পর্ব ১৪ : রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ভালো মেলা

জালাল ফিরোজ
Published : 16 Feb 2019, 02:03 PM
Updated : 16 Feb 2019, 02:03 PM

গ্রন্থমেলা ২০০৬ : রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ভালো মেলা
২০০৬ সাল ছিলো ২০০১ সালে গঠিত সরকারের শেষ বছর। এই বছর সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ দলীয় জোটের ডাকে লংমার্চে ঢাকা অবরুদ্ধ হয়। সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বইমেলা নির্বিঘ্নে ১লা ফেব্রুয়ারি শুরু ও ২৮শে ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। নানাক্ষেত্রে বইমেলা উল্লেখযোগ্য সফলতাও অর্জন করে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ১লা ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় বইমেলা উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সেলিমা রহমান। স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। ধ্যন্যবাদ জ্ঞাপন করেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ। বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব এ টি এম আতাউর রহমান ও বাপুপ্রবিস-র সভাপতি মো. আবু তাহের। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, বইমেলা আমাদের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। বই জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। বইমেলা আমাদের জনগণের মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক। এই মেলা গ্রন্থমনস্কতা বাড়াবে। বেশি বেশি বই পড়ুন, ঘরে ঘরে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলুন, শিশুদের বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করুন আর প্রিয়জনকে বই উপহার দিন।

২০০৬ সালে ৩১৭টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৪৭৭ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে ১৭৮টি প্রতিষ্ঠান ১ ইউনিটের, ১১৮টি প্রতিষ্ঠান ২ ইউনিটের এবং ২১টি ৩ ইউনিটের স্টল পায়।

আগের বছর বইমেলা শেষের দিন সদস্য সচিব নীতিমালা লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো 'যাতে কোন অবস্থাতেই মেলায় অংশগ্রহণ করতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে' বলে আশ্বাস দিলেও ২০০৬ সালে এ-বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গতবারের নীতিমাল লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মেলায় অংশ নেয়। তবে এই বছর শুরু থেকে নীতিমালা লঙ্ঘনের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ার উচ্চারিত হয়। একাডেমির মহাপরিচালক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ৬ই ফেব্রুয়ারি নীতিমালা বাস্তবায়ন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে মেলার ৫৩টি স্টল পরিদর্শন করেন। তারা ১০টি স্টলে নীতিমালা যে লঙ্ঘিত হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করেন। এসব স্টলকে তারা সতর্ক করেন এবং একদিনের মধ্যে না-শুধরালে স্টল বন্ধের নির্দেশ দেন। এই বছর প্রথম সপ্তাহে রেকর্ডসংখ্যক নতুন বই বের হয়। গতবার প্রথম সপ্তাহে যেখানে ৩০০টি নতুন বই বের হয়েছিল, এবার একই সময়ে ৪৫৪টি নতুন বই বের হয়।

২০০৬ সালের বইমেলায় দুটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়। এই দুটি বিষয় মেলায় স্থায়ীভাবে থেকেও যায়। এবারই প্রথম কোনো স্পন্সর প্রতিষ্ঠানকে মেলার যুক্ত করা হয়। গ্রামীণফোন বইমেলার মূল স্পন্সর হয়। কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর হওয়া নয়, অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান এই বছর গ্রন্থমেলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহও প্রকাশ করে। সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয় :

দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মিডিয়াগুলো প্রতিদিন মেলার নানামাত্রার সচিত্র সংবাদ প্রচার করার কারণে শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের মধ্যেও মেলাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের প্রণোদনা ছড়িয়ে পড়েছে। সম্ভবত বাংলাদেশে এই বইমেলাই একমাত্র উৎসব, যাকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী প্রচারণা চালায় আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলো।

লেখক-পাঠক-প্রকাশক-সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষের এই মিলনমেলাকে কেন্দ্র করে প্রচার মাধ্যমের এই প্রচারণার কারণে বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছে। কেউ স্পন্সর করে, কেউ বা কোনো একটা উছিলায় মেলায় একটি জায়গা করে নিতে চাচ্ছে।

