পরাজয় মানে না মানুষ: মৃত্যুর মিছিল এবং সর্বজ্ঞতা ও ভ্রমপ্রবণতা

হাবীবুল্লাহসিরাজী
Published : 1 July 2020, 03:33 PM
Updated : 1 July 2020, 03:33 PM

০৬.০৬.২০২০
শনিবার

রবিবার ৩১শে মে ২০২০ থেকে অফিস চ'লছে। সরকারি প্রজ্ঞাপন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুচারুরূপে কর্মসম্পাদন বেশ দুরূহ। করোনাকালে সব অবস্থানের এবং বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় ক'রে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিস-উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। তারপরও কঠিনের মধ্যে সহজকে খুঁজে নিতে হবে। জীবনের জন্যই জীবনধারণের বিষয়টি পাবে সর্বোচ্চ অধিকার। সে প্রেক্ষিতেই কাজের গুরুত্ব বুঝে এগুতে হ'চ্ছে। এই অফিস যাওয়া নিয়ে নিকটজনের বাধা-নিষেধ থাকলেও কর্তব্য ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে সব। খবর যা পাই আর টেলিভিশন-ফেসবুক যতোটা চাউর করে, তার সবটাই ভীতিকর। কিন্তু ভয়কে তো জয় ক'রতে হবে। হাতধোয়া বেড়ে গেছে, সময়-অসময়ের তোয়াক্কা না ক'রে নাক-মুখ ঢেকে রাখছে মাস্ক। ঘরে-বাইরের এই আতংকের মধ্যে আবার শাদা-কালোর লড়াই যুক্তরাষ্ট্র ছাপিয়ে আমাদের দেহেও উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছে। জর্জ ফ্লয়েড আজ দুনিয়ার কাছে রক্তপিপাসুর বিচার চায়। কিন্তু তা পাওয়ার মতো পরিস্থিতি কি পৃথিবীর কোনোদিন ছিলো কিংবা এখন আছে? না, ছিলো না। আর হবেও না ভবিষ্যতে। তা হ'লে কীসের সভ্যতার বড়াই? আর কার জন্যই বা মঙ্গলচিন্তা? এক কাজ ক'রলে হয় না, মানুষের অভিধান থেকে রং তুলে দিলেই তো হয়! আর নিদেনপক্ষে যদি রঙের তামাশা দেখতেই হয়, তবে কেবল লাল থাকুক। লালে কোনো বিবাদ নেই–কালোও লাল, শাদাও লাল। এক মৃত্যু অসংখ্য মৃত্যুর আতুড়ঘর।

ঔষধ ফুরিয়ে গেলে তা সংগ্রহের জন্য সবরকম বাঁধা ঠেলে দিতেই হয়। এরপর যদি তার সঙ্গে জুড়ে যায় ইনস্যুলিনের মতো বিষয়। তালিকামতো আমার ও যোরার এক মাসের ব্যাগ প্রস্তুত হ'লে কার্ডে দাম মিটাই। কাগজের টাকাও নাকি আজকাল কোভিড-১৯ এর প্রিয় হ'য়ে উঠছে। ওদিকে অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান জানালেন, রিফ্রেজারেটরের ঠান্ডা থেকেও অধিবাসীদের নিস্তার নেই। ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ভাইরাসের বড়ো সুখের আশ্রয়। আপেল-মাল্টা-পেয়ারা-তরমুজ অক্ষত দেহে দুর্গ পাহারা দিচ্ছে। যে 'বধিবে' সে তো আদা-লবঙ্গ-দারুচিনি-তেজপাতা দিয়ে সিলেটের বাগানের পাতা প্রস্তুতে ব্যস্ত। তারপর আছে বাষ্প গ্রহণের লৌকিক অভিযান।

