নিহত দিনের নাট্য: মোরাকেবাবিচ্যুত এ্যাবসার্ডিটি

মুহম্মদ মুহসিন
Published : 27 April 2022, 05:32 PM
Updated : 27 April 2022, 05:32 PM


বাংলা সাহিত্যে এ্যাবসার্ড নাটকের চর্চা খুব কম। গল্পপ্রিয় বাঙালি জাতি গল্পহীন নাটক উপন্যাস কল্পনা করতে ভয় পায়। তাদের নাটক উপন্যাস সবকিছুতে গল্প লাগবে। সে গল্প দর্শক পাঠকের মনোযোগকে টানটান করে রাখবে খালি 'এরপর কী ঘটলো'- এই চিন্তায়। তাছাড়া এ্যাবসার্ডের অর্থহীনতার দর্শনও বাঙালির ধাতের সাথে খাপ খায় না। সেলিম আল দীনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল- 'আপনি লম্বক, নাচারি, দিশা ইত্যাদি মধ্যযুগীয় কথকতার ধারণা প্রয়োগ করে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী যে নাট্যধারা প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন কথকতার ঐসব ধারণায় তো কথকতায় ঘটনাময়তা ও ঘটনার গতিময়তা আবশ্যিক, ফলে এই ধারায় নাটকে ঘটনাহীন বা আখ্যানহীন এ্যাবসার্ডিটি ধারণ করবেন কীভাবে?' তিনি উত্তরে বলেছিলেন 'আমি এ্যাবসার্ড থিয়েটারে একদম বিশ্বাস করি না। মানুষের জীবনে এ্যাবসার্ড কিছু থাকতে পারে না'। সেলিম আল দীন এই কথার মধ্য দিয়ে নাটকের আধুনিকতাকেই অস্বীকার করেছিলেন কি না জানি না। আমাদের বাংলাভাষায় সাঈদ আহমদই সম্ভবত একমাত্র এবং প্রথম এবসার্ড নাটক-রচয়িতা। তবে তার মতোই আমাদের বেশিরভাগ নাট্যকারই যে, এ্যাবসার্ড থিয়েটারের পথে পা বাড়াচ্ছেন না তার মূলে এক অন্যতম কারণ হলো আউল-বাউল-ফকির-দরবেশ-তান্ত্রিক-সাধকদের এই দেশে এখনো মানুষ জনমভর জীবনের অর্থ খোঁজার সাধনা থেকে নিজেদেরকে বিয়োজিত করতে পারছে না। ফলে আধুনিক সামাজিক-রাজনৈতিক অনাচার ও ধর্মদর্শনের তাত্ত্বিক ভিত্তির বিপর্যয় মানুষের জীবনকে যতই অর্থহীন করে তুলুক, জীবনের অর্থহীনতার উপস্থাপন আমাদের নাট্যকারদের সাহসে কুলোচ্ছে না।

এর আরেকটি কারণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণটি বয়ান করতে কবি খোন্দকার আশরাফের একটি কবিতা থেকে কয়েকটি শব্দ ধার করে বলা যেতে পারে যে, আমাদের শিল্পসাহিত্যের স্রষ্টাগণ বেশিরভাগ সময় আমাদের পাওয়ারফুলদেরকে ঘিরে মোরাকেবায় থাকেন। তাদের সেই মোরাকেবার মাজেজা যদি তাদের সৃজনকর্মে তুলে ধরতে না পারেন তাহলে স্বাভাবিকভাবে তাদের মোরাকেবা কামিয়াব হয় না এবং যাদেরকে ঘিরে এই মোরাকেবা তাদের মর্জি বিগড়ে যাবার ভয় থাকে। ফলে এইসকল শিল্পসাহিত্যের স্রষ্টাগণকে তাদের সৃজনকর্মে চতুর্মুখী প্রয়াসে দেখাতে হয় তাদের পাওয়ারফুলরা কত সার্থকভাবে জগৎসংসারের সবকিছু অর্থময়, বৈভবময় ও কীর্তিময় করে