় ভ্রাম্যমাণ আত্মজীবনীটুকু রচনা করা। কবি কুমারও সেই দিকে পা বাড়িয়ে বলেছেন :

এসেছি এই ঝিলের ধারে
ভ্রমণের বিবরণ লিখে রাখি…

অথচ ভ্রমণ হলেও, দুদণ্ডের ভ্রমণ হলেও, কবি কুমারও কি অন্যদের মতো এই রক্ত মাংস ঘ্রাণের জীবনকে আশ্লেষে ও সংশ্লেষে গাঢ়ভাবে প্রগাঢ়ভাবে ভালোবাসেননি? বেসেছেন। সেই ভালোবাসা থেকেই তিনি নীড় নিয়েছেন, নারী নিয়েছেন, প্রকৃতি নিয়েছেন, সংসার নিয়েছেন; মধু ও রেশমের মধ্যদিয়ে স্বপ্ন ও নীলিমার অফুরন্ত ডাকও তো শুনেছেন। কিন্তু তারপর? একসময় এও বুঝেছেন―তিনিও আসলে এক অলীক স্বপ্নের দিকে ধাবিত 'অলীক মানব', যে নাকি বোধগম্য লালারসে জীবনের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আসলে―'জীবনকে ভালোবাসতে গিয়ে ভালোবেসেছি জীবনের মতো কোনো কিছু'―এই চূড়ান্ত অনুধাবনের কথাই বলে যায় আমাদের। কী ভয়ংকর কথাই না এইখানে বলে দিলেন কবি কুমার―জীবনকে ভালোবাসতে গিয়ে জীবন নয়, জীবনের মতো অন্য কিছুকেই তাহলে আমরা টানা একটানা প্রশ্নহীন আনুগত্যে চিরকাল ভালোবেসে গেলাম? প্রশ্ন ওঠে এবং প্রশ্ন উঠবেই―সেই অন্য কিছুটা কী? আসলে যেভাবে ভূমি ও আকাশের সমপ্রাণসংযোগে চিন্তাহীন বৃক্ষের বিকাশ, যেভাবে ভূমি ও আকাশের সমপ্রাণসংযোগে চিন্তাহীন পাখির পরিক্রমা―মানুষের তা নেই; কবি কুমার হয়তো সেই চিন্তাহীন বৃক্ষ ও চিন্তাহীন পাখির সজীব উপস্থিতির অস্তিবাদী বোধের নিকটে পৌঁছতে চেয়েই বুঝলেন―বৃক্ষের সর্বজাগতিক স্থিতি এবং পাখির মহাজাগতিক গতি, এই দুই থেকেই বঞ্চিত মানুষ―মূলত বিষাদ আক্রান্ত, মূলত স্নায়ু আক্রান্ত, মূলত জটিল দুরধিগম্য ধাঁধায় আক্রান্ত―অদ্ভুত এক মনস্তাত্ত্বিক মাস্তুল নিয়ে সে শুধু এই চলমান জীবনের ভেতর অনাবশ্যক পালক ছড়াচ্ছে আর জটিল হাহাকারকৃত জৈবনিক দ্বদ্বসূত্রে ক্রমাগত আবর্তিত হচ্ছে―এই আবর্তনশীল জটিল পরিক্রমা ছাড়া তার আর কিচ্ছু নেই―কিচ্ছু করার নেই―দেহের ভেতর তাই শুধু 'হাড়ের কান্না' জমে যায়―কবি কুমার এই 'হাড়ের কান্না' ফেলে দিয়ে এক 'জন্মহীন' ভারসাম্যময় মহাজীবনযাত্রার অনন্তমুখী অনুসন্ধানের ক্রিয়া ও স্তোন খুঁজেছেন―কালহীন বিস্তারের গন্ধ ও রহস্য খুঁজেছেন―শেষাবধি চেয়েছেন এক 'মানেহীন' জৈবনিক রূপান্তরপ্রক্রিয়া―আর এই ভাবনা থেকেই 'সব মানেহীন' কবিতায় তিনি নির্ভার ও মেদহীন উচ্চারণ করেন :

