‘যুক্তির মাধ্যমে আমাদের মুক্তবুদ্ধির উত্তরণ ঘটুক, তরবারির মাধ্যমে নয়’

অলাত এহ্সান
Published : 22 March 2021, 06:39 PM
Updated : 22 March 2021, 06:39 PM

বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে ছিল বাংলা ভাষার অধিকার। এই অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তাদের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসকে নানান অনুষ্ঠান ও মেলায় রাঙিয়ে তোলা। মাসব্যাপী বইমেলা তারই এক অনন্য রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আ্ত্মপরিচয়েরও এক প্রকাশ যেখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলন ঘটে। কিন্তু কোভিড ১৯-এর কারণে এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে না হয়ে, জনগণের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মার্চের ১৮ তারিখে শুরু হতে যাচ্ছে। শত শত প্রকাশকের অংশগ্রহণে মুখরিত বইমেলা আমাদের মন ও মননের এক নান্দনিক অভিব্যক্তি। গত কয়েক বছর ধরে কম করে হলেও প্রতি বছর চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। গতবছর প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ হাজারের মতো নতুন বই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মতে এর সবটাই মানসম্পন্ন নয়। বড় জোর সাড়ে সাত শ' বইকে তারা মানসম্পন্ন বই বলে মনে করেন। প্রতি বছরই মেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়লেও লেখকরা তাদের রয়ালটি ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা, তার কোনো বিধিবদ্ধ রূপ আদৌ আছে কিনা তা অনেক লেখকেরই জানা নেই্। বই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে– এই বিষয়টিও বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের একটি প্রধান কৌতূহল। করোনা ভাইরাস প্রকাশনাশিল্পকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষে তরুণ গল্পকার অলাত এহসান এসব কৌতূহল ও প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের। প্রতি পর্বে মোট পাঁচজন প্রকাশকের অভিমত প্রকাশিত হচ্ছে গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে শেষ পর্ব। এতে অংশগ্রহণ করেছে অবসর প্রকাশনা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন লি, পাঠক সমাবেশ, জার্নিম্যান বুক্স এবং খড়িমাটি। বি.স


'সৃজনশীল বই সব সময় রিস্কের মধ্যেই করতে হয়'
…………………….
আলমগীর রহমান, প্রকাশক, অবসর প্রকাশনা সংস্থা ও প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
…………………….
বিডিনিউজ: এবার বইমেলা শুরু হয়ে যাচ্ছে, আপনারা স্টল পেয়েছেন। গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। এর প্রভাব নিয়ে সারাবছর পার করে আপনারা মেলার দিকে যাচ্ছেন। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
আলমগীর রহমান: বই ব্যবসায় করোনার প্রভাব সর্বগ্রাসী। বই পড়ুয়া মানুষের জীবনযাত্রার যে চেইন সিস্টেম— এক জায়গা থেকে পাবেন, আরেক জায়গা খরচ করবে— এইভাবে মানুষের খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাত্রায় যা লাগে সেখানে বই তো এখনো বিলাসিতার পর্যায় রয়ে গেছে। আমরা মনে হয়, গতবারের মতো এবারও হবে। গতবারের চেয়ে খারাপও হতে পারে। কারণ, করোনা আবার বাড়ছে, কমছে না। মানুষ কি জানের ভয় নিয়ে মেলা দেখতে যাবে? এই প্রভাব আরো দুই-দিন বছরের মধ্যে যাবে না। এটা দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রভাব বিস্তার করেছে।

বিডিনিউজ: এর মধ্যে একটা কিন্তু ব্যাপার ছিল, করোনা শুরুতে অনেককে দেখেছি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— তার বলছেন, আমরা যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারিনি নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে পড়বো। তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার বিক্রির অভিজ্ঞতা কী?
আলমগীর রহমান: আমরা তো অর্ধেকের কমে নেমে গেছে, চারভাগের একভাগে দাঁড়িয়েছে। অনেকে তো লোক ছাটাই করেছেন বেতন দিতে পারবেন না বলে।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে অবসর-প্রতীক কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
আলমগীর রহমান: আমরা ওই লাইন চালু করেছি। সরাসরি তো আর বিক্রির সুযোগ ছিল না, তাই অনলাইন শুরু করেছি। গতবার তো মেলা শেষের আগে দিয়েই করোনা শুরু হলো, দ্রুত সব বন্ধ করে দেওয়া হলো।

বিডিনিউজ: বিপনের বাইরে, বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন নেয়া। অনেকে এটি এড়িয়ে যান, 'বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল নয়' অযুহাতে। বড় প্রকাশনী হিসেবে এটা মানার সুযোগ আপনার জন্য বেশি। তো, এই নীতিমালা কতটা আপনারা মানতে পারছেন?
আলামগীর রহমান: আমরা যত বই ছাপি অনুমতি নিয়েই ছাপি। অনুমতি ছাড়া বই ছাপার প্রশ্নই উঠে না। যেগুলোর কপিরাইট শেষ হয়ে গেছে, সেগুলোর লাগবে না। তবে যেগুলোর কপিরাইট আছে, সেগুলোর লাগবেই।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। আপনি প্রকাশনায় পুরোনো মানুষ, আপনার জানাই আছে— খোদ আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ সাম্প্রতিক অনেক লেখক এ নিয়ে সভা-সংবাদ সম্মেলন করছেন। বিষয়টা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। যে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন— যেসব প্রকাশক চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানে স্বচ্ছ নয়, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হোক। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
আলমগীর রহমান: এ রকম দাবি সম্পর্কে আমি জানি না, আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। যেহেতু জানি না, তাই কোনো মন্তব্য করতে পারবো না। প্রকাশনার মানুষ হিসেবে বলতে পারি, চুক্তি থাকা দরকার।

বিডিনিউজ: অবসর-এর বই নিয়ে পাঠকের মধ্যে একটা তৃপ্তি আমরা দেখেছি। এটা মানসম্পন্ন বইয়ের কারণে। এজন্য সম্পাদনার কোনো বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। আপনি এটা কিভাবে করছেন?
আলমগীর রহমান: আপনি বানান সমন্বয়ক পাবেন না, সম্পাদক পাবেন কোত্থেকে! আমি চলছি জোড়াতালি দিয়ে। বই ছাপা হয় তিনশ-সাড়ে তিনশ কপি, সেখানে সম্পাদনা সম্মানি কত দিবেন? তাহলে বইয়ের দাম বেড়ে যাবে। সেটা করা যায় যদি হাজার হাজার কপি বই বিক্রি হয়। (অবসর/প্রতীক প্রকাশনের বই তো অনেক বিক্রি হয়— এহ্সান)। না, ঠিক নয়। অনেক প্রকাশনীর চেয়েও কম হয়।

