জীবনানন্দ: ভাবসাগরে নিমজ্জমান অনন্তের মানবপাখি

ধ্রুব সাদিকধ্রুব সাদিক
Published : 17 Feb 2022, 06:00 AM
Updated : 17 Feb 2022, 06:00 AM


মাতৃসমা পৃথিবীর তৎকালীন বাংলা জনপদটির বরিশাল নামক স্থানে আজ থেকে ১২৩ বছর পূর্বে মিলু নামের একটি প্রাণ মানবজন্ম লাভ করেছিলো। পরবর্তীতে, ভাবসাগরে নিমজ্জমান অনন্তের মানবপাখি মিলু বাংলা ভাষাভাষী তো বটেই, দুনিয়ার কবিতার পাঠকদের কাছে পরিচিত লাভ করেন কবি হিসেবে। কবিত্ব তাঁর এতটাই প্রগাঢ় আর শক্তিশালী, যে, বলতে যার কারণে দ্বিধা কাজ করে না, পৃথিবীতে তিনি এসেছেন যেন পৃথিবীর সমান আয়ু নিয়ে। বয়স তাঁর বাড়ে কিংবা কমে না। তাঁর বয়স যা ছিলো তাই যেন আছে। জীবনানন্দ দাশ কবিতার নিবিড় পাঠকদের কাছে স্রেফ একটি নাম।

মনে অবশ্য ইচ্ছে জাগ্রত হলো পাঠকদের প্রতি একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিতে মূলত বিস্ময় এবং প্রশ্ন একইসঙ্গে কাজ করায়: বরিশাল অঞ্চলটি কি করুন সুন্দর; নাকি সুন্দর এবং করুন; নাকি জীবনানন্দ তাঁর করুন-সুন্দর অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়ে অনুভব করে অনুধাবন করার পর মগজচোখে ছুঁয়েছিলেন বরিশাল?

সে যাই হোক। জীবনানন্দকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের অবশ্যই ধারণা থাকা জরুরি, যে, ভাবের উদয় হয় না; মানুষের মধ্যে নিহিত থাকা ভাব মূলত জাগ্রত হয়। মানুষের মধ্যে গভীর ভাব জাগ্রত হলে সহস্র মানুষের মাঝে থেকেও মানুষ দুনিয়ার সমস্তকিছু ভুলে গিয়ে ভাবসাগরে নিমজ্জমান থাকেন। অথবা, কেউ কেউ ক্ষণিকের তরে নিমজ্জিত হয়ে যান। প্রশ্ন আসতে পারে, জীবনানন্দ আসলে ভাবসাগরে নিমজ্জিত হওয়া কবি নাকি ভাবসাগরে তিনি নিমজ্জমান অবস্থায় ছিলেন। এই প্রেক্ষিতে বলতে হয়, জীবনানন্দ এমন একজন কবি যিনি নিমজ্জিত হয়ে যেতেন না, তিনি থাকতেন ভাবসাগরে নিমজ্জমান; আর এই নিমজ্জমানতা থেকেই উঠে এসেছে তাঁর কবিতার অনেকানেক পঙতি।

'স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বলো তো' উচ্চারণ যিনি করেন, ভাবসাগরের নিমজ্জমানতা তো কায়মনোবাক্যে তিনিই কামনা করতে পারেন। জীবনানন্দ দাশ কায়মনোবাক্যে ভাবসাগরের অতলেই শুধু জেগে থাকতেন তাই নয়, তাঁর কবিতা গভীর অভিনিবিষ্ট মনে পাঠ করলে অনুভব করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না, তিনি দিনযাপন মূলত ভাবের সাথেই করতেন। তাঁর ধূসর পান্ডুলিপি'র ভাবের সাগর সেঁচে কয়েকটি পঙক্তি পাঠ করা যাক:

"শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে
বলিলাম: 'একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!–
পঁচিশ বছর পরে!'"
[পঁচিশ বছর পরে ]

কবি এরপর বলেন, 'এই ব'লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;/ তারপর, কতবার চাঁদ আর তারা,/
মাঠে- মাঠে মরে গেল, ইঁদুর – পেঁচারা / জ্যোৎস্নায় ধানক্ষেত খুঁজে/ এল-গেল!– চোখ বুজে/ কতবার ডানে আর বাঁয়ে/ পড়িল ঘুমায়ে /কত- কেউ!'। এইসব ভাব ভাবের কতটা অতলে নিমজ্জমান কবির ভাবনা আমরা শুধু অনুধাবন করতে পারি। অথচ, কবি দুনিয়ার সমস্ত পার্থিব লোভ-ভোগ-লালসাকে পরাভূত করে ছিলেন এই অবস্থায় দণ্ডায়মান। একা যেন জেগে থাকতেন কবি, যেমন একা নক্ষত্র বেগে ছোটে আকাশে। এইক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসতে পারে, আসলে কার পানে ছোটেন তিনি? মূলত অন্তঃস্থিত সত্তায় যে ভাব জাগ্রত হয়, সেই ভাবের দিকে ছুটতে ছুটতে বহুদূর ছুটে তারপর স্থবির হয়ে অন্তরালের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে তিনি মেতে উঠতেন। আর তারপর হৃদয়ের নৃত্যরতধ্বনি থেকে উঠে এসেছে তাঁর প্রেম কবিতাটি। কবি উল্লেখ করেছেন:

'কারণ , যোদ্ধার মতো – আর সেনাপতির মতন
জীবন যদিও চলে,- কোলাহল ক'রে চলে মন
যদিও সিন্ধুর মতো দল বেঁধে জীবনের সাথে,
সবুজ বনের মতো উত্তরের বাতাসের হাতে
যদিও বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন
একবার-দুইবার- জীবনের অধীর আঘাতে,–
তবু- প্রেম- তবু তারে ছিঁড়ফেড়ে গিয়েছে কখন!
তেমন ছিঁড়িতে পারে প্রেম শুধু !- অঘ্রাণের রাতে
হাওয়া এসে যেমন পাতার বুক চ'লে গেছে ছিঁড়ে!
পাতার মতন ক'রে ছিঁড়ে গেছে যেমন পাখিরে!'

