মাসব্যাপী বইমেলার পরিবর্তে ১০ বা ১২ দিনের বইমেলার পক্ষপাতি

অলাত এহ্সান
Published : 1 Feb 2021, 07:18 AM
Updated : 1 Feb 2021, 07:18 AM

বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে ছিল বাংলা ভাষার অধিকার। এই অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তাদের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসকে নানান অনুষ্ঠান ও মেলায় রাঙিয়ে তোলা। মাসব্যাপী বইমেলা তারই এক অনন্য রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আ্ত্মপরিচয়েরও এক প্রকাশ যেখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলন ঘটে। কিন্তু কোভিড ১৯-এর কারণে এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে না হয়ে, জনগণের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মার্চের ১৮ তারিখে শুরু হতে যাচ্ছে। শত শত প্রকাশকের অংশগ্রহণে মুখরিত বইমেলা আমাদের মন ও মননের এক নান্দনিক অভিব্যক্তি। গত কয়েক বছর ধরে কম করে হলেও প্রতি বছর চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। গতবছর প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ হাজারের মতো নতুন বই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মতে এর সবটাই মানসম্পন্ন নয়। বড় জোর সাড়ে সাত শ' বইকে তারা মানসম্পন্ন বই বলে মনে করেন। প্রতি বছরই মেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়লেও লেখকরা তাদের রয়ালটি ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা, তার কোনো বিধিবদ্ধ রূপ আদৌ আছে কিনা তা অনেক লেখকেরই জানা নেই্। বই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে– এই বিষয়টিও বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের একটি প্রধান কৌতূহল। করোনা ভাইরাস প্রকাশনাশিল্পকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষে তরুণ গল্পকার অলাত এহসান এসব কৌতূহল ও প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের। প্রতি পর্বে মোট পাঁচজন প্রকাশকের অভিমত প্রকাশিত হবে গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব। এতে অংশগ্রহণ করেছে নালন্দা, সংহতি প্রকাশন, সূচীপত্র, অনিন্দ্য প্রকাশ ও মাওলা ব্রাদার্স। বি.স


…………………….
"অনলাইনের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছি"
রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল, প্রকাশক, নালন্দা
…………………….
বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
রেদওয়ানুর জুয়েল: করোনায় শুধু সৃজনশীল প্রকাশনায় ক্ষতি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এখানে প্রকাশনার সাথে প্রেস, বাঁধাই, প্যাকেজিং, লেমিনেশন, পেস্টিং প্লেট, ইত্যাদি প্রতিটি শাখায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে নালন্দা কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
রেদওয়ানুর জুয়েল: করোনার পর নালন্দা শুধুমাত্র অনলাইনবেইজ মার্কেটিং করে টিকে আছে। কাটাবনে এক হাজার স্কয়ার ফিটের একটি নান্দনিক আউটলেট ছিল আমাদের। শুধু করোনার কারণে সেটি আমরা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। এখনো আমরা অনলাইনের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
রেদওয়ানুর জুয়েল: নালন্দা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটেলম্যান এগ্রিমেন্ট করে। আবার যদি প্রয়োজন হয়ে তখন আমরা লিখিত চুক্তি করি। প্রতি বছর জুন থেকে জুলাই আমরা প্রতিটি লেখকের স্টক ও বিক্রিত বইয়ের হিসাব এবং সাথে লেখক সম্মানী দিয়ে থাকি।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। নালন্দা এটা কিভাবে করছে?
রেদওয়ানুর জুয়েল: নালন্দার একটি সম্পাদনা বিভাগ আছে। যে কারণে নালন্দার বইয়ের দাম অন্যান্য প্রকাশনীর চেয়ে একটু বেশি। কারণ নালন্দা'র স্ট্যাবলিশমেন্ট খরচ বেশি। আমি মনে করি প্রত্যেকটি প্রকাশনার জন্য সম্পাদনা বিভাগ থাকা জরুরি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
রেদওয়ানুর জুয়েল: প্রথমত প্রকাশনায় পেশাদারিত্ব থাকাটা জরুরি। এছাড়া ভালো প্রুফরিডার পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শিশুদের জন্য মানসম্মত কনটেন্টের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। যার কারণে শিশুদের জন্য আমরা ভালো বই উপহার দিতে পারি না।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
রেদওয়ানুর জুয়েল: কোনো অবস্থাতেই আমরা অমর একুশে গ্রন্থমেলা নির্ভর প্রকাশনা করি না। আমরা সারা বছর বই প্রকাশ করে থাকি। ছোট প্রকাশকদের আমরা অনলাইনের উপর বেশি জোড় দিতে বলব। এটা আসলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার। এখানে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এগুতে হবে।