বিডিনিউজ: প্রকাশনী হিসেবে অবসর এবং প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর বইমেলা কেন্দ্র করে ছোট বা স্বল্পস্থায়ী প্রকাশনীগুলো বিপননের নতুন কৌশল নিয়ে আসে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশে হুমকি?
আলমগীর রহমান: হুমকি না। এটা সারভাইবের ব্যাপার। তারা যদি সারভাইব করতে পারে, তাহলে পরের বছর আসবে, যদি না করতে পারে তাহলে হারিয়ে যাবে, আর আসতে পারে না।
বিডিনিউজ: এদিক দিয়ে সব প্রকাশনীই বইমেলার বিক্রির উপর খুব বেশি নির্ভর করে! এটা কি প্রকাশনার ক্ষতিকর দিক?
আলমগীর রহমান: হ্যাঁ, সারা বছরের বই তো এ সময়ই বিক্রি হয়। সব সময় তো বই বিক্রি নেই। আমাদের প্রকাশনা হয়ে গেছে বইমেলাকেন্দ্রিক। তবে সারা বছর কাজ করলাম না, কিন্তু বই মেলার সময় ঝাপাঝাপি করলাম, এটা ঠিক না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা পছন্দও করি না। তবে লেখকরাও সারা বছর পাণ্ডুলিপি দেয় না। তারা আগেভাবে পাণ্ডুলিপি দিলে আমরাও আগেভাগে কাজ করতে পারতাম। এক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশক— দুজনেরই সক্রিয় হওয়ার ব্যাপার আছে।

বিডিনিউজ: অবসর ও প্রতীক এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাতশ বই প্রকাশ করেছে। এখানে অনেক তরুণের বই আছে। তরুণদের পাণ্ডুলিপি নির্বাচনে একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। আপনারা কিভাবে এই পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করেন?
আলমগীর রহমান: পাণ্ডুলিপি পেলে প্রথমে বড়ে দেখি। ভাল লাগলে প্রকাশ করি, নইলে ফেরত দেই। যতদূর সম্ভব চেক করি আমি।

বিডিনিউজ: এক জরিপে দেখছিলাম, গত বছর, করোনার মধ্যেই চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের দেশে যে বই প্রকাশ তা বিক্রি দিকে অধিক নজর থাকায় মননশীল, গবেষণাধর্মী, জ্ঞান নির্ভর বইগুলো কম প্রকাশ হয়। এটা তো জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে। আমরা দেখছি মোটিভেশনাল ও ধর্মীয় বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণে উপায় কি?
আলমগীর রহমান: মহামারীর মধ্যে অনেক কিছু থেমে যায়। বই এর থেকে বাদ যাবে কেন, বই তো বাদ যাবে না। তবে জ্ঞানভিত্তিক বই যে বিক্রি হচ্ছে না, তা না।

বিডিনিউজ: প্রকাশনা নিয়ে আমাদের দেশে অনেকে হয়তো ভাবেনও নাই যে, বই প্রকাশের কারণে প্রকাশক আক্রান্ত হবেন। অথচ ঢাকায় জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন, মুন্সিগঞ্জে বিশাখা প্রকাশনীর শাহজাহান বাচ্চুকে খুন হতে হয়েছে,শুদ্ধস্বর এর আহমেদুর রশিদ টুটুলকে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছে। এখনো কি আমাদের প্রকাশকরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন? বা এর সমাধানই কি হতে পারে?
আলমগীর রহমান: সমাধান হলো, ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের জাগ্রত হতে হবে, আমরা জাগ্রত না হলে এটা চলবেই। আর প্রকাশকরা তো ঝুঁকির মধ্যে আছে এখনো।

বিডিনিউজ: মুজিবজন্মশতবর্ষ চলছে। এ নিয়ে আপনারা এবার কি বই করছেন?
আলমগীর রহমান: গত বছর চার-পাঁচটা করেছিলাম। এবার আমরা কিছু করছি না। আমাদের বইয়ের সংখ্যাই কম এবার।

বিডিনিউজ: এবার উল্লেখযোগ্য কি কি বই করছেন আপনারা?
আলমগীর রহমান: নাম তো সবগুলোর মনে নাই এই মুহূর্তে। তারপরও সংখ্যা ১৫-২০টা হবে।

বিডিনিউজ: এই করোনার মধ্যেই বইমেলা হচ্ছে এবার। এখানে আপনাদের খরচ উঠে আসবে কিনা, বা স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা এড়ানো সম্ভব হবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।
আলমগীর রহমান: সৃজনশীল বই সব সময় রিস্কের মধ্যেই করতে হয়। রিস্ক নিতেই হবে।

বিডিনিউজ: তবে একটা বিষয় জরুরি, দেশে যদি লাইব্রেরি গড়ে না ওঠে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি না হয়…
আলমগীর রহমান: এ নিয়ে বহুবার, বহুবছর বলা হয়েছে, এতে কর্তারা কেউ কর্ণপাত করেন না। এটা আপনি বুঝতে পারছেন, এটা আমি বুঝতে পারছি, যাদের এটা বুঝা দরকার তারা তো বুঝতে পারছে না।

বিডিনিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ আলমগীর ভাই, সময় দেয়ার জন্য।
আলমগীর রহমান: এহ্সান, আপনাকেও থ্যাঙ্ক-ইউ।


"অনুবাদের বই প্রকাশে আমাদের লেখক- প্রকাশকদের সচেতন হতে হবে"
…………………….
কামরুল হাসান শায়ক, প্রকাশক, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন লি
…………………….
বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
কামরুল হাসান শায়ক: বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব সকল সেক্টরে পড়েছে, প্রকাশনা সেক্টরে পড়েছে ভয়ংকরভাবে। গতবছরের অমর একুশে বইমেলার পরপরই বাংলাদেশে করোনার ছোবল শুরু। দীর্ঘ সময় অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিল। বই বিক্রয়ের দোকানগুলোও সারাদেশে বন্ধ থাকে। সবরকমের বইসহ যাবতীয় শিক্ষা উপকরণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা কিনতে পারেনি। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে শিক্ষা উপকরণ সংশ্লিষ্ট প্রকাশনাসহ সকল সেক্টর। এক পর্যায়ে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এলে সরকার এক পর্যায়ে বই বিক্রয়কেন্দ্রসহ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমের সুযোগ করে দেয়। এতে কিছুটা ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে। এসময়ে প্রচুর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও বই বিক্রয়কেন্দ্র তথা লাইব্রেরী বন্ধ হয়ে যায়। বই ব্যবসার সংগে সংশ্লিষ্ট বিশাল সংখ্যক বন্ধু ও সহকর্মী চাকরিচ্যুত হয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখনও বইসহ শিক্ষা উপকরণ কেনাকাটার গতিও খুবই শ্লথ। সামগ্রিকভাবে করোনার প্রভাবে বই ব্যবসা অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মুখোমুখি।

বিডিনিউজ: করোনা শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
কামরুল হাসান শায়ক: কথাটা খুবই সত্যি। যে কোন ঘটনারই দুটো দিক থাকে- সমস্যা এবং সম্ভাবনা। করোনায় ডিজিটাল প্লাটফর্মে বইয়ের মার্কেটিং এবং বেচাকেনার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে, তবে তা বেশ অপ্রতুল। প্রথমত, কঠিন লকডাউনে দীর্ঘসময় অনলাইনে অর্ডার নেয়া গেলেও বই ডেলিভারি সাথে সাথে দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলশ্রুতিতে অনলাইনে বইকেনার গতি ছিল ধীর। হোম অফিসের সুবাদে বই পড়ুয়া মানুষ নিজের ঘরে রক্ষিত বইগুলো যেগুলো আগে পড়া হয়নি, সেগুলো পড়ে শেষ করেছেন আগে। কিছু বই অর্ডারও করেছেন, সেগুলো পেয়েছেন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর। তবে আমাদের বইকেনার সংস্কৃতি অনলাইনে যেতে আরও অনেক দীর্ঘদিন লাগবে। আমরা বই বিক্রয়কেন্দ্র থেকে দেখেশুনে বই কিনতেই আনন্দ অনুভব করি। তাই অনলাইনে বই বিক্রয় বিস্তৃত হয়েছে বটে, তবে সম্পূর্ণ বিক্রয়ের শতকরা কতোভাগ? আমরা আমাদের বুক স্টোর পিবিএস- এর বিক্রয় ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখেছি অনলাইনে বিক্রয়ের গড় সর্বোচ্চ ১২%। গড়ে ৮৮% বিক্রয় এখনও বুকস্টোর থেকে সরাসরি।