এবার মেলায় প্রধান স্পন্সর হিসেবে অংশ নিয়েছে গ্রামীণফোন। তারা প্রচার পোস্টার, তোরণ নির্মাণ, ভাষাশহীদদের ছবি সংবলিত চত্বর বিন্যাস, তিনটি মঞ্চসজ্জা, মেলার অনুষ্ঠানসূচি প্রচার ইত্যাদিতে অংশ নিয়েছে। অপর মোবাইল কোম্পানি বাংলালিংকও স্পন্সরের জন্য এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারা দেরি করে আসার কারণে সুযোগ নিতে পারেনি। তারপরও তারা বসে থাকেনি। বইমেলা উপলক্ষে বিশেষ ব্যাগ তৈরি করে স্টলে বিলিয়েছে পাঠকদের বই নিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে। প্রসাধন সামগ্রী কিউট পরিবেশবান্ধব কয়েক হাজার ব্যাগ দিয়েছে বাংলা একাডেমীর বিক্রয় কেন্দ্রে।

২০০৬ সালে গ্রামীণফোনের স্পন্সর করার মধ্যদিয়ে একাডেমির বইমেলা স্পন্সর করার যে রীতি শুরু হয় তা স্থায়ী হয়। এরপর বিভিন্ন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বছর বইমেলা স্পন্সর করতে এগিয়ে আসে। তবে সেই বছর গ্রামীণফোনের স্পন্সর করা নিয়ে বিতর্কও হয়। অনেকে একটি বহুজাতিক কোম্পানিকে অমর একুশে বইমেলা স্পন্সর করার দায়িত্ব দেওয়ায় বাংলা একাডেমির সমালোচনা করেন।

২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি প্রথম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের পুরস্কার দেওয়ার রীতি চালু করে। দীর্ঘদিন থেকে একাডেমি কেবল অঙ্গসজ্জা ও সৌন্দর্য্যের জন্য তিনটি স্টলকে পুরস্কৃত করছিলো। এবার ভালো বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়ার নীতি ঘোষণা করে। প্রথম বছর হিসেবে অনেক প্রকাশনা সংস্থা এই পুরস্কারের জন্য বই জমা দেয়।

কাগজের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রকাশকেরা বইমেলায় প্রতিবাদ করেন। তারা ব্যানার নিয়ে মেলার বিভিন্ন চত্বর প্রদক্ষিণ করে তথ্যকেন্দ্রের সামনে প্রতিবাদ সভা করেন। তারা কাগজের মূল্য বৃদ্ধি প্রকাশনা শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ফেলছে বলে মন্তব্য করেন। বইমেলার মতো সংবেদনশীল স্থানে অনুষ্ঠিত এই প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

২০০৬ সালে রেকর্ড সংখ্যক নতুন বই প্রকাশিত হয়। প্রথম তিন সপ্তাহে বইমেলায় ১৪৪২টি নতুন বই বের হয়। অথচ ২০০৫ সালে সারা মাসে বের হয়েছিলো ১৩৯৫টি নতুন বই। এই বছর একদিনে সর্বোচ্চ ২১৮টি নতুন বই বের হয়। এক দিনে নতুন বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এটি তখন রেকর্ড ছিলো। ২০০৬ সালে আগের রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বমোট ১৮২৫টি নতুন বই প্রকাশিত হয়। অমর একুশে বইমেলা সম্পর্কে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের মন্তব্য ছিলো, 'আমাদের বইমেলায় বইয়ের বৈচিত্র্য কম। এটি প্রধানত উপন্যাসের মেলা, এক সময় ছিল সস্তা উপন্যাসের মেলা, এখন সেটা বেশ কমেছে।' হুমায়ুন আজাদের এই মন্তব্যকে সত্য প্রমাণ করে ২০০৬ সালের মেলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। আর প্রকাশিত সকল উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় হুমায়ুন আহমেদের নতুন উপন্যাস হলুদ হিমু কালো র‍্যাব। মেলায় বইটির ৩০ হাজার কপি বিক্রি হয়।
টীকা:
১.দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা, ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ১৬
২.দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা, ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ১৬
৩.দেখুন, আজিজুল পারভেজ, 'স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বাড়ছে', দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ১৬
৪. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা, ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ১৬
৫. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা, ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ১৬

(দেখুন পর্ব ১৫ : তত্ত্বাবধায়ক আমলে বইমেলা)