বিডিনিউজ: নালন্দা ইতিমধ্যে সাতশোর উপরে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
রেদওয়ানুর জুয়েল: প্রায় ৮০০ টাইটেলের বই নালন্দা প্রকাশ করছে। আসলে নালন্দার নিজস্ব সম্পাদনা, প্রুফরিডার এবং কম্পোজ শাখা থাকাতে কাজ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।

বিডিনিউজ: নালন্দা এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
রেদওয়ানুর জুয়েল: শকুনি উবাচ, তিম্বুক্ত, মিশন কঙ্গো, রঙ মিলান্তি, অ্যান্টিডোট, কাঠপাতার ঘর, কমান্ডো, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, করোনায় করুন, ধূসর নির্জনতা, জলের দেশের স্থলপদ্ম এবং মোশতাক, রিঙ্গনপুর, ফরবিডেন রুমি, আমি এবং রুমি, টু হিস্ট্রো ট্রায়ালস ইন রেড ফোর্ড, স্কেচ, মনশ্মশান, চলো নক্ষত্রে হেঁটে আসি, তোমার ঠিকানা হতে চাই, কেইস হিস্ট্রি, ত্রিশ জাতির ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের উত্থানযাত্রার পথ।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
রেদওয়ানুর জুয়েল: মায়াবি দৌলত, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বের রাজনৈতিক হত্যা, বাঁচার দাবী; বাংলা বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু, ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জনকের শিশুকিশোর গল্প, এবং মোশতাকের মন্ত্রীসভা ও বেইমানের ইতিবৃত্ত, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
রেদওয়ানুর জুয়েল: প্রতি বছর নালন্দা পাণ্ডুলিপি আহবান করে। যাদের পাণ্ডুলিপি প্রকাশের উপযুক্ত শুধু তাদের বইগুলোই নালন্দা প্রকাশ করে থাকে। এখানে আমরা আসলে কনটেন্ট এবং লেখার মান দেখে বই প্রকাশ করি। এবং তাদের লেখক সম্মানিও দিয়ে থাকি।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
রেদওয়ানুর জুয়েল: পেশাদারিত্ব, বইয়ের প্রাইজিং নির্ধারণ এবং গ্রন্থ প্রকাশের একটা নীতিমালা থাকা জরুরি। সেই সাথে প্রকাশনাকে 'প্রকাশনা শিল্পের' মর্যাদা প্রদান।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, জুয়েল ভাই, সময় দেয়ার জন্য।
রেদওয়ানুর জুয়েল: আপনাকেও ধন্যবাদ, এহ্সান।


…………………….
"বাংলাদেশের বইয়ের দোকানগুলো দেশীয় বইপত্র কম রাখে"
দীপক কুমার রায়, প্রকাশক, সংহতি প্রকাশন
…………………….

বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
দীপক কুমার রায়: প্রকাশনা শিল্প ধ্বংসের পথে। করোনার ১ বছর হতে চলল। বই বিক্রয়ের নাজুক দশা কাটেনি। কিন্তু সরকার এ শিল্পে অল্প কয়েকজন প্রকাশক বাদে সার্বজনীন কোনো প্রণোদনা দেয়নি। সারাদেশেই ক্রমাগতভাবে ব্যবসা সংকোচন চলছে এবং এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও অনেক উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। একে একে বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়েছে। যেমন কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামের বইয়ের দোকান মধ্যমা, এই এলাকার বড় আউটলেট নালন্দা, কবিতাক্যাফে; বনানীর পেন্সিল বন্ধ হয়েছে। জাগৃতি বইয়ের ব্যবসা গুটিয়ে ছোট করে এনেছেন।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে সংহতি প্রকাশন কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
দীপক কুমার রায়: করোনাকালের একটা পর্যায় এসে আমরা অনলাইনে ফেসবুক-পেজে বই বিক্রি করছি। ঢাকা শহরের যেকোন প্রান্তে হোম ডেলিভারি দিচ্ছি। সাথে সাথে আমাদের বিক্রয়কেন্দ্র সংহতি বইয়ের ঘর দেশীয় দুঃষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজ ও সেগুলো পাঠককে পৌঁছে দিচ্ছে। অনলাইনে অন্যদের চেয়ে আরো কম রেটে আমরা বই কেনার সুযোগ রেখেছি। বইয়ের বিপণনকে মাথায় নিয়ে আমরা সামনের দিনগুলোয় সুনির্দিষ্ট বই ও প্রাসঙ্গিক সংস্কৃতি ধরে অনলাইনে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশন কি এসব মেনে চলছে?
দীপক কুমার রায়: লেখকদের সাথে যথাসম্ভব পেশাদারি সম্পর্ক আমরা রক্ষা করে থাকি। রয়ালটি দেয়া, হিসাব দেয়া এবং বিদেশি বই হলে যথার্থভাবে তার অনুমতি আমরা নিই। যেমন শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বের হওয়া খ্যাতনামা বই 'মেজর থিমস অব কোরআন', 'ইসলাম' বাংলাভাষায় প্রকাশের অনুবাদ স্বত্ব কিনে প্রকাশ করেছি। তেমনি ভাবে ইয়স্তাইন গোর্ডারের সোফির জগৎ, অরুন্ধতী রায়ের ওয়াকিং উইথ কমরেডস বইটির অনুবাদ 'অরণ্যে যুদ্ধ' নামে বের হয়েছে; অনুবাদগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সামনে বের হবে অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত বই 'গ্লোবাল পলিটিকাল ইকোনমি'।
আমরা মনে করি, বর্তমানে বইয়ের ব্যবসা না দাঁড়ালেও বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের স্বার্থকে যথাসম্ভব রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশি হোক, বিদেশি হোক, বই প্রকাশের অনুমোদন নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সব নিয়ম মেনে চলায় আমরা নিষ্ঠাবান।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। সংহতি প্রকাশন এটা কিভাবে করছে?
দীপক কুমার রায়: পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে সংহতি প্রকাশন দায়িত্ব নিয়ে ভালো মানের দরকারি বই বের করার প্রচেষ্টায় থাকে। যেমন এক বই মেলায় স্বাধীন ভারতে নদ-নদী পরিকল্পনা নামের একটি বই মাত্র ৭ কপি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য বছরে তা ৫০-৬০ কপি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে বইটা এরকম কম বিক্রির পূর্বানুমান থাকলেও আমরা দেশের প্রয়োজন বিবেচনায় সে বই ছাপতে পিছপা হয়নি। আর এটাও তো ঠিক, একটা ভালো বইয়ের বিক্রয় যেকোন সময় বাড়তে পারে। অন্যদিকে বই নির্বাচনে আমরা অনেকসময় কঠোরও হই। অনুবাদ খারাপ হলে তা ছাপি না। এছাড়া তথাকথিত 'বাজারি' বই বের করাকে আমরা গুরুত্ব দিই না।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
দীপক কুমার রায়: প্রথমত এখানে সরকারী ক্রয়ে সীমাহীন দুর্নীতি, পাঠাগারের জন্য বই যথার্থ ও পর্যাপ্ত না কেনা, তৃতীয়ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার ভয়ংকর অবনতি ও উচ্চস্তরের বই না পড়েই পাঠ সমাপ্ত করার পরিস্থিতি এবং চতুর্থত দেশের শিশু-কিশোরদের পাঠাভ্যাস ও সংস্কৃতি গড়ে তোলায় সরকারি উদ্যোগের অনুপস্থিতি। এই কারণগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ না নিলে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ হবে না।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপনের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
দীপক কুমার রায়: বাংলাদেশের বইয়ের দোকানগুলো দেশীয় বইপত্র কম রাখে। এটা ওনারা করে 'দেশীয় বিক্রি কম হবার কারণে নয়, ভারতীয় বই বিক্রি করলে কমিশন বেশি হবে বলে'। ফলে বইমেলার বিক্রিই প্রকাশকদের প্রধান বিক্রি। কারণ সারা বছর পাঠক দেশীয় বইপত্রকে বইয়ের দোকানে দেখেনই কম। দেশের যে কোন বইয়ের দোকান ঘুরলে যতগুলো দেশীয় বই মিলবে, তার চাইতে বহুগুন বেশি ভালো বই দেশের বাজারে আছে, কিন্তু সেগুলোর প্রদর্শন নেই। বইমেলাই একমাত্র প্রদর্শনের স্থল। সেই কারণেই বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে; বই যদি সারা বছর দেশের দোকানগুলোতে প্রদর্শনী হতো এবং সরকার বই নিয়ে নানা আয়োজন করতো তাহলে সারা বছরই বই অনেক বেশি করে প্রকাশিত হতো। তবে এখনো কিছু কিছু বই সারা বছর ধরে প্রকাশিত হয়, আমরাও করি কিন্তু এই সংখ্যাটা পরিস্থিতি না বদলালে বদলানো সম্ভব না।

