মহামারী অনাহার কোন কলমে লিখি

অমর মিত্র
Published : 26 May 2020, 04:13 PM
Updated : 26 May 2020, 04:13 PM

১লা এপ্রিলের খবর যা যা এসেছিল।

পেন্সিলিয়া খবরিয়া বলল, ঐ দিন দুপুর থেকে গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয় ছড়াল। ইতালি, আমেরিকা ব্রিটেন গোষ্ঠী সংক্রমণে বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে। খাদের কাছে বলা যায়। আমাদের দেশে এতদিন অবধি যে খবর পাচ্ছি সবই বিদেশ প্রত্যাগত দ্বারা সংক্রামিত। কিংবা ভ্রমণ সংক্রান্ত। কিন্তু এ কী খবর। দিল্লির নিজামুদ্দিনে ১৩ই মার্চ থেকে ১৫-ই মার্চ অবধি ধর্মীয় সংগঠন তবলিগের এক বড় জমায়েত হয়। দিল্লি পুলিশ তা করতে দিয়েছিল। কিন্তু মহারাষ্ট্র তার অনুমোদন দেয়নি। দিল্লি পুলিশের ভূমিকা অবাক করেছে। ভয় বাড়ছিল তিরুপতির মন্দির থেকে পাড়ার শেতলা মার মন্দিরের জমায়েতে। মানুষ কত নির্ভয়।

পশ্চিমবঙ্গ থেকেও ৭০-৭৫ জন গিয়েছিল নিজামুদ্দিনের ধর্ম সভায়। ভয়ের খবর, সেখানে চিন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব থেকে ধর্মগুরুরা এসেছিলেন। তাদের দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে কি হয়নি তা আন্দাজ না করতে পেরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে চিহ্নিত মানুষকে গৃহপর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলা হয়েছে। কোয়ারান্টিনের একটি বাংলা প্রতিশব্দ আমাদের স্বরাষ্ট্র সচিব ১৪ দিন পর ফিরে এসে দিয়েছেন। চমৎকার। এই রকম আর এক ধর্ম সমাবেশের কথা ২৯ তারিখে মুরারী সিংহর কাছে শুনেছি। পঞ্জাবের বাঙ্গা জেলায় ১৫টি গ্রামকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সেই শিখ ধর্মগুরু মারা গেছেন। নিজামুদ্দিনে সমাবেশে অংশগ্রহণ করা মানুষ সারা ভারতে ছড়িয়ে গেছেন। এইসব মানুষকে আমি কিছুটা চিনি। হতদরিদ্র। ধর্ম ব্যতীত কিছুই জানেন না। সরকারও ভয় পেয়েছে। ফেসবুক হিন্দু মুসলমান হয়ে গেল সত্যি। তার ভিতরে অতি সক্রিয় হয়ে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক কথা বলতে লাগলেন। সুর ভালো না।

শুভেন্দু দেবনাথ লিখেছিল,
ডোনাল্ড ট্র্যাম্প ভারতে আসার প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে সতর্কবার্তা এসেছিল করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত, যা নিয়ে কার্যত গা ছাড়া মনোভাব দেখিয়ে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতে এই মহামারী ছড়িয়ে যাওয়ার আগে ভারতের কাছে প্রায় দু সপ্তাহের বেশি সময় ছিল, আমরা আটকাতে পারতাম। শুধু মাত্র সরকার খানিক সচেতনতা অবলম্বন করলে। কিন্তু না আমরা তা করিনি। তার বদলে গা এলিয়েছি, আর বলেছি আরে ওই তো ইতালিতে মরেছে, আরে ওই তো চায়নারা অখাদ্য কুখাদ্য খায়। আসলে আমরা ভারতীয়রা ভেবেছিলাম যেমনভাবে বিভিন্ন ঘুর্নিঝড় ভারতের গাঁ ঘেষে বাংলাদেশ বা অন্যান্য দেশে আছড়ে পড়ে আর ভারত বেঁচে যায়, এবারও তাই যাবে। …
এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে অতি ভীত, মৃত্যু ভয়ে ভীত, বাঁচব কী করে, লকডাউনের ফলে আগামী মাসের মাইনে ঢুকবে কিনা পরের মাসের মুদি কিনতে পারব কিনা এই ভয়ে ভীত আমি ভারতের এক সাধারণ নাগরিক।

মার্কোর কথা— **

মার্কো পোলো বলল, সমস্যা ক্রমশ বাড়ছিল। মানুষ দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। কদিন ধরে পারস্পরিক দোষারোপ চলছিল। পৃথিবী কতটা দূষিত হয়ে গেছে তা দেখা যাচ্ছিল। মাটি জল দূষিত হলে, মানুষ কি বাদ থাকে জয়িত্রী?

জয়িত্রী আজ লং স্কারট পরেছে, তার ভিতরে কত রঙ। মার্কোর মনে হলো জয়িত্রী এক সাত রঙের পাখি। মার্কো এমনি এক কন্যাকে দেখেছিল, সে দিন রাত ছুটে বেড়াত, কবিতা লিখত, গান গাইত। সেই মেয়ের সঙ্গে কলকাতার এক কাফেতে আলাপ। কেউ চেনেনি, সে চিনেছিল। সে এসে বলেছিল, স্যার আপনিই মার্কো পোলো ?