সব মানেহীন শব্দ দিয়ে আজ লিখি কবিতা
লিখি অস্তিত্বহীনতা…

কিন্তু কবে আমাদের এই জীবন সম্পূর্ণ মানেহীন হবে? কবে আমাদের এই অস্তিত্ব সম্পূর্ণ মানেহীন হবে? অন্ধকারের ঠিক আগের স্টেশনে এই সুতীক্ষ্ণ ও সুতীব্র প্রশ্ন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন কবি কুমার―যেন অস্তিবাদ ও নাস্তিবাদের অনিশ্চয় এক দ্বান্ধিক জটিল মুহূর্তে এইবার তিনি নিজের দেহবোধ থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিচ্ছেন প্রেম ও যৌনতা, লালা ও উদ্বেগ, পাপ ও হাঁসকল, সিঁড়ি ও আয়না, ঘূর্ণি ও সংবিৎ। মগ্নচেতনার গভীরে যে শ্রবণবধির বাক ও ব্যাকুলতা আছে―কবি কুমার সেই পথেই যেন ক্রমশ মানেহীন বা অস্তিত্বহীন হয়ে এগিয়ে যেতে চাইছেন―এই যাত্রাই তাঁর কাছে বাচ্যহীন চেতনার দিকে সামগ্রিক অভিযাত্রা― যেকথা আলাপে দ্বিরালাপে বলেন তিনি 'প্রতিধ্বনি' কিংবা 'কে বলে এসেছি' কবিতায়। যে সত্য উচ্চারণ করেন তিনি মহাবাক্সময় ভাষাচেতনায় 'ঘুমের ভেতর' বা 'সূত্র' কবিতায়―যা আসলে এই প্রাত্যহিক পাপ ও অজাচারের ব্যক্ত জীবন থেকে কোনো এক অব্যক্ত ভাষারই নিঃশব্দ আরাধনা―যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন :

অব্যক্তের ভাষা নিয়ে লিখে যাই একটি কবিতা
তোমরা তা পড়ে নিয়ো, সুধীজন, ব্যক্ত মানুষেরা …

সময়ের ভেতর বিলীন এই দেহ ও তার বস্তুঅভিভব, জীবনের ভেতর বিলীন এই হৃদয় ও তার প্রাত্যহিক স্বত্বাধিকার―এই সব কিছু দেখতে দেখতে, বুঝতে বুঝতে এবং জানতে জানতে কবি কুমার ক্রমশ তার স্থূল জাগতিক মুগ্ধতাবোধ থেকে নিস্ক্রান্ত হয়ে যান―আর এই নিস্ক্রমণের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিতে মিশে যেতে যেতে একসময় কী ভয়ংকর আত্মযন্ত্রণা ও আত্মপ্রত্যাহারে লিখে দিতে থাকেন তাঁর নিরাসক্তির বর্ণমালা―তাঁর অস্থিহীন অন্তর্ধানের চৈতন্য সংক্রমণজাত সংকেতবার্তা―আর এরই মধ্যে যাবতীয় বস্তু ও প্রাণজাত দৃশ্যবাস্তবতা কিংবা ছায়াবাস্তবতা সবকিছুর মধ্যে নিজেকে অনুপস্থিত করতে করতে কবি কুমার 'সূত্র' কবিতায় স্পষ্ট করে দেন তাঁর অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের দ্বন্ধ। লেখেন এইসব গাঢ় পংক্তিমালা :

নিজেকে অদৃশ্য করতে কে না চায়? দৃশ্যমানতার থাকে
সারাদিন―একান্ত জ্যামিতি। ভাসমান ক্লান্তিভারে লুপ্ত
করেছি এ দেহবোধ, চৈতন্যকে বলেছি―পরিব্যাপ্ত হও
সময়ের ডালে; মস্তিষ্কের করোটির গভীর গভীরে
দুর্বোধ্য সংকেতবার্তা―অর্থোদ্ধারে হয়েছি বারিত,
বোঝে না কথনবিশ্ব, বোঝে শুধু পরাবাস্তবতা―
নৈঃশব্দ্যের আত্মপরিসর। এভাবেই অধিজগতের কাছে
উৎসপাঠ নিয়েছে তুমুল, অনেকার্থ বেদনা নিহিত ছিল
নির্জ্ঞানতা, গাণিতিক ঐক্যগুলো ভেঙে গেছে তার
মাধ্যাকর্ষণে, ফলে আমি প্রতীকবাদী নিশ্চেতনা নিয়ে
যত্রতত্র ছুটোছুটি করি, চিন্তাক্রিয়া স্বতঃসিদ্ধ করে
বুঝেছি সমগ্রের অবসাদ, সত্যভ্রম নয়, শুধু প্রতিভাস
আমাকে করেছে সম্মোহিত। প্রয়োজন ছিল না তো জীবনের
যেমন অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুও;―এই দুই বহির্ভূত আগাছায়
ভরেছে এ দেহকাল।

