ঢাকার উঁচু উঁচু ইমারত, জমকালো আলো আর গ্ল্যামারের নিচে আছে এক অন্ধকার বাস্তবতা যে-অন্ধকার বাস্তবতার মুখোমুখি নারীকে হতে হয় প্রতিনিয়ত। শুধু লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণেই পদে পদে নারীকে বৈষম্য ও ভায়োলেন্সের শিকার হতে হয়। এমনই বিষয় নিয়ে গত ১৯ ও ২০ আগস্ট গুলশান-১-এর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে হয়ে গেল 'বহ্নিশিখা-আনলার্ন জেন্ডার'র এক চমৎকার পরিবেশনা 'ইট'স এ শি থিং'। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নানা বয়সী নারীর না বলা অনেক গল্প উঠে এসেছে এই আয়োজনে।
অনুষ্ঠানের নামকরণ থেকেই বেরিয়ে এসেছে এর দর্শন। 'It's a SHE thing'। যার অর্থ হতে পারে, 'এটা সে কলাপ'। কিন্তু এই 'সে'টা এখানে বিশেষ অর্থবহ। ইংরেজিতে SHE শব্দটি নারী শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত সর্বনাম। কিন্তু কখনো কখনো এই 'সে' উচ্চারণের ভেতরে থাকে উপেক্ষা, অবদমন, অবমূল্যায়ন, অস্বীকার বা নাই করে দেয়ার প্রচেষ্টা। যে কারণে নারীর সব কিছুকে 'এটা সে কলাপ' বা 'মেয়েলি বিষয়' শব্দবর্গে মুড়ে দেয়া যায়। অনেক সময় তা অবাঞ্চিত, অনাহুত, নিষিদ্ধের মতো করে ছুড়ে ফেলা হয়। 'It's a SHE thing' অনুষ্ঠানটি সেই বিষয়-আশয়কে সামনে নিয়ে আসে নান্দনিক ব্যঞ্জনা ও বলিষ্ঠতায়। যা ধরা পরে অনুষ্ঠানের উপশিরোনামে 'A play about women and girls of Dhaka, Inspired by The Vagina Monologues'। এই উপশিরোনাম মনে করিয়ে দেয় নারী–যিনি বয়সে যুবতী–বিষয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের অবদমন। আধুনিক শহরে যা উবে যায়নি। আর তাই ইটের পাঁজর খুলে দেখার আয়োজন।
গত ১৯ ও ২০ আগস্ট দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রদর্শনী, প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ম্যাজিশিয়ন ম্যাক্স মিস্টাল মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের। যদিও ম্যাক্স এদিন ম্যাজিক দেখাননি। করেছেন কমেডি। হাস্যরসে মুগ্ধ করে রাখেন দর্শকদেরকে। ম্যাক্সের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের আলো নিভে যায়। পুনরায় আলোর আবির্ভাবের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় ইট'স এ শি থিং।
প্রথাগত অর্থে নাটক নয়, বিভিন্ন রকমের মনোলগের সমাহার। মনোলগগুলোতে চাকরিজীবী, শ্রমিক, যৌণকর্মী, গৃহিনী, ছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ও বয়সের নারীর না-বলা কথাগুলো উঠে এসেছে। মূলত ইভ এন্সলারের বিখ্যাত নাটক 'ভ্যাজাইনা মনোলগজ'-এর অনুসরণে বাংলাদেশি প্রেক্ষিত মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে 'ইট'স এ শি থিং'। শহরে নারীরা প্রচলিত যে ট্যাবুর মুখোমুখি হয়, যেমন 'ladies don't behave like that', 'women are meant to raise families' এবং 'make sure you don't earn more money than your husband'.
এই পরিবেশনাগুলোতে কীভাবে নারীর পোশাক, চলাফেরার ধরণ, সাজগোজ বিষয়ে বিধিনিষেধ, ট্যাবু ইত্যাদি সমাজে বৈষম্য টিকিয়ে রাখে তা নিয়ে এপিসোডিক পরিবেশনা ছিল। চমৎকার পরিবেশনা ছিল ওড়না নিয়ে। নারীবাদ নিয়ে জনমনে ভুল ধারণা বিষয়ে সচেতনতা আনতে ছিল একটি এপিসোড। কীভাবে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সম্মতি আদায়ে জোরজবরদস্তি চলে, তুলে ধরা হয়েছে সেসবও।
মেন্সট্রুয়েশনের কথা গোপন রাখা কিংবা শরীর খারাপ বলা ইত্যাদি প্রথা, মাতৃত্বকালীন জটিলতা, নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক ভায়োলেন্স ইত্যাদি উঠে এসেছে মনোলডগুলোতে।
শুধু মাত্র নাট্যপরিবেশনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি সন্ধ্যা। চমৎকার এপিসোডিক পরিবেশনা একই সাথে দর্শকশ্রোতাদের বিনোদিত করার পাশাপাশি সচেতনও করেছে। মনোলগগুলোর ফাঁকে ফাঁকে জনসচেতনতামূলক ছোট ছোট ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়েছে। যেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল, মাদ্রাসায় মেয়েদের জীবন, যৌণকর্মীদের জীবন, সার্ভিক্যাল ক্যানসার, যৌনশিক্ষার অভাব ইত্যাদি। টানা দুই ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপস্থিত দর্শকশ্রোতারা উপভোগ করেছে অনুষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল নারীবাদী সংগঠন 'বহ্নিশিখা' যা আগে 'ভি-ডে ঢাকা' নামে পরিচিত ছিল। লৈঙ্গিক কারণে বৈষম্যের শিকার বা পিছিয়ে পড়া কিংবা সংগ্রামরত নারীদের তুলে ধরে, এবং মানুষ হিসেবে বিকশিত হবার সুযোগ যাতে পায় সেকারণে, সমস্ত নারীদের একত্র করা, নারীর বিভিন্ন সমস্যাও সচেতনতা গড়ে তুলতে কাজ করছে সংগঠনটি। দর্শকশ্রোতাদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রতিষ্ঠানটি। ভবিষ্যতে আরও ভাল ভালো কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
প্রথমদিনের পরিবেশনায় উপস্থাপনায় অভিনয় করেছেন আনিকা, চেনোয়া, মায়িশা, মিনাল, নমিরা, নওরিন, পরমা, সামারা, সারারাত। এর চিত্রনাট্য লিখেছেন, অদিতা, আমান্দা, আনিকা, ফাতিমাহ, ইফফাত, মায়িশা, মিথিলা, নমিরা, নাজিয়া, সাগুফে, সামারা, তাহমিনা, তাসাফি।
দুইদিনের স্পন্সর ও পার্টনার হিসেবে যুক্ত থেকেছে পুনার্ভা, ইমঢাকা.কম, লিপিংবাউন্ডারিস জাস্ট জুস, বিপ্রপার্টি, কোয়েসট ভিডিওস, সেকুরেক্স ইত্যাদি।