পরাজয় মানে না মানুষ (৭ম পর্ব)

হাবীবুল্লাহসিরাজী
Published : 6 Jan 2021, 01:16 PM
Updated : 6 Jan 2021, 01:16 PM

০৫.১০.২০২০
সোমবার

ভোর ফুটতেই ঘষামাজা আকাশ। আলোদের দারুন ফুর্তি। সকাল এবং আমি মিলে এক ডজন ইলিশ কেনায় মেতেছি। সঙ্গে একটা বাড়তি। এই তেরো ইলিশের লেজ ও মাথার কাঁটায় যেন খোঁচা দিলো করোনা। কিন্তু তার বাইরেও আছে বিধিনিষেধের বেড়াজাল। ইলিশধরা বেচাকেনা ক'দিন পরেই সাময়িকভাবে বন্ধ হবে, এবং সে প্রস্তুতি হিশেবেই আজ সকালের তোড়জোড়। নাকে এসে লাগে ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ। আহ্ !
বাংলাদেশে প্রায় সাত মাসের করোনা-তাণ্ডব কবে শেষ হবে তার খবর কেউ জানে না। টিকা পর্বের ডামাডোলও বুঝি ধীরে বাজছে! ফলে জীবনের গতি নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষ ডান-বামের হিশেব ক'রতেও গেছে ভুলে। তার সম্মুখে কেবল স্বপ্নহীন অজানা গন্তব্য! পথ ও রথের একদম অন্য হিশেব নিয়ে পরিবর্তিত হ'চ্ছে জলবায়ু, হ'চ্ছে পৃথিবী নামক গ্রহের অকল্পনীয় এবং অভাবনীয় সৌরপ্রদক্ষিণ। প্রাণিকুলে মনুষ্য প্রজাতির জাতিত্বেও প'ড়েছে মহাটান। দিগভ্রান্ত মানবমেলার এ উচাটন কি মঙ্গলশর্তে পরিসমাপ্তি ঘটার কোনো সূত্র মেলে?


আলোকচিত্র: সরকার আমিন
দুলতে-দুলতে বেলা বাড়ছে তো শোনা যাচ্ছে কর্মস্থলের ডাক। সেখানে বৃক্ষরাজির সঙ্গে অপেক্ষায় থাকে থরে-থরে পুস্তক। মানুষের সান্নিধ্যে সে বৃক্ষের ছায়ারূপ যেন গাছ হ'য়ে জীবনতরঙ্গে পরিস্ফুটনের দিকে যায়, আবার অন্যদিকে প্রাণস্পর্শে পুস্তকসমাহার পায় বই-বিদ্যার অভ্যাস। চিত্র ও বিচিত্রে এ মহামারিকালেও বুঝিবা অপরূপ বাংলা একাডেমি।
ফুলতে-ফুলতে রোদ তার দাপট হারিয়ে ফেললে ঘরের ডাকে ঘাই ওঠে ঝিমধরা জলাশয়ে। পুকুরও বলা যেতে পারে, যার শান বাঁধানো ঘাটে সেলফি তোলার আলো ক'মে এলে ফিরে যায় জোড়-বেজোড়! বর্ধমান হাউসের পশ্চিম সিঁড়িতে মুহূর্তের জন্য রাজহাঁসের গলা তুলে আকাশ দেখা যেন কূল-অকূলের দ্বন্দ্বে দোল খাওয়া। প্রিয় একাডেমি আজকের মতো বিশ্রামে যাবার আয়োজন করে ।

২০.১১.২০২০
শুক্রবার

আসলে যতো বিপত্তি মধ্যস্থিত পর্বতশ্রেণী নিয়ে। মাটি-পাথর নয়, আকরিক লোহা দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অভেদ্য-অগম্য পর্বতমালার একপার্শ্বে ঘন অরণ্য ও গভীর সমুদ্র, এবং অন্যপার্শ্বে বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র ও সুপেয় জলরাশি। প্রাণচলাচলে যেন বিচ্ছিন্ন পৃথিবীর দুই রূপ। শূন্য সীমানায় পরিদৃষ্ট অসীম শূন্যতা আকাশরূপে কেবল হাহাকার ছড়ায়। অভিন্ন হ'তে চায় জড় ও চৈতন্যের অনন্ত সত্তা। কিন্তু অন্তরায় তো প্রায় মহাকাশগ্রাসী লৌহবিভাজন। ভরসা-বায়ু পক্ষে রায় দেবে, অগ্নি পালন ক'রবে মিলনের শর্ত। দিনরাতের তুমুল আয়োজনে লোহার পাহাড়ের একদিক অরণ্যের কাঠ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলা হ'লো। রাশিরাশি জ্বালানির দেহ স্পর্শ ক'রলো চকমকি পাথরের স্ফূলিঙ্গ। দাউদাউ ক'রে জ্ব'লে উঠলো পদপ্রান্ত থেকে শীর্ষদেশ পর্যন্ত। ওরে ভাই আগুন লেগেছে আকরে, লৌহশিকড়ে।
জ্ব'লছে। পুড়ছে। গ'লছে।


দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বছরের পর বছর যায়।
একসময় আগুন নেভে, গলিত লোহা সমভূমি-মালভূমি একাকার ক'রে দেয়। বায়ু বহে পুব থেকে পশ্চিমে। তুষারে-তরলে শীতল হয় পৃথিবী।
প্রাণ জাগে প্রাণের নিয়মে। অরণ্য ও ফসল, সমুদ্র ও সমতল যুক্ত হয় মুগ্ধতায়। বিস্তারিত হয় সভ্যতার নবপ্রকরণ।
তা সেই লৌহযুগের কল্পনা ও বাস্তবতা আজ প্রায় অবসিত। তবুও জয়ের ঝাণ্ডার সঙ্গে যেন এখনো ঝুল দেয় চাকা ও চরণ, যন্ত্র ও যৌবন, অস্ত্র ও অভিযান।