শুক্রবার ফুস ক'রে উড়ে গেলো পাঠক সমাবেশে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে রচিত গ্রন্থসমূহের পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং ক'রলো চ্যানেল আই। ১৫ খানা গ্রন্থের এ আয়োজনে বেলা ঢলে প'ড়লো। ঘরের বাইরে মাস্ক খুলে এতো দীর্ঘসময় নাক-মুখ রাখা হয়নি। ভয় ছিলো, তবে বঙ্গবন্ধু সাহস জুগিয়েছেন।
দাঁত বেয়াড়া হ'লে জান ফানাফানা হ'য়ে যায়। করোনা ঢোকার আগেই দাঁতের মেরামতে নেমেছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি পেরে ওঠার আগেই দন্তচিকিৎসক তাঁর কপাটে খিল তুলে দিলেন। ফলাফল, একটি ভাঙা দাঁতের আর্তচিৎকারে আমি দিশেহারা হবার জোগাড়। সব খোলাদের দলে এসে প্যাসিফিক ডেন্টালও তার বাহু উন্মুক্ত ক'রলো। এবং কালবিলম্ব না ক'রে আমিও ডাক্তারের চিৎ-কেদারায় পিঠ নামিয়ে হা ক'রলাম।
বিকেলের রোদে এখন ঝাঁজ অনেক বাড়তি। তাতে আম পাকে, জাম পাকে; লিচু পাকে গাল নামিয়ে। বাজার ম' ম' জ্যৈষ্ঠ-সন্ধ্যায় হিড়িক লেগে গেছে ফেসবুক লাইভের। ঢাকা-কলকাতা-দিল্লী-লন্ডন-ন্যুয়র্ক-টরোন্টো-টোকিও-দুবাই-কুয়ালালামপুর গলা খুলে গাইতে লেগেছে। করোনা ও কবিতা মাখামাখি হ'য়ে ওড়াচ্ছে স্যানিটাইজার। সংগীত ও গলাবাজির তোড় এক প্রস্থ মাস্কের পক্ষে সামলানো কঠিন হ'য়ে প'ড়েছে। এর মধ্যেই
একসময় দুই চোখের পাতা মুদে আসে।

১২.০৬.২০২০
শুক্রবার

যেন বাঁচার ইজারা রক্ষার জন্য নিত্যদিন নানা প্রকরণে লড়ে যেতে হ'চ্ছে। অযত্ন-অবহেলায়ও বংশবৃদ্ধি ঘটছে আগাছার, আর প্রবল পরিচর্যার পরও জাত বৃক্ষটি ঢ'লে প'ড়ছে মৃত্যুর কোলে। প্রকৃতি মেতেছে এক নতুন অভিযাত্রায়। মনুষ্যকূল তার একমাত্র লক্ষস্থল, এবং তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার মধ্যেই যেন তার সর্বসাফল্য নিহিত। এ হেন পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ এর অভিযানের কিনারা পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার।
৭ই জুন ছিলো ৬-দফা দিবস। ১৯৬৬ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা উত্থাপন করেন। করোনার কারণে দিনটির সামগ্রিক আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকে কেবল ডিজিটাল উপস্থাপনায়।
অন্যদিকে ৭ই জুন সন্ধ্যায় যোরার ভাই, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আমার সহপাঠী এ. টি. এম. সোলায়মানের মৃত্যুসংবাদ আসে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা চ'লছিলো। মৃত্যুর একদিন পূর্বে পরীক্ষায় কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। করোনায় মৃত্যু একটি পরিবারকে নতুন সংশয় ও সংকটের মুখে নিপতিত করে।
সরকারি অনুশাসন মেনে একাডেমির কর্মসম্পাদনের প্রচেষ্টা চালানো হ'চ্ছে। পরিস্থিতির শিকার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের সহায়তা প্রদানের নিমিত্তে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের অংশ হিশেবে শিল্পকলা একাডেমিতে সভা হ'লো। আবার নানা উদ্যোগের ফেসবুক লাইভেও মু–মাথা একপাত্রে রাখছি।
চ'লে গেলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী নীলুফার বানু। ১০ বছর ধ'রে লড়াই ক'রছিলেন কর্কটরোগের সঙ্গে। তাঁকে অন্তিম অভিবাদন ।
বাংলাদেশের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হ'য়েছে। লক্ষকোটি টাকার এ বাজেট দেশের এমন একটা সময়ে এলো, যখন জীবন বড়ো না জীবিকা প্রধান প্রশ্নটি ১৮ কোটি মানুষকে অস্থির ক'রে তুলেছে! তবুও তো আলোচনার বিষয়, নতুন কীসের-কীসের দাম বাড়লো নতুবা কোথায়-কোথায় দাম কমলো! বাজেট পরবর্তী এ ঢেউ টেলিভিশন-ফেসবুকে ঘুরপাক খেলেও খোলা বাজারে তার উপস্থিতি নেই ব'ললেই চলে।
সকালের নানা আয়োজনে দিনদিন ঝুটঝামেলার চেহারা বদলাচ্ছে। নাস্তায় ডিমের কুসুম কাঁচা থেকে যাচ্ছে তো ফলের গায়ে ধ'রছে দাগ। গতরাতে লেখা 'মুহূর্তে'র কিছু অবলীলায় হাওয়া হ'য়ে গেছে মোবাইল থেকে, নাকি নিজেই মুছে ফেলেছি–তা আর মনে প'ড়ছে না। এর মধ্যেই টিকটিকি-তেলাপোকা-মাছি-মশা-পিঁপড়ে-উই নিয়ে বসতবাড়ির গোষ্ঠী উদ্ধারে সামিল হ'তে হ'চ্ছে। ফলাফল, ৪৭ বছরের সম্পর্কে আরো এক প্রস্থ ক্ষয়কালি মেখে দুর্দিনকে নতুনভাবে ঘোলা করা।


