Published : 07 Mar 2022, 10:12 PM
সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর বহুবিধ রচনার মহোত্তম সৃষ্টিগুলোর একটি 'শুদ্ধতম কবি'-তে জীবনানন্দ দাশকে বলেছেন 'চিত্রকল্পের কবি'। জীবনানন্দ দাশ নিজেও বিশ্বাস করতেন চিত্রকল্পই হচ্ছে কবিতা। এই চিত্রকল্প আবার কবির চেতনা থেকে উৎসারিত। ফলে প্রকৃতি ও নগর-চেতনা এবং আধুনিক ও পরাবাস্তব কবিতা কিংবা নিখাদ পল্লী জীবনালেখ্যেও কিছু প্রচল উপকরণ বাদ দিলে অভিন্ন চিত্রকল্প ধারনের কোনো সুযোগ নেই। এই প্রচল উপকরণগুলো হচ্ছে নদী, সমুদ্র, বন, বৃক্ষ, সাগর, পাখি, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র, ফুল ও ফল প্রভৃতি। কবি এসব উপকরণ যেকোনো বাস্তবতার ও চিন্তার অবস্থান থেকে গ্রহণ করতে পারেন। এজন্য তাঁকে বিশেষ অভিধায় বসানো যায় না। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কথা উঠলেই বিদগ্ধ পাঠক একবাক্যে বলে উঠবেন : তিনি প্রকৃতির কবি। তাঁর কবিতার চরণে চরণে প্রকৃতির নানারূপ বৈচিত্র্য এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে যে, আর কোনো কবির কবিতায় তা অতখানি দেখা যায় না, যেন প্রকৃতিকে দেখতে হলে দরকার একজন জীবনানন্দের অন্তর্লোক। জীবনের বহুবিধ বাস্তবতাকে দেখিয়েছেন তিনি এই প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপকল্পের ভেতর, ধারন করেছেন প্রকৃতির স্থিরচিত্রের অনুষঙ্গে বিদ্য ও বিরাজমান নানা প্রজাতির
'কাফেলা থেকে হারিয়ে যাওয়া উট' চিত্রকল্পটি তাঁর কবিতায় পরাবাস্তবতার রূপটিকেই চিহ্নিত করে। কিন্তু তিনি যেহেতু প্রকৃতি নিবিষ্ট কবি তাই তাঁকে শ্বাশত বাস্তবতার কবি বলাই সঙ্গত। সেভাবে পল্লী জীবনালেখ্যকে নিপুণভাবে উপস্থাপনের জন্য জসীমউদ্দীন কিন্তু পল্লী কবি হিসেবেই সুখ্যাত। আমাদের কাব্যধারার মূলস্রোতটি মূলত সেখান থেকেই উৎসারিত, যে স্রোতটি চর্যাপদ ও মধ্যযুগীয় কবিদের হাত ঘুরে অনুপমভাবে ধরা দিয়েছিল কবি জসীমউদ্দীনের হাতে। কবি আল মাহমুদ সেই স্রোতেই অবগাহন করে আধুনিক মনোজগৎ তৈরি করেছেন। অন্যদিকে আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমান যুগপৎ নগর ও গ্রামকে উপজীব্য করে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর আধুনিক কাব্যজগৎ। কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা দেয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্বটিও তিনিই পালন করেছেন। তিনি ছিলেন কবিতার এক মুক্তমঞ্চ, স্বাধিকার থেকে মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। সেজন্য তাঁকে স্বাধীনতার কবি-ও বলা হয়ে থাকে। আসাদের শার্ট, স্বাধীনতা তুমি, প্রভৃতি কবিতার ঐতিহাসিক মূল্য কোনোদিনই ফুরিয়ে যাবার নয়। এসব কবিতা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছেন কালের চূড়ায়। সেক্ষেত্রে একেবারে ভিন্ন স্বর ও চিন্তার এবং স্বপ্ন ও কল্পনা জগতের