মার্কো অবাক। তার ছিল জিন্স আর ফুল হাতা শার্ট। লাল কালোয় চেক। শ্যাম বর্ণ। মুখখানি পান পাতা। চোখের মণি ঈষৎ বাদামি। যেমন এই জয়িত্রীর। মার্কো জিজ্ঞেস করেছিল, সে কে ?
তার নাম ইসাডোরা। ইয়েস ইসাডোরা ডানকানের নামে তার নাম। নৃত্যশিল্পী। আমি তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম জয়িত্রী। সেই কবে শুনেছি। কোন যৌবন কালে। তখন ছিল কৌতুহল বেশি। সব কিছু আমার করে নিতে হবে। কত কিছু জানতে হবে। দস্তয়েভস্কি পড়তে হবে, তলস্তয় পড়তে হবে, বেটোভেন শুনতে হবে, সোয়ান লেক দেখতে হবে, দেখতে হবে ব্যাটলশিপ পটেমকিন, জানতে হবে কে ইসাডোরা ডানকান।
জয়িত্রী বলল, আমি জানি আমি জানি, আমার একটা নাম ইসাডোরা, আমার মা বলত।
তারপর ?
মা চেয়েছিল আমি নৃত্যশিল্পী হই।
তারপর?
আমি অপেরায় জয়েন করি।
তারপর ?
জয়িত্রী বলল, একটা অপেরা আছে, অদ্ভুত সুন্দর তার কাহিনি, আমরা সকলে দেখেছিলাম, আমার দাদা, আমি, মা, বাবা, তাতে একটা গ্রামের মেয়ে ছিল, সে ঘুমের ঘোরে এক পুরুষকে দেখল, পুরুষকে তার পছন্দ হয়ে গেল, সে বলল, ঐ যুবককে ছাড়া সে কাউকে বিয়ে করবে না।
মার্কো বলল, ওদিকে স্তেপের শেষে আর এক গ্রামে একটি যুবক ছিল, ভেড়া চরিয়ে বেড়াত, সেও এক স্বপ্ন দেখল, একটি সুন্দরী কন্যা তার জন্য ভাবছে বসে এক ঝর্নার ধারে বসে।
জয়িত্রী বলল, ঠিক তাই, মা বলল, তুই অপেরায় অভিনয় করবিরে ইসাডোরা।
কে ইসাডোরা মা ?
মা বলল, ইসাডোরা জন্মেছিল সানফ্রান্সিস্কোতে…
ইসাডোরা ডানকানের কথা বলতে লাগল মা।
তোমার মা কোথায় বাবা কোথায় জয়িত্রী ?
মা নেই। মা চলে যেতে আমার ইসাডোরা নামটিও হারিয়ে গেল, মার ইচ্ছে ছিল অপেরায় অভিনয় করবে, ইচ্ছে পূরণ হয়নি, আমাকে বলেছিল অপেরায় যেতে, বাবার মত ছিল না, আমি ভাবতাম বাবার মতো জারনালিস্ট হবো।
বাবা কোথায় ?
জয়িত্রী বলল, বাবার নতুন সংসার হয়েছিল, বাবা চেয়েছিল আমি সাংবাদিক হই, থাক মার্কো, তুমি যে কথা বলছিলে, বল।
মার্কো বলল, তার নাম ইসাডোরা ইসলাম, সে বলল, খবর পেয়েছে মার্কো ঘুরছে শহরে।
জানল কী করে ? জয়িত্রী জিজ্ঞেস করে।
সে বলল, সাংবাদিকের খবরের সূত্র সাংবাদিক বলবে না, সে জানত দুপুরে আমি সেই কাফেতে যাব, কাফের নাম অবাক জলপান।
এমন সুন্দর নাম।
মার্কো বলল, কলকাতায় এমনি হয়, একদল কবিতা লেখে, আর একদল কবিতার বই ছিঁড়ে দেয়, একদল গান গায়, আর একদল গানের মাইক্রোফোন খুলে দেয়, একদল প্রতিবাদী মিছিল করে, অন্যদল মিছিলে লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবাক জলপানে কবিরা আসে শুনে আমি গিয়েছিলাম।
কেন সেই কফি হাউস ?
সে তো আছে, একদল সেখানে যায় না, যার যেমন পছন্দ, তো ইসাডোরা ইসলাম আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল, একটা সাক্ষাৎকার নেবে তাই।
তারপর ?
তখন কোভিড-১৯ ঢুকে পড়েছে শহরে, শহর ফাঁকা হতে শুরু করেছে, তিমির, সেলিম, অচিন্ত্যরা যে যার বাড়ির পথে যাত্রা করেছে, কী হতে যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না, আমাকে সে জিজ্ঞেস করল আমি কি ভেনিস থেকে আসছি? ভেনিসের কী অবস্থা, ভেনিস থেকে আসিনি বরং আমি ভেনিসে ফিরে যাব শুনে ইসাডোরা বিষণ্ণ হলো।