সত্যি বলতে এসব পংক্তিমালার কোনো ব্যাখ্যা হয় না―ব্যাখ্যা সম্ভবও নয়―পংক্তিতে পংক্তিতে শুধু দেখবার বিষয়―কবি ও কবিতার অভ্যন্তরীণ যূথবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিক জীবনের ভেতর, তুমুল আমোদ ও আহ্লাদের ভেতর, এই যে আমাদের চারপাশে কত রকম পাতানো সংসারের প্রথাবদ্ধ জ্যামিতি তৈরি হয়ে গেছে―এই যে আইন-আদালত-ইসকুল-পানশালা-স্খলন-পতন-ক্লান্তি-গোলকধাঁধা ―এরই মধ্যেই তো যাবতীয় উদ্বেগ আর অতৃপ্তি নিয়ে সন্তানের জন্ম দিতে দিতে কেটে যাবে কাল। বিভ্রম আর নানামুখী অমূল প্রত্যক্ষণের মধ্যদিয়ে এইভাবেই 'অভীপ্সার চোরাটানে উন্মোচিত অর্থহীনতায়' আমরা কালও ছিলাম―আজও সেই একই জ্যামিতির জীবনপদ্ধতিতেই রয়ে গেছি। আর এই জ্যামিতির প্রথাবদ্ধ জীবনপদ্ধতির মধ্যে সংগম করতে করতে, ইসকুলে যেতে যেতে, চাকরির চক্রব্যূহে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে, একসময় আমাদের শরীরের সমস্ত রেখাগুলো বেঁকেচুরে যায়―মাংস আর মেধায় সমূহ সর্বনাশ নিয়ে ঢুকে পড়ে অনিঃশেষ জীবাণু―আর তখনই তো প্রজ্ঞা ও হৃদয়ের ভেতর শুরু হয়ে যায় প্রশ্নজাগ্রত স্নায়ুযুদ্ধ―আর তখনই তো মানুষ ভেতরে ভেতরে স্পষ্ট অনুভব করতে থাকে―এই জীবন কতখানি স্থূল, এই রক্তপাত ও রক্তক্ষরণ কতখানি অর্থহীন এবং আমরা এই যে দেহী অবয়ব নিয়ে ভূতত্ত্ব ও ভূমিবিদ্যারূপ জৈব জীবনের ভেতর দাঁড়িয়ে রয়েছে―এ সবই তো এক দুরারোগ্য কর্কট রোগ আক্রান্ত 'বিমূঢ় উপস্থিতি'। কবি কুমার এখান থেকেই একা ও নিঃসঙ্গ হয়েছেন এবং সেই নিঃসঙ্গতাজাত প্রজ্ঞাদীপিত চিন্তাক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট বুঝেছেন―চলমান মুহূর্তের যাবতীয় উল্লাস ও উদ্যাপনের মধ্যেই রয়ে গেছে সমগ্রের অবসাদ… আর এখান থেকেই তিনি এক চরম সত্যে উপনীত হন এবং যাবতীয় বাকপ্রিয় বাচালতা অতিক্রম করে শেষাবধি স্থিতপ্রজ্ঞ উচ্চারণ করেন―'কে যেন ঘোরায় চাকা স্নায়ুনালির গুপ্তপথে'―। এবং সেই সূত্রেই মানুষের মধ্যকার সবরকম বসতবাড়িতে প্রবেশ করে দ্বিধাহীন বিশ্বাসে এও তিনি বলতে বাধ্য হন :

কোনো মানুষই জানে না কোথায় আরম্ভ
আর কোথায় বা শেষ, কে জানে
জগতের ভেতর অনেকগুলো জগৎ
যেমন চাঁদের ভেতর অনেকগুলো চাঁদ
আকাশের ভেতর অনেকগুলো আকাশ …

