পর্ব ১৮ : পরিসর ও স্থান নিয়ে বিতর্ক

জালাল ফিরোজ
Published : 27 Feb 2019, 05:39 AM
Updated : 27 Feb 2019, 05:39 AM


গ্রন্থমেলা ২০১০ : পরিসর নিয়ে বিতর্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আণবিক শক্তি কমিশন না কি কেবল একাডেমিতে ?
২০১০ সালের গ্রন্থমেলার শুরু থেকে মেলার পরিসর নিয়ে বিতর্ক হয়। একদিকে একাডেমি প্রাঙ্গণে নতুন ভবন নির্মাণের ফলে স্থান সংকুচিত হওয়া এবং অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক প্রকাশকের মেলায় অংশগ্রহণের আগ্রহের ফলে এই বিতর্ক দেখা দেয়। কেউ কেউ বলেন‌ মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত পরিসরে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আবার কেউ কেউ একাডেমি সংলগ্ন আণবিক শক্তি কমিশনে মেলা বিস্তৃত করে স্থান সম্প্রসারণের যুক্তি দেন। কেউ কেউ এই অবস্থান নেন যে, বইমেলা কেবল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই অনুষ্ঠিত হওয়া সমীচীন। ২০১০ সালে বইমেলা শুরুর পর এই বিতর্ক দেখা দেয়।

১লা ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ-বছরের বইমেলা উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বই শুধু শিক্ষার উপকরণ নয়, সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশেরও শক্তিশালী হাতিয়ার। একুশে বইমেলা লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা। তিনি প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের প্রতি আহ্বান জানান।

এই বছরের বইমেলায় ৪৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৩১ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৪ ইউনিটের ১টি, ৩ ইউনিটের ২৩টি, ২ ইউনিটের ১০৯টি এবং এক ইউনিটের স্টল ছিল ২৪০টি। প্রকাশকের আবেদনপত্রের সঙ্গে টিআইএন নম্বর দেয়ার শর্ত দেওয়া হয়। এই বছরের বইমেলা ভাষাশহিদ ও কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নামে উৎসর্গ করা হয়। পুরো মেলা প্রাঙ্গণ ৯টি ভাগে বিভক্ত এবং একেকটি অংশ একেকজনের নামে উৎসর্গকৃত হয়। চত্বরগুলোর নাম ছিলো এ-রকম : ভাষাশহিদ চত্বর, রবীন্দ্র চত্বর, নজরুল চত্বর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চত্বর, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ চত্বর, সুফিয়া কামাল চত্বর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বর, সোমেন চন্দ চত্বর ও বেগম রোকেয়া চত্বর। এই বছরের মেলা স্পন্সর করে ব্রাক ব্যাংক।

প্রতি বছরের মতো এবারও একাডেমি বইমেলা উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। প্রতিদিন বইমেলায় নতুন নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। ২রা থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সেমিনারগুলোতে 'ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কথা : ১৯৪৭-১৯৫৩' এই বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা হয়।

২০১০ সালে টিএসসি ও দোয়েল চত্ত্বরের দিক থেকে মেলায় প্রবেশের সময় অনেকে হকারদের উপদ্রবের শিকার হন। 'বই লন খালি ষাইট, দেইখ্যা লন ষাইট, বাইচ্ছা লন ষাইট', এই জাতীয় স্লোগান ও কোরাসে হকাররা রাস্তায় বই বিক্রি করে প্রকৃত ক্রেতা-পাঠকদের হয়রানি করে। এছাড়া আরও কিছু নেতিবাচক সংবাদ যেমন 'নোট বই প্রকাশ করায় ৫ স্টল বন্ধ ঘোষণা : ৩০ প্রকাশনীকে সতর্কবাণী', 'মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের বিক্রি হতাশাজনক', 'বিজাতীয় শিশুতোষ গ্রন্থে সয়লাব', 'বইমেলায় পাঠকদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না' ইত্যাদি প্রকাশিত হলেও এই বছর সুন্দর ও সফল বইমেলা হয়। বৃষ্টির কারণে ২৪শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা পণ্ড হয়। তবু এই বছর 'পরিপূর্ণরূপে' সার্থক ও 'কেনাকাটায় ধুম', পড়ে এমন মেলা হয়েছিল।

