থমকে দেওয়া এক সারি ছবি নিয়ে সুজনের ‘দাঁড়াও, ঢাকা’

হাসান বিপুল
Published : 16 May 2022, 09:21 AM
Updated : 16 May 2022, 09:21 AM


ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ

শিল্পের কাজ কী? এ নিয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত রয়েছে, এবং এর প্রতিটি মতের পেছনেই রয়েছে কারো না কারো সমর্থন।

কেউ বলছেন, শিল্পের কাজ হচ্ছে সৌন্দর্য বা নান্দনিকতার অনুভূতি তৈরি করা। কেউ বলছেন, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক বা দার্শনিক ধারণার সংযোগ। কেউ বলছেন, বিশেষ কোনো বোধ তৈরি করা, সেটা আনন্দদায়ক হতে পারে বা যে কোনো ধরনের তীব্র কোনো অনুভূতিও হতে পারে।

মোদ্দা কথা শিল্পী তার অনুভূতি প্রকাশ করেন তার কাজের মধ্যে দিয়ে। সেই শিল্প রস যারা গ্রহণ করেন, শিল্পী খেলা করেন সেই রস গ্রহীতার অনুভূতি নিয়ে।

সে যাক। আমরা সুজনের ছবি নিয়ে কথা বলি বরং।

বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের সবচেয়ে পুরোনো কোঅপারেটিভ এজেন্সি ম্যাপ-এর সদস্য বশির আহমেদ সুজন ছবি তুলছেন প্রায় দুই যুগ ধরে। ঢাকায় ফরাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর গ্যালারিতে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছেন সুজন, আর সেটি গুছিয়ে দর্শকের জন্য তুলে ধরা, যাকে বলা হয় কিউরেটিং, সেটি করেছেন আমিরুল রাজিব আর নাঈম উল হাসান তাদের 'দুনিয়াদারি আর্কাইভে'র ব্যানারে।

এই কেতাবী বর্ণনা পেরিয়ে আলিয়ঁসের ল্যো গ্যালারিতে ঢোকামাত্রই একটু ধাক্কা খেতে হয়। গ্যলারির চারপাশের সাদা দেয়ালে কোনো ছবি নেই! তার বদলে মেঝে থেকে সার সার ছবি দাঁড়িয়ে আছে দর্শকের মুখোমুখি। কোনো ছবির ডান পাশ দিয়ে, কোনো ছবির বাম পাশ ছুঁয়ে এগিয়ে যেতেই কোনো ছবি আবার মুখোমুখি বেমাক্বা থমকে দেবে।

প্রদর্শনীতে সাদা-কালো এই ছবির মধ্য দিয়েই হেঁটে গিয়ে পৌঁছাতে হয় ভিন্ন ভিন্ন ছবির কাছে।

সুজন পেশাদার আলোকচিত্রী। কোনো বিষয়ে 'পেশাদার' শব্দটির মানে হচ্ছে আয়ের অর্ধেকের বেশি ওই পেশা থেকে আসা। সুজনের বেলায় এটি শতভাগ।

যাদের ভিন্ন একটি পেশা আছে এবং তার পাশাপাশি ছবি তোলেন তাদের সঙ্গে শতভাগ পেশাদার আলোকচিত্রীদের তফাৎটি বিস্তর। তাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্লিক প্রতিটি ট্যুর আবর্তিত হয় পেশাদারী ফরম্যাটে। আর এর মধ্যে নিজের জন্য ছবি তোলা, নিজের একটি প্রজেক্ট এগিয়ে নেওয়া একেবারেই যক্ষের ধনের মতো সময় খরচ করে এগোয়। ফলে, একেবারেই অবাক করা বিষয় নয় যে, দুই যুগের ক্যারিয়ারে আলোকচিত্রীর এটি প্রথম একক প্রদর্শনী।