বিডিনিউজ: সংহতি প্রকাশন ইতিমধ্যে শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এই বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
দীপক কুমার রায়: বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পরিস্থিতি, বাংলাদেশে পানি ও জলবায়ু, নদী, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, নারী, ফোকলোর, ধর্মতত্ত্ব, সাহিত্য-সমালোচনা, দর্শন, মার্কসবাদ, অর্থনীতি, উন্নয়ন দর্শন, রাজনীতি, বৈশ্বিক অবস্থা এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির মৌলিক বইসহ বিভিন্ন অনুবাদের বই— এ পর্যন্ত ১১৫টি সৃজনশীল ও মননশীল বই সংহতি প্রকাশন প্রকাশ করেছে। গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা বিষয়বস্তুর ভিত্তি এবং আমাদের সমাজের জ্ঞানকাণ্ডে সেগুলোর উপযোগীতা খেয়াল করি।

বিডিনিউজ: সংহতি প্রকাশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
দীপক কুমার রায়: এ বছর বের হবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর 'বিদ্যাসাগর ও কয়েকটি প্রসঙ্গ', আজফার হোসেন এর 'পাঠ: শব্দ ও নৈশব্দের রাজনীতি', ইরফানুল বারি সম্পাদিত 'মওলানা ভাসানীর কৃষক সমিতি', জাহেদা আহমদ এর 'হিন্দু জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশ', আনু মুহাম্মদ এর 'বিশ্বায়নের বৈপরীত্ব', মনিরুল ইসলাম এর 'বুদ্ধির মুক্তি ও আমাদের মুক্তি', মুহাম্মদ তানিম নওশাদ এর 'শিখ ধর্মের উত্থান এবং তার ঐতিহাসিক পথচলা', নূরুল কবীরের একাত্তর নিয়ে বই, আল্যান বাদিউ ইতিহাস ও অভ্যুত্থান বিষয়ে অনুবাদ, এবং ফ্রয়েডের ওপর বইসহ আরো বেশ কয়েকটি বই নিয়ে কাজ চলছে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
দীপক কুমার রায়: আমরা সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধের চাপা পড়া, অনালোচিত এবং এড়িয়ে যাওয়া অংশগুলোকেই সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের 'একাত্তরের রণাঙ্গণে আমার দেখা আমার করা', নূর মোহাম্মদের 'একাত্তরের যুদ্ধ যশোরে পূর্ব পাকিস্তান (এম-এল) এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও জীবনদান', হায়দার আনোয়ার খান জুনোর 'একাত্তরের রণাঙ্গণে শিবপুর', নুরুল কবীরের 'ডিপোজিং অব এ ডিক্টেটর', সৈয়দ ইরফানুল বারীর 'মাও সেতুঙ এর দেশে' এই সব গ্রন্থগুলোতে প্রসঙ্গক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনীতিকে নিয়ে আলোচনা এসেছে। অবশ্য এটা খুবই ঠিক, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর নতুন গ্রন্থ গত দুয়েক বছরে প্রকাশিত হয়েছে, সমালোচকরা বলছেন এই সব গ্রন্থের অধিকাংশই অমৌলিক, তাদের মাঝে নতুনত্বের কিছু নেই। এই জোয়ারে সামিল না হবারই সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর নতুন বই থাকে। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
দীপক কুমার রায়: তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ করাটা জরুরী কর্তব্য, আমরা সে বিষয়ে যথাসম্ভব খেয়াল রাখি। তবে আমাদের প্রকাশনীটি প্রধানত গবেষণা, অনুবাদ এবং প্রবন্ধ ধরনের বইপত্রের বিশেষায়িত প্রকাশনী। তরুণ লেখকদের এ ধরনের মানসম্পন্ন বই প্রকাশে আমরা চেষ্টা করি; তাদের সাথে যথাসম্ভব পেশাদারিত্বের ভিত্তিতেই যোগাযোগ রক্ষিত হয়।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, দীপক ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
দীপক কুমার রায়: আপনাকেও ধন্যবাদ এহ্সান, সংহতি'র মননশীল বইয়ের সংগ্রহে পাঠকদের সব সময় স্বাগতম।


…………………….
"সম্পাদনা করতে গেলে যেই পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, সেই পরিমাণ অর্থ বই বিক্রি থেকে আসে না"
আফজাল হোসেন, প্রকাশক, অনিন্দ্য প্রকাশ
…………………….

