সালমা বাণীর প্রতিক্রিয়া: তিনি লিঙ্গ দোষে দুষ্ট এবং সনাতনী মানসিকতার রক্ষণশীল লেখক

সালমা বাণী
Published : 25 July 2017, 11:35 PM
Updated : 25 July 2017, 11:35 PM

দেবেশদার সাথে কথা বলে আজ আমি নিশ্চিত হয়েছি, তিনি কখনো হাসান আজিজুল হককে 'ইমিগ্রেশন' উপন্যাস নিয়ে আলোচনার অনুরোধ করেননি। দেবেশদা হোয়াটস এ্যাপ-এর মাধ্যমে আমাকে এসএসএম করে লিখেছেন- 'আমি ওনাকে তোমাকে নিয়ে কখনো লিখতে বলিনি। তুমি আমার স্নেহভাজন কী না এমন ব্যক্তিগত কথা বলার মতো সম্পর্ক ওনার সঙ্গে আমার কখনোই নয়। অত্যন্ত আপত্তিকর।'
এবং হাসান ভাই আপনি আমার কোন উপন্যাস নিয়ে আজ পর্যন্ত কোথাও কোন আলোচনা লেখেননি। অন্তত আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি। একজন অগ্রজ সাহিত্যিকের নিকট থেকে এই ধরনের ভুল মনগড়া মন্তব্য মূলত দুঃখজনক।
"তুমি মেয়ে, তোমার হাতে সেক্স অঙ্গের এমন খোলা বর্ণনা তুমি যে করছো, তুমি কি মনে কর, এতে তোমার সাহিত্যের কোন উন্নতি হচ্ছে?"
ওপরের এই উদ্ধৃতিটি আমার শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক-এর।
আমি সালমা বাণী একজন মেয়ে মানুষ, সেক্সের বর্ণনা এমন করে কেন দেবো? সাহিত্যে যদি সেক্সের বর্ণনা দিতে হয় সেটা দেবে পুরুষ লেখকেরা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ওটা তাদের জন্য নির্ধারিত, ওটাতে পুরুষ সাহিত্যিকদের অবাধ স্বাধীনতা ও অধিকার। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের রাজকুমার বলে খ্যাত আমাদের শ্রদ্ধার ও প্রিয় হাসান আজিজুল হক তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে এভাবে লিঙ্গ বিভাজন করেন? সাহিত্য রচয়িতা নারী না পুরুষ এই লিঙ্গ ভেদটা মনে হয় হাসান আজিজুল হকের নিকট একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার বক্তব্যে নারী সাহিত্যিক হলেও সে মেয়েমানুষ! সমাজের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীর যেমন কোনো অধিকার নেই তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই রকম বৈষম্যমূলক মনোভাব প্রকাশ করলেন গল্পকার হাসান আজিজুল হক। চরিত্রের প্রয়োজনে সেক্সের খোলা বর্ণনা দিতে হলে সে যে কোনো সাহিত্যিক নারী অথবা পুরুষ অথবা তৃতীয় লিঙ্গের হউন এটা তাঁরা সবাই সমমর্যাদায় সমঅধিকারের ভিত্তিতে করতে পারেন। এই ধরণের মুক্ত চিন্তা চেতনার মানুষ বলে আজ আর হাসান আজিজুল হককে মনে হলো না। যদিও আমরা অনুজরা হাসান ভাইকে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার, বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী লিঙ্গ ও শ্রেণীবৈষম্য-বিরোধী বলে অনুমান করতাম। হাসান ভাই নিজেই তার রক্ষণশীল বক্তব্যে প্রমাণ কর দিলেন তিনি আদতে তা নন, মানসিকভাবে রক্ষণশীল। যদিও 'সাবিত্রী উপাখ্যান'-এ ধর্ষণের বর্ণনা এসেছে অযাচিতভাবে।
কারণ একই সাক্ষাতকারে হাসান আজিজুল হক স্বীকোরোক্তি দিচ্ছেন –"সেক্সকেও ঠিক ওই ভাবে ব্যবহার করেছি| একটা চরিত্র আরম্ভ করার জন্যে যখন দরকার হয়েছে তখন খুব অশ্লীল কথাও ব্যবহার করেছি| 'পাতালে হাসপাতালে' প্রথম দিককার লেখা, ওখানে ব্যবহার করা আছে| রোগীরা গিয়ে চিৎকার করছে, সেখানেও নানা রকম অশ্লীল কথাবার্তা আছে| আমি যেগুলো ডিমান্ড করে, ওই পর্যন্তই| ওটা নিয়ে কচলা-কচলি কোনো ধরনের কিছু করি নি| সেক্সকেও ঠিক ওই ভাবে ব্যবহার করেছি|
