ছবিমেলায় ওপেন এয়ার এক্সিবিশনমুনেম ওয়াসিফের ফটোগ্রাফি বাংলাদেশের ‘টেকসই উন্নয়ন’কে এগিয়ে দেবে

এস এম রেজাউল করিম
Published : 30 Jan 2011, 08:02 PM
Updated : 30 Jan 2011, 08:02 PM


'নোনা পানির আহাজারি' বা 'Salt Water Tears' প্রদর্শনীতে সাতক্ষীরার মানুষ

ষষ্ঠ ছবিমেলায় মুনেম ওয়াসিফের ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী 'নোনা পানির আহাজারি' বা 'Salt Water tears' চলবে ০৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। শুরু হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি। ঢাকার দৃক-এ 'মুক্ত হাওয়া প্রদর্শনী (Open Air Exhibition)' চলছে। প্রদর্শনীর মুখবন্ধ হিসেবে বাংলা টেক্সট লিখেছেন পাভেল পার্থ। সেটি ইংরেজি অনুবাদ করেছেন নাঈম মোহাইমেন। সাতক্ষীরা জেলায় মুনেম ওয়াসিফের ফটোগ্রাফি কর্ম নিয়ে এই প্রদর্শনী। চিংড়ী চাষের কারণে সাতক্ষীরা জেলার পানি লবণাক্ত হয়ে পড়া এবং খাবার পানির সংকট সম্পর্কে আমাদের সুলভ বোধগম্যতা দেয় এই প্রদর্শনী। পানির লবণাক্ততার কারণে এই জেলার মানুষের শরীর ও জীবন কতটা ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত তা দেখে দর্শকের হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে। সাতক্ষীরার মানুষের জীবনসত্য আমাদের অন্তরে গেঁথে দেয় এই ছবিগুলো। ডকুমেন্টারির দায়িত্ব হিসেবে বিশ্বাস উৎপাদন করতে পেরেছে এই ছবিগুলি। এই বিশ্বাসের গাঁথুনি শক্তিশালী; সাতক্ষীরার মানুষের সুখী হাসি আমাদের আর বিশ্বাস হবে না, অথবা আমাদের সন্দেহ হতে থাকবে সেই হাসিকে।


দৃক-এ মুক্ত হাওয়া প্রদর্শনী 'নোনা পানির আহাজারি'

শিল্পকর্মের নাম হিসেবে 'Salt Water tears' সীমানা উত্তীর্ণ। মুনেম ওয়াসিফের দু'টি কাজ এই নামে আছে। ২০০৮ সালে প্রিক্স পিকটেট (Prix Pictet) মুনেম ওয়াসিফকে তাদের হ্রস্বতালিকায় (Shortlist) স্থান দেয়। পানি সম্পর্কিত কোনো প্রকল্প ধারণ (record) করতে হ্রস্বতালিকার একজন শিল্পীকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এই প্রকল্পে শিল্পী হিসাবে প্রিক্স পিকটেট মুনেম ওয়াসিফকে নির্বাচন করে। প্রিক্স পিকটেট ইউকে ভিত্তিক সেবক (এটি উন্নয়নশীল বিশ্বের পানি নিয়ে চিন্তা করে ও পানিসেবা দিয়ে থাকে) সংগঠন WaterAid-এর সাথে যৌথভাবে ওয়াসিফের মাধ্যমে এই কর্ম সম্পাদন করে। এ সম্পর্কিত তথ্যের জন্য দেখতে পারেন: http://www.prixpictet.com/exhibitions/water/munem_wasif_salt_water_tears_lives_left_behind_in_satkhira_bangladesh/। এই নিযুক্তির ফলাফল হিসেবে http://www.lensculture.com/wasif_ss.html ঠিকানায় ২৬ টি ফটোগ্রাফের একটি স্লাইড শো বা প্রদর্শনী পাওয়া যায়। প্রকল্পের ফটোগ্রাফগুলি নিয়ে লন্ডনের মল গ্যালারিতে (Mall Galleries, London) ২০০৯ সালের মার্চে 'Salt Water Tears: Lives Left Behind in Satkhira, Bangladesh' নামে একটি প্রদর্শনী ঘটে। ওদিকে http://www.amazon.com/-এ Brian A. Hopkins রচিত কিছু গল্প নিয়ে 'Salt Water Tears' নামে একটি পেপারব্যাক বই কিনতে পাওয়া যায়। ব্র্যায়ান এ. হপকিন্সের বইয়ের সাথে মুনেম ওয়াসিফের ফটোগ্রাফির কোনো সম্পর্ক সম্ভবতঃ নেই, আর দৃকের 'মুক্ত হাওয়া প্রদর্শনী'র সাথেও প্রিক্স পিকটেট-ওয়াটারএইড প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে ছবিমেলায় চলমান ওয়াসিফের প্রদর্শনীর পাভেল পার্থ লিখিত ভূমিকা বা মুখবন্ধে কিছু বলা নেই।