'তবে এসো হে হাওয়া, হে হর্ষনাদ' নামক দীর্ঘ প্রবহমান কবিতাটির এই নির্নিমেষ পংক্তিগুলো স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় কবি কুমার তাঁর ভ্রমণের বিবরণ লিখতে লিখতে মুখ্যত পথহীন পথের গভীরে চলে গিয়েছেন এবং 'স্বপ্ন আর গন্তব্যের হাহাকার' নিয়ে সূচনা ও সমাপ্তির ফাঁদ পাতা নীরবতাকেই স্পর্শ করেছেন। জীবন ও তার আরম্ভ আসলে সবসময়ই একটা 'মুগ্ধ চিত্রকল্প'। কবি কুমার ফড়িং কিংবা প্রজাপতির মতোই সেই মুগ্ধ চিত্রকল্পে এসে বসেছেন। আর ক্রমে ক্রমে দেখেছেন―সর্বত্রই রয়েছে এক 'অদৃশ্য ও অবিস্মরণীয়' ফাঁদ―আর এই ফাঁদের বিরুদ্ধে অসম্ভব নিঃসঙ্গতাজাত আমূল প্রতিক্রিয়াই হলো তাঁর কবিতা―যে কবিতার প্রজ্ঞাচেতনে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু গভীর মর্মদাহ থেকে আমাদের স্রেফ দুটি কথা বলেন :

―হাসতে হাসতে আমি শূন্য হয়ে যাব …
―হাসতে হাসতে আমি নিখিল হয়ে যাব …

স্থূল জীবকাতর জীবনচক্র থেকে এভাবেই নিজেকে প্রত্যাহার করেন কবি কুমার, পথভোলা অব্যাহতি গ্রহণ কবি কুমার, কিন্তু তাই বলে আজও জীবনের হলকর্ষণ করে চলেছে যেসব মানুষ―তাদের বিশ্বাস ও আমোদকে কিন্তু এতটুকুও অগ্রাহ্য করেন না তিনি। শুধু সতর্ক করেন তাদের… সচেতন করেন তাদের… বলেন―নিম্নভূমিতে রয়েছে বিমূঢ় ও বিস্ময়কর একটি মায়ামুকুর। এই 'মায়ামুকুর' শুধু চিরকাল মাতাল করে রাখে, কোনো দিনও মহাপ্রাণধ্বনি দেয় না…