বিডিনিউজ : করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
আফজাল হোসেন: করোনার কারণে সবচাইতে বেশি প্রভাব পড়েছে আমাদের সৃজনশীল পুস্তক ব্যবসার উপর। কারণ স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বই বিক্রি কমে গেছে। এই অবস্থার মধ্যেও আমরা কোনো অনুদান পাইনি।

বিডিনিউজ : বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে অনিন্দ্য প্রকাশ কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
আফজাল হোসেন : বই বিপনের জন্য আমরা অনলাইনে বিক্রি করার চেষ্টা করছি। তবে তেমন সফলতা পাইনি, অনেক ক্রেতা ঢাকার বাইরে অবস্থানের কারণে।

বিডিনিউজ : বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
আফজাল হোসেন : আমরা যে সমস্ত বই প্রকাশ করি, সেগুলোর জন্য লেখকের সাথে চুক্তিপত্র করে থাকি এবং বছরে একবার হিসাব প্রদান করে থাকি। বিদেশি বই অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়া খুব কঠিন, এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা দরকার।

বিডিনিউজ : বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। অনিন্দ্য প্রকাশ এটা কিভাবে করছে?
আফজাল হোসেন : সম্পাদনা করতে গেলে যেই পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, সেই পরিমাণ অর্থ বই বিক্রি থেকে আসে না। তবে আমরা চেষ্টা করি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাচাই করতে।

বিডিনিউজ : বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
আফজাল হোসেন : প্রকাশনা এখনও শিল্প হয় নাই। আমরা চাই প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তাহলে আমরা সুবিধা পাবো।

বিডিনিউজ : প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
আফজাল হোসেন : বই মেলার বিক্রির চাইতে আমরা প্রচারণাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবন করতে পারলে, আমার মনে হয়, আরো ভালো হবে।

বিডিনিউজ : অনিন্দ্য প্রকাশ ইতিমধ্যে সহস্রাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
আফজাল হোসেন : অনিন্দ্য প্রকাশ বরাবরের মতো যে বিষয়ের উপর বই করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। আমরা গুণ ও মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রুফ রিডিং, ভালো কাগজ, ভালো প্রিন্টিং, বাঁধাইয়ের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

বিডিনিউজ : অনিন্দ্য প্রকাশ এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
আফজাল হোসেন : অনিন্দ্য প্রকাশ অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও নির্বাচিত বই প্রকাশ করবে। কি কি বই হবে তা বলতে মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বিডিনিউজ : বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
আফজাল হোসেন : আমরা আগে থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশ করেছি এবং ভবিষ্যতে ও করবো।

বিডিনিউজ : প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর নুতন বই থাকে। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
আফজাল হোসেন : অনিন্দ্য প্রকাশ প্রতি বছর নতুন লেখকের বই প্রকাশ করে থাকে, এ বছরও করবে।

বিডিনিউজ : প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
আফজাল হোসেন : প্রকাশনা শিল্প বিকাশের জন্য প্রতিটি উপজেলায় পাঠাগার স্থাপন করা দরকার। তাছাড়া স্কুল কলেজে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কম পক্ষে সপ্তাহে একটি করে ক্লাস করা দরকার যাতে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠে।


…………………….
"পাণ্ডুলিপির বেলায় খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্যে আমাদের সুনাম-দুর্নাম দুই-ই আছে"
সাঈদ বারী, প্রকাশক, সূচীপত্র
…………………….

বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
সাঈদ বারী: বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধি করোনার প্রভাব ও অভিঘাত আমাদের দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে, সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পও এর বাইরে নয়। বই বিপণনের সবচেয়ে সহজ, স্বাভাবিক আর কার্যকর মাধ্যম হলো বুকস্টল বা বুকশপ। করোনার কারণে ক্রেতাশূন্যতায় ধুঁকে ধুঁকে ভুগছে বুকশপগুলো। এর ফলে প্রকাশকরা বই বিপণনের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এই সমস্যা আরো গভীর ও জটিল আকার ধারণ করেছে।
লকডাউনের তিন মাস প্রকাশকদের সরাসরি যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা-ও পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়নি তারা। করোনার কারণে একুশে বইমেলা নিয়ে প্রথম থেকে অনিশ্চয়তা (যদিও এখন মার্চে বইমেলা আয়োজনের ঘোষণা এসেছে) ও বিভ্রান্তি থাকায় নতুন বই প্রকাশনার পরিকল্পনা গ্রহণে দ্বিধা, সংশয় কাজ করেছে প্রকাশকদের মধ্যে।