তুলছেন। এই প্রয়াসের ফসল হিসেবেই তাদের সাহিত্যে যাপিত জীবনের অর্থহীনতার প্রকাশ অসম্ভব। তাদের সাহিত্যে জীবনের অর্থহীনতার প্রকাশের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তারা যাদের মোরাকেবায় আছেন জীবন ও জগৎকে অর্থময় করে তুলতে তাদের পারঙ্গমতা নিতান্তই ঢঢনং। তৌবা, তৌবা, এই কথা তাদের সাহিত্যে তারা কেমনে উপস্থাপন করবেন? তাহলে পাওয়ারহাউজের সাথে লাইন দেয়া তাদের সব তারই তো ছিঁড়ে যাবে। ফলে এই তারছেঁড়া কম্মে তারা কোনোভাবেই আগান না, আর বাংলাসাহিত্যও এ্যাবসার্ডের কথা শুনলে তওবা-আস্তাগফিরুল্লাহ বলে পাওয়ারফুলদের পানাহ কামনা করে।

তবে মোরাকেবার এই মচ্ছবেও মাঝে মাঝে দুয়েকটি ফাসেকি আওয়াজে আচমকা কান খাড়া হয়ে ওঠার ঘটনা বাংলা সাহিত্যেও ঘটে। সম্প্রতি এমন একখানা ফাসেকি আওয়াজ এই রোজারমজানের দিনে আমার কানদুটোকে বেশ ঝামেলায় ফেলেছে। আওয়াজখানা এসেছে যে হালজামানার ফস্টাসের কাছ থেকে তিনি জাহিদ সোহাগ নামে বাজারে পরিচিত। তার কেতাবখানার নাম 'নিহত দিনের নাট্য'। আমাদের শিল্পসাহিত্যের মোরাকেবা গোষ্ঠি তাদের মোরাকেবার মাজেজায় যে দিনের কথা বলেন, দিনের আলোর যে উদ্ভাসের কথা বলেন, মোরাকেবার লাইনচ্যুত জাহিদ সোহাগ সেই দিন কীভাবে আমাদের সকলের সামনে খুন হচ্ছে এবং খুন হয়েছে তার অজস্র এলোমেলো দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে দিগ্বিদিক টানতে থাকেন আর কানের পর্দা ফাটিয়ে সেই খুনের চিৎকার শোনান। ব্যাপারটা মোরাকেবার মাজেজাকে খান খান করে দেয়, পাওয়ারফুলের মোরাকেবায় উচ্চারিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থিক-বৈষয়িক সকল অর্জনের শ্লোগানের ফাঁপা অভ্যন্তরকে আলীবাবার মতো ছিছিম ফাক করে দেখিয়ে দেয় এবং অর্থের খোলস খুলে মোরাকেবাপন্থীদের গল্পগুলোর ফাঁপা অনর্থকে থিয়েটার অব দ্য এ্যাবসার্ডের আঙ্গিকে দৃশ্যমান করে তোলে।

আখ্যানহীন এই অনর্থের নাট্যে সকল উচ্চারণ ও দৃশ্যায়নের দুটি কেন্দ্র দৃষ্টিগোচর হয়। একটিতে রয়েছে জীবনকে পেঁচিয়ে ধরা বিশাল বিষাক্ত এক আজদাহা যার জনপ্রিয় নাম হলো রাজনীতি, আর অপরটিতে রয়েছে জীবনের সকল অর্থ শুষে নেয়া রক্তচোষা দুই ভ্যাম্পায়ার যোনি আর শিশ্নের মাঝে হাসফাসরত অসহায় এক মানবিক অস্তিত্ব। প্রথম গুচ্ছের দৃশ্যসমূহের কয়েকটির শিরোনাম যেমন: 'প্রায় তিন/চার জন', 'মৃত্যুরঙিন', 'নিহত দিনের', 'ফুল প্লে', 'রাজা বা রাজার মতো কেউ' ও 'জিহাদ, জিহাদ'। যোনি ও শিশ্নরূপ ভ্যাম্পায়াররা জীবন নিয়ে খেলছে যে সব দৃশ্যে সেগুলোর কয়েকটি যেমন: 'বাতি নিভিয়ে যাও, দরোজাও', 'পাতা ঝরার আগে', 'তোমাকে আমাকে', 'প্রেম এক পরিখার জল', 'নীল ও নীলিমা', 'চরিতামৃত' ও 'নরক'। রাজনীতি আর যোনি-শিশ্নের মল্লযুদ্ধের ক্ষেত্র থেকে দূরত্ব রচনা করতে পারলেও যে এই অনর্থে পরিবৃত জীবনে অর্থময়তা প্রযুক্ত হওয়ার কোনো দ্বার উন্মোচিত হয় না তার প্রকাশ ঘটেছে 'নিহত দিনের নাট্য'-এর যে দৃশ্যে তার নাম 'তাহলে কী রান্না করবো'।