বিডিনিউজ: কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে বইয়ের কয়েকটি আউটলেট উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ বলবেন, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ স্বল্পতা, তারই ঘনিভূত প্রভাব বলবেন? কারণ এতদিনের ব্যবসা সাময়িক দুর্যোগেও কি দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সঞ্চয় দেয়নি— এই প্রশ্ন সামনেই আসে।
কামরুল হাসান শায়ক: আমি বলবো মূলত করোনার কারণেই। প্রকাশনা শিল্পে করোনার ভয়াবহতা ছিল বিধ্বংসী। সেটা আগেই বলেছি। অন্যকারণও থাকতে পারে। তবে মানুষের পাঠ স্বল্পতা কথাটার সাথে আমি একমত নই। মানুষ বই পড়ছে, ভালো বই পড়ছে প্রচুর। আগামীর পৃথিবী হচ্ছে জ্ঞাননির্ভর সমাজব্যবস্থার পৃথিবী। সেখানে মানুষ নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে বই অনিবার্যভাবে পড়বে। হতে পারে সেটা প্রিন্টেড বই কিংবা ডিজিটাল ফর্মের বই।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
কামরুল হাসান শায়ক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.সবসময় পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ। প্রকাশক হিসেবে একটি বইয়ের উন্নত প্রকাশনার পাশাপাশি বিপণন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভালো লেখা। লেখক-প্রকাশকের যৌথ কমিটমেন্টে পাঠকের জন্য সেরা বই প্রকাশ খুবই জরুরি। লেখককে ডেডিকেটেড লেখক হতে হবে। সৌখিন কিংবা শর্টকাট পথে লেখক হওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে প্রযুক্তির কারণে। পাঠকের হাতের মুঠোয় পৃথিবী। পাঠককে কোন লেখক ঠকানোর চেষ্টা করলে পাঠক এখন খুব সহজে বুঝতে পারে। লেখক প্রসিদ্ধ বা খ্যাতিমান নাকি খুব তরুণ, সেটা এখন মূখ্য বিষয় না। মূখ্য বিষয় ভালো লেখা, উন্নত প্রকাশনা এবং শক্তিশালী বিপণন। পাঞ্জেরী একাজটিই করছে। এই করোনাকালেও আমরা অনেক তরুণ লেখকের চমৎকার পান্ডুলিপি প্রকাশ করেছি, আরও প্রকাশিত হচ্ছে।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— সেক্ষেত্রে আপনাদের সুনামও আছে। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি এড়িয়ে যাওয়ার অযুহাত হচ্ছে, এগুলো বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল নয়। আপনাদের কি অভিজ্ঞতা? কতটা মানতে পারছেন?
কামরুল হাসান শায়ক: আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত সবগুলো বিষয় শতভাগ রক্ষা করেই আমরা এগুচ্ছি। এসবে আমাদের কোন অজুহাত নেই, বরং এগুলো মেনে চলাটাই প্রকাশনায় পেশাদারিত্ব। আজ পর্যন্ত একজন সম্মানিত লেখকও আমাদের সাথে লেখক- প্রকাশক চুক্তি এবং লেখক সম্মানী নিয়ে কোন অভিযোগ করেননি, ভবিষ্যতে করার সুযোগও আমরা দিবো না। অনেকেই কপিরাইট আইন অমান্য করে অনুমোদনবিহীনভাবে বিদেশি জনপ্রিয় বইয়ের অনুবাদ করছেন, এটা খুব নিকট ভবিষ্যতে করা যাবে না। এটার জন্য লেখক-প্রকাশকের নামে আন্তর্জাতিক আদালতে 'ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি ওরগ্যানাইজেশন' মামলা করবে। তাই যথাযথ অনুমোদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই অনুবাদের বই প্রকাশে আমাদের লেখক- প্রকাশকদের সচেতন হতে হবে।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ সাম্প্রতিক অনেক লেখককে দেখেছি এ নিয়ে সভা-সংবাদ সম্মেলন করতে। পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন সময় লেখা বা টিভি চ্যানেলে আলোচনা হয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
কামরুল হাসান শায়ক: আমি লেখক-প্রকাশক চুক্তির শতভাগ সমর্থক। চুক্তি অনুযায়ী লেখকের রয়্যালিটি প্রতি বছর পূর্ণ হিসাব বিবরণীসহ পরিশোধ করা উচিত। তবে এটার কারণে বইমেলায় অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণাকে সমর্থন করি না। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগটি প্রকাশকদের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে করা হয়। তাছাড়া সমৃদ্ধ প্রকাশনা শিল্পের পথে এগিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন চরিত্র থাকে। সেটাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তবে প্রকাশকরা সচেতন হচ্ছেন, অচিরেই এসব সমস্যারও ক্রমশ অবসান ঘটবে। যেমনটি উন্নত বিশ্বের প্রকাশনা শিল্পে আগে ছিল, এখন আর নাই।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন এটা কিভাবে করছে?
কামরুল হাসান শায়ক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের সম্পাদনা পরিষদ তিনস্তরে সম্পাদনার কাজ করে থাকে। ১.পান্ডুলিপি সম্পাদনা ২. লাইন এডিটিং ৩. গ্যালারী এডিটিং।
এছাড়া প্রুফরিডিং সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে করা হয়ে থাকে।
মানসম্পন্ন বই প্রকাশে মানসম্পন্ন সম্পাদনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
কামরুল হাসান শায়ক: বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা বা সাপ্লাই নির্ভর প্রকাশক প্রকাশনার মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যান। প্রকাশককে আপাদমস্তক পেশাদার প্রকাশক হতে হবে। সারাবছর বই প্রকাশ এবং সারাবছরই বই বিপণন করতে হবে। মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ার সামাজিক আন্দোলনগুলো ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। বইবিমুখ মানুষকে বইয়ের পাঠকে রূপান্তরিত করার সরকারি শক্তিশালী পরিকল্পিত উদ্যোগ খুব জরুরি, সেখানে প্রকাশকরা বেসরকারি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এগিয়ে এলে একদিকে বাঙালি হিসেবে জ্ঞানভিত্তিত সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা গর্বিত অংশীদার হতে পারবো, অন্যদিকে আমাদের প্রকাশনাশিল্পও শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