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা : তো সেই প্রসঙ্গ ধরে এই প্রসঙ্গ তুলেছিলাম এই জন্য যে, দেখা যায় যে স্যার, সামাজিক ইস্যু, বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক বই লেখা হয়| সেইগুলোর ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যভাবে করেছেন, বা তাঁর ছোট্ট একটা উপন্যাস আছে ÔPZz‡®‹vbÕ নামে, যৌনতা নিয়ে চমৎকার বই, সেখানে সাহিত্যে যৌনতার বিষয়টি অনায়াসে বের করে এনেছেন| লেখকরা যখন কোনো বাস্তব ইস্যু তার বইয়ে বা ফিকশনে নিয়ে আসবেন সেক্ষেত্রে বাস্তবতার প্রজেনটেশনটা কি রকম হবে? সেটা নিশ্চয় প্রতিবেদন হবে না।

হাসান আজিজুল হক: না, নিশ্চয় প্রতিবেদন হবে না| তুমি নিজেই বুঝতে পারবে সবটা বলা হয়ে গেল| রাহেলা বলে যে মেয়েটি ছিল, স্কুলশিক্ষক আর সেই ছেলেটা, কেবল মাত্র একটুখানি বড় হয়েছে মাত্র, সে একদিন গেল; হঠাৎ করে সেই মহিলা ওকে ধরে চুমু খেল এবং মোটামোটি 'ই' করলো| আমি পুরোপুরি লিখেছি, সেখানে ওই যে চিত হয়ে ঘুমাচ্ছিল মহিলা তার ইয়ের বর্ণনা, মানে কোনো কিছু চেপে লিখি নাই| কিন্তু খুব বেশি দূর আমি এগোইনি| সাবিত্রীর উপখ্যান তাই| রেপের বর্ণনা আছে, রেপ করা হচ্ছে এই বর্ণনাও আছে| এখন রেপ চলছে সে বর্ণনা ডিটেইলসেই আছে| কিন্তু চিন্তা করে দেখ, আমার সেখানে কারোর প্রতি কোনো রিরংসা জাগানোর মতো কোনো বাক্য আমি লিখি নাই| যাতে করে পড়লে আমারও মনের মধ্যে রিরংসা জেগে উঠে| আর সেভাবে আমি করি না কাজ, করা উচিতও নয়|

সাক্ষাৎকারগ্রহিতা : তাহলে সাহিত্যে সেক্সকে কোনোভাবে ইনজয়েবল করাটা আপনি কি মনে করছেন? সিম্পলি ইনজয়েবল করাটা

হাসান আজিজুল হক: যদি তেমন বিষয় হয় তাহলে করবো| যদি মনে করি এই বিষয়টা শুধুমাত্র সেক্স নিয়ে তাহলে আমি সেভাবেই করবো| সেটার আমি একটা রাস্তা বার করবোই করবো- ঘুরিয়ে হোক আর সরাসরি হোক| কিন্তু কখনো আমার মনে হয় না এগুলো করার জন্য নারী-পুরুষের যৌনাঙ্গের বিবরণ বা ইত্যাদি দেয়ার কোনো দরকার আছে| এগুলোর তো কোনো দরকার নেই| ঠিক জিনিসটা কি, এগুলো তো বলার কোনো দরকার নাই| কেউ বলে না, বলবে কী জন্যে, বলার কোনো দরকার নাই| জৈবিক ব্যাপার কেউ বলে! বাথরুমে গিয়ে কেউ বলে- কি করলো না করলো, বলো তো? হয় না ওটা।
কিন্তু আমি সুচিবায়ূগ্রস্ত লোক বলে মনে করার কিছু নাই| আমি নিজেও সাড়া দেব, সব জায়গায় দেব| আমাকে এখনো যদি কেউ, একটা নির্জন গৃহে কোনো কুমারী যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে, তা আমি একদম পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো, এটা কি মনে হয় তোমাদের? হা হা হা। "
যখন যেখানে যেভাবে ডিমান্ড করে তিনি সেক্সকে সেভাবেই সাহিত্যে ব্যবহার করেন। একটা চরিত্র আরম্ভ করার জন্য যখন দরকার হয়েছে তখন খুব অশ্লীল কথাও ব্যবহার করেছেন। যেহেতু তিনি পুরুষ লেখক সেহেতু তিনি এই স্বাধীনতা ভোগ করবেন নির্বিবাদে। তিনি কতদূর পর্যন্ত যাবেন বা লেখবেন এক্ষেত্রে তাকে বিবেচনা করতে হয় না বা হবে না। আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় গল্পকার হাসান ভাই এটা দম্ভের সাথে স্বীকার করছেন। কিন্তু একজন নারী লেখক যখন একই প্রয়োজনে সেটা ব্যবহার করছে তাঁর পক্ষে সেটা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না, অভিভাবকত্বের যতরকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মন্তব্য আছে ছুঁড়ে দিচ্ছেন নারী লেখকটির প্রতি। শুধু সাহিত্যে নয় ব্যক্তি জীবনেও কুমারী নারী একাকী ঘরে পেলে একই কায়দায় প্রয়োগ করবেন তাঁর স্বাধীনতা।