২০১০ সালে বছর মেলার স্থান ও পরিসর নিয়ে বিতর্ক হয়। এই বিতর্ক বেশ আকর্ষণীয় ও কৌতুহল উদ্দীপক ছিল। লেখক ও শিক্ষাবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, 'প্রতি বছর বইয়ের স্টলের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে একাডেমী চত্বরের খোলা জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এ মেলা আগামীতে করা দুরূহ হবে। …বাংলা একাডেমীর কাজ নয় বছরে তিন মাস তাদের মূল কাজ বন্ধ রেখে বইমেলা করা। এ কাজটি গ্রন্থকেন্দ্রের। একুশে বইমেলা থাকুক এবং তার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করা হোক। শুধু আবেগ দিয়ে কাজ হবে না। শুধু আবেগের ওপর ভিত্তি করে গঠনমূলক কোনো কাজও এগিয়ে নেয়া যায় না।' ২০১০ সালে একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে প্রথম গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন শামসুজ্জামান খান। বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে মেলা করলে সমস্যা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমিও মানি এবং এ বিষয়ে পক্ষপাতী। আমাদের লেখকেরাই কেউ বাংলা একাডেমীতে মেলা হোক আবার কেউ সোহরাওয়ার্দীতে হোক এমনটি চান— ফলে মতানৈক্য থেকেই যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি মেলাকে পরিচ্ছন্ন এবং জঞ্জালমুক্ত করতে সোহরাওয়ার্দীতে সরিয়ে নেয়া উচিত।' লেখক রাহাত খান বলেন, 'বর্তমান বাস্তবতায় মেলার পরিসর বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। তবে তা করতে হবে একাডেমী চত্বরে মূল মেলাকে রেখেই। আণবিক শক্তি কমিশন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা বিস্তৃত করা যেতে পারে।' বইমেলাকে বাংলা একাডেমি থেকে না-সরানোর পক্ষে অবস্থান নেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, 'অমর একুশে বইমেলা আমার জায়গা। মেলা চত্বরটি আমার বড়ই আপন। এখানে আসার পর প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি। …বইমেলা এই একাডেমীস্থল থেকে অন্য কোথাও যাক সেটা আমি চাই না।' বইমেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেওয়ার পক্ষে কথা বলেন লেখক শাকুর মজিদ। তিনি বলেন, '…আমি আশংকিত, বইমেলায় নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। মেলার জায়গা বাড়ানো উচিত। আমি মনে করি মেলার জায়গা প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দীতে সরিয়ে নেয়া যেতে পারে। মানুষের চলাফেরার জন্য জায়গা বাড়ানো উচিত। যেখানেই সরানো হোক না কেন, বইপোকারা যাবেনই মেলায়।' তবে সেলিনা হোসেনের মতো বইমেলাকে বাংলা একাডেমি থেকে অন্যত্র সরানো ঠিক হবে না বলে মনে করেন সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি বলেন, 'বইমেলাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া উচিত হবে না। কারণ বাংলা একাডেমীর বইমেলার একটা ঐতিহ্য আছে। এই যে ছোট জায়গা এত স্টল অসংখ্য মানুষের পদচারণা একজনের পা আরেকজনে লেগে যায় এটাই মেলার আসল চিত্র, মেলা এমনি হওয়া উচিত।' কবি নির্মলেন্দু বইমেলার পরিসর বাড়ানোর কথা বলেন। তবে তাঁর মতে সেটা হতে হবে বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন, 'আমি চাই বাংলা একাডেমীকে কেন্দ্র করেই মেলা চারপাশে বিস্তৃত করা হোক। আণবিক শক্তি কমিশনের দেয়াল ভেঙ্গে বাংলা একাডেমীর সঙ্গে এক করা যেতে পারে। ফলে মেলার পরিসর বাড়লে মেলা আরো জমজমাট হয়ে উঠবে বলেই মনে করি।'

১৯শে ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের নাম ঘোষণা এবং ২৮শে ফেব্রুয়ারি পুরস্কার প্রদান করা হয়। এবার প্রথম বইমেলায় তারবিহীন ওয়াইফাই ইন্টারনেট সুবিধা স্থাপিত হয়। ৩৩৫৪টি নতুন বই প্রকাশিত হয়। এক বছরের বইমেলায় এই বিপুলসংখ্যক নতুন বই প্রকাশনাকে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে '৪৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে' বলে উল্লেখ করা হয়। এইবার প্রথম চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। পুরো মেলায় ২০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। কেবল বাংলা একাডেমি ৬৮,০১,৬৮৫.৮৫ টাকার বই বিক্রি করে।