বাসিন্দা আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার খেতাবটি হচ্ছে তিনি 'পরাবাস্তব কবি'। এ দেশের কবিতায় একমাত্র তিনিই এই পরাবাস্তবচেতনার সার্থক রূপকার। তাঁর কবিতার চিত্রকল্প তাই যেমন নান্দনিকতায় তেমনি অভিনবত্বে ভরপুর। অন্যদিকে এখনো পর্যন্ত নাগরিক কবির মুকুটটি শহীদ কাদরীর-ই দখলে। ফলে কবিতার চিত্রকল্পে উপমায় তিনি আপাদমস্তক নগরকেন্দ্রিক। নগর ছাড়িয়ে অন্যত্র ভ্রমণ করেননি তেমন। কিছু কবিতায় নগরের সঙ্গে গ্রামের অনুষঙ্গ আনলেও তা যুগপৎ সার্থক বলা যাবে না। মনে হবে তা আরোপিত। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে ষাটের দশকে এসে বাংলা কবিতার নতুন বাঁক নেয়া ও নবপলি সঞ্চারের পেছনে মূল ভূমিকা ছিল যাদের আবদুল মান্নান সৈয়দ ও শহীদ কাদরী তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এ দু'জনেরই কাব্যচিন্তা ও নান্দানিক সত্তার মধ্যে একটি সাঁকো বেঁধে দিয়েছেন সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবিদ আজাদ। তবে এ দু'জনের কাব্যসত্তার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এলেও আবহমান বাংলা কবিতার শোভাযাত্রায় নিজের শক্তি ও স্বকীয়তায় একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন তিনি, যা-ছিল তাঁর সমসাময়িক এমনকি অগ্রজদের কাছেও ঈর্ষণীয়। আবিদ তৈরি করতে পেরেছিলেন তাঁর নিজস্ব একটি কাব্যভাষা ও কণ্ঠস্বর, নিসর্গ ও নষ্টালজিকতার ভেতর দিয়ে সেই কণ্ঠস্বর বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তাঁর কবিতার মধ্যে যেমন আছে সেই ভাষার আর্দ্র সম্মোহন তেমনি পরিপাটি এক লীলাচিত্র যা ধারন করে আছে বহুবর্ণিল এক আত্মা।
ফলে বলাবাহুল্য আবিদ আজাদের কবিতার বড় অস্ত্র চিত্রকল্প। সেই চিত্রকল্প এতই সাবলীল ও নিজস্ব যে তাঁর কবিতা অন্যদের চেয়ে সহজেই তাঁকে আলাদা একটি আসনে বসিয়ে দেয়। আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্যচেতনায় অনুপ্রাণিত হলেও বিষয়ে ও বাকপ্রতিমায় আবিদ আজাদের কবিতার জগতে ষাটের দশকের সুদূরপ্রভাবী ও আজও অবধি তারুণ্যের আইডল আবুল হাসানের প্রভাব অনেকখানি লক্ষণীয়।
তারপরও এই আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান ও শহীদ কাদরীর কাব্যসরনি থেকে তৃতীয় একটি পথের দিকে ছুটে গেছেন তিনি। সেখানে যেমন আছে তার প্রিয় মফস্বলের আবছায়া এক স্মৃতির নষ্টালজিয়া তেমনি নিত্য বহমান বাস্তবতার ভেতর আধুনিক মননের বিচিত্র খানাখন্দ। তিনি সেখানে নিত্য খুঁজে বেড়িয়েছেন পাওয়া না পাওয়ার এক সাংঘর্ষিক বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথ। সে অর্থে ত্রিশের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো তাঁরও কবিতার এলাকা জুড়ে ছিল মৃত্যুচিন্তা ও নৈরাশ্যবাদ। ফলে কাব্যযাত্রার শুরুতেই তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে এমন আর্তি!