আমি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের অনবদ্য গদ্যের একজন শুভাকাঙ্খি ও লেখক জীবনের শুরু থেকে যে কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের গদ্য নিরন্তর পাঠের মাধ্যমে নিজের গদ্যকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছি তার মধ্যে হাসান আজিজুল হক অন্যতম। শিক্ষকের নিকট থেকে সরাসরি শিক্ষা লাভের গুরুত্ব ও অহংকার চিরন্তন। অবশ্যই আমাদের ভেতরে পারস্পরিক আন্তরিক সম্মান, শ্রদ্ধার ও স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে মনে করেছি।
প্রাণের তাগিদে প্রবাস জীবনে যারা বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা করে সাহিত্যের প্রয়োজনে তাদেরকে দেশের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। হাসান ভাইয়ের সাথে আমার প্রায়শই টেলিফোনে কথা হয় যার সবটুকুই মূলত সাহিত্য বিষয়ক। দেশে গেলে হাসান ভাইয়ের প্রতি সম্মান ভক্তি প্রদর্শনের জন্য, এবং তার কথা ও আলোচনায় সমৃদ্ধ হবার জন্য সুদূর রাজশাহী পর্যন্ত ছুটে যাই লেখক বন্ধুদের নিয়ে দলবেঁধে। হাসান ভাইয়ের প্রাণখোলা সাহচার্য এবং জ্ঞান অভিজ্ঞতা বিতরণের মাহাত্ম্যে আমরা অনুজরা অভিভূত ও কৃতার্থ হই।
কিন্তু আমি কখনোই হাসান ভাইয়ের নিকট এই স্বীকোরোক্তি প্রদান করিনি যে মেয়ে হয়ে সেক্সের খোলামেলা বর্ণণা দিয়ে ভুল করেছি। অথবা ভবিষ্যতে আমি আর এমন লিখবো না। হাসান ভাই আমি আপনাকে বলতে চাই- বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বইয়ের কাটতির জন্য আমি সেক্স-এর বহুল এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার আনি না। গল্প উপন্যাসে বাস্তবতার প্রয়োজনে শিল্প সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে আমি আবেগপ্রবণতা ও রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতার পরিবর্তে বাস্তবতাকেই প্রধানত গুরুত্ব দিয়ে থাকি। গল্প বা উপন্যাস রচনার প্রাথমিক পর্যায় উত্তীর্ণ করার পূর্ব পর্যন্ত আমি আমার গল্প বা উপন্যাসের বিষয় বা চরিত্র নিয়ে আলোচনা করি না। হউক না তিনি গল্পের রাজকুমার অথবা বিশ্বমাপের সাহিত্যিক। কারণ আমি নিজস্ব স্বকীয়তা ও মৌলিকতায় বিশ্বাস করি। ভবিষ্যতে কি ধরনের সাহিত্য রচনা করবো সেটাও আমার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমি একান্ত গুরুজন অথবা সাহিত্যিক বন্ধুদেরও উপদেশ বা পরামর্শ গ্রহণ করি না। কারণ আমি মনে করি একজন সাহিত্যিকের সবচেয়ে বড় শক্তি তার চিন্তার স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা।
"সাক্ষাৎকারগ্রহিতা : তার মানে হচ্ছে, আপনার লেখায় যে প্রশংসাটা ছিল, তার মানে মনে হয়নি, আসলেই ভাল মানের ছিল বই দুটো- সালমা বা কাজী শাহেদ আহমেদের| অনুরোধ বা স্নেহ যাই হোক, এর বাইরে আপনার কী মনে হয় ভালমানের বই ওদুটো?
হাসান আজিজুল হক: 'ইমগ্রেশন' নয়, 'ভৈরব' উপন্যাস হয়ই নাই| এক আত্মকথা ধরনে, আত্মকথা সব সময়ই ইন্টারেটিং হয়| সালমা বাণীর আত্মকাহিনী কোনটা, ওই কানাডায় যাওয়া, ওই ইমিগ্রেশন? ওটা আত্মকাহিনীও নয়| ও আবার একটা অদ্ভূত জিনিস| তারপর আবার কিছুদিন আগে লিখেছে আর একটা জিনিস| আমি বললাম, সালমা এটা কেন করো তোমরা? তুমি কেন মনে কর খোলা বর্ণনা দিলে, তুমি মেয়ে, তোমার হাতে সেক্স অঙ্গের এমন খোলা বর্ণনা তুমি যে করছো, তুমি কি মনে কর, এতে তোমার সাহিত্যের কোন উন্নতি হচ্ছে? তুমি যে সম্প্রতি লিখলে, গ্রাম থেকে একটি ছেলে শহরে এসছে, সেখানে তার ভাই ছিল বিদেশে আর ভাইয়ের বৌটা বাড়িতেই ছিল| ন্যাচারলি, বৌটা হয়তো তার জৈবিক তাড়নায় বারবার ওই ছেলেটিকে ডেকেছে| ছেলেটি বার বার সেখানে গিয়েছে| তারপর ওই ছেলেটির মনে হচ্ছে যে- না, এটা উচিত হচ্ছে না| ছেলেটি কাজের খোঁজে শহরে গিয়েছে| শহরে যাওয়ার পরে তাকে পুরুষ বেশ্যা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে| কলকাতায় এমন পুরুষ বেশ্যা আছে, ওরা বলে জুগুল| আমি জিজ্ঞেস করি, হোট ইজ ইউওর পয়েন্ট? তুমি লিখছটা কী? কেন লিখছ? তারপর ধরো, সে সমকামী মানে হোমো হয়ে যাচ্ছে, তুমি কেন লিখলে, বল? মানুষের সমাজ আছে, সংসার আছে, কত কাজ আছে| সেখানে ঐসব বাদ দিয়ে এই সব লেখার দরকারটা কী? ও চুপ করে থাকে, বলে- বুঝতে পারছি, আমার এসব লেখা ঠিক হয় নাই| আমি বলি, না, এসব লিখ না| ওই বঙ্কিমচন্দ্রের মতো, যদি মনে করেন, লিখিয়া সৌন্দর্য্য সৃষ্ট করিতে পারিবেন অথবা কল্যাণ করিতে পারিবেন তবেই লিখবেন| অন্য কোন উদ্দেশ্যে লেখনি ধরা পাপ|
তাহলে সালমা বানী উপন্যাস ইমিগ্রেশন নিয়ে কি বলবেন? এই উপন্যাস নিয়েও তো আপনার একটা আলোচনা বেরিয়েছিল|
হাসান আজিজুল হক: বেরিয়েছিল? (হ্যাঁ, কানাডা প্রবাসী লেখিকা, ধনাঢ্য বলেও প্রচার আছে -সাক্ষাৎকারী)| দেবেশ রায় আমার খুব পুরনো বন্ধু| দেবেশ রায় আমাকে বললো, সালমা বাণী নিয়ে একটু-আধটু লিখে দেন| আমি বললাম, ঠিক আছে, দিমানি| আমি তো খুব কঠিন ধাতের লোক নই|

হাসান আজিজুল হক: সে রকম কেউ পড়ে নাই| অনুরূপ ভাবে আমার কিচ্ছু মনে নাই কি লিখেছি সালমা বাYx সম্বন্ধে| কি লিখেছি আমি জানি না| সালমা বাYx টেলিফোন করে- হাসান ভাই, আপনার গদ্য কি সুন্দর! আমি বলি- তা হতে পারে|
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: তো, দেবেশ রায় বলার পর আপনি লিখলেন|
হাসান আজিজুল হক: দেশের রায় বললেন, সালমা আমার খুব স্নেহের পাত্রী, দিন না লিখে| আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, লিখে দিলাম| সালমাও আমার বেশ স্নেহের| কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, লেখা একজিনিস আর মানুষটা আলাদা জিনিস| সালমা আমাকে খুব শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বা, আমিও তারে খুব স্নেহ করি| কিন্তু সেই কারণে তো তার বই নিয়ে লেখা যায় না। "