… এখন নভশ্চর আমি…আজ উড়ব পাখা ছেড়ে দিয়ে …

আসলে সব অর্থেই কবি কুমার চক্রবর্তী লিখেছেন স্বপ্নভাঙা অথচ স্বপ্নগ্রস্ত জৈবনিক কবিতা। এই সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে তাঁর নিঃশব্দ ও নীরব কবিতা অন্ধকার গর্ভগৃহে প্রবেশ করা দরকার। সত্যি বলতে প্রত্যেক মন্দিরের ভেতর যেমন করে একটা অদৃশ্য বা লুক্কায়িত গর্ভগৃহ থাকে, যে গর্ভগৃহ দেখতে হলে বাইরের আলোকসজ্জা নয়―চকিত সম্মোহে নেমে যেতে হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে―গভীরে, আরও গভীরে―তদ্রূপ প্রত্যেক কবিরও একটা করে নিজস্ব গর্ভগৃহ থাকে―যার অভ্যন্তরীণ দ্যুতি ও বিস্ময়ে পৌঁছতে হলে চাই অন্তর্গত চেতনাশক্তি। কবি কুমারও তাঁর রচিত কবিতার অভ্যন্তরে সবসময়েই এ-রকম একটা নিঃশব্দ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্ভগৃহ ধরে রেখেছেন। দীর্ঘকালীন কবিতাপাঠের ক্রিয়া ও প্রক্রিয়া থেকে আজ আমরা এই সত্য জেনে গেছি যে কোনো কোনো কবি, কালের প্রেক্ষিতে, দেখা যায়―নিজের নাড়ী টিপে শরীরী, সংবেদী ও স্নায়বিক স্নায়ুযুদ্ধের কবিতা লেখেন―লিখতে লিখতে নাড়ীকম্পিত শব্দগৃহ থেকে ক্রমশই স্নায়ুকম্পিত বোধিগৃহে চলে যান―সময়ের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে এবং গোপন সব অসুখের সঙ্গে নিরন্তর সংঘর্ষ করতে করতে তিনি অনেক সময় ভুল জীবনের গর্ভাশয় চিরে বার করে আনেন মানবীয় সত্তার রহস্য ঝাঁপি―যেখানে স্বপ্ন ও বেদনা একইসঙ্গে নিজেদের ভাষায় কথা বলে ওঠে। কবি কুমার অবশ্যই এই 'কোনো কোনো কবি'র তালিকায় পড়েন। তাঁর কবিতার গর্ভকেন্দ্র একটাই―যা আসলে এক 'স্নায়ুর দুর্বোধপ্রতিম প্যান্ডোরাবাক্স'―যা খুললেই একসঙ্গে বার হয়ে আসে আদিম ও আধুনিক নিরস্ত্র স্নায়ুযুদ্ধের তৃষ্ণা ও আক্রান্ত উত্তাপ―তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে এই তৃষ্ণা ও উত্তাপটাই সর্বাধিক জরুরি―সবচেয়ে বড়কথা―তাঁর কবিতায় দুটি মানুষ সর্বদাই পরস্পর একে অপরের পরিপূরক হয়ে আসে―একজন রোদে জ্বলে কামে ক্লেদে লৌকিক মানুষ―আর একজন দূরসঞ্চারী―নিয়ত ভ্রাম্যমাণ―যাকে বলা যায় অলীক মানব। লৌকিক মানুষ যখন তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়, তখন টের পাওয়া যায় কী তীব্র তার তৃষ্ণা ও উত্তাপ, কী তীব্র তার ঘ্রাণ ও রতিকলা। আর যখন এই লৌকিক মানুষ ক্রমে ক্রমে অলীক মানব হয়ে ওঠে―তখনই তার মধ্যে চলে আসতে থাকে পাখির মতো উড়বার ইচ্ছা, বৃক্ষের মতো স্থিরনিমগ্নতা―কবি কুমার এই মানুষের মধ্যে একইসঙ্গে বাস করেন আর সেই বসবাস থেকেই নিজের মধ্যে তুলে আনেন জীবন ও সময়সংক্রান্ত নানাবিধ অসমাপ্ত প্রশ্নমালা, কবি কুমার যাকে তাঁর কবিতাসংগ্রহের 'ভূমিকা'-গদ্যে স্পষ্ট বলেছেন―অশ্লেষা আক্রান্ত অপূর্ণের সহসংবেদন ও বিপর্যয়ের সৌন্দর্য। বলেছেন―কালগ্রাসিত তৃতীয়ার চাঁদ। তাঁর লৌকিক মানুষ ও অলীক মানব―এই দুইয়েরই উৎস ও উৎপত্তি মূলত এ-হেন কালগ্রাসিত দুঃখবোধের ইন্দ্রিয়ানুভূতি থেকেই। আর তখনই মনে হয় আমাদের, মনে হতে থাকে আমাদের―তাহলে কি কবি কুমারের ক্রমাগত স্নায়ুযুদ্ধ এই কালগ্রাসিত দুঃখবোধের সঙ্গেই? তাহলে কি এই কালগ্রাসিত দুঃখবোধের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ করতে করতেই কবি কুমার বুঝেছেন চলমান জীবন আসলে একটা ধারাবাহিক ভ্রমবাতুল ফাঁকি? শূন্যগর্ভ স্বপ্নের তাঁত? কিংবা অলীক বাতিঘরের ভেতরে যাবার মিথ্যে এক ক্যালাইডোস্কোপ? তবুও, তবুও, কী এক পরম ঐশী আহ্লাদে কখনো কখনো 'নিশীথ-পিদিম' জ্বলে ওঠে। তবুও, তবুও, কী এক আশ্চর্য সৃজনীকলায় চারদিকে পতঙ্গেরাও ধ্বনির কবিতা লিখে যায়। কবি কুমার এইসব পর্যবেক্ষণ করেন। কবি কুমার এইসব দেখতে দেখতে সময়হীন চিহ্নের ভেতর নিজস্ব উড়বার ডানা খুঁজতে থাকেন আর বস্তুজগতের এই ঠিকানাহীন অন্ধকার থেকে কোনো এক দিক-নির্দেশক আলোকসঞ্চারের দিকে উড়ে যাবার তীব্র আকুলতায় নতুন এক জীবনের শরীরী স্থাপত্য খোঁজেন আর শূন্যতাকে অতিক্রম করবার জন্য শূন্যতার ভেতরেই ডানা মেলে উড়বার কথা ভাবেন আর ক্রমশ এই স্পৃহা ও পিপাসা থেকেই বলেন :

ক. খসে গেছে দেহ, শুধু ডানা দিয়ে
চলে গেছি―অস্তাচল থেকে
নভোসন্ধানের কাছে …

খ. এখন নভশ্চর আমি, যাচ্ছি আকাশের উড়াল প্রান্তিকে
আজ উড়ব পাখা ছেড়ে দিয়ে, মন খুলে দিয়ে …