এই দৃশ্যাবলীর প্রথম গুচ্ছে বিশেষ করে আমাদের মোরাকেবাপন্থী লেখকগোষ্ঠী থেকে জাহিদ সোহাগের স্বতন্ত্র স্থান ও অস্তিত্ব ঘোষিত হয়। 'প্রায় তিন/চার জন' শীর্ষক দৃশ্যমালায় গল্পরহিত কিছু চরিত্র ও একটা দেশের পরিচয় পাওয়া যায়। বোঝা যায় চরিত্রগুলো আমরা এবং দেশটাও আমাদের। দেশটি জীবনের এ্যাবসার্ডিটির স্বর্গভূমি। সেখানে চরিত্ররা এমনই ব্যক্তিত্বহীন ও বিশেষত্বহীন যে তাদের পরিচয়জ্ঞাপক ব্যক্তিগত কোনো নাম নেই। তাদের একজন 'মধ্য-বয়সি নারী', একজন 'যুবক-বয়সি পুরুষ' এবং তৃতীয় জন 'আরেক 'যুবক-বয়সি পুরুষ'। এই তাদের সাকুল্য পরিচয়। নামের পরিচয়ে তারা হারুন হতে গিয়ে দেখে মামুন, আবার মামুন হতে গিয়ে দেখে হারুন। তারপর বলে 'ওই একই- মামুনও যা হারুনও তা'। তারপরে তারা কে জীবিত এবং কে মৃত তা সনাক্ত করতে গিয়েও গোল বেঁধে যায়। 'অজ্ঞাত, নিহত, মর্গে বা বেঁচে থাকা মামুন ও হারুন'- এই সকল সম্ভাবনায় তাদের অস্তিত্ব অনুভূত হয়। এই চরিত্রদের নিয়ে মঞ্চে যিনি খেলতে চেষ্টা করেন তার চারিত্রিক নাম 'নাট্যকার'। তিনি নিজেকে 'গণতন্ত্রের সেবক' বলে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু চরিত্ররা তার গা থেকে কর্নেলের গন্ধ পায়। সে অস্বীকার করলে চরিত্ররা বলে তার জাইঙ্গা থেকে কর্নেলের গন্ধ আসছে। এই কর্নেলের কথিত হট্টমুলার গাছ থেকে গণতন্ত্র পেড়ে আনার চেষ্টা করতে করতে তাদের উপলব্ধি হয় তারা সবাই ধর্ষক আর ধর্ষণ করে তারা তাদের নিজেদেরকেই জন্ম দিচ্ছে। এই অভিন্ন পরিচয়ে তারা একাত্মতা অনুভব করে এবং তারা তাদের দলীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করে। এবার নাট্যকার কর্নেল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আর বলে- 'যাক (এখন) তোমরা রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ'। আমরা এই কর্নেল আর কর্নেলের জাইঙ্গাগুলো চিনি। তারা আমাদের গণতন্ত্রের সেবক। আর তাদের তাওয়াফে আর মোরাকেবায় মশগুল আমাদের লেখককুলকেও চিনি। তারা দলীয় সঙ্গীতের এই গায়কদলকে অনেক গায়েবি গুণে গুণান্বিত করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ একিলিস-আগামেমননরূপে উপস্থাপনে অহর্নিশ তৎপর। কিন্তু জাহিদ সোহাগ ঐ মোরাকেবায় মশগুল নয় বিধায় রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ ঐ ক্লীবশ্রেণিকে এমন নগ্ন করে দেখাতে পেরেছেন। এই ক্লীবরা জীবন ও জগৎকে, দেশ ও জাতিকে কতখানি ক্লেদাক্ততায় ও অর্থহীনতায় পর্যবসিত করেছে তা জাহিদ সোহাগের দৃষ্টিতে এই চরিত্র ও মানচিত্রকে দেখতে পারলে অনুভব করা সম্ভব।