শিল্পকর্মের পেছনের মানুষটির এইসব খুঁটিনাটি জানা থাকলে তার কাজের সঙ্গে ভাব বিনিময়, আলাপচারিতা আর বোঝাপড়ার বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়। সেই সব খুঁটিনাটি তথ্যের একটি হলো আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে বিশেষ একটি ক্যামেরা কিনেছিলেন সুজন। সে সময় প্রায় সব পেশাদার আলোকচিত্রী ফিল্ম ছেড়ে ডিজিটাল ক্যামেরায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। আর তিনি ডিজিটাল ক্যামেরার পাশাপাশি কিনলেন একটি ফিল্ম ক্যামেরা। সুইডিশ ক্যামেরা নির্মাতা হ্যাসলব্লাডের এক্সপ্যান সিরিজের ক্যামেরা সেটি।

চলতি প্রদর্শনীর ছবি বুঝতে হলে এই হ্যাসলব্লাড এক্সপ্যান সম্পর্কে দুইএকটি কথা বলে নেওয়া জরুরী। ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তোলার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা জানেন, ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মে প্রচলিত ক্যামেরায় স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ৩৬টি ছবি তোলা যায়। যারা ডিজিটাল যুগের আগে পকেটের পয়সা জমিয়ে ফিল্ম কিনে ছবি তুলেছেন তারা অনেক কায়দা করে, অন্ধকার ঘরে গিয়ে ফিল্ম লোড করে ৩৮টি পর্যন্ত ছবি তুলতে পারলে বিশাল কিছু করে ফেলার আনন্দ পেতেন। এই হ্যাসলব্লাড এক্সপ্যান ক্যামেরায় সেই হিসেবে এক রোল ফিল্মে ছবি ওঠে সাকুল্যে ১৮ কি ১৯টি। কেন? কারণ, এই ক্যামেরায় তোলা ছবি চাওড়ায় হয় দ্বিগুণেরও বেশি। সহজ ভাষায় যাকে বলে প্যানারমিক ছবি।

এ থেকে বোঝা গেল প্রদর্শনীর ছবিগুলো প্যানারমিক। বেশ! আর কী বোঝা গেল? আর, সব ছবি ফিল্মে তোলা। ঠিক আছে। আর কী?

আর, সব ছবি ভর্টিকাল!

বিজ্ঞান বলছে, মোটামুটি ভাবে দুই চোখ মিলে আমরা ডানে-বায়ে প্রায় ১৮০ ডিগ্রিতে দৃশ্য দেখি, আর ওপর-নিচে এইটি প্রায় ১৫০ ডিগ্রি। তার মানে হচ্ছে, খালি চোখে দেখা দৃশ্য আমরা আড়াআড়িই দেখি।

যারা ছবির কম্পোজিশন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তারা জানেন ছবিতে জায়গার ব্যবহার বা স্পেস ম্যানেজমেন্ট প্যানারমা ফরম্যাট কতোটা 'প্যারা' দেয়। সেই কম্পোজিশন যখন আড়াআড়ি থেকে হয়ে ওঠে একেবারে খাড়া, সেইটি একটা অভিজ্ঞতা বটে! এ প্রদর্শনী সেই অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী হয়ে থাকবে।

সেই অভিজ্ঞতা কি পুরোটাই – ইহা কী হেরিলাম! জাতীয় স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়? এর জবাবে এক দমে হ্যাঁ বলে ফেলাটা একটু দুষ্কর বৈকি!

ছবির বিষয়বস্তু ঢাকা, ঢাকার রাজপথ থেকে প্রতিদিনের দেখা দৃশ্যের সাদা-কালো, নিরেট বাস্তব আর কাব্যময় প্রকাশের মিশেল। ঢাকায় এই প্রতিদিনের দৃশ্যপটে মাথার ওপরে তাকালেই চোখ আটকে যায় অট্টালিকায়। এই অট্টালিকার সারি কোনো দৃষ্টিনন্দন অনুভুতি দেয় না।

সুজন কি সেটাই দেখাতে চেয়েছেন? সম্ভবত তা-ই। যে ঢাকা এক সময় বিস্তৃত ছিল, সেই ঢাকা এখন বাড়ছে ওপরের দিকে। ঢাকার রাস্তায় ডানেবায়ে তাকালে যে চটপটির গাড়ি আর লেইসফিতা এক আটপৌড়ে সহজিয়া অনুভুতি দিত, আলোকচিত্রী বললেন, সেইটি তিনি আর পান না।