দুপুর গড়াতে সংবাদ এলো অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম আর নেই। ভাষা-গবেষণা, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য-উদ্ঘাটন, পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার, সাময়িকপত্র-চর্চার মধ্য দিয়ে তাঁর গবেষক-সত্তার অনন্যতার পরিচয় মিলেছে। 'সাময়িকপত্রে সাহিত্য-প্রসঙ্গ', 'চকবাজারের কেতাবপট্টি', 'অভিধান'-এর মতো গ্রন্থ তাঁকে স্মরণীয় ক'রে রাখবে। বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে শিক্ষক হিশেবে মোহাম্মদ আবদুল কাইউম তাঁর বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হ'চ্ছে।

২০.০৬.২০২০
শনিবার

মৃত্যুর মিছিল বুঝি আর মিছিলে থাকছে না, যেন কোনো মহাসভাতে পরিণত হ'তে চ'লেছে।
একদিকে যেমন রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম, শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, বদরুদ্দীন আহমদ কামরান প্রমুখ করোনার কবলে মৃত্যুমুখে পতিত হ'লেন অন্যদিকে তেমনি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী ও জাফর আলমও চ'লে গেলেন পরপারে।


বীর ভাষাসংগ্রামী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শব্দসৈনিক, বরেণ্য সাংবাদিক, বিশিষ্ট লেখক কামাল লোহানীর একমাত্র তুলনা তিনি নিজেই। পাকিস্তানি বিরুদ্ধ পরিবেশে বাঙালি সংস্কৃতি লালন ও বিকাশে তাঁর লড়াই কখনো বিস্মৃত হবার নয়। আজীবন তিনি সাম্যবাদী ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ-রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে নিবেদিত থেকেছেন।
প্রগতিশীল উর্দু সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে জাফর আলম আমাদের সাহিত্য-ভুবনকে সমৃদ্ধ ক'রেছেন। অনুবাদের পাশাপাশি সাহিত্য-গবেষণায়ও রেখেছেন অনন্যতার স্বাক্ষর।
চতুর্দিক থেকে আসা মৃত্যু-সংবাদে মানসিক ভারসাম্য নড়চড় হ'য়ে যাচ্ছে। চেনাজানা গণ্ডীর মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মী, প্রশাসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, শিক্ষক-ছাত্র, সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী থেকে নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, কৃষক-শ্রমিক-গণমানুষ…। কেউ যেন আর আজ বাদ নেই। ঘরে বাইরে শুধু মৃত্যুর সংবাদ।
করোনা পরিস্থিতির হালনাগাদ করা যেমন এক অসাধ্য ব্যাপার, তেমনি খাদ্য-পরিস্থিতিরও সুষ্ঠু সমাধান জটিল বিষয়। নিত্যদিনের আয়ে যাদের প্রতিদিন অন্ন জোটে, তাদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি নিতান্তই গৌণতার পর্যায়ে পড়ে। ছুটি-লকডাউন-সামাজিক দূরত্ব… একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা চায়, যাতে ক'রে মানুষ জীবনের সঙ্গে জীবনধারণের বাস্তবসম্মত সমাধান ক'রে নিতে পারে। তা না হ'লে বিপর্যয়ের দোরগোড়ায়ই পা আটকে থাকে।
বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটলে সবরকম প্রস্তাব-পরিকল্পনাই বাস্তবায়নের বাইরে অবস্থান নেয়।
আষাঢ়ের শুরু থেকেই এবার বর্ষার চোখরাঙানি পরিদৃষ্ট হ'চ্ছে। জোর হাওয়া আর বৃষ্টিপাতে উত্তরাঞ্চল বিপদের কিনারা অতিক্রম ক'রতে চাইছে। এরমধ্যে করোনা-ডেঙ্গু-বন্যা একজোটে নেমেছে ধ্বংসলীলায়। মানুষ কি পারবে, বাংলাদেশের জনগণ কি পারবে তা সামাল দিতে?