'নোনা পানির আহাজারি' প্রদর্শনীতে মুনেম ওয়াসিফের প্রোফাইল

মুনেম ওয়াসিফের পরিচিতিতে লেখা আছে—বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পানি সমস্যা নিয়ে কাজের কারণে প্রিক্স পিকটেট কমিশন তাঁকে পুরস্কৃত করে ২০০৯ সালে। অর্থাৎ প্রিক্স পিকটেট দ্বারা নিয়োজিত হয়ে তিনি কাজটি করেননি, কাজটি পুরস্কারের পূর্ববর্তী। দুটি প্রদর্শনীরই ফটোগ্রাফির মাঠ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল—সাতক্ষীরা জেলা। এবং প্রিক্স পিকটেট-ওয়াটারএইড প্রদর্শনী ও ছবিমেলায় দৃকের প্রদর্শনীর মাঝে বেশ কিছু সাধারণ ছবি আছে, কিছু ছবি উভয় প্রদর্শনীতে জায়গা দিয়েছেন মুনেম ওয়াসিফ।


নোনা পানির আহাজারি প্রদর্শনীতে চিংড়ীর ছবি

দৃকের প্রদর্শনীতে মুনেম ওয়াসিফ যে সাতক্ষীরাকে পরিবেশন করেছেন সেই সাতক্ষীরা চিংড়ী চাষের কারণে লবণাক্ত হয়ে পড়া পানিতে বিপর্যস্ত সাতক্ষীরা। মাটি চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ধান উৎপাদন হয় না। ঘাস মরে গেছে, গরু-ছাগলের খাবারও জন্মায় না। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মানুষেরা বিকল্প জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সুন্দরবনের নিধন চলছে। এক বিপর্যয় নিয়ে এসেছে আরেক বিপর্যয়। খাবার পানি পাওয়া যায় না। খাবার ও পানির অভাবে মানুষেরা অপুষ্ট, বাচ্চার জন্য পুষ্টি নাই, বৃদ্ধগণ অনাহারে, রুগ্ন। নোনা পানিতে, অপুষ্ট শরীরে ভালবাসা তবু জন্মায় বলে ভালবাসা আছে; অন্তত এইভাবে যতদিন বাঁচা যায়। মানুষের যে পরিস্থিতি আমরা চাই না, সে পরিস্থতি নিয়ে আগত দর্শকদের মনে আগে আবছা কোনো ধারণা থেকে থাকতে পারে। প্রদর্শনী দেখবার পরে সেটি আর আবছা থাকে না, মুনেম ওয়াসিফের ফটোগ্রাফ মানুষের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দশার ছবি। মানুষের দিকে তাকিয়ে আমরা যা দেখি না, অথচ যেগুলি দেখবার জন্যই তাকাই, আমাদের সেই 'অপটিক্যাল আনকনসাস্' মুনেম ওয়াসিফের ফটোগ্রাফ। সাতক্ষীরার যে মরা ঘাস, কাটা গাছের গোড়া, শুকনা-ফাটা মাটি, রুগ্ন এই মানুষগুলি, নোনা পানি আমাদের মনে ছিন্ন দৃশ্যমাত্র হয়ে আছে, ওয়াসিফের ছবি সেগুলিকে জোড়া লাগাইয়া দেয়—কার্যকারণসহ। ফলে এটি সাতক্ষীরা নয়, সাতক্ষীরার ব্যাখ্যা। ছবিগুলি তৎপর ও সরব, চিৎকার করছে। চিৎকার করার জন্য প্রয়োজনীয় যে জোর ঐ রুগ্ন-ভাঙা মানুষগুলির শরীরে নাই, সেই জোর মানুষগুলির ছবিরা পেয়েছে ওয়াসিফের কাছ থেকে।


