বৈশ্বিক মহামারী: ভাবনায় দেশ ও বিদেশ

ফাতেমা খান
Published : 22 April 2020, 01:28 PM
Updated : 22 April 2020, 01:28 PM


আমার বাসার পাঁচ মাইলের ভিতরে আট থেকে দশটি হাসপাতাল আছে। বাসাটা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। সারাদিন গাড়ির শব্দ শোনা যায়। তবে এখন শুধু এম্বুলেন্সের শব্দ। আর মাঝে মাঝে আকাশে হেলিকপ্টারের আওয়াজ। এক একটা হেলিকপ্টার মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে শহরবাসীদের নির্দেশনা দেয়। আমি চমকে উঠি। তাড়াহুড়ো করে উঠানে গিয়ে দাড়াই কি বলে শোনার জন্য কিন্তু ততক্ষণে অনেক দূরে যেতে যেতে শব্দ অস্পষ্ট হয়ে যায়। আমি অপেক্ষা করতে থাকি আবার কখন আসবে।

আজকের দিন নিয়ে মাসাধিক কাল কেটে যাচ্ছে মৃত্যুর থাবা থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আছি। মা বলল, তোরা তো যুদ্ধ দেখিস নি এবার দেখবি কিভাবে সবকিছু পালটে যায়। মা'র মুখে ছোটবেলা থেকে যুদ্ধের গল্প শুনে আসছি। মা বলতেন ঢাকা থেকে মাইলের পর মাইল হাজার হাজার মানুষ হেটে চলছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কারো হাত ধরে আছে সন্তানের হাত, কাঁধে বোঁচকা, মাথায় বোঝা, মাথার উপরে জলন্ত সূর্য। আমি ভাবতে থাকি সত্যি কি কোভিড-১৯ পুরো পৃথিবীকে ওলোট-পালোট করে দিবে?
আমার খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজ অভ্যেসমতো উঠে সকালের আকাশ দেখছি। দেখলাম, সাদা লাল রঙের একটা কুৎসিত এম্বুলেন্স আমাদের এপার্টমেন্টের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে সামনের বিল্ডিং এর দিকে। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে ঘরে চলে এলাম। প্রতিদিন নিউজে দেখছি মরার খাটে করে লাশ নিয়ে যাচ্ছে হসপিটাল থেকে বের করে। নিউ ইয়র্কে কান্নার রোল পড়ে গেছে। হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এক একদিনে। এখন এই এম্বুলেন্স আমার এপার্টমেন্টের সামনে। লোকাল সরকার নিউজে প্রতিদিন বলে যাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার অবস্থা অন্যান্য স্টেটের তুলনায় অনেক ভাল। আমি নিজের মনকে আশস্ত করলাম। কত রকমের অসুখ করে মানুষের? হার্ট ফেইলর, কিডনীর সমস্যা। তাছাড়া এদেশে তো কত ভাল ভাল হসপিটাল। সব ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমার দেশে তো এসবের কিছু নেই। না আছে যন্ত্রপাতি, না আছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। কোটি কোটি লোক ছোট্ট একটা দেশে গাদাগাদি করে বেঁচে থাকে। তাদের আলাদা করা এক বিশাল সমস্যা। অথচ এ রোগের এখন কোনো ওষুধ নাই। আলাদা থাকা হল একমাত্র ওষুধ। আট হাজার মাইল দূরে দুরুদুরু বুকে দেশের খবর শুনি। ঠিক যেমন মা যুদ্ধের গল্প বলেছিল: প্রতিদিন মা রেডিও শুনতো কোথায় কোথায় মিলিটারী আক্রমণ হয়েছে, কোথায় মুক্তিবাহিনী হটিয়ে দিয়েছে মলিটারীদের। কান পেতে শুনতে থাকি যদি কোথাও কোনো একটুকরো ভাল খবর পাওয়া যায়।
একদিন খবর পেলাম বাংলাদেশে ইতালী থেকে এক লোক গিয়ে বিয়ে খেয়েছেন। খুব কষ্ট লাগল। কারো কোনো নজর নাই এদিকে? তারপর আবার পরেরদিন এ ধরনের আরো খবর, তারপর আরো। ভয়ে শিউরে উঠলাম। আজ এদেশের নিউজে শুনতে পেলাম বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭৭২ জন। কোথায় পাবে আমার এক টুকরো ছোট্ট দেশ এত ওষুধ-পত্র, মেডিক্যাল সরঞ্জাম? হাজার মাইল দূরে প্রিয় মানুষের মুখ ভেসে আসে ভাবনায়। আমার ছোটবেলা, স্কুল, খেলার মাঠ, সঙ্গী-সাথী সবাইকে মনে পড়তে থাকে। এত বছর যাদের কথা কোনদিন মনে পড়েনি এমনকি অনেককে অনেকদিন দেখিনি পর্যন্ত তাদের মুখগুলিও ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাকে যখন পারি যোগাযোগ করে সাবধান হতে বলি। এদেশের অবস্থার কথা বলি।