নিহত দিনের এ নাট্যে কোনো অঙ্ক বিভাজন নেই। নাটকে অঙ্ক থাকা একটি আখ্যানের চলমানতা বোঝায়। আর আখ্যানের চলমানতা থাকলে সে নাটক তো এ্যাবসার্ড থিয়েটার থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। জাহিদ সোহাগ সেই ঝুঁকিতে যাননি। ফলে নাটকের দৃশ্যমালা পারম্পর্যহীন। পারম্পর্যহীন তার পরের দৃশ্যমালার শিরোনাম 'মৃত্যুরঙিন'। এই দৃশ্যমালায় প্রথমেই হাওয়া থেকে গায়েবি আওয়াজ আসে 'এত লাশ পোড়াইবো ক্যাডা, গোরই বা দিবো ক্যাডা?' এরপর এই লাশেরই একজন মঞ্চে উঠে বলতে শুরু করে- 'কোনো কথা চাপা থাকে না। কোনো লাশ গোপন থাকে না। . . . দুনিয়াডা উদাম পাছার লাহান। কোনো গোপন নাই। তুমি আমারডা দ্যাহো, আমি তোমারডা দেহি। কিন্তু তুমি মনে কর তোমারডা বুঝি কেউ দ্যাহে না।' যেমন রাষ্ট্রপতি মনে করছেন। পত্রিকায় এসেছে রাষ্ট্রপতি খেজুর গুড়ের পাটালি খেয়েছেন এবং খাওয়ার সময় তিনি বিরোধীদলীয় প্রধানের সাথে ফোনে ঘ্রাণ বিনিময় করেছেন। অথচ বিরোধীদলীয় প্রধান এই সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন, কারণ রাষ্ট্রপতি ঘ্রাণ বিনিময়ের সময় তাকে বলেছেন এটি ছিল মাংস দিয়ে রান্না কাঁঠালের এচোড়। জাতির সাথে রাষ্ট্রপতির এমন বেঈমানি করায় বিরোধীদলীয় প্রধান বিকালে প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন। কিন্তু টেলিভিশনে মোরাকেবাপন্থী বুদ্ধিজীবীগণ রাষ্ট্রপতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে কবর থেকে যুক্ত হওয়া সংস্কৃতিবিদ ডক্টর ড্যাশ দৃঢ়তার সাথে বলছেন যে, পাটালি গুড়ের সাথে মুড়ি সেবন বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ চর্চা। এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য জাতির বিরুদ্ধে কঠিন ষড়যন্ত্রের অংশ। এই যাত্রা-দেখা লাশ এবার নিজেই নিজেকে আর মঞ্চে খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ এই নাটক যে মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে সেই মঞ্চে তথা মানচিত্রে লাশ হওয়ার অধিকার সকলের আছে, কিন্তু সে লাশ খুঁজে বের করার অধিকার কারো নেই। মৃত্যুরঙিন এই মঞ্চকে মোরাকেবাপন্থীরা শুধু রঙিন রূপে দেখেন, আর জাহিদ সোহাগ দেখেছেন জীবনকে মৃত্যুর চেয়েও অর্থহীন শূন্যতায় বা এ্যাবসার্ডিটিতে পৌঁছে দিতে এই মঞ্চ ও মানচিত্র কতখানি পারঙ্গম।