বিডিনিউজ: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন ইতিমধ্যে ১২০০-এর উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। শুরু থেকে মননশীল ও মানসম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি রেখে আসছেন আপনারা। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
কামরুল হাসান শায়ক: পান্ডুলিপি নির্বাচন থেকে শুরু করে সম্পাদনা, প্রি-প্রডাকশন, পোস্ট-প্রডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন, বিপণনসহ সকল স্তরে সর্বাত্মক ভালো করার প্রচেষ্টা থাকে আমাদের। আমরা সর্বোপরি পাঠকের হাতে সেরা বই তুলে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাঠকও জানে পাঞ্জেরী থেকে প্রকাশিত বই মানে সেরা বই। পাঠকের সাথে পাঞ্জেরীর এই রসায়নটি আমাদের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অবিচ্ছেদ্যভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকা রাখতে পারে?
কামরুল হাসান শায়ক: সামগ্রিক প্রকাশনা শিল্পে মূলত তিন ধরনের বই প্রকাশিত হয়ে থাকে। ১. ট্রেড পাবলিশিং ২. এডুকেশনাল পাবলিশিং ৩. একাডেমিক পাবলিশিং।
একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে এই তিনধরনের প্রকাশনাকে সমন্বয় করে তার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ট্রেড পাবলিশিং-এর অন্তর্ভুক্ত বইগুলো দিয়ে প্রকাশক সর্বোচ্চ লাভবান হবেন, এডুকেশনাল পাবলিশিং-এর অন্তর্ভুক্ত বইগুলোর মাধ্যমে মধ্যম মানের ব্যবসা করবেন আর একাডেমিক পাবলিশিং-এর অন্তর্ভুক্ত বইগুলোতে আর্থিক ক্ষতিও থাকতে পারে। একজন প্রকাশক এই তিন ধরনের বইই করবেন, গড়ে লাভ করার হিসাব মাথায় রেখে। এভাবে পরিকল্পনা করা গেলে আমাদের সবধরনের বই প্রকাশের পথ সুগম হবে, সমৃদ্ধ গবেষণামূলক একাডেমিক লেখার প্রকাশ যেমন অব্যাহত থাকবে, প্রকাশনা শিল্পও সমৃদ্ধ হবে। বিদগ্ধ পাঠকের অভিযোগও অনেকটা দূর হবে।

বিডিনিউজ: আপনার সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। মৌলবাদের বিরুদ্ধে বা বিজ্ঞান নিয়ে লেখার কারণে লেখক শারীরিক আক্রমন সম্ভবত ২০০৪ সালে হুমায়ূন আজাদ স্যারকে দিয়ে দেশে শুরু হয়েছে। পরে বই প্রকাশের কারণে জাগৃতি'র ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, লেখক অভিজিৎ রায়কে মরতে হয়েছে। এখন দেশে লেখা ও বই প্রকাশেও সেন্সর আনা হয়েছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যে আছেন, আপনি কী মনে করেন?
কামরুল হাসান শায়ক: আমি দায়িত্বশীল মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। মুক্তচিন্তা ছাড়া নতুন চিন্তা, সমাজের প্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কঠিন যুক্তির নিরিখে মুক্তচিন্তার আবহ তৈরি হোক। কেউ যদি নতুন চিন্তাকে প্রচলিত চিন্তার যুক্তির নিরিখে খন্ডন করতে পারে, আমি সেটাকেও সমর্থন করবো। যুক্তির মাধ্যমে আমাদের মুক্তবুদ্ধির উত্তরণ ঘটুক, তরবারির মাধ্যমে নয়।

বিডিনিউজ: আশঙ্কা কাটিয়ে এখন পর্যন্ত মধ্য মার্চে গ্রন্থমেলার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
কামরুল হাসান শায়ক: আগামী ১৮ মার্চ থেকে বইমেলা শুরু হচ্ছে। এবারের বইমেলায় পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে ৪৫টির অধিক বই প্রকাশিত হচ্ছে। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, কমিকস, শিশুতোষ, কিশোর ক্লাসিক সব ধরনের বই প্রকাশিত হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের প্রকাশিত এক তৃতীয়াংশের বেশি বই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
কামরুল হাসান শায়ক: আমরা প্রতি বছরই সম্ভাবনাময় তরুণদের বই প্রকাশ করে থাকি। পত্রিকায়, ফেইসবুকে, ব্লগে, বিভিন্ন প্লাটফর্মে তরুণরা লিখছে। তাদের লেখার প্রতি আমি নজর রাখি। তারাও যোগাযোগ করেন। যথাযথ প্রক্রিয়ায় পান্ডুলিপি জমা দিতে আমরা নতুন সম্ভাবনাময় লেখকদের উৎসাহিত করি। অনেকের লেখা কিছুটা সম্পাদনা করে প্রকাশ উপযোগী করে প্রকাশ করি। তবে মানের ব্যাপারে সবসময় সতর্ক আমরা।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
কামরুল হাসান শায়ক: একটি দেশের এগিয়ে যাওয়ার সাথে সবকিছুই এগুবে। এটাই স্বাভাবিক। দেশ এগুচ্ছে, প্রকাশনা শিল্পও বাঁধা অতিক্রম করে এগুবে। তবে বর্তমানে আমাদের প্রকাশনার বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক বাঁধা বিপত্তি আছে। এটি একটি বিস্তৃত বিষয়। এই ছোট্ট পরিসরে বলা দুরূহ। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনায় প্রকাশক-লেখকদের সংগে নিয়ে এই শিল্পে পেশাদারিত্ব ও উন্নয়নে কাজ করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে সব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, শায়ক ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
কামরুল হাসান শায়ক: আপনাকেও ধন্যবাদ।


'পাঠকই সব বাধা মুক্ত করে দেবে'
…………………….
ওয়াহিদুল হক, হেড অব পাবলিকেশন, পাঠক সমাবেশ
…………………….
বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
ওয়াহিদুল হক: কিছুটা, তবে পাঠক সবসময় বই পড়তে চায় তাই কাটিয়ে উঠেছি বলে মনে হয়।
বিডিনিউজ: বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে পাঠক সমাবেশ কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
ওয়াহিদুল হক: করোনা-পরবর্তী পাঠক সমাবেশ অনলাইনে বিক্রি ও ক্যাশ অন ডেলিভারি সেবার উপর জোর দিয়েছে। সম্প্রতি "বইয়ের দোকান বা শো-রুম এখন আপনার হাতের মুঠোয়" এই শিরোনামে পাঠক সমাবেশ অ্যাপস লঞ্চ করেছে, যার ফলে পাঠক ঘরে বসেই যেকোন দেশি-বিদেশি বই স্টক থাকা সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ৭২ ঘন্টার মধ্যে হাতে পাবে। অ্যাপসটি গুগল প্লে স্টোরে রয়েছে। অ্যাপস লিংক : https://play.google.com/store/apps/details?id=com.pathak.shamabesh

বিডিনিউজ: বই প্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
ওয়াহিদুল হক: পাঠক সমাবেশ বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রচলিত এবং প্রয়োজনীয় সব রকরমের নীতিমালা অনুসরণ করে।
বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। পাঠক সমাবেশ এটা কিভাবে করছে?
ওয়াহিদুল হক: পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ পাঠক সমাবেশ নিজস্ব পদ্ধতিতে যথাযথভাবে করে থাকে।
বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
ওয়াহিদুল হক: কোনো বাধা নেই। ঠিকমত বাজারজাতকরণ ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে পাঠকই সব বাধা মুক্ত করে দেবে।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
ওয়াহিদুল হক: মন্তব্য করবো না।