প্রিয় জন্মভূমি। বাতাসের সুগন্ধ পাই, সবুক ঘাসের উপর টলটলে জল বয়ে যায়। খড়ের গাদা। মাথার উপরে চিল ত্বারস্বরে চিৎকার করে চলে যায় ঠিক এখানের এম্বুলেন্সের মত। বাংলাদেশের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেল। টালমাটাল পৃথিবী। কে কাকে সাহায্য করবে?
ঘর থেকে বাইরে বের হই না। মনে হয় ঘরের বাইরে ট্রেঞ্চ খুড়েছে সৈন্যরা। যুদ্ধ করছে, গোলাগুলি, হেলমেট, মাইন এইসব দেখতে পাবো বাইরে পা ফেললে। সভ্যতার কি শেষ পরিণতি দেখতে হবে এইবার? মাটির নীচে চাপা পড়ে যাবে সবকিছু? সমুদের পাড়ে বাচ্চারা আর খেলবে না? নরম নরম বালি মাড়িয়ে উঠে আসবে না মেয়েরা সমুদ্রের জলে ভিজে? বালির উপর বসে তরলের মুখ খুলবে না কেউ? সবকিছু কি তবে বিগত কালের অধীনে চলে যাবে?

কে যেন বলছিল পাপে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। তাহলে এখন কি সেই পাপ খন্ডনের জন্য পৃথিবীর হৃদপিন্ড ছিড়ে বের করে ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার লাগিয়ে দেয়া হবে? আর তাই বিষাক্ত তীর ছোড়া হবে নিরীহ মানুষের হৃদপিন্ড লক্ষ্য করে।
লাল পিপড়ার সারির মত লাইন ধরে কনভয় লাশ নিয়ে যায়। এত লাশ কোথায় যায়? বাংলাদেশ তখনও নিরুদ্বেগ। খেলা, ধুলা, গল্প, গসিপ, শাড়ি, গয়না, বাস, ট্রাম, কক্সস বাজার, এয়ারপোর্ট, নিউজ, মিডিয়া, ইব্রাহীম হুজুর, দোয়া, পানিপড়া সব একাকার। ছোট্ট একটা মেয়ে পায়ে পায়ে অন্ধকারের দিকে হেটে চলছে অথচ কেউ থামাবার নেই।
আমার এই লেখাগুলি কেউ পড়বে কেউ পড়বে না। কেউ কেউ বলবে বেশি বেশি জানে, আঁতলামি। তারপরও মনকে দমাতে পারি না। মনে হয় কেউ কেন লাল পতাকা হাতে বাংলাদেশকে শনির সংকেত দিচ্ছে না। কেন বুঝতে চাইছে না শিক্ষিত মানুষগুলিও। একটা মানুষ সচেতন হওয়া মানে একটা পরিবার সচেতন হওয়া। আর তার পাশের মানুষটাও সচেতন হওয়া। লক্ষ লক্ষ পরিবার মিলে একটা দেশ। মসজিদের দেশ আমার দেশ। প্রতিদিন ভাবি, কাল সকালে উঠে দেখব একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু পরেরদিন আবার সেই একই বাস্তবের মুখোমুখি হই।

এপিডেমিকের অর্থ যদি মহামারী হয় তবে পেন্ডেমিকের বাংলা শব্দ কী? বৈশ্বিক মহামারী? নতুন নামের সংযোজন হবে অভিধানে 'চিতাভস্মে মৃত্যু-অভিলাষ'। বিশ-পনর বছর পর বেরিয়ে আসবে মৃত্যু-অভিলাষ কি মানুষের তৈরী ছিল নাকি প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলা ছিল। কোন দেশের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল। কি মেথড অনুসরন করা হয়েছিল। সেই মেথড পড়ানো হবে টেক্সট বইতে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হবে। কত মিলিয়ন শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এ ইতিহাস সৃষ্টি হল তা লেখা থাকবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাতকার থাকবে। ইতিহাস বইতে পড়ানো হবে হিস্টোরি অব কোভিড নাইন্টিন।