পরের দৃশ্যমালার শিরোনাম থেকেই উদ্ভূত হয়েছে পুরো গ্রন্থের নাম। ফলে এটি পুরো নাটকের এক অনন্য গুরুত্বের অংশ বলা যায়। এ দৃশ্যমালার নাম হলো 'নিহত দিনের' এবং এর মূল উপজীব্য হলো ক্ষমতা কীভাবে সকল ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে দেয় তা দেখানো। তবে তা দেখানো হয়েছে এ্যাবসার্ড নাটকের ধারায় কোনো আদ্যমধ্যঅন্তসম্পন্ন আখ্যানের ব্যবহার ছাড়া। নামহীন চরিত্ররা 'যখন কথা বলতে পারি' ¯েøাগান দিয়ে বিরুদ্ধতার স্বর তোলে, উচ্চারণ করে 'খুন', কিংবা 'ব্যাংক লুট', কিংবা 'নদী কেড়ে নিলো', কিংবা 'ঋণ খেলাপি' তখনই ক্ষমতার বজ্র নির্ঘোষ 'তুই রাজাকার' কিংবা 'তুই নাস্তিক' কিংবা 'তুই জঙ্গি' ঘোষণা দিয়ে নির্দেশ দেয় 'মার শালাকে'। আর তার মধ্য দিয়ে চুপ হয়ে যায় সকল বিরুদ্ধ স্বর। নিরুদ্দেশ ডেড বডি হয়ে যায় বিরুদ্ধ স্বর। আর সে ডেড বডি নিজের পাছায় লাথি মেরে নিজেকেই নরকে পাঠায়। কিন্তু সেখানে ফেরেশতার জেরায় সে বলতে পারে না সে কেন মরেছে। চুপ হওয়ার প্রয়োজনে তাকে মরতে হয়েছে এ কথা মনে করতে না পারলেও, সে হঠাৎই ক্ষেপে ওঠে এবং বলে 'না আমি চুপ থাকবো না। সবাইকে জাগিয়ে দেবো। . . . কেউ খুন হলে নিহতের অধিকার আছে জানার সে নিহত কিনা'। এই অধিকার আদায়ের জন্য সে কথা বলার অধিকার পাচ্ছে নরকে এসে, এর পূর্ব পর্যন্ত নয়। এই হলো এ দৃশ্যমালায় ধৃত দেশের মানবাধিকারের চিত্র। এখানকার মানুষেরা নিহত কিনা তা জানার অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা শুরু করে মৃত্যুর শেষে নরকে যাওয়ার পরে। অধিকারহীনতার এই এ্যাবসার্ড চিত্র মোরাকেবাপন্থীদের পক্ষে প্রদর্শনের প্রয়াস তাদের আত্মহত্যার শামিল, তারা যাদের মোরাকেবায় দিনমান তসবিহ টিপে যাচ্ছে তাদেরকে পাবলিকের সামনে 'ছিলা কলা'র মতো ন্যাংটো করে দেখানের শামিল। ফলে এ কাজ তারা কখনো করবেন না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে এমনই একজন মোরাকেবাবিচ্যুত জাহিদ সোহাগের জন্য।

নাটকের এর পরের দুটি দৃশ্যমালার শিরোনাম 'এক পয়সার' ও 'বাতি নিভিয়ে যাও, দরোজাও'। এই দুই দৃশ্যমালায় 'যোনি' আর 'শিশ্ন' রূপ দুই ভ্যাম্পায়ার মানবজীবনকে কী ভয়ঙ্কর এ্যাবসার্ডিটিতে পর্যবসিত করেছে সে বিষয়ে নট-নটীর ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শিত হয়েছে যা জাহিদ সোহাগের মোরাকেবাবিচ্যুত এ্যাবসার্ডিটির সাথে আপাতভাবে সম্পর্করহিত বিধায় এ নিবন্ধের বিষয়বস্তু থেকে এ দৃশ্যমালাদ্বয় খানিকটা