ইসাডোরাঃ ভেনিস খুব বিপদে আছে মার্কো, সব ঠিক হোক, যেও।
মার্কোঃ সকলে নিজ গাঁও-এ ফিরছে, আমিও ফিরব।
মার্কো, তোমাকে কি কেউ চলে যেতে বলেছে ?
মার্কোঃ না কিন্তু মনে হয়, পৃথিবীর পথে রওনা হওয়ার এইই শ্রেষ্ঠ সময়।
মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে, তুমি ঘরের বাইরে চলে যাবে ?
মার্কোঃ ঘর কোথায় আমার, সে তো বহু বর্ষ আগে ভেনিসে ছিল শুনেছি, তাই ভেনিসের পথে হাঁটব।

জয়িত্রী বলল, ইসাডোরা ঠিক প্রশ্ন করতে পারেনি তোমাকে।
মার্কোঃ ঠিকই প্রশ্ন করেছিল, আমি ঠিকই জবাব দিয়েছিলাম, সকলেই ঘরের পথে হেঁটেছে, আমিও, ভারতবর্ষ হাঁটতে আরম্ভ করল দুদিন বাদে, তুমি ভাবতেই পারবে না, মহাসড়কগুলি কেঁপে উঠছে ভয়ার্ত মানুষের পদশব্দে। গোটা দেশ বন্ধ হয়ে গেছে, রেল বন্ধ, বাস বন্ধ, মানুষের কাজ বন্ধ, তারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গেছিল কাজ করতে, কাজ গেছে, ভাত নেই পেটে, অনাহার শুরু হয়ে গেছে, আমি তাদের সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করলাম জয়িত্রী, ইসাডোরা আমার কাছে ভেনিসের খবর না পেয়ে বলল, সে আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি করবে…।

করেছিল কিনা জানি না, আমি পরদিন হাঁটতে শুরু করলাম, সেই যে শুরু তারপর আর তা শেষই হচ্ছে না, কত শত মাইল পথ হেঁটে তারা নিজ গাঁয়ে পৌঁছবে, কাজ নেই ভিন দেশে, অনাহার আর অনাহার, মরলে গাঁও এ ফিরে মরবে…।
তখন জয়িত্রী বলল, থাক মার্কো, অন্য কথা বল।

মার্কো বলল, হ্যাঁ, অন্য কথা বলি, মানুষের মহাযাত্রার কথা আমি পরে শুনাব তোমাকে। বরং এমদাদ রহমানের কথা বলি তোমাকে,

খবরিয়া পেন্সিলিয়া বলছে:

ফরাসী দেশ থেকে তখন লেখক, অনুবাদক এমদাদ রহমানের সাড়া পাওয়া গেল। কদিন ধরে এমদাদের দেখা নেই। সে দিনদশ আগে লিখেছিল আকাশ খুব নীল, ঘুরেছে নানা মলে, রুটি দুধ সব ফুরিয়ে গেছে। এমদাদ সিলেটের যুবক। লন্ডনে থাকত। এখন ফরাসী দেশে, পরবাসী। এমদাদের লেখাটি দমবন্ধ ভাবটি কাটিয়ে দিল। কত আর সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ দেখে যাব। কত আর এসব পড়ে রক্তচাপ বাড়ানো যায় ? সরকার পারছে না, সরকার পারছে, হিন্দু, মুসলমান, মেঘনাদ বধ কাব্য কিসে খারাপ, গরিব মানুষ, কেড়ে খায় না কেন ( গল্পটি, ছিনিয়ে খায়নি কেন ), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে উল্লেখ করা হয় গল্পের ভুল নাম লিখে। ফেসবুক কখনো কখনো অসাধারণ ( ! )