২৫.০৬.২০২০
বৃহস্পতিবার

"ঊষার দুয়ারে হানি' আঘাত/আমরা আনিব রাঙাপ্রভাত/আমরা টুটাব তিমির রাত,/বাঁধার বিন্ধ্যাচল…"
রাঙাপ্রভাতের অপেক্ষায় থাকি, থাকি সুন্দর একটি সকালের প্রত্যাশায়। তিমির রাত ছিন্ন ক'রে সে প্রতীক্ষার কবে শেষ তা কি কেউ জানে?
মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে এই পথচলায় কাছের কিংবা দূরের গন্তব্য ব'লে যখন কিছু নেই, তখন আপনার মধ্যে আপনাতে পৌঁছানোর একটি ছুট অবিরাম চ'লছে। সেই ছুটের চক্রে দৈনন্দিন দেনা-পাওনার হিশেব চলে। আর, আমাদের শরৎ বাবুর 'দেনা পাওনা'র ভেতরমহলের ভাঁজটির মধ্যে যা বর্তমান, তার খোঁজ পাওয়া আজ যে বেজায় কঠিন! তবু কঠিনেরে ভালোবেসে শোকের সামাল দিতে হয়।


কবি মাশুক চৌধুরী চ'লে গেলেন। ধ'রতে গেলে হঠাৎ ক'রেই পরাস্ত হ'লেন নিউমোনিয়ার কাছে। 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর প্রধান বার্তা সম্পাদক পদে কাজ করার পাশাপাশি আমৃত্যু কবিতায় ছিলেন নিষ্ঠাবান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ ক'রে গত শতাব্দীর সত্তর দশকে একজন মাশুকুর রহমান চৌধুরী কবিতাঙ্গণে পদার্পণ করেন। পরবর্তীতে শুধুমাত্র মাশুক চৌধুরী হ'য়ে প্রতিষ্ঠা পান বাংলাদেশের কবিতায়।
দুপুর আড়াইটে বাজতেই বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ ক'রে ওঠে। করোনা সংক্রান্ত একটি খতিয়ান নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টেলিভিশন পর্দায় উপস্থিত হয়।
বাংলাদেশে আজ ২৫শে জুন পর্যন্ত সর্বমোট নমুনা পরীক্ষা হয় ৬৮১৪৪৩ জনের, তার মধ্যে ১২৬৬০৬ জন করোনায় শনাক্ত এবং মৃত্যু ঘটেছে ১৬২১ জনের। অপরদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭৯৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষা শেষে ৩৯৪৬ জন আক্রান্ত ও ৩৯ জনের মৃত্যুর সংবাদ মেলে। তবে এও ঠিক, নানা অন্তরায়ের কারণে অনেক সংবাদই খাতা পর্যন্ত পৌঁছে না। ফলে, মহামারীর প্রকৃত হিশেব পাওয়াটা সবসময়ই দুরূহ। বিশ্বব্যাপী করোনার এখন অব্দি যে দাপট, তাতে সহসা এর থেকে মুক্তি মিলবে ব'লে মনে হয় না! তারপরও মহামারী সচেতনতাই উদ্ধারের একমাত্র পথ। অতি ঘন বসতিপূর্ণ দেশে যেখানে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছলতাই একটি বড়ো রোগ, সেখানে মহামারী কোভিড-১৯ কে আর কতোটা ভয় পাওয়া যায়? ভয় পাই না, আর এ-ও বিশ্বাস ক'রতে চাই, আমাদের মনোবল, সদিচ্ছা এবং সম্পর্কের দৃঢ়তা দিয়েই আমরা করোনা জয় ক'রবো।
'আমি ভয় করব না ভয় করব না…'
বেলা থামিয়ে জিজ্ঞেস ক'রতে ইচ্ছে হ'চ্ছে : ও সূর্য, আজ তোমার না গেলেই কি নয়?