প্রথম কবিতাটির নাম―'ইমন' এবং দ্বিতীয় কবিতাটির নাম―জার্নাল ১৪১৮। জলের জীবন ও স্থলের জীবন যখন ক্রমশই এক নাস্তিগর্ভ বস্তুজগতের বোধহীন 'অশ্লেষা-আক্রান্ত'―তখন স্নায়ুবেদনাগ্রস্ত মানুষ শেষাবধি কোথায় যাবে? কোথায় গিয়ে আশ্রয় ও স্থাপত্য পাবে? ফলত কোথাও একটা যথাযথ আশ্রয় পাবার মর্মতাড়িত প্রয়াস যেন ছড়িয়ে আছে কবি কুমারের পংক্তিতে পংক্তিতে। কালগ্রাসিত মরত্ব ও চিত্রবৎ মন্থরতার শূন্যগর্ভ শ্বাসপ্রশ্বাস―এই দুইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা ক্রমশই হয়ে উঠেছে এক প্রদীপ্ত প্রকল্পনা―আর এই প্রদীপ্ত প্রকল্পনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যুগ অনুযায়ী নিয়েছিলেন―'মাঝি', জীবনানন্দ যুগ অনুযায়ী নিয়েছিলেন―'নাবিক' এবং কবি কুমারও তাঁর যুগের অভিপ্রায় অনুযায়ী নিলেন―নভশ্চরের উড়ন্ত ভূমিকা ও পরিক্রমা। আসলে রবীন্দ্রনাথের ছিল জলে জলে ভাসমান মানবীয় ঐশীসন্ধান, জীবনানন্দের ছিল প্রেম ও নীড় পাওয়ার ঘনগভীর প্রত্যাশায় জল থেকে ডাঙায় (―দারুচিনি দ্বীপে―?) উঠে আসবার আপ্রাণ প্রয়াস, আর কবি কুমারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নতুন সময়ের এবং নতুন যুগের নতুন বসতি খুঁজে নেবার আগ্রহী ও উন্মুখ নভশ্চর ভূমিকার শূন্যভ্রমণ। আর এই শূন্যভ্রমণের কারণ ও তাৎপর্য জানাতে গিয়ে কবি কুমার তাঁর 'কবিতা সংগ্রহ'-এর (দ্রষ্টব্য : সংবেদ―ফেব্রুয়ারি-২০১৯) ভূমিকা-গদ্যে বলেছিলেন :

শিল্প হলো বিপর্যয়ের সৌন্দর্য। একটি অসম্ভব-অনিয়ন্ত্রিত বিরামহীন―জবরজং গতিবাদের মধ্যে মানুষ সেঁটে গেছে অজান্তেই যা সে হয়তো চায়নি, এই না-চাওয়াই জন্ম দিয়েছে এক অবোধ মানবনিয়তির, যার আঘাত এসে পড়ছে সংবেদনশীলতার সাহারায়। মানুষ ফেঁসে গেছে তার নিজস্ব ফাঁদে। আমার কাছে মনে হয়―এটাই এখনকার কবিতার সর্বজনীন লাইটমোটিভ। কেননা এর থেকেই ব্যক্তিক দুঃখবাদের জন্মান্তর, এর থেকেই ঐতিহাসিক দুঃখবাদেরও রূপগ্রহণ… এই উপলব্ধি থেকেই কবিতা লিখছি… জরুরি বাস্তবতার ফাঁকা, ফাঁপা প্রতিস্থাপনগুলোর অন্বেষণ। আমাদের কোনো জায়গা ছিল না কস্মিনকালেও, বা আমাদের জায়গাগুলো লোপাট হয়ে গেছে। আমরা আছি শূন্যগর্ভতায়, শূন্যময় একটি জীবন দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কীইবা করতে পারি আমরা… মানুষ আর বস্তুর সমাধিমগ্নতাকে চিনতে ও ধরতে পারলে হয়তো কবি হিসেবে আমার কাজ সারে… কিন্তু এটাও এক ফাঁকি… অজানার পশ্চাদ্ধাবন, অসম্ভবের পিছু নেওয়া, জানি তা নিপাট ব্যর্থতা, তবু কোথায় যেন আনন্দ বা বোধায়ন, কিছু না পেয়েও যেন পাওয়া হলো―এই বোধ থেকেই মনে হয় কবিতা লিখি…