আলব্যের কামু লিখেছিলেন প্লেগ আক্রান্ত, অবরুদ্ধ শহর ওরান-এর কথা। প্লেগ প্রসঙ্গে তরুণ বন্ধু রাজসিক বলছিল, একটি ছবির কথা, 'মন্টি পাইথন অ্যান্ড দ্য হোলি গ্রেল'–১৯৭৫-এর ছবি। সেই ছবি আরম্ভ হয় ৯৩২ সালে ইংল্যান্ডের এক কাউন্টিতে। কাউন্ট তাঁর অনুচরকে নিয়ে পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। হয়ত তাঁর ভেট সংগ্রহে। প্রজার দেওয়া কলামুলোতেই তো রাজা-জমিদার জীবিকা নির্বাহ করেন। শীতকাল। প্লেগ মহামারি হয়ে ছড়িয়েছে সমস্ত অঞ্চলে। মানুষ মরছে। এক ঘিঞ্জি বসতিতে একটি প্লেগ কার্ট এল। তা টানছে একজন। অন্যজন ঘন্টা বাজিয়ে দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে হাঁক দিচ্ছে, 'ব্রিং আউট ইওর ডেড'। প্লেগ কার্টই বুঝি মৃত্যুদূত। তার ঘন্টা শুনে যারা, যেসব দুস্থ বৃদ্ধরা পথের ধারে বসে ছিল, সকলে লুকিয়ে পড়তে চাইল। এক বৃদ্ধ আতঙ্কে তার মাথা ঢুকিয়ে দিল চ্যাঙারির ভিতর। প্লেগ কার্ট তাকে নিতেই এসেছে যেন। গাড়িটি বুঝি আবর্জনা সংগ্রহে এসেছে এমন। প্লেগ কার্ট ডাঁই হয়ে আছে মৃতদেহে। একের পিঠে অন্য। হ্যাঁ, শীতের সেই অনুচ্চ আলোর ভিতরে মুমূর্ষু মানুষ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল একজন। লোকটি কাঁদছে। তার মৃত্যু হয়নি তখনো। যে মানুষটি প্লেগ কার্ট পরিচালনা করছিল ঘন্টা, হাতুড়ি হাতে, সে তার হাতুড়ি মারল লোকটির মাথায়। মরে গেল। গাড়িতে থাকে ফেলে দিল তার বাহক। ইওরোপ কত মহামারি পার করেছে। আমরাও পার করেছি। তা সেভাবে ডকুমেন্টেড নেই। এসব ভাবছিলাম। মহামারিতে এমন হয়। মৃতদেহ ছুঁয়ে দেখবে না কেউ। ভোরে কত রকম ভাবি যে। ভাবতে ভাবতে অথৈ বিষাদ সিন্ধুতে ভেসে যাই। তখন ফেসবুকে ভেসে এল এমদাদ রহমান। বেশ ক'দিন বাদে ও লিখেছে কিছু।

" এসব কি রূপকথা! না কি মিথ! হঠাৎ এমন স্তব্ধতা, এমন নৈঃশব্দ্য… বাম হাতে গ্যালাক্সি ট্যাবটা ধরে ডান হাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। আঙুলগুলো নিজে থেকেই নড়ে… খপ করে ধরে ফেলে পাশে রাখা স্যানিটাইজারের শিশি। তেমনি জীবনও কেমন ক্ষয়াটে ক্ষ্যাপার মতো দেখিয়ে দেয় ভাঙা শিশিবোতলের বিনিময়ে ন্যাংটোবেলার ঘি-চমচম! রিনরিনে বেল বাজে ছেলেবেলার লাল সাইকেলে।
এ জীবনে বাবাও যেন পাখির গলার গানের মতোই এক মিথ। একদিন হঠাৎ, তিনিও স্তব্ধ হয়ে যান। মৃত্যু কেবল দৃশ্য গড়ে, আবার ভেঙে ফেলতে থাকে। জীবনের মতো দীর্ঘতম সড়ক ধরে রাতভর সাইরেন বাজাতে বাজাতে বাবাকে নিয়ে গ্রামে ফিরি। আমাদের মনের গভীরে সেইদিন থেকেই নৈঃশব্দ্য ব্যাপারটি স্থায়ী হয়ে যায়।
সেই সঙ্গে বিষন্নতা।
মা কে নিয়ে তারপর কতবার চাতলাঘাটে গেছি। নৌকোয় পাড়ি দিয়েছি যে-নদী, তার নাম মনু। মায়ের গায়ে পেয়েছি গোলাপ ফুলের গন্ধ। গন্ধের শূন্যতা বারবার বলে- বাবা কোথায়?
বুঝতে পারি পৃথিবীও বদলে গেছে।
মার্চের শেষ দিন আজ। গত ১৫ দিন চার দেয়ালে আটকে আছি, সকলের বেদনাকে ধারণ করে স্তব্ধ। চার দেয়ালের ভেতর তুলোর মতো উড়ছি।
জানলা গলে রোদ ঢুকছে।
আরও ১৫ দিন এভাবে থাকতে হবে। এরপর হয়তো মে, জুন…চলে যাবে।
পৃথিবী- বড় বেশি ক্লান্ত হয়েছিলে…
ঘরের ভেতর উড়তে উড়তে মনে পড়ছিল হুইটম্যানকে। মধ্যরাতে পাখির উড়ে চলা দেখছিলেন কবি। ভাবছিলেন দূরবর্তী শব্দরা কেমন করে ভেঙে দেয় স্তব্ধতা।
ভারগাস ইয়োসা চুপি চুপি বলছিলেন- প্রত্যেক যুগের নিজস্ব আতংক আছে।
বোর্হেস বলছিলেন- পত্রিকা আমি কখনোই পড়িনি, তার একমাত্র কারণ আজকাল কী ঘটছে তার চেয়ে বরং বহুদিন আগে কী ঘটেছিল- আমার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল সেইসব ঘটনাবলীর প্রতি। এক ধরনের মানসিক বিকার। মনে আছে- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, আমি ছিলাম জেনেভায়। সেখানে আমি পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের উপর লেখা বইপত্র পড়ছিলাম। সেই সময় প্রায়ই ভাবতাম, একেবারেই সাদামাটা ছিল ভাবনাটা, আর, হ্যাঁ, বয়সও তখন চৌদ্দ কি পনেরো- আমি ভাবতাম- আরে কী অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই যেন হঠাৎ করেই সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, ভাল কথা, কিন্তু, কী অদ্ভুত, সাম্প্রতিক ডামাডোলের ভিতর কেউই আগ্রহী নয় কার্থেজের যুদ্ধের ব্যাপারে, কিংবা কেউ আগ্রহী নয় পারসিক ও গ্রিকদের মধ্যকার যুদ্ধে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে জানতে, কিন্তু, সবাই আগ্রহী হয়ে পড়েছেন- সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে…