২৭.০৬.২০২০
শনিবার

নিত্য প্রত্যুষে চেতনানাশকারী যে শব্দটিকে বিসর্জন দিয়ে গাত্রোত্থান করার ইচ্ছে পোষণ করি–তা 'ভয়'! কীসের ভয়? মৃত্যু? উত্তর জানা কিংবা না জানা আজ আর কোনো বিষয় নয়, সময়ের সঙ্গে ঘটনার সম্পর্কই বিবেচ্য। করোনা-ভয়-মৃত্যু সারিবদ্ধভাবে যেন সময়-বিষয়ের দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের লক্ষ্য ক'রছি, দূরে থাকতে চাচ্ছি, কিন্ত পেরে উঠছি না।
"বিশ শতকের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ যেমন যৌক্তিক প্রতক্ষবাদ, মার্কসবাদ, নির্ধারণবাদ, ভাষা-দর্শন ও বিশ্লেষণী-দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করে এদের কয়েকটির ওপর মরণাঘাত হেনে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন কার্ল পপার (১৯০২-১৯৯৪)। তিনি বিজ্ঞানের তো বটেই একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্বের মহান দার্শনিক। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মজীবনী হলো অন্তহীন অন্বেষণ নামক এই গ্রন্থ। কীসের অন্বেষণ? জ্ঞানের? সত্যের? নাকি সমস্যা সমাধানের? আর তা অন্তহীনই-বা কেন? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন পপার এই গ্রন্থে। …বিষয়বস্তু বিচার করে বলা যায়, গ্রন্থটি কেবল পপারের আত্মজীবনী নয়, বিশ শতকের পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের দলিলও।"


উদ্ধৃত অংশটি কার্ল পপার রচিত আনএন্ডেড কোয়েস্ট গ্রন্থের আমিনুল ইসলাম ভুইয়া কৃত বঙ্গানুবাদ 'অন্তহীন অন্বেষণ'-এর মলাট থেকে নেয়া হ'য়েছে। এতে ক'রে আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি সম্পর্কে পাঠ-পূর্ব একটি ধারণা যেমন জন্মে, তেমনি দার্শনিক কার্ল পপার আমাদের মানসপটে তাঁর জীবন-উন্মোচনের সুযোগটি ক'রে দেন। শুরু 'সর্বজ্ঞতা ও ভ্রমপ্রবণতা' দিয়ে, আর সহজেই অনুমেয় দর্শনে সর্বজ্ঞতা ব'লে কিছু থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। অপরপক্ষে, ভ্রমপ্রবণতা মনুষ্য-চরিত্রের একটি সহজাত দিক।
কার্ল পপারের জন্ম ভিয়েনায়, ধর্মান্তরিত এক খ্রিষ্টান পরিবারে। বাবা ও মা দু'জনই ইহুদি থেকে খ্রিষ্টান হ'লেও তাঁর জীবনাদর্শে ইহুদি ধর্ম এবং সমাজ-আচারের উপস্থিতি ছিলো লক্ষ্য করার মতো। আর, তাই তো পপারের জীবন-সায়াহ্নে রচিত একটি প্রবন্ধের শিরোনাম 'সকল জীবনের সাধনাই হলো সমস্যার সমাধান'। বাল্যকাল হ'লে এককথা, কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এসে যদি কেউ বলে : 'আমি সবকিছুই জানি', তবে আর বাকি কি থাকলো? পপারের বয়স যখন বিশ, তখন অভিজ্ঞ এক কাঠমিস্ত্রির শিক্ষানবিশি করার কালে ওস্তাদের মুখ থেকে এমনই শোনা।
কোভিড-১৯ এর আক্রমণ থেকে কবে রেহাই মিলবে, তা যেমন আজ এক বড়ো প্রশ্ন; তেমনি আরেক জিজ্ঞাস্য, করোনার প্রতিষেধক কবে নাগাদ আবিষ্কৃত হবে? প্রশ্ন আছে, কিন্তু উত্তর নেই ক'রতে-ক'রতে পৃথিবীর পাঁচ লক্ষ মানুষ এর মধ্যে সাবাড় হ'য়ে গেছে। আরো কতো যে যাবে তার হিশেব কে জানে?
ভাবনা আর বেদনার মধ্যে একেকটি দিন পার করার পাশাপাশি নতুন যে সুতোটি টান মারছে, তা হ'লো-আরোপিত বিচ্ছিন্নতার এই সাময়িক প্রভাব কি মানুষের অন্তরমহলে ঝাঁকি দেবে?