বিডিনিউজ: সেক্ষেত্রে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে সূচীপত্র কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
সাঈদ বারী : বইয়ের বিপণন, প্রচার আর পাঠকবান্ধব করার ব্যাপারে সূচীপত্র অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে সর্বাত্মক ব্যবহার করার চেষ্টা ও প্রয়াস নিচ্ছে। সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশ-বিদেশের বইয়ের পাঠক ও ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্যে ইতিমধ্যেই আমরা অনেকখানি অগ্রসর হয়েছি। আমরা প্রায়ই অনলাইন বইমেলার আয়োজন করে থাকি। অনলাইন বুকশপগুলো কখনো কখনো সহ-আয়োজক থাকে। এছাড়া সূচীপত্র'র বইগুলোর হার্ডকপির পাশাপাশি স্বল্পমূল্যের ই-বুক প্রাপ্তির ওপরও আমরা গুরুত্ব আরোপ করছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনি কি মনে করেন?
সাঈদ বারী : এসব প্রত্যেকটি বিষয়ই পেশাদারিত্বের অংশ। বাণিজ্যিকভাবেও অনুকূল বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি। আমার প্রকাশনী সব সময় এসব বিষয়ে শতভাগ নিয়ম রক্ষাকারী, তা আমি দাবি করব না; তবে চেষ্টা থাকে— এটা জোর দিয়ে বলতে পারি। নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে আমাদের সৃজনশীল প্রকাশনা চালিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে যারা এ সরকারের সমর্থক নয়, তাদের জন্যে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। সূচীপত্র এটা কিভাবে করছে?
সাঈদ বারী: পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা বিষয়ে আমরা কখনো লেখক বা সম্পাদকের (সংকলিত গ্রন্থের বেলায়) সঙ্গে আপোস করি না। পাণ্ডুলিপির বেলায় খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্যে আমাদের সুনাম-দুর্নাম দুই-ই আছে। দুর্নাম তারাই করেন, যারা আমাদের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা (পাণ্ডুলিপি কখনো কখনো আমূল পরিবর্তন হয়ে যাওয়া) ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। এমনও হয়েছে কোনো কোনো পাণ্ডুলিপি থেকে বইয়ে রূপান্তর হতে পাঁচ বছরও সময় নিই আমরা। কখনো কখনো অনেক ঘষামাজার পরেও পাণ্ডুলিপি আমরা পরিত্যক্ত ঘোষণা করি।
প্রকাশনায় আসার আগে পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করায় সম্পাদনা বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা ও পক্ষপাতিত্ব এ ব্যাপারে আমাকে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করেছে। আর এর ফল ও সুমিষ্ট প্রতিক্রিয়াও আমরা পেয়েছি অজস্র পাঠকের কাছ থেকে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সূচীপত্র'র সুহৃদ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সহযোগিতা নিই অস্থায়ী ভিত্তিতে।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
সাঈদ বারী : আমাদের দেশে এখনো রিডিং সোসাইটি গড়ে ওঠেনি। এটি একটি প্রধান অন্তরায়। সাধারণ মানুষের পাঠাভ্যাস আরো বাড়াতে হবে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি মানসম্পন্ন সৃজনশীল-মননশীল বই তিনশ কপি বিক্রি করতে কয়েক বছর লেগে যায়!
পাঠাগার আন্দোলনও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বহু বছর হলো। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকাশকদের কাছ থেকে বই ক্র‍য়ে স্বচ্ছ, ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা অনুসরণ করে না। বই নিয়ে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই নয়, সারা বছরই আরো সৃজনশীল প্রকাশনাবান্ধব হওয়া জরুরি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
সাঈদ বারী: এটা সত্যি, প্রকাশকদের মধ্যে একটা বড় অংশের ভাবনাচিন্তা, পরিকল্পনা, রোডম্যাপ শুধু একুশে বইমেলাকে ঘিরে আবর্তিত। শতকরা ৯০ ভাগ লেখকের বেলায়ও একথা সত্য। ফলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প নিজ পায়ে দাঁড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। এ থেকে আমাদের উত্তরণ হওয়া জরুরি।
বই প্রকাশনা, ব্যবসায় সারা বছরের পেশা বা কাজ। এটাকে দুই তিন মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললে প্রকাশনা শিল্প শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে কীভাবে?
এ কারণেই আমি মাসব্যাপী বইমেলার পরিবর্তে ১০ বা ১২ দিনের বইমেলার পক্ষপাতি।
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে, আমরা সূচীপত্র'র প্রকাশনা-প্রস্তুতিকে বইমেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছি। সারা বছরই আমরা নতুন নতুন বই প্রকাশ ও পুরনো গুরুত্বপূর্ণ বই পুনঃপ্রকাশ বা পুনঃমুদ্রণ করে থাকি। অনলাইন বইমেলার মাধ্যমে পাঠকসংলগ্ন থাকার চেষ্টা করি।