সারামাগোর অন্ধত্ব উপন্যাসের শুরুতেই The Book of Exhortations থেকে এক আশ্চর্য কীর্ণলিপি পাই-
If you can see, look.
If you can look, observe.

পুরো উপন্যাসের মূল কথাটাই যেন দুই লাইনে ব্যক্ত। সারামাগো প্যারিস রিভিউকে বলছেন- অন্ধত্ব এখানে মেটাফর। মেটাফর, কেননা এ অন্ধত্ব মানুষের দ্বারা ছড়িয়ে পড়েছে। এই অন্ধত্বই মঙ্গলে পাথর পরীক্ষার জন্য মহাকাশযান পাঠাবার ব্যবস্থা করছে, একই সময়ে আমাদের গ্রহে অযুত নিযুদ সংখ্যক মানুষ খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত। আমরা হয় অন্ধ নয় তো উন্মাদ।
if you can look, observe!
হাইনরিখ ব্যোল যেমন দেখেছেন
লিখতে গিয়ে হঠাৎ আটকে যাওয়া কিংবা লিখতে না পারা — ব্যাপারজাত আমার দ্বিতীয় সত্ত্বা । এর কারণটা কিন্তু বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেন হবে । আমি এমন একটা দেশে বাস করছি, যে-দেশটির ভাণ্ডারে রক্ষিত আছে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি আণবিক মারণাস্ত্র, আরও নতুন নতুন আণবিক অস্ত্র দেশটির ভাণ্ডারে যুক্ত হচ্ছে। ভয়ানক এই ব্যাপারগুলাে আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেবে, আপনার জীবন যাপনের আনন্দকে ধ্বংস করে দেবে। যে-লেখায় ক্ষোভ কিংবা ক্রোধ থাকে, যে-লেখায় কোনাে একটা বিশেষ মানে তৈরি হয়, সে লেখাকেও বন্ধ করে দেবে। লেখককে থামিয়ে দেবে। কোনাে সময় সংগীত, বিশেষ করে ধ্রুপদি সংগীতই একমাত্র আটকে যাওয়ার হাত থেকে আমাকে বাঁচাত; বেটোভেনের ব্রেদ, যা শুনলেই আমার ভেতর পশ্চিম-ইউরোপ আর রাইনের মতো অদ্ভুত সব জায়গার কথা মনে পড়ত।
জেগে উঠত আশ্চর্য জীবনবোধ।

মার্চের শেষ দিনটি চলে যাচ্ছে। ঝকঝকে আকাশ থেকে হাসছেন দিনমণি, তার উজ্জ্বলাভা ঢুকে পড়ছে ঘরে। পৃথিবীরে, কবির মতো, মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ বলে মনে হচ্ছে।
এমদাদ রহমান প্যারিস, ফ্রান্স, ৩১.০৩.২০"

এমদাদ পড়ার পর এক মৃত্যু সংবাদ পেলাম, না, করোনায় মৃত্যু নয়। নভশ্চর আলেক্সেই লিওনভ প্রথম মহাকাশে হেঁটেছিলেন ১৯৬৫ সালের ১৮-ই মার্চ। মস্কোতে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। সম্প্রতি নিজেদের ওয়েবসাইটে নভশ্চর লিওনভের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস। লিওনভ ১২ মিনিট মহাকাশে হেঁটেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশযান ভস্তক-২ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল মহাকাশে। পড়লাম তাঁর অপূর্ব অনুভূতির বিবরণ। শূন্যে হেঁটে চলেছেন শিশুর মতো। পড়ে যাচ্ছেন না। তাঁকে ঘিরে আছে নক্ষত্রদল।

০১.০৪.২০

আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত ৩৭, মৃত্যু ০৩। সারা ভারতে আক্রান্ত ১৭৫০, মৃত্যু

এরই ভিতরে একেবারে আড়ালে থাকা পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় মানুষ মানুষের কাছে চাল ডাল আটা পৌঁছে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পুরুলিয়ার গ্রাম জানকিবেড়া,চুলাপাণি,হেঁটবেড়া,ভীমজারা,উপর বামনি,হেঁট বামনি,চুনকুড়ি, কমলাবহাল, ঘাঁটিয়ালি, পিঁটিটিরি। ভয়ানক তাপমাত্রা। জলের অভাব। গরিবস্য গরিব মানুষের কাছে খাদ্য নিয়ে যাচ্ছে কবি, লেখকদের একাংশ। জীবন তাঁরা এইভাবে চেনেন। এসব জেনে ভরসা হয় মানুষের প্রতি।