'নোনা পানির আহাজারি' প্রদর্শনীর সাতক্ষীরা

এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে ওয়াসিফ বস্ত(সাতক্ষীরা)নিষ্ঠ জ্ঞান পুরুৎপাদন করলেন। পুনরুৎপাদন, কেননা পরিবেশ নিয়ে ওয়াসিফের এই সাতক্ষীরা ব্যাখ্যায় অভিনব বেশি কিছু নেই। চিংড়ী চাষ 'উন্নয়ন' ছিল, পরিবেশ এখন 'টেকসই উন্নয়ন'। উন্নয়নশীল বিশ্বে আগে 'উন্নয়ন' আর সম্প্রতি 'টেকসই উন্নয়ন' ঘটাবার তহবিল ছিল-আছে 'উন্নত' বিশ্বের। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশেও 'উন্নয়ন' আর 'টেকসই উন্নয়ন'-এর গ্রাহক ও এজেন্ট ছিল-আছে। বিষয়টা এত সরল নয় যে এতে করে উন্নত বিশ্বের লাভ আর বাংলাদেশের ক্ষতি। ধ্রুপদী অর্থনীতিতে 'উভয় পক্ষের লাভ' বলে একটা বিষয় আছে। তেমনটাও হতে পারে।


সাতক্ষীরার মানুষ

মুনেম ওয়াসিফের লাভালাভ অনালোচ্য রেখে ধরা যাক, সাতক্ষীরাবাসী খাবার পানি পেয়ে গেল, মাটি ধুয়ে লবণাক্ততা অপসারণ করা হলো। ঘাস, ধানের চাষ হইতেছে, গরুর দুধ লবণাক্ত হবার উপায় নাই আর; ফলে বাংলাদেশের লাভ। অন্যদিকে, সাতক্ষীরার দুর্দশার জন্য সাতক্ষীরার বা বেশির পক্ষে বাংলাদেশের মানুষের কর্মকে দায়ী করলেন ওয়াসিফ, তাঁর ফটোগ্রাফের মাধ্যমে। কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয় তো দেশের টেরিটরি মেনে হয় না। শিল্পোন্নত, অস্ত্র উৎপাদক, যুদ্ধবাজ দেশগুলির ভোগ, উৎপাদন, পারমাণবিক বা রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষা, টন-টন বোমা ফেলায় পৃথিবীর পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটে তার সাথে চিংড়ীর তুলনা করতে দেয় না ওয়াসিফের কাজ। পৃথিবীকে নাজুক করে তুলছে উন্নত বিশ্ব, অথচ তারাই উন্নয়নশীল বিশ্বে 'টেকসই উন্নয়ন' ঘটাইতে অর্থ খরচ করে। সাতক্ষীরার মানুষকে বহন করতে হয় বৃটেনের দায়। এখানেই উন্নত বিশ্বের লাভ। উন্নত বিশ্ব পৃথিবীর জন্য হুমকি, কিন্তু তারা তাদের অর্থ দিয়ে অপরাধী প্রমাণ করে দেয় সাতক্ষীরাকে। সাতক্ষীরাবাসী পানি সেবা পাবার কৃতজ্ঞতায় প্রশ্ন করতে ভুলে যায়—'উন্নত বিশ্বের বাড়তি জমি কেন তাদের নয়?'

আর্টস প্রোফাইল: এস এম রেজাউল করিম
ইমেইল: rezaulkarim.manu@gmail.com

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts