লুড্ডাইট ও নব্য লুড্ডাইট

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 3 Jan 2008, 05:33 PM
Updated : 3 Jan 2008, 05:33 PM

যারা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিরোধিতা করেন, মোটা দাগে তারা হলেন লুড্ডাইট।

…….
১৮১১ সালে ইংল্যান্ডের নটিংহামে লুড্ডাইট দাঙ্গা। দ্রতগতি যন্ত্রের কারণে শ্রমিক ছাটাই বাড়তে থাকলে দাঙ্গা শুরু হয়।
………
তবে শুরুতে শব্দটা দিয়ে সরাসরি প্রযুক্তি বিরোধিতা বোঝাতো না। শব্দটা প্রথম ব্যবহার হতে শুরু করে ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে। ইউরোপে তখন শিল্পবিপ্লব অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা দ্রুত স্বয়ংক্রীয় হয়ে উঠছে, পেশীশ্রমের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে যন্ত্রপাতি। এরকম সময়ে বৃটেনের পোশাক শিল্পীদের একটা বড় অংশ নিজেদের বিপন্ন বোধ করতে শুরু করে। তারা শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তনগুলোর বিরোধিতা করতে থাকে। এদেরই একটা খুব সক্রিয় অংশ সেলাই মেশিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষজনের বাসায় বা মিল-কারখানায় হামলা চালিয়ে সেলাই মেশিন ধ্বংস করে দেয়াই হয়ে দাঁড়ায় তাদের প্রতিবাদ পদ্ধতি।

এই 'দুর্বত্তদের' লুড্ডাইট নামে কেন ডাকা শুরু হয়েছিল, সেটা নিয়ে একাধিক তত্ত্ব চালু আছে। কেউ কেউ বলে, নেড লুড নামে এক আধপাগল লোক ভাংচুরের কাজটা বিসমিল্লাহ করেছিল। পরে কাউকে সেলাই মেশিন ভাঙতে দেখলেই তাকে 'লুড' নামে ডাকা শুরু করে সবাই।

এদের সম্পর্কে আপাতত এটুকু বলে নেয়াই যথেষ্ঠ যে, কেবল আক্রান্তরাই এদের লুড্ডাইট নামে ডাকতো না, এরা নিজেদেরকেও অনেক সময় এই নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করতো। বোঝা যায়, লুড্ডাইটরা সেই সময় নিজেদের মধ্যে একটা ঐক্য বা ভ্রাতৃত্ব অনুভব করতে শুরু করেছিল। তারা কিছুটা সংগঠিতও হয়েছিল সম্ভবত।

শিল্প বিপ্লবের কাল পেরিয়েও লুড্ডাইটস বা লুড্ডিজম কথাটা টিকে গেছে। এখন শব্দটা দিয়ে সাধারণভাবে সেইসব লোকদের চিহ্নিত করা হয়, যারা যে কোনো ছুতোয় যে কোনো ধরনের প্রাযুক্তিক অগ্রগতি আর কারিগরী পরিবর্তনের বিরোধী।

……..
লুড্ডাইটদের কাল্পনিক নেতা নেড লুডলাম। ধারণা করা হয় তিনি লিস্টারের কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে এসেছিলেন।
……..
এখন নিও-লুড্ডাইট বা নিও-লুড্ডিজম নামে একটা শব্দ চালু হয়েছে একটা আধুনিক আন্দোলন হিসেবে। যারা সাধারণভাবে যে কোনো প্রাযুক্তিক বিকাশের বিরোধিতা করেন, তারা নিজেদের শুধু লুড্ডাইট বা নিও-লুড্ডাইট নামে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। আবার একটা কোনো সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তির আগমনের যারা বিরোধিতা করেন, তারাও অনেক সময় নিজেদের ওই নামটা দেন। তবে দ্বিতীয় ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উল্টোটা সত্যি। মানে, যারা ওই সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তিটির পক্ষের লোক, তারা বিরোধিতাকারীদের 'নিও-লুড্ডাইট' বলে গালি দেন। আবার নিজেদের লুড্ডাইট বা নিও-লুড্ডাইট বলে পরিচয় দেওয়াটা একটা ফ্যাশনও বটে। বিশেষ করে বৃটেনে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায়। যারাই কোনো বিশেষ প্রযুক্তিকে অপছন্দ করেন, তারা নিজেদের লুড্ডাইট নামে পরিচয় দেন। তবে মোটের ওপর, প্রযুক্তির বিকাশের পক্ষের লোকজনের প্রতিপক্ষকে নিও-লুড্ডাইট নামে চিহ্নিত করার ঘটনাটিই বেশি ঘটে থাকে।

নিও-লুড্ডিজমের খুব কাছাকাছি একটা আন্দোলনের নাম অ্যানারকো-প্রিমিটিভিজম। অ্যানারকো-প্রিমিটিভিস্টরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মাত্রেরই বিরোধী। তাদের মতে, বিজ্ঞানই সব নষ্টের গোড়া। নিও-লুড্ডাইটরা সবাই সেরকম নাও হতে পারেন। তাদের অনেকে প্রযুক্তিকে অপশক্তি মনে করে না। তারা মূলত এটির প্রয়োগ বা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত রাজনীতির বিরোধিতা করেন। নিও-লুড্ডাইটদের অনেকে প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত বিকাশ এবং লাভ-ক্ষতি বিবেচনার বালাই না রেখে অন্ধভাবে মানব সমাজে সেটা গ্রহণ করে নেয়ার বিরোধিতা করেন। তারা মনে করেন, অনেক প্রযুক্তি মানব সমাজে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি ঘটায়। এখন যারা পরিবেশবাদী আন্দোলন করছেন, তারাও এক অর্থে নিও-লুড্ডাইট, যদিও তারা নিজেরা সেটা মানতে রাজি হবেন কিনা সন্দেহ আছে।

নিও-লুড্ডাইট আন্দোলনের অনুসারীদের বেশিরভাগই এটা স্বীকার করে নেন যে, প্রযুক্তি নিজে 'নীতি-নৈতিকতা' নিরপেক্ষ কোনো নিষ্পাপ নিরীহ অস্ত্র নয়, প্রযুক্তির পক্ষের লোকজন যেমনটা প্রচার করে থাকেন। নিও-লুড্ডাইটরা বলেন, কিছু কিছু প্রযুক্তির ভেতরের বৈশিষ্ট্যই এমন যে, সেটা সমাজের নির্দিষ্ট কোনো মূল্যবোধে ক্ষয় ধরিয়ে দেয়, বা অন্য কোনো বাতিল মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে তোলে। এমন কিছু প্রযুক্তি আছে, যেগুলো শ্রেণী-বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে দেয়, পরিবেশের ক্ষতি করে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করে, উপজাতিদের পুরনো সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে দেয় এবং সর্বোপরি মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা ফিকে করে দেয়। যেসব বহুজাতিক কোম্পানি এসব প্রযুক্তি বাজারজাত করে, তারা এইসব ক্ষতিকর প্রভাব গোপন করার সবরকম চেষ্টা চালায়, নেয় নানান কৌশল। বিজ্ঞাপন তার একটি।

আমাদের দেশে লুড্ডাইট
সব রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানেই নিও-লুড্ডাইটদের উপস্থিতি থাকা সম্ভব। বাম শিবিরের মধ্যেও যেমন লুড্ডাইটরা আছেন, তেমনি রক্ষণশীল বা উদারনৈতিক শিবিরেও লুড্ডাইটদের সংখ্যা কম নয়।

আমাদের দেশে আমরা অনেককেই লুড্ডাইট বা নিও-লুড্ডাইট হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। তবে আমাদের এখানে কালচারাল লুড্ডাইট এবং বায়ো-লুড্ডাইটের সংখ্যাই সম্ভবত বেশি। এদের অনেকেরই বামপন্থি ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। কালচারাল লুড্ডাইটরা মনে করেন, নব্য উপনিবেশবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের 'নিজস্ব সংস্কৃতি' কলুষিত হয়ে পড়ছে। এদের অনেকে পোশাকের ঐতিহ্য ধরে রাখার দিকে জোর দেন। অনেককে আমরা প্যান্ট-শার্টের বদলে লুঙ্গি পরতে দেখি। আর বায়ো-লুড্ডাইটরা বিশেষ বিশেষ বায়ো-টেকনোলজির বিরোধিতা করে থাকেন। বিশেষ করে শস্য উৎপাদনে জিন প্রযুক্তির ব্যবহারকে এরা দুরভিসন্