২রা এপ্রিল

এই দিনটি গেছে ভয়ে। সারাদেশ জুড়ে দিল্লির নিজামুদ্দিনের ঘটনা নিয়ে চুলচেরা বিচার চলছে। খড়্গপুর থেকে কজন বিদেশিকে চিহ্নিত করে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। কলকাতার হজ হাউসে ৫৩জন আগেই কোয়ারান্টিনে গেছেন। ফেসবুক কদর্য কথাবার্তায় ভরে উঠছে। কবি সৈয়দ কওসর জামাল কঠিন ভাষায় নিজামুদ্দিন কাণ্ডের নিন্দা করেছেন। তাঁর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন অনেক মুসলমান যুবক, মধ্যবয়সী। যা নিন্দার নিন্দা করতে হবে। সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য লিখছেন দক্ষিণ কোরিয়ায় খ্রিস্টানদের এক জমায়েত সে দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে। তবলীগের জমায়েত মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়ায় কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়েছে। ওই দেশগুলি ইসলামিক দেশ। এইটি হিন্দু মুসলমান ব্যাপার নয়। লড়াই ধর্মান্ধতা এবং শিক্ষার, জ্ঞান বিজ্ঞানের। হ্যাঁ, এইদিন ছিল রাম নবমী। কলকাতার রাম মন্দিরে প্রত্যেকবারের মতো ভক্তের ঢল নেমেছে। মুখে কাপড় দিয়ে ভক্তরা একের উপর অন্যরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। রাম নবমী বাঁকুড়ায় পালিত হয়েছে। মিছিল হয়েছে। এ জাতির কী হবে ? ধর্ম যে আফিম তা এখন বুঝতে পারছি বেশ। এইদিন আমাদের দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এক লাফে অনেকটা বেশি। ৪০০-র উপরে।

আজ এক অভিজাত আবাসন থেকে পরিচারিকাকে তাড়িয়ে দিয়েছে জ্বরজ্বর ভাব থাকায়। তারা হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। মনে পড়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাদা অ্যাম্বুলেন্স গল্পটিকে। তা ছিল পক্সে আক্রান্ত পরিচারকের গল্প। এমনিই বের করে দিয়েছিল ধনী গৃহস্ত। ভাবুন, এই পৃথিবীর এই বিপর্যয়ের কারণ এরাও নিশ্চয়। এত নিষ্ঠুর এত লোভী প্রাণী এরা, কে মরল কে বাঁচল তা দিয়ে এদের কিছু যায় আসে না। মানুষের কাজ মানুষ করেছে, বস্তির লোক পুলিশে খবর দিয়ে পথের পাশ থেকে উদ্ধার করেছে বালিকা পরিচারিকাকে। মানুষের কত রকম আছে। দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন।

২রা এপ্রিল গেছে আতঙ্কে। সন্ধ্যায় দেখলাম অতনু ঘোষ পরিচালিত ছবি 'ময়ূরাক্ষী'। কী বিষাদ এবং বিমর্ষতার ছবি। কিন্তু এক ভয়ানক সত্য। সেই বিমর্ষতা কাটিয়ে উঠবে মানুষ, সেই ইঙ্গিতে ছবি শেষ। এর আগে একটি সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম দেখেছি তাঁর। অ্যাবি সেন। অসম্ভব ভালো। অতীতচারিতা তাঁর প্রিয় বিষয়। যেন ইতিহাস খনন করছেন। লকডাউনের এই সময় পুরোন দিন, হারিয়ে যাওয়া দিন, সময় ফিরে আসে মনে। অতনুর ছবি দেখতে দেখতে তাইই এল। মনে হলো ময়ূরাক্ষী যেন লকডাউনের ছবিই। বিস্মৃতি, একটি জানালা, অসুখী জীবন… লকডাউন থেকে মানুষ মুক্ত হবেই।

কিন্তু এও সত্য হয়ত আগামীকাল পৃথিবীতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। এখন অবধি পৃথিবীতে মৃতের সংখ্যা ৫০,০০০ এর উপর। ভারতে একদিনে ৪০০-র উপরে। আমাদের কি সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে ? ভয় গ্রাস করে নিচ্ছে ক্রমশ। এর ভিতরে পুরুলিয়ায়, কেরালার কোথাও চন্দন কিংবা যদুবাবু আর্তের সেবা করছে। দিন মজুরদের অন্ন সংস্থান করছে। মানুষের সকলে আমাদের মতো ফেসবুকসেবী নয়। উত্তরাখণ্ডের দেব প্রয়াগ জেলার গণেশ ভাট নিজের গাড়িকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে ফেলেছে। এইভাবে দিল্লি, ইন্দোর, তিরুপতি, নাগপুর সর্বত্র কিছু মানুষ এই অদৃশ্য ঘাতককে প্রতিরোধ করতে অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এমন হয়েছে ইন্দোরে কোভিড-১৯ খোঁজ করতে গিয়ে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী পুলিশকে আক্রমণ করছে একদল মানুষ। উন্মাদ এরা। এদের কে বোঝাবে ? না বোঝান গেলে বন্দুকের মুখে শাসন করতে হবে। যে মানুষ বাঁচতে চায়, তাকে মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করার অধিকার নেই কারো। গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়ে গেলে কী হবে ? মানুষ কি জীবনের নিভৃতি ভুলে গেল। একটু একা হলে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান যায় না ? ঘরে থাকা মানে তো নিঃসঙ্গ থাকা নয়।

আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে মাসের পর মাস একা থেকেছি। গ্রামে গঞ্জে। তখন গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, তাদের কথা শুনতে শুনতে হাটে যেতাম, মেলায় যেতাম। আসলে তো একাই। এক বরষার দিনে ধান রোয়া করতে জমিতে নেমেছি। কীভাবে করে বুঝব। সাঁওতাল কামিনদের কী হাসি। পুরুষটি শিখিয়ে দিতে লাগল কী করে গোছ ধরতে হয়, জলে ডোবা ক্ষেতে পরপর গেড়ে দিতে হয় বীজতলা থেকে নিয়ে আসা ধান, ব্যান বলত মনে হয়, ভুলে গেছি। একা জীবন ছিল সতেজ সতেজ, সবুজ সবুজ। তখন যেন সহস্র মাইল দূরে কলকাতা। নতুন লেখা গল্পটির কথাও কাউকে বলা বা পড়ে শোনান যেত না। চিঠি লিখতাম প্রভাত চৌধুরী, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, শচীন, সমীরকে। বাসে উঠে পাশকুড়া বা খড়্গপুর পৌঁছাতে পারলে মনে হত কলকাতা যাচ্ছি। বন্ধু আর মা বাবা ভাই বোনদের পাব। একা আমি থাকতে পারি। একা থাকার অন্য আনন্দ আছে। তখন কিন্তু ফোন, মোবাইল ফোনের কোনো সুযোগ ছিল না। আমার একটি রেডিওও ছিল না। মনে হয় ট্রাঞ্জিস্টার অত প্রচলিত হয়নি ১৯৭৫, ৭৬,৭৭, এই সময়। ইলেক্ট্রিক ছিল না সেই সব গ্রাম গঞ্জে। হেরিকেনের আলো। লম্বা কাচের কেরোসিন ল্যাম্প৷ জনতা স্টোভ। ১৯৮০ তে একটি এইচ এম ভি ফিয়েস্তা রেকর্ড প্লেয়ার কিনতে পারি। ইলেকট্রিক পেলাম প্রথম। রেকর্ড কিনে কিনে নিয়ে যাই। দীঘায় সমুদ্রতীরে থাকি তখন। ওই রেকর্ড প্লেয়ার ছিল সঙ্গী। আর লাইব্রেরির বই। নিজেও কলকাতা থেকে ফেরার সময় বই নিয়ে যেতাম অনেক। এই একা থাকা নিশ্চয় লকডাউন নয়। কিন্তু সেই অভ্যাসে এখন তো খারাপ নেই। বাড়িতে আছি। পড়ছি। লিখছি। সিনেমাও দেখছি। অনেক সুবিধা এখন। এত সুবিধা দিয়েছে সভ্যতা। ঘরে বসে সিনেমা, ভাবাই যেত না। এখন যেন আমার কাছে ৪০/৪৫ বছর আগের পৃথিবী ফিরে আসছে। কারোর সঙ্গে দেখা হয় না। কফিহাউসে যাইনি কতদিন। টেলিফোনে , ভিডিওতে আড্ডা হচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে। কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।

সন্ধ্যায় দেবেশ রায়কে ফোন করলাম। কানে যন্ত্র লাগিয়ে কথা শুনতে পাচ্ছেন। না হলে মেসেজ করে কথা হয়। ৮৫ বছর চলছে দেবেশদার। সদ্য লিখতে এসে তিন লেখকের সংস্পর্শে এসেছিলাম। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায় এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর প্রফুল্ল রায়, অতীন, সুনীল…কতজনকে চিনেছি। দেবেশদার উপন্যাসে রুশ উপন্যাসের ব্যপ্তি থাকে। এখনো পড়েন। মাথা সচল রয়েছে। আমাকে বললেন, অমর আমার ভয় করছে।

কিসের ভয় দেবেশদা, মে-জুনের ভিতরে মিটে যাবে সব।
তুমি বলছ ?
হ্যাঁ আমি বলছি।
তুমি কে বলছ ?
মার্কো পোলো।
দেবেশ রায় বললেন, ভেনিসের মার্কো, ভূ পর্যটক, আরে তুমি কেন এখানে, পৃথিবীর পথে হেঁটে যাও, তিস্তাপারের খবর এনে দেবে আমাকে ?
ইয়েস স্যার, তিস্তা, ভূটান পাহাড়, তিস্তাবুড়ি…সব খবর এনে দেব।