বুক থেকে অবিস্মরণীয় মৌনতার লতাতন্তু
ঝরাতে ঝরাতে চলে গেছো তুমি।
আমি পড়ে আছি অপাঙ্গেবিদীর্ণ হতশ্রী বাড়ির মতো একা
আকণ্ঠবিরহী এই একা আমি
শুভ্র নির্জনতাধৌত পথের রেখার পাশে পড়ে আছি অনুজ্জ্বল
আরেকটি ম্লান রেখা শুধু
(আজো তুমি/ ঘাসের ঘটনা)
কিংবা
আমাকে পাবে না। পাবে শুধু অচল দিবাবসান
অনুক্ষণ মরীচিকা পোড়া দিগন্তের ভান
বিসর্পিল শুষ্ক জিহবা ঝরে যাবে তোমার পথের
পিপাসার্ত নদী তোমাকে দেখিয়ে দেবে ভুলপথ
হরিণশিঙের মতো মুমূর্ষু আকাশ চিরে চিরে
এঁকে বেঁকে উঠে যাবে তোমার জীবন
তবু তুমি আমাকে পাবে না।
(আর্তি/ ঘাসের ঘটনা)
এমন অনিশ্চয়তা ও গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার যাত্রা শুরু হলেও তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বহুদূর এবং নিজেকে ক্রমশ ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কবিতা বাংলা কবিতার মহাসড়কে ঠাঁই করে নিয়েছিল আপন অধিষ্ঠান। একমাত্র তাঁর মৃত্যুই সে পথে টেনে দিল সীমানা। বেঁচে থাকলে তাঁর হাতেই বাংলা কবিতা নতুন নতুন বিষয় ও পথের ঠিকানা দিত আমাদের।
তারপরও বলবো, মৃত্যুর জন্য হয়তো তিনি প্রস্তুতই ছিলেন, যেহেতু চিরসঙ্গী হুপিং কাশি। কিন্তু মৃত্যুই শেষ কথা নয়। সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু নেই। সৃষ্টির ভেতর সে চির অমলিন। মৃত্যুর আঁচ পেয়ে তাই আরও ঝকঝক করে উঠেছে তাঁর কবিতার আকাশ। নইলে হাসপাতালে বসে অসুখকে জিরোতে দিয়ে কেন লিখবেন গভীর উপলব্ধির এমন ঝরঝরে সুন্দর কবিতা:
মৃত্যুর হাতকে আজ পরিচ্ছন্ন মনে হলো খুব
জীবন, প্রতিষ্ঠা, গ্লানি সব তার হাতের মুঠোয় লুকালো–
কৃতি, খ্যাতি, সম্ভাবনা, পুরস্কার সব আজ চুপ
তিনপুত্র বাবার শরীরে নুয়ে কাফন পরালো।
এই সাদা জামা এই স্কুল ড্রেস গায়ে পরে কবিতার খাতা ফেলে ভুলে
আব্বু তুমি যাচ্ছ আজ স্বচ্ছ কোন নতুন ইস্কুলে?
মৃত্যুর লগ্ন থেকে এমন সুন্দর কবিতা লেখা আমাদের তেমন চোখে পড়ে না। যদিও জীবনে অনেক সুন্দর কবিতাই লিখেছেন। সেসব কবিতা শুধু মুগ্ধতাই ছড়ায়নি, পাঠক হৃদয়ও দখল করে আছে। কারণ তিনি ছিলেন দুর্দান্ত এক রোমান্টিক ও সংবেদনশীল কবি। সত্তরের কবিতা নানাদিকে বাঁক নিলেও সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার প্রতিই ছিলেন তিনি প্রতিশ্রুতিশীল। তারমধ্যেই আটকে ছিল তাঁর কবিতার প্রাণ-ভোমরা। মৃত্যুর চিরন্তন উপলব্ধিতেও তিনি অবিচল উচ্চারণ করেন এমন ঝরঝরে পঙ্ক্তি:
স্পষ্ট হচ্ছে শুধু ফিরে যাওয়ার রাস্তা
চশমার কাঁচ মুছতে আর ভাল্লাগেনা আমার (স্পষ্ট হচ্ছে)
এমনকি মরণোত্তর দৃশ্যপট যখন আঁকেন তিনি তখন আরও অবাক হতে হয়। যেমন,
আমি আমার কবরের মাটি খোঁড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি
আমি আমার কবরে বিছিয়ে দেয়ার বাঁশ কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি
আমি আমার কবরে বিছিয়ে দেয়ার জন্য পাটি বোনার শব্দ শুনতে পাচ্ছি
আমি আমার মৃতদেহে পরিয়ে দেয়ার জন্য আনা কাফনের সাদা ভাঁজ খোলার
শব্দ শুনতে পাচ্ছি
আমি আমার মৃতদেহের পাশে বসে গুণগুণ করে পড়া কোরান তেলাওয়াতের
সুর শুনতে পাচ্ছি
আমি আমার জানাজায় শরিক হওয়ার জন্যে দলে দলে ছুটে আসা
দীর্ঘ বৃষ্টির, পড়ন্ত রৌদ্রের আর মেঘের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
চিত্রময়তায় তাঁর কবিতা যে ঝলমলে, মৃত্যুর নিদারুণ দৃশ্যকল্পেও তা অভাবনীয়। এমনই এক শক্তিমান ও সুন্দরের কবি ছিলেন আবিদ আজাদ।