"এখন এক প্লেট চটপটিও শান্তিতে খেতে হলে আপনাকে অট্টালিকার ভেতরে ফুডকোর্টে যেতে হবে। রাজপথের লেইসফিতার জায়গা পোক্ত হয়েছে সুউচ্চ শপিং মলের শোকেসে।"


সুপরিচিত ঢাকা আলগোছে কখন যে অপরিচিত হয়ে ওপরের দিকে বাড়ছে সেটি রাজপথের প্রতিদিনের চোখ সওয়া মননে আর গাঁথে না। সেই গেঁথে দেওয়ার ব্যাথাময় অনুভুতি মিলবে আলিয়ঁসের শিততাপ নিয়ন্ত্রিত গ্যালারিতে। সেই ব্যাথাতুর অনুভুতি জাগানোর কৃতিত্ব সুজনের প্রাপ্য।

গ্যালারির দেয়াল বাদ দিয়ে মেঝে থেকে ফ্রেমের ওপর ছবি বসানোর ধারণায় চমক আছে।

"দেয়ালে ছবি ঝোলালে ভার্টিকাল প্যানারমায় গোটা দেয়াল হয়ে উঠত অনেকটা পিয়ানোর রিডের মতো।" – বললেন রাজিব।

তবে প্রদর্শনীতে ঢোকার পর মনে হতেই পারে – এই আয়োজনের জন্য এটাই সম্ভবত সবচেয়ে যুতসই সমাধান ছিল। আর এর কৃতিত্ব দুই কিউরেটর রাজিব আর নাঈমের।

তবে, এই ছবিগুলো নিয়ে এই আয়োজন কী আরও উপভোগ্য হতো বড় কোনো গ্যলারিতে? ধরা যাক, শিল্পকলা একাডেমিতে? সম্ভবত।

ভার্টিকাল ছবিগুলোর কম্পোজিশনে শিল্পী কখনো অনেক সুক্ষ্ম একগাদা উপাদান রেখেছেন, কখনোও বা খেলেছেন স্পেস নিয়ে। ফলে, আরও বড় প্রিন্ট যদি বড় কোনো গ্যালারিতে দর্শক দেখতে চান, তবে সম্ভবত দোষ দেওয়া যাবে না।


দুই বছরের কোভিড বন্ধ্যাত্বের পর এমন আয়োজন যথেষ্ট সংখ্যক শিল্প পিপাসুকে গ্যালারিতে টেনে আনবে সে আশা করাই যায়। ফলে, মাত্র আট দিনের এই আয়োজনে ভীড় এড়িয়ে শান্তিমতো ছবি দেখার অভিজ্ঞতায় ছেদ পড়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। কোনো ছবি একটু দূর থেকে দেখার ইচ্ছায় সতর্ক থাকতে হয় পেছনে না অন্য কোনো দর্শক বা ফ্রেমের সঙ্গে বেমাক্কা ধাক্কা লাগে। বিশেষ করে ছবি সাজাতে গিয়ে কিউরেটররা মুন্সিয়ানার সঙ্গে কখনো দুটি কখনো তিনটি ছবি মিলে এক একটি সেট তৈরি করেছেন। ছবিগুলো আলাদা কিন্তু তিনটি ছবি মিলেও ভিন্ন একটি ব্যঞ্জনা তৈরি করে। সেই ব্যঞ্জনার স্বাদ পেতে হলে আপনাকে খানিকটা দূর থেকেই দেখতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।

আয়োজকরা যদি সেই শঙ্কা আর সতর্কতাকেও প্রদর্শনীর 'সাট্ল এলিমেন্ট' বলে চালিয়ে দেন, তাহলে অবশ্য কিছু বলার নেই!

১৩ মে থেকে শুরু হওয়া এ আয়োজন চলবে ২১ মে পর্যন্ত। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের গ্যালারি খোলা থাকে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা অব্দি। এর মধ্যে রোববার সাপ্তাহিক ছুটি।