পৃথিবীর গহ্বরের মতো, পাণ্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত ভাবসায়রে ঘুমিয়ে থাকা ধূসর পান্ডুলিপির কবি তাঁর এই কবিতাগ্রন্থটির প্রেম কবিতাটিতে আমাদের ঠিকই অনুধাবন করিয়ে দেন কতটা ছিলেন তিনি গভীর প্রেমিক। পাহাড় নদীর পারে তাঁর প্রিয় অন্ধকারের ভাবসাগরেই তিনি হয়েছেন বারবার আহত। গভীর প্রেমিক ছিলেন বলেই হয়তো জীবনানন্দ'র প্রেমে ছিলো সংশয়। একবার নক্ষত্রের পানে তো আরেকবার বেদনার পানে চেয়ে কিংবা চুমু খেয়ে তিনি লিখেন:

'একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে
অনেক কবিতা লিখে চলে গেলো যুবকের দল;
পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে
শুনিল আধেক কথা – এই সব বধির নিশ্চল
সোনার পিত্তল মূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরি কানে
অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল:
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে।'

গভীর প্রেমিক হলেওপ্রেমে মিলিত যে হতে হবে এমন নয় এবং ছিলো মিলিত প্রেমেও তাঁর প্রবল মমতা। এইসব কিছু তিনি বুঝিয়ে দেন তাঁর রচিত পঙক্তি দ্বারা, 'যদিও বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন/ একবার-দুইবার জীবনের অধীর আঘাতে,-/ তবু- প্রেম- তবু তারে ছিঁড়ফেড়ে গিয়েছে কখন!' এছাড়া, তাঁর প্রবল ভাবসত্তাটিকে আমাদেরকে তিনি অনুধাবন করিয়ে দেন সাম্রাজ্য, রাজ্য, সিংহাসন প্রভৃতি পার্থিব বিষয় ও বস্তুর সাথে মৃত্যুর তুলনা করার মাধ্যমে। তিনি জ্ঞান করেন এইসব পার্থিব ব্যাপার খুবই খেলো; মৃত্যুর শান্তির মতো নয়!

'তবু পাতা – তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে,
বনের শাখার মতো – শাখার পাখির মতো হয়ে
হিমের হাওয়ার হাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে
বিদীর্ণ শাখার শব্দে – অসুস্থ ডানার কোলাহলে ,
ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে,
আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে
আমাদের এ জীবন ! – জীবনের বিহ্বলতা সয়ে
আমাদের দিন চলে,- আমদের রাত্রি তবু চলে;
তার ছিঁড়ে গেছে ,- তবু তাহারে বীণার মতো ক'রে
বাজাই ,- যে প্রেম চলিয়া গেছে তারি হাত ধ'রে'

বাংলার ক্ষেত-মাঠ-জল-জলাঙ্গী-নদী প্রভৃতি তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। ভালোবেসেছেন বাংলার শঠিবন, লক্ষ্মীপেঁচা, সুমহান আম্রবৃক্ষ, কাঁঠালগাছ আর অশ্বত্থের ডালপালা। সহস্রাব্দ প্রাচীন উপলব্ধি আর ভাবের ভারে ন্যুব্জ জীবনানন্দ বাংলার পথ-ঘাট-বাট হেঁটে হেঁটে পরিব্রাজক জীবনই শুধু যাপন করেননি, তিনি উপলব্ধি করেছেন আকাশের পউষ-নীরবতা, রাত্রির নির্জনযাত্রীর যাত্রা। তাঁর বরিশাল দিয়েওছিলো তাঁকে পৃথিবীকে দুচোখ ভরে অনুভবে দেখার অনন্য সে মগজ-চোখ, বোধ, আর কবিতা লেখার অনন্যসাধারণ সব উপাদান। যেভাবে শিশির পতনের শব্দের মতন সন্ধ্যা অনুভব করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই যেন উদ্বেলিত হয়ে পড়তেন রাতের নিস্তব্ধতার লিমেরিক কানপেতে শুনে। আর আচমকা একটি চিল, একটি গাঙচিল, গোধূলির নদীর আকাশে গাঙচিলের ওড়াউড়ি দেখে হৃদয়ে পেতেন অপার্থিব আনন্দ! পৃথিবীর দুঃখীতম আত্মার মানুষগুলো বোধকরি কমলালেবুর ঘ্রানে আনন্দ লাভ করে থাকেন। জীবনানন্দ কমলেলেবু হতে চেয়েছিলেন। আমরা তাঁর ভাবের কমলার খোঁজ পাই নগ্ন নির্জন হাত কবিতাটিতে:

'অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল;
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।'

পৃথিবীর সকল বিম্ব-প্রতিবিম্বের ভারে ভারাক্রান্ত মানুষের প্রিয় কবিকে আরেক করুন এবং সুন্দর কবি বিনয় মজুমদার তাঁর ফিরে এসো চাকা'র ৩৬ নম্বর কবিতাটি লিখেছিলেন প্রিয় কবির জন্ম উপলক্ষে:

"ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিলো, 'এই জন্মদিন'।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল বলে ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।"