২২.১১.২০২০
রবিবার

হুট ক'রে অর্চি এসেছিলো কানাডা থেকে। সঙ্গে মেয়ে সাবাবা। তা নভেম্বর ৩ তারিখ মঙ্গলবার দুপুরের কথা। অফিস থেকে ফিরে ওদের দেখে তো অবাক। কোনোকিছু না জানিয়ে এমনভাবে আসায় বাড়তি একটা খুশি উপচে পড়লো। ম' ম' ক'রে উঠলো সারা বাড়ি। প্রায় দু'মাস থাকবে ব'লে জানাতেই করোনাকালে তা এক মধুরমিলন হ'য়ে বিস্তারলাভ ক'রলো।
মন্দ মানতে-মানতে যদি ভালো কোনো ছন্দ এসে পড়ে তবে বিষয়-সংবাদ গাঢ় হয়, মূল্যে যোগ হয় নতুন উপমা। অর্চি-সাবাবার এই অপ্রত্যাশিত আগমনও যেন তেমন ঢোল-করতালে সরগরম হ'লো।
না, ছন্দের পতনে লাগলো মাত্র দুই সপ্তাহ! কোভিড-১৯ তছনছ ক'রে দিলো মিলনমেলা, পরিকল্পনার স্বর ও মাত্রা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বুঝি লাগে কানাডার গায়, আর তাই স্থায়ী বাশিন্দাদের কানাডার বাইরে যে যেখানে আছে ফেরার তোড়জোড়। অর্চিও সে আয়োজনে সামিল হ'য়ে বেশ বড়ো অর্থদণ্ড দিয়ে নিশ্চিত ক'রলো প্রত্যাবর্তন।
আজ মধ্যরাত পেরিয়ে ওদের যাত্রা।

৩১.১২.২০২০
বৃস্পতিবার

ভোর-সকালে সূর্য দেখার কাল ফুরিয়ে এলো। বিকেল বেশ তোড়জোড় শুরু ক'রেছে সন্ধ্যায় ঝাঁপ দেবে ব'লে। ফলে, শুরুর হাওয়া শেষের সীমানা স্পর্শ করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। আজ যদি সিঁড়ির হিশেব নেয়া যায়, তবে চকখড়ি দিয়ে বাহাত্তর দাগিয়ে দিতে হবে। সেই ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের অনিশ্চিত যাত্রা নানান সীমা, অন্যস্রোত, ভিন্ন হাওয়া অতিক্রম ক'রে এখনো নিরুদ্দেশের পথে।
রাজারবাগ পুলিশ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশংসনীয় কাজ ক'রে যাচ্ছে। তারই অংশ হিশেবে বিজয়ের মাসের সমাপনী আয়োজন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান। মূলের বিপরীতে অনেক ভুল আমাদের টানছে। তাই, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা অন্য এক বাংলাদেশ চাই। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের প্রকৃত বিকাশ চাই। চাই আমার সন্তানের দুধে-ভাতে থাকার নিশ্চয়তা।
বিদায়ের মধ্যেও আনন্দের প্রতিচ্ছবি আছে, তা বোঝা গেলো একাডেমির শেষবেলার কর্মচাঞ্চল্যে।
ঘরে ফিরে জন্মদিনের একটা ঘ্রাণ তিনপুরুষে সন্ধিস্থাপন ক'রলো।


বিশবিশ(২০২০) বছরটি বিষে-বিষে কাটলো। মার্চ থেকে ডিসেম্বর অব্দি আমাদের জড়িয়ে থাকলো বেদনার অন্যরকম মাটি ও আগুন। তা-ও কিন্তু শেষ নয়। করোনা মহামারি এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়। কবে তার তাণ্ডবলীলা সাঙ্গ হবে তা কেউ জানে না! টিকা তো সান্তনার ভগ্নাংশ। এর মধ্যেই জীবন নিয়ে বিশ একুশের (২০২১) ভাবনা। আশা ও স্বপ্নের এক নতুন মানচিত্র নির্মাণ। প্রত্যাশার দুয়ার খুলে সূর্যালোকে নবস্নানের প্রস্তুতি। অভিযাত্রা মঙ্গলের অন্বেষণে…
ইচ্ছে ছিলো দু'হাজার বিশ সাল জুড়ে নিজের লেখালেখির সঙ্গে যোগ করবো প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার/লেখালেখির একটা অংশ। অনুবাদ-ভাবনার একটা অবকাঠামো বাংলা একাডেমিতে জুড়ে দিয়ে চেষ্টা করবো ভিত্তিপ্রস্তরটি সংহত করার। না, কিছুই হয়নি। ভয় খেয়ে গেছে বেলা আর চিন্তাকে আড়াল ক'রেছে মুখোশ…
সবকিছু উজিয়ে নাছোড় এ আমি কিন্তু 'না'-তে নেই। পদ্য-গদ্য মিলিয়ে নির্মাণ করছি আটখানা গ্রন্থের ভিত-দেয়াল-দরোজা-জানালা। এখন ছাদ জুড়ে দিলেই মলাটের মধ্যে ময়না ডাক দেবে : কুটুম এলো, পাটি দাও…
বিশের পাওনা কড়ায়গণ্ডায় একুশে বুঝে নেবো।