এই গদ্যাংশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে কবি কুমারের নভশ্চর স্বরূপ সবণজাত শূন্যভ্রমণের অতৃপ্ত ও অসমাপ্ত কারণ এবং এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে একইসঙ্গে কবি কুমারের সামগ্রিক কাব্যভাবনাও। এই গদ্যাংশ থেকেই আমাদেরও ক্রমে ক্রমে তাঁর কবিতাকেন্দ্রিক প্রশ্নমুখী অনুসন্ধিৎসা শুরু হয়ে যায়―তাহলে কি ফাঁকা ও ফাঁপা বাস্তবতার প্রাত্যহিক বিপর্যয়ের সৌন্দর্য থেকে মুক্তি নেবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁর এই নভশ্চর শূন্যভ্রমণের ইচ্ছে? তাহলে কি শূন্যগর্ভ জীবনের জবরজং আহাম্মক গতিবাদের অবোধ মানবনিয়তি থেকে সরে যাবার ও সরে থাকবার অভ্যন্তরীণ পিপাসা থেকেই তাঁর ডানা মেলা উড্ডীয়মান এই অভিযাত্রা? নাকি ঐতিহাসিক দুঃখবাদের ভেতর যৌনশরীর নিয়ে সম্পূর্ণ ফেঁসে যাওয়া মানুষের প্রাত্যহিকী সমাধিমগ্নতা দেখতে দেখতে অসহ্য বিমোক্ষণেই তিনি পাড়ি দিতে চাইছেন ওই শূন্যে ওই সামগ্রিক আবহমানতায়? এসব প্রশ্নই আসলে কবি কুমারের নিহিত কাব্যদর্শন। তিনি জানেন―বস্তুর সমাধিমগ্নতা থেকে, শরীরী চাওয়া-পাওয়ার দুঃখবাদ থেকে, বস্তুবাদী অশ্লেষা আক্রান্ত শূন্যগর্ভতা থেকে মানুষজন্মে মুক্তি পাওয়া অত সহজ নয়। তিনি এও জানেন―শূন্যভ্রমণের মধ্যে গিয়েও এই নভশ্চর-স্বরূপও হয়তো জীবনসংক্রান্ত ও সময়-সংক্রান্ত কোনো মৌল প্রশ্নেরও ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পাবে না। হয়তো সবটাই হয়ে উঠবে―'অজানার পশ্চাদ্ধাধন।' হয়তো সবটাই হয়ে থাকবে―'অজানার পিছু নেওয়া।' তবুও, তবুও কবি কুমার যেতে চান সেই অজানা জীবনসংকাশে―কারণ বস্তুবাদী জীবনের উত্থান, পতন ও সংঘর্ষের মধ্যে বাস করতে করতে তাঁর সত্তাগত স্নায়ুকম্পনে প্রতিদিন যে-সব প্রশ্ন ক্রমাগত তৈরি হয়েছে―সেই মৌল প্রশ্নমালা তিনি কোথায় রাখবেন? একা কেনই-বা বহন করবেন? মনে পড়ে যায়, এরকমই এক অস্বাভাবিক সময়কালে, ১৮৭৯ সালে, টলস্টয়, ছোট্ট ছোট্ট কাগজের চিরকূটে, বিভিন্নরকম প্রশ্ন লিখে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কবি কুমারও ছড়িয়ে দিতে চাইছেন―কিন্তু বস্তুবাদী চার দেয়ালের ভেতর নয়, শূন্যভ্রমণের সেই অনাবিষ্কৃত মহাজগতের অদৃশ্য তরঙ্গায়িত শূন্যের ঢেউ ও স্পন্দনে―যেখানে আত্মা ও নক্ষত্রেরা সংসার পেতে স্থলপদ্ম ও রক্তপলাশ ফুটিয়ে চলেছে―কবি কুমার সেই নিশ্চুপ সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার কাছেই নিয়ে যেতে চান তাঁর আকণ্ঠ জীবনসংঘর্ষজাত প্রশ্নমালা…