শ্রদ্ধেয় হাসান ভাইয়ের নিকট থেকে অনুজ লেখক সম্পর্কে এমন তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য দুঃখজনক। তিনি বলতে চাইছেন ছয়শত পৃষ্ঠার 'ইমিগ্রেশন' উপন্যাস একটি অদ্ভুত জিনিস। তার বিচারে সেটা হতেই পারে। 'ইমিগ্রেশন' একটি উপন্যাস, নাকি আত্মজীবনী, নাকি ইতিহাস অথবা পাগলের প্রলাপ সেটা নির্ণয় করার সক্ষমতা ও স্বাধীনতা আপনার আছে। সাহিত্যের কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না, এমন একটা অদ্ভুত জিনিস আপনার মনে হতেই পারে 'ইমিগ্রেশন' উপন্যাসটিকে। তবে এটা অবশ্যই একজন বয়োজেষ্ঠ্য সাহিত্যিক করবেন গঠনমূলক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে। হিংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক ভাবে নয়। কিন্তু এর পরেই মন্তব্য করছেন "তারপর আবার কিছুদিন আগে লিখেছে আর একটা জিনিস।" তিনি এটিকেও কোন রকমের সংজ্ঞায় ফেলতে পারলেন না, নাকি চান না? এখানেও কোন প্রকার গঠনমূলক অথবা শিক্ষামূলক আলোচনা নেই। আপনার সমালোচনায় মনে হলো আপনি আমার এবছরে প্রকাশিত 'যুবক হয়ে ওঠার সময়' এই উপন্যাসটিকে শুধু মাত্র ব্যঙ্গ করলেন। এই উপন্যাসের বিষয় আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলে যে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে না সেটি কেন ভাবলেন? নাকি যে ভাবে বঙ্কিম ও রবীন্দ্র আমলে নারীদের জীবন ও পছন্দের ছক কাটা ছিল সেভাবে ছক কেটে দিচ্ছেন নারী সাহিত্যিকদের জন্য? বইটির নামটিও আপনি বলতে পারেননি। বইয়ের ভেতরের বিষয় এবং চরিত্র সম্পর্কেও আপনি ভুল উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা দিলেন? এতেই প্রমাণ করে উপন্যাসটি আপনি পাঠ করেছেন নাকি উল্টে পাল্টে রেখে দিয়েছেন। একজন অনুজ লেখককে সামান্য সম্মান জানাতেও আপনি কৃপণতা প্রকাশ করেছেন। এই সাক্ষাতকার এটাই প্রমাণ করে হাসান ভাই অনুজদের প্রতি কতটা হীনমন্যতায় ভোগেন এবং তাদের সাথে অবচেতনভাবে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হন। অনুজদের প্রতি হীনমন্যতায়, কিংবা নতুনদের নিতে না পারার উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে যেমন আছে বাংলা সাহিত্যেও অজস্র প্রমাণ আছে, কৃত্তিবাস গোষ্ঠী বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে গিয়েছিলেন কবিতা অনুষ্ঠানে কবিতা শোনাতে, বুদ্ধদেব বসু শুধু তারাপদের ছন্দজ্ঞান আছে বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের কবিতা হয় না বলেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