বিডিনিউজ: সূচীপত্র ইতিমধ্যে ১৭০০-এর উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
সাঈদ বারী : সূচীপত্র ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ১৭০০ এর অধিক বই প্রকাশ করেছে। সব বই-ই যে মানসম্মত, সেটা আমরা দাবি করব না। নতুন লেখক, তরুণ (ব্যতিক্রমও আছে) লেখকদের বই অথবা কোনো বিশিষ্টজনের অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে কিংবা বাণিজ্যিক কারণে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও অনেক বই প্রকাশ করতে হয়েছে।
আমরা বিষয় বৈচিত্র্যের বই প্রকাশে আগ্রহ দেখিয়ে আসছি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বনামধন্য, অভিজ্ঞ লেখকের বই প্রকাশে প্রাধান্য দিয়েছি। সম্ভাবনাময় নবীন/তরুণদেরও অগ্রাধিকার দিয়েছি। এক্ষেত্রে গত ৩১ বছর ধরে পাঠকের আগ্রহ ও ভালোবাসা আমাদের চলার পথকে মসৃণ করেছে।

বিডিনিউজ: সূচীপত্র এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
সাঈদ বারী : প্রতি বছর বইমেলায় আমরা আমাদের প্রকাশিত একটি বইকে 'থিম বই' ঘোষণা করি। যে বইটি সূচীপত্র'র সিগনেচার পাবলিকেশন হিসেবেও পাঠকমহলে সমাদৃত হয়ে থাকে। এ বছর সূচীপত্র'র থিম বই কবি জীবনানন্দ দাশ-এর অগ্রন্থিত ১২৭টি কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থ 'সূর্য-অসূর্যলোক'। এই বইটির ভূমিকা ও সম্পাদনা করেছেন বিশিষ্ট জীবনানন্দ গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। এটি একটি ব্যত্যয়ী ও এক্সক্লুসিভ প্রকাশনা হতে যাচ্ছে বলে আমি মনে করছি।
এ বছর আমাদের প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই— নারীপক্ষ, ধর্ম নিয়ে যত কথা, লেখাজোখায় বাংলা বানান ও ভাষারীতি, বাঙলা ও প্রমিত বাঙলা, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর, ইতিহাসের অনুষঙ্গ, টম সায়ারের দুঃসাহসী অভিযান, মার্কসীয় শিল্পধারণা, টাইম ম্যানেজমেন্ট, ইসলামের রূপরেখা, ধ্বংসনগর, ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মেঘের ওপারে, কৃষ্ণচূড়া ও তুমি নীল জোছনা, নিঃশ্বাস নিঃশেষ হলে, দ্য গ্রেটেস্ট সেলসম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, সুকান্তসমগ্র, গল্পে গল্পে চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাঙালির ধর্মচিন্তা, গীতিকবিতা সংকলন, দ্য এজেন্ট, মঙ্গল গ্রহের সুপারহিরো।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
সাঈদ বারী : গুরুত্বপূর্ণ কিনা জানি না, আমরা দুটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে যা সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
সাঈদ বারী : আমরা প্রতি বছরই সম্ভাবনাময় তরুণ/নবীন লেখকদের বই প্রকাশ করার চেষ্টা করি। পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সরব ও উজ্জ্বল উপস্থিতি এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করে থাকে।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
সাঈদ বারী : প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্যে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। বর্তমানে প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়নে মনোযোগী না হয়ে রাজনীতিকে প্রকাশনা ব্যবসায়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।


…………………….
"অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিয়েই বই ছাপা উচিত"
আহমেদ মাহমুদুল হক, প্রকাশক, মাওলা ব্রাদার্স
…………………….

বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
আহমেদ মাহমুদুল হক: বৈশ্বিক মহামারি পুরো মানবজাতিকেই বিপর্যস্ত করেছে। সারাবিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। করোনার প্রভাবে আমাদের প্রতিটি সেক্টরই গত বছর থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রকাশনাশিল্প এর বাইরে নয়। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, আমরা তাদের ফিরে পাবো না। তবে আমরা আশা করছি যে, অচিরেই আমরা অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। আশার কথা হচ্ছে, করোনার ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই দেশে চলে এসেছে।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপণন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে মাওলা ব্রাদার্স কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
আহমেদ মাহমুদুল হক: বই বিপণনের ক্ষেত্রে সারাদেশের বই বিক্রেতারা মাওলা ব্রাদার্সের বই বিক্রি করেন। একইসঙ্গে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি আছে। এছাড়া আমরা অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের ওয়েবসাইট mowlabrothers.com-এ আমরা সাড়া পাচ্ছি। ই-কমার্স উদ্যোগে অনেকেই এসেছেন। আমরা এসেছি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। পাঠক-ক্রেতারা আমাদের বই পাবেন, পাশাপাশি অন্য প্রকাশকদের বই বিপণনের ব্যবস্থাও আমরা করবো। পরিকল্পনা সেভাবেই করেছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কেউ কেউ বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল মনে করেন না। আপনি কি মনে করেন? আপনার প্রকাশনী কিভাবে তা মেনে চলছে?
আহমেদ মাহমুদুল হক: যেকোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে বইয়ের বাজার মূলত টেক্সট-বই নির্ভর। সৃজনশীল-মননশীল বইয়ের বাজার খুবই সীমিত। আমাদের সৃজনশীল-মননশীল লেখকরা এটা জেনেও বই লেখেন। তাদের এই মহৎ ও সৃজনশীল কর্মের সাথে প্রকাশকরা সম্পৃক্ত থাকছেন।
আমরা লেখক-প্রকাশকের চুক্তি অনুযায়ী বিক্রীত বইয়ের অর্থ লেখকদের সময়মতো দিয়ে থাকি। অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিয়েই বই ছাপা উচিত। মাওলা ব্রাদার্সের ৭ দশকের ইতিহাসে এভাবেই বই ছাপা হয়েছে। আমি মনে করি, সবারই লেখক-প্রকাশক চুক্তি থাকা উচিত।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। মাওলা ব্রাদার্স এটা কিভাবে করছে?
আহমেদ মাহমুদুল হক: মাওলা ব্রাদার্সের এডিটোরিয়াল বোর্ড রয়েছে। সম্পাদনা ছাড়া মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করা খুবই দুরুহ। অন্যান্য প্রকাশনাও সম্পাদনা নীতি মেনেই বই প্রকাশ করছে বলে মনে করি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?

আহমেদ মাহমুদুল হক: বিষয়ভিত্তিক ও মানসম্পন্ন, সৃজনশীল-মননশীল, সেইসাথে গবেষণাধর্মী পাণ্ডুলিপির অভাব রয়েছে। উপজেলা-থানা পর্যায়ে লাইব্রেরি স্থাপন এবং সেখানে লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দিতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে গণগ্রন্থাগারের সরকারি বরাদ্দ আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
আহমেদ মাহমুদুল হক: বইমেলা পাঠক-প্রকাশকদের একটি মিলনমেলা। আমাদের পাঠক খুবই সচেতন। সারাবছরই তারা বই ক্রয় করে থাকেন। পাশাপাশি তারা তাদের পছন্দের বই মেলা থেকে সরাসরি সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া বইমেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বই বিপণনের চেয়ে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিডিনিউজ: মাওলা ব্রাদার্স ইতিমধ্যে প্রায় ১,৮০০ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
আহমেদ মাহমুদুল হক: মাওলা ব্রাদার্স সবসময় মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে থাকে। তরুণ সম্ভাবনাময় সব লেখকের বই আমরা প্রকাশ করে থাকি। মাওলা ব্রাদার্সের অনেক মানসম্পন্ন বই দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছে। এডিটোরিয়াল বোর্ড বইয়ের মান নির্ধারণ করে থাকে।

বিডিনিউজ: মাওলা ব্রাদার্স এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
আহমেদ মাহমুদুল হক: এবছর বেশ কিছু নতুন বই আমরা প্রকাশ করতে যাচ্ছি। mowlabrothers.com এ এসব বইয়ের তথ্য পাওয়া যাবে। সৃজনশীল-মননশীল সব শাখায় বই প্রকাশিত হবে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
আহমেদ মাহমুদুল হক: আমরা এরই মধ্যে Agartala Conspiracy Case (Vol: 1, 2, 3, 4), 'বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যেভাবে ফিরে পেল' প্রকাশ করেছি। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ (দুই খণ্ড) প্রকাশ করতে যাচ্ছি।

বিডিনিউজ: বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
আহমেদ মাহমুদুল হক: আমরা নতুন লেখকদের বই প্রতি বছরই ছেপে থাকি। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত প্রথম বইয়ের লেখকরা দেশের প্রভাবশালী লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

বিডিনিউজ: প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
আহমেদ মাহমুদুল হক: বই তস্করদের কারণে প্রকাশনাশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এদেরকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ পাঠকদের সচেতন হতে হবে। নকল বই না কিনলে আমাদের লেখকরা তাদের প্রাপ্য সম্মানি পাবেন এবং তারা উৎসাহিত হয়ে আরো ভালো বই লিখবেন।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, মাহমুদুল হক ভাই, সময় দেয়ার জন্য।
আহমেদ মাহমুদুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।