… পতঙ্গেরা লিখে যায় ধ্বনি কবিতা …

কবিতামাত্রেই তো একধরনের ব্যথার কৃষ্ণগহ্বর থেকে চুঁইয়ে নামা মনোজগতেরই রহস্য। যে রহস্যময় ব্যথার পাহাড়ে ডুবতে ডুবতে কবিও কোনো এক ভ্রান্তবেলার হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে হঠাৎই শুনতে পান স্যানাটোরিয়াম নামক এই বিশ্বগহ্বরে শ্যাওলারা ব্যথায় চিৎকার করছে। আর তখনই নড়ে ওঠে স্নায়ুর সংস্থাপন; সেই নড়ে ওঠা স্নায়ুকম্পন থেকেই পতঙ্গেরা যেভাবে লিখে যায় ধ্বনির কবিতা, রক্তমাংসপুঁজসর্বস্ব মানুষ কি পারে সেই প্রাকৃত স্পন্দনের কবিতা লিখতে? হয়তো পারে―হয়তো পারে না। আর এই পারা-না-পারার দ্বান্ধিক ডায়ালেকটিকে দাঁড়িয়েই তো কবিতা লিখেছেন কখনো সিকদার আমিনুল হক কখনো দেবীপ্রসাদ, কখনো খোন্দকার আশরাফ হোসেন কখনো শম্ভু রক্ষিত, কখনো ফরিদ কবির কখনো ভাস্কর চক্রবর্তী, কখনো উৎপলকুমার বসু কখনো শামসের আনোয়ার, কখনো ব্লেজ সেঁন্দ্রর কখনো রেনে শার, কখনো গিয়োম আপলিনের কখনো ফ্রান্সিস পোঁজ… স্নায়ুযুদ্ধের কবিতা লিখতে লিখতে, স্নায়ুকম্পনের কবিতা লিখতে লিখতে, এভাবেই তো যুগ যুগ ধরে কবিরা কবিতায় সৃষ্টি করেন অন্তর্গত ও অন্তর্ভূত ধ্বনির কম্পন। সবাই কি সফল হতে পারেন সবসময়? পারেনও না। কিন্তু সেসব সাফল্য বা ব্যর্থতার পিচুটি লাগা টীকা-ভাষ্যে আমাদেরই-বা কী আসে যায়? বরং এইসব কবিতা পড়তে পড়তে আমরা শুধু বলব―'অন্ধকারের ভেতর তোমার লেখাগুলো পড়ে ফেললাম।' আমরা শুধু বলব―'শুরু হলো তোমার ধাঁধা।' আমরা শুধু বলব―'বিশাল এলিজি নিয়ে নত হই আকাশ প্রণামে।' আমরা শুধু বলব―'তবে এসো হে চিহ্ন, হে নিস্তরণ, গুপ্তপথ ধরে চলো যাই কোনো এক সীমাহীনতায়।' স্নায়ুকম্পিত এবং স্নায়ুযুদ্ধকাতর ধ্বনির কবিতা লিখতে হলে এইরকমই একটা 'গুপ্তপথ' চাই―যে পথ পৌঁছে দিতে পারে কোনো এক সীমাহীনতায়। কিন্তু সব কবি কি জানে সেই কাঙ্ক্ষিত 'গুপ্তপথ'-রহস্য? সব কবি কি জানে সেই ধু ধু অনির্বাণ 'সীমাহীনতা'র চিরন্তন তরঙ্গবাহিত ঢেউ ও বিস্তৃতি-রহস্য? কবি কুমারের বিপর্যয়ের সৌন্দর্যজাত স্নায়ুযুদ্ধ ও স্নায়ুকম্পনের এইসব কবিতা পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়ে যায় প্রণবেন্দুদার সেই অর্ধস্ফুট অসংলগ্ন স্বর :

―বোধাক্রান্ত শব্দটা বসাও…
―বোধাক্রান্ত শব্দটা বসাও…

আর তাঁর পাশাপাশি, তাঁরই অসংলগ্ন ও অসমাপ্ত স্বরের সঙ্গে ক্রমশ, ক্রমশ, মিশে যেতে থাকে রেনে শার সেই চরমতম কথা―'আবার আমরা অজানা এক ভারসাম্যে নিঃসঙ্গ মুখোমুখি হলাম, কবিতা।' অদ্ভুত এক আদিম ও মরমিয়া যন্ত্রণায় নীরব বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে দুঃখসহন ও দুঃখদহনের কালমুহূর্তে তিনিই তো তাঁর কবিতায় বলে গিয়েছিলেন―'পবিত্র আসন কোথাও নেই।' কবি কুমারও হয়তো এই সূত্রে ও সত্যে অবগাহন করেই 'নভশ্চর' হয়ে ওঠার পথে নতুন করে যাত্রা করেছেন।