বিডিনিউজ: পাঠক সমাবেশ ইতিমধ্যে তিন শতাধিক বই প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
ওয়াহিদুল হক: বিশ্ব মানের বই প্রকাশের লক্ষ্যে পাঠক সমাবেশ যেহেতু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই গুণগত মান রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মেনুয়াল অনুসরণ করে।
বিডিনিউজ: পাঠক সমাবেশ এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
ওয়াহিদুল হক: গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে বহু পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য অপেক্ষমান আছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সবগুলো সম্ভব না হলেও এগুলোর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বই গ্রন্থ মেলায় প্রকাশ করার চেষ্টা করছি।
বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
ওয়াহিদুল হক: বঙ্গবন্ধুর বাণী, বঙ্গবন্ধু ও সুমনের গল্প, মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও কুমিল্লা এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সহ ৫০ খণ্ডের একটি কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া আমাদের প্রকাশনার তালিকায় রয়েছে: বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত, বঙ্গবন্ধু-মানিক মিয়া সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধুর দৈনন্দিন জীবন ও তাঁর অনুসারীরা, বঙ্গবন্ধুর চিঠিপত্র, বায়ান্নে গোয়েন্দা নজরে শেখ মুজিবের দৈনন্দিন জীবন।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
ওয়াহিদুল হক: পাঠক সমাবেশ সবসময় নতুন লেখককের মান সম্পন্ন বই প্রকাশ করে আসছে নিয়মিত ভাবে, যাতে তারা পরবর্তীতে বড় গুরুত্বপূর্ণ লেখক হতে পারেন।
বিডিনিউজ: প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
ওয়াহিদুল হক: না।
বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, ওয়াহিদুল হক ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
ওয়াহিদুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।