আমাদের শ্রদ্ধেয় হাসান ভাই আপনার নিকট থেকে এই রকম লিঙ্গ দোষে বিভাজন আশা করিনি। আপনার নিকট থেকে পুরুষতান্ত্রিক পিউরিটান এই সব মন্তব্য আমাদের মতো অনুজ সাহিত্যিকদের হতাশার ভেতরে নিক্ষেপ করে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা গল্পকার হাসান আজিজুল হকের নিকট থেকে অনুজ সাহিত্যিকেরা লিঙ্গ বৈষম্যহীন নিরপেক্ষ মন্তব্য ও সমালোচনা প্রত্যাশা করে বৈকি। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য যখন বিশ্ব সাহিত্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নামছে তখন আপনি আপনার পুরাতন, সনাতন ও রক্ষণশীল মন মানসিকতায় সেই সাহিত্যকে পেছনে টেনে ধরবার অপপ্রয়াস চালালেন। আপনি যখন হাহাহা… এমন কটাক্ষ করে হাসছেন তখন প্রগতিশীল, সংস্কার মুক্ত লৈঙ্গিক বৈষম্যমুক্ত অনুজ সাহিত্যিকরা আপনার হাসির সঠিক অর্থ উদ্ধারে সক্ষম হচ্ছে।
সাহিত্যের যেমন কোন লিঙ্গ ভেদ নেই, সাহিত্যিকেরও কোন লিঙ্গ ভেদ নেই। বিশ্ব সাহিত্যের যেখানেই নারী লেখক ব্যতিক্রমী সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে সেখানেই নারীকে নানা রকমের লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। শিল্পের প্রয়োজনে সাহিত্যের প্রয়োজনে আমাকে সেক্স-এর ব্যবহার আনতে হয়েছে। এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সেটা অবশ্যই আমি ব্যবহার করবো। আপনার দৃষ্টিতে সমাজের যে বিষয়টি সমস্যা অথবা সাহিত্যের বিষয় বলে গুরুত্ব পায়নি সেটা আমার দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে না সেটা কি করে আপনি সমাধান দিলেন? শ্রদ্ধেয় হাসান আজিজুল হক তার এই সাক্ষাতকারের ভেতর দিয়ে এটাই প্রমাণ করলেন তিনি লিঙ্গ দোষে দুষ্ট এবং সনাতনী মানসিকতার রক্ষণশীল লেখক। বঙ্কিমচন্দ্রের উদাহরণ ব্যবহার করে তিনি সার্বিক ভাবে নিজেকে বঙ্গিমচন্দ্রের ঘরানার সাহিত্যিক বলেও প্রমাণ করলেন। প্রগতিশীল সাহিত্যিক সময়ের থেকে বহু শতাব্দী এগিয়ে থাকে, আপনি সময়ে থেকে বহু শতাব্দী পিছিয়ে আছেন। বহু কিংবদন্তী পুরুষ সাহিত্যিক আপনার মতো করেই সেক্স-এর খোলামেলা ব্যবহার করেছেন সাহিত্যের প্রয়োজনে। আপনি কোনো পুরুষ লেখকের প্রতি মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন না? নাকি কখনো দিয়েছেন? একজন নারী লেখককেই বেছে নিলেন শাসনের আঙ্গুলি প্রদর্শন করতে। সনাতন দৃষ্টি ভঙ্গির কালো চশমা পরা নৈতিকতার মুরুব্বি হতে চাইলেন শুধু মাত্র নারী সাহিত্যিকদের জন্য! শ্রদ্ধা ও সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে আপনাকে স্থান দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের অনুজ সাহিত্যিকেরাই।