দূরত্বে অবস্থান করে। তাই এ দৃশ্যমালাদ্বয়কে পাশে সরিয়ে আমরা চলে আসতে চাই 'ফুল প্লে' শীর্ষক দৃশ্যমালায়। এ দৃশ্যমালাও যথারীতি আখ্যানহীন এবং নামহীন চরিত্রময়। প্রতি দৃশ্যমালায়ই রয়েছে একটি নাটক আয়োজনের প্রয়াস। কোনোটিতেই সে নাটক শুরু হয় না, কারণ নাটক তো আখ্যান চায়, আর আমাদের লেখকের কাছে তো আখ্যান নেই, আছে দৃশ্য। সে দৃশ্য এবার নাটকের কথকের কথা দিয়ে শুরু। তিনি শুরু করতে চেষ্টা করছেন এভাবে- 'আমি কথক। আমার গলার মধ্যে ট্রানজিস্টার বসিয়ে নিয়েছি, আমি সীমাহীন বকবক করে যাবো। আপনারা শুনলে শুনবেন, না শুনলে না শুনবেন। . . . যাক এসব কথা বাদ দিয়ে রীতিমাফিক একটি বন্দনাগীত শুরু করি। পয়ার ছন্দে। নইলে বলবেন বাংলা নাটক হয় নাই, বিদেশি নাটকের অনুবাদ হয়েছে। আর সাইজে ছোট দেখে বলবেন একাঙ্ক, তাই বকবকের মাত্রা বাড়িয়ে ফুল প্লে করে যাবো।' এবারে বন্দনা শুরু হয়। 'তারপরে বন্দনা করি যত গুণীজন। গুণীজন কারা তো বুঝতে পারছেন? মহাজনের ওলকপিতে ত্যাল দেয় আর দানদক্ষিণা নিয়ে খুশি থাকে। মানে . . . সংস্কৃতির সুধীজন।' আশরাফ হোসেনের ভাষায় মোরাকেবাগোষ্ঠী।

শুরু থেকেই স্পষ্টত জাহিদ সোহাগ এবার মোরাকেবাগোষ্ঠীকে ডাইরেক্ট হিট করেছেন। সেই গোষ্ঠীর মাননীয় ব্যাঙ মহোদয় এবার নিজেই মঞ্চে উঠে আসেন এবং বলতে শুরু করেন- 'আমি মাননীয় ব্যাঙ মহোদয়। এইমাত্র ফারাক্কা-তিস্তা চুক্তি মাফিক পানির হিস্যা নিয়ে আসলাম। বিশ্বাস না হয় দেখুন পানিতে সামান্য গুয়ের গন্ধ আছে, এজন্য এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার সাতশ কোটি টাকার পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, গোলাপের নির্যাস দিয়ে পানি সুগন্ধী করা হবে।' ব্যাঙ মহোদয়রা এমন সব প্রকল্পের মাহাত্ম্য বর্ণনায় তত্ত্বের ও পাণ্ডিত্যের বন্যা বইয়ে দেন। লালা ফুডের কারখানায় ৫২ জন পুড়ে মরাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদত্ত ৫২টি মুরগি কীভাবে ডিমে আর বাচ্চায়, ডিমে আর বাচ্চায় তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারে সুখের আর সমৃদ্ধির জলোচ্ছ্বাস জাগিয়ে তুলবে তার বয়ানে ব্যাঙ মহোদয় দর্শকগণকে চমৎকৃত করে তোলেন। কথক তখন তার চরিত্র ব্যাঙের বর্ণনায় মোহিত হয়ে এমন মরণের বন্দনায় বলতে শুরু করেন- 'আমরা বন্দনা করি গুরুর চরণে, আমরা বন্দনা করি নিজের মরণে'। এই মরণের বন্দনার বাইরে আর কোনো জীবনচিত্র খুঁজে না পাওয়ায় নাট্যকার শেষ পর্যন্ত মঞ্চে প্রদর্শনের দৃশ্যের সংকটে নিপতিত হন। কথক এই সংকটের উচ্চারণে শেষ পর্যন্ত বলতে শুরু করেন- 'এতক্ষণে অরিন্দম কহিল বিষাদে/ নাট্যকার পড়িল এ কেমন ফ্যাসাদে/ নিজেই দায়িত্ব নিয়ে আবার ছেড়েছে/ হরিণ বাঘেরে দ্যাখো কেমন মেরেছে/ জনতা মিতালি করে হাততালি দিতে/ নেতারা আনন্দ করে ফ্রি পাওয়া ঘিতে'। নেতাদের এই ফ্রি পাওয়া ঘিতে যারা দিনে দিনে ভাগ বসানো শুরু করছেন সেই মোরাকেবার কাতারের জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিদ ড. ডট ডট চৌধুরী ও ভেজাল সনদের মাননীয় ডট ডট বিচারপতি এবার মঞ্চে আসেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর সকল কথায় হ্যাঁ বলতে বলতে নাট্যকারকে বিরক্ত করে তোলেন। তিনি শেষে বলতে বাধ্য হন- 'এভাবে ক্রমাগত হ্যাঁ বললে মানুষ বিশ^াস করবে না।. . . দর্শক ভাববে আরোপিত করা হয়েছে'। এই বলে অসমাপ্ত নাটক সমাপ্ত হয়ে যায় আর কোরাস জোরসে গেয়ে চলে 'আহা বেশ বেশ বেশ'। তা বেশ তো হবেই, দেশ জুড়ে মরণের বন্দনা, প্রধানমন্ত্রীর সবকিছুতে হ্যাঁ বলার মিছিল, নাট্যকার ফুল প্লে করতে গিয়ে হাফ প্লের দৈর্ঘ্যরেও কোনো জীবনের গল্প খুঁজে পান না, অথচ 'জনগণের দুঃখ নাই বাঁচামরা নিয়া/ উদয় অস্ত খাইটা চলে গায়ের শক্তি দিয়া'- এমন দেশের অভিনেতা-শ্রোতার সমম্বয়ে গড়ে ওঠা কোরাস 'বেশ বেশ' ছাড়া কী-ই আর গাইবে?

এই 'বেশ' বাহবার 'বেশ' নয়, মুখোশের আর পরিচ্ছদের 'বেশ'। জীবনের সকল মাত্রিক অর্থহীনতা একত্রিত হয়ে মঞ্চ জুড়ে নেচে গেয়ে যাচ্ছে। চতুষ্পার্শের সমাজ-রাজনীতির মহানায়কদের বন্দনায় স্বপ্ন আর কীর্তির রয়ানি চলছে মোরাকেবায় বসা শব্দশিল্পীদের মৌজ ও মাহফিলে। সেই সব স্বপ্ন কোন মনুষ্যগোষ্ঠীর জীবনে চাষ হচ্ছে তা এই নাট্যকার খুঁজে পাচ্ছেন না। সেই সব কীর্তি কোন গ্রহের মানুষের জন্য? সেই সব স্বপ্ন কোন গোলোকের অরোরায় বাস করে? সেই গোলোক বা দ্যুলোকের সাথে নাট্যকার জাহিদ সোহাগের এই ভূলোকের দেখা হয় না। অথচ তিনি চতুষ্পার্শের মোরাকেবায় বসা শব্দশিল্পীদের মৌজ ও মাহফিলে শুনছেন স্বপ্নের রয়ানি। তাহলে এই মৌজ-মাহফিলের নটনটীদের সবাইই কি 'বেশ' বা মুখোশের আড়ালে এই অর্থহীন রয়ানি গেয়ে যাচ্ছেন? না-কি তীব্র বিদ্রুপে জীবনের সকল মাত্রিক অর্থহীনতার মঞ্চজোড়া নর্তনকুর্দনকে জাহিদ সোহাগের কোরাসরা বাহবা দিতে দিতে আজকের সমাজ-রাজনীতির শিকার জীবনের এ্যাবসার্ডিটিকে প্রকটতর রূপে দর্শকদের দৃষ্টির সম্মুখে মেলে ধরলেন? হয়তো দুটোই সত্য। তবে উভয় দিক দিয়েই স্পষ্ট সত্য হলো এই যে, জাহিদ সোহাগ আমাদের সমাজ রাজনীতির এই বাস্তবতায় যাপিত জীবনের এ্যাবসার্ডিটি সেই প্রকটতায় উপলব্ধি করতে পেরেছেন যা মোরাকেবাপন্থী শব্দশিল্পীদের উপলব্ধিতে কখনো আসার নয়।