'প্রকাশনা শিল্পের বয়স অনেক দিন হলেও এখনও এখানে প্রফেশনালিজমের অভাব রয়েছে'
…………………….
তারিক সুজাত, কবি-প্রকাশক, জার্নিম্যান বুক্স
…………………….
বিডিনিউজ : গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
তারিক সুজাত : বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে আমরা যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে আমাদের আরও কয়েকবছর সময় লেগে যাবে। তারপরও যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতেই আমরা বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধান করি। এরই মধ্যে অনেকে অনলাইন বিক্রয় ও ই-বুক্স প্রকাশনায় সাফল্য পেয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পুস্তক ব্যবসাও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে করি।
বিডিনিউজ : করোনা শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি– যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেননি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
তারিক সুজাত : একথা ঠিক করোনা পরিস্থিতিতে অনেকের ক্ষেত্রে পাঠ্যাভাস বেড়েছে। যারা লেখালেখির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাঁদের কারো কারো সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, দীর্ঘদিনের জমে থাকা কাজ এ সময় শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যে কোনো গবেষণা ও ভালো লেখার জন্য পাঠ আবশ্যক। পরিমাণের দিক থেকে সংখ্যায় অনেক না হলেও আমাদের প্রকাশনার বেশকিছু ভালো বই এ সময় বিভিন্ন অনলাইন পোর্স্টাল ও বইয়ের দোকানের মাধ্যমে পাঠকরা সংগ্রহ করেছেন।
বিডিনিউজ : কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে বইয়ের কয়েকটি আউটলেট উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ বলবেন, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ স্বল্পতা, তারই ঘণীভূত প্রভাব বলবেন? কারণ এতদিনের ব্যবসা সাময়িক দুর্যোগেও কি দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সঞ্চয় দেয়নি– এই প্রশ্ন সামনেই আসে।
তারিক সুজাত : এ বিষয়ে আমি ভিন্ন একটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বইয়ের ব্যবসা থেকে যে আয় হয় তার মাধ্যমে দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দামি এলাকায় রিটেল স্পেসগুলো অন্যান্য বাজার-চলতি ব্যবসার উদ্যোক্তারা বেশি ভাড়ায় নিয়ে নিচ্ছেন। এসব ব্যবসায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজিও বিনিয়োগ হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না। গত এক দশকে ঢাকা নিউ মার্কেট থেকে যেভাবে ধীরে ধীরে বইয়ের দোকানগুলো উঠে গেলো।
বিডিনিউজ : আগে থেকেই বই বিপণনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপণন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে জার্নিম্যান বুক্স কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
তারিক সুজাত : 'জার্নিম্যান বুক্স' এই আনুষ্ঠানিক নামে আমাদের প্রতিষ্ঠানের যাত্রা ৭-৮ বছর হলেও আমরা প্রকাশনা ও ডিজিটাল প্রকাশনার সঙ্গে প্রায় আড়াই দশক ধরে সংশ্লিষ্ট। ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছুসংখ্যক ই-বুক্স ও অডিও বই প্রকাশ করেছি। মোবাইল প্ল্যাটফর্মকে বই পড়া ও শোনার জন্য ব্যবহারের কাজ আমরা শুরু করেছি। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি মুদ্রিত বইয়ের আবেদন শাশ্বত। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ছাপা বইয়ের যাত্রা অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বিপণনের দিকটি আরো সহজ ও কার্যকরী করার জন্য আগামী দিনগুলোয় আরো কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছি।
বিডিনিউজ : বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করাÑ সেক্ষেত্রে আপনাদের সুনামও আছে। কারো কারো এটি এড়িয়ে যাওয়া অযুহাত হচ্ছে, এগুলো বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল নয়। আপনাদের কি অভিজ্ঞতা? কতটা মানতে পারছেন?
তারিক সুজাত : যদি নীতিমালার কথা বলি, সেটা তো সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর প্রকাশনা শিল্প যেহেতু একটা টিমওয়ার্ক, এখানে সকল পক্ষের মধ্যে সমঝোতা থাকা প্রয়োজন। লেখক-প্রকাশক-প্রেস-বাইন্ডার-বইবিক্রেতা এই চেইনের প্রত্যেককেই একে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রকাশক যদি বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যথাসময়ে পাওনা না পায় সেক্ষেত্রে লেখকের পাওনা মেটাতে তাকেও হিমশিম খেতে হয়। তবে হিসেবটা সময়মতো দেয়ার রীতি থাকলে পাওনা পেতে বিলম্ব হলেও ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো সম্ভব হয়। ভারত, সুইডেন, বৃটেন, চায়নার বেশ কয়েকটি নামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু বই প্রকাশনার কাজ করেছি।
বিডিনিউজ : লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ সাম্প্রতিক অনেক লেখককে দেখেছি এ নিয়ে সভা-সংবাদ সম্মেলন করতে। পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন সময় লেখা বা টিভি চ্যানেলে আলোচনা হয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
তারিক সুজাত : আমাদের প্রকাশিত মনজুরুর রহমানের লেখা একটি বই 'কপিরাইটের নানা প্রসঙ্গ'। কেবলমাত্র প্রকাশনা নয়, শিল্প-সাহিত্যসহ সকল সৃজনশীল মাধ্যমের প্রত্যেকের এই বইটি পড়ে নেয়া জরুরি। নিজের অধিকারটুকু না জানলে প্রাপ্যটা কী করে আদায় করবেন। সারা বছরে বইয়ের যা কেনাবেচা হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি টার্নওভার হয় মাত্র একমাসে সেল ফোন ইন্ডাস্ট্রিতে। একটি সুষ্ঠু VAS পলিসি না থাকার কারণে দেশের ক্রিয়েটিভ অঙ্গনের মানুষেরা প্রায় দুই দশক ধরে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে। মধ্যস্বত্বভোগী কিছু বিদেশি-কোম্পানি অ্যাগ্রিগেটর হিসেবে বহু টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশনা শিল্পের বয়স অনেক দিন হলেও এখনও এখানে প্রফেশনালিজমের অভাব রয়েছে। আবেগের বশবর্তী না হয়ে শুরুতেই চুক্তি, রয়্যালিটি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে নিলে পরে গিয়ে সমস্যা এড়ানো যায়।
বিডিনিউজ : বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। জার্নিম্যান বুক্স এটা কিভাবে করছে?
তারিক সুজাত : এক্ষেত্রে একটি কথা শুরুতেই চলে আসে। যোগ্যতাসম্পন্ন সম্পাদকের এখন বড় রকমের সঙ্কট। কাজের পরিমাণের তুলনায় এখন দক্ষ জনবল কমে আসছে। সম্পাদকের কাজটি অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। এই কাজের জন্য সম্পাদনা কাজের জন্য উপযুক্ত সম্মানী অনেক সময় দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া মিডিয়া, নিউ মিডিয়া এবং বিভিন্ন রকমের ইভেন্টনির্ভর নতুন কাজের সৃষ্টি হওয়ায় অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। যারা ভালো কাজ করেন তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঘুরে ফিরে ভালো কাজগুলো অল্প কয়েকজনের ওপর চলে আসায় যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ দিতে পারেন না। এ ছাড়া অন্য ধরনের সমস্যাও আছে কোনো কোনো লেখক স্ক্রিপ্ট সম্পাদনাকে তাঁদের জন্য অসম্মানের মনে করেন। এটা ঠিক না। আমরা শুরু থেকেই এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছি।
বিডিনিউজ : প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপণনের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
তারিক সুজাত : বই বিপণনের বিকল্প কৌশল উদ্ভাবনের জন্য নতুন প্রকাশনীগুলোর যে উদ্ভাবনী শক্তি নেই একথা আমি মনে করি না। অনেকেই নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে এই প্রতিযোগিতামূলক জটিল বিপণন যুদ্ধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস আর সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ ব্যাংক-বিমা-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। যেভাবে তারা কর্মীদের প্রণোদনার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে দেশি-বিদেশি প্রায় বিনোদনধর্মী ওয়ার্কশপ-সেমিনার করে থাকেন, তার থেকে সামান্য অর্থ সরিয়ে এনে নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত বই-প্রদর্শনী, মেলার আয়োজন করলে কেবল একমাসব্যাপী বইমেলা নয় বছরের যে কোনো সময়েই নতুন পাঠক তৈরিতে অবদান রাখতে পারবে।
বিডিনিউজ : জার্নিম্যান বুক্স ইতোমধ্যে ২৫০-এর উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি রেখে আসছেন আপনারা। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
তারিক সুজাত : আমরা সংখ্যা বিবেচনাকে শুরু থেকেই পরিহার করেছি। ভালো বই প্রকাশের জন্য সারা বছরব্যাপী বই নির্মাণের জন্য সময় দেয়া প্রয়োজন। বইমেলা এলে তাড়াহুড়ো করে বই বের করার বিষয়টি একেবারেই সমর্থন করি না। এক্ষেত্রে লেখকরাও সচেতন হলে ভালো। বইতো আর ক্রোড়পত্র না যে নির্দিষ্ট দিবসে বের করতে হবে। ভালো বই প্রকাশের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিন বা মাস নেই। বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী বইগুলো কোনো বইমেলাকে লক্ষ্য করে বের হয়েছিলো এমন তথ্য জানা নেই।
বিডিনিউজ : একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বইÑ যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো, সেই ধরনের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকা রাখতে পারে?
তারিক সুজাত : এসব ক্ষেত্রে প্রকাশকদের প্রলোভিত করার মতো যে সব উদ্যোগ লক্ষ্য করি, যার ইঙ্গিত আপনার প্রশ্নের ভেতর আছে, সেই জায়গাগুলোতে শুদ্ধি অভিযান আনা উচিত। প্রকল্প করে ভালো কাজ হয়নি একথা মেনে নেয়া যাবে না। এদেশেও প্রকল্প করে, কমিশনিং করে ভালো কাজ হয়েছে। আপনার নিশ্চয়ই ষাটের দশকে ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন্স বা প্রাভদার বইগুলোর কথা মনে আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক যে কোনো কাজের জন্য কাজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সদিচ্ছা ও নিজেদের আরো যোগ্যতর করে তোলার জন্য প্রচেষ্টা জরুরি।
বিডিনিউজ : আপনার সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। মৌলবাদ বিরুদ্ধে বা বিজ্ঞান নিয়ে লেখার কারণে লেখক শারীরিক আক্রমণ সম্ভবত ২০০৪ সালে হুমায়ূন আজাদ স্যারকে দিয়ে দেশে শুরু হয়েছে। পরে বই প্রকাশের কারণে জাগৃতি'র ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, মুক্তমনা লেখক অভিজিৎকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এখন দেশে লেখা ও বই প্রকাশেও সেন্সর আনা হয়েছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যে আছেন, আপনি কি মনে করেন?
তারিক সুজাত : শুধুমাত্র হুমায়ূন আজাদ কেন, কবি শামসুর রাহমানকেও নিজগৃহে চাপাতির আঘাত করা হয়েছিলো। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায়, প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান ১৯৫৩ সালে 'একুশে ফেব্রুয়ারী' নামে যে ঐতিহাসিক সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন তাও অল্প সময়ের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছিলো। তার লেখকগোষ্ঠীকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হয়েছে। গোটা পাকিস্তানি আমলজুড়ে বহু লেখক-কবি কারারুদ্ধ ছিলেন। স্বাধীনতার পর সামরিক শাসন আমলেও আমরা মামলা-হামলার শিকার হয়েছি। এখন হামলাকারীগোষ্ঠীর চেহারা বদলেছে। এর মধ্যেই আমাদের টিকে থাকতে হবে।
বিডিনিউজ : জার্নিম্যান বুক্স এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
তারিক সুজাত : বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব থাকা সত্বেও এ বছর আমরা প্রায় ২০-২৫টি নতুন বই প্রকাশ করছি। তার বেশ কয়েকটি এরই মধ্যে বইমেলায় গেছে। যেমন, ইকবাল বাহার চৌধুরী'র আলোকের এই ঝর্ণাধারা, মনোজ বসু'র চীন দেখে এলাম, মাহবুব তালুকদারের প্রেমের চতুর্দশপদী, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, শহীদুল্লা কায়সারের জেল থেকে লেখা পত্রাবলি, আবুল আহসান চৌধুরী'র সংগ্রহ-সংকলন-সম্পাদনায় শতবর্ষের পদাতিক সুভাষ মুখোপাধ্যায় অপ্রকাশিত পত্রাবলি, ইকতিয়ার চৌধুরী'র ভ্রমণবিষয়ক দশ প্রান্ত দশ দিগন্ত, নূহ-উল-আলম লেনিনের যারা আলো জ্বেলেছিল, মুনতাসীর মামুনের আজো কি মনে পড়ে, উদাসীন চর আর বুনোহাঁস আকাশের গাঁয়, মুস্তাফা মজিদের মণিপুরী, নাশিদ কামাল সম্পাদিত Chasing Dreams An autobiography of Md Hafizur Rahman, আনিসুল হকের তুই কি আমার দুঃখ হবি (Will You Be My Sorrow), রুহুল হকের Untitled Till We Meet Again, সালমা এ শফি'র ফিরোজা ও ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেনের একুশে একুশে একাত্তর প্রকাশিত হয়েছে।
বিডিনিউজ : বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
তারিক সুজাত : অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ-এর বঙ্গবন্ধুকোষ, জালাল ফিরোজের লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর একদিন, মুহম্মদ আবু তাহেরের কবিতায় বঙ্গবন্ধু (BANGABANDHU IN POETRY) ও শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের শিল্পকর্ম ও আমার কবিতা নিয়ে অন্যপ্রকাশ ও জার্নিম্যান বুক্স যৌথ প্রকাশনা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও বাশার খানের বৃক্ষপ্রেমী বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি।
বিডিনিউজ : প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
তারিক সুজাত : ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেন ফাউন্ডেশন ও জার্নিম্যান বুক্স অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এ পোস্টবক্স'র সৃষ্টিশীল সকল প্রয়াস এবং সৃজনশীলতাকে উৎসারিত করতে ১০ জন কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশের উগ্যোদ নিয়েছিল। একই ধারাবাহিকতায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ 'আমার প্রথম গল্পের বই' সিরিজের ৫ জন গল্পকারের বই প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতি বছর অনলাইনে নতুন পাণ্ডুলিপি আহ্বান করা হয়। প্রথিতযশা লেখক-কবিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী নতুন পাণ্ডুলিপি বই হিসেবে প্রকাশের জন্য বাছাই করেন। সেগুলোই 'আমার প্রথম বই' সিরিজের বই হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে।
বিডিনিউজ : বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
তারিক সুজাত : বাংলাদেশের প্রকাশনার সার্বিক উন্নয়নের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাবনায় নিতে পারলে সম্মিলিতভাবে আমরা উপকৃত হতে পারবো বলে বিবেচনা করি :
১.প্রকাশনার মান উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, যোগ্য সম্পাদক তৈরি, আন্তর্জাতিক Standard অনুসরণ, নিয়মিত প্রশিক্ষণ– দেশে এবং বিদেশে নতুনতর বাজার সৃষ্টি। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া উচিত।
২.বই-এর সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ। বই বলতে কেবল কাগজে মুদ্রিত বই নয়। e-books, audio books -এ জাতীয় Digital প্রকাশনাগুলোকে বইয়ের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি লাইব্রেরিগুলোতে e-books, audio books পড়া ও শোনার জন্য কর্ণার স্থাপন এবং সরকারি বই ক্রয় নীতিমালায় e-books, audio books অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তা না হলে এই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রটি বিকাশিত হবে না।
৩.একটি যুগোপযোগী গ্রন্থ নীতিমালা দরকার। কপিরাইট সোসাইটির কর্মকাণ্ড আরো সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
৪.বইয়ের জন্য যে লাইট ওয়েট পেপার প্রয়োজন তা দেশে তৈরি হয় না, আমদানিও হচ্ছে না। প্রকাশনা শিল্পের মানোন্নয়নের জন্য একে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খাত বিবেচনা করে স্বল্পসুদে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সংবাদপত্রের মতো বিশেষ বিবেচনায় শুল্কমুক্ত কাগজ ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি আমদানির সুযোগ যদি তৈরি হয় তবে মানসম্পন্ন বই আরো কম মূল্যে পাঠকের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব বলে মনে করি।
৫.১৭৭৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা বই, সাময়িকপত্র ও প্রকাশনার ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ আর্কাইভ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা– যেটি জাতীয় ইতিহাসের একটি অমূল্য সংগ্রহশালা হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করি।
বিডিনিউজ : প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
তারিক সুজাত : পাঠকের অভ্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। আর এর ভিতরেই নিহিত আছে বাংলা বই ও প্রকাশনার নতুন ভুবন আবিষ্কারের ভূ-খণ্ড। সেই সীমানাহীন ভূ-খণ্ডটিকে আমরা যদি অকর্ষিত রেখে দিই, তাহলে বাংলা প্রকাশনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই। আসুন আমরা সকলে মিলে সেই অযুত সম্ভাবনাময় ভূ-খণ্ডে নতুন বীজ বপন করি।
বিডিনিউজ : ধন্যবাদ, তারিক সুজাত ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
তারিক সুজাত : আপনিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ।