মার্কো আমার খুব সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে, পুরোন ছবি, যা অল্প বয়সে দেখেছি, তা, মারসেল্লো মাস্ত্রোয়ানি এবং সোফিয়া লোরেনের সিনেমা, সান ফ্লাওয়ার, লা দোলচে ভিতা, ফেলিনির ছবি, অ্যানিটা একবারগ ছিল, সোফিয়া লোরেনের সান ফ্লাওয়ার, ভিত্তোরিও ডি সিকার বাই সাইকেল থিভস যদি আর একবার ।

এসব দেবেশ বাবু বললেন, নাকি মার্কো তাঁকে তালিকা করে দিল নিজের দেশের বলে অনেকটা জানা থাকায়। একটা ছবি ছিল, ম্যারেজ ইতালিয়ান স্টাইল, দুজনেই ছিলেন, মাস্ত্রোয়ানি এবং সোফিয়া লোরেন…সোভিয়েত রাশিয়ার তারকোভস্কির ছবি, নস্টালজিয়া, স্যাক্রিফাইস…। মনে মনে দেবেশ রায়ের জন্য সিনেমার তালিকা করে দেতে লাগল মার্কো, তিনি চুপ করে শুনতে লাগলেন। আহা সত্যিই কি দেখতে পাব আবার?

জিজ্ঞেস করলাম, লিখতে পারছেন ?

দেবেশবাবু বললেন, কী আর করব, সেই ইউসুফ জুলেখা লেখাটির শেষ পর্বটি লিখছি।

স্বপ্নের ভিতরে মরুভূমি পেরিয়ে জুলেখার খোঁজে যাওয়া। মার্কো বলল।

হ্যাঁ, তাই বললাম তোমাকে, ২৬শে মার্চ দেওয়ার কথা ছিল, ৪ তারিখে আহমেদাবাদ যাব ঠিক ছিল, আটকে গেলাম।

আহমেদাবাদে পুত্র থাকে। এই ফ্ল্যাটে তিনি একা থাকেন। দুজন পরিচারিকা ছিল। একজন বাড়ি গিয়ে আর আসতে পারেনি। যে আছে সে আমার মা অমর। তাকে বলি, তুই হাসপাতালে না গিয়ে আমাকে পেয়েছিস হা হা হা। ও দুয়েকদিন অন্তর বের হয়। কিনে নিয়ে আসে এটা ওটা। তুমি বেরিও না। একদম বেরবে না। আমি ভাবছিলাম চারতলার উপর সেই ফ্ল্যাটটির কথা। লিফট নেই বল্মীক আবাসনে। ঐ ফ্ল্যাটে এক সময় কত মানুষ। কাকলি বৌদি, দেবেশদার বৌদি, লেখক দীনেশচন্দ্র রায়ের স্ত্রী, তাঁর বৌঠান, পুত্র, ভাইঝি। এখন একা। আছে দেওয়ালজুড়ে বইয়ের তাকে বই। বইয়ের সঙ্গেই যেন কথা বলেন। রুশ লেখকরা বেরিয়ে আসেন। ওভারকোট, হ্যাট, লংকোট পরা গোগোল, পুশকিন, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি …তিনি তাঁদের সঙ্গে গল্প করেন।

আমার জানালার বাইরে জলের রিজার্ভার। সেখানে রৌদ্র। দূরে কয়েকটি কুকুর ডেকেই যাচ্ছে। রিজারভারের উপর একটি বেড়াল ঘুমিয়ে। জানালায় সাফাই কর্মী নির্মল। নির্মলের বাবা এক মাস আগে মারা গেছেন। এখনো মাথা চুলে ভরে ওঠেনি। আমার প্রশ্নে বলল, খাওয়া পাচ্ছে, দুদিন অসুবিধা হয়েছিল। একদিন আগরওয়াল বাড়ি থেকে রুটি তরকারি দিয়েছিল, কিন্তু তাতে বিল্টুদা খুব রাগ করেছে। চোটপাট করেছে বউদির উপর। আচ্ছা দাদা, আমি তো চাইনি, দিয়েছিল বলে নিয়েছিলাম…। শুনে মিতালি বলল, নির্মল প্রতিদিন সকালে তুমি এসে নিয়ে যেও, রুটি তরকারি তোমার জন্য থাকবে। পরের দিন নির্মলকে জানালার সামনে দেখতে পেয়ে ডাকলাম। ও নিয়ে গেল। তারপরের দিন ও আসেনি। অনেক বেলায় আমি জানালার ধারে দেখতে পেয়ে ডেকেছি, ও নির্মল, বউদি ডাকছে…।

নির্মল মিতালিকে বলেছিল, নিতে দরজায় এসেও সে ফিরে গিয়েছিল, লজ্জা করছিল।
মার্কো বলল, জয়িত্রী, একদিন তোমায় নির্মলের কথা বলব।

( **এইটি মহামারীর ধারাবাহিক ডায়েরি। ভূ পর্যটক মার্কো পোলো ভেনিসের পথে সেজান শহরে পৌছেছেন। জয়িত্রী সেই শহরে তার গাইড। সাংবাদিক।)