'প্রকাশকরা একটা স্বাভাবিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন'
…………………….
মনিরুল মনির, কবি-প্রকাশক, খড়িমাটি
…………………….
বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
মনিরুল মনির: পুস্তক ব্যবসায় একটা অর্থনৈতিক চাপ পড়েছে। বিপণন ও প্রচারে করোকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে না। কারণ, পুরো বছর ছোট ছোট যে মেলাগুলো হয়, অনুষ্ঠানগুলো হয়— তা বন্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ের যে প্রচলন থাকে, তাও বন্ধ। মোট কথা, ব্যবসায় কমে গেছে। প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিডিনিউজ: করোনা শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। দিনশেষে তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
মনিরুল মনির: বিষাদ সময়। মন ভালো নেই। চারিদিকে লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। সেখান থেকে মনোনিবেশ করা বইয়ে। বিস্তর পড়ে নেবার ব্যাপার কী আসলে হয়? হয় না। তবুও অনেকে পড়েছেন। বই কিনবার বিষয়টি অনলাইনে হয়েছে। কেননা, উন্মুক্ত কেনাবেচার বইয়ের হাট বন্ধ। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অনলাইনে বই কিনেছেন। কিন্তু সারাবছর বই বিক্রির যে হার তাতে এই প্রক্রিয়ার সাথে মেলানো যাবে না। আশাবাদ, এই প্রক্রিয়াটি ছড়িয়ে পড়বে বহুদূর পর্যন্ত।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে খড়িমাটি কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
মনিরুল মনির: এটা ঠিক, আস্তে আস্তে মানুষ বই বিমুখ হয়ে পড়ছে। করোনা মানুষের ভিন্নরকম অভ্যাস তৈরি করেছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কহীনতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। মানুষকে একা করে তুলেছে। কেউ কেউ হয়তো বই পড়ছেন। বই পড়ছেন না অনেকেই। কারণ, অবাধ পাঠে মন স্থির নয়। মানুষ চেষ্টা করছে অনলাইন থেকে পাঠ নেয়ার। সেখানে অনলাইন আসক্তি বেড়ে গেছে। যেহেতু সবাই অনলাইনে সহজে সবকিছু জানতে পারছে। কিন্তু বইয়ের কদর তো এই অনলাইনে মিটবে না। অনলাইনে যেহেতু বেশিরভাগ মানুষের সাথে যোগাযোগের অভ্যস্থতা তৈরি হয়েছে সেহেতু খড়িমাটি অনলাইন প্রচারণাকে জোর দিচ্ছে।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? বড় প্রকাশনী হিসেবে আপনার সুযোগ আছে সেই উদারহণ তৈরি করা। আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
মনিরুল মনির: আমরা যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করি। সামর্থ্যকে প্রাধান্য দিয়েই বই করি। তেমন কষ্ট হয় না। তারপরও লেখক-প্রকাশক চিরকালীন বৈরিতা থাকে দুদিক থেকেই। স্বচ্ছতা প্রকাশক দেবেন, লেখক মানবেন অঙ্গীকার। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় সভা, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
মনিরুল মনির: অবশ্যই প্রত্যেক প্রকাশকে চুক্তি, অঙ্গীকারনামা ও রয়্যালিটিপত্র থাকা জরুরি। নচেৎ সেটা কোনো প্রকাশনায় পড়ে না। বইব্যবসা কেন একা প্রকাশকের— তা লেখক ও সংশ্লিষ্ট সবার হতে হবে।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। খড়িমাটি এটা কিভাবে করছে?
মনিরুল মনির: হ্যাঁ, প্রকাশকদের সম্পাদনা পর্ষদ থাকতে হবে। না হলে প্রকাশনা শিল্প আগাবে কী করে? এখনও খড়িমাটি সম্পাদনা টিম তৈরি করতে পারিনি। চেষ্টা করছি করার জন্য।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট, স্বল্পস্থায়ী প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে থাকে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
মনিরুল মনির: আমরা এখন মেলার ওপর নির্ভর করতে পারিনি। যেহেতু মেলা কেন্দ্র করে হালকা মানের বই প্রকাশ করতে পারিনি। সেটা হয়তো করবোও না। আমাদের বইগুলো সারাবছর বিক্রি হয়। বিভিন্নভাবে লেখক-পাঠক-প্রকাশক সম্মিলনের মাধ্যমেও সংযোগ ঘটাতে চেষ্টা করি।

বিডিনিউজ: খড়িমাটি চট্টগ্রামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশের বড় শহর থেকেও ভাল প্রকাশনা হওয়া উচিত। বিপরীতে দেশের অনেক লেখক, বই বিপনন ব্যবস্থা ঢাকা কেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে খড়িমাটি কে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এগুলো কেমন? আপনারা কিভাবে তা সমাধান করেন? দেশের বড় শহর থেকেও কিভাবে ভাল প্রকাশনা চলতে পারে?
মনিরুল মনির: চট্টগ্রামে থেকে বিপণনের জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি। দ্রুত পাঠকের হাতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে। এছাড়াও ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বই প্রস্তুত করায় খরচ বেশি। ভালো মানের বই করার জন্যই আসলে আমাদের লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
বিডিনিউজ: খড়িমাটি ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ বই প্রকাশ করেছে। খড়িমাটি শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি বলে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
মনিরুল মনির: ইতোমধ্যে ৫০০ অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। মননশীল ও সৃজনশীল কিংবা মানসম্মত বইয়ের কথা বলি। এখনও চাই। কিন্তু কিছু নতুন লেখক ও কবিদের বইয়ের মান রাখা যায়নি। আমরা ব্যতিক্রম কিছু করতে গিয়ে হয়তো ব্যর্থ হয়েছি।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
মনিরুল মনির: এই অভিযোগের সাথে আমি একমত। একটু আগে বলেছি আমরা মেলায় অসফল। কেননা, মেলায় বহুল বিক্রিত বই আমরা করতে পারিনি। যেমন এখন বিভিন্ন চটকধারি বই, মোটিভেশনাল বইয়ের নামে বিভিন্ন ধরনের বই বিক্রির হিড়িকে যুক্ত হতে পারিনি। এটা তো অবশ্যই প্রকাশকদের হাতে, যারা পাঠকের রুচির পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু অসাধু প্রকাশকদের জন্য তো তা অসম্ভব, তাদের দৌরাত্ম বেশি। এক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রকাশকদের ঐক্য দরকার।
বিডিনিউজ: খড়িমাটি এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
মনিরুল মনির: খড়িমাটি থেকে এ বছর নাটকের বই, উপন্যাস, প্রবন্ধের বই, কবিতা, ছড়া ও সায়েন্স ফিকশন একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
মনিরুল মনির: বঙ্গবন্ধুর উপর বইয়ের মান রক্ষার্থে ৩টি বই প্রকাশ করেছি, দুটি প্রবন্ধের ও একটি উদ্বৃতির বই।
বিডিনিউজ: আপনি কিভাবে তরুণদের সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
মনিরুল মনির: আমরা ছোট পত্রিকা থেকে প্রকাশনা করতে এসেছি। তরুণ লেখকদের যন্ত্রণা বুঝি। অনেকের বই করেছি। কিন্তু প্রচণ্ড চাপ নিয়ে থাকি। মানের কথাও ভাবি। ভাবি কোন ধরনের লিখা পাঠকের হাতে তুলে দিব। তরুণ লেখকদের ক্ষেত্রে বাছাই করি। যে তরুণ বহুদূর যাবার মতো সম্ভাবনাময় তার বই তালিকায় রাখি।
বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
মনিরুল মনির: বহু বাঁধা রয়েছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এগুচ্ছে এই শিল্প। মানহীন কাগজ, কালি ও মুদ্রণ ব্যবস্থা অনুন্নত থেকে যাওয়া। উন্নত মানের বইয়ের জন্য উন্নত কাগজ উৎপাদনের গবেষণা নেই। বাঁধাই আধুনিক মেশিনপত্র সুলভ নয়। এই শিল্পের সকলের সাথে ধারাবাহিকতার অভাব। বিপণনের সমন্বয়হীনতা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কিছু আসলেও তা বড় প্রকাশক, যারা টিকে আছে তাদের কাছে চলে যায়। ছোটরা আর বড় হতে পারে না। ইতোমধ্যে আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি বিভিন্ন খাতে আর্থিক অনুদানগুলো কীভাবে বণ্টন হয়েছে। দুঃখজনক।
বিডিনিউজ: একটা বিষয় নিয়ে বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? আর প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যের আছেন, আপনি কি মনে করেন?
মনিরুল মনির: মুক্ত হওয়া কিংবা বাক মুক্তির কথা আমরা বলছি। এর সাথে নিরাপত্তার সংযোগ রয়েছে। এমন এক পরিস্থিতি কিংবা পরিবেশ তৈরি হয়েছে মুক্তচিন্তার প্রকাশ করা যায় না। মতের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে না। লেখক মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবে প্রকাশক প্রকাশ করবে। এতে সমাজের মন্দ বা ভালোর তারতম্য পাঠক যাচাই-বাছাই করবে। কিন্তু প্রকাশক কিংবা লেখক যখন আক্রান্ত হন তখন সেই দেশের প্রকাশনায় মান নিম্নমুখী হতে থাকে। এই ক্ষেত্রে বলবো, এখানকার প্রকাশকরা একটা স্বাভাবিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
মনিরুল মনির: আমার একটাই প্রস্তাব, প্রথমত প্রকাশকদের ঐক্য। সৃজনশীল প্রকাশনার জন্য প্রয়োজন লেখক-পাঠক-প্রকাশক সম্মিলন। পৃষ্ঠপোষকতা ও লেখক-প্রকাশকের নিরাপত্তা নিশ্চিত। এজন্য চাই উদার সমাজ ব্যবস্থা। বই পাঠকের হাতে পৌঁছানোর জন্য পুরো দেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক, যা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রকাশকরা একত্রিত হতে হবে।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, মনিরুল ভাই, আন্তরকি সময় দেয়ার জন্য।
মনিরুল মনির: ধন্যবাদ আপনাদেরও।